অন্তত এখন ভয়ের এমন একটা রূপ ফুটেছে যে, দিন যত বাড়ে ততই সে প্রকাশ হয়ে পড়ছে। আমাদের বন্ধুটির নাম ছিল মকবুল। ব্রিটিশ আমল হলে তাকে নকল কুত্তা বলা যেত।
কেন?
এক – বাঙালি পাদরি এসেছিলেন জলেশ্বরীতে, নলিনীকান্ত। বরিশালের এক বিশেষ স্কুলে তার শিক্ষা শুরু হয়। তার স্ত্রী শ্রীমতী কল্যাণী দাসি আমাদের হাসপাতালের গাইনির ইনচার্জ সিস্টার। আর সেই সুবাদে তার স্বামী শ্রী (অস্পষ্ট স্বগতোক্তি) আর সেই থেকে আমাদের বন্ধুরা নানারকম নামের অর্থ পেতে থাকে।
আমাদের গর্ভবতী মেয়েরা বাড়ির পেছনে নতুন উঠানো কাঁচাঘরে সন্তান প্রসব করল। ওই ঘরগুলোকে বলা হতো সটি ঘর। চল্লিশ দিন পরে সটি ঘর ভেঙে কোলের শিশুটিকে কোলে নিয়ে সংসারে প্রবেশ করত নতুন মা আর তার সন্তান।
কাঁচা বাঁশের সটি ঘর বাড়ির পেছনে সারা বছরে দুর্গন্ধ পূতিময় থেকে লাল দালানে উদ্ধার পেয়ে বাংলার গর্ভবতীরা ইংরেজ মহারানির পায়ে সালাম ঠোকে।
সটি ঘর থেকে মকবুল জন্ম পেয়ে বেরিয়েছিল। কিন্তু ততদিনে ব্রিটিশরাজ আর নেই। নলিনীকান্ত, শ্রমতী কল্যাণী দাসির স্বামী – তারও আর দাপট নেই।
ভয়ে ভয়ে মকবুলের নামকে দুই ভাগ করে বানিয়েছে মোক্ আর বুল, অর্থাৎ একটি নকল, একটি কুত্তা – না, না, না, কুত্তা নয়, কুকুর।
আমরা নামটিকে ব্রিটিশের শেষ শয়তানি হিসেবে না দেখে একটা মজার খেলা হিসেবে নিই। মাঝে মাঝেই আমরা মকবুলের কাছে বুদ্ধি ঠাহর না পেলে দুয়ো দুয়ো বলে নকল কুকুর বলে চেঁচিয়ে উঠি। এ তো ছিল আমাদের নিজস্ব খেলা। একদিন খেলাটি বেশ দশ জনের কাছে পৌঁছে যায়। আমরা নকল কুকুরকে নিয়ে কনে দেখতে বেরোই। নদীর এপার থেকে যাব আমরা ওপারে। তো মাঝে মাঝেই আমরা হুঙ্কার দিয়ে উঠি জয় বন্ধু, জয় দোস্তো, এ নয় দুই কুকুরের যুদ্ধ, এ হলো প্রাণ মিলনের উপকথা।
ভোগডাঙায় সেখানে পাত্রী আছে, পাত্রী দেখা হবে। মকবুলের মা মকবুলের পকেটে আংটি তুলে দিয়েছেন। মেয়ে পছন্দ হলে মেয়েকে আংটি পরিয়ে আসবে। কিন্তু ভোগডাঙায় পৌঁছতে পারলে তো হয়। আজ ভোররাত থেকে খেয়া পারাপার বন্ধ। কারণ মান্দারবাড়িতে রাজার প্রাসাদে ভাঙা থোবা যাই থাক লুট হয়েছে। আর সেই লুটে বাধা দিতে গিয়ে দুজন মুসলিম যুবক গর্জোদার হানিফার হাতে নিহত হয়।
গভীর রাত থেকে এখন পর্যন্ত নৌকো চলাচল আধকোশা নদীতে বন্ধ। আধকোশার নির্মল জল যেন ওই দুই মুসলিমের রক্ত মেখে বিস্বাদ হয়ে যায়।
মাঝে মাঝে সওদাগরের বহর (এতদিন) নৌকো চালিয়ে দক্ষিণ থেকে উত্তরে আসত। তারাও আজ নৌকো থামাতে রাজি নয়। এপারে আমাদের হাতছানি শুনে তরতর করে নদীর মাঝখান দিয়ে অগ্রসর হয়ে যায়।
তবে কি আজ কনে দেখা হবে না?
আমরা যে এতক্ষণ, দূর দূর, মন বানানো কুকুরের পাত্রী দেখার অপেক্ষা করছিলাম সব পুটস পুট পাখি হয়ে উড়ে যায়। ওই পাখিটি তো সাত সওয়ালি পাখি। সাত প্রশ্ন করে সাতটি উত্তর চায়। একটিরও উত্তর না পেয়ে নদীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে।
আমরা পাখিটিকে জলে ভাসতে ভাসতে ডুবে যেতে দেখি। আর সেই ডুবে-যাওয়া পাখির শরীর থেকে এক অবাক সুন্দরীর জন্ম আমরা দেখে উঠি। দেখে উঠেছি কি উঠি নাই, সেটা বড় কথা নয়, আমাদের জীবন থেকে সাতটি প্রশ্ন – তার যে উত্তর পাওয়া গেল না।
নদীর ভেতর থেকে সুন্দরী পাগলিটি জন্ম লয়ে কোমরে দুহাত রেখে খলখল খিলখিল খ্যালখ্যাল করে সাধারণ নারীর মতো হাট ইস্টিশনের বাজারে নাচতে থাকে।
তার এই সাধারণ সামান্য যুবতীর মতো আচরণটি আমাদের মকবুলের চোখে পড়ে না। সেও নদীজলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারপর নারীটির কোমর ধরে ঘূর্ণি জলের বুকে মাছঘূর্ণীর মতো নাচতে থাকে। তারা নেচেই চলে একে অপরের দিকে তাকিয়ে। নাচতেই থাকে। নাচতে-নাচতে তাদের শরীর এক হয়ে যায়। এভাবে বিশ্বসংসারে এক নর এক নারীর সঙ্গে এক হয়ে যায় – যেতে থাকে। দুপুরের ঝলসিত রৌদ্রে আর কিছু নয় সাতটি সওয়ালের পাখি জেগে উঠে আমাদের মকবুলকে বুকের মধ্যে তুলে নেয়। এই গল্পের নীল পট ক্রমেই আকাশে উড়ে যেতে থাকে।