প্রতিবার কোরবানি এলে ছোট বেলার একটা ঘটনা মনে পড়ে। এবার যেহেতু অনেকেই কোরবানি দিতে পারবেনা বলে মন খারাপ, তাই ভাবলাম গল্পটা সবার সাথে শেয়ার করি।
প্রতিবার কোরবানির ঈদে আমাদের বাসায় আসে বড়সড় একটা গরু। প্রতি ঈদেই গরু কেনার বাজেটও বাড়ছে, আর বাড়ছে গরুর সাইজ। কিন্তু আমার পরিবারের আর্থিক অবস্থা সবসময় এমন ছিলো না। আমি যখন খুব ছোট তখন আমার আব্বু কাজ করতেন ইস্টিলের আলমারির দোকানে। আর টাকা যা পেত তা দিয়ে কোনরকম পেট চলে যেতো৷ সুতরাং কোরবানি দেয়া তখন আমাদের পক্ষে ছিল দূরহ ব্যাপার। আর একা একটা গরু কিনাতো কল্পনার বাহিরে ছিলো। ৩-৪ বছর আগে আব্বু যখন ছুটিতে দেশে আসেন ( আব্বু আজ অনেক বছর প্রবাসী, এবং আয়ও আল্লাহর রহমতে অনেক ভালো ) তখন তার কাছে আমার ছোট বেলার একটা গল্প শুনি।
গল্পটা ২০০৩ সালের। আমার তখন ৩ বছর বয়স। আমরা যেই কলনীতে থাকতাম তার পাশেই ছিলো বেশ কয়েকটি উচু দালান। সেখানকার মানুষেরা কোরবানি দিত। আর আমার ছিলো কোরবানির গরু দেখার শখ৷ যেখানেই কোরবানির গরু আনতো আমি সেখানেই ছুটে যেতাম গরু দেখতে। আব্বুকে নাকি অনেকবার বলেছি গরু কিনতে, কিন্তু সামর্থ না থাকায় কেনা সম্ভব হয়নি। আব্বু মন খারাপ করে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেন৷ আর আম্মু আমাকে বকাবকি করতেন। সেই বছরই আমার এক ফুফাতো ভাইয়ের বিয়ে হয়। আমার ফুফুদের টাকার অভাব ছিলো না। সেই ২০০৩ এ তারা ৫০,০০০ টাকা দিয়ে গরু কিনেছিলেন। আবার ফুফাতো ভাইয়ের শ্বশুর বাড়ি থেকেও অনেক বড় গরু দিয়েছিলো তাদের৷ কিন্তু তারা একবার জানায়নি আমাদের সেই ব্যপারে (আমার আব্বু সেই ব্যপারে অন্যের থেকে জানতে পারেন ঈদের পরে)। আমার ফুফুর বাসা আমাদের বাসা থেকে ১০ মিনিটের রাস্তা ছিলো। কিন্তু কেউ একবার এসে আমাকে নিয়ে যায়নি গরু দেখাতে।
দেখতে দেখতে ঈদ চলে এলো। ঈদের নামাজ পড়তে গেলাম আব্বুর সাথে, নামাজ পড়ে অন্যের গরু কোরবানি দেখার কথা। সেটাই তখন আমার আনন্দ। দুই-তিনটা গরু কোরবানি দেখার পরে দেখলাম একটা অনেক বড় গরু (এখনকার বাজারে মিনিমান ২৫০০০০+) কোরবানির জন্য নিয়ে যাচ্ছে৷ সেই গরু দেখে আমি আব্বুর হাত ছেড়েই দৌড় দিলাম সদ্য পাকা করা রাস্তা দিয়ে গরুর পিছু।
আব্বু আমার পেছনে। হঠাৎ কার গায়ের সাথে যেন ধাক্কা লেগে আমি রাস্তায় পড়ে গেলাম৷ রাস্তায় পড়ে আমার থুতনি কেটে গেল, আর আমার প্রথম পাঞ্জাবির পায়জাম ছিড়ে গেল। সাথে আমার হাটুর বেস অনেকটা যায়গা কেটে গেল৷ আব্বুর কিনে দেয়া আমার প্রথম পাঞ্জাবিটা তখন থুতনির রক্তে লাল, আর পায়জামাটা হাটুর রক্তে। আব্বু সাথে সাথে এসে আমাকে ধরলেন। আমি নাকি তবুও সেই গরু জবাই দেখবো বলে কান্না করছিলাম। আব্বু আমাকে দুইটি থাপ্পড় দিলেন। ( গল্পের এই অংশ বলার সময় দেখলাম আব্বুর চোখে পানি টলমল করছে, আর আম্মু নিঃশব্দে কাঁদছেন।) তারপর আব্বু আমার পাঞ্জাবী ওড়না দিয়ে হাটু বেধে দিলেন, আর নিজের রুমাল দিয়ে আনার থুতনি চেপে নাকি প্রায় ২০ মিনিট হেটে ছিলেন। ঈদের দিন হওয়ায় ফর্মেসি খুজে পেতে দেরি হয়।
সেইদিন আমার থুতনি আর হাটু প্রথমবার কাটে। থুতনিতে সেলাই লাগে ৪ টি( যার দাগ এখনও বিদ্যমান)। সেইদিন বাসায় আসার পর আম্মু নাকি আমার অবস্থা দেখে অনেক কান্না করেছিলেন। আর আমি বাসায় এসেই ঘুমিয়ে পরি। বিকেলে আব্বু আমাকে কসাইখানায় নিয়ে যায়, সেখানে অনেক বড় গরু জবাই করা হবে। আর আমি নাকি আব্বুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম “এইটা কার গরু?”। আব্বু বলেছিলেন “আমাদের”। আমি নাকি বলেছিলাম, ” তাহলে তুমি কেন আমাকে আগে দেখাওনি আমাদের গরু। আমি তোমার সাথে কথা বলবো না। “। তারপর সেই গরুর একটা রান আব্বু কিনে নেন। সেইদিন রাতে খাওয়া পর্যন্ত আমি নাকি আব্বুর সাথে কথা বলনি।
আব্বু বলা শেষ করতেই দেখলাম তিনি কাদছেন। আব্বুকে বোকার মতো জিজ্ঞেস করলাম ” রানটা কেনার টাকা কি ধার করেছিলেন? “। আম্মু তখন বললেন ” ঐটা তোমার না জানলেও চলবে। “। কিন্তু আব্বু রোবটের মতো গলায় বললেন ” তোর আম্মুকে বিয়ের সময় যে কানের দুল দিয়েছিলাম, সেগুলো তোর আম্মু একজনের কাছে বন্ধক রেখে টাকা এনেছিলো! “। বাস্তব জীবনে আমি পাশান ধরনের মানুষ। আমার অতি আপন কেউ আমার সামনে মারা গেলেও আমাকে খুব একটা স্পর্শ করে না। কিন্তু ওইদিন পুরো ঘটনা শোনার সময় আমার মন অনেক খারাপ হচ্ছিল, আর শেষে আম্মুর কানের দুল বন্ধক রাখার কথা শুনে চোখ যেন ভিজে আসছিলো। মনে চাচ্ছিলো আম্মু আব্বুকে জড়িয়ে ধরে কাদি। কিন্তু পারিনি।
যাইহোক আল্লাহ মানুষকে হতাস করেন না। তিনি মানুষের জীবনে অবশ্যই সুখের সময় আনেন। সেই সময় কোরবানি দেয়া ছিলো আমাদের কল্পনার অতীত। আর এখন আল্লাহর রহমতে প্রতিবছরই বেস বড় গরু কোরবানি দিতে পারি। এই পোস্ট লেখার মূল উদ্দেশ্য একটাই, যারা কোরবানি দিতে পারছেন না তারা মন খারাপ করবেন না। ইনশাআল্লাহ আপনিও হয়তো আগামী বছর কোরবানি দিবেন। আস্থা রাখুন আল্লাহর উপর, আর পরিশ্রম করুন।
গল্পের বিষয়:
গল্প