বাজারের লিস্টে সবার নিচে সুন্দর করে মোটা দাগে লেখা, “একগুচ্ছ কদম ফুল আনবে আমার জন্য।” আমি লেখাটি দেখে থমকে দাঁড়ালাম।ঝুম বৃষ্টির দিনে পিচঢালা রাস্তায় এক হাতে ছাতা মাথায় নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ লেখাটির দিকে তাকিয়ে রইলাম।নিশির এমন আবদারটা আমার কাছে বেশ অদ্ভুত লাগলো।আমি জানি নিশির কদম ফুল খুব পছন্দ।কিন্তু আমার যে কদম ফুল খুব অপ্রিয়।যে অপ্রিয় মনকে বিষাদ করে তোলে একটি নিষ্পাপ ফুলের প্রতি।যে ফুলের মোহে সবার মন মোহাবিষ্ট হয়ে সাত রঙা রঙধনু আঁকতে চায়,সে ফুলকে দেখলে আমার মনের রঙ বিষাদের অবয় অরণ্যে হারিয়ে যায়।কদম ফুল দেখলে আমার শিউলি আপুর কথা খুব মনে পড়ে।বৃষ্টি ভেজা কদম ফুলগুলোর শুভ্র অনূভুতি আমার মনে অতীতে কিছু হারানোর ধূসর স্মৃতি হয়ে ধরা দেয়।
শিউলি আপুর কাছে আমি ‘কদম আলী’ নামে পরিচিত ছিলাম। আপুর জন্য প্রতি শ্রাবণের বৃষ্টি ভেজা কদম ফুল এনে দেওয়ার জন্য আপু আমাকে এই নামে ডাকত। আমার কাছে এই ডাকটা কেন জানি খুব অদ্ভুতভাবে ভালো লাগতো। আমি অপেক্ষা করতাম প্রতি শ্রাবণ মাসের জন্য।এক গুচ্ছ কদম ফুল হাতে শিউলি আপুর কাছ থেকে ‘কদম আলী’ ডাকটা শোনার জন্য। শিউলি আপু আর আমরা একই বাড়ির ভিন্ন ফ্লাটে থাকতাম। প্রথমে আপুর সাথে আমার সেরকম কোনো সখ্যতা ছিল না। আপুর সাথে আমার পরিচয় এই কদম ফুলের মাধ্যমেই।একদিন আমার হাতে বৃষ্টিতে ভিজে কদম ফুল দেখে শিউলি আপু বললো, “আমি যদি তোমার বড় বোন হয়ে কদম ফুলগুলো চাই,তবে আমাকে দিবা?”
আমি কি জানি ভেবে তার ছোট ভাই হলাম।কষ্টে পেড়ে আনা কদম ফুলগুলো উৎসর্গ করে পেলাম এক মিষ্টি বোনকে। ধীরে ধীরে সখ্যতা বাড়লো।এক অন্যরকম অনুভুতি হলো। শিউলি আপুর কোনো ভাই-বোন ছিল না। আমি তার ভাই সাজলাম।ভাই সেজে আপন মানুষ হলাম।মন খারাপের সাথী হলাম।আপুর মনে আমার জন্য মায়া জন্মে ‘তুই’ ডাক হলো।আমার মন প্রফুল্ল হয়ে আকাশ ছুঁতো।এই প্রফুল্লতায় আমি হাত আর হাঁটুর চামড়া ছিলে কদম ফুল পেড়ে শিউলি আপুর জন্য আনতাম।আপুর মুখখানি হাস্যোজ্জ্বলে পরিণত হতো। আমাকে’কদম আলী’ বলে ডাকতো। আমার মনটা ভরে উঠতো। মনের আকাশের মেঘগুলো রঙিন স্বপ্নের মতো করে উড়ে বেড়াত। শিউলি আপুকে ভাই সেজে বিরক্ত করতাম।নানা বায়না ধরতাম। মাঝে মাঝে আপু বিরক্ত হতো।রাগ করে বলতো,
“তোর মতো ভাই দরকার নেই আমার।জ্বালিয়ে মারলি একদম।আর কথা বলবি না আমার সাথে?”
আমি সেসময় চুপ করে থাকতাম।মাঝে মাঝে অভিমানী হয়ে লুকিয়ে থাকতাম।আপু আমাকে খুঁজতে আমাদের বাসায় আসতো।আমাকে পেয়ে একটা চড় মেরে বলতো, “আমার থেকে বেশি অভিমান তোর?কোথায় ছিলি এই কয়দিন?কদম আলী কি জানে না এই বোন তার উপর বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারে না?” আমি কিছু না বলে চোখের জল ফেলতাম।আপু চোখের জল মুছে বলতো, “কাঁদে না বাবু!তোর জন্য বিরিয়ানি রান্না করে নিয়ে এসেছি।আর রাগ করে থাকিস না কেমন?”
আমার চোখের জল তখন হাসিতে পরিণত হতো।আমি রাক্ষসের মতো বিরিয়ানি খেতাম।আপু তা দেখে খিলখিল করে হাসতো।আমি সেই হাসিটাতে এক ভালোলাগা প্রাপ্তি খুঁজে পেতাম।কি বলা যায় ভাবতাম।কিন্তু কিছু বলতে পারতাম না।আমারও খুব ইচ্ছে ছিল একটি মিষ্টি বড় বোনের।মা বলেছিল ছোটবেলা নাকি আমার এক বোন দুই বছর অবস্থায় থাকতে এক অভিশপ্ত জ্বরে মারা যায়।আমার সেই বোনকে খুঁজে পেতাম শিউলি আপুর ছায়ায় আর শাসনভরা মায়ায়।যার শাসনের সাথে ভালোবাসার মায়ায় আমি মোহাবিষ্ট হয়ে আনমনে আকাশ ছোঁয়ার কল্পনা আঁকতাম। আমি ছোট বেলা থেকেই খুব চুপচাপ শান্ত স্বভাবের ছিলাম। এজন্যই আমার বন্ধুমহলে আমার বন্ধু-বান্ধব খুব কম ছিল।আমি সবার সাথে সহজে মিশতে পারতাম না।মুখে জড়তা থাকায় ভালো করে কথা বলতে পারতাম না।সব সময় চুপচাপ থাকার চেষ্টা করতাম।আর এই নীরবতার চরিত্র আমাকে নিয়ে সবাই হাসি তামাশা করতো। স্কুলে প্রথম দিকের ছাত্র হওয়ায় প্রায় সময় বই নিয়ে থাকতাম।বই এর সাথে আমার খুব ভাব ছিল। কিন্তু আমার ক্লাসমেটরা আমাকে মেয়েলি স্বভাব বলে ক্ষেপাত।সারাদিন বই নিয়ে নাকি মেয়েরা বসে থাকে। এইসব নিয়ে ছেলেরা না শুধু মাঝেমধ্যে অনেক মেয়েও মজা করতো।
মেয়েরা মজা করতো হিংসায় আর ছেলেরা মজা করতো অসহায় ভেবে। আমার মন খারাপগুলো আমাকে অসহায় মনে করাতো।কারণ আমি প্রতিবাদ করতে পারতাম না। আমার দ্বারা এসব হতো না।ছোট বেলা থেকেই আমি ভীতু,লাজুক,নীরব স্বভাবের ছিলাম। আমিও খুব চাইতাম সবার মতো হাসি তামাশায় নিজেকে মেলে ধরতে। আমি কেন জানি পারতাম না।তাহলে এটা কি তাহলে আমার দোষ? চুপচাপ থাকলে , সারাদিন পড়াশোনা করলেই একটা ছেলে কি মেয়েদের মতো হয়ে যায়? আমি এই নিয়ে মাঝে মাঝে শিউলি আপুর কাছে খুব কান্নাকাটি করতাম। শিউলি আপু আমার চুল হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতো, “জবা ফুলের রঙ লাল হলে কি হবে সেটা তো আর গোলাপ ফুল নয়। সুগন্ধি রয়েছে যার মধ্যে সেটাই তার পরিচয়।তারা তোর রঙ দেখেছে সুগন্ধি নয়।কারণ আল্লাহ তাদের গন্ধ শুঁকার ক্ষমতা দেয়নি,তাই তারা এমন করে।সবসময় নিজের মন যেটা বলে সেটা মেনে চলবি কেমন।” আমি চোখের জল মুছতাম।আর উপলব্ধি করে এইসব ভারী কথার মানে বুঝার ব্যর্থ চেষ্টা করতাম।
আমি তারপর থেকে নিজেকে আড়ালে রেখে ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে নিজের মতো করে চলতে শুরু করি।আর এই চলার পথে নিশি অপ্রত্যাশিত ভাবে জড়িয়ে যায়। নিশি আমার সাথে পড়তো।বছর দুয়েক এক ক্লাসে থেকেও কখনো তার সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলতে না চাইলেও নিশি বারবার আমার সাথে নানান কথা বলতে আসতো।অন্যান্য মেয়েরা আমাকে এড়িয়ে চলতো কারণ আমি ক্ষ্যাত ছিলাম।পড়ালেখা ছাড়া কিছুই হতো না আমার দ্বারা। কিন্তু একমাত্র নিশি আমার সাথে কথা বলতে আসতো।ক্লাস সিক্সে নিশিরা আমাদের বাসার পাশে বাড়ি ভাড়া নেয়।এরপর থেকে নিশি আমার সাথে মেলামেশা বাড়িয়ে দেয়।আমি নিশির সামনে কিছু বলতে পারতাম না।গাধার মতো চুপটি করে থাকতাম।নিশি আমার নাক টেনে বলতো, “কি রে বলদা!কথা বলিস না কেন?”
এই বলে নিশি খিলখিল করে হাসতো।আমি নিশির কথায় কিছু বলতে পারতাম না।মাথা নিচু করে পাশ কাটিয়ে যখন চলে যেতাম তখন সে হাতটা ধরে বলতো, “বলদা বলেছি বলে কষ্ট পেয়েছিস?ঠিকাছে এই যে আমি কানে ধরছি।” এরপর নিশি বাচ্চাদের মতো করে তার বাম হাত দিয়ে তার বাম কানটা ছুঁয়ে দিত। আমি সেই সুন্দর দৃশ্য দেখতাম।নিশি কিছু ক্ষণ কান ধরে পরে বলতো, “এখন আমার সাথে মিশবি?আজ থেকে আমি তোর বন্ধু বুঝলি?” আমি কি বলবো ভেবে পাই না।নিশি আমার চুপ করা দেখে নিজেই হাত ধরে ক্লাসে বেঞ্চের উপর বসে একা একা শুধু বকবক করতে শুরু করে।আমি চুপটি করে তার সুন্দর মুখ নাড়ার দৃশ্যগুলো মনের ভেতর এঁকে চলতাম।
নিশির সাথে আমার বন্ধুত্ব ধীরে ধীরে গাঢ় হতে শুরু করে।এক একেলা সাথী হয় সে।মনে স্বপ্ন বাঁধতে শুরু করে।আমি তা অনুধাবন করতে পারতাম না।মাঝে মাঝে নিশি যখন তার কাজলে আঁকা চোখ দুটো দিয়ে আমার চোখে জলছবি সৃষ্টি করতো তখন আমি কেঁপে উঠতাম।নিজের ভেতর অন্যরকম এক আমিকে অনুধাবন করতাম।সে আমি শুধু নিশি নামক এক অগোছালো নিশিকাব্য লিখতে চাইতো। আমি ভয়ে পালিয়ে বেড়াতাম।পালিয়ে শিউলি আপুর কাছে গিয়ে লুকাতাম। কিন্তু নিশি সেখানে চলে যেত। শিউলি আপুর সাথে নিশির ভাব জমে উঠলো।এরপর থেকে আমার দায়িত্ব বেড়ে গেল।শিউলি আপুর সাথে সাথে নিশির জন্যেও কদম ফুল এনে দেওয়ার দায়িত্ব।কারণ যখন আমি শিউলি আপুর জন্য কদম ফুল আনতে যেতাম সেসময় নিশি ভ্রু জোড়া কুঁচকে তাকিয়ে বলতো,
“এই শোন,আমার জন্য কদম ফুল না আনলে কিন্তু খবর আছে বলে দিলাম।” আমি ভয় পেতাম।ভয় পেয়ে নিয়ে আসতাম। নিশি কদম ফুলগুলো পেয়ে বাচ্চাদের মতো করে আমাকে বলতো, “আমাকে সেসময় ভয় পেয়েছিলি?” আমি কি বলবো ভেবে পেতাম না।সত্যি কথা বললে লজ্জাজনক একটি বিষয় হবে।নিশি খিলখিল করে হেসে বলতো,
“শোন আমাকে ওতো ভয় পাবি না।একটু একটু পাবি।আর একটু একটু দুষ্টুমি করবি, বুঝলি?”
“আচ্ছা,করবো।”
“গাধা একটা। এভাবে বলছিস যেন আমি তোর ম্যাডাম। ভালো করে কথা বলতে পারিস না?”
“আচ্ছা বলবো।”
“ধ্যাত, পাগল একটা।”
নিশি রাগ করে ঠিকই চলে যেত কিন্তু যাবার সময় ধন্যবাদ টুকু দিতে ভুলতো না।একদিন হঠাৎ করে আমার গালে তার ঠোঁট ছুঁয়ে পালিয়ে যায়।আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না।আমি কিছু বলতে পারতাম না শুধু শ্রাবণে ভেজা কদম ফুলের মতো একটা মিষ্টি মেয়ের মন ভুলানো হাসিতে চুপকথা সাজাতাম।মাঝে মাঝে শিউলি আপু আমাকে বলতো, “কিরে কদম আলী নিশির সাথে তোর কিছু চলে নাকি? আজকাল দেখি তার সাথে বেশি সময় কাটাস?” আমি কিছু বলি না। আমার লজ্জা করতো।একই প্রশ্ন শিউলি আপু নিশিকেও করতো।নিশি আমার মতো একদম লজ্জা পেত না। সোজাসুজি বলতো,
“এই গাধাটার সাথে কখনো কি প্রেম করা যায় বলো?সে প্রেম কি বুঝে?” শিউলি আপু নিশির কথায় হাসে। হাসতে হাসতে বলে,
“কেন?তুই শিখাবি।গাধাকে এখন থেকেই মানুষ করা শুরু করে দে।”
“উহু! আমার বয়েই গেছে।“
নিশি শিউলি আপুর কথায় লজ্জা পেয়ে ওড়না দিয়ে মুখ টিপে হাসতো। আমি বলদের মতো তাদের এই কান্ডকীর্তি দেখে কি বলবো বুঝতে পারতাম না। আমার শিউলি আপুর বিরিয়ানি পছন্দ বলে নিশি নাকি শিউলি আপুর কাছে বিরিয়ানি শেখার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল।নিশির উপর মায়া জন্মে।এরপর থেকে তার বিরিয়ানির পাগল সাজি।নিশিও তৃপ্তি করে দেখে আমার পাগলামি।মাঝে মাঝে হাসতো।আমি চুপ করে খেতাম আর মিষ্টি মেয়েটার হাসি মনের ভেতর আবদ্ধ করতাম। হঠাৎ করে একদিন শুনি শিউলি আপুরা আমাদের ফ্ল্যাট ছেড়ে শহরে চলে যাচ্ছে।আমাদের ফ্ল্যাট শহর থেকে তেমন দূরে নয়। কিন্তু যখন শুনলাম শিউলি আপুরা আমাদের ছেড়ে শহরে পাড়ি জমাচ্ছে তখন বুকটা কেঁপে উঠে।আমি আপুর কাছে ছুটে যাই আর পাগলের মতো কান্না করতে থাকি।শিউলি আপু আমার চুলগুলো সুন্দর করে বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, “আমার কদম আলী ভাইটার কি হয়েছে? কাঁদছে কেন?” আমি কাঁদতে কাঁদতে বলি,
“তোমরা এই বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছো কেন? তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো কি?”
“আরে পাগল।আমি কি শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছি নাকি?শহরেই যাচ্ছি।শহর থেকে আমার কলেজ টাও কাছে।আর তুই চিন্তা করিস না মাঝে মাঝে আমি আসবো তোর কাছে। আমার কদম আলীর কাছে।”
“কেন?শহরে না গেলে হয় না? তুমি চলে গেলে তোমার সাথে আর কথা বলবো না কিন্তু বলে দিলাম।” শিউলি আপু এরপর কিছু বলেনি।আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল। হয়তো কান্না করছিল। আমি কেন জানি মনে হচ্ছিলো শিউলি আপুরা মোটেও সামান্য কারণে চলে যাচ্ছে না।কলেজ শহরের কাছে হলেও শিউলি আপুর কোনো সমস্যা ছিল না।হয়তো বাড়িওয়ালার সেই বদমাইশ ছেলেটার জন্য তারা চলে যাচ্ছে। আমি দেখেছি শিউলি আপু যখন ছাদে যেত বাড়িওয়ালার ছেলে গিয়ে আপুকে ডিস্টার্ব করতো। এজন্যই শিউলি আপু ছাদে যাওয়া বন্ধ করে দেয়।আমি মাঝে মাঝে সবকিছু বুঝেও কিছু করতে পারতাম না।চুপটি করে আড়ালে থাকতাম।আর ঐ বাড়িওয়ালার ছেলের অত্যাচারের জন্য হয়তো চলে যাচ্ছে শিউলি আপুরা।
শিউলি আপু চলে যাওয়ার পর আমার একাকিত্ব সময় কিছুতেই কাটতে চাইতো না।আগে একাকিত্ব অনুভব করলে শিউলি আপুর কাছে গেলেই মন ভালো হয়ে যেত। শিউলি আপু মাঝে মাঝে আমার জন্য তার স্পেশাল বিরিয়ানি নিয়ে আসতো।আমি তা খেতাম আর আপু তা তৃপ্তি করে দেখতো। শিউলি আপু যখন আসতো তখন আপুর সাথে কথা বললে যেতে দিতে ইচ্ছে করতো না।মাঝে মাঝে শিউলি আপুকে থাকতে বলতাম আপু থাকতো না।নানা বাহানায় চলে যেত।আমার কষ্ট হতো।আমি অপেক্ষা করতাম শ্রাবণের।সেই বৃষ্টি ভেজা কদম ফুল নিয়ে আপুর কাছ থেকে আমি আবার কদম আলী ডাকটা শুনবো।আপু আমার নাক টেনে বলবে, “ফুলগুলো খুব সুন্দর রে কদম আলী।”
এরপর শ্রাবণ এলো।একদিন শ্রাবণের এক বর্ষায় আমি কদম কুড়াতে যাই।সেই কদম কুড়ানোর ফলে গাছ থেকে পড়ে গিয়ে পা মচকে যায়।আমি উঠতে পারিনা।বাবা রাগারাগি করে। আমার বাবা খুব বদমেজাজি। সামান্য বিষয় নিয়ে তিনি তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলে। আমি চুপটি করে তা হৃদয়ে লুকায়।শিউলি আপু আমাকে দেখতে আসে।বাবা রেগে যায়। শিউলি আপুর উপর রাগারাগী করে।বাবার ধারণা শিউলি আপুর জন্য আমার এই অবস্থা।শিউলি আপু আমার দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়।আমার খুব ইচ্ছে হয় তার হাতের ছোঁয়া পেতে। শিউলি আপু আসে না।অভিমান ভরা মন নিয়ে ছুটে চলে যায়। আমার কষ্ট হয়।বুকটা কেঁপে উঠে। আমি প্রতিদিন শিউলি আপুর আসার প্রহর গুনি। কিন্তু আপু আসে না।
এর কিছুদিন পর হঠাৎ একরাতে আম্মুর মুখ থেকে যখন শুনলাম শিউলি আপুদের বাসায় আগুন লেগেছে আমার অপেক্ষার প্রহরগুলো মূহুর্তের মধ্যে বিদ্রোহ শুরু করে।আমি আম্মুকে জড়িয়ে ধরে শিউলি আপুর কাছে যেতে বলি।আম্মু আমাকে সান্তনা দেন। আল্লাহকে ডাকতে বলেন। আমি আল্লাহকে ডাকি। প্রাণভরে ডাকি। নিজের জীবনের বিনিময়ে ডাকি। কিন্তু পরেরদিন আমার সকল আশা ভরসা মুহূর্তে ভেঙে যায় যখন শুনি শিউলি আপুদের পরিবারের কেউ বেঁচে নেই।বারো তলা বিল্ডিংয়ের বাড়িতে আটকে পড়ে আগুনে জ্বলসে গেছে।আমি সেদিন কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না।বুকে খুব কষ্ট হচ্ছিল।নিশি আমার কাছে এসে কাঁদতে কাঁদতে বলে, “শিউলি আপু নেই রে আরিফ?” আমি নিশির কথায় বাকরুদ্ধ হয়ে যাই।আম্মুর সাথে ছুটে যাই সেখানে।শুধু আগুনে পোড়া বাড়ি দেখি।আর হারানো মানুষের আর্তনাদ।শহরটা একরাতেই অভিশপ্ত আগুনে পোড়া শহরে পরিণত হয়।আমার বুকটা ফেটে যায়।কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। শিউলি আপুর প্রিয় মুখটাও আর দেখার মতো ছিল না। আমি কান্না করি।আকাশের দিকে তাকিয়ে সৃষ্টিকর্তার নিকট মিথ্যা অভিযোগ করি।
বাজারের ব্যাগটা হাত থেকে নিয়ে নিশি কিছু না বলে সোজা রান্নাঘরে চলে গেল। একবার জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলো না তার জন্য কদম ফুল এনেছি কিনা? আমি নিজেই রান্নাঘরে যেয়ে কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বললাম, “দুঃখিত, তোমার জন্য কদম ফুল আনতে পারিনি।” নিশি চুপচাপ রান্না করার দিকে মনোযোগ দিল। আমি আবার তার সামনে গিয়ে বললাম, “কি হলো চুপ করে আছো যে?রাগ হচ্ছে না আমার উপর?” নিশি এবার ফিরে তাকালো।এই ফিরে তাকানোর মাঝে আমি আমার জন্য তার মনে রাগ, অভিমান, অভিযোগ খুঁজছি কিন্তু অদ্ভুত কিছুই পেলাম না।নিশি নির্লিপ্ত ভাবে বললো,
“তোমার উপর রাগ করে থাকব কেন?আমিই সেটা এমনি এমনি লিখেছিলাম।”
“ওহ!”
“তুমি রাগ করেছো?”
“না না। তা কেন? তুমি লিখতেই পারো।”
“দেখো একদম হেঁয়ালি করবে না।আমি জানি আমি ভুল করেছি।তাই ইচ্ছে হলে আমাকে বকবে।আমি তোমার বকা শুনে অভিমান করবো। তুমি আমার অভিমান ভাঙাবে ,বুঝলে ছেলে?” আমি নিশির কথায় কিছু বললাম না।সত্যি আমি নিশির উপর রাগ করতে পারি না।মাঝে মাঝে অভিমান হয়।তবুও আমি কখনো তার উপর কেন যেন রাগ করতে পারি না।এই মিষ্টি হাসিটার অধিকারী মেয়ের উপর রাগ নয় বরং সব সময় ভালোবাসা গুলো আসে।মনের শুভ্র অনূভুতি গুলো সব সময় রঙ তুলির আঁচড়ে ভালোবাসা নামক জলছবি আঁকতে চায়।
শিউলি আপুর চলে যাওয়ার পর আমার একাকিত্ব দূর করার একমাত্র সঙ্গী হয় নিশি।আমার ভালোলাগা,হাসি তামাশা,মন খারাপের মাঝে সঙ্গী হিসেবে আমার পাশে ছিল নিশি।শিউলি আপুর শূণ্যতা কিছুটা হলেও নিশি লাগব করতে পেরেছিল। এরপর এক বসন্ত থেকে অন্য বসন্ত যাওয়ার সাথে সাথে নিশির সাথে আমার মনের ভালোবাসার বসন্ত গুলো দানা বাঁধতে থাকে।নিশিই আমাকে প্রথম তার ভালোলাগার অনুভূতি জানায়।এই অকর্মাকে নিয়ে তার মনের স্বপ্নগুলো আমাকে বলে। আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না।আমি বলি, “আমি ভালোবাসা কি তা জানি না?ভালোবাসা নামে মন আকাশের যে সুখের রঙগুলো খেলে যায় তা আমার কাছে বড্ড ফ্যাকাশে।এই রঙহারা মানুষ কেমন করে একজনকে ভালোবাসবে?” নিশি আমার নাকটা ছুঁয়ে বলে,
“ভালোবাসতে রঙ লাগে না। শুধু লাগে বিশ্বাস, সম্মান,মায়া-মহব্বত আর কিছু নীল মেঘের রঙের মতো শুভ্র অনূভুতি হয়ে তার পাশে থাকা।যে সময়গুলোতে ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে পাড়ি দিতে মন চাইবে দূরদেশে।যে দেশে শুধু তুই আর আমি থাকব, বুঝলি?” আমি না বুঝলেও নিশি একপ্রকার জোর করে তার ভালোবাসার বীজ আমার মনে বপন করে।আমার একলা পথের ক্লান্ত পথিক হিসেবে সে পাশে থাকে।আমার ভেঙে পড়ার দিনগুলিতে সে ভালোবাসাময় সুখ বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে পড়ে।মাঝে মাঝে নিজেকে বড্ড বেমানান লাগতো নিশির কাছে।নিশিকে বলতাম, “আমাকে কেন ভালোবাসো?”
“বাহ্ রে, ভালোবাসতে কারণ লাগে বুঝি? চোখদুটো বন্ধ করলে যার মুখছবি ধরা দেয় , কল্পনায় সুখবৃষ্টির গল্প সাজাতে ইচ্ছে করে তাকে ভালোবাসতে কি কোনো কারণ লাগে?” আমি নিশির কথায় কি বলবো ভেবে পেতাম না। চোখদুটো বন্ধ করে স্বপ্ন আঁকতাম। স্বপ্নের মাঝে নিশি আসতো আমার ফ্যাকাশে অনূভুতিগুলোর সুখের বৃষ্টিবিলাসী হয়ে।আমি তার সাথে বৃষ্টিতে ভিজে তার ভেজা চুলগুলো ছুঁয়ে ভালোবাসা অনুভব করতাম।তখন আমার মনেও স্বপ্ন আসে, সুখের জলে ভাসে, ভালোবাসা জমা হয়।
ধীরে ধীরে আমাদের ভালোবাসার সুখবৃষ্টি খেলাগুলোর রঙ গাঢ় হতে থাকে।আমাদের পড়াশোনা শেষ হয়।নিশির বাসা থেকে বিয়ের চাপ দেয়।সেই চাপ আমাকে চাকরি খোঁজার জন্য মরিয়া করে নিশিকে হারানোর আক্ষেপ জাগিয়ে তুলে।নিশি আমাকে বলে, “এইবার ভালোর থেকে ভালো পাত্রের সন্ধান পেয়েছে।কিছু একটা করো?” আমি মেঘশূণ্য আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলি,
“আর কিছু দিন।” নিশি আমার উত্তরে মনকে সাময়িক সান্ত্বনা ছাড়া কিছুই দিতে পারতো না। নিশি আমার হাত ধরে বলে,
“চলো উড়াল দেই? ভালোবাসা খেয়ে না হয় দুজন বেঁচে থাকব।” আমি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলি,
“নাহ্। আমি উড়াল দিতে পারবো না।” সেদিন নিশি প্রথম আমাকে অন্যদের মতো মেয়ে বলে গালি দিয়ে চলে যায়।আমি চুপটি করে তা হৃদয়ে আড়াল করে রাখি। বাবাকে কিছু বলতে পারি না।বাবা কোনোদিন মেনে নিবে না।বাড়ির পাশে শ্বশুরবাড়ি বাবা মানতে নারাজ।আমার না পাওয়ার আক্ষেপের কষ্টগুলো নিজেকে অসহায় হিসেবে উপলব্ধি করায়।মা আমার কষ্ট বুঝে।হাতে কিছু টাকা দিয়ে বলে,
“যতোদিন দূরে থাকবি, ভালোবাসা নিয়ে বেঁচে থাকিস।”
আমি মা’কে জড়িয়ে ধরে মায়ের মিষ্টি গন্ধ শুকি।সেই গন্ধটা মনে আশার সঞ্চার হয়ে সাহস এনে দেয়।আমি নিশির কাছে ছুটে গিয়ে বলি,
“চল উড়াল দেই?”
নিশি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে তার চোখে জলকণা আনে। আমি তা পরম আদরে মুছে দিয়ে হাতটি ধরে পাড়ি জমায় দূর অজানায়।এরপর থেকে নিশি আর আমার টুনাটুনি সংসার। আমি একটা ছোটখাটো স্কুলে শিক্ষকতা করি।নিশি ঘরে বসে কাপড় সেলাই করে। নিশির দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেতে হয়।এত কষ্টের পরেও নিশির মুখে বিরক্তি ভাব ফুটে উঠে না।আমি খুব করে চাই সে বিরক্ত হোক। মাঝে মাঝে রাগ করে বলুক, “তোমার সাথে সেদিন উড়াল দেওয়াটাই আমার ভুল হয়েছে।” কিন্তু নিশি বলে না।তার ভালোবাসার মায়ায় আমাকে জড়িয়ে রাখে। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি বৃষ্টির ফোঁটা যেন ঢাকঢোল বাজিয়ে তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে।আমি নিশির সেই মায়াময় মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকি।ঘুমন্ত নিশির মুখটি যেন মনে এক রাশ শান্তি নিয়ে আসে।নিশির মাথা কাল রাতে আমার বুকে রেখে যখন বললাম, “আচ্ছা তোমার এভাবে চলতে কষ্ট হয় না?”
“কষ্ট কেন হবে গো?”
“এই যে আমি তোমার জন্য কিছু করতে পারি না। তোমার কতো ইচ্ছা অপূর্ণ রয়ে আছে।” নিশি মিষ্টি হেসে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে, “বিষণ্ণতাতে ডুবেও এক পূর্ণতা চাই, হোক না তা অপূর্ণ,অনলে পড়ুক তবুও তোমার ভালোবাসায় বাঁচতে চাই।” আমি নিশির কথায় কি বলবো ভেবে পাই না।একটা মেয়ের সেই ছোটবেলা থেকেই কতোটা মায়া নিয়ে আমার জন্য স্বপ্নঘর সাজিয়ে আসছে। অপূর্ণতার মাঝেও প্রাপ্তি খুঁজে বেড়াচ্ছে।এক অদ্ভুত মায়ার চাদর দ্বারা জড়িয়ে আছে আমার জীবনের সাথে।আর আমি তার জন্য এই বুকে জায়গা দেওয়া ছাড়া কিছুই করতে পারি না।
হঠাৎ করে আমার কদম ফুলের কথা মনে পড়ে। শ্রাবণ মাসের বৃষ্টিতে ভিজে আনা কদম ফুলের বিনিময়ে নিশির কাছ থেকে অমূল্য হাসিটা দেখার লোভ জাগে।শিউলি আপুর মৃত্যুর পর কদম ফুলের বিনিময়ে নিশির মিষ্টি হাসিটা আর দেখা হয়নি।কাল চাইলো তবুও ব্যর্থ সৈনিকের মতো অসহায় হলাম। বাইরে বৃষ্টি দেখে আমার কি জানি হলো।ছাতা হাতে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। ছাত্র পলাশের বাড়িতে নাকি কদম ফুলের গাছ আছে।আমি বৃষ্টি ভেজা সকালে হেঁটে চলেছি এক গুচ্ছ কদম ফুলের জন্য। স্বপ্নডানা হয়ে এক মিষ্টি মেয়ের মন ভুলানো হাসিটা ছুঁয়ে দিতে।
গল্পের বিষয়:
গল্প