ইন্দ্রাণীর সাথে আমার প্রেম ছিল।খুব গভীর প্রেম।এ প্রেম শারীরিক প্রেম নয়।এ প্রেম ঘন্টার পর ঘন্টা ফোনে কথা বলার প্রেম না।এ প্রেম দূরে ঘুরতে যাবার মতন ও প্রেম না।এ প্রেম প্রতিদিন ক্লাস টাইম এর আধাঘন্টা আগে এসে স্কুলের পিছনে দাড়িয়ে চিঠি বিনিময়ের প্রেম ছিল। তখন ক্লাস নাইনে বসে ঘড়ি ইউজ করাই অনেক উচ্চ পর্যায়ের কাজ ছিল। ফোন তো অনেক প্রভাবশালী বেপার।প্রতিরাতে সে চিঠি পড়ে উত্তর লিখতে লিখতে ইন্দ্রাকে ভাবাতেও প্রেম ছিল।
প্রেম ছিল ক্লাস এর ফাঁকে বার বার আড়চোখে ওকে দেখার।ওর অদ্ভুত ঘ্রান ছিল।যা আমি ওর বাড়ির সামনে,ওর বই,ওর খাতা সব কিছু থেকেই পেতাম। ইন্দ্রাণী পাল,আমার স্কুল জীবনের সাথী।ওকে ভালোবাসার মতন সব ছিল।রূপে-গুনে-লেখাপড়া সব ছিল।দূরে ঠেলে দেয়ার মতন ছিল কেবন ধর্ম।এ যে সেই বেপার নয়।ক্লাস নাইন এ বসে কি বুঝেছিলাম আমি শেখ বংশ।আমার সব পাপ মাফ হলেও হিন্দু কে ভালোবাসার পাপ জনমেও ঘুচবেনা।ক্লাসে আমি ২য় ছিলাম আর ও ছিল প্রথম।লেখাপড়া দিয়েই আকর্ষন টা শুরু হয়।নোট আদান-প্রদান।আমার বাড়ি আর ওর বাড়ি একই রাস্তায়।দুজন একত্রে বুকে এক গাদা বই চেপে স্কুলে যেতাম।
সেবার আমাদের ক্লাস এর সবচেয়ে রাগী স্যার ইন্দ্রাণীকে পড়া জিজ্ঞেস করতেই ও ভয়ে বলে দেয় ওর বই আমার কাছে।আমি বই ফেরত দেইনি।সেদিন প্রচুর মার খেয়েছিলাম ওর জন্য।সেদিন থেকে ওর সাথে আর কথা বলতাম না।আমাকে ডাকলেও ওর কথা না শুনে চলে আসতাম।একদিন সকাল বেলা ইন্দ্রাণী পিছন থেকে ডাক দিয়ে বলে সেলিম আমার সাথে কেন এমন করছো? আমি রেগে বললাম দেখ ইন্দ্রা আমার সময় নাই।তুই আমায় হিংসা করিস।যাতে তুই প্রথম হতে পারিস ক্লাস এ।এবার আর তা হচ্ছেনা।আমি ই প্রথম হবো দেখিস। ইন্দ্রা কেঁদে চলে গেল।পরের সপ্তাহে আমাদের ফাইনাল পরীক্ষা ছিল।পরীক্ষার সময় পার হয়ে যাচ্ছে। পিছনের বেঞ্চ ফাঁকা।ইন্দ্রা আসেনি।পরীক্ষা শেষে ওদের বাসায় গেলাম।মুসলমান দেখে আমি ওদের বাসার ভিতরে যেতাম না।তা ঠাকুমার পছন্দ ছিলনা।জানালা থেকে আমায় দেখেই ও দৌড়ে এসে আমায় ঘরের ভিতর নিয়ে গেল।
আমি: ইন্দ্রা ঠাকুমা বকবে।আমি মুসলমান ভুলে গেলে? ইন্দ্রা হেসে বলে তার আগে ও তুমি আমার বন্ধু।
আমি: পরীক্ষা দিলে না কেন?
ইন্দ্রা: পরের বার দেই।আমি ১ম হতে চাইনা বিশ্বাস করো।
আমি: তার মানে তুমি আমার উপর রাগ করে এটা করলে?
ইন্দ্রা: আমি তোমায় মার খাইয়েছিলাম এটা আমার শাস্তি।
মেয়েরা লেখাপড়ার জন্য নাকি সবাইকে প্রতিপক্ষ ভাবে কিন্তু ইন্দ্রা কেন আমায় এতোটা ছাড় দেয় আমি বুঝতাম না।
ইন্দ্রা আমার চেয়ে ১বছর পিছিয়ে গেল।তবুও আমি ও একত্রেই স্কুলে আসতাম।ওর সাথে টিফিন এর সময় কথা বলতাম।একদিন এসে কান্না জুড়ে দিল।মা মরা মেয়ে তাই বাবা আর ঠাকুমা বিয়ে দিয়ে দিবে।আমি হেসে বললাম করে নেও তবে কেন যেন তা বলতে খারাপ লেগেছিল। আমি চলে আসতে নিলাম ইন্দ্রা পিছন থেকে বলে উঠলো তুমিও কি ঠাকুমা হয়ে গেলে? আমি পিছন ফিরে বললাম কেন?
ইন্দ্রা: হিন্দু তাই দূরে সরিয়ে দেও?আমার ভালোবাসা বুঝোনা তুমি? তোমাকে পেতে হলে আমার কি কি করতে হবে সেলিম?আমি নতুন করে মুসলমান ঘরে জন্ম নিতে পারলে নিতাম।তা পারবোনা কিন্তু মুসলমান হতে পারলে আমায় বউ করবে তোমার?
মেয়েটার মায়াভরা প্রতিমার চোখ জোড়ায় আমি পবিত্রতা দেখতে পেয়েছিলাম।টপ টপ করে গড়িয়ে পরা পানিতে আমি আমার প্রতি ওর আস্থা দেখতে পেয়েছিলাম।ওর হাত ধরে বললাম তুমি মুসলিম হও বা না হও সেটাতে আমি জোর করবোনা তবে তোমার ইন্দ্রাণী নাম টা পরিবর্তন করোনা।নাম টা আমার বেশ পছন্দের।ইন্দ্রা নিজের মাথায় কাপড় দিয়ে বলে হুম ইন্দ্রা শেখ। আযান দিলে মাথায় কাপড় দিতো। যা আমি দেখে মুগ্ধ হতাম।আমার মতন তুচ্ছ মানুষ এর জন্য নিজের ধর্ম বিষর্জন দিলো?মেয়েটা কি করে পারে এতো ভালোবাসতে!
আমার পরীক্ষার পর আমি ঢাকা চলে আসি।ও আসার সময় কেঁদেছিল খুব।কথা দিয়েছিলাম আমি পরিবর্তন হবোনা।মনে রাখবো আমার ইন্দ্রাণীকে।মসজিদ এর সামনে গিয়ে দুজন মোনাজাত তুলে কবুল বলেছিলাম।ও প্রানে মনে আমায় স্বামী ভাবতে লাগলো।সরলতা ভরা মনের মন্দিরে আমি একাই ভগবান ছিলাম ওর।যাকে ও নিয়ম করে পূজো করতো রোজ।ঢাকা এসে কোন ভাবেই যোগাযোগ করতে পারলাম না ওর সাথে।দিন গুনতাম কবে ঈদ আসবে বাড়ি যাব। ইন্দ্রাণীকে দেখার জন্য তৃষ্ণা বেড়েই চলেছিল।হঠাৎ মা ঢাকা আসলো আমার অসুস্থতার খবর পেয়ে।কথায় কথায় মা বলে দিল ইন্দ্রাণী কার সাথে যেন পালিয়ে গেছে।আমি নিজের কান কেও বিশ্বাস করতে পারিনি।এতোটা ছলনাময়ী ইন্দ্রা?মাত্র ৬মাসেই আমার জায়গা দিয়ে দিলো!যে নিজের ধর্ম ত্যাগ করতে পারে সে আমায় ত্যাগ করতে পারবে নাই বা কেন!অনেক ঘৃনা-অভিমান জমিয়ে ২বছর বাড়িতেই যাইনি আমি।এর মাঝে আমার রিলেশন এর পাল্লা হয়েছে ভাড়ি।৩জন মেয়ের সাথে আমি শারীরিক সম্পর্ক করেছি তবুও কখনো ইন্দ্রাণীকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারিনি।আমার এই অবনতির জন্য আমি ওকে প্রতিনিয়ত অভিশাপ দিতাম।
২বছর পর বাড়ি ফিরছি।এই সেই মেঠো পথ,যেখানে একসময় দুজন হাঁটতাম।হঠাৎ ইন্দ্রাণীর কন্ঠে কেউ সেলিম বলে ডেকে উঠলো।থমকে পিছনে তাকিয়ে দেখি কেউ নেই।তুলসী গাছ টা মরে আছে ইন্দ্রাণীর বাড়ির উঠোনে।এক জোড়া মঠ দেখছি উঠোনের পাশেই।যা আগে ছিলনা। তাহলে কি ঠাকুমা আর নেই!ইস!মহিলা বেশ ভালো ছিলেন।এর মাঝেই দেখি কুঁজো হয়ে ইন্দ্রার ঠাকুমা। কে…? আমি: ঠাকুমা কেমন আছো?আমায় চিনলেনা?আমি সেলিম।
-ও সেলিম।এই তো বেঁচে আছি আমি।আসো ঘরে আসো
আমি:না থাক। সবাই কেমন আছে? মুখফুটে বলতে পারিনি ইন্দ্রা কেমন আছে? ঠাকুমা হেসে বলে সবাই আর কে?আমি ই আছি। আমি মুখ মলীন করে ভাবলাম ইন্দ্রা কি বেইমান।পালিয়ে গিয়ে একবার এই বুড়ো মহিলার কথা ভাবলোনা। মুখ ফুটে বলেই ফেললাম ইন্দ্রা আসেনা? ঠাকুমা আমার দিকে তাকিয়ে চুপ করে আছে।
আমি: কি হলো?
ঠাকুৃৃমা: ইন্দ্রার কি সেই শক্তি আছে আসার? ২বছর আগেই চলে গেল
আমি: জানি আমি।পালিয়ে গেছে ও।
ঠাকুমা: কি বলো?কে বলছে এসব?আমার ইন্দ্রা ওমন না।কোন এক মুসলমান ছেলেকে ভালোবাসছিল।সারাদিন কান্না করতো।আমি জিজ্ঞেস করলেও বলতোনা।নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে খাল পাড়ে বসে থাকতো।একদিন কান্না করতে করতে আসলো। আমায় জড়িয়ে ধরে বলে ঠাকুমা সেই ছেলের বাড়িতে গিয়েছিলাম।একবার তার খোঁজ নিতে।আমায় অপমান করে বের করে দিল।আমি পা ধরে বললাম আমি আপনাদের সব কথা মেনে নিবো। আমার বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছে আমায় একটু জায়গা দিন।কিন্তু তারা ওকে দূর দূর করে বের করে দিল।আমি বুঝিয়েছি শুনেনি ও।পরেরদিন সকাল থেকে ওর খোঁজ নেই।সবাই বলে বেড়ালো ইন্দ্রা পালিয়ে গেছে।২দিন পর এই খাল এ ওর লাশ পাওয়া গেলো এই বলে ঠাকুমা মাথায় হাত দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বসে পরলো। আমি ঠিক নিথর হয়ে দাড়িয়ে আছি।
ঠাকুমা ঘরে গিয়ে হাতে করে কিছু জিনিস এনে আমার হাতে দিয়ে বললো এই দেখো ও চিঠিতে লিখে গেছে মরার পর যেন ওকে কবর দেয়া হয়।আমি অনেক বুঝিয়েছি।ওর শেষ ইচ্ছে পূরন করতে পারিনি।ওকে পোড়ানো হলো ১সপ্তাহের মাথায় নির্মলটাও মেয়ের শোকে মারা গেলো। আমায় জম ও চোখে দেখেনা বাবা। চিঠির নিচে কতগুলি নামাজ শিক্ষার বই।যা আমি ই ইন্দ্রাকে কিনে দিয়েছিলাম। ঠাকুমা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন তুমি তো ওর বন্ধু।তুমি কি জানতে ওই ছেলে কে? আমি কথার উত্তর না দিয়ে চলে আসলাম।খালের পাড়ে দাড়িয়ে পানির দিকে তাকিয়ে ভাবছি, তুমি আমায় এ দুনিয়ার সামনে মাটির মতন পবিত্র করে নিজে জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে গেলে।আমার দেয়া কথা রাখতে পারিনি।আমার অভিশাপ ফলে গেলো।কিন্তু আমার কিছু হয়না কেন ইন্দ্রা?
তুমি আমায় কেন অভিশাপ দেওনা ইন্দ্রা?২বছর তুমি নেই আর আমি তা জানতেই পারলাম না!আমি অধম!আমি আসলেই বিশ্বাসঘাতক।তুমিতো পানিতে মিশে সব চিন্তা থেকে মুক্তি নিলে।আমার বুকের ভিতর যে চিতার আগুন জ্বালিয়ে গেলে তা কি এজনমেও মুছবে!আমায় নিয়ে যাও তোমার কাছে। পানির স্রোতের শব্দ প্রবল হচ্ছে।বার বার মনে হচ্ছে আছরে পড়া ঢেউ চিৎকার করে বলছে, “এখানে অপবিত্রতার কোন ঠাঁই নেই” ।
গল্পের বিষয়:
গল্প