দৃশ্য -অদৃশ্য

দৃশ্য -অদৃশ্য
ঠিক এই মুহূর্তে একটা গাড়ি ফুড়ুৎ শব্দ করে পাশ কেটে গেলো। সাধারণত গাড়ি পাশ কাটার সময় ‘পুশশ’ কিংবা ‘হুশশ’ টাইপের শব্দ হয়। ‘ফুড়ুৎ’ হয়না! ফুড়ুৎ করে পাখি উড়ে যায়। গাড়ি পাখি নয়। ড্রাইভার সামনে তাকিয়ে ওভারটেক করা পাখি টাইপের কালো গাড়িটার লাইসেন্স প্লেটে চোখ রেখে ঠোঁট বাঁকিয়ে নিচু স্বরে কিছু একটা বিড়বিড় করলো। পেছন থেকে মিষ্টি একটা কন্ঠস্বর বললো,
— খলিল। তুমি কি ওভারটেক করা গাড়ির ড্রাইভারকে আবারো গালি দিয়েছো? ড্রাইভারের নাম সম্ভবত খলিল। কারণ সে দ্রুত অসহায় চোখ করে গলার স্বরভর্তি কাতরতা নিয়ে মিথ্যে বললো,
— আপামনি। অসম্ভাব! আমি আর গালি.. দুইটা আলাদা জিনিস। একটার লগে একটার জিন্দেগীতে ও দেখা হয় নাই। আপনে জানেন এইটা। আমার নাম খলিল না, জলিল। এইটাও আপনে জানেন। তবুও বারবার খলিল কন। আপামনি, পনরো বৎসর ধইরা শেষ বাক্য শেষ করতে পারলোনা, তার আগেই জলিলের চোখে জল জমলো। কথা বলতে বলতে জলিল খুব দ্রুত চোখে জল জমাতে জানে। চোখে দ্রুত জল জমাতে শিখেছে সে তার বড় ভাই থেকে। বড় ভাই টেকনিক শিখিয়ে দিয়েছিলো পনেরোটা। তারমধ্যে এইটা এক নাম্বার। দুই নাম্বার হচ্ছে, ‘এতো বৎসর ধইরা গাড়ি চালাই আপনাগো…!’
যেকোনো সমস্যা- ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অপরাধ মাফ কিংবা সমাধানে টেকনিক গুলো কাজে আসে। যেমন এখন এলো। জলিল স্পষ্টই গালি দিয়েছিলো ঐ হারামজাদাটারে। গাড়ি ওভারটেক কে র্যাংকিং ভাবতে ভালোবাসে ড্রাইভার রা। কেউ ওভারটেক করলে র্যাংকিং এর অবনতি হয়। জলিলের গালি অস্পষ্ট ভাবে শুনেছে আপামনি, কিন্তু চোখের জলে বিব্রত ও হয়েছে এইমাত্র। জলিল মনে মনে হাসলো। বেঁচে থাকলে বড় ভাইজানের পায়ের ধুলো নিতো সে। পেছনের আপামনির চেহারাটা কন্ঠস্বরের মতোই ভীষণ মিষ্টি। বড় বড় চোখ, চোখভর্তি ঘুম। যে কেউ প্রথম দেখায় বলবে, ইনার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। অথচ তা না। আপামনির চোখ দু’টোই এমন। মানুষ বিভ্রান্ত হয়। আপামনি ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করে।
আপামনির হাতে একটা বই। ‘মনের মতো মন!’ সমরেশ মজুমদার। আপামনি একা নন। আপামনির পাশে একজন মহিলা সিটে হেলান দিয়ে নির্বিঘ্নে ঘুমোচ্ছেন। শুধু আজকের দিন নয়, এ সপ্তাহে ও তার ঘুম ভাঙ্গবে বলে মনে হচ্ছেনা। ড্রাইভার জলিল গাড়ির গতি সামান্য বাড়ালো। গাড়ি নির্দিষ্ট কোনো জায়গায় যাচ্ছেনা। তাই তাড়াতাড়ি পৌঁছার তাড়া নেই। তবুও গাড়ির গতি বাড়িয়ে জলিল পেছনে তাকিয়ে ‘পড়ন্ত’ আপামনি এবং ঘুমন্ত ভদ্রমহিলাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— গান দিই?
আপামনি মাথা নাড়লো, মাথা নাড়ার মানে হচ্ছে, গান বাজালেও বাজাতে পারো, না বাজালেও না। ভদ্রমহিলা বেঘোরে ঘুমোচ্ছেন। আপামনি বইয়ের পাতা উল্টালো। গানের আওয়াজ কানে যেতেই ভদ্রমহিলা তড়াক করে ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠে বললেন,
— তিথি.. তিথি। আপামনির নাম সম্ভবত তিথি, কেননা সে দ্রুত ভদ্রমহিলার হাত চেপে ধরে জিজ্ঞেস করলো,
— কি.. কি হয়েছে আম্মু? এইতো আমি।
— কিছুনা। খলিল হুট করে গান চালিয়েছো কেন?
আর এতো আস্তে গাড়ি চালাচ্ছো কেন? একটু আগে দেখলাম সাইকেল একটা ওভারটেক করে গেলো ভদ্রমহিলা মিথ্যে বলছেন। তিনি একটু আগেও ঘুমোচ্ছিলেন। জলিল গান বন্ধ করে আগের মতো দ্রুত চেহারায় অসহায়ত্ব আর গলার স্বরভর্তি কাতরতা এনে বললো,
— ম্যাডাম। জলিল। খলিল না, জলিল। পনরো বৎসর ধইরা আপনাগো গাড়ি চালাই.. তবুও পত্যেকদিন নাম ভুইলা যান। কষ্ট পাই। স্যার কিন্তু কোনো দিন ও ভুলেন না তিথির আম্মু ভয়ানক চটে গেলেন স্যারের কথা শুনে। গলার স্বর সামান্য উঁচু করে বললেন,
— শুনো খলিল..! আমি যখন গাড়িতে উঠবো, নামার আগ পর্যন্ত স্যারের নাম মুখে আনবানা। শুধু নাম নয়, ফোন ও ধরবানা তার। ইজ ইট ক্লিয়ার খলিল? জলিল মাথা নাড়লো, এবারও তাকে খলিল ডাকা হয়েছে। আগেরবার ভুল করে হলেও এবার ইচ্ছে করেই দু’বার খলিল ডাকা হয়েছে। ম্যাডামের সামনে ম্যাডামের সাথে স্যারের তুলনা করে কথা বলার শাস্তি এটা! স্যারের প্রতি একগাদা রাগ- ক্ষোভ- অভিমান পুষে রাখেন ম্যাডাম। অথচ জলিল জানে, পৃথিবীতে স্বামী- স্ত্রীর যে কয়টা চমৎকার ভালোবাসার সম্পর্ক আছে, তার মধ্যে ইনাদেরটা একটি। সন্ধ্যে হয়ে আসছে, জলিল গাড়ির গতি আরেকটু বাড়ালো। তবে অল্প কিছুদুর যেতেই কমাতে হলো। রাস্তার পাশে কেউ একজন এক হাত তুলে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে, লিফট চাইছে। জলিলের থামার ইচ্ছে ছিলোনা, থামতে হলো। হাসিমুখে কাউকে লিফট চাইতে দেখা যায়না। ম্যাডাম কৌতুহলী হয়েছেন। জলিল জানে, ম্যাডামের কৌতুহল ভয়ানক। ম্যাডাম বললেন,
— হাবলা গোছের ছেলেটা নির্ঘাত বিপদে পড়েছে। দেখোতো হাবলা গোছের ছেলেটার গালভর্তি হাসি। গাড়ি থামিয়ে কাঁচ নামাতেই ছুটে এলো, মুখে হালকা দাঁড়ির ছাপ। মায়াকাড়া চেহারা। ছোট করে কাটা চুল। চোখে চশমা। যুবক জানালার কাছে মুখ নামিয়ে মুখে হাসি ধরে রেখে জিজ্ঞেস করলো,
— আপনারা মানুষ তো?
ম্যাডাম হাসলো, এই ছেলে মোটেও হাবলা গোছের নয়। তিথি বই থেকে চোখ তুলে তাকালো ছেলেটির দিকে। ভার্সিটির বইপড়ুয়া সিনিয়র ভাইয়া টাইপের ছেলে, যাদের কাছ থেকে নানাবিধ বই নিয়ে যাওয়া হয়, ফেরত দেওয়া হয়না। এতে ভাইয়ারা রাগ করেন না। জলিল প্রচন্ড বিরক্ত হলো। মুখ কঠিন করে বললো,
 — নাহ। আমরা বান্দর। বান্দর চিনেন? ছেলেটির ঠোঁট থেকে হাসি মুছলোনা, বললো,
— আসলে সেই বিকেল থেকেই দাঁড়িয়ে আছি। জনশূন্য এলাকা এটা। এখানে কেউ কারো নয়! মরে পড়ে থাকলেও কেউ দেখেনা। লিফট চাচ্ছি সে কখন থেকে, কেউ একটা গাড়ি থামালো না। আপনারা থামিয়েছেন। ভাবলাম দেবদূত নয় তো ম্যাডাম জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বললো,
— এই ছেলে, কোথায় যাবে তুমি?
— এইতো সামনে। ত্রিশ মিনিটের পথ।
খলিল পেছনে তাকালো, ম্যাডাম মাথা নাড়লো। জলিল দরজা খুলে দিলো, যুবক ড্রাইভারের পাশের সিটে হেলান দিয়ে বসে লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
— অসংখ্য ধন্যবাদ। আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছেনা আপনারা মানুষ। কোথায় যাচ্ছেন আপনারা? জলিল মুখ কঠিন করে বললো,
— কোথাও যাচ্ছিনা, ঘুরান্টি দিচ্ছি। তুমি আর একটা কথা ও অনুমতি না নিয়ে বলবানা। চুপ থাকবা। ঠিকাছে?
যুবক মাথা নাড়লো। ‘আচ্ছা।’ যুবক অনেকক্ষণ চুপ ছিলো, ম্যাডাম পেছন থেকে জিজ্ঞেস করলেন,
— তোমার নাম কি? যুবক ড্রাইভার জলিলের দিকে তাকালো, তারপর মুখ খুললো,
— অনিকেত। আপনারা? ম্যাডাম কন্ঠস্বর একটু নিচু তবে গম্ভীর করে বললেন,
— আমরা আত্মা। ভুত। যখন বেঁচে ছিলাম একটা পরিচয় ছিলো। এখন নেই। এই হারামজাদা ড্রাইভার গাড়ি একটাকে ওভারটেক করতে গিয়ে এ্যাক্সিডেন্ট করেছিলো। দু’মাস হলো মারা গেছি। যুবক হাসছিলো এতোক্ষণ, চট করে হাসি মুছে গেলো। জলিল ব্যাপারটা ভীষণ উপভোগ করলো। এই অনিকেত না পনিকেত নামের এতো বড় ছেলেটা ও ভুত- প্রেত- আত্মা ভয় পায়। এরে আরেকটু ভয় পাইয়ে দিলে প্রচুর আনন্দ হবে। জলিল গলা খাকারি দিয়ে বললো,
— ম্যাডাম… সামনের গাড়িটারে উড়ায়া দিই?
— থাক এখন না। অনিকেত ভয় পাবে। ও কে নামিয়ে দিয়ে তারপর উড়ায়া দিও। অনিকেত ভয় পাচ্ছো তুমি?
অনিকেত মাথা নাড়লো, ভয় পাচ্ছেনা সে। নির্ঘাত মিথ্যে বলছে। জলিল ব্যাপারটা ভীষণ উপভোগ করলো। এই পোলার বারোটা বাজিয়ে দিবে সে আজ। অনিকেত আর একটা কথাও বলছেনা, তার চোখমুখ শুকিয়ে গেছে। তিথি মায়ের দিকে রাগী চোখে তাকালো। ড্রাইভারের পাশের সিটে বসা হাবলা গোছের ছেলেটার জন্যে মায়া হচ্ছে ভীষণ তার। বই থেকে চোখ নামিয়ে ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— অনিকেত শুনুন.. অনেক আগে একটা বই পড়েছিলাম আমি। ওখানে ফুটন্ত শাপলা ফুলের উপর জোনাকি বসার একটা দৃশ্যের কথা উল্লেখ ছিলো। আমরা শাপলা ফুল খুঁজছি! রাতের বেলা শাপলা ফোটেনা, তবে বিশেষ এক ধরণের শাপলা ফোটে। ‘রাতের রানি’ নাম ওটার। লাল রঙের শাপলা। পাতার রঙ লালচে সবুজ। সারা রাত ফুটে থাকে, সকালের দিকে বুজে যায়। রাতে যখন ফুটে থাকে, জোনাকি কিলবিল করে ফুলের চারোপাশে। শহরে শাপলা নেই, জোনাকি ও হারিয়েছে। তাই ঘুরতে বেরিয়েছি। খলিল অবশ্য এটাকে বলে, ‘ঘুরান্টি দেওয়া!’ আমরা ঘুরান্টি দিচ্ছি।
আমার আম্মুর স্বভাব এমন, প্রচুর ঘুমোতে আর মজা করতে পছন্দ করেন। ভূত- প্রেত বলে পৃথিবীতে কিছু নেই। বুঝতে পেরেছেন? বিশ্বাস না হলে খলিল কে ছুঁয়ে দেখুন অনিকেতের হাত কাঁপছে, কাঁপা কাঁপা হাতে সে জলিল কে ছুঁয়ে দেখলো। তারপর ঠোঁটে আবার হাসি ফিরে আসলো তার। ম্যাডাম কে মুখ টিপে হাসতে দেখা গেলো, তিথি চোখ রাঙিয়ে হাসতে নিষেধ করলো মা কে। জলিলের আবার মন খারাপ হলো, তাকে আবারো খলিল বলা হয়েছে। শহরের এদিকে রাস্তার একপাশে ক্ষেত, অন্যপাশে জঙ্গল। জলিল এরমধ্যে অনিকেত কে আরো কয়েকবার ভয় দেখানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু তিথির রাগী চোখের ইশারায় সেটা এগুলোনা বেশিদুর। অনিকেত একটা গল্প বলছে,
— আমি আত্মা বিশ্বাস করি। তিথি বই বন্ধ করে ফেললো, গাড়ির ম্লান আলোয় বইপড়া কষ্টকর। তারচেয়ে গল্প শুনা যাক। জিজ্ঞেস করলো,
— তাই?
— হুম। স্বচক্ষে দেখেছি।
— স্বচক্ষে আত্মা দেখেছেন?
— হু। রাস্তায় এ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিলো মানুষটার।
একটা ট্রাক বাইক সহ মানুষটাকে উড়িয়ে নিয়ে ফেলে দিয়েছিলো ক্ষেতের পাশে। কেউ ছিলোনা আশেপাশে। দ্রুত ছুটে গেলাম আমি। লাশটা পড়ে ছিলো ধানক্ষেতে, কপালে রক্ত। মাথা ফেটে মগজ বের হয়ে গেছে। লাশের দিকে তাকিয়েই প্রথমবারের মতো বিশ্বাস করি, আত্মা আছে। এক দৌঁড়ে ছুটে আসি ওখান থেকে.।
— কবেকার কথা?
— প্রায় দেড় বৎসর হলো।
রাত বাড়ছে। আট টা বেজে দশ মিনিট। শহরের এপাশ ভীষণ নির্জন। অন্ধকার বেশি, কোনো জলাধার, খাল- বিল না দেখা গেলেও জোনাকি দেখা যাচ্ছে এপাশে। রাস্তায় গাড়ি চলাচল প্রায় নেই বললেই চলে। তিথি জানালার কাঁচ নামানোর চেষ্টা করলো, কাঁচ অর্ধেক নেমে আর নামছেনা। গরম লাগছে তিথির, সাথে প্রচন্ড রাগ ও হচ্ছে এই মুহূর্তে। কাঁচের আবার কি সমস্যা হলো। কয়েকদিন পর পর কিসব সমস্যা হয় জানালার কাঁচগুলোয়। বাবাকে বলতে হবে। আপাতত মাকে বলা দরকার, পাশ ফিরে তাকিয়ে হতাশ হতে হলো ওকে। মা ঘুমিয়েছেন আবার।
হুট করে গাড়ি ব্রেক করায় ঘুম ভেঙ্গেছে তার। জলিল কে কড়া একটা ধমক দিতে গিয়ে দিলেন না তিনি। রাস্তার মাঝখানে কিছু মাঝারি সাইজের গাছের গুড়ি ফেলে রাখা হয়েছে। গাড়ি থামতেই গাড়ি ঘিরে দাঁড়ালো চারটে লোক। লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরা চারজনই স্বাস্থ্যবান। মোটাসোটা লোক। গায়ের রঙ কালো। পেট ভারী হয়ে সামনে ঝুলে পড়ছে চারজনের ই। সবচেয়ে বেশি ঝুলেছে যেটার, সে বোধহয় সর্দার। সর্দার ছাড়া বাকি দুইজনের হাত খালি। সর্দার আর বাকি একজনের হাতে দু’টো ফলকাটার ছোট্ট ছুরি। জলিলের মুখ শুকিয়ে এতোটুকুন হয়ে গেলো। তিথির প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে। ডাকাত দলটাকে দেখে হাসি পাচ্ছে। যদিও এরা চেহারায় জোর করে ডাকাত ডাকাত ভাব আনার বৃথা হাস্যকর চেষ্টা করছে। তাদের লাগছে গোপাল ভাঁড়ের মতো। তিথির আরো হাসি পাচ্ছে অস্ত্র দেখে, ফলকাটার ছোট্ট ছুরি নিয়ে কেউ ডাকাতি করে?
ম্যাডাম জিজ্ঞেস করলেন,
— তিথি, ডাকাত নাকি রে? তিথি হাসি চেপে রেখে বললো,
— হু
— গাড়ির দরজা আটকে বসে থাক। বলদমার্কা ডাকাত! বিরক্ত হয়ে চলে যাবে। আমি ঘুমোলাম। রাস্তা না ছাঁড়লে এইটা নিয়ে ভয় দেখাস.. ম্যাডাম ব্যাগ ইশারা করে দেখিয়ে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়লেন। তিথি অর্ধেক নামানো জানালার কাঁচে মুখ রেখে ডাকাত দলের একজনকে জিজ্ঞেস করলো,
— আংকেল, এদিকে লাল শাপলা ফুল কোথায় ফুটে বলতে পারেন? শুধু ফুল হলে চলবেনা। জোনাকি ও থাকতে
হবে। ডাকাত দলের এই সদস্য হতাশ চোখে গাড়ির সামনে থাকা ডাকাত সর্দারের দিকে তাকালেন, সর্দার হুংকার দিলেন,
— চুপ.. চুপ থাক মাইয়া। তোর ভয় ডর নাই? গাড়ির দরজা খুল যা আছে টাকা পয়সা বাইর কর, নইলে কাঁচ ভাইঙ্গা টাইনা বাইর করুম হগল রে তিথি গলা বাড়িয়ে বললো,
— আরগুলো বাদ দেন, এই কাঁচটা ভাঙ্গেন আগে। এটা আটকে আছে.. নামাতে চাইছি, নামছেনা। রাগ লাগছে..
ডাকাত সর্দার আবার হুংকার দিলেন,
— চুপ.. চুপ থাক মাইয়া। কথা কইবিনা।
জলিল মাথা নিচু করে হাত উপরে করে রেখে দোয়া দরুদ পড়ছে সেই প্রথম থেকেই। দোয়া দরুদে ভয় যাচ্ছেনা। বাড়ছে। ম্যাডামের মৃদু নাক ডাকার শব্দ শুনতে পাচ্ছে সে, এই ভয়ংকর পরিস্থিতিতেও ম্যাডাম আবার ঘুমিয়েছেন।
পুরো গাড়ি ভর্তি এই মুহূর্তে ভয় পাচ্ছে শুধু একজন, সে নিজে। তিথি জানালায় মুখ রেখে ডাকাত দলের শলা- পরামর্শ শুনছে।
অনিকেত চুপ করে আছে, তার মুখে ভয় ভীতি নেই; বিরক্তি আছে। এই ছেলে ভুত ভয় পায়, ডাকাত ভয় পায়না! ডাকাত সর্দারের নাম জানা গেলো। মোতালেব। গাড়ি থেকে দশ- পনেরো হাত দুরে দাঁড়িয়ে মোতালেব দলের বাকি তিন সদস্যের সাথে শলা- পরামর্শ করছে। গাড়িভর্তি চাইরটা লোকের মধ্যে তিনটাই তাদের ভয় পাচ্ছেনা। দরজা ও খুলছেনা। মেয়েটা চটরপটর কথা বলছে, সম্ভবত মেয়েটির মা যিনি, তিনি এখন ঘুমোচ্ছেন। সামনের সিটে হাবলা গোছের একটা ছেলে আরামসে সিটে হেলান দিয়ে বসে আছে। গাড়ি আটকে রেখেছে তাই বিরক্ত ও হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পর জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করছে,
— ডাকাতি শেষ হবে কবে? আমার তাড়া আছে…
মোতালেব জীবনেও এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখে নাই। চাইর চাইরটা ভয়ানক ডাকাত কে পাত্তা দিচ্ছেনা এরা কেউ। শুধুমাত্র ড্রাইভারটা ছাড়া। তারে আরেকটু ভয় পাইয়ে দেয়ার দরকার আছে। ভয় সংক্রামক। একজন পাইলে আরেকজন হুদাই পাইতে থাকে। ডাকাত দলের একটা সদস্য জলিলের দিকে এগিয়ে আসলো। জলিল আড়চোখে ওদিকে তাকিয়ে দোয়া দরুদ পড়ার মাত্রা বাড়িয়ে দিলো। দোয়া দরুদের আওয়াজে ম্যাডামের ঘুম ভাঙ্গলো আবার। ম্যাডাম ঘুম ভাঙ্গা চোখে বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
— খলিল, কি বিড়বিড় করছো তুমি? রাস্তা পরিষ্কার হয়নি এখনো? ডাকাত দলের একজন জলিলের পাশে দাঁড়িয়ে জলিলকে কঠিন মুখ করে কিছু বলার আগেই ম্যাডাম জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ডাকলেন,
— এই বস্তা.. এদিকে আসো তুমি ডাকাত সদস্য ভয় ভয় চোখে একবার ম্যাডামের দিকে তাকালো, আরেকবার সর্দারের দিকে। সর্দারের অনুমতি পেয়ে ম্যাডামের দিকে এগিয়ে গেলো। ম্যাডাম তার ব্যাগ থেকে কুচকুচে কালো রঙের একটা পিস্তল বের করে দেখিয়ে বললেন,
— এটা কি দেখেছো? লাইসেন্স করা। ছয় ছয়টা বুলেট আছে। তোমরা মাত্র চারজন। আমার নিশানা ভালো না। তবে সমস্যা নাই। তোমরা যথেষ্ট মোটা, নিশানা ভুল হবেনা। চোখ বন্ধ করে গুলি করলেও গায়ের যেকোনো একটা অংশে নির্ঘাত লেগে যাবে, কোনো সন্দেহ নেই। পাঁচ মিনিট সময় দিলাম, রাস্তা পরিষ্কার করো। নইলে জৈনেক ডাকাত কিছুক্ষণ ম্যাডামের হাতের কালো অস্ত্রটার দিকে তাকিয়ে রইলো, তারপর কথা শেষ হওয়ার আগে ঘোঁ ঘোঁ শব্দ করে চোখ কপালে তুলে ধপাস করে পড়লো। ম্যাডাম দ্রুত গাড়ি থেকে বের হয়ে মুর্ছা যাওয়া ডাকাতের হার্টবিট চেক করলেন। নাহ। মারা যায় নাই। ডাকাত সর্দার ভ্যাবাচেকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তিথি আর অনিকেত ও নেমে এলো গাড়ি থেকে। সর্দারের দিকে তাকিয়ে হুংকার দিলেন ম্যাডাম,
— মারা যায়নাই, হাসপাতালে নিতে হবে। হা কইরা দাঁড়ায়া আছো কেন বস্তার দল! এসে হাত লাগাও.. গাড়িতে উঠাও বস্তাটাকে। পেছনের তিনটা সিটে চেপেচুপে চারটা বস্তা বসেছে। মুর্ছা যাওয়া বস্তাটার নাম ‘আলাদ্দিন।’ আলাদ্দিনকে বাকি তিনজনের কোলে লম্বা করে শুইয়ে দেয়া হয়েছে। হাসপাতাল এখান থেকে দুর আছে। মোতালেব এখনো ভ্যাবাচেকা খেয়ে আছে। বাকি দু’জন খোদ সর্দারের হকচকিয়ে যাওয়া মুখ দেখে চুপসে আছে। ম্যাডামের আপাতত ঘুম পাচ্ছেনা, তিনি জিজ্ঞেস করছেন,
— মোতালেব? ছেলে মেয়ে কয়টা তোমার? মোতালেব নিচু স্বরে উত্তর দিলো,
— দুইটা।
— পড়াশুনা করে?
— একটারে ভর্তি করাইছি, আরেকটা ছোড।
— কাজ টাজ করো?
— না।
— তা বুঝতেই পারছি। ডাকাতিও তো ঠিকঠাক করতে পারোনা।
মোতালেবের পাশের দুইজন শব্দ করে হেসে দিলো, মোতালেব রাগী চোখে তাকিয়ে দু’জনকে দু’টো থাপ্পড় দিলো। বেইজ্জতির সীমা আছে একটা! ম্যাডাম জিজ্ঞেস করলো,
— বাসার সিকিউরিটি- দারোয়ানের চাকরি করতে পারবে? মোতালেব বিষ্মিত হলো, চোখে জল জমলো। রাত নয়টা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট। ছেলে দু’টার কথা মনে পড়লো হঠাৎ তার। স্ত্রী আর ছেলে দু’টোর কাছে কতোকিছু লুকোয় সে। মোতালেব মনে মনে ঠিক করলো, এই অদ্ভুত রাতের কথা তাদের কাছে লুকোবেনা একদম। অনিকেত চুপ করে আছে অনেকক্ষণ ধরে। জলিল অনিকেতের কানের কাছে মুখ এনে নিচু স্বরে বললো,
— ভয় পাওয়ার কিছু নাই। এইগুলান ছ্যাঁছড়া চোর। দুইটা থাপ্পড় দিলে সিধা হইয়া যাবে তিথি জানালার কাঁচ নামানোর চেষ্টা করলো আবার। নামছেনা। সমস্যাটা হচ্ছে মুলত অনিকেত গাড়িতে উঠার পর থেকে। অনিকেত আত্মা বিশ্বাস করে, এইটার সাথে আত্মার কোনো সংযোগ- সম্পর্ক নাই তো? তিথি মনে মনে হাসলো, তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনের তিনজনকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— আংকেল, তোমরা আত্মা বিশ্বাস করো? মোতালেব মাথা চুলকিয়ে বললো,
— আম্মা আমরা আত্তা চিনিনা জানিনা। বিসসাস ও করিনা। অনিকেত বললো,
— তোমরা কখনো শাপলা ফুলের মাথায় জোনাকি পোকা বসতে দেখেছো? মোতালেব চুপ করে রইলো, ম্যাডামের নাক ডাকার মৃদু আওয়াজ শুনা যাচ্ছে, আলাদ্দিনের এখনো জ্ঞান ফিরেনাই। তিথি বললো,
— ওটা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম দৃশ্যের একটি। মোতালেব ডান দিকের জানালায় তাকিয়ে ভেজা স্বরে বললো,
— আমি একবার একডা বিরাট সৌন্দর্য দেখছি। তিথি, অনিকেত পেছন ফিরে তাকায়, মোতালেব জানালার বাইরে দৃষ্টি রেখে বলে,
— অনেক রাত হইছিলো, রাস্তা বন্ধ কইরা বইসা আছি। গাড়ির দেখা নাই। একডা গাড়ি আইসা হঠাৎ দাঁড়াইলো। গাড়ির ভিতরে ড্রাইভার বাদে চাইরজন। দুইডা বাচ্চাপোলা আর তাগো বাপ মা। আমাদের দেইখা চরম ভয় পাইছে, পোলা দুইডা তো ভয়ে চিৎকার দেয়া শুরু করছে। আমি এই ছুরিটা নিয়া জানালার সামনে গিয়া দাঁড়াই, জানালার কাঁচ নামাইয়া ভিতর থেকে ধুপ কইরা একটা ব্যাগ ফালাইয়া দেয়া হয় বাইরে। ব্যাগের ভিতরে চাইরহাজার টাকা। রাস্তা কিলিয়ার করে দিই। গাড়ি চলি যায়। সারা রাত জঙ্গলে কাটে! বাজার সদাই করি বাড়ি ফিরি দুপুরের দিকে। পোলা দুইডা ভাত খাইতে বসে গরুর মাংসর দিকে কেমন করে চাইয়া থাকে! বিশ্বাস হয়না তাগো! শেষ মাংস খাইছে এরা দুইমাস আগে। আমি ওগো সামনে বসি ওগো চেহারার দিকে তাকাই। ওগো সামনে দুই পেলেট সাদা ভাত আর মাংস। এইটার চাইতে বিরাট সৌন্দর্য আমি আর কোনোদিন দেখিনাই আম্মা।
মোতালেবের চোখে জল! তিথি কিছু একটা বলতে গিয়ে বলতে পারলোনা; কিছু একটা দেখতে পেয়েছে। চিৎকার করে গাড়ি থামাতে বললো সে। রাস্তার পাশে ক্ষেতের ধারে ছোট করে কাটা জলাধারের মতোন কিছু একটা। তাতে থই থই করা পানি। ওখানে ফুটে আছে লাল শাপলা ফুল। আর অসংখ্য জোনাকি। তিথির চিৎকারে ম্যাডামের ঘুম ভাঙ্গে, আলাদ্দিনের জ্ঞান ফিরে আসে। অনিকেত গাড়ি থেকে বের হয়ে আসে। তারপর একেক করে সবাই। ম্যাডাম, জলিল, তিথি, মোতালেব, আলাদ্দিন আর বাকি দুইটা সিমেন্টের বস্তা। পানিতে ভাসমান শাপলা, জোনাকি ঘিরে ধরেছে সবগুলোকে। কি অপরুপ দৃশ্য। গাড়ির সবগুলো লাইট নিভিয়ে দেয়া হয়েছে। আবছা অন্ধকার চারোপাশে। অথচ লাল শাপলা ফুল গুলো জোনাকির হলদে আলোয় উজ্জ্বল।
অনিকেত বিড়বিড় করে বলে,
— মানুষগুলা একা একা! অথচ একটা শাপলা ফুলকেও জোনাকিরা একা থাকতে দেয়না! পৃথিবীর সুন্দরতম দৃশ্যের একটি। তিথি অনিকেতের চোখের দিকে তাকায়, জোনাকি পোকা দেখে কেউ কাঁদে বুঝি? তিথির কেন জানি মনে হয়, এই যুবক কখনো কাঁদেনি! তিথি জিজ্ঞেস করে,
— আর সবচেয়ে কষ্টময় দৃশ্যটা? অনিকেত এক দৃষ্টিতে শাপলা ফুলের দিকে তাকিয়ে বলে,
— একটা লাশ। নয়দিনের মাথায় শিয়াল- কুকুর টেনে নিয়ে গেলো জঙ্গলে! আট দিন ধরে পড়ে থাকা একটা একা লাশ। ধানক্ষেতের পাশে। হুবহু আমার মতো। কিংবা আমিই। নিজেকে নিজে দেখার মতো অসহ্য কষ্টময় দৃশ্য আর একটাও নেই। তিথি চমকায়! স্পষ্ট টের পায়, অনিকেত বলে কেউ নেই এখানে। অনেক আগে থেকেই ছিলোনা। দেড় বৎসর ধরে ছিলোনা।
আমরা যে যার মতো। শাপলা ফুলের মতোই অনেকটা সময় বুজে থাকি, অন্ধ থাকি। একদিন চোখ খুলে দেখা হয়না নির্জন এলাকায় রাস্তার পাশে ক্ষেতের ধারের লাশ, ছ্যাঁছড়া চোর- ডাকাতের চোখে আসা জল, দু’টো ক্ষুধার্তের পেটপুরে ভাত খাওয়ার ছবি.. কিংবা লাল শাপলা ফুলের মাথায় টিপ টিপ করে জ্বলা জোনাকি! স্বার্থপর আমরা যা দেখিনা, আমাদের কাছে তা অদৃশ্য! আর, কিছু দৃশ্যমান দৃশ্যের কাছে আমরা নিজেরাই অদৃশ্য; বুজে আছি! আমরা ফুটবো কবে? মোতালেব, আলাদ্দিন আর দু’টো সিমেন্টের বস্তা ধানক্ষেতের ওপাশে জোনাকির আলোয় ঝলমলে থই থই পানিতে ফোটা লাল শাপলা ফুলের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকায়, কতোরাত তারা জোনাকির গা ঘেঁষে কাটিয়েছে। অথচ এমন করে দেখা হয়নি কখনো।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত