বিছানায় শুতে গিয়ে চমকে উঠল নিখিল। তার বালিশের পাশে একটি নারীমু-। সোনালি চুল, নীল চোখ, পাতলা গোলাপি ঠোঁট আর হলুদ জবার মত গায়ের রং। কে এ? খুব গরম পড়ায় আজকাল মশারি টাঙায় না আর। তাই সেই নারীমু- খুব স্পষ্ট করেই দেখতে পেল নিখিল, মশারির জালে তা আবছা হয়ে গেল না। মশার ধূপ জ্বলছিল। তার ঝিমঝিমে গন্ধ নিখিলের স্নায়ুর ওপর কাজ করছিল। কিন্তু বালিশের পাশে নারীমু- দেখে তার ঝিমঝিমে ভাব কেটে গেল। সে চমকে তাকাল। ভয়ও পেল একটু। ভয়, কারণ সীমা অনেকদিন হল মেয়েকে নিয়ে চলে গেছে এ-বাড়ি থেকে। তাদের সঙ্গে-সঙ্গে এ-বাড়ি থেকে সমস্ত নারীচিহ্নিত, নারীস্পৃষ্ট জিনিসপত্রও চলে গেছে। নিজেদের জামাকাপড় ছাড়াও রুমকির সব বার্বি, বার্বির জুতো-জামা, ব্যাগ, সুইম স্যুট সব নিয়ে গেছে সীমা। ঝড়তিপড়তি যা পড়ে ছিল সবই কাজের মাসিকে দিয়ে দিয়েছে নিখিল। কেষ্টপুরের খালের ধারে সেই একমুঠো অন্ধকার ঘরে দড়িতে রুমকির কেপ্রি ঝুলছে কিংবা ফুটন্ত ভাতের হাঁড়ির পাশে মেঝেতে পড়ে আছে বার্বি – এমন দৃশ্য কখনো পীড়িত করেনি তাকে।
চলে যাওয়া ও দিয়ে ফেলার পর আর কিছুই পড়ে ছিল না কোথাও, এমন তার মনে হয়েছিল। চোখের সামনে যা দেখা যায় তার বাইরে লুকিয়ে থাকার জায়গা এই ফ্ল্যাটে কোথায়? চিলেকোঠা বা বেসমেন্ট নেই। কিচেনের ওপর লফট একটা আছে বটে। কিন্তু তিন বছরের মেয়ের খেলনাগুলো অত প্রাচীন হয়ে যায়নি যে, ওখানে তুলে রাখা হবে। ব্যালকনির এক কোণে রুমকির বল, দু-এক পাটি জুতো আরো কীসব হাবিজাবি রাখা ছিল, সেসব ও বিলিয়ে দিয়েছে সেদিন। ফাঁকা জায়গায় কয়েকটা টব এনে রেখেছে, আরো আনবে আসেত্ম-আসেত্ম। ব্যালকনিটা পুরো সবুজ হয়ে গেলে সে তার মধ্যে একটা গিরগিটির মতো লুকিয়ে থাকবে।
কিন্তু তার এই স্বপ্নের মধ্যে সোনালি চুলওয়ালা মাথাটা কোথা থেকে এলো? বিছানা থেকে ছুড়ে ফেলবে বলে ওটা হাতে নিল নিখিল। কিন্তু মুখটার মধ্যে এমন সুকুমারত্ব আছে যে, সে ছুড়তে পারল না। উলটে রেখে দিলো। তারপর মাথার কাছ থেকে বইটা টেনে যতদূর পড়া হয়েছে তার পর থেকে পড়তে শুরু করল। পড়তে-পড়তে আড়চোখে মু-টার দিকে তাকাতেই তার হৃৎস্পন্দন থেমে গেল। সে তো আপসাইড ডাউন করে রেখেছিল একটু আগে। ওটা আবার সোজা হয়ে গেছে আর ড্যাবড্যাব করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। নিখিল হাতের বইটা রেখে ধড়ফড় করে উঠে বসল। এসব কী হচ্ছে? বস্ন্যাক ম্যাজিক-ট্র্যাজিক নাকি? হতে পারে, সীমা এসব করছে। সীমাকে সে অনেকটাই বুঝে উঠতে পারেনি, তার না-বোঝা অংশে থাকতেই পারে তুকতাক, বশীকরণ, জড়িবুটি। সীমার একটা হাফ-প্রেমিক টাইপের আছে। সে হুটহাট জঙ্গলে বেড়াতে যায়, নাকি ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফি করে। এই ব্যাপারটা যদিও খুব ফেক মনে হয় নিখিলের। ফটোশপে এখন সবকিছু সম্ভব। ওর ছবি তোলাটা ফেক না সীমার সঙ্গে প্রেমটা, তা নিয়ে অবশ্য মাথাব্যথা নেই নিখিলের। সীমা চলে গিয়ে সে একটু নিজের মতো করে বাঁচতে পারছে, সেটাই বড় কথা। সীমা চাকরি করে, যথেষ্ট ভালো রোজগার। কিন্তু সংসারে একটা পয়সা দিতে বললে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করত। ওর কেমন একটা মান্ধাতা আমলের ধারণা আছে, সংসারে টাকা দেবে পুরুষ আর দেখভাল করবে মেয়েরা। যদিও রান্নার লোক ছিল, কিন্তু নিজে রাঁধতেও সীমার আপত্তি ছিল না, এমনকি ঠিকে ঝি টানা সাতদিন না এলেও নিখিলকে বাসন মাজতে বা ঘর ঝাঁট দিতে ডাকত না সে, তার যত আপত্তি ছিল সংসারে টাকা দিতে। জন্মদিন, পুজোর উপহার, মেয়ের চকোলেট, খেলনা ছাড়া এক পয়সাও বের করত না সীমা। উপরন্তু রোজই বেরোনোর সময় নিখিলের কাছ থেকে খুচরো নেই বলে পঞ্চাশ-ষাট টাকা নিয়ে নিত। মাসে দু-চারবার বাইরে খাওয়ানো, দামি লিপস্টিক, পারফিউম কিনে দেওয়ার বায়না ছিল তার। নিখিল অ্যাফোর্ড করতে পারত, যথেষ্টই পারত। প্রথম-প্রথম সীমার এই স্বভাব তার প্রশ্রয়ই পেয়েছে। আসেত্ম-আসেত্ম তার বিরক্তি এলো, শেষে ভয়ংকর রাগ ও সন্দেহ। সীমা যে এত টাকা মাইনে পায়, কোথায় যায় সেসব? সীমার বাবা-মা যথেষ্ট অবস্থাপন্ন, সীমার টাকায় তাদের কোনো দরকার নেই। তাহলে এত টাকা সীমা শুধু জমায়? এখন নিখিল জেনেছে সীমার টাকার একটি বড় অংশ যেত সেই হাফ-প্রেমিকটিকে পুষতে। সীমা অবশ্য তখন বলত, শুভাশিস, ওর ডিসট্যান্ট কাজিন চাকরি-বাকরি ছেড়ে বনে-জঙ্গলে ঘোরে আর জন্তু-জানোয়ারের ছবি তুলে বেড়ায়। আর দরকার মতো এর-তার কাছে হাত পাতে। এই তো সেদিন ক্যামেরা ভেঙে গেল। নিখিল সেদিনই প্রথম চমকে উঠেছিল। একটা ক্যামেরা, মানে এই ধরনের ক্যামেরা, সে তো প্রচুর দাম। সীমা, যে সংসারে এক পয়সাও ঠেকায় না, সে কিনা ডিসট্যান্ট কাজিনের ক্যামেরা কিনে দিচ্ছে!
সেই ক্যামেরা নিয়েই ওদের সংঘর্ষটা প্রথম মুখোমুখি এলো। এতদিন ঝোপেঝাড়ে চলছিল। এবার সব সংকোচ কাটিয়ে চক্ষুলজ্জা ঘুচিয়ে নিখিল সীমার ওপর হালুম করে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সীমাও জমি ছাড়ল না। ভালোই হলো, এই সামনাসামনি মোকাবিলা না হলে নিখিল তো জানতেই পারত না, শুভাশিস যাকে সীমা হাফ কাজিন বলে চালাচ্ছে আদৌ সীমার তুতো ভাই নয়, প্রেমিক টাইপ কিছু। তবে হাফ বা সিকি, কারণ ক্রমশ প্রকাশ পেল সীমার একটি পূর্ণ সময়ের প্রেমিক আছে এবং তিনি যথেষ্ট রইস, বিবাহিত এবং দুটি সন্তানের পিতা।
এই নবলব্ধ জ্ঞানের প্রাথমিক অভিঘাতে নিখিল একেবারে দিশেহারা হয়ে গেল। তার তিনটি কারণ আছে।
এক. সীমাকে বিশ্বাস করা যায় না।
দুই. তাদের মেয়েটি তার ঔরসজাত নাও হতে পারে।
তিন. সীমার প্রেমিক এত বড়লোক হওয়া সত্ত্বেও সীমার টাকা কোথায় যায়?
সীমা প্রথম দুটি স্বীকার করে নিতে বেশিক্ষণ সময় নেয়নি। সত্যিই তাকে বিশ্বাস করা যায় না এবং মেয়েটি সেই ভদ্রলোকেরই দান। কিন্তু টাকার ব্যাপারে সে মুখে কুলুপ আঁটল এবং বিস্তর অশান্তির পরেও সে ঘর ছাড়তে চাইল না। তার না যাওয়ার সপক্ষে তিনটি যুক্তি এবং তিনটিই খুব, খুব অদ্ভুত।
এক : এখান থেকে সীমার অফিস ও মেয়ের স্কুলে যাওয়ার সুবিধা।
দুই : মেয়ে নিখিলকেই বাবা বলে জানে এবং স্কুলেও তাই জানে।
তিন : সে নিখিলকে ভালোবাসে।
সীমার থেকে যাওয়ার সপক্ষে আরো কয়েক হাজার কারণ থাকতে পারত, কিন্তু তাতে নিখিলের মন গলত না। সে তার ফ্ল্যাটে এতদিন দুধকলা দিয়ে কালসাপ ও কালসাপের বাচ্চা পুষে এসেছে, এখন শুকনো লংকার ধোঁয়া দিয়ে তাড়ালে যদি যায় তো ভালো, নয়তো সে কার্বলিক অ্যাসিড ঢালতে বাধ্য হবে।
সীমারা চলে যেতে তার মন শান্ত হলো। মেয়েটার জন্য প্রথম-প্রথম কষ্ট হতো খুব। কিন্তু কী আর করা যাবে মেয়ে তো তার নয়, সীমা নিজের মুখেই স্বীকার করেছে সে-কথা। কাকের বাসায় কোকিলের ছানা বড় করে কী লাভ?
সীমারা চলে যাওয়ার পর তার বেশ কাটছিল। পুরনো কাজের লোকদের ছাড়িয়ে দিয়েছে। তাদের কাজে কোনো ত্রম্নটি ছিল না, কামাইও বড় একটা করত না, কেবল বউদি আর বাচ্চাটার কথা তুলত ছুতোনাতায়। পুরনো রান্নার মাসি আবার প্রায়ই সবজির ঝুড়ি, ফ্রিজের পেছন, ক্যাবিনেটের মধ্যে থেকে একটা লাল বল, একটা পুতুলের পা, একটা খেলনা মোবাইল বের করে আনত। নিখিলের মনে হতো তার বা যাই হোক সীমার বাচ্চাটার ফেলে যাওয়া খেলনার সম্ভার ঝুড়ি অফুরন্ত। কোনাকাঞ্চি থেকে বেরোচ্ছে তো বেরোচ্ছেই। নাকি মাসি নিজের নাতনির খেলনা লুকিয়ে নিয়ে এসে এভাবে নিখিলকে খোঁচাতে চাইছে? নিখিল পত্রপাঠ মাসিকে তাড়াল। তার খুব অসুবিধা হলো যদিও। মনের মতো লোক পাওয়া গেল না, দু-তিনটে লোক পালটানোর পর হোম ডেলিভারিতে থিতু হলো নিখিল। একটা উপকার হয়েছে অবশ্য। সে টুকটাক রান্না করতে শিখে নিয়েছে।
রান্নাঘরে প্রথম-প্রথম ঢুকতে তার ভয় করত। সীমার মেয়ে রুমকি, যাকে ও টুমটুমি বলে ডাকত, রান্নার মাসির সঙ্গে তার ছিল ভারি ভাব। সে অনেক সময় রান্নাঘরের সামনে বসে খেলত তার এক টাবভর্তি খেলনা নিয়ে। মাঝে-মাঝেই সে তার বল গড়িয়ে দিত মাসির দিকে। অমলেট করতে-করতে কি টোস্টারে রুটি সেঁকতে-সেঁকতে নিখিলের ভয় করত তার দিকেও যদি বল গড়িয়ে আসে! সে তন্নতন্ন করে রান্নাঘর, বাড়ির প্রতিটি কোণ, কাবার্ড, আলমারির পেছন পরিষ্কার করে ফেলল। এর ফলে সে যা চাইছিল, বাড়িকে শিশু-খেলনাবর্জিত করতে, তা তো হলোই, বাড়তি জঞ্জাল, ধুলোময়লা দূর হয়ে ঘরগুলো নতুন করে সেজে উঠল। সীমা এমনি গুছিয়ে স্বভাবেরই ছিল। কিন্তু বাচ্চা, অফিস সামলাতে গিয়ে ইদানীং ঘরদোরের দিকে মন দিতে পারেনি। তার ওপর প্রেম-ট্রেমগুলো তো ছিলই।
নিজের হাতে সাজানো একটা সবুজ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে নিখিল ভাবল, তার জীবনে এবার একটা প্রেম আসতেই পারে। তবে বিয়ে বা লিভ টুগেদার একেবারেই নয়। এ-বাড়িতে কোনো নারীচিহ্নের স্থায়ী বসতি সে সহ্য করবে না।
এই ভাবনার মাসখানেকের মধ্যে শ্রাবণীর সঙ্গে আলাপ হলো তার। শ্রাবণী ডাক্তার, সম্প্রতি বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে বদলি হয়েছে। ভোরের ট্রেনে যায় আর সন্ধের ট্রেনে ফেরে। বিবাহবিচ্ছিন্না, রুবি কানেক্টরের কাছে নিজস্ব ফ্ল্যাট আছে তার। এক ডে-অফের দিন নিখিলকে সে ডাকল তার ফ্ল্যাটে।
ঘটনাচক্রে নিখিলের সেদিন ছুটি ছিল। বহু মাস পর দিনটা চমৎকার কাটল তার। মানে সন্ধে থেকে মধ্যরাতের কিছু আগে পর্যন্ত। যেহেতু শ্রাবণীকে পরদিন ভোররাতে উঠতে হবে, তাই নিখিলকে সে থেকে যেতে বলল না।
শ্রাবণী অ্যামেজিং কুক, তার বানানো কাবাব খেয়ে নিখিল মোহিত। এ ছাড়া তার সেলারে উৎকৃষ্ট ওয়াইন সম্ভার আর শ্রাবণীর ত্বক, ওয়াইনের মতো রং আর কেমন যেন নাব্যতা আছে তার। প্রথম রাতেই নিখিল ভেসে গেল। যদিও বাড়ি ফিরে আসার পর প্রথম যে-কথাটা তার মনে হলো তা হল শ্রাবণীর খরচের হাত। শ্রাবণী প্রতি সপ্তাহে এভাবে নিজের ফ্ল্যাটে নিখিলকে চাইবে এবং সেই অভিসারের সমস্ত খরচ সে-ই বহন করবে, এটা ভেবে ভারি আরাম হলো তার। নিখিলের মনে পড়ল বিপরীত রতির তুঙ্গ-মুহূর্তে শ্রাবণী তাকে বলেছিল ‘নেভার ডেয়ার টু বাই ইভন মাই লজারি। দিজ আর টু এক্সপেনসিভ।’ আলো মৃদু মূর্ছনায় বিছানায় খুলে রাখা শ্রাবণীর লজারি বেগুনি অর্কিডের গুচ্ছের মতো মহার্ঘ মনে হয়েছিল নিখিলের।
মাসখানেক একরকম হাওয়ায় ভেসে-ভেসে কেটে গেল নিখিলের। এর মধ্যে একদিন সীমা এসেছিল টুমটুমিকে নিয়ে। ওর স্কুল চেঞ্জ করবে, ইন্টারভিউয়ের দিন নিখিলকে যাওয়ার অনুরোধ করতে।
‘ওর বাবাকে বলো মানে ওর বায়োলজিক্যাল বাবাকে।’
সীমা ওর দিকে স্থির চোখে চেয়ে বলল, ‘তাকেই তো বলছি।’
‘মানে!’
‘নিখিল, তুমিই টুমটুমির বাবা। এর আগে যা বলেছি সব মিথ্যে। ওইরকম কোনো লোক আমার জীবনে নেই-ই তো সে টুমটুমির বাবা হবে কোত্থেকে?’
নাহ্, সীমা এবার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
‘হোয়াট দ্য হেল ইউ আর টকিং অ্যাবাউট?’
‘আমি বলছি, তুমি আমার এক এবং একমাত্র স্বামী এবং টুমটুমির এক এবং একমাত্র বাবা।’
‘তাহলে তুমি ওরকম কথা বলেছিলে কেন? কোনো মেয়ে এমন কথা বলতে পারে? কী তোমার লাভ?’
সীমা এবার শব্দ করে হেসে উঠল। হাসতে-হাসতে চোখে জল চলে এলো তার।
‘আমি দেখতে চাইছিলাম আমাদের সম্পর্কটা এই ছোট্ট মিথ্যের ভার নিতে পারে কিনা।’
ওকে সম্পূর্ণ হতভম্ব করে রেখে সীমা টুমটুমিকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। আর তার পরদিন নিখিল শুতে গিয়ে আবিষ্কার করল তার বালিশের পাশে সোনালি চুলওয়ালা একটি নারীমু-। প্রথমেই ওর সন্দেহ পড়ল সীমার ওপর। সীমা কি কাল এসে রেখে গেল এটা? বেশ কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করার পর সে ভাবল মু-টা ময়লার বালতিতে ফেলে দেবে। পারল না। সাইড টেবিলে রেখে দিলো তার বদলে। জল খেয়ে শুতে গিয়ে দেখল মেসেজ এসেছে। শ্রাবণীর মেসেজ। যার মোদ্দাকথা, কাল তার বাড়িতে কিছু গেস্ট আসছে তাই তাদের নির্ধারিত প্রোগ্রাম ক্যানসেলড হচ্ছে।
মানে কাবাব, ওয়াইন, শ্রাবণীর নাব্য শরীর – সব বাতিল! নিখিলের ঘুম এলো না বহুক্ষণ অবধি। শ্রাবণীর গেস্টস! ব্যাপারটা তার কাছে ভীষণ সন্দেহজনক মনে হলো। শ্রাবণী তো বারবারই বলে, সে তার বিবাহিত জীবনে বরের জোরাজুরিতে এত পার্টি দিয়েছে, এত গেস্ট অ্যাটেন্ড করেছে যে, এসব সামাজিকতায় এখন তার বমি আসে। সে তার বাড়ির নিভৃতি কিছুতেই নষ্ট হতে দেবে না, নিখিল আর তার কাজের লোক ছাড়া বাড়িতে কাউকে সে ঢোকাবে না।
সেখানে শ্রাবণীর বাড়িতে গেস্টস! এক সপ্তাহ তার কেমন বিভ্রমের মধ্যে কেটে গেল। আজ আবার শ্রাবণীর ডে-অফ। নিখিল উত্তেজিত। কিন্তু সকাল থেকে ফোন করে-করে পেল না শ্রাবণীকে। ফোন সুইচড অফ। নিখিল সেদিনও ছুটি নিয়েছে। দুপুরে খাওয়ার পর ঘরে এসেছে, টুং করে একটা শব্দ। শ্রাবণীর মেসেজ।
‘সরি, বিশেষ কাজে কিছুদিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি, ফিরে আমি যোগাযোগ করে নেব।’
নিখিল ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল। শ্রাবণীর হাতের কাবাব, তার সেলারের প্রাচুর্য কিংবা তার বার্গেন্ডি রঙা ত্বক – এসব সেই মুহূর্তে তার মাথায় ছিল না। আসল কথা হলো, শ্রাবণী তাকে অ্যাভয়েড করছে। তার দৃঢ় ধারণা হলো, শ্রাবণী অন্য কাউকে ডেট করছে এবং হয়তো তাকেই বিয়ে করতে চলেছে।
তার বুকে চিনচিনে একটা ব্যথা করছিল। মনে হলো এক্ষুনি মরে যাবে। মরে যাওয়ার আগে একবার কি শ্রাবণীর বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াবে? সেখানে গিয়ে দাঁড়ালে নিশ্চিত সে দেখতে পাবে শ্রাবণী নতুন এক পুরুষের কণ্ঠলগ্ন হয়ে একগাদা শপিং ব্যাগ নিয়ে গাড়ি থেকে নামছে। তার মহার্ঘ লজারি কিনে দেওয়ার মতো সমর্থ পুরুষ সে পেয়ে গেছে?
সেই মুহূর্তে ওর ফোন বাজল। সীমা। ‘মনে আছে তো কাল টুমটুমির নতুন স্কুলে ইন্টারভিউ? এগারোটার মধ্যে চলে এসো।
ভালো কথা, এখানে চান্স পেলে কিন্তু লাখখানেক লেগে যাবে অ্যাডমিশনে।’ সেই পুরনো সীমা। নিখিল দাঁতে দাঁত চেপে বলতে চাইল, ‘এই জন্যই বুঝি আমাকে আবার বাবা সাজতে হচ্ছে?’ কিন্তু তার বদলে সে ক্লান্ত গলায় বলল, ‘টুমটুমির কত খেলনা তুমি ফেলে গেছ সীমা? এত খেলনার সঙ্গে শুয়ে থাকতে-থাকতে আমি নিজেই একটা খেলনা হয়ে গেছি।’