অন্দর

অন্দর
ট্রেনের এই কামরাটা একদিকে কাত হয়ে আছে। লাইনচ্যুত। আশেপাশে রক্ত ঝরছে। একটা বাচ্চার চিৎকার শুনা গেল। আমি হাঁটু মুড়ে গোল হয়ে শুয়ে আছি। এমন করে মায়ের পেটে থাকে শিশু। জীবনটা যদি পেছনের দিকে নেওয়া যেত আমি এই মুহূর্তে দশ মিনিট পেছনে যেতাম। একটা সদ্য আবছা হয়ে উঠা সন্ধ্যায়। অজানা এক স্টেশন। দুই লাইনে দুইটা ট্রেন। গন্তব্য একে অপরের বিপরীতমুখী। মাঝখানে স্টেশন রেখে দুইটা ট্রেনের গতি স্লো হচ্ছিলো তখন।
ডানপাশের ট্রেন থেকে ধীরে ধীরে ক্রস করা বামপাশের ট্রেনের ছোট্ট জানালায় দেখতে পাই ওকে আমি। দীপা। সাত জন্মের বিষন্ন সেই মুখ, কপালের একপাশ বেয়ে চুলের গোছা উড়ছে বাতাসে। আমার বুক কেঁপে উঠলো। ধক ধক। এই আওয়াজ, গন্তব্য কিংবা নিঃশ্বাস- সবকিছুই আলাদা। অথচ আমাদের এক ট্রেনেই উঠার কথা ছিলো। মানুষের মৃত্যুর আগে নাকি পুরো এক জীবন, যেটুকু সে যাপন করেছে- ভেসে উঠে। পাজরের হাড় ভেঙে গিয়েছে আমার। মুখভর্তি রক্ত বের হলো বমির সাথে। দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়ে আসছে। এই কালচে সন্ধ্যায় সদ্য উল্টে যাওয়া ট্রেনের কামরায় রক্তের গন্ধ চেপে আমার চোখে ভেসে উঠছে দুই বৎসর আগেকার একটা রাত্তির..। একটা বাস। অনির্বাণ পরিবহন। গাড়ির নাম্বার, গ- ৪৫২৯০। গন্তব্য শিবরামপুর।
বাসে উঠে একটা কুৎসিত দৃশ্য দেখার দুর্ভাগ্য হলো আমার। আমার পার্শ্ববর্তী জানালার সিটে যে ভদ্রলোক বসেছেন, তিনি ঘুমোচ্ছেন। একটা ঘুমন্ত মানুষ এতটা কুৎসিত হতে পারে আমার জানা ছিলোনা। ভদ্রলোক জানালা ফেলে আমার দিকে মুখ করে ঘুমোচ্ছেন। মুখটা আধখোলা। ঠোঁটের এক কোন বেয়ে লালা গড়িয়ে পড়ছে। ভদ্রলোক একটু পর পর ঘুমের ঘোরে ওটা একটা বিশ্রি শব্দ করে টেনে নিচ্ছেন মুখে। আমার গা শিরশির করে উঠলো। সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজলাম। ‘ঠাসসস’ বামগাল চ্যাঁৎ করে জ্বলে উঠলো। চোখ খুলে কিছুক্ষণ পিটপিট করতে হলো। ঝাপসা দেখছি। হাত মুঠো করে দাঁতে দাঁত লাগিয়ে মনে মনে হিংস্র একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। দৃষ্টি পরিষ্কার হলে যে মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠবে তার দুই গাল লাল করে দেব।
থাপ্পড়ের আওয়াজেই বোধহয় পাশের ভদ্রলোক সহ বাসের অধিকাংশ যাত্রীর ঘুম ভেঙে গেল। সবার চোখ আমার দিকে। আমি তাকিয়ে আছি সামনে। যে মুখটা ভেসে উঠলো ওই মুখটা গোল, নরম গাল। চোখ দুটো বড় বড় বড় এবং চোখের কোনে লাল। কপাল কুঁচকে আছে রাগে কিংবা বিরক্তিতে। মুখটা মেয়েলি স্বরে বললো, ‘তোদের মতো অসভ্যর জন্য মেয়েরা বাসে রাস্তায় ঘরে বাইরে কোথাও নিরাপদ না। পা ঢুকাচ্ছিস কেন সিটের ফাঁকে?’ পাশের ভদ্রলোক খুক খুক করে কেশে উঠলেন। পুরো বাসভর্তি মানুষ ক্ষেপে আছে। আমার প্রচণ্ড আত্মসন্মানবোধে যেন কেউ ব্লেড দিয়ে আঁচড় কাটলো। ভেবে পেলাম না কি করবো। প্রতিবাদ করবো নাকি চুপচাপ থাকবো। মেয়েটি কিছুক্ষণ কড়মড় করে তাকিয়ে সিটে বসে পড়লো। আমার মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে আসলো। চোখ বুজলাম। তখনো চোখ বুজা ছিলো, হয়তো দুই সিটের ফাঁক দিয়ে পা রেখেছি ঘুমের ঘোরে। বাজে ইনটেনশন তো ছিলোনা। কে বুঝাবে?
বাসে ফিসফাস হলো কিছূক্ষণ। আমাকে নিয়েই। আমার হাতে একটা মেয়ে কতটা নিরাপদ, কয়েকজন বেশ কড়া মতামত জানালেন। সিটের ফাঁকে পা ঢুকিয়ে দেশের ঠিক কতটুকুন ক্ষতি করে ফেলেছি, তা মাপজোক করা হলো বেশ কিছুক্ষণ। চোখের মতোন কানেরও যদি পাতা থাকতো, বুজে রাখতাম আজ। কুমিল্লায় বাস থামলো। পনের মিনিট বিরতি। সবাই বাস থেকে নামলো। আমি একা বসে রইলাম বাসে। নামতে ইচ্ছে হলোনা। সবাই নেমে যাওয়ার পর মোবাইলের ফ্রন্ট ক্যামেরা ওপেন করে মুখটা দেখলাম। বাম গালে লালচে আভা সেঁটে আছে। হাত বুলিয়ে দেখছিলাম ফুলেছে কিনা। এই মুখ নিয়ে বাসায় ফেরা যাবেনা। খট করে আওয়াজ হতেই চমকে উঠে তাকালাম সামনে। মেয়েটি তাকিয়ে আছে। লজ্জায় ইচ্ছে করলো সিটের ভেতর ঢুকে যাই। অথচ আশ্চর্য হলো। মেয়েটি নাক কুঁচকে অপরাধী মুখ করে বললো, ‘আমায় একটা থাপ্পড় দিন।’
আমি থতমত খেয়ে বললাম, ‘স্যরি?’ ‘নো, আই এম স্যরি। আই এম রিয়েলি স্যরি। আপনার পাশের উনি বললেন নিচে একটু আগে। উনার খারাপ লাগছিলো আপনাকে থাপ্পড় দিয়েছি দেখে। উনিই ঘুমের ঘোরে পা দিয়ে ফেলেছিলেন সিটের ফাঁকে। বাজে ইনটেনশন ছিলোনা। আমি পেছনে তাকিয়েছি যখন আপনার পা নাড়ানো দেখে আপনাকেই সন্দেহ হলো। প্লিজ। আমাকে থাপ্পড় দিন।’ আমি আশেপাশে তাকালাম। পুরো বাসে আমরা দুইজন। এখনো পাঁচ মিনিট বাকি বিরতি শেষ হওয়ার। আমার তাকানো দেখে মেয়েটি বললো, ‘আচ্ছা, এখন মারবেন না এই তো? অকে, পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করুন। সবাই বাসে উঠুক। তারপর আমায় জোরে থাপ্পড় দিবেন সবার সামনে।’ ‘না না, ছি কি বলছেন। ইটস অকে।’ ‘আপনি কি গাধা, একবারও প্রতিবাদ করলেন না ওটা আপনি করেন নি। মানুষ এত গাধা কি করে হয়।’ ‘আশেপাশে দেখেছেন? প্রতিবাদ করলে মেরে তক্তা বানিয়ে দিতো। হা হা।’
আমার হাসি মেয়েটির চোখে মুখে লেপ্টে থাকা অপরাধবোধ কমালোনা। বাড়ালো আরো। সামনের সিটে গুটিশুটি মেরে বসে থাকা মেয়েটি বাকি রাস্তা দশ পনের মিনিট পর পর পেছনে উঁকি দিয়েছে। মুখে ছিলো একগাদা অপরাধবোধ। আমি ভাবিনি এই মেয়েটির সাথে আর দেখা হবে আমার। হলো। আমাদের উপরের ফ্ল্যাটেই। আমাদের দেখা হলো লিফটে। বাসায় ফিরছি সেদিন সন্ধ্যায়। লিফটের দরজা খুলতেই চমকালাম। হাত অজান্তে গালে চলে আসলো। মেয়েটি প্রথমে বিস্মিত হলেও একটুপর ভয়ানক বিব্রত হলো গালে হাত রেখে আমায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। আমাদের পরিচয় পর্ব সারা হলো লিফটেই। দীপা।
দীপারা এখানে ছয় তলায় থাকছে প্রায় তিন বৎসর হয়ে এলো। ঘরকুনো আমার দেখা হয়নি কখনো তাকে। তাছাড়া দীপা হোস্টেলে থাকে। বাসায় আসা হয় কম। কোথাও যাচ্ছিলো দীপা। কথা বলতে বলতে আমরা উপরে উঠলাম। একদম উপরে। পরে খেয়াল হলো আমার বাসা তের তলায়। আঠার থেকে তের-এর উদ্দেশ্যে নিচে নামলাম। কথা বলতে বলতে। একদম নিচে। গ্রাউন্ড ফ্লোর। লিফট আর নিচে নামছেনা দেখে সামনে তাকাতেই দীপা খিলখিল করে হেসে উঠলো। দীপা আর কোথাও গেলোনা। আমিও আর বাসায় ফিরলাম না। আমরা কথা বলছিলাম লিফটে। একবার আঠার একবার গ্রাউন্ড ফ্লোর। এমন একটা চমৎকার সন্ধ্যা কীর্তনখোলার পাড় ছাড়া অন্যকোথাও নামতে পারে জানা ছিলোনা।
বই মুভি ছাড়া আমার আরো একটা জগৎ হলো। দীপা। বিকেল হলেই আমি ছাদে চলে যেতাম। দীপা আসতো। কখনো হাতে বই নিয়ে। গল্প উপন্যাসে আমরা যেভাবে দেখি, অনেক পরিকল্পনা করে নাটকীয় মুহূর্তে ভালোবাসার প্রকাশ, আমাদের তেমন হলোনা। একদিন কথা বলতে বলতেই বললাম, ‘তুমি আর আমি একসাথে একটা বই পড়বো। যে আগে পড়ে ফেলবে, সে পরের পৃষ্ঠায় যাওয়ার জন্য তাড়া দেবে- মিষ্টি ঝগড়া করবে, তবে একাও পড়তে যাবেনা- অপেক্ষা করবে। যে ধীরে পড়ে, সে দ্রুত পড়বে যাতে বাকিজনকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে না হয়। একটা ছিমছাম সুন্দর সংসারের মতোন। পারবে? দীপা হুট করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর অচেনা একটা স্বরে বললো, ‘পারবো।’
আমি মোটেও কোনো কাব্যিক ছন্দে মাখানো প্রপোজ করিনি। এমনকি এটাও অমন কোনো ইনটেনশন নিয়ে বলা ছিলোনা। সত্যিই বই পড়ার জন্য পারমিশন চেয়েছিলাম। বইটা আমায় সে পড়তে দিচ্ছিলোনা। সুনীলের, প্রথম আলো। অনেক বড় বই। আমি বই পেলে বিকেলে ছাদে আসবোনা। ওটা নিয়েই পড়ে থাকবো। এই ভয়ে। না চাইতেও এরপর থেকে দীপাকে আমি পেলাম। ঠিক অন্যরুপে। বন্ধুত্বের বাইরের একটা রুপ। এখানেও বন্ধুত্ব, তবে তীব্র। কিছু অধিকার বন্ধুত্বে ছিলোনা, এখানে তাও পেলাম। আমি দীপার একাংশ পেয়ে গেলাম যেন। আমরা রোজ একসাথে প্রথম আলো পড়ি। এত চমৎকার সময় আমার জীবনে আসবে কখনো ভাবিনি। দীপার ক্লাস শুরু হলো। হোস্টেলে যেতে হবে। দীপার হোস্টেলটা জেলখানার মতোন। ভয়ানক কড়াকড়ি। আমাদের রোজ দেখা হবেনা। ভার্সিটি টাইমে দেখা করা যায়। তবে আমার ক্লাস মিস দিতে হবে তাহলে। আর দীপা ওইভাবে দেখা করবেনা। ক্লাস ফাঁকি দেয়া যাবেনা। দুই সপ্তাহে একদিন হবে দেখা। দীপা হোস্টেলে পৌঁছুলো।
আর আমি আমাকে চিনলাম। আমি মূলত প্রচণ্ড পজেসিভ একজন প্রেমিক। দীপা আমার বিকেলের ছাদ থেকে সরতেই আমি টের পেলাম আমার মূলত কোনো আশ্রয় নেই কোথাও। দীপা দীপা। আমার সমগ্র চিন্তা চেতনায় এই নামটা ছাড়া অন্য কিছুর স্থান ছিলোনা। দীপা কখন হোস্টেল থেকে বের হয়, কয়টা ক্লাস করে, কার পাশে বসে, কার সাথে হাঁটে, কার সাথে ফুচকা খায়, কখন হোস্টেল ফিরে, কিভাবে ফেরে, রাতে কখন খায় এবং কখন ঘুমায়- আমার চব্বিশ ঘন্টা এসবেই চক্রাকারে আটকে থাকে। দীপা কখনো বিরক্ত হয়না। কখনো না। সকালে বেরিয়ে এতগুলো ক্লাস করে, টিউশনি করে বাসায় পৌঁছে খেয়ে দেয়ে পড়ে যখন আমায় হ্যালো বলে, আমি প্রশ্নের ঝড় বইয়ে দিই। দীপা ক্লান্ত স্বরে মিষ্টি হেসে উত্তর দেয়। সারাদিন আমি কি করেছি জেনে নেয়। তাও আমার রাগ হয়। খুব রাগ। আমি বকি। প্রচণ্ড বকি। দীপা চুপ করে শুনে যায়। রাগ কমলেই বলে, ‘আমায় কেউ কোনোদিন উঁচু স্বরে কথা বলেনি, ছোটবেলা থেকে। জোরে কিছু বলিওনা কেমন? আমি সহ্য করতে পারিনা। আস্তে আস্তে বলবা।’ আমি তাও বলি। আগের চেয়েও জোরে বলি।
দীপা নিরবে শুনে যায়। হয়তো বা কাঁদেও। আমি শুনতে পাইনা। দীপা শব্দহীন কাঁদে। ছয়মাস কাটে এইভাবে। আমি এই ছয়মাসে দীপাকে চমৎকার ছয়টা দিনও উপহার দিতে পারিনি। মাস দেড়েকের লম্বা ছুটিতে দীপা হোস্টেল থেকে বাসায় আসে। আমার বিকেলের শূন্য ছাদে আমি দীপাকে খুঁজে পাই আবার। কিন্তু কোথাও যেন কিছু নেই। আমার সেই দীপা আর নেই। হাসৌজ্জ্বল, হাসিখুশি। হাসে, অথচ প্রাণ নেই তাতে। কথা বলে, অথচ শব্দ নেই তাতে। তাকায়, অথচ দৃষ্টি নেই চোখে। এই দীপাকে আমি চিনিনা। আমার দীপাকে চাই। দুই দিন দীপা ছাদে আসেনি। ফোন রিসিভ করেনি। দুয়েকবার রিসিভ করে ব্যস্ত বলে রেখে দিয়েছিলো ফোন। একই বিল্ডিং এ থেকেও একটা মারাত্মক দূরত্বে বাস করছিলাম আমরা, ওই দুইদিনেই টের পেলাম আমি।
তিনদিনের মাথায় ছাদে আমি ওকে পাই। একটা ছেলে ছিলো সাথে। মেহমান। কাজিন হতে পারে। অথবা অন্য কেউ। হাসাহাসি করছিলো দুইজন। সেই হাসৌজ্জ্বল দীপা। আমি সিড়ি থেকে লুকিয়ে দেখি। দীপা হাসতে হাসতে গায়ে হাত দেয় ছেলের। আমার কপালের শিরা ফুলে উঠে। ধীরপায়ে এগিয়ে যাই দীপার দিকে। আমাকে দেখে চমকে উঠার কথা দীপার। দীপা একটুও চমকায় না। ওই হাসি মুখে ধরে রেখেই বলে, ‘অন্তু, নে পরিচিত হয়ে নে.. এটাই..’ কথা শেষ হওয়ার আগে চড় দিই আমি দীপার গালে। হাত জ্বলসে উঠে আমার। অন্তু নামের ছেলেটা চমকে উঠে। দীপা গালে হাত দিয়ে চোখ বুজে থাকে। আমি যেভাবে এসেছিলাম ওই ভাবেই ধীরপায়ে বাসায় আসি। দীপা আর ছাদে উঠেনি তারপর।
একসপ্তাহ আমি লিফট ব্যবহার করিনি। সিড়ি দিয়ে নেমেছি। মোবাইল আছাড় দিয়ে ভেঙেছি। জানালা খুলিনি। বই পড়িনি। ছাদে যাইনি। দীপার সাথে দেখা হওয়ার যতগুলো সম্ভাবনা ছিলো, সবগুলো এড়িয়ে গিয়েছি। এই মেয়েটির দিকে আর কখনো তাকাবোনা। কখনোই না। একটা সেকেন্ডের জন্যও না। এক সপ্তাহ পর অন্তু নামের ছেলেটি আসলো আমার বাসায়। আমার বয়েসী ছেলেটা আমার হাত ধরে কাতর স্বরে বললো, ‘তুলো চিনেন?’ আমি অন্যদিকে তাকিয়ে থাকি। ‘দীপু তুলোর চেয়েও নরম। ভয়ানক সেন্সিটিভ। আমি একবার ওর গায়ে জুতো ছুঁড়েছিলাম ছোটবেলায় ঝগড়ার সময়। রাতে জ্বর চলে এসেছিলো ওর। ভয়ানক জ্বর। হসপিটালে ভর্তি করানো লাগছে। পরবর্তী দশ বৎসর আমার সাথে একটা শব্দ কথা বলেনি সে জানেন?’
আমি অন্তুর দিকে তাকাই। অন্তুর চোখ অশ্রুসজল। পুরুষ মানুষ এত দ্রুত কাঁদতে পারে কিভাবে! অন্তু বললো, ‘দীপুর অবস্থা সিরিয়াস। দীপুকে স্যরি বলেন। আমি যতদূর জানি, ভালোবাসার মতোন ছ্যাঁচড়া জিনিস আর একটাও নেই। এই যে দেখেন দীপু, সামান্য জুতো ছুঁড়োছুঁড়ি সেই কবে ছোটবেলায়- আমায় দশ বৎসর চোখের আড়াল করে রেখেছে সে। ইগো, সেল্ফ রেসপেক্ট। অথচ, আপনি স্যরি বললে কেঁদে ফেলবে সে আমি জানি।’ অন্তু চলে গেলো। আমি র’য়ে গেলাম। আমি র’য়ে গেলাম একটা বাসের ভেতর। অনির্বাণ পরিবহন। একটা রাত্তির। ভুল করে চড় দেওয়া কোনো এক মানবীর জায়গায়। মানবী আমাকে স্যরি বলেছিলো। ভুল করলে স্যরি বলা যায়। ভালোবাসায় ছ্যাঁচড়া হতে হয়।
আমি পারিনি। আমি মূলত ওই বাস থেকে বের হতেই পারিনি আর। দীপারা পরের মাসেই বাসা ছাড়ে। যাওয়ার দিন লিফটে আমাদের দেখা হয়। দীপা একবার তাকিয়েছিলো আমার দিকে। হয়তোবা আমার চোখে অনুতপ্ত ভাব খুঁজছিলো। আমি আমাকে চিনলাম ওইদিন। হয়তো আমি কোনো মানুষই নই। দীপা তৃষ্ণার্ত ছিলো, অনুতপ্ত আমায় বুকে টেনে নেওয়ার জন্য। আমি অনুতপ্ত ছিলাম না। অনুতপ্ত হতে সময় লাগে। অনুতপ্ত হওয়ার জন্য কিছু সময় দিতে হয়। দীপা আমায় সময় দিলো। বাকি জীবন। ট্রেনের এই কামরাটা কাত হয়ে আছে। বদ্ধ কামরায় রক্তের উষ্ণ গন্ধ। বাইরে অন্ধকার। চিৎকার, চেঁচামেচি। ‘হায়, হায়- কি হলো। ট্রেন এ্যাক্সিডেন্ট। হায় খোদা! হায় ঈশ্বর! হায় যিশু। রক্ষা করো। আল্লাহু আকবার। মা রক্ষা করো। কেউ ইমার্জেন্সীতে ফোন দাও। ফোন দাও। এই দিক দিয়ে আসো। ওরে টেনে বের করো। উদ্ধারে হেল্প করো।’ নানানরকম কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছি।
আমি জানি, আর দশ মিনিট যদি আমি বেঁচে থাকি তবে ওরা আমায় টেনে বের করবে। ট্রেনের ভাঙাচুরা কামরা থেকে। অথচ আমি একটা বাস থেকে বের হতে চাই। একটা বহু বৎসর পুরনো বাস। একটা মানবী আমায় একা ফেলে নেমে গিয়েছে ওই বাস থেকে। আমি নামতে পারছিনা। এই গল্পের এমন সমাপ্তি আমি চাইনা। ঈশ্বর, আমায় বাস থেকে নামার ব্যবস্থা করো। চোখ বুজলাম আমি। মানুষের মৃত্যুর আগে নাকি পুরো এক জীবন, যেটুকু সে যাপন করেছে- ভেসে উঠে আমার চোখেও ভেসে উঠলো। দুইটা ট্রেন। গন্তব্য একে অপরের বিপরীতমুখী। মাঝখানে স্টেশন রেখে দুইটি ট্রেনের গতি স্লো হচ্ছিলো। দীপাকে দেখলাম আমি জানালায়। পাশের লাইনে। সাত জন্মের বিষন্ন মুখ। খোলা চুল হাওয়ায় উড়ছে। এই গল্পের দ্বিতীয় জানালায় আমি।
দু’টো ভিন্ন লাইনের ট্রেনের জানালা একত্র হবে একটু পর। এগিয়ে আসছে ধীরে। ক্রস করার সময় আমি দীপার চোখাচুখি হবো একটা মুহূর্তের জন্য। হতে পারে সেটা দুই সেকেন্ড। আমার কাছে দুই শতাব্দি। আমার চোখে জল। আমি একবার তাকাবো দীপার চোখে। একটা বাসের ভেতর আটকে আছি আমি। বহু রাত্তির। বহুক্ষণ। বহু মুহূর্ত। বহু মরশুম। নামতে পারিনি আজো। এই একটুকুন মুহূর্ত আমায় মুক্তি দেবে। আমি বাস থেকে নামবো। অপেক্ষায়। এই আর অল্প একটু।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত