আহমেদ কারিম ডান কাতে শুয়েছিলেন, চোখ বোজা অবস্থায় পরিবেশের একটা অপরিচিত গন্ধ নাকে এলো। চোখ মেললেন, পাতাজোড়া বেশ ভারী। চোখের সামনে ধবধবে সাদা মোটা সুতি-পর্দা, জানালার কাচ পেরিয়ে নরম আলো লুকোচুরি খেলছে। বুঝতে দু-এক মুহূর্তের বেশি লাগল না যে, তিনি কোনো নার্সিং হোমে, তবে কেন, কীভাবে তা মনে পড়ছে না। এদিকটায় দেয়াল থাকায় আর কিছু চোখে পড়ল না। তিনি পাশ ফেরার চেষ্টা করলেন। নাহ্, ঘুরতে পারছেন না, শরীরটা কেমন আড়ষ্ট হয়ে আছে, ব্যথাও বোধ হচ্ছে। কয়েকবার ভালো করে শ্বাস নিলেন, তারপর একটু শক্তি সঞ্চয় করে চিৎ হয়ে শুলেন। তখন চোখের সামনে সাদা অ্যাপ্রোন পরা অল্প বয়েসি একটি মেয়েকে দেখা গেল।
‘স্যার, আপনার কিছু প্রয়োজন?’
আহমেদ কারিম যতটুকু দৃষ্টি দিতে পারেন সেটুকুতে আর একবার চোখ বুলিয়ে নেন, নার্স মেয়েটির দিকেও ভালো করে তাকান।
‘আমি একটু বাঁদিকে ঘুরতে চাচ্ছি, পারছি না কিছুতেই।’ কারিমের কণ্ঠে ও নিশ্বাসে ক্লান্তি আর অস্বাভাবিকতার ছাপ।
‘আপনার ছোট একটা সমস্যা হয়েছে। আপাতত চিৎ হয়ে শুয়ে থাকাই ভালো।’ তরুণী নার্স বেশ নির্বিকার।
‘আমি একটু ওদিকটা দেখব।’
কারিম এরই মধ্যে খেয়াল করেছেন তার দৃষ্টির দিকটাতে কেবল একটা উঁচু বড় কাচ-ঢাকা ভেন্টিলেটর আর বাকিটা সাদা দেয়াল।
‘আচ্ছা, আমি আপনার মাথার দিকটা উঁচু করে দিচ্ছি, আপনি তাহলে দেখতে পাবেন।’
মেয়েটি কথা বলতে বলতে কিসে একটা চাপ দিয়ে বেডের মাথার দিকটা উঁচু করে দিলো। আহমদ কারিম বাঁ-হাতটা নাড়তে গিয়ে খেয়াল করলেন সেখানে সুই ফোটানো, মাথার ওপরে স্যালাইনের ব্যাগ। তিনি বললেন, ‘আমার কী হয়েছে?’
‘তেমন কিছু না, প্রেশারটা একটু বেড়েছিল। দুদিনেই হয়তো ছাড়া পেয়ে যাবেন।’
আহমদ কারিম এতক্ষণে দেখলেন তার বাঁদিকের বিছানায় আরো একজন রোগী। তিনি অন্যদিকে তাকিয়ে থেকেও সম্ভবত অবচেতনে এই ঘরে আরো একটা মানুষের অসিত্মত্ব টের পেয়েছিলেন। লোকটার শরীরের সঙ্গে বেশ কয়েকটি নল ও তারের সংযোগ। পাশে বিভিন্ন আকৃতির অনেকগুলো যন্ত্রপাতি, সেগুলোর বিচিত্র আলো ও সিগন্যালও চোখে পড়ছে। এটা সম্ভবত আইসিইউ – হ্যাঁ তা-ই হবে। তাহলে তারও তো গুরুতর কিছু হয়েছিল। নার্স মেয়েটি কিছু লুকোচ্ছে – মামুলি প্রেসার বৃদ্ধি হয়তো নয়। মেয়েটি এখনো পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। আহমদ কারিমের মনে হলো তার গলাটা শুকিয়ে আছে। মেয়েটিকে বললেন, ‘আমি একটু পানি খেতে চাই, খিদেও পেয়েছে বোধহয়।’
মিনিটখানেক পরে ও পানি নিয়ে কাছে এলো। চায়ের চামচের এক চামচ পানি মুখে দিয়ে ভেজা কাপড়ের সাহায্যে ঠোঁট ভিজিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘স্যালাইন চলছে তো। আপাতত কোনো খাবার বা পানি দেওয়া যাবে না। স্যালাইন যেটুকু আছে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।’
পাশের বেডের রোগীটির অবস্থা হয়তো বিশেষ ভালো নয়; কিন্তু সে অচেতনও নয়। আহমদ কারিম খেয়াল করলেন রোগীটি অস্পষ্ট স্বরে নার্সকে কী যেন বলতে চাইছে; কিন্তু নার্স সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করছে না।
মেয়েটি বেরিয়ে গেলে আহমদ কারিম মনে করার চেষ্টা করলেন তিনি কেন কীভাবে এখানে এলেন। মনের ভেতরে বিভিন্ন কুঠুরিতে নানা রকম অনুসন্ধান চলল। নাহ্, ঠিক মনে পড়ছে না তো। অন্তত এটুকু তো মনে পড়বে – সর্বশেষ কোথায় ছিলেন তিনি? কারিম চোখ বন্ধ করলেন। হ্যাঁ, এবার চোখের সামনে দৃশ্যপটটা খুলে গেল, যদিও তা খুব স্পষ্ট নয়, কেমন ঘোলাটে। একটা কালো রঙের এয়ারকন্ডিশন্ড মাইক্রোবাস দ্রম্নত ছুটে চলেছে। কারিম বসে আছেন দ্বিতীয় সারির বাঁদিকের সিটে। গাড়ির ভেতর নজরুলের বা লালনের কী একটা গান বাজছে। বাইরে সবুজ গাছপালা আর ছোট ছোট টিলা। হঠাৎ দৃশ্যটা নিশ্চল হয়ে গেল। না আর তো কিছু মনে পড়ছে না। তিনি চোখ মেললেন। তাদের গাড়িটা কি অ্যাক্সিডেন্ট করেছিল? না, তার শরীরের কোথাও তো আঘাতের আঁচ পাচ্ছেন না। আর বাকিরাই বা কোথায়?
মাথার ভেতর অনেক হিসাবই গরমিল লাগছে। হঠাৎ মনে হলো কাছেই একটা ছায়া, ধীরপায়ে একজন মানুষ তার কাছে এসে দাঁড়াল। কারিম দৃষ্টি ঘুরিয়ে তাকালেন। হ্যাঁ, মুখটা যেন চেনা চেনা, কিন্তু নামটা মনে পড়ছে না যে।
লোকটা আরো খানিকটা কাছে এসে কথা বলে, ‘সস্নামালেকুম স্যার, এখন কেমন বোধ করছেন?’
‘ভালো। আপনি কে যেন ভাই?’
‘স্যার, আমি আশিক মুস্তাফা। আপনি চিনতে পারছেন না? আমাদের সংগঠনের আমন্ত্রণেই তো আপনি কক্সবাজার থেকে ফেরার পথে চট্টগ্রাম এলেন। আমরা এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করে আপনাকে অনুষ্ঠানের মঞ্চে তোলার পর আপনি অসুস্থ হয়ে যান। আমি এখানকার ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছি, এখন আপনি অনেক ভালো আছেন।’
‘ও হ্যাঁ। তোমাদের লিটল ম্যাগাজিনের ২০ বছর পূর্তি; কিন্তু আমি এখানে কেন?’
‘ওই যে বললাম, আপনি একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। আমরা রিস্ক না নিয়ে আপনাকে সোজা এই ক্লিনিকে নিয়ে আসি।’
‘আমার তো আজই ঢাকা ফেরা দরকার।’
আশিক বলল, ‘সে-বিষয়টা ডাক্তারের সঙ্গে ডিটেইল কথা বলে ডিসাইড করা যাবে। আমরা দুঃখিত যে, আমাদের এখানে এসে আপনার এ-অবস্থা হলো।’
কারিমের মনে একটা জবাব এলো – অসুস্থতা আর মৃত্যু থেকে কখনো পালিয়ে বাঁচা যায় না। এজন্য তোমাদের দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু কথাগুলো তার বলতে ইচ্ছা হলো না। এ-কথা বাদ দিয়ে তিনি অন্য কী কথা বলবেন তা ভাবছিলেন। তখন নার্স এসে সতর্ক করল, ‘প্যাশেন্টের সঙ্গে বেশি কথা বলার অনুমতি নেই। একটু পরেই বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আসবেন।’
আহমদ কারিমের এবার মনে পড়ে – দু-তিন সপ্তাহ লেখাটা একেবারেই আসতে চাইছিল না। দুটো-তিনটে গল্প এক পৃষ্ঠা করে লেখার পরে মাথায় কিছু কাজ করছিল না। অথচ এক সময় শুরু করাটাই সামান্য কঠিন হতো। তারপর একরাত-দুরাতে একটা করে গল্প শেষ করা অসম্ভব হতো না; কিন্তু এখন তো কলম চলছে না। নিজের ভেতর একটা সংশয়ও জাগে – তিনি কি ফুরিয়ে আসছেন? তার জীবনের এখন আর একটাই চাওয়া বাকি – তিনি শেষ দিন পর্যন্ত লিখে যেতে চান। থেমে যাওয়া চলবে না, যে করেই হোক আবার শুরু করতে হবে। তাই চেঞ্জের জন্য পাঁচ দিনের ট্যুরে কক্সবাজার এসেছিলেন। তখনই আশিক আর তার বন্ধুরা ফোন দিয়েছিল, ‘কারিমভাই আপনি যদি দয়া করে আমাদের এই অনুষ্ঠানে অ্যাটেন্ড করে যান – এ-সংগঠনে আপনার অনেক ভক্ত আছে। যেহেতু কাছাকাছিই আছেন – আপনাকে তো আর সহজে পাব না।’
আহমদ কারিম ঢাকা থেকে বাসেই এসেছিলেন কক্সবাজার। তবে পস্ন্যান ছিল ঢাকায় ফিরবেন বিমানে। কিন্তু চট্টগ্রামের ওই ছেলেদের আমন্ত্রণ রক্ষা করতে টিকিট ক্যানসেল করেন। সংগঠনই কক্সবাজার টু চট্টগ্রামের টিকিট অ্যারেঞ্জ করে। হ্যাঁ, কক্সবাজার এয়ারপোর্টে ছোট্ট একটা পেস্ননে ওঠা পর্যন্ত মনে পড়ছে। খানিক আগে তো একটা চলমান কালো মাইক্রোবাসের কথাও মনে পড়ছিল; কিন্তু দৃশ্যগুলোর ধারাবাহিকতা তিনি ঠিক মেলাতে পারছেন না।
আধ ঘণ্টা পরে বয়স্ক একজন ডাক্তার এলেন, চেহারা দেখে বেশ আস্থা জন্মাল কারিমের। নার্সের কাছ থেকে নিয়ে কারিমের ফাইলটাতে তিনি মনোযোগের সঙ্গে দৃষ্টি রাখছিলেন। সেখানে তার লেখা শেষ হলে কারিম ডাক্তারকে বললেন, ‘আমি কি আজ চলে যেতে পারব?’
‘না, আরো অন্তত একটা দিন আপনাকে থাকতে হবে, তাছাড়া আপনি এখন লম্বা জার্নি করে ঢাকায়ও তো যেতে পারবেন না। তবে হ্যাঁ, আশা করি কাল সকাল নাগাদ আপনাকে আইসিইউ থেকে সাধারণ কেবিনে শিফট করা হবে।’
‘আমার ঢাকায় ফেরাটা খুব জরুরি।’
‘হ্যাঁ, সে তো হবেই – আপনি ব্যস্ত ও বিখ্যাত লেখক – আমিও কিন্তু আপনার কিছু লেখা পড়েছিলাম। আজকাল অবশ্য আর সময় হয়ে ওঠে না।’
অসুস্থ অবস্থায়ও একজন ডাক্তার-পাঠকের কথা শুনে কারিমের ভালোই লাগে। ডাক্তার ভ্রূ কুঁচকে পাশের রোগীটিকে অনেকক্ষণ ধরে নিরীক্ষণ করলেন। রোগী ডাক্তারকে অস্পষ্ট আওয়াজে কী যেন বলতে চাইলেন তার কিছুই বোঝা গেল না।
ডাক্তার চলে গেলে খানিক বাদে সিস্টারকে আবারও কী যেন অনুনয় করলেন; কিন্তু নার্স মেয়েটি আবারও যথারীতি এড়িয়ে গেল। তখন আহমদ কারিম বিরক্ত বোধ না করে পারলেন না। বললেন, ‘সিস্টার, একটু এদিকে আসুন তো!’
মেয়েটি কারিমের মাথার কাছে এগিয়ে এলো। ‘জি বলুন।’
‘আচ্ছা আমি কঘণ্টা ধরে খেয়াল করছি, তিনি কী যেন বলতে চাইছেন, আপনারা কেউ শুনছেন না কেন?’
‘তিনি একটা ফোন করতে চান।’
‘তো দিচ্ছেন না কেন?’
‘আসলে ওনার তেমন কেউ নেই। আর যাকে ফোন করতে চাইছেন তার ফোন নম্বর জানেন না?’
‘রোগীর কোনো পরিচিতজন বা আত্মীয়ের কাছে নম্বরটা পাওয়া যায় না?’
‘না, কারো কাছে নেই, কোথাও নেই, কেউ জানে না।’
‘মানে কার সঙ্গে কথা বলতে চান? ওনার স্ত্রী নাকি সমত্মান?’
‘বললাম, সেরকম আপন কেউ তার নেই।’ তিনি একটা ওল্ড হোমে থাকেন।
‘তবে কে সে, কার কাছে ফোন করতে চান? ওল্ড হোমে যোগাযোগ করলে ওনার কোনো আত্মীয়ের ফোন নম্বর জানা যাবে না?’
‘তিনি নাকি ভগবানকে ফোন করবেন। আসলে অসুস্থ হয়ে মাথাও ঠিক নেই, এটা তার তৃতীয় স্ট্রোক।’
মারাত্মক রোগশয্যায় ঈশ্বরকে ফোন? ভারি অদ্ভুত ব্যাপার তো! কারিম ভাবেন।
আহমদ কারিমের মনে হয় তিনি যদি জানতে পারতেন ভগবানকে মুমূর্ষু মানুষটা কী বলতে চান তাহলে বেশ হতো। কারিম যদি সুস্থ থাকতেন তাহলে কাউকে ফোনের ওপারে ঈশ্বর সাজিয়ে লাইনটা দিয়ে বলতেন – ‘এই নিন, ঈশ্বর লাইনে আছেন, আপনি কথা বলুন’, তাহলে শোনা যেত তিনি কী কথা বলেন। দু-এক মুহূর্ত বাদে একজন গুরুতর অসুস্থ লোককে নিয়ে এমন মজা করার কথা ভাবায় নিজেকে অনেকটা হীন মনে হয় কারিমের। তবে এমন যদি হয়, তারা দুজনই সুস্থ; কোনো এক আড্ডায় তাকে জিজ্ঞেস করা যেত – ‘আপনি রোগশয্যায় কী বলতে চেয়েছিলেন ভগবানকে?’
লোকটা কে? কী পেশা ছিল তার? কেমন কেটেছে অতীত জীবন? কোনো সাধু-সন্ত প্রকৃতির মানুষ? নাকি কেবল বখাটেপনা করে কাটিয়ে দিয়েছেন সমগ্র যৌবন? – তাই শেষ জীবনে এমন আতঙ্কিত। হয়তো ভেতরে প্রবল মৃত্যুভয় তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। কী জানি, অহেতুক অনুমান করা ঠিক নয়। তবু মানুষটা সম্পর্কে জানার একটা অন্যায় কৌতূহল কারিমের ভেতরে আকুলি-বিকুলি করতে থাকে।
খানিক বাদে নার্স এসে কারিমের অন্য হাতে নতুন সুই ফুটিয়ে আরো নতুন একটা স্যালাইন চালু করে দিলো, তখন বিকেল প্রায় চারটা, জানালার বাইরের আকাশে সাদা মেঘগুলো চঞ্চল হয়ে উঠেছে।
কারিম বললেন, ‘আমার এগুলো কখন খোলা হবে?’
‘আগামীকালের আগে আপনি মুখে খাবার খেতে পারবেন না, তাছাড়া স্যালাইনের মধ্য দিয়ে আপনার শরীরের আরো কিছু ইনজেকশনও যাবে। ইনজেকশনটা দেওয়ার পর খোলা হতে পারে।’
কথাগুলো শুনে কারিমের আরো অস্থির বোধ হতে থাকে। আরো একটা দিন এই বন্দিশালায়?
তার তো জরুরি একটা ফোন করা দরকার। কাকে যেন ফোন করবেন? স্ত্রীকে? একমাত্র কন্যাকে? নাকি কোনো প্রিয় ভক্তকে?
আচ্ছা, তিনি যে চট্টগ্রাম এসে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন সে-খবর ওদের কাছে পৌঁছেনি? ওরা একটা ফোনও তো করল না। এক্ষুনি একটা ফোন করা দরকার। কিন্তু মোবাইল সেটটা হাতড়ে তো কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। আহমদ কারিম চিৎকার করে ওঠেন – ‘সিস্টার, সিস্টার – আমার মোবাইলটা দিন, একটা ফোন করতে হবে, খুব জরুরি।’
কয়েকবার করে তিনি ডাকলেও কেউ যেন তার কথা শোনে না। নাকি আওয়াজটা খুব অস্ফুট হয়ে বেবোচ্ছে, কারিম ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না। তার গলাটা খুব শুকিয়ে আসছে। একগস্নাস হিমশীতল পানি পান করা দরকার তার। তিনি এবার ‘পানি পানি’ বলে চিৎকার করেন; কিন্তু আশপাশে কেউ শুনতে পাচ্ছে বলে মনে হলো না। কারিমের যখন ঘুম ভাঙল, তখন ভোরের আলো ঠিকরে পড়েছে কামরার শুভ্র মেঝেতে। ঘরটা খুব সুনসান। যে-মেশিনগুলো থেকে সূক্ষ্ম আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল সেগুলো কি বন্ধ? কারিমের দৃষ্টি গেল কক্ষির অন্য বেডে। ওটা খালি। লোকটাকে কি রিলিজ দিয়ে দিলো – কারিমের আগেই?
আহমদ কারিম সিস্টারকে ডাক দিলেন। সিস্টার বোধহয় কাছেই ছিল। ‘জি স্যার বলুন।’
‘আচ্ছা – পাশের বেডের লোকটা কোথায় – ছাড়া পেয়ে গেছে? কখন?’
‘হ্যাঁ, গতকাল রাত তিনটেয়।’
‘তো আমাকে ছাড়ছেন না কেন আপনারা?’
‘লোকটা তো তার ভগবানের কাছে গিয়েছেন।’
কারিম কথাটা শুনে প্রথমে শুধু বললেন, ‘ও আচ্ছা’। খানিক বাদে অনেকটা অস্ফুট স্বরে বললেন, ‘ফোনে পাওয়া গেল না বলে সশরীরেই চলে গেলেন?’
তখনই আবার মনে হলো, না – লোকটার শরীরটা তো যায়নি, বড়জোর গিয়েছে ভেতরের পাখিটা। পাখির কথা মনে হতেই কারিমের বুকের ভেতর যেন একটা পাখি ডানা ঝাপটাতে থাকল। আহমদ কারিম তার গল্প-উপন্যাসে বহু চরিত্রের মৃত্যু ঘটিয়েছেন। জীবন-মৃত্যু তার লেখার খাতায় এক ধরনের খেলা। কোথাও তিনি মৃত্যুকে ভয়ংকর ও যন্ত্রণাময় করে এঁকেছেন, আবার কোথাও ছিল নিছক রোমান্টিক বা মিস্টিক মনের প্রতিফলন। কারিম নিজে আরো একাধিকবার ক্লিনিকে থেকেছেন, কিন্তু এবার সবকিছু অন্যরকম ঠেকছে – এতটা অস্থির আর অসহায় জীবনে আর কখনো লাগেনি। আশপাশে কোনো নিকটজনও নেই। যে-লোকটা মারা গেল তার ওই আইডিয়াটা কারিমের খুব ভালো লেগেছে। যদিও ভগবানের সঙ্গে কথা বলতে চাওয়াটা নতুন কিছু নয়, তবু এই পরিবেশে এমন একজন মৃত্যুপথযাত্রীর সে-চাওয়াটা একেবারে ভিন্ন অনুভবের জন্ম দেয়।
এসব ভাবতে ভাবতে আবারও তার ফোনের কথা মনে হলো। আশ্চর্য! ওই চলে যাওয়া লোকটার মতো তারও ঈশ্বরকে ফোন করতে ইচ্ছা করছে। প্রচ- তাগিদ বোধ হচ্ছে – হ্যালো, পরম দয়ালু ঈশ্বর বলছেন? আমি আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। দয়া করে ফোনটা কাটবেন না; কিন্তু কী বলবেন তাকে? কারিমের তো কোনো কথা নেই। অথবা, এত বেশি কথা আছে, যা শুরু হলে শেষ হওয়ার নয়। বরং তার মুখোমুখি বসে বলতে পারলেই ভালো হতো।
কিন্তু ফোন – ফোন কোথায় পাওয়া যাবে? সিস্টারকে অনুবোধ করবেন? না, লাভ হবে না। একজনকে ওরা যেভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে, তাতে ফোন ধার চাইবার আর অভিরুচি নেই।
মার্কেজের একটা গল্পের কথা এ-মুহূর্তে মনে পড়ছে কারিমের। সমুদ্রতীরের বাসিন্দাদের মধ্যে কেউ কেউ হঠাৎ সামুদ্রিক বাতাসের সঙ্গে গভীর রাতে ফুলের গন্ধ পেতে শুরু করে। যারা গন্ধ পায় বেশিরভাগই বৃদ্ধ। এই গন্ধ পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যে তারা মারা যায়। গন্ধ পেলে তাই অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে উঠত। কারণ অনেকে বলেছে, ওই গন্ধটা আসে স্বর্গ থেকে। এই ফুলের সুবাস হলো স্বর্গ থেকে আসা মৃত্যুর বার্তা।
মানুষ যা ভাবে, বিচ্ছিন্ন এলোমেলো ভাবনার মধ্যেও কার্যকারণ সম্পর্কসূত্র পাওয়া যায়। কারিম ঈশ্বরকে ফোন করার কথা ভাবছেন, তবে কি আজ রাতেই তার মৃত্যু হবে – গল্পের ওই লোকটার মতো?
নাহ, তা হবে কেন? এ-কথা যখন তিনি ভাবছেন, ভেতর থেকে কে যেন বলে ওঠে – হবেই বা না কেন? হলে দোষ কোথায়?
এ কী হলো তার? তিনি কি সামান্য ঘটনায় মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছেন? এ-ধরনের অপচিমত্মা কি ছোঁয়াচে হতে পারে? পাশের বেডের ওই রোগীর কাছ থেকে তার কাছে চলে এলো?
আশিক সালাম দিয়ে রুমে ঢুকল। ‘স্যার, আপনার মোবাইলটা হয়তো কোনোভাবে মিসিং হয়েছে। আপনার পকেট, হাতব্যাগ সব চেক করেছিলাম, পাইনি। তাই আপনার বাসায় যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। আপনি যদি একটা নম্বর বলেন -’
কারিমের মনে হয় মেয়ে সেঁজুতি কিংবা ওর মাকে তো এক্ষুনি একটা ফোন করা দরকার। তিনি বলেন, ‘তাই নাকি? আচ্ছা নম্বরটা লিখুন তো আশিক -’
‘জি বলুন।’ আশিক তার মোবাইল সেটে নম্বরটা সেভ করার জন্য প্রস্ত্তত হয়।
কারিম বলেন – ‘জিরো ওয়ান,… তারপর প্রায় তিরিশ সেকেন্ডেও তিনি কোনো সংখ্যা বলতে পারেন না।’
আশিক বলে, ‘মনে পড়ছে না?’
কারিমের মুখে একটা বিমর্ষ ব্যথা ছায়া ফেলে। ‘নাহ, মনে করতে পারছি না যে! আমার মেয়ের নাম সেঁজুতি – ওর নম্বরটা আমি কখনো ভুলি না।’
‘ম্যাডামেরটা?’
‘নাহ্, কিচ্ছু মনে পড়ছে না।’
‘তাহলে তো আপনার নামে নতুন সিম না তোলা পর্যন্ত যোগাযোগ করা যাচ্ছে না, আচ্ছা দেখি বিকল্প কী করা যায়। আপনি চিমত্মা করবেন না। আমরা জানানোর একটা উপায় বের করব।’
এর খানিক পর কারিমের অনুমতি নিয়ে একদল ছেলেমেয়ে এলো। তাদের হাতে একঝুড়ি ফুল। মুখে সুস্থতা কামনার শুভেচ্ছা। ওদেরকে দেখে কারিমের মনে হলো, তিনি খ্যাতিমান লেখক না হয়ে আজ যদি এই তরুণদের মধ্যে নিতান্ত সাধারণ একজন হয়ে যেতে পারতেন তো বেশ হতো। অবশ্য আবারও একটা দীর্ঘ জীবনের পরিক্রমা – সে-স্বপ্ন তাকে বিশেষ টানে না। তার কাছে একটা জীবনই যথেষ্ট মনে হয়। কিছু অতৃপ্তি আছে, থাকবে। সে-অতৃপ্তি বোধহয় হাজার মানবজনমেও মিটবে না। ব্যাপারগুলো কারিম তার নিজের মতো করে ভাবতে পছন্দ করেন।
পরের রাতটা ভারি অস্থির লাগে। ঘুম আসতে চায় না। চোখ মেললে মনে হয় ঘরের দেয়ালগুলো তিরতির করে কাঁপছে। পাশের বেডে নতুন রোগী এসেছে, এই রোগী আগের জনের মতো বৃদ্ধ নয়, তরুণ কিংবা বড়জোর প্রৌঢ়। সে কাতরানির মতো বিচিত্র আওয়াজ করছে বলে ঘুমোনোর আরো বেশি অসুবিধা হচ্ছে। কারিম তখন ভাবছিলেন নার্সকে একটা ঘুমের ওষুধ দিতে বলবেন কিনা, ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া নার্স তো ওষুধ দেবে না। জেগে থাকলে নতুন কোনো লেখার পস্নট নিয়ে ভাবা যাবে। আহমদ কারিম চোখ বন্ধ করে ভাবেন, চোখের সামনে যে-দৃশ্য আসবে, সেটা দিয়েই শুরু করবেন পরবর্তী রচনা। তিনি চোখ বন্ধ করে দেখলেন তার বালকবেলার নদীতীর। তিনি কলার ভেলায় ছোট্ট স্রোতস্বিনী নদীটা পাড়ি দিচ্ছেন। হঠাৎ একটা প্রবল ঢেউ এসে তার ভেলাটা জলের নিচে তলিয়ে দিলো, তিনি হাবুডুবু খেতে থাকলেন জলে। আশৈশব পরিচিত নদীটাতে তিনি সাঁতার কাটতে পারছেন না কেন? তাঁর দম আটকে আসছে।
আহমদ কারিম যখন চোখ মেললেন, তখন তার মুখে অক্সিজেনের মাস্ক পরনো। মনে পড়ল সেই দুঃস্বপ্নটা। অর্থাৎ তার শরীরের কষ্টটাই দুঃস্বপ্ন হয়ে ধরা দিয়েছিল তার চেতনায়। তাই তিনি জলে ডোবার স্বপ্ন দেখেছেন। হঠাৎ মনে হলো, তিনি যেন তার মেয়ে সেঁজুতিকে দেখতে পাচ্ছেন; কিন্তু ও কীভাবে আসবে। আর একটু ভালো করে চোখ মেলে সামান্য ডানে ঘুরে দেখলেন, হ্যাঁ, সত্যিই তো সেঁজুতি; তিনি স্পষ্ট তার কন্যাকে দেখতে পাচ্ছেন। সেঁজুতির অশ্রম্ন-টলমল চোখ, পাশেই ওর মা দাঁড়িয়ে।
কথা বলার জন্য কারিমের বুকটা ফেটে যাচ্ছে। ওরা কেমন আছে? কীভাবে খবর পেল। তার মোবাইলটা হারিয়ে গেছে; কিন্তু তার মুখ তো বাঁধা নয়।
অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে দুপুরের পর ডাক্তার রিলিজ দিয়ে দিলেন। বললেন, ‘চাইলে আজই আপনারা ঢাকায় চলে যেতে পারবেন।’ ভাগ্য ভালো, বিকেল পাঁচটার ফ্লাইটে তিনটে সিটও পাওয়া গেল। পেস্ননে উঠে কারিমের মনে হলো, কী যেন একটা জরুরি কাজ আছে – হ্যাঁ, একটা ফোন করতে হবে। মেয়েকে বললেন, ‘তোর মোবাইলটা দে তো মা।’
‘এখানে কি নেটওয়ার্ক পাবে? আচ্ছা দেখছি। নম্বরটা বলো আমি ডায়াল করে দিচ্ছি।’
‘নম্বর – নম্বর তো মনে পড়ছে না।’
কারিম মেয়েকে কী করে বলবেন, যার সঙ্গে কথা বলতে চান তার ফোন নম্বরটা তার জানা নেই। পেস্ননটা সাদা মেঘ ভেদ করে ভেতরে ঢুকে পড়ছে। হঠাৎ কারিমের মনে হলো – আচ্ছা, এই উড়োজাহাজটা যদি চিরকালের জন্য মহাশূন্যের কোনো গহবরে বিলীন হয়ে যেত তাহলে মন্দ হতো না। তাতে কি নির্বাণ লাভ ঘটত তার? নাকি অজানা ফোন নম্বর নিয়ে কৌতূহল আরো তীক্ষন হতো? অথবা তিনি চলে যেতেন সকল অনুভবের ঊর্ধ্বে?
কারিমের মনে হয়, তার এই অদ্ভুত ভাবনাগুলো কারো সঙ্গে শেয়ার করা দরকার, নাহলে বিচিত্র চিমত্মারাশি চেতন-অবচেতনের গহবরে দলা পাকিয়ে তাকে সিজোফ্রেনিয়ার পাঁকে ফেলতে পারে। কারিমের মনে খোঁচা মারে – তার নিজের অনেক লেখায়ই এই রোগের কথা এসেছে। সেসব চরিত্রের জন্য আজ সত্যিই খুব মায়া হচ্ছে। তিনি ভাবছিলেন সেঁজুতিকে কথাগুলো বলবেন। তাতে ভেতরের চাপটা খানিক কমতে পারে। সেসব শুনে সেঁজুতি কি আজো তাকে মনোচিকিৎসকের কাছে নেওয়ার জন্য জোরাজুরি করবে? ভাবনা যখন এই অবধি, তখনই ঘোষণা এলো পেস্নন ঢাকা এয়ারপোর্টে কিছুক্ষণের মধ্যে ল্যান্ড করবে। কারিম তখন নিজস্ব পৃথিবীতে মন কেন্দ্রীভূত করার চেষ্টা করেন। মনে হয় অন্তত আরো কিছু দিন – আরো কিছু রাত। পেস্ননের চাকা মাটি স্পর্শ করতেই কারিমের মনটা চঞ্চল হয়ে ওঠে – এই তো পেয়ে গেছি নতুন নভেলের পস্নট – একেবারে অন্যরকম কিছু লিখব এবার।
[কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের একটি সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষের প্রেরণা রয়েছে এই গল্পে, তবে বিষয়বস্ত্ত, প্রেক্ষাপট ও চরিত্র সম্পূর্ণই কাল্পনিক]