আমি রুপা। এটা আমার গল্প, আবার হয়তো অনেকের – আমার মতো অথবা একেবারেই আলাদা কারো। এই গল্প বা কথাগুলো পড়তে পড়তে আপনার মনে ভেসে উঠতে পারে কোনো একজনের কথা, যাকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলেছেন জীবনের আশ্চর্য গতিময় ঘূর্ণিপাকে। অথবা হয়তো এটা আপনারই কাহিনি। এমন স্বতঃস্ফূর্ত স্বীকারোক্তি করবেন বলে বহুবার ভেবেছেন, মনস্থির করেছেন, তবে শেষ পর্যন্ত কেন যেন প্রয়োজনীয় সাহসটুকু সঞ্চয় করে উঠতে পারেননি। তা হোক, তাহলে বরং আজ আমার কথাই হোক, আমার বয়ানে উচ্চারিত হোক দীর্ঘশ্বাসের তলায় চাপা পড়ে থাকা সুতীব্র্র হাহাকারের এক কষ্ট-কাহিনি। কখনো না কখনো তো আমাদের অতীতের কাছে ফেলে আসা জীবনের দিকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়। কারণে বা কারণ ছাড়াই।
ক্লাস সিক্স থেকে সেভেনে ওঠার সময়ই বলতে গেলে আমি পেকে গেলাম। পেকে একদম ঝুনা না, অনেকটা রসে ভরা টসটসে। খুব বেশি পাকলে ফল বা এ-জাতীয় জিনিসকে ঝুনা পাকা বলে, যেমন ঝুনা নারকেল। আবার এর রূপক অর্থও আছে। এই বিদ্যা অর্জন করেছিলাম বান্ধবী সুরমার কাছ থেকে। তাকে ঝুনা বান্ধবী বলা যায়। তবে মানুষ ভালো। চমৎকার গুছিয়ে কথা বলে, দরকারমতো জ্ঞান বিতরণ করে। আর দুজনে একসঙ্গে থাকলে প্রায় সময় আমি চুপচাপ কেবল তার কথা শুনতে থাকি। কিন্তু নারকেলের শাঁস খেতে খেতে যেদিন সুরমা আমাকে জানাল যে, ডাব ভালোভাবে পাকলে তাকে ঝুনা নারকেল বলে, তখন স্বভাবমতো আমার মাথায় অন্য চিন্তা চলে এলো। ওই সময় টিভিতে একজন অভিনেতা ছিলেন, যার নাম ছিল ঝুনা চৌধুরী। প্রথম প্রথম তাকে আমার বেশ ভালোই লাগত; পরে ভালো লাগাটা অন্যদিকে ঘুরে গেছে। তো সুরমার বিদ্যা বিতরণপর্ব শেষ হওয়ার আগেই আমি বেমক্কা বলে বসলাম, তাহলে মানুষের নাম ঝুনা হলে সেটার কী অর্থ হতে পারে বা কেন রাখা হয় – এরকম কিছু। এ-ধরনের উদ্ভট প্রশ্ন শুনে ভালো মানুষ সুরমা প্রথমে চোখ বড় করে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর হেসে ফেলেছিল। সম্ভবত ওই মুহূর্তে সে বাকশূন্য হয়ে পড়েছিল। তারপর দুজনে মিলে, আমাদের চিন্তার ভেতরে আদৌ কোনো যোগসূত্র আছে কিনা তার বিচার-বিবেচনা না করেই, ঝুনা নারকেল ফেটে পড়ার সশব্দ-হাসিতে আমরা ভেঙে পড়লাম। একে অন্যের গায়ে।
যাক গে, আমার গায়ের রং সবাই বলত, দুধের মধ্যে এক ফোঁটা আলতা ফেলে দিলে যেমন হয় তেমনটা। সেটার সমাস হচ্ছে দুধে-আলতা। তো সকলেই যখন এমনটা বলে, তাহলে তার পেছনে নিশ্চয় যুক্তি আছে। যুক্তি না থেকে উপায় কী! পাড়ার ছেলেরা তা যে-বয়সেরই হোক, আমাকে দুবার দেখলে তাদের মন ভরে না; তিনবার, চারবার করে তাকায়, দেখে। কেউ ঘাড় ঘুরিয়ে বারবার; কেউ কেউ আবার সামনাসামনি তাকিয়ে থাকে, একবারও চোখের পলক না ফেলে। এই দ্বিতীয় শ্রেণিরগুলো একদম বেহায়া; কোনোরকম ধমক বা গালিগালাজে তাদের কোনো বিকার হয় না।
এদের একজন একদিন যখন আমি ক্লাস এইটের ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, এমন একটা সময় আমার পথ আগলে দাঁড়াল এবং যেন মুখস্থ বলছে এমনভাবে গড়গড় করে বলে চলল, ‘রুপা, তুমি যে কেমুন একটা মাইয়া, তোমারে দ্যাখলেই, না-না, তুমার কথা ভাবলেই সারা শরীলে আগুন ধইরা যায় সুইটি ডার্লিং, আমার লগে প্রেম করবা? তুমারে আমি অনেক ভালো পাই’, ইত্যাদি। আরেকটা কথাও সে আমাকে বলেছিল যার অর্থ ওই সময় বুঝতে পারিনি। পরে বাসায় ফিরে মেজোপার কাছে কথাটার অর্থ জানতে চাইলে তার সাদা গাল লজ্জায় লাল হয়ে গেল। মেজোপার গায়ের রংও ফর্সা, তবে আমার মতো অতটা নয়। ততদিনে আমি সাদা-ফর্সা আর দুধে-আলতা ফর্সার পার্থক্যটা বেশ বুঝে গেছি। সব শুনে সে আমাকে সাবধান করে দিলো, ঘুণাক্ষরেও আমি যেন দ্বিতীয় কাউকে এসব কথা বলতে না যাই। তাতে নাকি আমাকেই সবাই দোষ দেবে, মন্দ কথা বলবে, এরকম মুরব্বিগোছের উপদেশ।
মেজোপার পরামর্শ মেনে কয়েকদিন চুপচাপ থাকলাম; কিন্তু ভেতরে ভেতরে কাউকে বলতে না পেরে রীতিমতো উশখুশ করতে শুরু করলাম। এবং একদিন মজা করার ছলে হোক অথবা তার প্রতিক্রিয়া দেখতে হোক, আমার ফুপাত ভাই, আশফাক, যার সঙ্গে আমি তখন চুটিয়ে প্রেম করছি, তাকে বিষয়টা বলব বলে মনস্থির করে ফেললাম। আমি ক্লাস সেভেনে ওঠার পরপরই দুজনে প্রায় একই সঙ্গে একে অন্যের প্রেমে পড়ে গেলাম। আশফাকভাই তখন ক্লাস টেনে উঠে বেশ বড় বড় ভাব নিতে শুরু করেছে। কারণ পরের বছর ম্যাট্রিক পাশ করলেই সে মুক্ত কলেজ জীবনের স্বাদ পাওয়ার সুযোগ পেতে শুরু করবে এবং নিজস্ব একটা স্বাধীন জগতের মালিক হয়ে যাবে। এ নিয়ে মাঝেমধ্যে সে আমার সঙ্গে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা আলোচনা করে খানিকটা বিরক্ত করে ফেলেছে। কেননা, ভালোবাসা বা প্রেমপূর্ণ রোমান্টিক বাতচিত ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে অর্থহীন প্যাঁচাল শোনার ব্যাপারে আমার সামান্যতম আগ্রহ ছিল না। যদিও বাড়ির বড় ছেলে হওয়াতে এবং বেশিরভাগ সময় অহেতুক গম্ভীর হয়ে থাকাতে নিজের মতো করে থাকার সুবিধা সে আগে থেকেই উপভোগ করে এসেছে। ক্লাস এইটে উঠতে না উঠতেই বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে সিগারেট টানতে শুরু করেছে এবং জন্ম থেকে পাওয়া কালো, পুরু ঠোঁটটাকে আরো কালো বানিয়ে ফেলেছে।
তো যা বলছিলাম, আশফাকভাইকে কথাটা বলার আগে তার মেজাজ বুঝে আমি খানিকটা সতর্ক হয়ে গেলাম, মানে শেষ পর্যন্ত আসল কথাটা বলতে পারলাম না বা বলা হয়ে উঠল না। কারণ, ওই ছেলের প্রসঙ্গ আসতেই সে ভীষণমাত্রার রাগের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করল আর আমার মুখের কথা পেটের ভেতরেই থেকে গেল। পাড়ার আরো বেশ কয়েকজন ছেলের মতো ওই ছেলেটাও যে আমার প্রেমাকাক্সক্ষী তা আশফাকভাইয়ের বেশ ভালো করেই জানা ছিল এবং আমার মুখে এরকম কারো কথাই সে শুনতে পারত না। ছেলেরা যে এমন হিংসুটে হতে পারে আশফাকভাইকে না দেখলে আমার জানা হতো না। তবে তার এভাবে উত্তেজিত হয়ে যাওয়াটা আমার বেশ ভালোই লাগত। মনে হতো, আমাকে ভালোবাসে বলেই না এমন করে। আমি যেমন ওর ক্লাসের হিন্দু মেয়েটা, মল্লিকা না মালবিকা কী যেন একটা নাম, তার কথা একদম সহ্য করতে পারি না। মল্লিকা বা মালবিকা নামের অদেখা মেয়েটা, যে নাকি আশফাকভাইকে এতটাই ভালোবাসে যে, তাকে বিয়ে করার জন্য নিজের ধর্মও বদলে ফেলবে বলে মরণপণ করে বসে আছে, তার নাম শুনলেই আমার সারা শরীরে কাঁটার মতো ফুটতে থাকত আর অসম্ভব রাগে ভেতরটা জ্বলে যাওয়ার মতো হতো। আশফাকভাই আমার এই মানসিক প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারটা জানত এবং যখন-যখন আমাকে রাগানোর ইচ্ছা হতো, যেন আমাকে দেখতে পায়নি এমন ভাব ধরে ঘ্যারঘেরে বেসুরো গলায় ওই একটা গানই গাইত, ‘আমার মল্লিকাবনে যখন প্রথম ধরেছে কলি/ তোমার লাগিয়া তখনি, বন্ধু, বেঁধেছিনু অঞ্জলি … আমার মল্লিকাবনে।’
সেদিন বিকেলের দিকে আশফাকভাই বাসায় এসে হাজির। সপ্তাহে এরকম দু-তিনবার হুটহাট করে যখন-তখন চলে আসে। আমার জন্যই আসে। সবাই বুঝতে পারে। কিন্তু আমরা দুজন আমাদের অভিব্যক্তিতে এমন একটা মুখোশ পরে থাকি যে, যেন তার এই হঠাৎ বাসায় চলে আসার বিষয়ে আগে থেকে কেউ কিছুই জানতাম না। আশফাকভাইয়ের এত ঘন-ঘন আসা নিয়ে বড়ভাইকে আম্মার সঙ্গে রাগ করতেও দেখেছি। তবে কোনো লাভ হয়নি। আমাদের লাভের পথে আমরা তখন আশপাশের সবকিছুই উপেক্ষা করে যাচ্ছি। যেমনটা বেশিরভাগ সাহসী প্রেমিক-প্রেমিকা করে থাকে।
সন্ধ্যাটা খানিকটা ঘন হয়ে আসতেই আমরা বাসার ছাদে উঠে গেলাম। ছাদটা আমাদের দোতলা বাসার সবচেয়ে সুন্দর জায়গা। চাইলে এখানে সারাদিন এমনকি সারারাতও কাটিয়ে দেওয়া যেতে পারে। কথা বলার জন্য বাসার ভেতরে সুবিধা করতে না পারলে আমরা এই ছাদে চলে আসি। যে পাশটায় পানির ট্যাঙ্কের ওপর বিশাল জামরুল গাছের ছায়া পুরা জায়গাটাকে একটা মায়াবী ঘেরাটোপ বানিয়ে রেখেছে, কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটির পর আমরা সেখানে গিয়ে বসি আর ঘোরলাগা চোখে আমাদের যুগল ভবিষ্যতের স্বপ্নগুলো বুনতে থাকি। এদিক থেকে আমার চেয়ে আশফাকভাই বেশি এগিয়ে থাকে। একটু বেশিরকম রোমান্টিক কিনা।
যাক, সেদিন যখন সবাই ড্রইংরুমে টিভি দেখায় মশগুল, আমরা দুটি প্রাণী সুযোগ বুঝে পা টিপে-টিপে ছাদে গিয়ে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। বিশাল পূর্ণিমার চাঁদ তার জমিয়ে রাখা সমস্ত জাদুময় আলো পৃথিবীর ওপর ঢেলে দিয়ে আকাশের গায়ে লেগে ছিল আদুরে প্রেমিকার মতো। ছাদে উঠেই আশফাকভাই সিঁড়ির দরজাটা আস্তে করে টেনে দিলো। আগে দরজাটা টানার সময় ক্যাঁএএএচ করে একরকম বিশ্রী শব্দ হতো বলে কেউ ছাদে গেলে টের পাওয়া যেত; কোনো এক ফাঁকে নারকেল তেল না গ্রিজ কিছু একটা এনে দরজার ওই জায়গায় লাগিয়ে দিয়ে আশফাকভাই সেই শব্দ বন্ধ করার ব্যবস্থা করে ফেলেছে, যাতে আমাদের সান্ধ্যকালীন বা মাঝেমধ্যে একটু বেশি রাতের অভিসারগুলো নির্বিঘœ হতে পারে।
তো দরজাটা টেনেই শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে সে আমাকে জড়িয়ে ধরল; জোঁকের মতো ঠোঁট কামড়ে পুরে নিল তার সিগারেটের গন্ধেভরা ভেতর মুখে আর আমার জামার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে কিছুক্ষণ যা করার করল। সামান্য সময়ের জন্য হাঁসফাঁস করা ছটফটানি তারপর আবার এক ঝটকায় আলাদা হয়ে যে যার মতো পাশাপাশি হাঁটতে থাকলাম যেন মুহূর্তমাত্র আগে আমাদের মধ্যে কিছুই হয়নি। ছাদে এলে আশফাকভাই প্রায়ই এমন পাগলামি কা- করত; আমিও কখনো তেমন করে বাধা দিইনি। সবসময়ের সবার কাছে শান্ত-ভদ্র তার ওই বিশেষ বন্য রূপটা দেখতে আমার ভালো লাগত। যদি কখনো কোনো কারণে মনমরা বা উদাসীন থেকে আমাকে একবারও ছুঁয়ে দেখতে চাইত না, ওতেই বরং আমি বিরক্ত হতাম; এটা-সেটা বলে বা করে প্রকাশও করতাম।
তাকে আমি আশফাকভাই বলেই ডাকি। যদিও সে বলতে বলতে হয়রান হয়ে গেছে, তাকে ছোট কোনো নামে ডাকতে, যেমন সে তার প্রেমপত্রগুলোতে আমাকে সোনাবউ বলে লেখে আর কখনো কখনো প্রচ- আবেগের মুহূর্তে ডেকেও ফেলে। আমিও চিঠিতে তাকে মেরি জানেমান বা জানু বলে লিখি, কিন্তু ডাকার সময় সোজাসাপটা ওই আশফাকভাই! কারণ, আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারটা এখনই জানাজানি হয়ে যাক তা আমরা কেউই চাই না। এই সবার চোখের আড়ালে সবাইকে খানিকটা বোকা বানিয়ে নিজেদের মতো করে চুপিচুপি প্রেম করার মধ্যে একটা আলাদা মজা আছে। কখন ওরকম ভালোবাসার নামে কারো সামনে ডেকে বসব! এক বিচ্ছিরি ব্যাপার হবে। তার চেয়ে এই সাবধানতা ভালো।
তবে সবার চোখে ধুলা দিতে চাইলে হবে কেন। আগেই যে বলেছি, আমাদের ব্যাপারটা আসলে মনে হয় দুই পরিবারের প্রত্যেকেই জেনে গেছে। কিন্তু যেহেতু আমরা নিকট-আত্মীয়, সেজন্য এটা নিয়ে এখনই তেমন কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করছে না। অন্তত আমাদের দুজনার তাই ধারণা। মুরব্বিরা ভাবছে, অল্প বয়স, বয়সের রোগ, কিছুদিন পর এমনি এমনি মোহ কেটে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
জানাজানির ব্যাপারটা সেদিন খানিকটা পরিষ্কার হলো যখন আম্মার সঙ্গে মোনা ফুপু, অর্থাৎ আশফাকভাইয়ের আম্মাকে এ-বিষয়ে গুজগুজ করতে শুনলাম।
‘ভাবি, রুপার বিয়ার একটা বন্দোবস্ত করো। আশফাক তো অস্থির হইয়া পড়ছে। এতটুকুন পোলা, এখনো কলেজ পাশ দিলো না, কয় এখুনি বিয়া বসব। আমি কই, বাপ, রুপার তো ম্যাট্রিকটা পাশ করন লাগে। হে কয়, হ, করবোনে, বিয়া কইরাই পাশ করব, আমিই ওরে পড়া দেখায় দিমুনে, এখন খালি প্রেম-প্রেম কইরা ওর পড়ালেখাই হইতাছে না। আবার ওর মনটাও কেমুন জানি উড়াউড়া লাগে। কোনদিন কার লগে ভাইগা যায় তার ঠিক নাই। তুমি, আম্মা, আব্বারে একটু বোঝাও। রুপা আমার কাছে আসুক। বিয়াও হইল, পড়াও হইব, আমরাও নিজেরা নিজেরা একলগে থাকলাম। তুমি জানো না, কত পোলা ওর জন্য সারাদিন বাসার সামনে ঘুরঘুর করতাছে। কম বয়স, কখন কী কইরা বসে। তোমার দোহাই লাগে, আম্মা, একটা কিছু করো। পোলা এসব কয়, ভাবি। আমি তো মহামুসিবতে পড়ছি।’
ফুপুর এই কথাগুলা আমি কান খাড়া করে শুনি আম্মাদের শোবার ঘরের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে। আশফাকভাই আমাকে নিয়ে এত চিন্তা আর দুশ্চিন্তা করে জেনে একই সঙ্গে ভালোও লেগেছে, আবার বেশ কিছুটা রাগও হয়েছে। রাগ হয়েছে আমার ওপর তার বিশ্বাসের নড়বড়ে অবস্থা দেখে। এটা ঠিক, আমাকে অনেক ছেলে পছন্দ করে; আমার সঙ্গে প্রেমের খেলা খেলতে চায়, ভাব-ভালোবাসা করতে চায়; কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে এটা-ওটা কম দামি-বেশি দামি গিফটও পাঠায়। কিন্তু এসব ব্যাপারে আমার তো তেমন কিছু করার নাই। সুন্দর চেহারা-সুরত থাকলে সব মেয়েকেই এ-ধরনের ঝামেলা-উৎপাত সহ্য করতে হয়, হবে। এজন্য বড়পার মতো আমাকেও আব্বা হয়তো তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেওয়ার আয়োজন করবে। মোনা ফুপুর কথা আব্বার কান পর্যন্ত গেলেই হয়েছে, সব প্রেম-প্রেম খেলা খতম। এ নিয়ে আমার কী করা উচিত কিছুই ভাবতে পারি না। কেবল একটা ভাবনাই কাবু করে ফেলে, বিয়ে কি শেষ পর্যন্ত আশফাকভাইয়ের সঙ্গে হবে?
ছাদের যে-দিকটায় একটু আবছা অন্ধকারমতো, জ্যোৎস্না যেখানে সবটুকু আলো ছড়াতে পারেনি, ওদিকটায় গিয়ে আমার জানেমান একটু নিচের দিকে ঝুঁকে কী যেন দেখল। হাতে আরেকটা সিগারেট ধরিয়েছে। আমি তার পাশে গিয়ে শরীর ঘেঁষে দাঁড়াতে খালি ডান হাতটা দিয়ে সে আমার কোমড় জড়িয়ে ধরে আরো কাছে টেনে নিল। তার আদর করার এই বিশেষ ভঙ্গি আমার এত ভালো লাগে! আর তখন প্রিয় ডেনিম ওডিকোলনের গন্ধটা নাকে এসে ঝাপটা দিয়ে স্নায়ুটাকে খানিক পরিমাণ অবশ করে দিলো। আমি পছন্দ করি বলে দিনের পর দিন ওই একই ওডিকোলন সে মেখে যাচ্ছে। এত ভালোবাসে আমাকে!
তাকে একবার আড়চোখে দেখে নিয়ে বললাম, ‘শোনো, ওই যে জামালটারে চেনো না, মোড়ের দোকানে দাঁড়ায়ে সিগারেট টানে আর আমাদের ব্যালকনির দিকে সারাক্ষণ ড্যাবড্যাব করে তাকায়ে থাকে কখন আমি বারান্দায় আসব আর আমাকে দেখেই বেহায়ার মতো সিটি বাজাবে?’
‘হঠাৎ ওই রাস্তার পোলার এত লম্বা ফিরিস্তি দিতে হচ্ছে কেন?’
‘ওই তো হলো, জামাল সেদিন আমাকে এত খারাপ একটা কথা বলছে যে, আমি মুখেও আনতে পারব না!’
‘কী বলছে ওই মাদার-সান?’ (এটা তার অতি ইন্টেলেকচুয়াল এক বন্ধুর একটা বাংলা গালির বিশেষ ইংরেজি পরিভাষা। তাদের বন্ধুদের আরো এরকম নানা পরিভাষা এবং সাংকেতিক কোড আছে। যেমন, আড্ডার মধ্যে কারো পানির বেগ প্রবল হয়ে উঠলে বলবে, যাই গা, একটু মোতালেব কইরা আসি। তার কাছ থেকে তার বন্ধুদের এ-ধরনের মজার বাক্যালাপ শুনে হাসতে হাসতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসার জোগাড় হয়। কিন্তু তার এখনকার শক্ত হয়ে যাওয়া চোয়াল দেখে আমার আর হাসি পেল না।)
‘না, তোমারে বলা যাবে না। শুনলে তোমার রাগ হবে। শেষে আবার তার সঙ্গে গিয়ে হাঙ্গামা-হাতাহাতি করবা, সবাই জানতে পারলে একটা লজ্জার ব্যাপার হয়ে যাবে। (হাতাহাতির কথাটা এমনি বলার জন্য বলা; সে এটা কখনো করবে না। তার স্বভাবে এরকম কিছু নেই। কিন্তু ভীষণ অভিমান করতে পারে আর রেগে যেতে পারে প্রচ-। রেগে গেলে দু-এক রাত ভাত না খাওয়ার রেকর্ডও আছে।)
‘ওর নাম শুনেই তো আমার মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে। কী বলছে, বল না?’ (আমি এখন তার প্রেমিকা হলেও ছোটবেলা থেকে তুই করে বলে আসছে বলে এখনো তাই বলে যাচ্ছে এবং বিয়ের পরও নাকি তাই বলবে। সে এরকমটা শিখেছে ফুপার কাছ থেকে। ফুপার কথাবার্তার স্টাইল অনেকটা এরকম : ‘ওই নবাবের বেটি, এদিকে আয়, পাটা টিপা দিয়া যা, কখনো তারে না ডাকলে কাছে পাওন যায় না।’ যদিও আশফাকভাই ফুপার মতো এতটা খবিশমার্কা না। তবে বাপের কিছু দোষ-গুণ ছেলে তো পাবেই। তা পাক, তুই তুই করে বলতে চায় বলুক। কিন্তু ফুপার আরেকটা মারাত্মক দোষের কথা নিয়ে যে বড়দের মধ্যে কানাঘুষা করতে শুনেছি ওরকম যেনটা আবার না থাকে। ফুপার নাকি মেয়েমানুষের বাতিক আছে। এজন্য ফুপু ঘরের কাজে কোনো মেয়ে রাখতে পারে না। একবার নাকি একজনের পেটে বাচ্চাই চলে আসছিল। অনেক দেন-দেরবারের পর সেই ফাঁড়া কেটেছে। আশফাকভাইয়ের মধ্যে সেরকম কিছু আছে বলে এখনো দেখা বা শোনা যায়নি। সে তো আমি বলতেই ফিদা। কিন্তু ওই ধরনের দোষ থাকলে তো সর্বনাশ! যদিও এসব নিয়ে আমাদের তখন পর্যন্ত কোনো কথা হয়নি। তবে মাঝেমধ্যে আশঙ্কা হয়, বাবার বদ-অভ্যাসের কারণে আবার আমাদের সম্পর্কটা শেষ পর্যন্ত ভেস্তে যাবে না তো? কে জানে!)
এসব বিচিত্র ভাবনা মাথার মধ্যে কিলবিল করাতে তার প্রশ্নের জবাব দিতে কিছুটা দেরি করে ফেললাম আর তাতেই সে রেগে অস্থির হয়ে গেল।
‘তুই যদি না বলিস, তাহলে কিন্তু আমি সোজা গিয়া ওই হা…জাদার কলার চাইপা ধরব।’
‘আরে ধুর, বাদ দাও। তেমন সিরিয়াস কিছু না। আমি এই পাড়ার বিশ্বসুন্দরী না? আমাকে এসব কথা তো কতজনেই বলে, বলবে? সবার কথা ধরলে চলবে?’
আসলে আমি এখন আর আশফাকভাইকে জামালের বলা ওই খারাপ কথাটা বলতে চাচ্ছি না। জামালের নাম শুনেই ভ্রƒ-কপাল কুঁচকে মুখের যে চেহারা সে বানাল তাতে আমার ভয় হলো, কথাটা শুনে সত্যি সত্যি না গিয়ে তার কলার চেপে ধরে। তারপর শুরু হবে যত ঝক্কি আমাকে নিয়ে। এই বারান্দায় যাওয়া বন্ধ তো কয়েকদিন স্কুল কামাই, কয়েকদিন সারাক্ষণ সবার নজরে নজরে থাকা। এমনিতেই আমাকে নিয়ে আব্বা সারাক্ষণ ভীষণ দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকে, কোনদিন জানি তার মেয়েটারে কেউ পটিয়ে অথবা তুলে নিয়ে যায়। তাই বলব বলব করেও শেষ পর্যন্ত আমি আশফাকভাইকে জামালের কথাটা আর বলি না। সেদিন এরপর আমরা আর বেশিক্ষণ ছাদে ছিলাম না। ভাত খাওয়ার জন্য আম্মা আমাদের নাম ধরে ডাকতে থাকলে আমরা আলাদা হয়ে একেকজন করে ছাদ থেকে নিচে নেমে আসি। কথাটা বলিনি বলে আশফাক ভাই শেষ মুহূর্তে আমার সঙ্গে কিছুটা বাজে ব্যবহার করল এবং গালি দিলো।
‘তোরই তো স্বভাব খারাপ। জামালের আর কী দোষ। সারাক্ষণ সিনেমার নায়িকাদের মতো সাজুগুজু করে বারান্দায় দাঁড়ায় থাকিস কখন কোন ছেলে কী বলে শোনার আশায়। তুই কার সাথে কখন কী করে বেড়াস, কোথায় কোথায় যাস আমি কি ভাবছিস কিছুই জানি না? সব জানি, সব বুঝি, তারপরও কিছু বলতে পারি না। ভাবি, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে যখন তুই আমার ভালোবাসার মর্ম বুঝতে পারবি। আমার ভালোবাসাই তোরে ওইসব কিছু থেকে আমার কাছে ফিরায়ে আনবে। কারণ আমার ভালোবাসায় তো কোনো খাদ নাই, কোনো ভেজাল নাই। ভালোবেসে কেবল তোরেই চাইছি, বিনিময়ে তোর ভালোবাসাটুকুই চাইছি, আর তো কিছু চাইনি, চাই না…।’
সেদিন আশফাকভাইয়ের কথা শুনে মনে মনে আমি চমকে উঠেছিলাম। যদিও আমার চেহারায় বা আচরণে সেটা প্রকাশ হতে দিইনি। তাহলে কি সে শিশিরের কথা জেনে ফেলছে? আমি যে এখন প্রায়ই স্কুল ফাঁকি দিয়ে শিশিরের সঙ্গে দেখা করি, ওর হোন্ডায় চড়ে ঘুরতে বের হই, ওদের বাসার ছাদের চিলেকোঠায় গিয়ে ওর সঙ্গে শুয়ে থাকি, সব জেনে ফেলছে? আম্মার শরীরটা খারাপ যাচ্ছে বলে বেশ অনেকদিন আর আমাকে স্কুলে আনা-নেওয়া করতে পারে না। এর মধ্যে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড জুলিয়ার জন্মদিনে ওর বড়ভাইয়ের বন্ধু শিশিরের সঙ্গে পরিচয়। দেখতে দারুণ হ্যান্ডসাম, বাপের অনেক টাকা, আমাকে বলছে আমি রাজি থাকলে কালকেই আমাকে রানীর মতো করে সাজিয়ে বিয়ে করে নিয়ে যাবে। তার দিওয়ানা ভাব দেখে আমি বেশি কিছু বলিনি; শুধু বলেছি, আরেকটু সময় যাক। আশফাকভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারটা পুরোটাই চেপে গেছি। ভাবছি, নিজে থেকে কিছুই বলব না; যদি অন্য কোথাও থেকে জেনে কিছু জিজ্ঞেস করে, কী বলব তাও ভেবে ঠিক করাই আছে। ওই কথা যা আমি একই ধরনের প্রশ্নের জবাবে আশফাকভাইকে বলে থাকি।
এর মাঝে আমার শরীরের মধ্যে কিছু একটা ঘটছে আমি টের পাচ্ছি। দু-মাস ধরে পিরিয়ড হয় না। কাউকে কিছু বলতেও পারছি না। এর আগে একবার এরকম হয়েছিল। আম্মা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার পর কী একটা সিরাপের মতো ওষুধ খেলাম, সবকিছু ঠিক হয়ে গেল। কিন্তু এবার তো মনে হচ্ছে অন্য কিছু। আমার মনে একটা শিরশিরে শঙ্কা, একটা নাম-না-জানা ভয় নড়েচড়ে উঠছে। সেদিন শিশিরকে একটু বলতে গেলাম। কোনো গুরুত্বই দিলো না সে আমার কথায়। যেমনটা কাছে পেলেই করে, সোজা আমাকে বিছানার ওপর জোর করে চেপে ধরে বলল, ‘ও কিছু না ডার্লিং, সময় হলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে সব পরিষ্কার করে আনব। আর তুমি যদি বলো, আজই তোমাদের বাসায় প্রস্তাব নিয়ে যেতে পারি, কিন্তু তুমি তো রাজি হচ্ছো না। তাতে সবদিকই ঠিক থাকত।’
আমি, রুপা, পাড়ার বিশ্বসুন্দরী, একটা ধন্দের মধ্যে, ভীষণ রকম একটা গোলকধাঁধার চক্করে পড়ে যাই। কী করব এখন, কার সঙ্গে এগুলো শেয়ার করব। মেজোপা শ্বশুরবাড়ি; আম্মা অসুস্থ; বড়পার সঙ্গে টেলিফোনে বা তার বাড়ি গিয়ে এসব আলোচনার কোনো সুযোগই নাই। আমার সব কথা তো আশফাকভাইয়ের সঙ্গে। আমি কি তাকে একবার ফোন করে বাসায় আসতে বলব? সব শুনে সে আমার গলা টিপে ধরবে না তো? আমার মাথাটা এমন ঘুরছে আর পেটটা এমন গোলাচ্ছে। নাহ্, আর সহ্য করা যাচ্ছে না। আশফাকভাই-ই আমার শেষ ভরসা; তার কাছেই আমাকে সব খুলে বলতে হবে। আমি তার পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে নেব। আমি তো আসলে তাকেই ভালোবাসি। আবার শিশিরের ভালোবাসাও এমন যে, তাকেও আমি উপেক্ষা করতে পারছি না। কিন্তু আমার তো যে-কোনো একজনকে বেছে নিতে হবে, যে-কোনো একজনকে –
আশফাকভাইকে যখন ফোনটা করলাম, তার কণ্ঠস্বরটা মনে হলো একটা গভীর খাদের তলা থেকে ভেসে আসছে। কিছুটা জড়তামাখা তার কথাগুলোর অর্থ আমি ঠিক বুঝতে পারি না।
‘কে রুপা, কোন রুপা, আমি কোনো রুপা-টুপাকে চিনি না। যাকে চিনতাম সে তো এখন…।’ একটা চাপাকান্নার মতো ক্ষীণ আওয়াজ তার গলায়।
‘এসব কী বলছ আশফাকভাই, আমি রুপা, তোমার সোনাবউ রুপা। এখন একবার বাসায় আসতে পারবা? তোমাকে খুব দরকার আমার, খুব…।’
‘দরকার? আমাকে দরকার? কেন রে, তোর কি দরকারের লোকের, পেয়ারের লোকের অভাব আছে?’ বলেই ফোনটা খটাশ করে রেখে দিলো সে। আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে।
একদম চুপসে গেলাম। আশফাকভাইয়ের গলাটা কেমন অস্পষ্ট শোনাল, কেমন যেন অসংলগ্ন আর এলোমেলো তার বলা
কথাগুলো। তাকে আমি আগে কখনো এভাবে কথা বলতে শুনিনি। তবে কী সে সবকিছু জেনে গেছে? সেদিন ছাদ থেকে নামার সময় রেগে গিয়ে যে-কথাগুলো বলেছিল তাতে মনে হচ্ছিল, কিছুটা হলেও সে আন্দাজ করতে পেরেছে। আর এখন যা বলল, তাতে তো কোনো সন্দেহ নাই যে, তার আর কোনো কিছুই জানতে বাকি নেই।
ফোনটা রাখতে না রাখতেই বেজে উঠল। মোনা ফুপুর তীক্ষ চিৎকার অপর প্রান্তে।
‘ওরে তোরা আমার পোলাটারে বাঁচা, একগাদা ঘুমের বড়ি গিলা ফেলছে, মুখ থিকা খালি গ্যাজা বাড়াইতেছে। ওরে আমার বুকের ধনটারে বাঁচা রে…।’