স্যামরক্স ও সহোদরা

সূর্য দক্ষিণ গগনে।
উত্তর বারান্দা বেশ কিছুদিন থেকে ছায়াঢাকা। এদিকটায় পা পড়েনি।
সকালে বারান্দায় পৌঁছে বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে ফজলের।
টবের গাঢ় বেগুনি রঙের স্যামরক্সগুচ্ছ ওপরে রয়েছে।
কি রে বাবা, এ-কেমন করে হয়!
ঝড় নেই বাদল নেই, জোরে হাওয়া পর্যন্ত নেই, তাহলে?
তবে কি গৃহকর্মী আলোর মায়ের কাজ?
ঝুলে যাওয়া শুকনো পাতা ধরে টান দিয়েছে? কিন্তু তা-ই যদি হয় গাছটা বসিয়ে দিলেই তো হতো!
তাহলে!
যাতে প্রমাণ না হয় ও হাত দিয়েছে তাই এমন?
আলোর মা আসতে এখনো ঘণ্টাখানেক, তাই গোয়েন্দাগিরি সম্ভব নয়।
নিড়ানির খোঁজ।
এসিহীন ফোকরটায় ওটা থাকে, এখন তা নেই। কাজের সময় জিনিস হাতের কাছে না পাওয়া এদেশে স্বাভাবিক। রান্নাঘরের খোঁপে অবশ্য পাওয়া গেল।
বাঁচোয়া।
সবে রাজশাহী থেকে কেঁচোমাটি এনেছে সেই ব্যাগটাও হাতে নেয়।
নিড়ানি দিয়ে মাটি তৈরি করে গাছটা বসাতে হবে। চারপাশে দিতে হবে ভার্মি সয়েল।
এখন ছায়াটা কাজ দেবে। মনে মনে বলে ফজল। যতগুলো টব আছে তার মধ্যে এই গাছটা তার সবচেয়ে প্রিয়। প্রজাপতির মতো পাতার গুচ্ছ। হালকা নীলচে ফুল-পাতা ডিঙিয়ে মাথা তুলে থাকে। ফুলও চার-পাঁচটা করে গুচ্ছাকৃতির। পাতাগুলো মৎস্যপুচ্ছি। চমৎকার নকশা। রংটাও অদ্ভুত। না স্কারলেট। না কারমাইন। না চকোলেট। মিশ্র রং। ম্যাট রং। সমীরণ দোলন আনন্দ বর্ধন করে।
মনে পড়ে ছয় বছর আগের কথা।
মা তখন বেশ অসুস্থ। মধ্য পঁচাশি। বয়সটাই বালাই। উত্তরায় এক পরিচিত হাসপাতাল ও ডাক্তারদের তত্ত্বাবধানে।
খবর শুনেই কানাডা থেকে বোন নফিসা হাজির।
মেয়েকে পেয়ে মা-ও বেশ তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠলেন।
হাসপাতাল থেকে ঘরে আনা হলো।
কিন্তু এর মধ্যে ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। স্নায়বিক বৈকল্য ধরা পড়ল।
অনেকটা গুলেনবারি সিনড্রমের মতো, নার্ভ বিকল হয়ে মল-মূত্র ত্যাগের তাড়নাহীন হয়ে গেলেন, ফলে একজন মেয়েকে নিয়োগ দেওয়া হলো এই কাজে পূর্ণ সহযোগিতা দেওয়ার জন্য।
বিপত্তির সমাপ্তি এখানেই নয়, কিছুই খেতে পারেন না। শেষে নাক দিয়ে তরল খাবার ব্যবস্থা করতে রাজি করাল নফিসা। কারো কথা না শোনা, না মানা মা বালিকার মতো মেয়ের কথা মেনে নিলেন। তার আগে মা-মেয়ের কথাকাটাকাটি যে হয়নি, তা নয়। সব মনে পড়ে ফজলের।
নফিসা বলে, মা নাক দিয়ে না খেলে অন্যভাবে খেতে পারবেন না।
না, আমি ওভাবে পারব না।
পারতেই হবে। জোর দিয়ে বলে নফিসা। সারাজীবন আমি সবাইকে ধমকে এলাম আর তুই আমাকে ধমকাচ্ছিস!
সুযোগ পেয়ে শোধ তুলছি, বলে নফিসা। আর আমি এখন বালিকা নই, আমিও মা।
এই কথা শুনে মায়ের মুখে যে স্মিত হাসিটা দেখেছিল ফজল, এখনো ভুলতে পারে না। রাগী মানুষটার করুণ দশা দেখে তার কষ্টও হয়। সময় মানুষের সব ক্ষমতা কীভাবে কেড়ে নেয়। ফেরত আনে শৈশবে। জীবনচক্র বড় নিষ্ঠুর খেলা।
নফিসা ফজলের চেয়ে দশ বছরের ছোট। দেশভাগের আগে তার জীবনের দশটি বছর কেটেছে পশ্চিমবঙ্গে। হুগলির সবলসিংহপুর তার পৈতৃক ভিটা, এটা ছিল তার মথুরা, আর মামাবাড়ি হাওড়ার ঝামটিয়া ছিল ব্রজধাম। এই গ্রামে পরপর তারা চার ভাই ও বোন নফিসার জন্ম। আর একটা দৃশ্য সে এখনো ভুলতে পারে না, তৃতীয় ভাই হাবিবের জন্ম থেকে এই দৃশ্যের অবতারণা।
সে জানত, মা সন্তান প্রসবের কামরায়। তার বয়স তখন পাঁচ, সঙ্গে তিন বছরের মধ্যম ভ্রাতা। তারা দুজন বাকুলে মানে উঠানে খেলছিল। বেলা তখন দশটা, মামি হালিমা হাসিমুখে এগিয়ে এসে খবরটা জানাল।
শুনছ ফজল, তোমার আর এক ভাই হয়েছে।
আমাদের খুব আনন্দ। খেলোয়াড়ের সংখ্যা বাড়ছে।
একই দৃশ্য ঘটে চতুর্থ ভাই খলিলের জন্মের সময়। তবে সেটা ছিল বিকেল।
সবশেষে তারা চার ভাই বাকুলে খেলছে। দেশ তখন দুবছর হলো ভাগ হয়ে গেছে। তারা তখনো মামাবাড়িতে। বাবার কর্মস্থল চট্টগ্রাম যায়নি। সেই মামি হালিমা খাতুন, তাদের জানাল, ফজল, তোমাদের এবার এক বোন হয়েছে। মামির মুখটা যেন বেশি উজ্জ্বল মনে হচ্ছিল ফজলের। তারাও খেলা ছেড়ে ছুটল আঁতুড়ঘরের দিকে। তবে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হলো না। শুধু নানি গোলাপজান একমুখ হাসি নিয়ে কোলে করে একটি গোলাপকুঁড়ি এনে দেখালেন।

পরদিন থেকে চার ভাইয়ের দায়িত্ব ছিল একজন করে দুমিনিট পালাক্রমে নফিসাকে কোলে নিয়ে বসে থাকা। কী আনন্দ, কী আনন্দ… আমাদের সহোদরা এসে গেছে। সীমাহীন ছিল সে-আনন্দ।
১৯৫০ সাল। দুই বাংলায় আবার শুরু হলো দ্বিতীয় দফা দাঙ্গা। ১৯৪৬-এর দাঙ্গা ডেকে আনল দেশবিভাগ, অথচ সমস্যা মেটেনি। বরং তা যেন আরো বেড়ে গেল। শত শত বছরের পৈতৃক ভিটা ছেড়ে মানুষকে বাংলার একাংশ ছেড়ে আবার অন্যত্র যেতে হচ্ছে। পথেও হচ্ছে রাহাজানি। মেয়েদের সম্ভ্রম লুট। একই দেশের মানুষের শত শত বছর একসঙ্গে বসবাস, অথচ মুহূর্তে পিশাচে রূপান্তরিত। অন্ধকার জমে আছে বাংলায়, ভারতবর্ষে, সারা আফ্রিকায়… কটা দেশ আর মানবতা আনতে পেরেছে? দেড় বছরের নফিসাকে কোলে নিয়ে ফজলরা চট্টগ্রাম পৌঁছল।

চট্টগ্রাম শহরের চন্দনপুরায় একটি দোতলা বাড়ির একতলাটা তারা ভাড়া নেয়। ওপরে বাড়িঅলা। হিন্দু ভদ্রলোক। অমায়িক। ছোটখাটো ফর্সা মানুষটির একটা চোখ নষ্ট। সৌন্দর্যের কিছুটা হানি করেছে। কিন্তু তা পুষিয়ে দিয়েছে অমায়িক ব্যবহার। বাড়ির সঙ্গে অনেকটা জায়গা। আম-জাম-লিচু-কাঁঠালশোভিত ঘর। বেশ কয়েকটা নারকেল আর সুপারিগাছও আছে। ঘরের উঠোনে একটি শিউলিগাছ ও তুলসীমঞ্চ।
কয়েক মাস পর ওপর ঘরে তালা মেরে বাড়িঅলা কলকাতা গেল যে গেলই। ফেরার আর নাম নেই। মিউনিসিপ্যালিটি ট্যাক্স, জমির ট্যাক্স সব ফজলের বাবাকেই বহন করতে হলো।

চন্দনপুরার মাঝ দিয়ে চলে গেছে রাজপথ নওয়াব সিরাজুদ্দৌলা রোড। বড় রাস্তা থেকে শপাঁচেক গজ দূরে ফজলদের ভাড়াবাড়িটি। সামনে একটি পুকুর। পুরো পাড়ার ধোয়া-মোছা ও স্নানের জন্য ব্যবহৃত। প্রায় অ্যালজি জমে। জল সবুজাভ। স্নানের সময় সবাইকে দুহাত দিয়ে জল কাটতে হয়। ঢেউ তুলে দে ডুব। ছোটদের ওসব সমস্যা নেই। সারা পুকুর সাঁতরে বেচারা অ্যালজিদের রাজত্ব ছারখার করত। তার মধ্যে ফজলও ছিল একজন।
তখন বড় রাস্তায় ছিল হাতেগোনা চারটে দোকান। বাঁপাশে একটা কামারশালা। হাঁপরের ঢপঢপ শব্দ আর গনগনে আগুনের দৃশ্য মনে পড়ে ফজলের। পঞ্চাশোর্ধ্ব গাট্টাগোট্টা এক কামার কাজ করত। তার এক ছেলে সাহায্য করত। ফজলের বয়সী নাম খালেক। খালেকের সঙ্গে ফজলের বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল।

ওপাশে ছিল একটা চালকল। ফজলরা চন্দনপুরায় বসবাসের পর কলটা বসে। ওর পেছনে একটা ছোটখাটো পানাপুকুর। চালকলের কনভেয়ার বেল্টের খটখট শব্দ এখনো শুনতে পায়। তারপর একটা চায়ের দোকান। দোকানি নোয়াখালীবাসী। তারও বয়স পঞ্চাশোর্ধ্ব। প্রায়ই থাকত উদোম গা। তাদের সঙ্গে দেখা হলেই শুরু হতো তার রসিকতা – জ্যাডা, বুরুম ব্যাক্কা… তারাও উত্তর দিত জ্যাডা বুরুম বাক্কা…এছাড়া তার ছিল আর একটা রসিকতা, জ্যাডা বুডুর… তাদেরও একই জবাব, জ্যাডা বুডুর… চায়ের দোকানে চাঁপাকলার কাঁদিও ঝুলত। সোনালি রঙের কলার দাম ছিল এক আনায় তিনটে। হিসাবটা বেশ অদ্ভুত। চারটে নয় কেন? দুটোই বা নয় কেন? বোঝা যায়, এক আনা খরচ না করলে কলা কেনা যাবে না। কে জানে এই নীতি, না এমনি একটা ধারা তৈরি হয়েছে।
চায়ের দোকানের পাশে ছিল একটা লাকড়ির দোকান। কাঠচেরাইরত জোয়ান ফর্সা লোকটিকে ফজলরা প্রায় গুঁড়ি চেরাই করতে দেখত। তার কুড়ালের ঘার সঙ্গে নিশ্বাস ছাড়ার ঘোঁত ধ্বনি একটা ছন্দ তৈরি করত।

তাদের কোলে নফিসার থাকা হতো না। দোকানদারদের মধ্যে প্রতিযোগিতা লেগে যেত, কে তাকে কোলে নেবে। তার নামও বদলে গেল। হয়ে গেল নফু। আর কলা-বিস্কুট সব হাজির হতো চায়ের দোকান থেকে।

সেই নফু প্রজাপতির মতো ফুটফুটে। সকালে ভাইদের দলে প্রভাতফেরিতে সে-ও শামিল। বাড়িতে কোনো বোন নেই বলে সে চলাফেরায় সহজ-সাবলীল। তার হাঁড়িকুড়ি নিয়ে খেলার সরঞ্জামও নেই। বরং হাতে ব্যাডমিন্টনের র‌্যাকেট। বাড়িতে সবাই ব্যাডমিন্টনের ভক্ত।

দশক পার হতেই তাদের বাবার বদলি। রাজধানী ঢাকায়। ঢাকা তখন ফাঁকা। মাত্র এগারোটা পরিবার রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের উত্তরে ছোট একটা আবাসিক এলাকা তৈরি করেছে। সবাই সমমনা। মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পরিবার। এবার নফিসা খেলার সাথি পেল। তবে তার চলনে সহজ ভাবটা তেমনি বহাল থাকল। একরকম নেতৃত্বের ভাব। সবকিছুতে এগিয়ে। পাড়ায় আবৃত্তি প্রতিযোগিতা হোক বা সংগীতসন্ধ্যা।

শশীকলার মতো ছেড়ে উঠছে নফিসা। সাধারণ মেয়েদের চেয়ে লাবণ্যে উচ্চতায় চোখে পড়ার মতো। তখন আজকের মতো ছেলেরা পিছু লাগত না। তা ছাড়া আছে পাঁচ জওয়ান ভাই। সমীহ করতেই হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়ছে নফিসা। এসে গেল ১৯৭১-মুক্তিযুদ্ধ।

প্রথম রাতেই পুরো পরিবার যুদ্ধের বলি হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স আক্রান্ত হয়। বাবা-মায়ের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। পাঁচজন জওয়ান ছেলে আর সঙ্গে কুড়ি-একুশ বছরের মেয়ে।
ফজলের মনে পড়ে, বাবাকে আগরতলা পাঠিয়ে মা ও বোনকে নিয়ে সেও এক সময় ঢাকা ছেড়ে আগরতলায়। প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুর মুখোমুখি। নফিসা ছিল বোরকা-আবৃত। সেটা তো আর একটা চোখে পড়ার মতো চিহ্ন। যেভাবে হোক তাদের কপাল ভালো। সবকিছু কাটিয়ে আগরতলা পৌঁছায়। তারপর কলকাতা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাবা আর দেরি করেননি। এমএ পাশ করার আগেই মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেন। কয়েক বছর মাত্র নফিসা ছিল দেশে। তারপর বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার কন্ট্রাক্টের কাজে স্বামীর সঙ্গে নানা দেশে। কুয়েত, ব্রুনাই, সেমারাং, টরন্টো… শেষে ওরা টরন্টোয় স্থিতি নেয়।

টরন্টোতে নফিসা চাকরিতে লাগে। তা-ও আবার বিশ্বখ্যাত ওয়ালমার্ট কোম্পানির একটি শাখার সহ-ম্যানেজার। ফজল চমৎকৃত হয়। যে-নফিসা বাংলায় এমএটা পর্যন্ত কমপ্লিট করেনি, সে কেমন করে একটি বিভাষী দেশে বিপণি সামলায়! ভাবে, তারা পাঁচ ভাই বোনটিকে স্পেস দেয়নি। মা-বাবারা ছেলেদের ক্যারিয়ার গঠনের দিকে সব নজর। মেয়েরা… কোনোমতে বড় করা পর্যন্ত দায়িত্ব। তারপর পরবাসে। মা-বাবার দায়িত্ব থেকে একরকম মুক্তি।

মা-কে সামান্য সুস্থির করে নফিসা তার ঢাউস দুটো ব্যাগ খুলে বসে। যৌথ পরিবারে ওর বিয়ে। বড়-ছোট সব সদস্যের জন্য উপহার। গায়ে ট্যাগ লাগিয়ে নামাঙ্কিত। ভুল হওয়ার উপায় নেই। ফজল সব সময় বেডশিট আর বেডকভার পেয়ে থাকে। সারা বাড়িতে ওয়ালমার্ট। সহ-ম্যানেজার হিসেবে বড় একটা ডিসকাউন্ট পায়। তাই চাদরগুলো বেশ দামি। যে-ই দেখে চমৎকৃত হয়। বিনা ব্যয়ে রাজা। ফজল বোনের কৃতিত্ব প্রচার করে। ওয়ালমার্টের ম্যানেজার আমাদের নফিসা।

মাঝে মাঝে ঔৎসুক্য চেপে রাখতে পারে না ফজল।
আচ্ছা, তুই এত বড় ডিপার্টমেন্ট সামলাস কী করে?
প্রথমদিকে একটু কষ্ট হয়েছে, এখন আর কোনো অসুবিধা নেই। বরং দায়িত্ব এসে পড়েছে বেশি।
মানে?
সাদা চামড়ার ম্যানেজার সমস্ত ডিপার্টমেন্টের দায়িত্ব আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে হাওয়া। এমনকি চাবিগুচ্ছ পর্যন্ত দিয়ে লা-পাত্তা। প্রথম প্রথম ভয় লাগত। এখন সয়ে গেছে। তবে বসার জো নেই। ছোট একটা চেয়ার বরাদ্দ আছে… বাইরের লোক চেয়ারটাকে মনে করবে বেবিচেয়ার – এতটাই ছোট।
ভাষার প্রশ্নটা আর করে না ফজল। এতকাল বিদেশে, ভাষা নিশ্চয় বাধা হয় না। তবে দাদা, ঘরে ফিরে মুখের ব্যথাটা টের পাই।

মুখের ব্যথা! ব্যথাটা তো হওয়ার কথা পায়ে!
না, তা নয়।
তবে কি বেশি কথা বলতে হয় বলে?
না, তা-ও নয়।
তবে!
হাসি।
হাসি!
হ্যাঁ। সাইকে স্মিত হেসে আহ্বান জানাতে হয়। সবসময় হাসতে হাসতে…
এবার ফজলের হাসার পালা।
তুই যে একবারে নজরুলগীতি শোনাচ্ছিস… আমি দেখন হাসি…
তাই। নজরুলগীতি না গেয়েই মুখ ব্যথা হয়ে যায়।
বেশ মজার তো।
না বড়দা, মজার নয়, কষ্টের।
নফিসা ব্যাগ ঘাঁটতে ঘাঁটতে একটা পলিথিন মোড়া মোড়ক বের করে।
আরে, ভুলেই গিয়েছিলাম এর মধ্যে গাছের গেঁড় আছে। দাদা খালি টব হবে?
হ্যাঁ আছে একটা।
মাটি ভরা?
হ্যাঁ।
বাহ্। তাহলে এখনই কি ব্যবস্থা করা যায়?
ঠিক আছে। দে আমাকে। নিড়ানিটা বের করি।
ফজল দেখে, গাছদুটোর পাতার ডাঁটা কাটা। শুধু গোড়ায় সামান্য শেকড়ের আভাস।
গাছ দেশের বাইরে নেওয়া নিষেধ। তাই ডানা ছেঁটে এনেছি। মনে হয় হয়ে যাবে।
দেখি তো লাগিয়ে! গাছ আসলে প্রিমিটিভ লাইফ, মনে হয় মরবে না। গাছের পাতার ডাঁটা বেশ সতেজ আছে।

বারান্দায় গাছ রোপণে লাগে ফজল।
পেছনে এসে দাঁড়ায় ভাগ্নি টুম্পা।
জানো মামা, মায়ের হাতে গাছ খুব ভালো হয়। একবার একটা লাউগাছে ছয় ফুটের চেয়ে বড় লাউ হয়েছিল।

তোমার মায়ের হাতে যখন গাছ ভালো হয়, মামার হাতে নিশ্চয় খারাপ হবে না।
আত্মবিশ্বাসী ফজলের কথা ধরে সাতদিনের মধ্যে স্যামরক্সদ্বয়ে পাতা উঁকি মারল। আর সবাই ঝুঁকে পড়ে দেখে। এমন গাছ আগে কেউ দেখেনি। তরতর করে গাছ বাড়ছে। বদলাচ্ছে আকার, রং। শেষে গাছদুটো গাছের মতো হলো। একটা সবুজ, অন্যটা প্রায় চকোলেট রঙের।
গাছ বেড়ে ওঠার সঙ্গে মায়ের শরীরও ভালো হতে লাগল। একদিন মা উঠে দাঁড়ালেন। আর সেবা গ্রহণ করলেন গাছদুটোর। মুখে স্মিত হাসি, আমার মেয়ের হাতের গাছ। কী সুন্দর নাম! স্যামরকস্। সবুজটা রাধা। আর চকোলেট রঙেরটা শ্যাম।

মা, এই শ্যামের নামের বানান কিন্তু আলাদা। প-িতি ফলায় ফজল।
তা হোক। ওরা আমার রাধা-শ্যাম। মাকে সুস্থ করে, রাধা-শ্যামকে মায়ের হাতে সঁপে দিয়ে নফিসা হাসিমুখে কর্মক্ষেত্রে ফিরে গেল। অবশ্য বিদায়কালীন আলিঙ্গনে কান্না যে ছিল না, তা নয়। মায়ের মনে ভয় উঁকি দিচ্ছিল, এটাই হয়তো শেষ দেখা।

মায়ের আশঙ্কার ব্যাপারটা যে ফলে যাবে, কে জানত। ছয় মাসের মাথায় ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে মা মারা গেলেন।

নফিসাকে খবরটা কেমন করে দেবে ভেবে পাচ্ছিল না ফজল। বারো বছর আগে বাবার মৃত্যুসংবাদ শুনে নফিসা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। দশ বছরের ছোট এই বোনটা তার দুনিয়া। ফজল সবসময় ভাবে বিপদ-আপদে একজন অন্তত আছে যাকে ডাক দিলে ঠিক ঠিক কাছে পাবে। যত দূরেই যাক।
শেষ পর্যন্ত সব দ্বিধা ঝেড়ে ফোনটা তুলে নেয় ফজল। কণ্ঠে যথাসম্ভব স্নেহ মাখিয়ে সহজভাবে বলে, নফিসা, মা মারা গেছেন।

বড়দা, কী বললেন!
বলেই ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগল।
ফজলের মনে হলো, ছোটবেলায় মায়ের হাতে মার খেয়ে ঘরের এক কোনায় দাঁড়িয়ে নফিসা এমনি করে কাঁদত। পরে সে গিয়ে গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে রাগ-দুঃখ ভোলাত। এই নফিসার ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। সে অনেক দূরে। অত দূরে হাত যাবে না। তখন সে সেই চিরকেলে আপ্তবাক্য আওড়ায় : নফিসা, কাঁদিস না। মা-বাবা কি কারো চিরকাল থাকে!
নফিসা আর কোনো কথা বলেনি। ফোন ছেড়ে দেয়।

রাজারবাগে নিজেদের বাস্তুভিটাটা চারপাশে হাইরাইজ বাড়ি ওঠায় স্বাস্থ্যকর থাকল না। ফলে নিজেদের পঞ্চাশ বছরের বসতটি তারা বাধ্য হয়ে বিক্রি করে ফ্ল্যাট কেনে। সেগুনবাগিচায় কুড়িতলার একটি ফ্ল্যাটে সে আর তার মা বসবাস শুরু করে। বাগানের অভ্যাসের তাড়নায় টবের সংখ্যা এক-দুই করে অর্ধশত ছাড়িয়ে যায়। মা-ছেলে যখনই সময় পায় নিড়ানি আর জলের মগ নিয়ে তদারকিতে লাগে। নতুন ফুল ফুটলে পরস্পর আনন্দ ভাগ করে নেয়।

একদিনের কথা এখনো ভুলতে পারে না ফজল। বন্ধুর বড়ভাই আহাদভাই একদিন ফ্ল্যাটে হাজির। ওরাও মোহাজির, বর্ধমানবাসী ছিল। পারিবারিক বন্ধন না থাকলেও আত্মিক বন্ধন ছিল। মায়ের সঙ্গে আহাদভাইকে আলাপ করিয়ে দেয়। কথায় কথায় মা বললেন, ওর বোনকে আমি চিনি। চিটাগাংয়ে ছিল। দেবপাহাড়ে। তোমার আব্বার তো ওদের বাড়িতে ছিল রোজকার যাওয়া-আসা।

আহাদভাই মাকে তার পরিবারের অন্যদের খোঁজখবর দিতে থাকেন। ভাগ্নে রানা থেকে শুরু করে ভাগ্নি আইভি কেউ বাদ গেল না। আইভি ছিল ফজলের ক্লাসমেট। মা কথার মধ্যে যখন রান্নাঘরের দিকে গেলেন, আহাদভাই আবেগে বলে ওঠেন, ফজল, ইউ আর লাকি। মা আছেন সঙ্গে। হ্যাভেন ইজ মোভিং উইথ ইউ।

আহাদভাইয়ের মা কিছুদিন আগে প্রয়াত। সেই হ্যাভেনের বিচ্ছেদের কথা মনে পড়ে ফজলের। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
মা মারা যাওয়ার ছয় মাসের মাথায় সে বিকেলবেলা একটা ফোন পেল। ভগ্নিপতি খন্দকারের ফোন।
হ্যালো, …
বড়দা… বলে, আর কথা না বলে সে কাঁদতে লাগল।
ভয় পেয়ে যায় ফজল।
কাঁদছ কেন? বেশ সাহস নিয়ে জিজ্ঞেস করে।
নফিসার ক্যান্সার… তার কান্না থামে না।
তখনো মনে ভয় কাজ করেনি ফজলের। সে ভাবে, কানাডার মতো উন্নত দেশে কোনো অসুখকেই ভয় পাবে কেন!
সে বলে, অপারেশন কবে?
বড়দা, এটা ফোর্থ স্টেজ।
বুকটা ধড়াস করে ওঠে ফজলের। বলে কী!
এতদিন তবে কী করল! ফোর্থ স্টেজে পৌঁছল কী করে! তবু নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলে, ডাক্তাররা কী বলেন?
সবচেয়ে বড় ডাক্তারের কথা, প্রে ফর হার… আমার খুব খারাপ লাগছে… পরে কথা বলব। ফোন ছেড়ে দেয় ফজল। ফোন ছেড়ে দিয়ে মনে হয় অভদ্রতা হলো।
ঘরে ঢুকে সোফায় গা ছেড়ে দিয়ে অসহায়ভাবে সিলিংয়ের দিকে চেয়ে থাকে। চোখ দুটো জ্বালা করছে। কোনাগুলো ভিজে গেছে। কার জন্য? বোনের জন্য, না নিজের জন্য, ভেবে পায় না। প্রথম হ্যাভেন চলে গেছে, দ্বিতীয়টিও চলে যাওয়ার পথে। তার আর কোনো অবলম্বন রইল না।
প্রে ফর হার… মানে তো ডাক্তাররা জবাব দিয়ে দিয়েছেন।

ভাবতে পারে না ফজল। তার শরীর জুড়ে একটা সর্বগ্রাসী অবসাদ ভর করে। মনে হয় আর কোনোদিন সে উঠে দাঁড়াতে পারবে না। অনেক ভাবনা মাথায় ভিড় করতে থাকে। তার বয়স তখন পঁচিশ, ১৮ বছরের তরুণ এক সহোদর অভিমান ভরে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেল। তারপর এই অনুজা – দশ বছরের ছোট… একমাত্র বোন, এরা কেন এমন করে চলে যাবে! জীবন-সংসার বড় খামখেয়ালিতে ভরা।
দুদিন পর বোনের ফোন পেল, একেবারে স্বাভাবিক কণ্ঠ : বড়দা, কেমন আছেন?
ভালো।
তোর শরীর কেমন?
বড় ডাক্তার বলেছে সব ঠিক হয়ে যাবে।
বাহ্, এ তো আনন্দের কথা।
আপনি চিন্তা করবেন না। আমি চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি। শরীরে কুলোয় না।
ভালো করেছিস।
আপনি শরীরের প্রতি যতœ নেবেন।
ঠিক আছে।

নিয়মিত ফোন করত নফিসা। সেই একই সম্বোধন, বড়দা কেমন আছেন?
প্রায় তিন বছর পাল্লা দিয়েছিল।
আস্তে আস্তে গলার স্বরটা ভেঙে আসছিল। পরে কথা বলতে গিয়ে হাঁপাত।
ফজল বুকে পাথর বাঁধত। শোনাত আশার বাণী। জানত সবই মিছে আশ্বাস। তবু জীবন মানুষকে নিয়ে কত খেলা খেলে তার ইয়ত্তা নেই। এক সময় নফিসার ফোন আসা বন্ধ হয়ে গেল। স্বামী খন্দকার জানাত পরিস্থিতি।
ফজল সব সময় উৎকর্ণ হয়ে থাকত সেই কণ্ঠটি শোনার জন্য, বড়দা কেমন আছেন?
সে স্বর আর এলো না।
একদিন এলো তার মৃত্যুসংবাদ। এক ছেলে, এক মেয়ে আর স্বামীকে রেখে নফিসা নতুন দেশে চলে গেল।

দেখতে দেখতে আরো দুবছর কেটে গেছে। এর মধ্যে নফিসার সবুজ স্যামরক্স গাছটা মারা গেছে। ফজল গিয়েছিল বিদেশে। কাজের মেয়েটি নজর দেয়নি। এখন সবুজ স্যামরক্স বাজারে পাওয়া যায়, কিন্তু ইচ্ছা করেই আর কেনেনি। চকোলেট রঙের স্যামরকসের টবটা তাই রেখেছে মাথার কাছে জানালার পাশে। যাতে সব সময় নজরে পড়ে। সেই গাছ এমন উপড়ে পড়ে আছে দেখে খুব খারাপ লেগেছিল ফজলের। যতœ করে গাছটা বসিয়েও দেয়। মনে পড়ে, ভাগ্নি টুম্পার কথা : মামা, মায়ের হাতের লাগান গাছ খুব ভালো হয়। ফজল উতরে বলেছিল, তাহলে মামার হাতেও খুব একটা খারাপ হবে না।

ভাগ্য ভালো বলতে হবে টবে বসিয়ে দেওয়া স্যামরক্স গাছগুলো আবার পাতা ছড়িয়ে হালকা নীল ফুল ফুটিয়ে টব ভরে তোলে।

এ-ঘরে কত স্মৃতি আছে নফিসার। যত বেডশিট আর কভার সবই নফিসার উপহার। আজ পর্যন্ত নতুন করে কিনতে হয় না। তবু স্যামরকসের টবটা যত জীবন্ত হয়, ফুল ফোটে ফজলের মনে পড়ে তার শুভ্রমনের অধিকারী বোনটার কথা।

শীতের গাছ বলে স্যামরক্স শীতকালে ভালো বাড় বাড়ে। কদিন বেশ শীত পড়েছে। আর স্যামরকসের বাহার খুলছে। রোদ লেগে ঝকমক। তার মনে একটা ভাব খেলা করে। আচ্ছা, ঈশ্বর কি মানুষের প্রার্থনা পূর্ণ করেন? যদি করেন, তার একটাই বাসনা, এই সত্তরোর্ধ্ব বয়সে একবার যেন টরন্টো শহরে যেতে পারে! তাহলে তার আশা পূর্ণ হয়। নফিসার কবরের চারপাশ স্যামরক্স দিয়ে সাজিয়ে দেবে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত