জোড়দিঘির ভাঙা ঘাট পেরিয়ে বাড়ির প্রায় কাছাকাছি এসে সে দেখতে পেল কৃষ্ণা দাঁড়িয়ে আছে। রাত বাড়লে মাঝে-মাঝেই এসে দাঁড়ায়। কেন যে দাঁড়ায়! হয়তো টলোমলো পায়ে, কিন্তু এতটা পথ যে লোকটা দিব্যি হেঁটে চলে আসতে পারল, বাকি সামান্য পথটুকুর জন্য তাকে আগ বাড়িয়ে নিতে আসা কেন বুঝতে পারে না নীলকমল। নেশা করে বাড়ি ফেরে বটে, কিন্তু কখনো এমন তো হয়নি বাড়ির পথ ভুল হয়ে গেছে। এমনও না যে পথে হুঁশ হারিয়ে পড়ে ছিল কখনো। আফটার অল উচ্চবংশের সন্তান। হাসি-কৌতুক-করুণার পাত্র হয়ে পথের পাশে ধুলো-কাদার মধ্যে কখনোই পড়ে থাকবে না সে, এই পরিণতি যেন কখনোই না হয় এই প্রার্থনা করে এসেছে ঈশ্বরের কাছে। তিনি তো সব কথা শোনেন না, এটা শুনেছেন। মানীর মান রেখেছেন। কোনো অঘটন ঘটেনি কোনোদিন। এই পথ তার হাতের তালুর মতো মুখস্থ, তা সে পূর্ণিমার চরাচর ভেসে যাওয়া আলোয় হোক আর অমাবস্যার ঘনঘোর অন্ধকারে – গামছা দিয়ে চোখ বেঁধে দিলেও ঠিকঠাক পৌঁছে যাবে বাড়িতে। তবু সে দাঁড়িয়ে থাকে। মাঝে মাঝে প্রচণ্ড বিরক্ত লাগে, ন্যাকামি দেখে গা-জ্বলে যায়। আবার কখনো মনে হয় মায়া, তার জন্য মেয়েটার মনে কোথাও একটু মায়া পড়ে আছে।
মেজাজ আজ ফুরফুরে ছিল। জুয়াখেলায় হেরেছে, তা সে প্রায়ই হারে। কিন্তু আজ টাকা গচ্চা দেওয়ার পাশাপাশি পাহাড় থেকে আনা দোচুয়ানির চারশো টাকা ভাগাভাগিতে না গিয়ে নিজের পকেট থেকে দিয়েছে। সঙ্গীরা একটু অবাক চোখে তাকালে বলেছে, যব তক রুস্তম সিংকে হাত মে তলওয়ার হ্যায়, রাজা রাজা রহেগা, প্রজা প্রজা রহেগা।
কথা সত্য, এ কথা সঙ্গী-সাথিরা জানে। ভাগ্যের দোষে বা যে কারণেই হোক তাদের মদ-জুয়ার সঙ্গী লোকটা, মানে নীলকমল রায় যে জমিদার বংশের নিঃস্ব সন্তান এ-কথা কে না জানে। এই যে রায়পুরে আজ ‘কামাল্যার হাট’ নামে বিখ্যাত বাজারটি, এর নামকরণ যে জমিদার শিবশংকর রায়ের স্নেহের নাতি কমলের নামে হয়েছিল এ-কথাও জানে সবাই। কমল্যার হাটকে অজ্ঞাত কারণে কোনো এক অখ্যাত-অজ্ঞাত কামালের নামে কামাল্যার হাট করা হয়েছিল। সে অনেক আগের কথা।
তো ফুরফুরে মেজাজের কারণেই হোক, কিংবা তার জন্য অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে আজ ন্যাকা মনে না হয়ে একটু মায়াবতী মনে হলো বলেই হোক, নীলকমল বলল, বিয়ে বসবে কৃষ্ণা, আমার সঙ্গে বিয়ে বসবে?
কেঁপে উঠল কৃষ্ণা। এই আলো-অন্ধকারেও পরিষ্কার টের পেল কমল যে কৃষ্ণা কেঁপে উঠল।
কী বলেন দাদা, আমি বিধবা মেয়েমানুষ…।
বিধবা! শালার এইসব ন্যাকা-মূর্খের কথা শুনলে এমন জমাটি নেশার মধ্যেও মেজাজটা খিচড়ে যায়, জড়ানো গলায় প্রায় খেঁকিয়ে ওঠে কমল, হোয়াটস দ্য প্রবলেম উইথ বিধবা? ইন দ্য ইয়ার অব এইটিন ফিফটি সিক্স হিন্দু বিধবাবিবাহ আইন পাস হয়েছে। এতদিন পর এই দেড়শো বছর পরে এসেও তোমার সঙ্গে বিয়ে হতে পারবে না আমার?
সমাজ আছে না একটা, আপনি আমার ভাসুর…।
হ্যাঁ ভাসুর! কোথাকার কোন লতাপাতার ভাই, তার আবার ভাসুর। দূরসম্পর্ক বুঝেছ, অনেক দূরসম্পর্ক। আমাদের ক্লোজ রিলেশন ছিল না তোমার স্বামী পলাশ…। জমিদারবাড়িতে এরকম কত ভাই-বেরাদার থাকে।
সেটা ঠিক দাদা, গরিবরা বড়লোকের দূরসম্পর্ক, আর বড়লোকেরা গরিবদের নিকটাত্মীয়… সেটা আমিও বুঝি, কিন্তু এসব কথা বলে কী লাভ, সমাজ তো জানে আপনি আমার ভাসুর।
ভালো কথা। খুব ভালো কথা। তাহলে এত রাতে এখানে এসে দাঁড়িয়ে আছ কী জন্য? সমাজ তো এসে দাঁড়ায় নাই, তুমি দাঁড়াইছ… কেন দাঁড়াইছ, বলো?
কৃষ্ণা উত্তর দেয় না কোনো। চারপাশে তাকায় একবার। সুনসান নীরবতার মধ্যে কাছে-দূরে কোথাও লোকজন দেখা যাচ্ছে না নিশ্চিত হয়ে, মাতাল লোকটার হাঁটার গতি ও ছন্দ ঠিক করে দেওয়ার জন্যই যেন একটা হাত তুলে নেয় নিজের কাঁধে। আর এটুকু বাড়তি ভালোবাসা পেয়ে অভিমানে এবার গলা বুজে আসে নীলকমল রায়ের, যতবারই তোমাকে বিয়ের কথা বলেছি ততবারই তুমি একই উত্তর দিয়েছ কৃষ্ণা… বাট ইন দ্য ইয়ার অব…।
এইটিন ফিফটি সিক্স হিন্দু বিধবাবিবাহ আইন পাশ হয়েছে – একটু হেসে বাক্যটি শেষ করল কৃষ্ণা। ঘন হয়ে একটু মুখের কাছে এসে বলল, আপনি শিক্ষিত মানুষ আইনকানুনের কথা বলেন, বিদ্যাসাগর আর রামকৃষ্ণ বাবুর…
রামকৃষ্ণ না, রামকৃষ্ণ না, রামমোহন।
হ্যাঁ, রামমোহন বাবুদের কথা বলেন, আমি তো তেনাদের চিনি না, আমি চিনি এই গ্রামের মানুষ, এই পাড়ার মানুষজনকে। তারা… তারা এখন কিছু বলে না?
বলে, এক-আধটু বলে। বেশি কিছু বলে না। তারা তো জানে বউ মারা গেছে আপনার। পুরুষ মানুষ এক-আধটু চরিত্রের দোষ থাকবেই, তাছাড়া আপনারা আবার জমিদার বংশ – বলে ফিক করে একটু হাসে, যেন উচ্চবংশের বর্তমান ওয়ারিশ সম্পর্কে একটু ঠাট্টাও মেশানো আছে গলায়।
তোমার কথা বলে না?
বলে, আমার কথাও বলে। বলে যে, মন মরলে তো শরীর মরে, এই মেয়েলোকের স্বামী মরেছে, কিন্তু মন মরে নাই। মন মরলে শরীর এমন খালের পানির মতো খলবল করে! আবার বিধবা মেয়েমানুষ এতদিন বিয়েতে বসি নাই তার জন্য এক লাইন প্রশংসাও করে।
অন্যদিন হলে কথা আর বাড়াত না কমল, মেয়েমানুষকে পায়ে ধরে ভালোবাসার কথা জানানোর মতো হ্যাংলা সে হতে পারে না। আফটার অল শরীরে বস্নু বস্নাড, হা-হা… নীলকমলের শরীরে নীলরক্ত। কিন্তু আজ কেমন যেন সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। কৃষ্ণার কাঁধের কাছে মাথাটা নিয়ে কানের কাছে বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল, আসল কথা হচ্ছে তুমি আমাকে ভালোবাসো না।
কৃষ্ণা এবার কাঁধ থেকে হাতটা নামিয়ে দিল কমলের, ভালোবাসি না! একথা আপনি বলতে পারলেন দাদা? না বাসলে…
কৃষ্ণা কী বলতে চায় বুঝতে পারে কমল। তার কাপড়-চোপড় ধোয়, রান্নাবান্না করে দিয়ে যায়, তার মা-মরা মেয়েটাকে সারাদিনই বলতে গেলে খাইয়ে-দাইয়ে দেখে-শুনে রাখে। রাতে মেয়েকে খাইয়ে একা ঘরে ঘুম পাড়িয়ে রেখে যায়। কমলের জন্যও ভাত-তরকারি ঢাকনা দেওয়া থাকে। এত কিছু যে করে কৃষ্ণা তার জন্য জমিদারবাড়ির একটি ঘরে মাথাগোঁজার ঠাঁই হয়, বছরে-ছয় মাসে একটা পরনের কাপড়, এটা-ওটা খুচরো কিছু টাকা-পয়সাও পায়, এতেই সন্তুষ্ট কৃষ্ণা। ভালোবাসার কথা যে উঠল সেটা অন্য কথা। মাঝে মাঝে নিজের ইচ্ছাতেই গভীর রাতে তার ঘরে আসে, বিড়ালের মতো সোজা গিয়ে ওঠে দাদার বিছানায়। এই ব্যাপারটা বড় অদ্ভুত। এই নির্দিষ্ট সময়টাতেই শরীর নিয়ে মেতে ওঠে মেয়েটা, কিন্তু এর আগে-পরে কী করে যেন তার সঙ্গে একটা সমীহের দূরত্ব বজায় রাখতে পারে। এ অনেকটা পুকুরের হাঁসগুলোর মতো, জলের মধ্যে ভেসে-ডুবে সাঁতার কেটে ডাঙায় ফিরে আসার পর একটা গা-ঝাড়া দিয়ে ঝরঝরে হয়ে যাওয়া। দিনের পর দিন কী করে যে এটা পারে এই বিস্ময়ের কোনো কূল-কিনারা করতে পারল না নীলকমল। এসব রাতে প্রায়ই শরীরের উত্তেজনাপর্ব শেষ হলে জামা-কাপড় ঠিক করতে-করতে কৃষ্ণা অস্ফুটে উচ্চারণ করে : পাপ!
বলে বটে পাপ, কিন্তু চেহারায় কোথাও গ্লানির চিহ্ন ফুটে ওঠে না, বরং এক ধরনের পরিতৃপ্ত চেহারাই তো দেখে কমল, কী জানে ঠিক দেখে কি না।
পাপের কথা শুনে হাসি পায়। পাপ! কিসের পাপ? বিড়বিড় করে তখন শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশে কবিতা আওড়ায় নীলকমল –
প্রভু, তুমি পরমাত্মা, অন্যের বিছানা থেকে তুলে আনো জীবাত্মা প্রেমিকা
অপূর্ব তোমার লীলা, বোঝে সাধ্য কার
আমাদের ক্ষুদ্র জ্ঞানে কি বা পুণ্য কি বা পাপাচার।
কৃষ্ণা মাথামুণ্ড কিছুই বোঝে না, শুধু উচ্চশিক্ষিত প্রেমিকের দিকে তাকিয়ে অনুতাপে করুণায় মন ভিজে থাকে তার। নীলকমল তখন ওপরের দিকে আঙুল তুলে মারফতি সুরে বলে, পাপ-পুণ্য বিচার করার আমরা কে, সব তার লীলা…।
কৃষ্ণা আবার বলল, এমন কথা আপনি বলতে পারলেন দাদা। ভালো না বাসলে…।
এ-কথাটা কোত্থেকে আসছে? আসছে রাতের অভিসার প্রসঙ্গ থেকে। মানে আমি গোপনে রাতে এত ঝুঁকি নিয়ে আপনার সঙ্গে শুতে আসি, তবু আপনি বলতে পারলেন ভালোবাসি না! এখন নীলকমল কী বলবে এই মেয়েকে? সুযোগ পেলে রাত-বিরেতে একবার বিছানায় আসার নাম ভালোবাসা? শশী ডাক্তারের মতো বলবে, শরীর শরীর তোমার মন নাই কুসুম?
কমলও বা হঠাৎ বিয়ে নিয়ে এত উৎসাহী হয়ে পড়ল কেন? বেশ তো চলে যাচ্ছিল। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে স্ত্রী মাধুরী মারা গিয়েছিল চার বছর আগে। মেয়েটা একরকম কৃষ্ণার হাতেই বড় হচ্ছে।
শিবশংকর রায়ের ছেলে হরিশংকর হয়েছিলেন না ঘরকা না ঘাটকা। জমিদারি প্রথা উঠে গেল বলে জমিদারিও পেলেন না, আবার উচ্চশিক্ষা নিয়ে অন্য কোনো পেশায় প্রতিষ্ঠিত হবেন তাও হলো না। একজীবন জায়গা-জমি বিক্রি করেই চলেছে তাঁর। ছেলে নীলকমলকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাঠিয়েছিলেন হরিশংকর। ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স করে গ্রামে ফিরে এলে গর্বে বুক প্রসারিত হয়েছিল তাঁর, তবে অর্থনৈতিক আয়-উন্নতির বিশেষ ব্যবস্থা যে তাকে দিয়ে হয়নি তাও মৃত্যুর আগে দেখে গিয়েছিলেন হরিশংকর।
জমিজমা কম কিছু ছিল না, বেহাত হয়েছে, দখল হয়েছে, কিছু কিছু জলের দরে বিক্রি হয়েছে। এখন তেমন আর অবশিষ্ট নেই, তবু এখানে-ওখানে দু-এক টুকরো পাওয়া যায়, সেই জমি যখন বিক্রি হয় তখন রুস্তম সিংয়ের হাতে কাল্পনিক তরবারি ফিরে আসে, তখন খোলা দিলে প্রকৃত জমিদার-নন্দনের মতো খরচ করে নীলকমল।
শিবশংকর রায়ের বাড়িটি এখনো বাইরে থেকে সমীহ জাগায়। ঢোকার মুখে গেটের দু-পাশে দুটি হাঁ করা এখানে-ওখানে আস্তর খসে পড়া সিমেন্টের বর্ণহীন সিংহ যেন একসময়কার সম্পদ-সমৃদ্ধির কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য এখনো দাঁড়িয়ে আছে। এই বাড়ির একমাত্র ওয়ারিশের মধ্যে তাই বোধহয় এখনো সিংহহূদয় জেগে উঠতে চায়। তাছাড়া তিনতলা বাড়িটা যতই বিবর্ণ হয়ে পড়ুক, তার খাঁজকাটা বিশাল আকৃতির থামগুলো, আর দুদিক থেকে ছাদ পর্যন্ত এসে চাঁদ আকৃতি নেওয়া ঢেউ খেলানো চুন-সুরকির নকশার বাহার দেখে বিস্ময় তো জাগেই। এত-এত বহুতল ভবন হচ্ছে শহর-গঞ্জে, এমনকি গ্রামেও, কই এরকম একটি বাড়ি তো আর চোখে পড়ে না। জমিদারবাড়ি মানে জমিদারবাড়ি, সবার বাড়ি জমিদারবাড়ি হয় না, তা সে যত টাকা-পয়সাঅলাই হোক।
কিন্তু বাড়ির ভেতরের অবস্থা খুবই খারাপ। বর্ষায় ছাদ চুয়ে পানি পড়ে, দেয়ালের আস্তর খসে গিয়ে ছিরিছাদ বলে কিছু নেই। এর মধ্যেই পাঁচ খোপে পাঁচ ঘর ভাড়াটে আছে। তারা নানা অসুবিধার প্যাচাল পাড়ে। ঘ্যান-ঘ্যান করতে-করতে মাস শেষে সাত-আটশো টাকা করে ভাড়া দেয়।
চলে তো যাচ্ছিল, কিন্তু কৃষ্ণা ভাবছে, দাদা হঠাৎ বিয়ের জন্য এরকম উতলা হয়ে উঠল কেন? – কারণ একটা আছে। সেই কারণটা এখন দশ কান করতে চায় না কমল। এই যে ফুরফুরে মেজাজ, জুয়ায় হেরেও দোচুয়ানির খরচ দিয়ে রুস্তম সিং হয়ে ওঠা, এ সবকিছুরই একটা কারণ আছে। অনেক তো হলো এবার স্ত্রী-সন্তান নিয়ে একটা গুছিয়ে সংসার করার বাসনা জেগেছে নীলকমল রায়ের। মধ্যবিত্তের সংসার। পকেট ফাঁকা, অথচ তুড়ি বাজিয়ে নীলরক্তের গল্প ফেঁদে জমিদারির খোঁয়াড়ি বয়ে বেড়ানোর জীবন নয়। শহরে গিয়ে একটা ভদ্রস্থ ঘর ভাড়া করে, এমনকি যদি সম্ভব হয় ছোটখাটো একটা ফ্ল্যাট কিনে মধ্যবিত্তের জীবন। কৃষ্ণাকে বিয়ে করে বৈধ
স্বামী-স্ত্রীর মতো সংসার, মেয়েটাকে একটা ভালো স্কুলে ভর্তি করানো – এ সব শুধু স্বপ্ন নয়, পরিকল্পনা হয়ে এখন ঢুকে গেছে মাথায়। তাই বিয়ের প্রস্তাবটা পেড়েছিল কৃষ্ণার কাছে। কিন্তু মাগী এখন সতী বিধবা!
আপনি কি আমাকে মনে-মনে গাল দিচ্ছেন দাদা?
চমকে ওঠে কমল, এ ববাবা আজকাল মনের কথাও শুনতে পায় নাকি মেয়েটা!
কৃষ্ণাকে বরং সব কথা খুলেই বলা যাক – শোনো কৃষ্ণা, আমার একটা সম্পত্তি বিক্রির কথা চলছে।
সে তো প্রায়ই হয়, মাঝে মাঝে এখানে-ওখানে জমিজমা বিক্রি হয় শুনেছি, সেই ক-দিন আপনি খুব টাকা-পয়সা ওড়ান তা-ও দেখেছি, এ আর নতুন কথা কী?
এটা নতুন কথা। খবরদার ভুলেও কারো সঙ্গে আলাপ করতে যেও না। আমাদের বাড়িটা বিক্রির কথা হয়েছে আবু তৈয়ব সওদাগরের সঙ্গে…
দুবাইওয়ালা তৈয়ব?
হ্যাঁ, টাকার শেষ নাই আবু তৈয়বের। জোড়দিঘিসহ বাড়ির দাম ঠিক হয়েছে চল্লিশ লাখ টাকা।
চল্লিশ লাখ! চোয়াল ঝুলে যায় কৃষ্ণার।
ইয়েস। প্রসন্ন জমিদারি হাসি কমলের ঠোঁটে, নগদ চল্লিশ হাজার টাকা অ্যাডভান্স দিয়েছে, উইদাউট অ্যানি ডকুমেন্টস।
কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে কৃষ্ণা বলল, তাহলে আর কী, এবার দুই হাতে টাকা উড়াইতে থাকেন…।
না। এবার আর বেহিসেবি খরচ করব না কৃষ্ণা। চল্লিশ লাখ কম টাকা না, এবার গুছিয়ে নেব। বিয়ের কথাটা সেজন্যই বলছি, অনেক হলো, এবার বউ-বাচ্চা নিয়ে সংসার করব। বাড়িটার জন্য একটু মন খারাপ করবে, আফটার অল পূর্বপুরুষের স্মৃতি…, তবে কি এই বিরাট বাড়ির ছাঁচের ভেতর একটা ভাঙাচোরা ক্ষয়ে যাওয়া ঘর, এর মধ্যে দমবন্ধ জীবন, এটাও একটা অভিশাপের মতো, ইটস আ কারস…।
এ সব কথা কী কৃষ্ণাকে বলছে কমল, না নিজেকে?
চুপ মেরে গেল কৃষ্ণা। নিঃশব্দে দাদার পাশ ঘেঁষে হাঁটতে লাগল, কে জানে হয়তো ‘সংসার’ শব্দটা তাকেও ফেলে দিল একটা ঘোরের মধ্যে।
দুই
রুস্তম সিংয়ের হাতে যখন তরবারি, তখন তার রাজা হওয়া কে ঠেকাবে? নগদ চল্লিশ হাজার টাকা ট্যাঁকে রেখে চুপচাপ থাকে কী করে নীলকমল রায়। ভাবল কিছু একটা করা দরকার। জমিদারি রক্তটা একেবারেই যে ধুয়েমুছে যায়নি গ্রামের লোকদের এমন একটি ধারণা দেওয়ার জন্য একটা আইডিয়া খুঁজছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রটির ক্রিয়েটিভিটি অব্যবহারে-অপব্যবহারে অনেক আগেই শূন্যের কোটায় পৌঁছেছিল। আইডিয়ার মধ্যে তাই হাতের কাছে পাওয়া গেল কালীপূজা। সাড়ম্বরে মা কালীর পূজা করার মনস্থ করল কমল। গলায় ছিন্ন নরমু- পরিহিতা কালীমূর্তির মধ্যে এমনিতেই এ ধরনের রক্ত-ক্রোধ-তেজ ব্যাপারগুলো আছে। জমিদারির ইমেজের সঙ্গে বেশ খাপ খেয়ে যায়।
বহুকাল আগে জমিদারবাড়িতে মহাধুমধামে এই পূজা আয়োজনের গল্প প্রচলিত আছে এখনো। সুতরাং নীলকমল জমিদারবাড়ির আঙিনায় কালীপূজা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে দরিদ্র এলাকাবাসী, মানে হিন্দুপাড়ার নারী-পুরুষ, ছেলে-বুড়োর মধ্যে মোটামুটি চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করতে পারল। এটাই সে চেয়েছিল। বাড়িটা বিক্রি করে চলে যাবে এ-খবর এখনো কেউ জানে না। চলে যাওয়ার আগে জমিদারবাড়ির ওয়ারিশের জন্য কিছুটা সমীহও যদি বাঁচিয়ে রাখা যায় এসব মানুষের মনে।
লাল লকলকে জিহবা বের করা কালী মায়ের মূর্তি এলো পালপাড়া থেকে। মাইকে খুব গান বাজল, ‘মায়ের পায়ের জবা হয়ে ওঠ্ না ফুটে মন।’ মুন ডেকোরেটরের বিজলি বাতির আলোয় বাড়ির ছাদ থেকে গাছপালার ডালপাতা পর্যন্ত ঝিকিমিকি। ঢাক-ঢোল বাজিয়ে ধূপ-ধুনা পুড়িয়ে নেচে-গেয়ে অনেক রাত অবধি আরতি হলো ম-পে। পরদিন দুপুরে বাড়ির উঠোনে পাত পেড়ে পাড়াসুদ্ধ ছেলে-বুড়োর যখন খিচুড়ি মহাপ্রসাদের ব্যবস্থা হয়ে গেল, তখন নীলকমলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ সবাই। ঠোঁট টিপে হেসে নীলকমল শুধু বিড়বিড় করল, রাজা রাজা রহেগা…।
পূজার আয়োজন সুন্দরভাবে সম্পন্ন হলো। প্রতিমা বিসর্জন না দিয়ে আরো দিনদুয়েক রেখে দেবে ভেবেছিল কমল, থাক, রেশটা থেকে যাক আরো দু-একটা দিন। সবই ঠিক ছিল। কিন্তু মাঝরাতে হঠাৎ কোত্থেকে কী যেন হয়ে গেল। পদ্মবনে মত্তহাতির মতো হইহই করে শখানেক লোক এসে যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল জমিদারবাড়িতে। ‘নারায়ে তকবির’ স্লোগান দিয়ে এই লোকগুলো কালীমূর্তি ভেঙে, মণ্ডপ ভেঙে তছনছ তো করলই, বাড়ির ভেতর ঢুকে লোকজনকে মারধর করে, জিনিসপত্র ভেঙেচুরে, দু-একটা মূল্যবান জিনিস যা পাওয়া গেল লুটপাট করে নিয়ে গেল। হঠাৎ ঘুমভাঙা হতবাক নীলকমল কিছুই বুঝতে না পেরে ছুটে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল জোড়দিঘির ভাঙা ঘাটে। সেখানে তার মেয়েকে কোলে নিয়ে কৃষ্ণাও দাঁড়িয়ে আছে দেখে কিছুটা স্বস্তিও পেয়েছিল। একাত্তর সালে যুদ্ধের সময় এ-বাড়িতে এরকম হামলা-লুটপাট হয়েছিল বলে শুনেছে। তখন মায়ের কোলে ছিল। পুরো পরিবার নাকি এ-গ্রাম সে-গ্রামে আশ্রয় নিয়ে শেষে ভারতে পালিয়ে গিয়েছিল। তখন তো পাকিস্তানি আর্মি ছিল, রাজাকারও ছিল, কিন্তু এতকাল পর হঠাৎ এরকম সংঘবদ্ধ আক্রমণের কোনো কারণই খুঁজে পেল না সে।
সব লণ্ডভণ্ড করে যখন লোকগুলো ফিরে গেল, তখন জমিদারবাড়ির ভাড়াটিয়ারা একে-একে ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে বিস্মিত-আতঙ্কিত চেহারায় বেরিয়ে আসতে শুরু করল। জোড়দিঘির ঘাটে সমবেত হলো সবাই নীলকমলের সামনে। কাউকে কাউকে এমন মার মেরেছে হাঁটতে পারছে না। নীলকমলের চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজছে সন্ত্রস্ত নারী-পুরুষ। আশা-আশ্বাস, না অন্য কিছু? তার কাছে কেন? এই লোকগুলো এতকালেও জানল না রুস্তম সিংয়ের হাতে তরবারি নেই এখন?
বাকি রাতটা কেটে গেল অনিশ্চয়তা আর আতঙ্কের মধ্যে। জমিদারবাড়ি আর পাশের হিন্দুপাড়ার লোকজন নানা রকম আলাপ-আলোচনা করেও এ-হামলার কারণ কিছুই বের করতে পারল না। তবে হামলাকারীদের দু-একজন মাত্র এলাকার লোক, যাদের চেনা গেছে, বাকিরা বহিরাগত – এ বিষয়ে একমত হতে পারল সবাই।
ঘটনার পূর্বাপর বোঝা গেল পরদিন টিএনও অফিসের সালিশ বৈঠকে। সালিশ বৈঠক হলেও নাম দেওয়া হয়েছে সম্প্রীতি সভা। এলাকার হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের জনাবিশেক লোককে ডাকা হয়েছে। ইউএনওর ভাষায় এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। তার মানে নীলকমল এখনো ‘বিশিষ্ট’র তালিকায় আছে। আবার এমনও হতে পারে, বিবদমান পক্ষের একজন হিসেবে ডাকা হয়েছে তাকে। পুরো ঘটনাটি নাকি ঘটেছে একটি কবরখানার পবিত্রতা নষ্ট করার কারণে। ধীরে-ধীরে খোলাসা হলো ব্যাপারটা। একাত্তর সালে যুদ্ধের শুরুর দিকে পাকিস্তানি আর্মি যখন নেমেছিল এ-এলাকায়, হতাহতের ঘটনা ঘটেছিল তখন অনেক। দলে-দলে লোকজন পালাচ্ছিল। জমিদারবাড়ির পেছন দিকে বাঁশঝাড়ের কিছু অংশ সাফ করে কয়েকজন মুসলমান নারী-পুরুষের লাশ কবর দেওয়া হয়েছিল সে-সময়। তখন তো কার জমিতে কাকে কবর দেওয়া হচ্ছে এ-নিয়ে কথা বলার সময় নয়। স্বাধীনতার পর কিছু অংশ ঘিরে রেখে কবরখানা হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়েছিল কিছুদিন। কিন্তু পরে আর এ-নিয়ে কারো গরজ ছিল না বলে কবে কখন ঝোপঝাড়ের মধ্যে হারিয়ে গেছে কবরখানা। এবার কালীপূজার মণ্ডপ তৈরি হয়েছে বাঁশঝাড়ের আগাছা পরিষ্কার করে, সেখানেই পূজা হয়েছে।
মুসলমানদের কবরের ওপর মণ্ডপ, পূজা…, টিএনও সাহেব বললেন, মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে।
জায়গাটা কার? আমার জায়গাতে আমি কী করব না করব… ক্ষুব্ধ-উত্তেজিত কণ্ঠে বলতে শুরু করেছিল, কিন্তু কথার মাঝপথেই নিজেকে সামলে নিল আবার, কই কবরখানায় তো কাউরে কখনো যেতে দেখি নাই, কেউ গেছে কোনোদিন?
তবু কবরখানার একটা পবিত্রতা আছে না কমলবাবু? – সিকান্দার মিয়া বললেন। সিকান্দার সাহেব শিবশংকর রায় উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।
জুতসই একটা উত্তর খুঁজে পাচ্ছিল না কমল। তখনই এককোণে চুপচাপ বসে থাকা নাজমুল, কমলের বাল্যবন্ধু, এখন এলাকার নামকরা ডাক্তার নাজমুল করিম সিদ্দিকী উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল, কিসের পবিত্রতা? পবিত্রতা রক্ষার চেষ্টা করেছেন কোনোদিন, কেউ গেছেন সেখানে? প্রতিদিন শিয়াল-কুকুরে হেগে-মুতে রাখে, তখন কোথায় থাকে পবিত্রতা?
নানা রকম তর্ক-বিতর্ক হলো। তাতে সম্প্রীতির ক্ষতি-বৃদ্ধি কিছুই হলো না। শুধু নীলকমলের দু-একজন মুসলমান বন্ধু তার পক্ষ নিয়ে কথা বলেছে এটাই সান্তবনা। তারা এ-ঘটনার তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি দিতে বলেছে। বহিরাগত আক্রমণকারীরা কার ইন্ধনে হামলা করল তার খোঁজ করতে বলেছে, এটুকুই। টিএনও বললেন, হবে, অবশ্যই তদন্ত হবে। দোষীদের ছাড় দেওয়া হবে না… ইত্যাদি। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে দশ কেজি করে চাল দেওয়ার কথাও ঘোষণা করলেন তিনি।
নীলকমল বলল, দরকার নাই, হাত পেতে নেওয়ার অভ্যাস এখনো হয় নাই স্যার, চিরকাল দিয়ে এসেছি…।
উপস্থিত লোকজনের চেহারার দিকে তাকিয়ে বোধহয় টিএনও সাহেব বুঝতে পারলেন কথাটা সত্য, তিনি কোনো উত্তর দিলেন না।
তিন
এখন দেখছি বাড়ি বিক্রির চিন্তাটা আপনি ভালোই করেছেন দাদা। একটা সামান্য ব্যাপার নিয়ে যে লঙ্কাকান্ড করে ফেলল এলাকার মানুষ…, এখানে বাস করা দিনকে দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে। – কৃষ্ণা বলল।
নিজের সিদ্ধান্ত বিষয়ে স্বল্পভাষী মেয়েটির সমর্থন পেয়ে একটু সম্মানিত বোধ করল। জমিদারবাড়িতে এরকম একটি হামলার ঘটনা যে ঘটতে পারে তা তার ভাবনার ত্রিসীমানার মধ্যে ছিল না, কিন্তু এখন সে বেশ জোরের সঙ্গেই বলল, আমি জানতাম, আজ না হোক কাল এ রকম কিছু একটা যে হবে তা জানতাম আমি। জীবনে কম কিছু তো আর দেখলাম না কৃষ্ণা।
শহরে গিয়ে ব্যবস্থা একটা কিছু করেন, মেয়েরও তো একটা ভবিষ্যৎ আছে, স্কুলে ভর্তি করাতে হবে…।
তুমি যাবে না আমার সঙ্গে?
চোখের পাতা নামিয়ে নিল, পায়ের নখ দিয়ে মাটি খুঁটতে-খুঁটতে বলল, আমি তো আছিই দাদা, চরণতলে যদি স্থান দেন…।
কৃষ্ণার মুখে যদি স্থান দেন – কথাটা শুনে হূদয় তোলপাড় হয়ে গেল নীলকমলের, এখনই কিছুটা স্থান দেওয়ার জন্য বুকে টেনে নিতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু নির্জন হলেও এই প্রকাশ্য স্থানে সেই ঝুঁকি নেওয়ার ভরসা হলো না। তবে বাকি পথটা হাঁটল স্বামী-স্ত্রী-সন্তান-সংসার বিষয়ে অদ্ভুত এক মোহগ্রস্ততার মধ্যে।
সন্ধ্যার পরপরই বিধু বড়ুয়ার দোকানের পেছনের ঘরটায় আসর জমে ওঠে। তাস আর চোলাই। ঢুকে পড়লে রাত দশ-এগারোটার আগে আর মুক্তি নেই। তাই সন্ধ্যার আগেই একবার আবু তৈয়ব সওদাগরের বাড়িতে যাওয়ার কথা ভাবল কমল। বাড়ি বিক্রির ব্যাপারটা ফাইনাল করা জরুরি।
বাড়িতেই ছিল আবু তৈয়ব সওদাগর। নীলকমলকে দেখে বলল, আসেন, আসেন জমিদারবাবু…। – এই সম্বোধনেই তাকে ডাকেন আবু তৈয়ব, হয়তো বাত কি বাত, তবু একটু সম্মান বোধ করে কমল।
কী খবর বলেন?
খবর আর কী, কালীপূজার দিন কী হয়ে গেল…। সব তো শুনছেন হাজিসাব।
জি শুনেছি। ফালতু দাঙ্গা-হাঙ্গামা। মিটমাট হয়ে গেছে?
হ্যাঁ। মিটমাট হয়ে গেছে। আপনার কাছে এলাম বাড়িটার ব্যাপারে…।
ও হ্যাঁ বাড়িটার ব্যাপারে। কিছু মনে করবেন না বাবু, বাড়িটা কেনার মতো অবস্থা আর নাই আমার। – আবু তৈয়ব বলল।
কেন? – বিস্মিত কমল।
দেখেন আমি দুবাই ছিলাম বহুদিন। দেশের হাল-অবস্থা জানি না। আপনার বাড়িটা পছন্দ হয়েছিল, জমিদারবাড়ি… একটা সাধ হয়েছিল…।
হ্যাঁ, ঠিকই তো আছে।
না, ঠিক নাই বাবু। এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বললাম, সিকান্দার মাস্টারের সঙ্গেও পরামর্শ করেছি। সবাই এক কথা বলল বাবু, এত টাকা দিয়ে এই বাড়ি কেনা বেওকুফির কাজ হবে।
তিরিশ গণ্ডা জায়গার ওপর বাড়ি, সামনে জোড়াদিঘি…।
সব তো বুঝলাম বাবু, কিন্তু বাড়ি নিয়ে যে ঝামেলা শুরু হয়েছে, মনে করবেন না এটাই শেষ, এটা মাত্র শুরু, আরো হবে।
মানে?
মানে, এলাকার লোকজন বলছে, ওই বাড়ি কেনার জন্য এত টাকা খরচ করে লাভ নাই, কয়েকবার ঝামেলা হলে বাবু এমনিতেই বাড়ি ফেলে ইন্ডিয়া চলে যাবে…।
রাগে পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে উঠল, ও আপনি সেই ধান্দায় বসে আছেন?
না বাবু, আমি ওইসবের মধ্যে নাই, কেউ দখল করে নিলে আমি কিনে নেব, একটু সস্তা পাওয়া যাবে… এই আর কি।
বাক্রম্নদ্ধ হয়ে পড়ে নীলকমল। তার সামনে বসা লোকটাকে একটা ঠান্ডা মাথার খুনি মনে হতে থাকে তার।
আমি তাহলে আসি। প্রায় অপ্রকৃতিস্থের মতো ফিরে আসছিল কমল।
আবু তৈয়ব পিছু ডাকল, শোনেন বাবু, আমি একটা কথা বলি, একবার যখন কথা হয়েছে, আমি লাখ চারেক টাকা পর্যন্ত দিতে পারি। এতে পোষালে বাড়িটা আমাকে দিতে পারেন।
চার লাখ! চল্লিশ থেকে এক ধাক্কায় চার লাখ! নিজেকে আর সামলে রাখতে পারল না নীলকমল, রাগে কাঁপতে-কাঁপতে প্রায় তোতলানো গলায় বলল, জমিদারবাড়ি কেনা তোমার কাজ না, তুমি মিয়া মুদি দোকানদারের পোলা, দুবাই গিয়ে কিছু টাকা কামাইছ, টাকা থাকলে জমিদার হওয়া যায় না বুঝেছ? রাজা রাজা রহেগা…।
নীলকমলের নিষ্ফল উত্তেজনায় বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখাল না আবু তৈয়ব। আগের মতো ঠান্ডা গলায় বলল, অ্যাডভান্সের টাকাটা তাহলে ধীরে-সুস্থ ফেরত দিয়েন।
চার
এত রাত তো করে না লোকটা, প্রায় ঘণ্টাখানেক জোড়দিঘির ঘাটে অপেক্ষা করতে-করতে দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় কৃষ্ণা। অল্প একটু জায়গার মধ্যে পায়চারি করে, আর দূরপথের দিকে তাকিয়ে গাছপালার নড়ে-ওঠা ছায়া দেখে ভাবে, ওই বুঝি টলতে-টলতে লোকটা এলো।
কিন্তু মধ্যরাত পেরিয়ে যাওয়ার পরও যখন এলো না, তখন কৃষ্ণাকেই বেরিয়ে পড়তে হলো লোকটার খোঁজে। বেশিদূর যেতে হয়নি। বিধু বড়ুয়ার দোকান পেরিয়ে হেঁটে শ্মশানখোলা পর্যন্ত আসতে পেরেছিল কমল, তারপরই হোঁচট খেয়ে, নাকি নেশার ঘোরে, মাটিতে পড়ে জ্ঞান হারিয়েছে।
কখনো তো এরকম হয় না, আজ পর্যন্ত কখনো হয়নি। কৃষ্ণা অবাক হয়ে উপুড় হয়ে থাকা মানুষটির দিকে তাকায়। খুব ধীরে নিশ্বাস পড়ছে। এই ছমছমে অন্ধকারে নির্জন শ্মশানখোলার আঙিনার ভিতর ঢুকতে হলো কৃষ্ণাকে। টিউবওয়েল থেকে একটা পস্নাস্টিকের বোতল ভরে জল নিয়ে ফিরে এলো। মাথাটা কোলের ওপর নিয়ে মুখে জলের ঝাপটা দিতে গোঁ-গোঁ শব্দ করল নীলকমল। শাড়ির আঁচল ভিজিয়ে মুখে, কপালে, গলায়, দুপাশের কানে কাঁধে ভালো করে মুছিয়ে দেওয়ার পর ভাবছিল এখন লোকটাকে বাড়ি নিয়ে যাবে কী করে। ঠিক তখনই চোখ মেলল কমল, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, চলো কৃষ্ণা বাড়ি যাই।
পারবেন? হেঁটে যেতে পারবেন?
পারব। – উঠে দাঁড়াল।
কমলের বাম হাতটা নিজের ডান কাঁধে তুলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল কৃষ্ণা।
এই জীবনে তোমাকে অনেক কষ্ট দিলাম কৃষ্ণা…।
আমার কথা ভাবতে হবে না, এই কষ্ট আমার কাছে কষ্ট না, কিন্তু নিজের কথা একবার ভাববেন না দাদা, মেয়েটার কথা…, তা ছাড়া শহরে গিয়ে সংসার করার কথাও যে বলছেন, সুস্থ থাকতে হবে না?
এবার দুম করে দাঁড়িয়ে গেল কমল, ঝাঁকুনি দিয়ে নিজের হাতটা নামিয়ে নিল কৃষ্ণার কাঁধ থেকে, গলা চড়িয়ে বলল, ফাক্ ইয়োর সংসার। ওই সংসার-টংসার করা আমার পক্ষে সম্ভব না। জমিদারবংশের ছেলে আমি, শহরে গিয়ে ছাপোষা সংসারী হতে পারব না। ইম্পসিবল।
বিস্মিত কৃষ্ণা বলল, আপনিই তো বলেছিলেন দাদা।
বলেছিলাম, কিন্তু ভেবে দেখলাম সেটা সম্ভব না। যত যাই বলো আমার ব্লু ব্লাড, জমিদার বংশ… তোমার মতো নিচু জাতের একটা মেয়েকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব? তার চেয়ে এই ভাল আগের মতো তুমি রাত-বিরেতে আসবে যাবে। জমিদার বংশে এসব আগেও ছিল… কোনো অসুবিধা নাই। থমকে দাঁড়িয়ে নীলকমলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কৃষ্ণা, তার অভিব্যক্তি বোঝা যায় না। কারণ জোড়দিঘির ঘাটে তখন গাঢ় অন্ধকার।