ইঁয়ে… এ…, লবারের বিটা, চিত হঁয়্যা শুয়ে আছে দিখ, আঁধারে তো শালা কুকুরে শুঁকব্যা, উঠ… উঠ শালা – বলতে বলতেই ভানু কৈরীর পাছায় দুটো লাথ মারল লালু মাতো। ঘোর কাটিয়ে উঠে বসতে গিয়ে চোখ টেনে টেনে ভানু কৈরী দেখলো সামনে দাঁড়িয়ে লালু খুড়া।
– তু বিচার কর খুড়া, হামকে বলে কিনা মাগনায় মাতালকে ডিঙায় পার করবক লাই। মাতন মাঁঝি ভরা ডিঙায় ইতগুলো লোকের সামনে হামকে ঠেলি ফেলায় দিলো। তু বিচার কর খুড়া… বিচার কর।
বলতে বলতে হাউমাউ করে কেঁদে লালু মাতোর পা দুখানা জড়িয়ে ধরলো ভানু। দাঁত খিঁচিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল লালু, কিন্তু দেখলো এই লাউথুপির ঘাটে এখন শনিবারের হাটফিরতি মানুষের জটলা। এদের মধ্যে বেশকিছু লোক আবার এদের দুজনের রগড় দেখছে দাঁত কেলিয়ে। পুরন্দরপুরের হাটে ইয়াসিন মোলস্নার পস্নাস্টিকের ডাববর ফটফটানি তখনো ভানু কৈরীর কানে বাজছিল। বেলা তখন দুটো-আড়াইটা হবে। হাটে ঢুকেই দক্ষিণতলায় বুড়গা সরেনের লাল পিঁপড়ের ডিমের সঙ্গে দুজাম বাটি হাঁড়িয়া টেনে টং হয়ে গিয়েছিল ভানু। মাথার ওপর সূর্যটা যখন একটু একটু করে পশ্চিম দিকে হেললো ভানু কৈরী চোখ চিরে চিরে সূর্যের মধ্যে দেখলো কয়লার আগুন। ‘শালো, জ্বইলছ্যা তো জ্বইলছ্যাই, গমগম, গমগম। চিরকুণ্ডাটো পুড়াঁয় দিব্য, হারামির বিটা, বানোয়ারিলালের কইলজাটো ছিড়্যাঁ লিব্য। চিরকুণ্ডা হামার, শালো ট্যাকা দিয়্যাঁ বেবাগ বরাকরটো কিন্যা কিনে লিব্য।’ বলতে বলতে টলোমলো পায়ে ভানু কৈরী গিয়ে ধপ করে বসে পড়েছিল ইয়াসিন মোলস্নার ঠেকে। টেঁকে গোঁজা ছিল দুটো দশ টাকার নোট। প্রথমে একটা। ফটফট… ফট, রুইতন, রুইতন, ফক্কা! আবার হরতন, হরতন… ধুকধুক… ধুকধুক… ফতুর ফা! ‘ইবার দারে ধারে’ বলে ইস্কাবনের বিবির ওপর হাত চেপে ধরেছিল ভানু। ইয়াসিন মোলস্না জুয়াপালির কোনা টেনে ঠিক করতে করতে ক্যাঁত করে এক লাথি কষে দিয়েছিল ভানু কৈরীর পিঠে। এমনিতে নেশার ঘোরে টলছিল ওর সারাশরীর। নিজেকে সামলাতে না পেরে ইয়াসিনের লাথি খেয়ে পড়ে যায় মাটিতে। ক্ষক্ষাভটা এখনো ভুলতে পারেনি। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিয়েছিল মাতন মাঝি। হাট থেকে বরাকর নদীর ওপারে ওদের চিরকুণ্ডা কোলিয়ারিতে যাবে বলে যেই মাতনের ভরা ডিঙায় পা রাখতে গেছে অমনি এই বিপত্তি। বছর-ছাবিবশের ভানু জোয়ান, গাঁট্টাগোঁট্টা চেহারা। কয়লার মতোই কুচকুচে কালো গায়ের রং। তিনকোনা মুখের চোখের নিচে দুদিকের উঁচু হাড়, চোঙের মতো থিতুনি, ওপর পাটির উঁচু দাঁত আর সদা সর্বদা নেশায় ডুবে থাকা ঘোলাটে চোখ। এমনতর হতকুৎসিতকে কোলিয়ারির বসিত্ম অঞ্চলে কেউই খুব একটা পছন্দ করে না। ভানুও যে জায়গাটা পছন্দ করে তেমন নয়। পালান কৈরীর মেজ ছেলে ও; কিন্তু হলে কি হবে অভাবের সংসারে বেকার দামড়া ছেলেকে নিয়ে দিনরাত খেঁচাখেঁচি, তাই বেশ কিছুদিন হলো ভানু কোলিয়ারি বসিত্মর পূর্বদিকে ফাঁকা জায়গায় কোনোরকমে একটা ঝুপড়ি বানিয়ে থাকে। পেট চলে বানোয়ারিলালের তাঁবেদারি করে, নয়তো টানা কয়লার ফটকাবাজিতে। তবে লালু মাতোকে খুব খাতির করে ভানু। লালু মাতো চিরকুণ্ডা কোলিয়ারির শ্রমিক। এই বসিত্ম অঞ্চলের মাতববরগোছের লোক। মাতববরির জন্য যে ভানু ওকে খাতির করে তা নয়, খাতিরের পেছনে আছে ধান্দা। লালুর ছোট মেয়ে চম্পার কাছাকাছি পৌঁছানোর তোয়াজ। লালু কতবার ধমকে চমকে বলেছে, ‘ইখানে না পুষায়, হারামি শালা আসানসুলে যেঁয়ে কুন দুকানে-ফুকানে ল্যাগে যা।’ কেউ হলে খিসিত্ম মেরে বাপান্ত করত ভানু; কিন্তু লালু খুড়ার সামনে কেলানে মদন সেজে হাত দুখানা দু-থাই দিয়ে চেপে ধরে বলে, ‘ইবার ঠিক দিব্যা গো খুড়া, বানোয়ারিলাল বুইল্যাছ্যা কালতক টানা মাকের চার আনা পাটনার।’
আঁধার মিচমিচ করে গাঢ় হচ্ছে চোখের সামনে। মাঝ আষাঢ়ে বরাকর নদীর ভরা যৌবন ছলাৎছল নদীর বুকে লম্বা বাঁশের লগি দিয়ে ডিঙার টাল সামলাচ্ছে মাতন মাঝি। বেশ কয়েকজন উঠে পড়েছে ডিঙার ওপর। ডান হাতে ভানুর বাঁ বাহু ধরে সামনে দাঁড়িয়ে আছে লালু মাতো। এবার ভানুর পেছনে হাঁটু দিয়ে গুঁতো মেরে বলল, ‘ওঠ হারামি’। ভানু ঢুলুঢুলু, টলোমলো পায়ে গোঁত্তা খেয়ে কোনোরকমে ডিঙার ভেতরে পা রাখল, পেছনে লালু খুড়া। কটমট করে তাকিয়ে থেকে কী ভাষা উগরালো মাতন মাঝি অন্ধকারের ছায়ায় তা বোঝা গেল না। ভানু কৈরী নেশার ঘোরেও বুঝতে পারল বরাকর নদীর বুক চিরে তিরতির করে এগিয়ে যাচ্ছে ডিঙা। ডিঙাভর্তি লোকজনের কথাবার্তা ছাপিয়ে ওর কানে বাজছে মাতন মাঝির লগি দিয়ে গুঁতো মারার মুখের আওয়াজ : ‘হেঁই… হুঁ…’। মাঝনদী পেরিয়ে ওপারের কাছাকাছি এগোতে গিয়ে ডিঙার গতি মন্থর হলো। স্রোত ঝাপটা মারছে ডিঙার গায়ে, জল ছিটিয়ে মানুষগুলোর চোখে-মুখে লাগছে। কোনার দিকে জড়োসড়ো হয়ে কোনোরকমে বসে পড়েছিল ভানু, যেন আঁজলাভর্তি জল কেউ ছিটিয়ে দিলো ওর মুখে, কুলকুল… কুলকুল…, ভরা যুবতী চম্পা।
– তু তরল হয়্যাঁ বিছাঁয় যা।
– ক্যানে হামার ভেতর তু চিতোবি?
– হায় গো, তুকে সুরাল বানাব।
– হামকে ঢেউ ভাঙাবি।
– তুহার কোমর হাঁড়ায়ে লিচনে ডুবব্যো।
– সেতাক আন্দার আন্দার, ভরা নদীর চাপ।
– নদী তুহার গতররে চম্পা, হামকে ভাসাঁয়্যা দ্যা।
– তু হামার লাগর হব্যি তো আতর দে, শুঁষায় দিব।
– তুহার উদমা বুকে মুখ ঘইসব, নাইতেলাক ঘইসব, তুহার পাচা পাইড়া লীল শাড়িতে আতর ছড়ায়্যাঁ দিব আর ইটো… ইটো… হামার চম্পা রানীলো…
ডিঙা পাড়ে এসে ঠেকেছে। লোকজন নেমে গেছে। হুঁশ নেই ভানু কৈরীর। নেশার ঘোরে ডুবে থেকে ও মজে ছিল চম্পায়। ঘটমান বাস্তবকে ডিঙিয়ে ও ঢুকে পড়েছিল কল্প বাস্তবে। এবার চুলের মুঠি ধরে টান মারলো লালু মাতো। ‘তু হামার বাপরে খুড়া, তু হামার সব…’ বলতে বলতে ডিঙা থেকে নেমে এপারের মাটির ওপর আবার নেতিয়ে পড়লো ভানু।
এক সপ্তাহ হতে চললো চিরকুণ্ডা কোলিয়ারিতে মাল ওঠানামা বন্ধ। ডাম্পার আর লরিগুলো লাইন দিয়ে পড়ে আছে বসিত্মর পাশে ফাঁকা মাঠে। মালিকরা স্ট্রাইক করেছে মালটানার রেট নিয়ে। যতদিন ফয়সালা না হয় ততোদিন কোলিয়ারি কর্তৃপক্ষ মাল তুলছে না। শ্রমিকদের পেটে লাথি। বসিত্মর বেশিরভাগ লোকই দিনমজুর। দিন আনে দিন খায়। কারোর কারোর যৎসামান্য সঞ্চয় যা ছিল টানা সাতদিন বসে খাওয়াতে তাতেও টান পড়েছে। মাঝবয়সী লালু মাতো কোলিয়ারি কর্তৃপক্ষের পেটুয়া লোক, তাই বসিত্মর সবাই ওকে একটু বেশি খাতির-যত্ন করে। গেল শুক্রবার থেকে আর-একটা শুক্রবার পেরিয়ে আজ শনিবার, এখনো কোনো সুরাহা হলো না দেখে বসিত্মর বেশ কিছু মানুষ আজ সকাল থেকেই লালু মাতোর দাওয়ায় জড়ো হয়েছে। খাটিয়ার ওপর বসে অ্যালুমিনিয়ামের জাম-বাটিতে শুকনো মুড়ি নিয়ে ওদেরকে বোঝাচ্ছে লালু।
– আরে তুমরা বুঝনা ক্যানে, ই ইসটেরাইকটা তো উ বানোয়ারিলালেরই ডাকা, উ তো লিডার। উহার লিজের তিনঠো লরি কোলিয়ারিতে খাটে।
মালখোর পদম ম-ল শালা হাড় হাভাতে। দিনভোর কোলিয়ারিতে গাঁইতি চালিয়ে যা পায় তার অর্ধেকই সন্ধেবেলায় ভাকুতেলের ঠেকে যায়। ভাকুতেল মানে দিশি চোলাই মদ, এখানকার লোকেরা বলে, ঘরে ওর বুড়ো বাপ, বউ, তিন তিনটে বাচ্চা, বাকি পয়সায় রোজগারটা রোজ কুলায় না। তাই এদিক-ওদিক হলেই রাতে বউকে কেলায়। বাচ্চাগুলো হাউমাউ করে, বুড়ো বাপ বিছানায় থুতনি গুঁজে বিড়বিড় করে। সে নিত্যদিনের ব্যাপার। কিন্তু এই কদিনে কাম ধান্দা একেবারে না থাকায় ওদের পরিবারের অশামিত্ম একেবারে চরমে। খাটিয়ার খোঁটা ঘেঁষে মুখ নিচু করে বসেছিল পদমের বউ, তার পাশে পদম।
– খুড়া গো, হামার বিটাগুলো ভুঁখা পেটে একদম মরি যায়। হামদের বাঁচাগো খুড়া।
বলেই কাঁদতে কাঁদতে লালু মাতোর পা দুখানা জড়িয়ে ধরল পদমের বউ। ওদিকের দাওয়ায় ঘুরতে থাকা মুরগিগুলোকে মুড়ি ছড়িয়ে খাওয়াচ্ছিল চম্পা। বছর উনিশ-কুড়ির যুবতী, কালো গাঁট্টা চেহারা। একটু বেঁটে হলে কী হবে, মুখখানা বেশ সুন্দর, কোলিয়ারি ইস্কুলে কয়েক ক্লাস লেখাপড়াও শিখেছে। বসিত্মতে চম্পার বুদ্ধির তারিফ করে সবাই। পদমের বউয়ের এমনপারা কথা শুনে এদিকে এগিয়ে এসে চম্পা বললো,
– ই ঝ্যাঁটাটা লিয়ে তুহার মরদের পিঠে মার ক্যানে, তানু টানার পুঁইস্যা নাই, লবাব জাদার রোজ ভাকুতেল টানা চাই।
হাতে-ধরা বেড়া কলমির লাঠির খোঁচা পদমের পিঠে মেরে চম্পা বলতে লাগল, ই হারামি, বহুঁ, বিটা, বুড়া বাপকে ভুঁখা দিখ্যা মনটা কান্দে না তুর!
ক্ষেপে উঠে পদম বলল, কামটো কুত্থায় পাব, যে পুইস্যা লিঁয়ে এসে ইগুলোকে গিলাব। সাতদিন পার হল্য কোলিয়ারিতে বন্ধ।
অন্য সবাই একসঙ্গে বলে উঠল – ‘হয় বটে, উ কুথা পাব্যে।’
বসিত্ম থেকে খানিকটা দূরে ইটের রাস্তাটা চিরকুণ্ডা কোলিয়ারির গা ঘেঁষে চলে গেছে আসানসোলে যাওয়ার বড় রাস্তার দিকে। কোলিয়ারির পেছনে বরাকর নদী, তার পাড় বরাবর খনিশ্রমিকদের এই বসিত্ম। শদেড়েক পরিবারের বসবাস এখানে। এদের বাপ-ঠাকুরদারা মানভুম, ধলভুম, দিশের গড়, ঝাড়খ–র বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসে কয়লা খনিতে শ্রমিকদের কাজ করতে করতে থেকে গিয়েছিল এখানে। বর্তমানে এরা বর্ধমান জেলারই নাগরিক। রেশন কার্ড, ভোটার লিস্টে নাম – সবই আছে ওদের। প্রতিটি পরিবারই পেশায় খনিশ্রমিক। আগে যখন এ-অঞ্চলে ব্যক্তিমালিকানার খাদান ছিল তখনো ডেলি লেবারের কাজ করত ওরা। পরে যখন সরকার কোলিয়ারি খুলল সেখানেও ডেলি ওয়েজেস বেসিসে মাথায় হেলমেট পরল ওরা। তবে ঘড়ি ধরে মাপা কাজ, টাকাটাও কিছু বেশি আর বছরে দু-একবার বাড়তি কিছু পাওনা। ইদানীং কোলিয়ারি কর্তৃপক্ষ কিছু এনজিওর সঙ্গে হাত মিলিয়ে শ্রমিকবসিত্মতে উন্নয়নের কাজ করছে, বসিত্মতে ইলেকট্রিক আলো এসেছে। কিছু কিছু বাড়িতে পায়খানার পেস্নট পাতা হয়েছে। শ্রমিকদের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য কোলিয়ারি অফিস ক্যাম্পাসের মধ্যে স্কুল থাকলেও এই বসিত্মর বাড়িগুলির দেয়ালে দেয়ালে লেখা হয়েছে, ‘চলো সবাই-মিলে স্কুলে যাই, এসো কিছু করে দেখাই।’ বাঁশের খুঁটির ওপর পলিথিন চাপিয়ে সর্বশিক্ষা অভিযানের দুটো স্কুলও চালু হয়েছে। সেখানে আবার দুপুরবেলায় পোকা-ধরা চালের খিচুড়ি রান্না করে খাওয়ায়। এসব দেখভাল করে কোলিয়ারি ট্রান্সপোর্ট কন্ট্রাক্টর অ্যাসোসিয়েশনের নেতা ওই বানোয়ারিলাল। তাই বসিত্মতে প্রায়ই ঢোকে বানোয়ারিলালের সাদা অ্যাম্বাসাডর। সুযোগ পেলে নোলা মানুষগুলো ওর পেছনে ঘুরঘুর করে। সকাল সকাল গাড়ির শব্দ পেয়ে কথা থামিয়ে সবাই ফিরে তাকালো রাস্তার দিকে। পেছনের সিট থেকে নামছে বানোয়ারিলাল, আর ড্রাইভারের পাশে বসে থাকা ভানু কৈরী খুলছে সামনের দরজা। বানোয়ারি সোজা এসে লালু মাতোর খাটিয়ার ওপর বসলো। সবাই কেমন জড়োসড়ো হয়ে সামান্য সরে গেল। হাততিনেক দূরে দাঁড়িয়েছিল ভানু। কথা সে-ই শুরু করলো,
– তা পবলেমটা বাবু বলেন ক্যানে।
ভানুকে দেখে অবধি চম্পার গা-টা কেমন শিরশির করছিল, মুখে থুথু উঠছিল বারবার, মনে মনে ভাবছিল থু মেরে ছিটিয়ে দেয় বদমাশটার মুখে। কিন্তু তা না করে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। পদম ম-ল এগিয়ে এসে বললো,
– বাবু, ইসটেরাইকটো লাই মিটব্যাক?
– হামি আর কী করতে পারি, ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন আছে না, মানছে নাই। কিলোমিটার বিশ টাকা কেরিং কস্ট যবতক না দিবে এ সরকারি লোক তবতক সব লরি, ডাম্পারের চাক্কা বনধ্।
বানোয়ারির কথায় যেন বাজ পড়ল পদমের মাথায়, দু-হাতে কপাল চাপড়ে বললো, ‘তব তো হামদের কাম ধান্দা বি বনধ্।’
সবাই বিড়বিড় করলো, ‘কী হব্যেক ইখন।’
– মত ঘাবড়াও ভাইয়োঁ হামি আছে না। কাম ধান্দার কমতি হবে না, তবে দিক্কত কুছ অলগ হোগা।
দিক্কতটা জানে সবাই তবু এ-ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করছিল ওরা। এর মধ্যেই কথা বললো ভানু,
– মালিক লোক বহুদিন ছাড়্যা যেঁইছ্যা খাদান গুলান। সিগুলার গভ্ভে ইখনও কুইলা আছে। তুমরা পুলিশের ডরে দিনে না পার রেইতে মাল তুইলবেক। মণপ্রতি পুইসাও পাবে ভালো।
এবার খেঁকিয়ে উঠলো লালু মাতো।
– চুপ যা শালা মাতাল, চোর।
এগিয়ে আসে চম্পা। কিছু বলতে গিয়েও বললো না। চম্পা বোঝে সবটাই বানোয়ারিলাল আর তার দলবলের কারসাজি। কয়লা মাফিয়া বানোয়ারি কায়দা করে কোলিয়ারির কাজ বন্ধ করেছে। এবার ভুখা মানুষগুলো ওর ফাঁদে পা দিয়ে বেআইনি খাদান থেকে চোরাই মাল তুলবে। সেই মাল নামমাত্র টাকায় কিনে নিয়ে পাচার করবে বানোয়ারির দল। আর মানুষগুলো কেউ কেউ পুরনো ধসে যাওয়া খাদানের ভেতর কয়লা তুলতে গিয়ে চাপা পড়ে মরবে। সবাইকে চুপ থাকতে দেখে বানোয়ারি বলতে শুরু করলো,
– কী হলো, পসন্দ হলো না কথাটা, তো ফির…
বানোয়ারির মুখের কথা শেষ হতে না হতেই কেউ কেউ বলল,
– কথাটা মন্দ বলে নাই ভানু।
এবার যেন উৎসাহ পেয়ে গেল বানোয়ারি, সান্তবনার সুরে বললো,
– থানাকে লিয়ে ভাবনা করবে না। ইয়ে যো হামার এনজিও আছে না, বাচ্চা লোগকো ইস্কুলে মিড ডে মিল দেয়, কাল থিকে জাদা খানা বানাবে। হর ফেমলিতে বাচেঁচা কি সাথ সাথ বুড্ডা কো ভি খানা দিবে। বিডিও সাহাব কি সাথ হামার কথা হয়েছে। জাদা চাউল ভেজবে, কোয়ালিটি ভি ভালো দিবে।
মাসখানেক হতে চললো এখনো চিরকুণ্ডা কোলিয়ারির চাল্কে পা রাখেনি কোনো শ্রমিক। সরকারি তরফে বারবার চেষ্টা করেও কোনো সুরাহা হয়নি। মাঝখানে একবার সরকারি গাড়ি এনে জমে থাকা কয়লা চালান দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল; কিন্তু বাদ সেধেছে কন্ট্রাক্টর অ্যাসোসিয়েশন। গাড়ি আটকে, রাস্তা অবরোধ করে বানচাল করে দিয়েছে পরিকল্পনা। কিন্তু শ্রমিকবসিত্মতে ভুখা মিছিল বেরোয়নি এখনো। উলটো সন্ধেবেলায় কারোর কারোর বাড়ির দাওয়ায় ভাকু তেলের আড্ডার সঙ্গে ঢুলকি বাজিয়ে চলে ঝুমুর গানের আসর। দিনের বেলায় সামনের মাঠে লাইন দিয়ে বানোয়ারিলালদের ডাম্পার আর লরিগুলো দাঁড়িয়ে থাকলেও রাতের বেলায় বসিত্মবাড়ির মেঝে কাঁপিয়ে খাদান থেকে তোলা চোরাই কয়লা পাচার করে। বসিত্মর মরদগুলোকে ভেড়া মনে হয় চম্পার। এমনকি তার বাপ লালু মাতোকেও। বানোয়ারিলালদের কৌশল বুঝতে পারে না এরা। শুধু পেটের জন্য শয়তানটার খপ্পরে পা দিয়ে রাতের অন্ধকারে গাঁইতি নিয়ে মরণ কুয়ার ভেতের ঢোকে, কত পায় এক এক রাতে, আশি, একশ বড়জোর দেড়শো টাকা। আর ওদিকে লরির পর লরি কালো সোনা টেনে নিয়ে দিনের পর দিন বানোয়ারিলালের গায়ের রং পালটে যায় দুধে আলতায়। কাউকে কয়েকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে চম্পা। কিন্তু ওর কথায় তেমন একটা আমল দেয়নি কেউই। গালমন্দ দিয়ে কেউ কেউ বলছে,
– তুহার গতর বিকায়্যাঁ হামদের খাওয়াবি?
দুপুরে খেয়ে-দেয়ে ওর বাপ যখন ঘুমায় কোমরে শাড়ির আঁচল গুঁজে চম্পা তখন যায় খাবার দেওয়া ইস্কুলে। বসিত্মর বাচ্চাগুলো ভীষণ দুষ্টু। দিদিমণিগুলো শালপাতায় খিচুড়ি ঢেলে দিয়ে জিরোয় খানিকটা। বাঁশের খুঁটিতে ঠেস মেরে আঁচল দিয়ে গলায় হাওয়া করে। বানোয়ারিলাল তদবির করে বিডিও অফিস থেকে অনেক চাল আনিয়াছে। ইস্কুলের পাশেই একটা দরমার গোডাউন বানিয়ে তালাচাবি মেরে রাখা হয় বস্তা বস্তা চাল। কিছু বাচ্চা-বুড়ো খেতে পায় বটে কিন্তু চম্পার মনে কেন জানি সন্দেহ হয় সরকারি চাল রাতে কয়লার সঙ্গে পাচার হয় সদরে। খাওয়া-দাওয়ার পর কিছু বাচ্চা পালায়, কিছু বাচ্চাকে ধরে বেঁধে পড়াতে বসায় দিদিমণি দুটো। বাচ্চাগুলো বানান করে পড়ে, ‘ভারত আমাদের দেশ। দেশ চালায় জনগণ।’ ওদের মধ্যে একটি ছেলে বলে ওঠে, ‘দিদিমণি হামি দ্যাশ চালাব্য, হ্যাঁডেলটো কুথায়?’ চুপ কর – বলে রোগা দিদিমণিটা ধমক মারে। চম্পা মুখ টিপে হাসে।
খুব একটা রাত হয়নি তখন, তবে সন্ধে থেকেই ইটের রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে আছে লরিগুলো, বসিত্মতে আজ কোনো বাড়িতেই প্রায় মরদ নেই। চিরকুণ্ডা কোলিয়ারি ছেড়ে অনেকটা পেছনে বসিত্ম। বসিত্মর ডানদিকে বিসত্মীর্ণ অঞ্চলে বেশ কয়েকটা মজে যাওয়া খাদান। ঝোপঝাড় কেটে এই সমস্ত খাদানে দিনের আলো থাকতে থাকতেই চুপি চুপি মানুষগুলো কয়লা তুলতে নামে। ছেড়ে যাওয়া খাদানে সহজে পাওয়া যায় না কয়লা। অনেক ভেতরে যেতে হয়। অন্ধকার নামতে নামতে মরণকেও ভয় পায় না মানুষগুলো। টিম টিম করে দু-একটা লাইটপোস্টে আলো জ্বলছিল। খাবার দেওয়া ইশ্কুলের গোডাউনের পাশে ঘাপটি মেরে অন্ধকারে বসেছিল চম্পা, ও আজকে দেখবেই সত্যিকারে গোডাউন থেকে চাল পাচার হয় কিনা। গোডাউনের পাশেই ইটের রাস্তা, রাস্তার বাঁ পাশে খাদানের মাঠ। অনেকক্ষণ বসে থাকতে থাকতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল চম্পা। হঠাৎ সামনে একটা ছায়া নড়তে দেখে চমকে উঠল। মানুষের ছায়া। দূরের লাইটপোস্টের আবছা আলোয় চিনতে পারলো চম্পা। মানুষটা পদম ম-ল। পা টিপে টিপে পদম ম-ল গোডাউনের কাছে গিয়ে তালা খুলে ভেতরে ঢুকলো। খানিক বাদে আরো বেশ কয়েকজন অচেনা লোক লরির ওপাশ থেকে এসে গোডাউনে ঢুকলো। মিনিট দশ-পনেরো বাদে লোকগুলো বেরোলো, সবার পিঠে একটা করে চালের বস্তা। মানুষগুলো পিঠে বস্তা চাপিয়ে সামনের দিকে নুয়ে পড়ে থপথপ… থপথপ করে হেঁটে যাচ্ছে দাঁড়িয়ে থাকা লরির দিকে। উত্তেজনা চাপতে না পেরে চম্পা কেশে উঠতেই সবার পেছনে থাকা পদম পিঠের বস্তা মাটিতে ফেলে পেছন ঘুরে দাঁড়ালো। কেমন একটা ভয় পেয়ে গেল চম্পা। উঠে পড়ে খাদানের মাঠে অন্ধকারের দিকে দৌড় মারলো। শ্রাবণ মাসের আকাশে মেঘের আড়ালে জ্যোৎস্না ছিল আবছা। কাদার মধ্যে দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁপিয়ে উঠেছিল। দাঁড়িয়ে পড়ে পিছন ফিরে তাকাতেই ভয়ে কুঁকড়ে গেল ওর সারাশরীর। পদমের সঙ্গে তিন-চারটে লোক এদিকেই ছুটে আসছে। অন্ধকার রাত! এই অবস্থায় একা পেয়ে ওকে যদি… আর ভাবতে পারছিল না চম্পা। হঠাৎ ও খুব কাছ থেকে শুনতে পেল ধুপ ধুপ। খাদানের ভেতরে গাঁইতি চালানোর শব্দ, কেউ নিশ্চয় এই ছাড়া খাদানের ভেতরে কয়লা তুলছে। শব্দটা আন্দাজ করে কাছাকাছি গিয়ে পাগলের মতো খাদানে ঢোকার রাস্তা খুঁজলো চম্পা। আকাশ থেকে মেঘের খ- সরে যেতে যেতে মুহূর্তে প্রান্তরটাকে আলোকিত করে গেল একঝাঁক জ্যোৎস্না। চকিতে চম্পা দেখতে পেল ঝোপ কেটে পরিষ্কার করা খাদানে ঢোকার মুখ। আর কিছু না ভেবেই চম্পা দৌড়ে ঢুকে পড়লো খাদানের সুড়ঙ্গে। খুব একটা ভেতরে ঢোকেনি। ও মুখের কাছেই শরীর কুঁকড়ে বসেছিল। ও বুঝতে পারছে লোকগুলো দেখতে পায়নি ওকে। ওরা দৌড়ে চলে গেল অন্যদিকে। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে ভয়টা কাটিয়ে উঠলেও শরীরটা কাঁপছিল চম্পার। উঠে পড়ে বেরোতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গেল। গড়িয়ে গড়িয়ে সুড়ঙ্গের ভেতরে যেতে যেতে চম্পা দেখতে পেল ওর পড়ে যাওয়া শব্দের প্রতিধ্বনির সঙ্গে গমগমে আর-একটা পুরুষ মানুষের গলার শব্দ, ‘কে বটে?’
হাতে-পায়ে-মাথায় প্রচ- লেগেছে চম্পার। যন্ত্রণায় মুখ খুলতে পারছে না, বুঝে উঠতে পারছে না কিছু। হঠাৎ টর্চের আলো এসে পড়লো ওর মুখের ওপর, লোকটা আঁতকে উঠে বললো, ‘হায় বটে, চম্পা তু!’
এবার চম্পা বুঝতে পারলো লোকটা ভানু কৈরী। যন্ত্রণায় দাঁড়াতে পারছে না চম্পা। তাও ওকে টেনে তুলে সুড়ঙ্গের ক্ষয়ে যাওয়া সিঁড়িতে সাবধানে পা রেখে ওপরে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে ভানু। হঠাৎ মড়মড় করে আচমকা সুড়ঙ্গের মুখের দিক থেকে খসে পড়লো মস্ত বড় একটা মাটির চাঁই, পরক্ষণেই আর একটা, হায় কপাল এ যে ধস! সুড়ঙ্গের মুখ বন্ধ। রাস্তাও চাপা পড়েছে অনেকটা। ওদের দিকে গড়িয়ে আসছে মস্ত বড় একটা ঢেলা। চম্পার হাত ছেড়ে ভানু তার সমস্ত শক্তি দিয়ে পিঠ পেতে ধরেছে ঢেলাটাকে আটকাতে। সাক্ষাৎ মৃত্যুর সুড়ঙ্গে ঠেলা খেয়ে খেয়ে ওর কানে বাজছে চম্পার আর্তচিৎকার, ‘ভানু দাদা গো, হামকে বাতাস দাও, হামার দম ফুরাঁয় যেঁছ্যা, হামকে…।’