আর মাত্র এক ঘন্টা পর আমার মৃত্যু হবে। আর কিছুসময় এর জন্য আমি এই পৃথিবীর অস্তিত্ব অনুভব করতে পারবো। তারপরেই এই জগৎ সংসারের সমস্ত মায়া,ভালোবাসা ত্যাগ করে বিদায় নিতে হবে। এই বিদায় কোনো ক্ষণস্থায়ী বিদায় না। এই বিদায় চিরবিদায়।
মৃত্যুর পূর্বে ধরণী বড়ই সুন্দর দেখায়। ঘরবাড়ি, আকাশ,বাতাস,চন্দ্র,সূর্য, গ্রহ,নক্ষত্র, পাহাড়, সাগর সবকিছুই খুব সুন্দর মনে হয়। সবাই যেনো আঙুল তুলে জানান দিয়ে যায়। তুমি মৃত্যু বর্জন করো। চারদিকে দেখো সবাই কতো সুখে আছে,শান্তিতে আছে। বেঁচে থাকলে একদিন সুখী হবে,শান্তি পাবে। আমারও পৃথিবীটাকে বড় সুন্দর লাগছে,মনোরম লাগছে। তবে আমি এসব ভাবছি কেনো? আমার তো পৃথিবীতে বেঁচে থাকার মেয়াদ ফুরিয়ে গিয়েছে। আমি যাকে ভালোবেসেছিলাম, আপন ভেবেছিলাম। সে আমাকে ছেড়ে দূর অজানায় পাড়ি জমিয়েছে। আমি অনেক চেষ্টা করেছি তাকে ধরে রাখতে কিন্তু পারিনি। পারিনি বললে ভুল হবে, হয়তো আমার ভালোবাসাটা তাঁর কাছে শিকল বেড়ী মনে হয়েছে,তুচ্ছ মনে হয়েছে। তাই সে আমার বৃত্তটা কে ছেড়ে চলে গিয়েছে নতুন কোনো বৃত্তের সন্ধ্যান।
বাবা মার কথা খুব মনে পড়ছে। বাবাকে কথা দিয়েছিলাম শেষ বয়সে আমি পরিবারের দায়িত্ব নিবো। বাবা তখন খুশি মনে বলেছিল,আমি বেঁচে থাকতে তোর কিছু করতে হবে না। তুই সবসময় ভালো থাক এটাই চাই আমি। তোর এই বুড়ো বাপটা যতোদিন বেঁচে আছে ততোদিন তোকে কোনো চিন্তা করতে হবে না। সেই বাবাকে ছেড়ে আজকে আমি পাড়ি দিচ্ছি না ফেরার দেশে। মাকে সবসময় বলতাম এই পৃথিবীতে আমি তোমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। কিন্তু যদি কোনো কাজ করতে বলতো,তাহলে তুচ্ছ মনে করে ফেলে রাখতাম। বাজার করতে বললে যেতাম না,ছোট খাট কোনো কাজই করে দিতাম না। মা দেখতাম একাই রান্না বান্না সহ যাবতীয় সব কাজ করতো। কাছ থেকে দেখতাম,বুঝতাম যে তাঁর কষ্ট হচ্ছে কাজ করতে। তবুও কোনোদিন ইচ্ছে করে তাকে সাহায্য করিনি।
নিজের কাপড় গুলো অন্তত নিজে ধুতে পারতাম। কিন্তু সেটাও কখনো কোনোদিন করিনি। এই কাজটাও আমার মা করে দিতো। অথচ সবাইকে বলে বেড়াতাম আমি আমার মাকে অনেক ভালোবাসি।আজ শেষ বেলায় এসে নিজের কাছে প্রশ্ন করে যাচ্ছি আসলেই কি আমি আমার মাকে ভালোবাসতাম? নাকি লোভ দেখানো ভালোবাসা ছিল। তানিয়াকে তো অনেক ভালোবাসতাম। মাকে যে কথাটা বলতাম, তানিয়াকেও ওই সেম কথাটাই বলতাম। এই পৃথিবীতে আমি তোমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। আমার মতো করে তোমাকে কেউ ভালোবাসেনা। সে যদি কোনো কিছু বলতো তাহলে সেটা মুহূর্তের মধ্যেই করে দিতাম আমি। মায়ের কাজটা কে তুচ্ছ মনে করলেও
গার্লফ্রেন্ড এর কাজটা ঠিকই করে দিতাম। বাবা মা কি খাচ্ছে না খাচ্ছে সে চিন্তা কখনো মাথায় আসতো না। কিন্তু নিজের গার্লফ্রেন্ড কে কিভাবে খুশি রাখতে হবে, বিশেষ দিনে উপহার দিতে হবে সেটা নিয়ে ঠিকই চিন্তা হতো।
তাহলে কি আমি আমার মার চেয়ে গার্লফ্রেন্ড কে বেশি ভালোবাসতাম? এটা মনে হতেই নিজের ভিতরটা জ্বলে পুড়ে দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। যে মানুষ গুলো আমার ভালোবাসা পাওয়ার কথা,যে মানুষ গুলো আমাকে লালন পালন করেছে,যে মানুষ গুলো আমার জন্য সারাজীবন তাদের ভোগ,সুখ সবকিছুই বিসর্জন দিয়ে এসেছে। সেই মানুষ গুলোকে ভালো না বেসে, ভালোবেসেছি এমন একজন কে যে আমার কখনো ছিলোই না।
আমার তো মরে যাওয়াই উচিত। আমার মতো মানুষের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। ফোনটা বন্ধ করেছি বাসা থেকে বের হবার সময়। না বলেই এসেছি। হয়তো বাসায় অনেক চিন্তা করছে আমার জন্য। বাবার হায় প্রেশার, মা তো আগে থেকেই অসুস্থ। ছোট ভাইটাও হয়তো আমার জন্য রাত জেগে বসে আছে। ওতো আমাকে ছাড়া কোনোদিন ঘুমায়নি। তবে আজকের পর থেকে আমাকে ছাড়া ঘুমাতে হবে। কি মনে করে যেনো ফোনটা অন করলাম। অন করতেই বাবার নাম্বার থেকে ফোন। ফোনটা রিসিভ করতেই ছোট ভাইয়ের কণ্ঠটা শুনতে পেলাম। ভাইয়া,তুই কোথায়?
সেই কখন থেকে তোকে ফোন দিচ্ছি তোর ফোন বন্ধ। বাবা যেনো কেমন করছে। আমার খুব ভয় হচ্ছে। তুই তাড়াতাড়ি আয়। আমি কোনো কিছু বলতে পারলাম না। শুধু বলতে পারলাম,আমি আসছি। আমি দৌড়াচ্ছি, যত দ্রুত সম্ভম দৌড়াচ্ছি। আমি কত বোকা? আমি ভুলেই গিয়েছিলাম,জীবনে চলার পথে মাঝে মাঝে এরকম তানিয়াদের সাথে পরিচয় হয়,দেখা হয়। তারা কখনোই জীবনে স্থায়ী হয় না। স্থায়ী তো তারা,যারা আমার জন্য একবুক ভালেবাসা নিয়ে অপেক্ষা করছে। তাদের ভালেবাসার প্রতিদান কোনোদিন দেওয়া সম্ভম নয়। কারণ তাদের ভালোবাসা গুলো নিঃস্বার্থ।
গল্পের বিষয়:
গল্প