কেউ শোনে না তার কথা

কেউ শোনে না তার কথা
মা! মা! দ্যাখো, দ্যাখো, আমি কথা বলতে পারি।” চিৎকার করে বলতে বলতে দৌড়ে এসে রান্নাঘরে ঢুকলো আলিফ। মুখে আকর্ণ হাসি ফুটিয়ে মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো সে। অপূর্ব আনন্দের উচ্ছ্বাসে ওর নিষ্পাপ চেহারা আলো-ঝলমল করছিলো। ও আবার বললো, মা দ্যাখো, আমি কথা বলতে পারি! ওর মা এই কথা শুনে ওর দিকে এমনভাবে তাকালো যে, এই খবরে সে খুশি হতে পারেনি। যেন সতীনের বোবা ছেলের কথা বলার সুখবর শোনানো হয়েছে তাকে। আর এই কারণে তার উজ্জ্বল মুখখানা বিষাদের অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। আলিফ মায়ের এই অভিব্যক্তি দেখে কেমন থমকে গেলো। সহসা নিভে গেলো ওর চোখের আলো। নিমিষেই উধাও হয়ে গেলো মুখের হাসি। ওর চেহারায় ফুটে উঠলো স্পষ্ট হতাশার ছাপ। পূর্ণিমার চাঁদ যেনো হঠাৎ ঢাকা পড়ে গেলো ঘনকালো মেঘের আড়ালে।
মায়ের এই অবস্থা দেখে আলিফ ভাবলো, মা হয়তো কোন কারণে রেগে আছে। তাকে এখন বিরক্ত করা ঠিক হবে না।
ওখানে আর দাঁড়ালো না আলিফ। ধীর পায়ে বেরিয়ে এলো রান্নাঘর থেকে। আলিফ ঠিক করলো, এখন বাবার কাছেই যাবে। তার কাছেই বলবে ওর কথা বলতে পারার সুখবর। তারপর বাবার সাথে প্রাণ খুলে গল্প করবে। এত দিনের জমানো মনের কথা ব্যক্ত করবে। ছোট্ট ছেলে আলিফ। ৬ বছর বয়স। সর্বদা হাস্যোজ্জ্বল মুখ। টানা টানা চোখ। কী মায়াকাড়া সেই চোখের চাহনি! সবাই ওকে ভালোবাসে। কিন্তু একটাই দুঃখ ওর মনে। ও কথা বলতে পারে না। সৃষ্টিকর্তা ওকে ধরায় পাঠিয়েছে বোবা বানিয়ে।
আলিফ সবার সাথে প্রাণ খুলে মনের কথা বলতে চায়। অন্যান্য শিশুদের মতো মা-বাবার কাছে এটা- ওটা বায়না ধরতে চায়। কিন্তু আলিফের বাবা ছাদের কিনারায় রেলিং এর উপর হাত রেখে দাঁড়িয়েছিলো। নীচের দিকে তাকিয়ে একমনে কী যেন দেখছিলো। আলিফ ধীরে ধীরে বাবার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। কতক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল ওখানে। দেখলো বাবা ওর এখানে আসাটা ঠিক আমলে নিচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর ও আস্তে করে বললো, বাবা, শোনো, আমি কথা বলতে পারি! বাবা ওর কথা শুনে চট্ করে ওর দিকে ফিরলো। মনে হলো এই খবর শুনে সে চমকে উঠেছে। সে কেমন শঙ্কিত দৃষ্টিতে আলিফের দিকে তাকালো।
আলিফ ভেবেছিলো ওর কথা বলতে পারার খবর শুনে বাবা অনেক খুশি হবে। আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠবে। ওকে কোলে তুলে দু’হাত দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরবে। কপালে- দুই গালে চুমু খাবে। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। এই অবস্থা দেখে আলিফের চোখে পানি এসে পড়লো। ও আর এক মুহূর্তও ওখানে দাঁড়ালো না। দৌড়ে ছাদ থেকে নেমে এলো। আলিফ ভেবে পাচ্ছে না, এমন কেন হচ্ছে। ও কথা বলতে পারে দেখে ওর মা-বাবার আনন্দিত হওয়ার কথা। কিন্তু তা তো হচ্ছেই না। বরং তাদের চোখে-মুখে কেমন ভয়ের চিহ্ন ফুটে উঠছে। ওর মা-বাবা যে ওকে ভালোবাসে না, এমনও তো না। আরো বাবা ওকে একটু বেশি ভালোবাসে। তাহলে ওর কথা বলতে পারার খবর শুনে তারা এমন কেন করছে!
আলিফ ভাবলো, আচ্ছা, আমি কি এমন কিছু জানি, যা আমি কথা বলতে পারলে ফাঁস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে! অনেক ভেবেও সে এমন কোন গোপন কিছুর কথা মনে করতে পারলো না। ‘আচ্ছা তাহলে স্কুলবন্ধুদের কাছেই যাই। ওরা হয়তো এই খবর শুনে খুশি হবে’, মনে মনে ভাবলো আলিফ। ও যে প্রতিবন্ধীস্কুলে পড়ে, সেখানের সবাই কথা বলতে পারে। বাকপ্রতিবন্ধী শুধু সে একা। অনেকে এটা নিয়ে ওকে ব্যঙ্গ করতো। আলিফ ভেবে খুশি হলো, ও এখন কথা বলতে পারে। ওকে নিয়ে কেউ আর হাসি-তামাশা করতে পারবে না। স্কুলে গিয়ে আলিফ দেখলো,‌ পাঁচ- ছ’জন বন্ধু গোল হয়ে দাঁড়িয়ে কী যেন বলাবলি করছে। ওরা ছাড়া স্কুলে আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না। আজ স্কুলের পরিবেশটাও কেমন থমথমে- ভীতিকর মনে হচ্ছে।
আলিফ কী মনে করে আকাশের দিকে তাকালো। মেঘে মেঘে ছেয়ে গেছে আকাশ। সূর্য ঢাকা পড়েছে মেঘের আড়ালে। চারিদিকে আবছা অন্ধকার। কিন্তু আলিফ আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলো, কীভাবে যেন মাটিতে ওর ছায়া পড়ছে! আলিফ ধীরে ধীরে ওর বন্ধুদের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। ওকে দেখে ওর বন্ধুরা সবাই ওর দিকে ফিরে তাকালো। আলিফ মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে ওদেরকে লক্ষ্য করে বললো, জানিস, আমি কথা বলতে পারি! বন্ধুরা এই কথা শুনে চমকে উঠলো। ওদের চেহারায় ফুটে উঠলো আতঙ্কের ছাপ। ভয়ে ওরা কয়েক পা পিছু হটে গেলো। বড়ো বড়ো চোখে তাকিয়ে রইলো আলিফের দিকে। ওরা এমন ভাব করতে লাগলো, যেন ওদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কোন আজব চিড়িয়া।
ওদেরও এই অবস্থা দেখে আলিফ অনেক কষ্ট পেলো। ওর অন্তরে কে যেন হাতুড়ির আঘাত করতে লাগলো। ওর ছোট্ট হৃদয়খানি ভেঙে খানখান হয়ে গেলো। বুক ফেটে কান্না আসতে লাগলো ওর। আলিফ আর এক মুহূর্তও ওখানে দাঁড়াতে পারলো না। পেছন ফিরে এক ছুটে বাড়ি চলে আসলো। বাড়ি এসে সোজা পুকুর-ঘাটে চলে গেলো আলিফ। ওখানে দাঁড়িয়ে দুই হাত দিয়ে চোখ-মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো ও। ওর চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু কী এক অদ্ভুত কারণে চিৎকার করতে পারছে না। আলিফ ভেবেই পাচ্ছে না এসব কী হচ্ছে। কেন হচ্ছে। ও ভেবেছিলো সবাই ওর কথা বলতে পারার খবর শুনে অনেক খুশি হবে। কিন্তু সবাই এমন ভাব করছে, যেন কথা বলতে পেরে ও বড়ো অপরাধ করে ফেলেছে। ও ভাবলো, এর চেয়ে বোবা থাকাই তো ভালো।
হঠাৎ আলিফ শুনলো, খড়ের কাছে বাঁধা গরুটা হাম্বা করে ডেকে উঠলো। যেন আলিফকেই ডাকলো। ও ধীরে ধীরে গরুটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। ওটার মাথায় কতক্ষণ হাত বুলিয়ে দিলো। আলিফ গরুটাকে লক্ষ্য করে দুঃখভরা কণ্ঠে বললো, কেউ আমার কথা শুনতে চায় না। সবাই আমাকে কেমন ভয় পায়। এখন থেকে তুই আমার বন্ধু। তোর কাছেই বলবো আমার মনের কথা। কি, শুনতে চাস? গরুটা মাথা নাড়লো। যেন আলিফের দুঃখ সে বোঝে। সে আলিফের মনের কথা শুনতে চায়। আলিফ উৎসাহিত কণ্ঠে বললো, জানিস, আমি আগে কথা বলতে পারতাম না। এখন আমি কথা বলতে পারি! আলিফ এই কথা বলার পরই গরুটা হাম্বা করে ডেকে উঠে শিং বাগিয়ে ওর দিকে তেড়ে এলো। ভাবখানা এমন, কী তুই কথা বলতে পারিস? তাহলে আয়, তোরে‌ একটা গুঁতো দিয়ে দিই!
গরুটাকে এভাবে তেড়ে আসতে দেখে ভড়কে গেল আলিফ। একদিকে ফিরে উর্দ্ধশ্বাসে দৌড় দিলো হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেলো আলিফের। চারিদিকে ভয়াবহ অন্ধকার। কোথাও একটু আলো নেই। ও ভীষণ ভয় পেয়ে গেলো। ভয়ে ওর বুক ধুক্ ধুক্ করে কাঁপতে লাগলো। ও প্রাণপণে চিৎকার করে ডেকে উঠলো মাআআ…! কিন্তু ওর গলা থেকে কোন আওয়াজ বের হলো না।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত