রহিমা যে বাসায় কাজ করে সে বাসায় কুরবানির গরু কেনা হয়েছে ঈদের এক সপ্তাহ আগে। ম্যাডাম বলেছেন, গরুটার দাম নাকি এক লাখ আশি হাজার হয়েছে। ঈদের দিনদুই আগে ম্যাডাম রহিমাকে বলেছেন, অন্য বাসার কাজ যেনো বাদ দিয়ে দেয়। ঈদের আগের দিন থেকেই রহিমাকে তাদের বাসায় কাজ করতে হবে।
রহিমার স্বামী নেই। একটা ছেলে আছে। ক্লাস ফোরে পড়ে। ফুলপাকুড়ার পাশের বস্তিতেই থাকে রহিমা। মানুষের বাসায় কাজ করে নিজের আর ছেলের পেট চালায়। সুলতানা ম্যাডামের বাসায় কাজ করে আর এক বছর হতে চললো। আরও দুইটা বাসায় কাজ করে। ঈদের আগের দিন চিন্তা করে সেই দুই বাসা থেকে দিন দুইয়ের ছুটি নিয়ে নিলো রহিমা। উদ্দেশ্য একটাই, সুলতানা ম্যাডাম বড়ো গরু কুরবানি দিচ্ছেন, তাহলে তাকেও কিছুটা মাংস দিবেন।
ঈদের আগের দিন সব কাজ রেখে সকাল সকাল সুলতানা ম্যাডামের বাসায় এসে হাজির হয় রহিমা। সুলতানা ম্যাডাম পেয়াজ, রসুন, আদা দিয়ে শিলে পিষতে বসিয়ে দেন রহিমাকে। সকাল থেকে শুরু হয়ে পিষতে পিষতে বিকাল হয়ে যায়। পিষা শেষে রহিমা সুলতানা ম্যাডামকে বলে, আমি চইলা যাই ম্যাডাম?
সুলতানা ম্যাডাম একটা রাগচক্ষুতে তাকালেন রহিমার দিকে। তাকিয়ে বললেন, কই যাবি? আমি না বললাম ঈদের আগের দিন থেকে ঈদের দিন পর্যন্ত আমার বাসায় কাজ করতে হবে? রহিমা আমতা আমতা করে বললো, আমার ছেলে বাসায় একা আছে ম্যাডাম! কিচ্ছু খায়নাই সকাল থেকে। তাতে কী? বললেন সুলতানা ম্যাডাম। রহিমা কিচ্ছু বললো না। সুলতানা ম্যডাম বললেন, একদিন না খেয়ে থাকলে কিচ্ছু হবে না। বিকালে ঘরদোর মুছে রহিমার খাবার খেতে খেতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। রহিমাকে ফ্রিজ থেকে বের করে টক আর ডাল দিয়ে সুলতানা ম্যাডাম বললেন, এগুলো খেয়ে নে। আর কিছু বাকি থাকেনি। রহিমা খেয়ে নিলো। কিন্তু তার সামনেই দুপুরে মাছভাজা আর শুটকি ভর্তা করেছিলেন সুলতানা ম্যাডাম।
সন্ধ্যার পর আবার আরেক ঝুড়ি পেয়াজ এনে রহিমাকে বললেন, এগুলো পিষে দে তো। আমার বোনটার বাসায় কাজের মেয়ে নাই। গাড়ির ড্রাইভার দিয়ে পাঠিয়েছে মাত্র! তুই সকাল সকাল পিষে দে। ড্রাইভার বসে আছে। আর ঈদের সময় ব্লেন্ড করা পেয়াজ খেতে ভালো লাগে না। সতই হোক পেষা পেয়াজের মজাই আলাদা। কাজ শেষে রাতে সুলতানা ম্যাডামকে বললো, আমি এখন যাই? ছেলেটা আমার কিচ্ছু খায়নি সারাদিন। সুলতানা ম্যাডাম বললেন, যা। তবে সকালে ফজরের সাথে সাথে চলে আসবি। ড্রাইভারকে পাঠিয়েছি ছাগল কিনতে। দুইটা ছাগলও কিনতে হবে। রহিমা বললো, জি আচ্ছা। বাসায় গিয়ে দেখে ছেলে ঘুমিয়ে আছে। রহিমা সাথে সাথে চুলায় ভাত বসায়। শাক রাখা ছিলো আগের, সেগুলা কেটে চুলায় দেয়। রান্না করে। ছেলেকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে খাওয়ায়। ছেলে বলে, কোথায় ছিলা সারাদিন? ওইতো সুলতানা ম্যাডামগো বাসায়। কাজ আছিলো মেলা।
-আম্মা সুলতানা ম্যাডামরা কুরবানি দিবো?
-হ রে। গরু আনছে বড়ো দেইখা। শুনছি ছাগলও দিবো।
-আমগো মাংস দিবো আম্মা?
-হ দিবো না ক্যান? কালকে আইনাই তোরে রাইন্ধা খাওয়াইমু। রহিমার ছেলে বিলালের চোখে মুখে আনন্দের হাসি। সে বলে উঠলো,
-কী মজা হইবো আম্মা তাইনা? কতদিন গরু খাই না। ওই গেলো ঈদে খাইছিলাম মনে আছে তোমার?
-হ রে। কালকেই খাওয়াইমু তোরে।
-আম্মা ছাগলের মাংস আনবা? একদিন না খাইছিলাম মনে আছে? চৌধুরী চাচার পোলার আকিকার মাংস? আমার কী যে মজা লাগছে। আনবা আম্মা?
-আইচ্ছা আনমু। তুই ঘুমা এখন।
সকালে বিলাল ঘুমে থাকতে থাকতেই রহিমা চলে গেলো। সুলতানা ম্যাডাম বলেছেন সকাল সকাল যেতে। গেইটে ঢুকতেই রহিমা দেখলো বড়ো গরুটার পাশে আরেকটা গরু। আর ছাগল তিনটা। ম্যাডামকে জিজ্ঞেস করলো, আরেকটা গরু দেহি? সুলতানা ম্যাডাম বললেন, তোর স্যার রাতে আসবার সময় আরেকটা কিনে নিয়ে আসছে। আচ্ছা রহিমা শুন, ফ্রিজ দুইটা খালি আছে তুই একটাবার শুকনা কাপড় দিয়ে পরিস্কার করে নে আবার। গরু কাটা হলো। ভুঁড়ি পরিস্কার করলো রহিমা। বিকাল গড়িয়ে আবারও সন্ধ্যা। সবাই খাওয়াদাওয়া করে নিয়েছে। রহিমা খায়নি এখনও। এদিকে সে চিন্তায় আছে, তার ছেলেটা কী করছে?
সন্ধ্যার সময় রহিমার কাজ শেষ হলো। দুইটা ডিপ আর আরেকটা ফ্রিজের উপর ভর্তি করে রাখলো মাংস দিয়ে। তবুও এক বালতি মাংস পরে রইলো। সুলতানা ম্যাডাম তার বোনকে ফোন করে বললেন, জায়গা আছে তোর ডিপে? আমি মাংস পাঠাবো কিছু। আমার এখানে জায়গা নাই। রহিমার খেতে খেতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। সন্ধ্যার পর রহিমা বললো, আমি এখন চইলা যাই ম্যাডাম? না। এখন ঘরটা মুছা বাকি। রক্তের গন্ধে বসা যাচ্ছে না। রহিমা বললো, আমার ছেলেটা কিছুই খায়নি। সারাদিন উপোষ। তারে খানি দিয়া আই? কিছুক্ষণ ভেবে সুলতানা ম্যাডাম বললেন, যা। সকাল আসিস। রহিমা বললো, ম্যাডাম একটা কথা বলার আছিলো। কী? আমারে একটু খাসির মাংস দিবেন? আমার ছেলেটা শখ করছে। না না। খাসি দেওয়া যাবে না। আমি কুরমা খাওয়ার জন্য খাসি কাটছি। গরুর গোস্ত ও কাওরে দিছি না। ড্রাইভার বলছিলো আসবো, রাত্রে আসতে তারে দিমু শুধু।
অনেকটাই রাগ মুখে কথাগুলো বললেন সুলতানা ম্যাডাম। কিছুক্ষণ একটা ভর্তি পলিথিন রহিমার হাতে ধরিয়ে দিলেন সুলতানা ম্যাডাম। আরেকটা ছোট পলিথিন ও ধরিয়ে দিলেন তিনি রহিমার হাতে। রহিমা ভাবলো, বড়টায় হয়তোবা গরুর মাংস আর ছোটটায় খাসির মাংস দিয়েছেন ম্যাডাম। মুখে যাই বলুক ম্যাডাম মনের ভালো। বাসায় এনে কালো বড় পলিথিনের ভেতরের মাংসগুলা একটা স্টিলের বউলে ঢাললো রহিমা। সে আন্দাজ করেছে অন্তত পাঁচ-ছয় কেজি মাংস হবেই। উপুর করে ঢালতেই দেখে ভেতর থেকে ময়লা বেরিয়ে এসেছে। হাড্ডি, এটো ভেতরে। ছোট পলিথিনটা হাতে নিলো। এইটায় মাংস আছে তিনশো গ্রামের মতো। এইটা খাসির মাংস না, এইটা গরুর মাংস। বিলাল এসে বললো ,
-আম্মা এই ময়লা দিয়া কী করতাছো? আর মাংস কই? রহিমা বললো, এমনিতেই। খাসির মাংস আনছো আম্মা? হ আনছি। দাঁড়া রাইন্ধা দিতাছি।
রহিমা তিনশো গ্রামের মতোন গরুর মাংস খাসি বলে রেঁধে দিলো ছেলেকে। ছেলেকে খাওয়ানোর পর সুলতানা ম্যাডামদের বাসায় গেলো। সুলতানা ম্যাডাম বললেন, অহ! তোকে বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম তোর হাতে কালো ব্যাগটায় ময়লা ছিলো, এইটা ওই কোণায় ফেলে যাওয়ার জন্য দিয়েছিলাম। আর মাংস পেয়েছিস তো? ছোট ব্যাগে দিয়েছিলাম? রহিমা নিচু স্বরে বললো, হ্যাঁ পেয়েছি। সুলতানা…সুলতানা সুলতানা ম্যাডামকে তার স্বামী ডাক দিলেন। কী হয়েছে?
এখানে যে একটা তিনশো গ্রামের আলাদা প্যাকেট করে রেখেছিলাম মাংসের এইটা কোথায়? কেনো? আমি এইটা রহিমাকে দিয়ে দিয়েছি? মানে? এতোটাই দিয়ে দিলে রহিমাকে? মাংসের দাম জানো বাজারে কত এখন? এইটা আলাদা করে রেখেছিলাম মসজিদের মুয়াজ্জিনের জন্য। উনি বলে রেখেছেন আগে তাই তিনশো গ্রামের প্যাকেট করে রেখেছি। আজকাল গরুর মাংস কাওকে দেওয়া যায় না এমনি এমনি…
গল্পের বিষয়:
গল্প