কিছুকাল হলো গোয়েন্দা বিভাগের সেলের সিনিয়র ইন্সপেক্টর কানাইচরণ ক্লোজ হয়েছেন। নানারকম গোলমেলে কাজ করে বড়কর্তাদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। কানাইচরণের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা আর সুখ্যাতির কথা ভেবে লালবাজার থেকে দূরে পাঠায়নি, আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকতে বলা হয়েছে; কিন্তু কোনো কেস-ফাইল দেওয়া হচ্ছে না। তেমন গুরুতর কিছু ঘটলে ক্লোজড থেকে ওপেন হতেও যে বেশি সময় লাগবে না, কানাইচরণ তা জানেন। কানাইচরণ তাই এই সবেতন ছুটি বেশ উপভোগ করছেন বলা চলে। সকালে, বাড়িতে এক গরাস খেয়ে লালবাজারে চলে আসছেন। লালবাজারের পেটের ভেতর তার ছোট্ট চেম্বার, কোনো জানালা নেই, দুখানি দরজা – ক্রিমিনাল রেকর্ডস আর ডিসি – ক্রাইমের ঘরের দিকে চলে গেছে। চেম্বারে দুটি টেবিল-চেয়ার, একটিতে কানাইচরণ, অন্যটিতে সৌভিক – জুনিয়র ইন্সপেক্টর, ফোর্সে বেশিদিন হয়নি। কানাইচরণকে গুরু বলে ডাকে, সিগারেট-কফিটা নিজের পকেট কেটে খাইয়ে দেয়, আর যতদিন না পুনর্বহাল হচ্ছেন, সৌভিক বলেছে – কানাইদা, ডেকার্সে দুপুরের জলখাবারটা আমার খাতায় খাবেন। কানাই তাই দশটায় অফিসে ঢুকে একটা সিগারেট শেষ করেই পুরনো ফাইল খুলে বসছেন আর কেস রিপোর্ট শেষ হওয়ার আগেই নির্ভুলভাবে বলে দিচ্ছেন অপরাধীর নাম।
ক্রিমিনাল রেকর্ডস সেকশনের রেজিস্ট্রার ভদ্রমহিলাটিকে কানাইয়ের বেশ লাগে। পৃথুলা, গোল চশমা, কাঁধের কাছে সেফটিপিন-আটকানো শাড়ি, কানাই ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে ভাবেন – নিজের বয়সটা যদি আটান্ন না হয়ে তিরিশ-বত্রিশ আর ভদ্রমহিলার পঁচিশ কি তিরিশ, বেশ একটা অফিস রোমান্স তৈরি হতে পারত। সাতসকালে কানাইকে দেখে ভদ্রমহিলা এমনভাবে হাসলেন, যেন অফিস খোলার পর থেকেই আজ তিনি কানাইকে আশা করছিলেন। কানাই অনুযোগের সুরে বললেন, কী একঘেয়ে সব খুনের তামাদি ফাইল দিচ্ছেন দিদিমণি। একটা জম্পেশ কেস দিন না। বিকেলের জলখাবার অবধি যাতে কেসটা চলে।
দিদিমণি বললেন, আজ একটা জম্পেশ ফাইলই আপনার জন্য রেখেছি, যাকে বলে আনসলভ্ড মিস্ট্রি।
কানাই হতাশ গলায় বললেন, লালবাজারে আনসলভড বলে কিছু তো নেই, দুটো প্যাঁদানি দিলেই সব সলভ্ড। এই স্যরি, কিছু মনে করলেন না তো?
দিদি পাত্তা না দিয়ে বললেন, এটা তো মার্ডার কেস নয়, জাহাজ হারিয়ে যাওয়ার কেস। তাও খোদ বঙ্গোপসাগর থেকে। ব্রিটিশরাজের নাকের ডগা দিয়ে।
– বলেন কী! বঙ্গোপসাগর কবে থেকে বারমুডা ট্রায়াঙ্গল হয়ে গেল! দিন দিন, দেখি।
রেজিস্ট্রার দিদি রদ্দি-ঝড়তিপড়তি একগাদা ফাইল হাতবদল করতে করতে বললেন, ভালো সময়ে ফাইলগুলো আপনার কাছে গেল; পরের মাসেই পুলিশ মিউজিয়ামে পাঠাতে হবে। কানাইচরণকে একগাদা ময়লা, হলুদ, প্রায় ঝুরো ফাইল নিয়ে চেম্বারে ঢুকতে দেখে সৌভিক তাড়াতাড়ি উঠে কানাইয়ের টেবিলে এক প্যাকেট নেভিকাট রেখে দিলো। এই সময় কানাইচরণ কথাবার্তা একদম পছন্দ করেন না, শুধু নেশার জিনিসের জোগানটা ঠিকমতো হলেই হলো। জুনিয়র ইন্সপেক্টরকে কানাই সবসময় বলেন, কেস ফাইলগুলি সবসময় ঠিকমতো পড়বি, ওগুলির ভেতরই সব ক্লু আছে, যত ভোদাই সাব-ইন্সপেক্টর হোক না কেন, কেস ডায়েরিটা ঠিকমতো দিতে পারলেই কেলস্নাফতে। সৌভিক দেখল, কানাইচরণ ফাইলের মধ্যে ডুবে গেছেন, যন্ত্রের মতো হাত এসে প্যাকেট থেকে সিগারেট নিয়ে মুখে উঠিয়ে দিচ্ছে। কানাইচরণ ভ্রূ কুঁচকাচ্ছেন, কাগজ হাতড়াচ্ছেন। আর বোধহয় কেস ফাইলের মধ্যে থাকতে পারলেন না। এবার কোর্ট প্রসিডিংসের কপিও খুলে ফেলেছেন। ঘড়ির কাঁটা বারোটার দিকে যাচ্ছে কিন্তু কানাই একটা শব্দও করেননি; অন্যান্য দিন এতক্ষণে শুধু কেস ফাইল পড়ে দু-একটা প্যাঁদানির নিদান দিয়েই কানাই কেস গুটিয়ে নেন। সৌভিক ঝটপট হাতের কাজগুলো করে ফেলে কানাইকে বলল, দাদা কি ডেকার্সের দিকে আজ যাবেন?
কানাই চিমত্মার অথই সমুদ্র থেকে উঠে এলেন। হেসে বললেন, তোকে এখনো ব্রিফ করিনি না? চল হাঁটতে হাঁটতে বলব। দুজনে ব্যস্ত বউবাজার স্ট্রিটে নেমে এলেন। কলকাতার জনস্রোতের মাঝে দুই গোয়েন্দা। কানাইচরণ নিচু গলায় বলা শুরু করলেন – সংক্ষেপে বিষয়টা এরকম। ১৯১১ সালের ঘটনা। বাঙালির বিপস্নব প্রচেষ্টায় ব্রিটিশ থরথর করে কাঁপছে। মানিকতলা বোমা মামলা গুটিয়ে গেছে। অরবিন্দ ছাড়া পেয়ে গেছেন। কলকাতায় বিপস্নবীদের উপদ্রব অনেকটা শান্ত; কিন্তু ঢাকায় অশামিত্ম তখনো চলছে। এমন সময় কলকাতায় ধরা পড়ল এক স্পাই, নাম নৃপেণ চট্টরাজ। যে-সে জায়গা থেকে নয়, খোদ লালবাজার থেকে ধরা পড়ল। সে ছিল লালবাজারের ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যুরোর অধস্তন কর্মচারী, ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যবস্থার আদি পুরুষ আজিজুল হক আর হেমচন্দ্র বোসের সাক্ষাৎ শিষ্য। কিন্তু মনেপ্রাণে নিখাদ দেশভক্ত, বিপস্নবীদের প্রতি নরম-মনোভাবাপন্ন। অনুশীলন সমিতির বহু সদস্যের সঙ্গে ছিল গভীর সখ্য আর যোগাযোগ। সরাসরি বিপস্নব প্রচেষ্টায় অংশ না নিলেও নৃপেণ বিপস্নবীদের পরোক্ষভাবে সাহায্য করতে শুরু করে। লালবাজারে কাজ করার ফলে পুলিশের নানা কার্যকলাপের খবর তার কানে আসতই। নৃপেণ সাংকেতিক চিঠি লিখে বিপস্নবীদের খবর পাচার করতে থাকে। বিপস্নবীদের ধরপাকড় শুরু হলে নৃপেণের সঙ্গে বারীন ঘোষ বা হেম কানুনগোর প্রত্যক্ষ যোগাযোগ বন্ধ হয়ে আসে; কিন্তু পুলিশের চোখকে ফাঁকি দেওয়ার উপায় নৃপেণ খুঁজে নেয়। সাংকেতিক চিঠিগুলি নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব থাকত নৃপেণের ঠিকে ঝিয়ের ওপর। সে বেচারি ছিল নির্দোষ, কর্তার আদেশ সে কেবল পালন করত। ভাবত, পুলিশের কাজ করায় কর্তা বুঝি কোনো সরকারি কাগজ দিয়ে থাকবে! এই ঝিয়ের চরিত্র খুব একটা সুবিধার ছিল না। ঝিয়ের ঘরে একবার এক দেশি পুলিশ অফিসার এসে সাংকেতিক চিঠিটি নজর করে। ঝিকে গ্রেফতার করা হয়। সে-বেটি বুক ঠুকে নৃপেণের নাম বলে দেয়। ভেবেছিল, নৃপেণের নাম শুনলেই পুলিশরা তাকে ছেড়ে দেবে; কিন্তু হিতে হলো বিপরীত। চিঠির সংকেত উদ্ধার করা হলে দেখা গেল – চিঠিটি ঢাকার অনুশীলন সমিতির জনৈক সদস্য অমর চট্টোপাধ্যায়কে লেখা হয়েছে। লালবাজারের দুঁদে পুলিশকর্তা গডফ্রে দিনহ্যামের গতিবিধি জানানো হয়েছে চিঠিতে। নৃপেণ গ্রেফতার হলেন। খোদ লালবাজারের ভেতর খোচর ধরা পড়ায় বড়কর্তাদের মহলে বেশ শোরগোল পড়েছিল আর কী! যদিও খবরের কাগজে হাফ কলামের বেশি জায়গা নেয়নি।
আত্মপক্ষ সমর্থনে নৃপেণ চিঠির কথা স্বীকার করে বললেন, তিনি তার বিপথগামী বিপস্নবী বন্ধুদের পুলিশের ভয় দেখিয়ে নিরস্ত করার চেষ্টা করছিলেন; কিন্তু আদালতে সে-দাবি ধোপে টিকল না। তার তো আর চিত্তরঞ্জন দাশ নেই। তার ওপর গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো ব্রিটিশরা রাজসাক্ষী করল নৃপেণেরই এক তুতো ভাইকে। সে স্বীকার করল, দাদার টিকটিকিগিরির ভাগীদার সেও ছিল। আদালত তাকে রেহাই দিলো আর নৃপেণের হলো কালাপানি। আন্দামানের সেলুলার জেলে তখন অনুশীলন সমিতির সাজাপ্রাপ্ত সদস্যদের আনাগোনা চলছেই। নৃপেণ বোধহয় আশ্বস্তই হয়েছিলেন, ফাঁসিতে ঝুলতে হলো না। ১৯১৩-এর সেপ্টেম্বরে খিদিরপুর থেকে নৃপেণকে নিয়ে জাহাজ ছাড়ল। হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল এক ইংরেজ অফিসার, উইলসন আর দুই দেশি হাবিলদার – রাম সিং আর নবীনকুমার হোতা। জাহাজের নাম ‘জর্জ দ্য স্যভিওর’। দেড় দিনের মাথায় সে-জাহাজের সাগরে পৌঁছানোর বার্তা কলকাতা বন্দরে এলো। এরপর সপ্তাহখানেক পর কলকাতামুখী একটি জাহাজ জর্জকে দেখতে পায়। জর্জ পালটা হর্ন বাজিয়ে বার্তা দেয়। সেটাই জর্জের শেষ খবর। এর পর জর্জ নিরুদ্দেশ। রিপোর্ট বলছে, সমুদ্র শান্তই ছিল। আগুন ধরার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আন্দামানে জাহাজ যে অন্তত পৌঁছায়নি, সে-বিষয়টি নিশ্চিত। কলকাতার কাগজগুলি লিখেছে – অতঃপর নৃপেণের আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি। লালবাজারের স্পেশাল ব্রাঞ্চের হাতে কেস আসে। স্পেশাল ব্রাঞ্চ, যা হয় আর কী, প্রাইমারি ইনভেস্টিগেশন করে, কিছু জানতে না পেরে রিপোর্ট লিখে দেয় ড্রাউনড ইন দ্য স্যান্ড ডিউনস অব সাগর, সাগরের বালুচরে গিয়ে ডুবেছে। আর যোগ করে, যে-জাহাজটি সমুদ্রে জর্জকে দেখেছিল সেটি তাদের ভ্রম ছিল। সে-সময়ে একটি মালয় জাহাজ কলকাতা থেকে সিঙ্গাপুর যাচিছল, তাকেই জর্জ বলে ভুল করে। জর্জ প্রকৃতপক্ষে সমুদ্রে যায়ইনি, মোহনার কাছেই চলে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে এর সলিল সমাধি ঘটে। স্পেশাল ব্রাঞ্চের কর্তারা আশা করেছিলেন, নদীখাত বদলালে হয়তো জর্জের মাস্ত্তল দেখা যাবে; কিন্তু বিগত একশ বছরে হুগলি বহুবার বাঁক নিলেও জর্জ আর ভেসে ওঠেনি। এই হলো গল্প। এবার তুই বল, কী সিদ্ধামেত্ম আসা যায়? কানাইচরণ সৌভিককে জিজ্ঞাসা করলেন। সৌভিক এগ চাউমিনের ডিম মুখে পুরতে যাচ্ছিল। বউবাজার থেকে ডেকার্স অবধি হেঁটে আসতে আসতে ওর ক্ষিদেটা চা-পাউরুটি থেকে চাউমিন-বিরিয়ানি অবধি পৌঁছে যায়। এতক্ষণ বকবক করে ক্লান্ত কানাই ফিশ কারিরাজিতে মন দিলেন, কিন্তু কান খাড়া রইল, সৌভিক বলল – কেসটার তো আর কোনো সাক্ষী নেই! সব মরে ভূত। আর ধরে নিচ্ছি, জর্জের বাকি যাত্রীদেরও আর কেউ কোনোদিনও দেখেনি। তাহলে আমাদের কেসটা সাজাতে হবে সিনারিওর ওপর নির্ভর করে। অর্থাৎ কি-না, কী ঘটতে পারত আর কী কী ঘটেনি এই হিসাবটা করতে পারলেই যা ঘটতে পারত সেটুকু পড়ে থাকবে। কি গুরু, ঠিক বলছি তো?
কানাই চায়ে চুমুক দিয়ে চোখ বুজে বললেন, কী কী ঘটে থাকতে পারে?
– প্রথম সম্ভাবনা, সেপ্টেম্বরে জাহাজ ছেড়েছে। মানে সদ্য বর্ষার মরসুম শেষ হয়েছে। সমুদ্র শান্তই থাকার কথা। তবু সমুদ্র তো আর হারুবাবুর বাগান নয়, বিশাল জায়গা, ক্ষণিকের ঘূর্ণি তৈরি হতে পারে বা সুনামি, হয়তোবা সাইক্লোন। বিশাল সমুদ্রের কতটুকু জায়গার খবর আর আবহাওয়া দপ্তরের কাছে আসত।
– হুঁ, হতেই পারে। আজকাল নানা রকম টেস্ট করে হাজার-দেড় হাজার বছর আগের আবহাওয়া মিলিয়ে দিচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। সমুদ্রের দিকটা আরেকবার চেক করতেই হবে।
সৌভিক বলল, দ্বিতীয় সম্ভাবনা। জর্জ হয়তো খিদিরপুর থেকে ছাড়েইনি। আর ছাড়লেও কতজন লোককে নিয়ে ছাড়ল? আর কারা কারা যাত্রী ছিল? এই দিকটা দেখা দরকার।
– এটা বেশ কঠিন সম্ভাবনা। আমি রিপোর্টে দেখছি – জাহাজে কাপ্তান-খালাসিদের বাদ দিয়ে দশজন প্যাসেঞ্জার ছিল। সংখ্যাটা খুব কম বলেই আমার মনে হচ্ছে। একটা খটকা লাগছেই। কিন্তু জাহাজ খিদিরপুর থেকে ছাড়বেই না, এটা অতিকল্পনা, জাহাজঘাটায় পুলিশ থাকবে। আবগারির লোক থাকবে। রিপোর্টাররাও থাকতে পারে। আত্মীয়স্বজন। এদের সকলের নজর এড়িয়ে জর্জের লুকানো সম্ভব কি-না ভেবে দেখা দরকার। আর কোনো সম্ভাবনা?
– লাস্টলি, জাহাজের সব লোকজনকে হত্যা করে, নৃপেণকে ছাড়াতে জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে মালয় বা পদুচেরিতে নিয়ে যাওয়া হলো। সেটা কি অসম্ভব?
– বেশ অসম্ভব। জাহাজ তো আর উড়োজাহাজ নয়। স্টিমে চলে জাহাজ। খালাসি লাগে, মালস্না লাগে। সেই লোকগুলো কোথা থেকে এলো, সেটা তবে ভাবা দরকার।
সৌভিক মৃদু আপত্তি করে উঠল – ধরুন, নৃপেণ আর তার বিপস্নবী দলবল জাহাজের মালস্না-যাত্রীদের হত্যা করল। ইতোমধ্যে বিদেশি কোনো জাহাজ এসে উপস্থিত হলো। তাদের সঙ্গে এলো অতিরিক্ত মালস্না-সারেং, যারা জর্জকে ঠেলে সুন্দরবনের জঙ্গলে ঢুকিয়ে দিলো।
কানাইচরণ গস্নাসের জলে হাত ধুতে ধুতে বললেন, এবার গরু গাছে উঠছে, ওকে নামা। ব্রিটিশ জলসীমা ছোকরা। ব্রিটিশ পারমিশন ছাড়া বে অব বেঙ্গলে মাছিও নড়ত না। অতগুলো লোকভর্তি জাহাজ যাওয়া-আসা করলে পোর্টের রিপোর্টে ঠিক পাওয়াই যাবে।
– তাহলে অফিস ফিরে প্রথম ফোন কি পোর্টে করছ?
কানাইচরণ আকণ্ঠ হেসে বললেন, প্রথম ফোনটা আলিপুর, খিদিরপুরে নয়। আর করছিস তুই। আমি যে ক্লোজড, ভুলে গেলি!
ডেকার্স থেকে হেঁটে লালবাজারে একবার ফিরলেই কানাইচরণের দুপুরের খাওয়া হজম হয়ে যায়। একটা সিগারেট শেষ করে কানাই ফের কেসের পাতাগুলো উলটাচ্ছিলেন, চোখ বুজে ভাবছিলেন। নৃপেণ বিপত্নীক, ছেলেপুলে হয়নি, বিয়ের অল্প কবছরের মধ্যে দমদম ফিবারে টেসে যায়, সংসারে কাছের লোক বলতে প্রৌঢ়া মা। নৃপেণের কালাপানি হওয়ার পর মায়ের কী হলো সেটা কোথাও লেখা নেই। কেস ডায়েরিতে বাজেয়াপ্ত হওয়া মালের লিস্ট আছে, গ্রেফতারি পরোয়ানা আর নৃপেণকে জেরার বিবরণ আছে। যেহেতু কেউ খুন-জখম হয়নি তাই বর্ণনাগুলি ম্যাড়ম্যাড়ে। নৃপেণ জেলায় জানিয়েছে যে, সে কোনোদিনই মানিকতলায় যায়নি, ঢাকায় পা অবধি রাখেনি। গোয়েন্দারাও তেমন কোনো সূত্র পায়নি। গোটা কেসটাই তাই দাঁড়িয়ে আছে চিঠিগুলির ওপর আর ঠিকে ঝি ও তুতোভাইয়ের সাক্ষীতে। কোর্ট প্রসিডিংয়ে পুলিশ অনেকগুলি মিথ্যা সাক্ষী সাজিয়ে এনেছিল। ঝানু জাস্টিসের তাদের পালটে দিতে খুব মুশকিল হয়নি, খুব একটা গুরুত্বও দেওয়া হয়নি রায়ে। ঠিকে-ঝি, নাম গঙ্গা – এজলাসে দাঁড়িয়ে বলেছে যে, সে বাবুর চিঠি একাধিকবার নির্দিষ্ট স্থানে রেখে এসেছে। সেখান থেকে কে সেই চিঠি পেয়েছে সে কিছুই জানে না। নৃপেণ কখনো চিঠির কথা অস্বীকার করেনি; কিন্তু এজলাসে দাঁড়িয়ে সরকারি উকিলের প্রশ্নের উত্তরে এটাই বলেছে যে, তার পথভ্রষ্ট বন্ধুদের ধর্মের দোহাই, মানবতার দোহাই, ব্রিটিশরাজের দোহাই আর পেনাল কোডের দোহাই দিয়ে সশস্ত্র বিপস্নব প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকতে বলত। কানাইচরণ ফাইলের ভেতর থেকে তামাদি হয়ে যাওয়া কয়েকটি চিঠি পড়ার চেষ্টা করলেন। চিঠিগুলি বিলক্ষণ সাংকেতিক ভাষায় লেখা, সঙ্গে সংকেত-বিশেষজ্ঞের নোট জুড়ে দেওয়া হয়েছে। অতি ধূর্ত ছেলে। সে এমনভাবে চিঠিগুলি লিখেছে, যার মানে হ্যাঁ-ও হতে পারে আবার না-ও হতে পারে। এক জায়গায় লিখছে – গডফ্রে দিনহ্যাম থেকে সাবধান। পেনাল কোডের দোহাই, সে তোমাকে ছাড়বে না, ভাই অমর। তুমি প্রাতে চিতপুর লেন ধরলে সে তোমাকে সেখানেই হাতকড়া পরাবে। কানাই ভেবে দেখলেন – একদিকে অমর চ্যাটুজ্জেকে দিনহ্যামের ভয় দেখানোও হলো আবার দিনহ্যামের যাতায়াতের রাস্তাও সুচতুর নৃপেণ কৌশলে জানিয়ে দিয়েছিল।
কানাইচরণের দুপুরের তন্দ্রায় বিঘ্ন ঘটিয়ে সৌভিক বলল, দাদা, আলিপুর মেটিরিওলজির সঙ্গে ফোনে কথা হলো। সেপ্টেম্বর জেনেরালি সাইক্লোন সিজন। মেটিরিওলজির সুচয়নবাবু জানালেন, বর্ষার পরপরই নাকি সাইক্লোন আসে। ১৯১৩-এর সেপ্টেম্বরে কয়েকটা ছোটখাটো নিমণচাপ তৈরি হয়েছিল বে অব বেঙ্গলে, কিন্তু বড় ঝড় আসেনি।
– তখনো তাহলে আলিপুর থেকে আবহাওয়ার প্রেডিকশন হতো? কানাই ব্যঙ্গ করে বললেন।
– সুচয়নবাবু বলল, ১৮৫০ থেকে নাকি গোটা ইন্ডিয়ার ওয়েদার রিপোর্ট আছে; কিন্তু সমুদ্রের পর্যবেক্ষণগুলো অনেক পরের দিকে। ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড ওয়ারের আঁচ পেয়ে ব্রিটিশরা সমুদ্রের পর্যবেক্ষণ শুরু করে! মাইরি, মাঝে মাঝে ভাবি, ব্রিটিশরা না এলে আমাদের কী হতো! ঘূর্ণিঝড় আসত, জানতেও পারতাম না।
– তোর সুচয়নকে শালা দেখবি, কোনোদিন ভুলভাল ফোরকাস্টের জন্য লালবাজার ধরবে। এইবার মনসুন আসার ১২ দিন পরে মনসুন রিপোর্ট দিয়েছে। ডিসি বলছে, বন্যাত্রাণের কম্বল কি মেটিরিওলজি সাপস্নাই দেবে। হাসতে হাসতে কানাই আরেকটা সিগারেট ধরালেন।
সৌভিক ক্রাইম কনফারেন্স মিট করতে গ্যালো, যাওয়ার আগে বলে গেল, পোর্টকে প্রশ্নগুলো পাঠিয়েছি। দেখি কখন উত্তর দেয়!
কানাই সিগারেটে টান দিয়ে ফের কোর্ট প্রসিডিংস ভাবা শুরু করলেন। নৃপেণ হয়তো এ-যাত্রায় পার পেয়ে যেত; কিন্তু তুতোভাইয়ের সাক্ষীটা ভাইটাল হয়ে গেল। ঘরের শত্রু বিভীষণ। এরকম যদিও ব্রিটিশদের জন্য খুবই পরিচিত ছল। অনুশীলন সমিতিকে ভাঙার জন্য এই ছকটি ব্রিটিশ পুলিশ ব্যবহার করত। একজন অফিসার এসে ভয় দেখাত, আরেকজন মাথায় হাত বুলাত। বাচ্চা ছেলে সব, বারীন ঘোষদের কথায় উজ্জীবিত হয়ে দেশকে স্বাধীন করবে বলে এসে পুলিশ-কেস খেয়ে বসে আছে। অত্যাচার হচ্ছে। ঘরের ভাত জুটছে না। খারাপ পুলিশ আর ভালো পুলিশের বৈপরীত্যে অসহ অবস্থা। এমন অবস্থায় ভালো পুলিশের কথা শুনে রাজসাক্ষী বনে যাওয়াটাই সহজ উপায়। কালাপানি পার হতে হবে না। ঘরের ছেলে ফের ঘরে ফিরে যাবে। স্রেফ যাওয়ার আগে সমিতির মাথা কারুর কীর্তিকলাপ বলে দিলেই হলো। এই কৌশলে আইরিশ বিপস্নব-প্রচেষ্টা ভেঙেছে ব্রিটিশরা, বাংলাতেও ভাইকে ভাইয়ের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে। আর ঘরের লোকের বিরুদ্ধে – সাক্ষী সবসময়ই আইনের চোখে গুরুত্বের। অনুশীলন সমিতির এ এক করুণ ইতিহাস। তুতোভাইটিও, তার নাম মোহন বসু, এই পথেই পা দিয়েছে। গীতায় হাত রেখে যখন বলেছে যে, তার দাদা যখন চরবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত তখনো নৃপেণ অস্বীকার করে গেছে। কানাইয়ের করুণা হলো নৃপেণের কথা ভেবে। ছেলেটি সত্যি নির্দোষ, নয়তো সে হয়তো সত্যিই বিপস্নবীদের সমাজের সশস্ত্র পথ থেকে নিরস্ত্র করতে চেয়েছে। ভুলে গেলে চলবে না, সে-সময়ে ব্রিটিশ সরকারের বিরোধিতা করা তো দেশদ্রোহই। তাই সশস্ত্র বিপস্নবের বিরোধিতাকেও কি খুব দোষ দেওয়া চলে? কানাইচরণ এই তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে আর প্রবেশ করতে চাইলেন না। তার কৌতূহল হলো মোহন বসুর জীবনে কত টাকা আর সামাজিক সুরক্ষা সে পেল ইংরাজের কাছে? যত বেশি টাকা হবে, ততই নৃপেণের সম্ভাব্য চরবৃত্তিতে যোগ থাকার সম্ভাবনা কম!
কানাই বেল টিপে বেয়ারাকে ডাকলেন। বেয়ারাটি নেহাত বাচ্চা ছেলে, বাপ মরায় চাকরি পেয়েছে। কানাই একটা সিস্নপ দিলেন, তাতে লেখা – মোহন বসু, ১৯১৩। বেয়ারাকে বললেন, এই সিস্নপটা নিয়ে অ্যাকাউন্টসে যা আর যতক্ষণ লাগুক, দাঁড়িয়ে কপি নিয়ে আয়। ছোকরা সেলাম ঠুকে চলে গেল। যদিও সেলাম ঠোকার কথা তার নয়। উর্দি নেই বেয়ারার।
কানাই ইন্টারকমটা টেনে পুলিশ মিউজিয়ামের কিউরেটরের নম্বরে একটা কল করলেন। পরিচয় দিয়ে বললেন,
– গডফ্রে দিনহ্যাম, এই ধরুন সেকেন্ড ডেকেড অব টোয়েন্টিথ সেঞ্চুরি। নামটা কি চেনা-চেনা লাগছে?
কিউরেটর পুলিশের লোক নন, ভাগ্যিস। তিনি ইতিহাসবিদ, কানাই তাকে মিউজিয়াম উদ্বোধনের দিন দেখেছিলেন কমিশনারের পাশে। মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক, লালবাজারে মিউজিয়াম সামলাতে না এসে বোধহয় কলেজে পড়ালেই ভালো করতেন। কিউরেটর নিঃস্পৃহ গলায় বললেন – অবশ্যই, গডফ্রে দিনহ্যামকে ইতিহাস চেনে একজন অত্যাচারী পুলিশ অফিসার হিসেবে। অনুশীলন সমিতিকে প্রায় একার হাতে শেষ করেছে। যদিও পুরোটা পারেননি। ঢাকার অনুশীলন সমিতি বেঁচে গিয়েছিল। আর মানিকতলার সমিতি ছেড়েও অনেকে বাঘা যতীনদের যুগান্তর সমিতিতে চলে যায়; কিন্তু দিনহ্যাম সম্পর্কে যেটা বলার তা হলো – দিনহ্যামকে মারার প্রচেষ্টা করেছিল ঢাকা অনুশীলন সমিতির কিছু সদস্য। যদিও, আনফরচুনেটলি, দিনহ্যাম বেঁচে যান। বিপস্নবীরা ভুল লোককে মেরেছিল, যেমনটা সে-সময় অনেকবার হয়েছে।
কানাইচরণ ফোন ছাড়া মাত্র দেখেন, বেয়ারা পর্দা ঠেলে ঘরে ঢুকছে। ছোকরার কোনো কা-জ্ঞান নেই। কানাই রাগত স্বরে বললেন – তোকে বললাম না, কপি নিয়ে তবেই আসবি।
বেয়ারাটি নীরবে একটি কম্পিউটার প্রিন্ট-আউট কানাইয়ের সামনে মেলে ধরল। কানাই যথেষ্ট অভিভূত হলেন। লালবাজারের ডিজিটালাইজেশনের ওপর এই প্রথমবার তার একটা আস্থা এলো। ছোকরার ওপরও প্রীত হলেন। ভবিষ্যতে রেকমেন্ড করে দেবেন ভাবলেন। রিডিং গস্নাসটা চোখে এঁটে ১৯১৩-১৯৩০ সালের নোটসে চোখ রাখলেন। তাতে দেখা যাচ্ছে যে, কেস চলাকালীন মোহন বসুকে কিছু জলখাবার আর যাতায়াত বাবদ রাহাখরচ দেওয়া হয়েছিল। কেস মিটে যাওয়ার পর ব্রিটিশরাজ মোহন বসুর ওপর দয়াপরবশ হয়ে দুই টাকা মাসোহারা ধার্য করে। কিন্তু প্রথম মাসে সেই মাসোহারা নিতে এসেছে মোহন বসুর নাবালক পুত্র পুলক বসু, অভিভাবক সহযোগে। নথিকর্তা নাবালক পুত্রের টিপসই নিয়ে মাসোহারা দিয়েছেন এবং ফুটনোটে লিখে রেখেছেন যে, পুত্রটি জানিয়েছে, তার বাপ সেনাদলে নাম লিখিয়ে বিদেয় হয়েছে। নথিকর্তা আরো জানাচ্ছেন যে, এই বিষয়ে তিনি ওপরওয়ালাদের সঙ্গে আলোচনা করে পুত্রটিকে মাসোহারা দেওয়া নিশ্চিত করলেন, যতদিন না মোহন বসু দেশের কাজ করে ফিরে আসে। অতঃপর এই বন্দোবস্ত বজায় থাকে ১৯৩০ অবধি। সে-সময় নতুন নথিকর্তা জানিয়েছেন, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দুই বছর কাউকে মাসোহারা নিতে আসতে দেখেননি, মোহন বসু ক্রিমিয়ার যুদ্ধের বহু আগেই প্রাণ হারিয়ে থাকবেন। খুব সম্ভবত পূর্বের বড়বাবু ও তার সহকর্মীরা বছরের পর বছর মাসোহারাটি আত্মসাৎ করিয়া থাকিবে। বর্তমান সরকারের অর্থভাণ্ডারের কথা ভাবিয়া এই মাসোহারা চালু রাখার কোনো অর্থ নেই, অতএব ১৯৩০-এ মাসোহারা বন্ধ হলো। কানাই বেজায় মজা পেলেন। কেবল বিপস্নবীরাই নয়, বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা তাহলে হিসাবরক্ষকরাও বুনেছিল। সৌভিক ক্রাইম কনফারেন্স থেকে ফেরার পর কানাই এই কথাগুলিই বললেন।
সৌভিক টেবিলে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে শুনল। কানাই প্রতিটি লোকের ব্যাকগ্রাউন্ড চেক শুরু করেছে। এই পরিস্থিতিতে এটাই করণীয়। সে জিজ্ঞাসা করল – আর যে-সাহেব আর দুই হাবিলদার, রাম আর নবীন, জর্জ জাহাজে নৃপেণকে নিয়ে গেল তাদের ব্যাকগ্রাউন্ডটা চেক করবেন না?
কানাই তখনো মজার রেশ ধরে রেখেছিলেন – তারা তো পুলিশ, লালবাজার আমার বাপ-মা, আমি তাই পুলিশকে কখনো সন্দেহ করি না রে বাপ। তুই পোর্ট থেকে খবর পেলি?
সৌভিক শ্রাগ করে বলল – পোর্টের লোকজনের কাছ থেকে খবর বের করা যে কী ঝক্কির কানাইদা। আপনি এই সাইডটা সামলালে বুঝতেন। ব্যাটারা সবেতেই কাটমানি খেতে চায়। ইউনিফর্মের কোনো রেসপেক্টই নেই। এদের পেট থেকে খবর বের করতে গিয়ে আমার আজকের গোটা দিনটা নষ্ট হলো। যাই হোক। সোর্স ধরে খবর মিলেছে। ১৯১৩-এর ২২ সেপ্টেম্বর খিদিরপুর থেকে জর্জ দ্য সেভিয়ার অবশ্যই ছেড়েছিল। যাত্রী ছিল সাকল্যে নয়জন। খেয়াল করুন, পুলিশ-রিপোর্ট কিন্তু বলেছে, দশজন যাত্রী সওয়ার হয়েছিল – পয়েন্ট ওয়ান। জাহাজের কাপ্তানের নাম ওস্তাদ মাসুদ। বাকি যাত্রীদের নামধাম অবধি পোর্টের কাছে নেই। জাহাজের লাস্ট রিপোর্টিং ফ্রম সাগর। খিদিরপুর ছাড়ার দেড়দিন পর। তারপর লাপাত্তা। পয়েন্ট টু – পোর্টের নথিতে সমুদ্রে জর্জকে কলকাতামুখী জাহাজটা দেখেছিল এরকম কোনো খবর নেই।
– জর্জকে সমুদ্রে দেখার রিপোর্টটা থাকবে না, সেটাই আশা করেছিলাম। ১৯১৩-এর কলকাতা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চে তো আমাদের বংশধররাই ছিলেন, তারা প্যাঁদানিবিদ্যাটাই ভালো জানত। ওরাই ওটাকে ক্লাসিফায়েড করেছে, তারপর মুছে দিয়েছে। কারণ সমুদ্রে জর্জকে দেখতে পাওয়ার নথিটা থাকলে কলকাতা পুলিশের থিয়োরিটা – যে-জর্জ মোহনায় ডুবেছে, সেটা দাঁড়াত না।
সৌভিক ঘাড় নাড়ল – অ্যাগ্রিড। ওন পয়েন্ট ওয়ান। পোর্ট থেকে যাত্রীদের নামধাম না পাওয়া গ্যালেও নামের একটা তালিকা ক্রসচেক করে পেয়েছি। সেকালে জাহাজযাত্রার খবর নিউজপেপারে বিজ্ঞাপন দিয়ে ঘোষণা করা হতো। যাত্রীদের নামধামও অনেক সময় ছাপানোর চল ছিল। তাই অমৃতবাজার-যুগান্তরের ডাটাবেসটা একবার দেখতে ডিডির লাইব্রেরিকে বললাম। তারাও জানাচ্ছে নয়জন যাত্রী। যুগান্তর নাম আর পরিচয়ও ছেপেছে। উইলসনের নামটা আছে। দুজন হাবিলদারের নাম আছে, হাবিলদারদের পরিচয়ে যদিও স্বদেশি বেওসায়ী (ব্যবসায়ী) লেখা রয়েছে; কিন্তু নৃপেণের নাম অবধি নেই। কানাই মন দিয়ে শুনছিলেন। সৌভিকের ক্রসচেক করার পদ্ধতিতে তিনি বেশ খুশি। কিন্তু জাহাজের যাত্রীসংখ্যা তার কাছে কোনো ক্লু নয়। সৌভিককে কানাই বললেন, দশ না নয় সেটা ব্যাপার না। নৃপেণের নাম ইচ্ছা করেই বাদ দেওয়া হয়েছে কলকাতা পুলিশের নির্দেশেই। পুলিশ কখনো চাইবে না, নৃপেনের সম্ভাব্য সহযোগীরা এই জাহাজযাত্রার দিনক্ষণ ও অন্যান্য খবর জানুক। তাতে জাহাজের বিপদের আশঙ্কাই বাড়বে। বিপস্নবীরা মাঝগঙ্গায় বন্দিকে লুট করতে পারে। আর জাহাজে বন্দি যাচ্ছে বলে ঢাক পিটিয়ে বাকি যাত্রী আর তাদের ফ্যামিলিকেও ভয় দেখাতে পারে। তো ঠিকই আছে। উইলসন, রাম আর নবীন যখন জর্জে আছে, তখন আপাতত ধরে নেওয়া যাক ও আছে। আর কারা কারা যাত্রী?
সৌভিক পকেট থেকে মোবাইল বের করে বলল – মোবাইলে নোট করে নিয়েছি। হ্যাঁ, পেয়েছি, পুলিশদের বাদ দিয়ে, দুই ব্রিটিশ, দুজন বাঙালি আর দুজন তামিল। তামিলগুলি আন্দামান থেকে মাদ্রাজের (চেন্নাই) জাহাজ ধরবে। দুজন ব্রিটিশের পরিচয়ে লেখা এডুকেশনিস্ট, হাইলি ব্রিটিশ স্পাই, যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগের বছর! তামিলগুলি বেওসায়ী, বাংলায় ব্যাংক খুলেছে। দুজন বাঙালির একজন সার্ভেয়ার আর অপরজনের নাম রাখহরি ঘোষাল। কিন্তু পয়েন্ট থ্রি – রাখহরির নামের পাশে ব্র্যাকেটে লেখা অলকটপন্থী। আর কোনো পরিচয় দেওয়া নেই। এই অলকট না ভজকট কেসটা কী?
– থিয়োসফিস্ট। ভূতচর্চা বললে বোধহয় ভালো হয়। কিন্তু শুধুই ভূতচর্চা নয়। পরলোক, প্যারাসাইকো যতরকম উদ্ভট বিষয় এদের চর্চার বিষয় ছিল। নাইনটিন্থ সেঞ্চুরির শেষদিক থেকেই এদের বেশ রমরমা ছিল। কলকাতায় বোধহয় এখনো থিয়োসফিস্ট সোসাইটি আছে, কলেজ স্ট্রিটের দিকে! সে-সময় যদিও থিয়োসফিস্টরা শুধুমাত্র উদ্ভট শাস্ত্রেই নিজেদের আটকে রাখেনি। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনও এক থিয়োসফিস্টের হাত দিয়ে শুরু – তিনি আলান অক্টাভিয়ান হিউম, ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা। হিউম ছিলেন একজন অবসরপ্রাপ্ত সিভিল সার্ভেন্ট, ডাকসাইটে অরনিথোলজিস্ট, ইনফ্যাক্ট তার হাত দিয়েই ভারতে পক্ষীচর্চার শুরু। হিউম দাবি করেন, তার রহস্যময় ও তিববতবাসী গুরু মহাত্মার কথা শুনেই তিনি কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন ডাকার পরিকল্পনা নেন। এই গল্পটা বরং আরেকদিন। আপাতত শোনো, এই থিয়োসফির আরেক পুরোধা হলেন কর্নেল অলকট। তিনি যদিও জাতীয় রাজনীতিতে মাথা ঘামাননি। জর্জ দ্য স্যাভিওরের যাত্রী রাখহরি ঘোষাল কর্নেল অলকটের অনুগামী, যদিও বিষয়টি নিঃসন্দেহে সন্দেহজনক। আমি স্পেশাল ব্রাঞ্চে সে-সময় থাকলে রাখহরি ঘোষালের ফ্যামিলিকেই ট্রেস করার চেষ্টা করতাম। সৌভিক মোবাইল ফোনটা কানাইয়ের দিকে এগিয়ে দিলো। অ্যালান হিউমের উইকিপিডিয়া পেজ। দাড়িওয়ালা, সম্ভ্রান্ত ও বয়স্ক ব্রিটিশ। সৌভিক বলল, এই যদি থিয়োসফিস্টদের চেহারা হয় তাহলে আমি নিশ্চিত, রাখহরি ঘোষালই কালপ্রিট। কোনো স্বদেশি ছোকরা নিশ্চয়ই দাঁড়ি বাগিয়ে জর্জে থিয়োসফিস্ট সেজে উঠেছিল। আর কংগ্রেসের সঙ্গে থিয়োসফিস্টদের তলে তলে যোগ থাকলে পরিচয়পত্র, প্রাসঙ্গিক কাগজপত্র আর থিয়োসফির বইপত্তর জোগাড় করাটা কোনো ব্যাপারই নয়।
– রোসো ভাই রোসো। আমরা এখানে কালপ্রিটকে খুঁজছি না। কারণ, হতেই পারে কালপ্রিট কোনো অচেনা-অজানা দেশবোধে উদ্বুদ্ধ ছোকরা বা জলদস্যু। আমরা জাহাজ হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাব্য কারণ খুঁজছি, সেটাই আমাদের কেস। অপরাধী না ধরা পড়লেও বড়সাহেব এই কেসে বকবে না, জাহাজ খুঁজে দিলেই মিডিয়া খুশি হয়ে যাবে। যদিও রাখহরি ঘোষালকে মাথায় রাখলাম।
লাঞ্চের পর থেকে জানালাহীন চেম্বারে বসে কানাই হাঁপিয়ে উঠছিলেন। সৌভিককে নিয়ে তিনি লালবাজারের বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। সৌভিক পকেট থেকে মালবরোর প্যাকেট বের করল, যা দেখে বেশ চমকালেন কানাই। সৌভিক আন্দাজ করে বলল, একটা কেস সেটল করে দিলাম আজকে। কানাই চুপচাপ একটা মালবরো ধরালেন।
– আজ বাড়ি যাওয়ার আগে কি কেসটা সলভড হবে?
কানাই বললেন – আশা কম। কয়েকটা সম্ভাবনা মাথায় ঘুরছে কিন্তু সিকোয়েন্সটা না বানানো গ্যালে কেসটা দাঁড়াবে না। আর কয়েকটা প্রশ্নও এখনো উত্তরহীন, যেমন – যদি ধরেওনি নৃপেণকে বিপস্নবীরা ছিনিয়ে নিয়ে গেছে, কীভাবে ছিনিয়ে নিল সেটা পরে ভাবব, তাহলে প্রশ্ন হলো, হোয়াই! এত এত বিপস্নবী সব কালাপানি পার হলো। তাদের তো ছিনিয়ে নেওয়া হলো না।
– অরবিন্দ ইংরাজের হাত গলে চন্দননগরে চলে গিয়েছিলেন, পরে পদুচেরি। সেটা কি শুধুই সি আর দাশের সওয়াল-জবাবে, লালবাজারের দেয়াল কানাকানি করে, সেখানে ফরাসিদের যথেষ্ট হাত ছিল। জাস্টিসদের ইনফ্লুয়েন্স করা হয়েছিল। অরবিন্দর ক্ষমতা ফরাসিরা আন্দাজ করতে পেরেছিল বোধহয়।
কানাই ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, তাহলে তেমন বিশেষ ক্ষমতাবান বিপস্নবী হলে বিদেশি শক্তি তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসতেও পারে। গুড ডিডাকশন। নৃপেণ তো যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণই। সে লালবাজারের ফিঙ্গারপ্রিন্ট ডিপার্টমেন্টে কাজ করেছে। আজিজুল হক আর রায় বাহাদুর হেম বসুর কাছে কাজ শিখেছে। ফিঙ্গারপ্রিন্টের বিশেষজ্ঞই বলা চলে। ডাচ, ফরাসি, পোর্তোরা তো যুদ্ধের আগের বছর এমন লোককে ফোর্সে চাইবেই। ওই সময়, কোনো ফরাসি জাহাজ কি পদুচেরি থেকে ছেড়েছিল? বা কোনো জাহাজ পদুচেরিতে এসেছিল? জর্জ তো ছাড়ছে ২২ সেপ্টেম্বর, তার সঙ্গে আরো পাঁচ-সাতদিনের টাইম উইন্ডোতে ইনফরমেশনটা চাই। ক্যালকাটা পোর্টের আর্কাইভে শিওর থাকবে, পদুচেরি পোর্টকে ক্লোজলি ওয়াচ করা হতো। পোর্টে না পেলে, ওয়াচ ডিপার্টমেন্টের পুরনো মালখানাটা একবার দেখিস। নাকের ডগায় ফরাসিদের ব্রিটিশরা কোনোদিনই ভালোচোখে নেয়নি।
সৌভিক মনে-মনে বিরক্ত হলেও ওপরে বুঝতে দিলো না। পোর্টের সঙ্গে কথা বলার ঝক্কিটা ইতোমধ্যে একবার তাকে পোহাতে হয়েছে। আধখাওয়া সিগারেট ডাস্টবিনে ফেলে, অলিন্দের থামের আড়ালে গিয়ে সৌভিক ফোন করতে ব্যস্ত হলো। কানাইচরণও একটু দূরে সরে এসে নিজের অবশিষ্ট সিগারেটে মন দিলেন, আর ঝুঁকে পড়ে লালবাজারের চাতালে লোকজনের যাতায়াত দেখছিলেন। যত জুনিয়রই হোক, ফোর্সে এক অফিসারের সোর্সে অন্য অফিসারের উৎসাহ না দেখানোই অঘোষিত নিয়ম। কানাইয়ের কানে সৌভিকের কাকুতি-মিনতি কানে আসছিল। গোয়েন্দা বিভাগের স্পেশাল সেলের জাঁদরেল অফিসারের মামুলি ইনফরমেশন জোগাড় করতে কী নাজেহাল দশা ভেবে কানাই মজা পেলেন। সিগারেটের ফিলটার এসে গিয়েছিল, কানাই ডাস্টবিনে সিগারেট ফেলতে গিয়ে দেখলেন সৌভিক কথা শেষ করে আরেকটা সিগারেট ধরাচ্ছে।
সৌভিক বলল, জোগাড় হলো, আমার বাপের ভাগ্য, কোনোদিন ডিসি-পোর্টে গ্যালে শালাদের সেফ হাউজে নিয়ে গিয়ে মজা বুঝিয়ে ছাড়ব। যাকগে, ক্যালকাটা পোর্টের আর্কাইভস বলছে – একটি ছোট জাহাজ, নাওই বলা ভালো; পদুচেরি থেকে চাঁটগা যাওয়ার জন্য ছেড়েছিল। নৌকা রং করার আলকাতরা নিয়ে চাঁটগা যাচ্ছিল। কিন্তু যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে একদিন পরে পদুচেরিতেই ফিরে আসে। আর পদুচেরি বন্দরে একটি যাত্রীজাহাজ এসেছিল করাচি থেকে। তাতে ৫০ জন যাত্রী ছিল, বেশিরভাগই ফরাসি, এডেন ঘুরে, করাচি হয়ে পদুচেরিতে এসেছে। প্রচুর ওয়াইনও ছিল – সেটা বোধহয় না বললেই হতো। যুদ্ধের জন্যই সেবার সমুদ্রে জাহাজের আনাগোনা বেশ কম ছিল। অবশ্য ঝড়ের আশঙ্কাও হতে পারে। মোট কথা, নথিতে জর্জের ভেড়ার কোনো কথা নেই!
– পদুচেরিতে জর্জ ভিড়লে ব্রিটিশ গুপ্তচরদের কাছে ঠিকই খবর যেত। বলে কানাইচরণ নিজের মনে ডুব দিলেন। সৌভিক আর কথা বাড়াল না। দুজনের চেম্বারে ফিরে এলো। সৌভিক হাতের জ্বলন্ত সিগারেট ফেলেনি। কানাই যেন কালাপানির মধ্যে পড়ে গেছেন। অন্ধকারই বেশি কিন্তু খানিক আলো, সেলুলার জেলের ঘুলঘুলি দিয়ে প্রবেশ করছে। আর কানাই ভাবছে, সেই একফালি ঘুলঘুলি দিয়ে কি সূর্যকে দেখা সম্ভব। কিন্তু সেলে কি শুধুই ঘুলঘুলি থাকে, পাথরের দেয়ালে কি চিড় থাকে না! সেখান দিয়েই কি আলো প্রবেশ করে না! কানাই একটি তেমন চিড় দেখতে পেলেন।
– আচ্ছা ওই জর্জ জাহাজের যে কাপ্তান, কী নাম তার? ওস্তাদ মাসুদ? সে কি চিটাগাঁর লোক? সে-সময় তো বেশিরভাগ মালস্নাই চিটাগাঁর লোক ছিল।
– খোদ খিদিরপুরের। অনেক বছরের নাবিক, বংশানুক্রমে। পোর্টের নথিতেই লেখা ছিল। সেটা জেনে আমি লোকাল থানা থেকে ছেলে পাঠিয়েছিলাম। ওস্তাদের বংশধররা আছে এখনো খিদিরপুরে। ওস্তাদ তাদের বাজানের দাদা। সমুদ্রে মারা যায়। সম্ভবত জর্জেই মারা যায়, বংশধররা এর বেশি কিছু জানে না।
কানাই ফের চিমত্মার কালাপানিতে ডুবে গেলেন। সৌভিক এদিক সেদিক ফোন করে অধস্তনদের নির্দেশ দিচ্ছিল আর তার নিজের কাজ অন্যদের কাঁধে ঠেলার চেষ্টা করছিল। কানাইদার পালস্নায় পড়ে তার নিজের সব কাজ আজকের মতো লাটে ওঠার জোগাড়। ক্রাইম কনফারেন্সে কমিশনারের নাতিদীর্ঘ স্পিচের মাঝে সৌভিক টেস্ট আদান-প্রদান করেছে। ডিসি-ক্রাইম দেখতে পেয়ে ইশারায় ধমক দিয়েছে। কসবা থানা একটা খুনের কেস রেফার করেছে। সৌভিক ফরেনসিক পাঠানোর নির্দেশ দিলো। কানাই ক্লোজ থাকায় তার কাঁধে এমনিতেই অনেকগুলো দায়িত্ব। সৌভিক জানে, যদি প্যাঁদিয়ে কথা বের করার কিছু কেস আসে, তবেই এখন গোয়েন্দা বিভাগ সলভ করতে পারবে। সিরিয়াস কেস এলে এ-মুহূর্তে ডিডি অচল, কানাইকে ফের অফিসিয়াল তলব দিতে হবে। কানাই সেই আশাতেই সকাল থেকে দপ্তরে এসে বসে থাকে, এই বুঝি জয়েন্ট সিপির ঘর থেকে ডাক এলো। সপ্তাহ দুয়েক ঘুরতে চলল। কলকাতায় কি পেটি ক্রাইম ছাড়া আর কিছুই নেই রে বাপ! সৌভিক ফরেনসিকে ফোন করতে যাচ্ছিল, দেখল – চেম্বারের পর্দা ঠেলে এক পৃথুলা, বয়স্ক নারী প্রবেশ করলেন। সৌভিক এনাকে আগেও দেখেছে, লালবাজারেই, কিন্তু ঠিকঠাক মনে করতে পারল না।
ভদ্রমহিলা পর্দা সরিয়ে বললেন – আসতে পারি?
ভদ্রমহিলার গলা শুনেই কানাই কালাপানির অতল থেকে যেন জেগে উঠলেন, ব্যস্তসমস্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আরে কী ভাগ্যি, আসুন আসুন, পিস্নজ বসুন।
ভদ্রমহিলা প্রত্যাশিত আপ্যায়ন পেয়ে একগাল হেসে বললেন, লাঞ্চ পেরিয়ে গেল, তবু কেস সলভ হলো না দেখে নিজেই খোঁজ নিতে চলে এলাম।
সৌভিক চিনতে পারল, ক্রিমিনাল রেকর্ডসের রেজিস্ট্রার দিদিমণি, যিনি কানাইদাকে পুরোনো কেসের ফাইলপত্তর দিয়ে থাকেন।
কানাইচরণ বললেন, এই কেসটা একটু বেশিই জটিল।
দিদিমণি জিজ্ঞেস করলেন, নৃপেণ চট্টরাজের কোনো হদিস পেলেন?
কানাইচরণ আঙুল তুলে সৌভিককে দেখিয়ে বললেন, আমার এই তরুণ বন্ধুটি এখনো কয়েকটি সম্ভাবনা নিয়ে খেলা করছেন। প্রথম দুটি সম্ভাবনা বাদ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, খিদিরপুর থেকে জাহাজ ছেড়েছিল, সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আর সমুদ্রও ছিল শান্ত, তাই জাহাজডুবিও সম্ভব নয়, জলদস্যু আক্রমণ করবে এমন আশঙ্কা পুলিশের রিপোর্টেও নেই। এখন হাতে রইল পড়ে বারমুডা ট্রায়াঙ্গল, মানে জাহাজ যদি মাঝপথে ভ্যানিশ হয়ে যায়। সেটা কি সম্ভব!
দিদিমণি চেয়ার টেনে বেশ জুত করে বসে পান-মশলা চিবুতে চিবুতে বললেন, ওরকম জাহাজ ভ্যানিশ তো আমেরিকায় হয়টয় বলে শুনেছি। অনেকে বলে, বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে নাকি ভিনগ্রহীরা এসে জাহাজ ডুবিয়ে দেয়। আচ্ছা আমাকে বলতে পারেন, ভিনগ্রহীরা কেন আমেরিকাতেই আসে, বঙ্গোপসাগরে ইউএফও আসতে পারে না?
কানাই হাসলেন। – গরিব মানুষের বাড়িতে তো আর অতিথি আসে না, এলে বড়লোকদের বাড়িতেই আসে।
দিদিমণি হাত উলটে বললেন, তাহলে হাওয়ার কারসাজিই হবে হয়তো। জাহাজকে টেনে নিয়ে হয়তো শ্রীলংকা বা সিঙ্গাপুরে নিয়ে গিয়ে ফেলেছে।
সৌভিক পাশের টেবিল থেকে মুখ না তুলেই বলল, আলিপুর জানিয়েছে, সে-সময় কোনো সাইক্লোন আসেনি বে-তে।
– না না, আমি তেমন বড় ঝড়ের কথা বলছি না। আমি হাওয়ার কথা বলছি। কানাইবাবু, আপনি উত্তমাশা অন্তরীপের কথা শুনেছেন। ইউরোপীয় জাহাজ উত্তমাশা অন্তরীপ পেরোনোর পর এমন এক হাওয়া পেত, তাদের যাত্রার অনুকূলে বয়ে চলা হাওয়া, যা সোজা জাহাজগুলোকে ভারতীয় উপকূলে এনে ফেলত। দাঁড় বাইতেও হতো না। পাল খাটিয়ে দিলেই নৌকা ভেসে চলত। তেমন হাওয়া বঙ্গোপসাগরে কেন বইবে না!
কানাইয়ের গলায় সংশয় – ভূগোলের জ্ঞানটা আমার স্কুল ফাইনাল লেভেলের; কিন্তু বঙ্গোপসাগরে হাওয়া তো দক্ষিণ থেকে উত্তরমুখী বয়। অর্থাৎ আন্দামানের দিক থেকে বাংলার উপকূলের দিকে। জাহাজকে যদি ভ্যানিশ হতে হয়, হাওয়াকে বইতে হবে উত্তর থেকে দক্ষিণে – বাংলা থেকে আন্দামানের দিকে।
দিদিমণি ভুল শুধরে দিলেন – উত্তরমুখী হাওয়া বয় বর্ষাকালে, যখন মৌসুমিবায়ু সমুদ্র থেকে জল নিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করে। অথবা, সাইক্লোন তৈরি হলে, হাওয়া সমুদ্র থেকে বাংলায় ঢুকতে থাকে। কিন্তু বছরের সবসময় যে এমনটা হবেই তার মানে নেই, দক্ষিণমুখী হাওয়া তো থাকতেই পারে।
কানাই চমৎকৃত হয়ে বললেন, আপনার জিওগ্রাফিটা তো দারুণ।
দিদিমণি লজ্জা পেলেন – আমার হিস্ট্রি অনার্স ছিল, কিন্তু পাসে জিও ছিল।
কানাই দুবার ‘দারুণ’ বলে সৌভিকের দিকে তাকালেন। সৌভিকও দিদিমণির কথা শুনতে শুনতে ফরেনসিককে ফোন করতে ভুলে গেছে। কানাই নির্দেশ দিলেন – আলিপুরকে আধঘণ্টার মধ্যে সব উইন্ড ম্যাপ নিয়ে তুলে আনো। দরকার হলে সামনে একটা এসকর্ট-কার লাগিয়ে দে।
কানাই ঘড়ির দিকে তাকালেন, চারটের কাঁটা ছুঁয়েছে। – দিদি আজ একটু লেট হলে অসুবিধা হবে কী? সৌভিক আপনাকে অফিসের গাড়ি দিয়ে দেবে। দিদিমণি হাসলেন – থাকি তো রাজাবাজারে, কোনোই প্রবলেম নেই, হাতের কয়েকটা কাজ সেরে তবে আবার আসছি। বলে, উঠে চলে গেলেন।
কানাইচরণ উত্তেজনায় আরেকটা মালবরো ধরিয়ে লালবাজারের অলিন্দে চলে এলেন। সৌভিক ঝটপট ফরেনসিককে ফোনটা সেরে নিল। জলদি পিক করার জন্য পেট্রোলকার পাঠানো হয়েছে আলিপুরে। কানাইচরণ ঘড়ি দেখলেন, আর হয়তো মিনিট কুড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে দেবে। সিগারেটটা শেষ করে, দিনে প্রথমবার টয়লেটে গেলেন কানাইচরণ। নিজেকে উন্মুক্ত করে চেম্বারে ফিরে দেখেন দিদিমণিও তার দপ্তরের কাজ সেরে ব্যাগ কাঁধে ফিরে এসেছেন, কানাইয়ের টেবিলের সামনের কাঠের চেয়ারে বসে আছেন। সৌভিক ঘন-ঘন ঘড়ি দেখছে। চারটে পঁয়তালিস্নশে একজন সাব-ইন্সপেক্টর এক তরুণ ও সুবেশ পুরুষকে নিয়ে কানাইয়ের চেম্বারে এলো। সাব-ইন্সপেক্টরকে কানাই বিদেয় দিলেন। তরুণটির দুই হাত আর বগলভর্তি তাড়ি তাড়ি মোড়ানো কাগজ। কাগজগুলির ভেতর থেকে নানা ধরনের ম্যাপ উঁকি দিচ্ছে। তরুণটির গালে অল্প দাড়ি, ব্যাকপ্রেশ চুল, পরনে জিন্স।
সৌভিক তরুণটিকে বললেন, সুচয়নবাবু, পিস্নজ, বসুন।
সুচয়ন বললেন, আমি কিন্তু সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের কর্মচারী, এভাবে বলা নেই, কওয়া নেই বড়সাহেবরা কেউ জানে না, আপনারা আমাকে তুলে আনতে পারেন না!
সৌভিক সুচয়নকে শান্ত করতে বললেন, আহা, আপনার থেকে একটা জরুরি ফেভার চাই। নেক্সট টাইম আপনার যে-কোনো প্রবলেমে লালবাজারকে আপনি পাবেন।
সুচয়ন ধাতস্থ হলেন। সৌভিক বেল টিপে বেয়ারাকে বলল, সবার জন্য কফি আনতে। কানাইচরণ সুচয়নের কাছে নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, সুচয়নবাবু আপনাকে উইদাউট নোটিশে তুলে আনার জন্য আমরা দুঃখিত। ওয়েদার-সংক্রান্ত কয়েকটা ইনফরমেশন আপনার থেকে নিয়েই আমরা আপনাকে যেখানে বলবেন ড্রপ করে দিয়ে আসব।
সুচয়ন বললেন – ইট্স ওকে, কিন্তু ইনফরমেশন আমাকে ফোনে জিজ্ঞেস করলেও দিয়ে দিতে পারতাম।
কানাই বললেন, আমি নিজেও জানি না, কী ধরনের ইনফরমেশন আমাদের প্রয়োজন। আচ্ছা, আপনি কি বঙ্গোপসাগরে কোনো দক্ষিণমুখী হাওয়ার কথা জানেন?
– অনেক ধরনের উইন্ড সার্কুলেশন অর্থাৎ হাওয়ার চলাফেরা বে অব বেঙ্গলে দেখা যায়। সমুদ্র তো একটা ছোট জায়গা নয়। তাদের প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য আর নানা ধরনের বিষয়ের ওপর নির্ভর করে নাম দেওয়ার রেওয়াজও আছে। সুচয়ন বললেন। কানাই বললেন, আমি নিজেও জানি না আপনাকে ঠিক কী প্রশ্ন করা উচিত, আচ্ছা, কোনো হাওয়া কি একটা জাহাজকে… মানে, টেনে… বলতে বলতে কানাই দিদিমণির দিকে অসহায়ভাবে তাকিয়ে বললেন… আপনি একটু হেল্প করুন না, আপনি তো জিওগ্রাফির।
দিদিমণি সুচয়নকে বললেন, ভাই কাইন্ডলি উইন্ড ক্লাইমেটোলজির এটল্যাসটা খুলবেন, সেপ্টেম্বরেরটা বের করবেন।
একতাড়া ম্যাপের মধ্যে সুচয়ন ক্লাইমেটোলজির এটল্যাস খুঁজতে ব্যস্ত হলেন। কানাইচরণ আর সৌভিকের ভ্যাবাচ্যাকা অবস্থা দেখে দিদিমণি বললেন, ক্লাইমেটোলজি মানে হলো পঞ্চাশ কি একশ বছরের জলবায়ু। ধরুন ১৯১০ সাল থেকে যদি সমুদ্রের বিভিন্ন স্থানে হাওয়ার গতিবেগ মাপা হয়ে থাকে, ১৯১০ সাল থেকে ২০১৬ অবধি হাওয়ার গতিবেগ আর দিকের গড় নেওয়া হবে। আমি সেপ্টেম্বরের ক্লাইমেটোলজি বের করতে বললাম। সেটা দেখলে, সেপ্টেম্বর মাসে সমুদ্রের হাওয়া কোনদিকে বয় আর কত গতিবেগে বয় সেটার একটা ধারণা পাওয়া যাবে। সুচয়ন একটি অপেক্ষাকৃত ঝকঝকে বঙ্গোপসাগরের ম্যাপ সৌভিকের টেবিলের ওপর মেলে দিলেন। বঙ্গোপসাগরকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশরা চলে গেছে। নীল সমুদ্র এখন সৌভিকের টেবিলের ওপর। ম্যাপের তিনকোনায় করম-ল উপকূল, সুন্দরবন আর মিয়ানমারের উপকূল উঁকি নিচ্ছে। নিচের দিকে ভারত মহাসাগরের অথৈ জলরাশি। কানাই ম্যাপের দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে আনলেন, বঙ্গোপসাগরের ওপর অসংখ্য ছোট ছোট তীরচিহ্ন, তার একটির ওপর হাত রেখে কানাই জিজ্ঞেস করল, এই অ্যারোগুলি কিসের?
সুচয়ন জানালেন, এগুলিই তো হাওয়ার দিকনির্দেশ করছে, তীরচিহ্নগুলি কম্পাসের যেদিকে নির্দেশ করছে, সেদিকে সেপ্টেম্বর মাসে সাধারণত হাওয়া বয়ে থাকে। ম্যাপের মধ্যে আধ ডিগ্রি অন্তর অন্তর তীরচিহ্ন রয়েছে, অর্থাৎ প্রতি ৩০ কিলোমিটারে হাওয়া মাপা হয়েছে। আর হাওয়া যত জোরে বইবে তীরচিহ্ন তত লম্বা হবে, বলে সুচয়ন ম্যাপের বঙ্গোপসাগরের ওপর হাত রেখে বললেন, এই অঞ্চলটাকে আমরা সেন্ট্রাল বে বলি, এখানেই যত সাইক্লোন তৈরি হয়, তাই এই জায়গাটা অপেক্ষাকৃত শান্ত। তাই দেখুন, এখানে তীরচিহ্নটি আকারে অন্যান্য তীরগুলির থেকে ছোট আর অতি সামান্য উত্তরে দিকনির্দেশ করছি।
কানাইচরণ হুগলি নদীর মোহনার কাছে আঙুল রাখলেন, তারপর আঙুল দক্ষিণদিকে নামাতে থাকলেন, পারাদ্বীপের পূর্বে এসে থমকালেন, তারপর সোজা নিচের দিকে নামতে থাকলেন, আন্দামান পর্যন্ত গিয়ে থামলেন। তীরচিহ্নগুলিও মূলত দক্ষিণমুখে নির্দেশ করছিল। এরপর কানাইয়ের আঙুল ফের পারাদ্বীপের কাছে উঠে এলো। আঙুল কিছুক্ষণ ম্যাপের মধ্যে কিছু একটা খুঁজল, পারাদ্বীপের সামান্য নিচে নামতেই কানাই যা খুঁজছিলেন দেখতে পেলেন। লম্বা লম্বা তীর, সংখ্যায় বেশি নয়, পাশাপাশি ধরলে দুটি কি তিনটে, অর্থাৎ দেড়শো-দুশো কিলোমিটার জায়গা জুড়ে দক্ষিণমুখী তীরগুলির থেকে বাঁক নিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম মুখে চলেছে। যেন বড় একটি রাস্তা থেকে একটি ছোট রাস্তা বেরিয়ে গেছে। কানাইচরণের আঙুল হাওয়াদের রাস্তায় চলতে শুরু করল। কানাই সাবধানে আঙুল চালালেন, কারণ দক্ষিণ-পশ্চিমমুখী তীরের সংখ্যা খুব অল্প। তাদের প্রতিবেশী তীরগুলো সবই দক্ষিণে চলেছে। সমুদ্রের মধ্য দিয়ে কিছুক্ষণ চলার পর এক জায়গায় গিয়ে কানাই থামলেন। সেইখানে গিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমমুখী হাওয়া ফের দক্ষিণমুখী হয়েছে। কানাইয়ের আঙুল তামিলনাড়ুর উপকূল থেকে এক ইঞ্চি পরিমাণ দূরে থেমেছে। কানাই সুচয়নের দিকে চাইলেন।
সুচয়ন বললেন, আপনি এতক্ষণ যে-সার্কুলেশনকে ফলো করলেন সেটা এক ধরনের অ্যানোম্যালি অর্থাৎ বৈষম্য। সেপ্টেম্বরের সমুদ্রে হাওয়ার যে-ধরনের দিগ আর জোর থাকে তার থেকে বেশ আলাদা। এই হাওয়াটি পারাদ্বীপের দক্ষিণ থেকে তামিলনাড়ুর সামান্য পূর্বে গিয়ে শেষ হয়। এর জোরও শামিত্ম সামুদ্রিক হাওয়ার চেয়ে অনেক প্রবল কিন্তু ঘূর্ণাবর্ত বা সাইক্লোনের মতো অত জোরও নেই। ৬০ কিমির বেশি হাওয়ার বেগ হলে আমরা ঘূর্ণাবর্তকে সাইক্লোন বলি আর ৪০ কিমির ওপরে হলে বলা হয় গভীর নিম্নচাপ। কিন্তু এই বিষম হাওয়ার গতিবেগ ২০ থেকে ৪০-এর মধ্যে। বঙ্গোপসাগরের উষ্ণ জলের কারণে এই বিষম হাওয়া তৈরি হয়ে থাকে।
কানাই ম্যাপের ওপর মাথা ঝুঁকিয়েই সুচয়নের কথা শুনছিলেন, ম্যাপের ওপর চেপে থাকা তার তর্জনী দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন – এই যে জায়গাটি, যেখানে এসে আপনার স্পেশাল হাওয়া বাকি হাওয়ার সঙ্গে মিশে গেল এটি থেকে কত দূরে। সুচয়ন ম্যাপের অক্ষাংশ দেখে বললেন – অনধিক ৬০ কিলোমিটার। কানাই সুচয়নের দিক থেকে মাথা ঘুরিয়ে সৌভিকের দিকে তাকালেন। সৌভিক ইশারা ধরতে পেরে নিজের মনে জমা প্রশ্ন করে ফেলল – যদি আমরা ম্যাপ দেখে এই বিশেষ হাওয়ার কথা জানতে পারি, যদি আলিপুর জানে এই হাওয়ার কথা, ব্রিটিশ স্পেশাল ব্রাঞ্চ কেন জানতে পারল না?
কানাই ছোট একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ম্যাপ থেকে আঙুল তুলে নিলেন। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, বেতো কোমর টানটান করে বললেন – ভালো প্রশ্ন কিন্তু ব্রিটিশ পুলিশ কেন জানে না সেটা আমরা ইতোমধ্যেই জেনেছি। বরং প্রশ্নটা। একটু ঘুরিয়ে করা উচিত ছিল। যাহোক আগে ব্রিটিশ স্পেশাল ব্রাঞ্চের দক্ষতাটা দেখা যাক। সুচয়নবাবু আপনার কাছে ১৯১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসের সামুদ্রিক হাওয়ার এটল্যাস আছে।
– থাকতে পারে, বলে সুচয়ন আবার ম্যাপের গাদার মধ্যে হামলে পড়ে একটি জরাজীর্ণ ম্যাপ তুলে আনলেন। সেই ম্যাপে বঙ্গোপসাগরের স্বচ্ছ নীল রং ধূসর হয়েছে, ম্যাপের কোনায় মিয়ানমার, বাংলাদেশ, তামিলনাড়ু, মিলিয়ে একটাই দেশ, ব্রিটিশ ইন্ডিয়া। সুচয়ন আগের ম্যাপের ওপর ১৯১৩ সালের ম্যাপটি মেলে দিলেন। সৌভিক ঝুঁকে পড়ে পারাদ্বীপের কাছে সেই বিশেষ হাওয়াটিকে খোঁজার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো।
কানাই বললেন – তেমন কোনো হাওয়া নেই তো, আরো একটা জিনিস নেই, সেটা কি বলো তো?
সৌভিক বলল – আগের ম্যাপের অনেক বেশি তীরচিহ্ন ছিল, এখানে দেখছি অনেক দূরে দূরে একটা তীর।
– সমুদ্রের হাওয়া মাপার কাজ শুরু হয়েছিল ১৯১০-এর দিকে, তার আগে থেকেই যদিও স্থলভূমিতে বৃষ্টিপাত মাপার উদ্যোগ নেওয়া হয়; কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কাতেই ব্রিটিশরা সমুদ্রের পর্যবেক্ষণও শুরু করে। তখন কতগুলো স্টেশন ছিল সুচয়নবাবু?
– তখন আমাদের বে অব বেঙ্গলে ১৮টি পয়েন্টে হাওয়া, বৃষ্টিপাত, পারদ ইত্যাদি মাপার ব্যবস্থা ছিল।
সৌভিক বলল – কিন্তু ম্যাপে তো ১৮টির অনেক বেশিই তীর দেখতে পাচ্ছি।
সুচয়ন বললেন – ওগুলো গাণিতিক হিসাবে কষে বাড়ানো হয়েছে, তাই সে-সময় সমুদ্রের আসল অবস্থার সঙ্গে মেলার সম্ভাবনা কম। ধরুন একটি পয়েন্টের বৃষ্টিপাতের পরিমাণ জানতে পারলে আপনি তার থেকে ২০ কিমি দূর অবধি বৃষ্টিপাতের পরিমাণ আঁকা কষে বলে দিতে পারবেন, একে এক্সট্রাপোলেশন বলে। কিন্তু দূরত্ব যত বাড়বে, ভুলের আশঙ্কাও তত বাড়বে। কানাই সুচয়নের কথার সূত্র ধরে বললেন – যেহেতু সবে সমুদ্রে পর্যবেক্ষণ শুরু হয়েছে, তাই ১৯১৩ সালের মধ্যে ক্লাইমেটোলজির ম্যাপ পাওয়াও যাবে না, পাওয়া গেলেও তা নিখুঁত হবে না। ৩০ বছরের গড় আবহাওয়াকে জলবায়ু বলা হয়, কি তাই তো দিদিমণি?
দিদিমণি সায় দিলেন – নির্ভুল।
– এখন কটা পয়েন্টে আপনারা পরিমাপ করেন? সৌভিক সুচয়নের কাছে জানতে চাইল।
– এখন তো আর শুধু স্টেশন নেই, এখন এয়ারবোন, স্যাটেলাইট, ভেসেল, ড্রোন কত রকম পদ্ধতি চলে এসেছে। এখনকার যা ম্যাপ দেখছেন সব নির্ভুল। তাই নিখুঁতভাবে বিষম হাওয়াকে আমরা বুঝতে পারছি।
কানাই বললেন – রহস্যের একটা দিক এখন আমার কাছে পরিষ্কার। আমি এই বিষম হাওয়াকে উইন্ড বলে ডাকব, যদি আপনার আপত্তি না থাকে। ১৯১৩-এর ম্যাপে যখন এই হাওয়া নেই, তখন ধরে নেওয়া গেল, এই হাওয়ারও ১৯১৩-তে কোনো অসিত্মত্বও নেই…
সুচয়ন আপত্তি করলেন – তা কেন! ম্যাপে নেই মানে বাস্তবে নেই তা তো নয়। ম্যাপে তো এককালে আস্ত আমেরিকা মহাদেশেরই অসিত্মত্ব ছিল না।
– ওকে, অ্যাগ্রিড, ম্যাপে নেই মানুষ জানে না, ব্রিটিশ গোয়েন্দারা জানে না। বিপস্নবীরা জানে না। মানুষের নলেজেই যদি না থাকে তাহলে জাহাজ চালাতে এই হাওয়ার সুবিধা তোলাও তো সম্ভব নয়। আপাতভাবে তাই তো মনে হচ্ছে।
সৌভিক সায় দিলো, ঠিক।
– কিন্তু দিদিমণি, উত্তমাশা অন্তরীপে যে-হাওয়ার কথা আপনি বললেন সেটি কি ম্যাপে ছিল, বার্থোলোমিউ দিয়াজ উত্তমাশায় ফাঁসার পরেও কি ম্যাপে উঠেছে। হয়তো হ্যাঁ, নির্দিষ্টভাবে নয় হয়তো; কিন্তু তবু একদল মানুষ এই হাওয়ার অসিত্মত্ব জানেই, তারা না জানলে চলে না, কি সুচয়নবাবু, ঠিক বলছি? কানাই জিজ্ঞেস করল।
– অবশ্যই। সমুদ্রের সব খুঁটিনাটি সেলারস হ্যান্ডবুকে থাকে।
– নাবিক-মালস্নারা যুগ-যুগান্তর ধরে সমুদ্রকে পড়ে আসছে। বিজ্ঞানী-আবহাওয়াবিদরা উদয় হওয়ার বহু আগে থেকে, প্রাচীনকাল থেকে সমুদ্রকে পড়ার চেষ্টা করছে মাঝি-মালস্নারা। তাদের অর্জিত জ্ঞান কোনো ম্যাপে লেখা নেই। বংশানুক্রমে ছড়িয়ে আছে। কেউ কেউ নোটবুকে, ডায়েরিতে লিখে রেখেছে। সমুদ্রের প্রতিটি হাওয়াকে তারা কররেখার মতো চেনে।
সৌভিক বলল – কানাইদা জর্জের নাবিক ছিল ওস্তাদ মাসুদ, আমি নিজে তার খিদিরপুরের বাসায় লোক পাঠিয়েছি। সে জেনুইন নাবিক, সে বিপস্নবী নয়। সে জর্জের দিশা পালটে আপনার হাওয়ায় গিয়ে পড়বে না।
কানাই অস্বীকার করলেন – আমি তো বলিনি জর্জের দিশা পালটানোর জন্য নাবিক প্রয়োজন। যেটা প্রয়োজন সেটা হলো নাবিকি জ্ঞান, সেটুকু থাকলেই হলো। বাকি কাজ তো করবে উইন্ড। আর এই জাহাজটি নিখোঁজের কেসে নাবিকি জ্ঞান, ওস্তাদ মাসুদ ছাড়াও আরেকজনের থাকা সম্ভব ছিল।
রেজিস্ট্রার দিদিমণি উত্তেজিত হয়ে কানাইয়ের টেবিলের ওপরে রাখা ‘কিং–অ্যাম্পারার ভার্সাস নৃপেণ চট্টরাজ অ্যান্ড আদারস’ কোর্ট প্রসিডিংসের ফাইলটা তুলে ধরলেন। কানাই হা-হা করে হেসে উঠল। – কেস দাঁড়িয়ে গেছে, সব টুকরো জোড়া দিতে সেসিল বারে যাওয়া যাক। সুচয়নবাবু, আপনারকে ড্রপ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি, অনেক ধন্যবাদ।
পুলিশি কেসের মধ্যে বেশি না ঢোকাই ভালো – ভেবে সুচয়ন কানাইয়ের চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলেন। কানাই, সৌভিক আর রেজিস্ট্রার দিদিমণি লালবাজারের বাড়ি থেকে বিকেলের বউবাজার স্ট্রিটে নেমে এলেন। দুই পা হাঁটতেই বিখ্যাত পানশালাটি, কানাইচরণের প্রত্যহ বিকেলের আড্ডা। পানশালার কোণের দিকে একটি টেবিল পছন্দ করে তিনজনে বসলেন, কানাই আর সৌভিক এসি বস্ন্যাক অর্ডার দিলো। দিদিমণি বললেন – ভদকা উইথ লাইম কর্ডিয়াল। সঙ্গে এলো মিক্সড পকোড়া – পানশালাটির বিখ্যাত অনুপান। এক পিস হুইস্কি মেরে কানাইচরণ কথা বলা শুরু করলেন।
– ব্রিটিশ পুলিশের কেস ডায়েরি পড়ে প্রথম আমার যেটা মনে হয়েছিল নৃপেণের বিরুদ্ধে চরবৃত্তির কেসের খুব বেশি একটা মেরিট নেই। প্রধান সাক্ষী বলতে একজন – ঠিকে ঝি গঙ্গা আর তার নাগর, যে নিজে পুলিশ! আজকের দিনে এমন কেস হলে বটতলার উকিল ওকে ছাড়িয়ে আনতে পারত। পরাধীন দেশের কথা ভাবলে, এরকম কেসে পাঁচ কি সাত বছরে জেল যথেষ্ট। অনুশীলন সমিতির ছোকরা বিপস্নবীদের তাই হয়েছে। অনেকের কালাপানি হলেও বেশি বছরের নয়, আজীবন তো নয়ই। মাথাদের কথা অবশ্য আলাদা। নৃপেণেরও হয়তো কয়েক বছর কারাবাস হতো। সাজা কেটে বেরিয়ে আসত। কিন্তু তবু, ব্রিটিশরা নৃপেণের বিরুদ্ধে একটা সত্যি কি মিথ্যা রাজসাক্ষী দাঁড় করাল, এক তুতোভাইকে।
এই প্রথম আমার সন্দেহ হলো যে, নৃপেণের একটা গুরুত্ব আছে। স্বদেশিদের কাছে গুরুত্ব থাকতে পারে কি? আর পাঁচটা উৎসাহী স্বদেশি সে নয়। সে হয়তো বোমা বাঁধেনি, কিন্তু মূল্যবান তথ্য পাচার করেছে। মূলত তার পাচার করা তথ্যের ভিত্তিতেই পরে গডফ্রে দিনহ্যামের ওপর হামলার চেষ্টা হয়। একবার জেল থেকে ছাড়া পেলে তো আর চরবৃত্তি করে উঠতে পারবে না। তাই কারামুক্তির পর স্বদেশিদের কাছে নৃপেণের কতখানি গুরুত্ব অবশিষ্ট থাকত, আমার সন্দেহ আছে। কলকাতা অনুশীলন সমিতিও ততদিনে ম্রিয়মাণ হয়ে গেছে। একবার সাজা কেটে বেরিয়ে এলে ব্রিটিশের জন্যও ক্ষতিকর কিছু হয়ে উঠবে না। সে বারীন ঘোষ নয়, বাঘা যতীন নয়। ব্রিটিশরা তা সত্ত্বেও নৃপেণকে উচিত শিক্ষা দিয়ে ক্ষান্ত হলো না, কালাপানির ব্যবস্থা করল। লঘুপাপে গুরু দ-, তা হলে কি ব্রিটিশরা আসলে নৃপেণকে পাকাপাকিভাবে দূরে সরাতে চাইছিল? যাতে জেল থেকে কোনোমতেই বেরোতে না পারে। কার থেকে দূরে সরাতে চাইছিল? সৌভিককে প্রশ্ন করে উত্তর পেলাম – হয়তো কোনো বিদেশি শক্তির থেকে। এক্ষেত্রে নৃপেণের চরবৃত্তির কেসটা বড় নয়, নৃপেণ লালবাজারের ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্ট। ফিঙ্গারপ্রিন্টের দুই আবিষ্কর্তা আজিজুল হক আর হেম বসুর সাক্ষাৎ শিষ্য। লালবাজারে নৃপেণের বিকল্পের অভাব নেই। কিন্তু অন্যান্য রাজশক্তির ওকে প্রয়োজন হতে পারে। যুদ্ধের আশু-সম্ভাবনার মাঝে নিজের বাতিল অস্ত্রও কি অন্য রাজশক্তির হাতে তুলে দিতে আছে! ডাচ, ফরাসি বা পোর্তেদের নৃপেণের ওপর নজর থাকাটা একেবারেই অসম্ভব নয়। তাই নৃপেণের একটা গুরুত্ব ছিলই। ব্রিটিশ ভারতে ইংরাজদের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ফরাসিদের দিকেই আমার নজর গেল। তারা নৃপেণকে পেতে চাইবেই। তাদের জন্য এটা নতুন কিছু নয়। ঋষি অরবিন্দ ফরাসডাঙ্গা হয়ে পদুচেরিতে গেছেন। নলিনী সেনগুপ্ত গেছেন। অনুশীলন সমিতির অনেক সদস্যের সঙ্গেই পদুচেরির নিবিড় যোগ থেকেছে। একে স্বদেশি, দুই. ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্ট নৃপেণকে ফরাসিরা পেতে চাইবেই। কিন্তু সরাসরি ব্রিটিশ জলসীমায় তারা হামলা চালাবে না। তাই তারা ঘুরপথ নিল। নিজেদের এক চরকে জর্জ দ্য স্যাভিওরে যাত্রী সাজিয়ে উঠিয়ে দিলো, তার নাম রাখহরি ঘোষাল। তার পরিচয়ে যুগান্তর পত্রিকা বলছে যে, তিনি একজন অলকটবাদী থিয়োসফিস্ট! সে-সময় থিয়োসফিস্টদের সঙ্গে ন্যাশনালিস্ট নেতাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক! রাখহরি ঘোষাল তার ফরাসি আর অরবিন্দ ঘোষদের প্রভাব খাটিয়ে থিয়োসফিস্টদের কাগজপত্র জোগাড় করে থাকবেন। জাহাজে তাকে কেউ সন্দেহ করেনি। থিয়োসফিস্ট দোহাই দিয়ে দাড়ি-পাগড়ির বিচিত্র সাজই বাকি যাত্রীদের সন্দেহের উদ্রেক করবে না। এমনিতেই বর্ষা শেষের সমুদ্র, ঝড়ের আশঙ্কায় জাহাজে বেশি লোক হয়নি। রাখহরি ঘোষাল তক্কে তক্কে রইলেন, জাহাজে সাগর পার হলো। কলকাতামুখী জাহাজটির সঙ্গে মোলাকাত হলো। তারপর পারাদ্বীপের পূর্বে আসতেই রাখহরি ঘোষাল জাহাজের দখল নিল। সম্ভবত নৃপেণ বাদে জাহাজের বাকি সকলকেই সে হত্যা করে। এমনকি কাপ্তান ওস্তাদ মাসুদকেও সে হত্যা করে। রাখহরি ঘোষাল জাহাজ চালাতে জানেন না, বা জানলেও তাতে কাজ হবে না, কারণ জাহাজের মাঝি-মালস্না সকলেই মৃত -বয়লার রুমে কেউ নেই। তাতে সমস্যাও নেই, কারণ –
সৌভিক কানাইচরণের কথার খেই ধরে বলল – ততক্ষণে জাহাজ পদুচেরি উইন্ডের পালস্নায় এসে গেছে। জাহাজে স্রেফ পাল খাটিয়ে দিতে পারলেই জাহাজ তরতর করে পদুচেরির কাছে পৌঁছে যাবে।
– কারেক্ট পদুচেরির কাছে পৌঁছে যাবে; কিন্তু পদুচেরি অবধি পৌঁছবে না। ষাট-সত্তর কিমি আগেই থেমে যাবে। আর রাখহরি ঘোষাল চাইবেও না জাহাজ নিয়ে পদুচেরি বন্দর অবধি পৌঁছতে, কারণ বন্দরে ইংরাজ গুপ্তচর থাকার আশঙ্কা আছে। তাই জাহাজ, জর্জ দ্য স্যাভিওর এখন পদুচেরি থেকে মাইলষাটেক দূরে থেমে আছে। অপেক্ষা করছে একটি ফরাসি নাওয়ের, যেটি কিছুক্ষণের মধ্যে এসে উপস্থিত হবে রাখহরি ঘোষাল ও চট্টরাজকে উদ্ধার করতে। এই একটি মাত্র নাও জর্জের যাত্রাকালে পদুচেরি বন্দর থেকে রওনা দিয়েছিল। আলকাতরাবোঝাই নাও। আগুন লাগানোর জন্য ভারি উপযুক্ত জিনিস। একটি পিপে উপুড় করলেই জর্জকে যথেষ্ট ঝলসে দেওয়া সম্ভব। ফরাসি নাওটি যান্ত্রিক গোলযোগের অজুহাত নিয়ে পদুচেরিতে ফিরে আসে। এই নাওতেই লুকিয়ে আছে নৃপেণ ও রাখহরি। আর নাওয়ে একটি কি দুটি আলকাতরার পিপে ফাঁকা। সম্ভবত বন্দরে প্রবেশের মুখেই আর রাখহরি ফরাসি নাওটি ত্যাগ করে বাকি পথ সাঁতরে নেয়।
সৌভিক বলল – এই পর্যন্ত মেনে নিতে আমারও আপত্তি নেই। কিন্তু দুটো প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। ব্রিটিশরা সমুদ্রে তলস্নাশি চালালে কি জর্জের পোড়া কাঠ খুঁজে পেত না?
– জর্জে মোটে দশজন যাত্রী ছিল, তিনজন সাদা চামড়া মোটে। ব্রিটিশরা খুব বেশি তলস্নাশিতে জোর দেয়নি। জর্জের অবশিষ্টাংশও দক্ষিণমুখী ঢেউয়ে ভেসে ভারত মহাসাগরের বিসত্মৃত অংশে চলে গিয়ে থাকতে পারে।
– তাহলে দ্বিতীয় ও মোক্ষম প্রশ্নটি এই যে, পদুচেরি হাওয়ার কথা এটল্যাসে নেই, ব্রিটিশ স্পেশাল ব্রাঞ্চ জানে না, শুধু কিছু নাবিক জেনে থাকতে পারে, সেটা এই মিস্ট্রিরিয়াস রাখহরি ঘোষাল কী করে জানল? সে কি পেশায় প্রকৃতপক্ষে নাবিক? সৌভিক জানতে চাইল।
– তা কেন, তার সঙ্গে নাবিকদের ইয়ারদোসিত্ম থাকতে পারে। নাবিকদের সঙ্গে ভাব জমালে অনেক খবরই জানা যায়। দিদিমণি জাহাজের খবর কি শুধু নাবিকরাই রাখে? কানাইচরণ রেজিস্ট্রার দিদিমণির কাছে জানতে চাইলেন। তার গস্নাসের ভদকা উইথ লাইম কর্ডিয়াল আর একফোঁটাও নেই।
দিদিমণি জবাব দিলেন – কেন! আদার বেপারীরাও জাহাজের খবর রাখতে পারে।
– দেখ সৌভিক, কেসটা হাতে নিয়ে ভেবেছিলাম, কেবলমাত্র জাহাজ হারিয়ে যাওয়ার মিস্ট্রিটা সলভ করলেই যথেষ্ট। সেটা সল্ভ করতে গিয়ে বুঝলাম, এটা জাহাজ মিস্ট্রির কেস নয়। এটা আসলে বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা আর ঘোগের ঘরে ফেউয়ের বাসার কেস।
সৌভিক মদের নেশায় মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, দুজনে মিলে কী যে হেঁয়ালি করছ, কোথায় বাঘ কিসের ঘোগ আর আদার বেপারীই বা কী করে এলো।
কানাই হুইস্কির দ্বিতীয় পেগটি একঢোকে খেয়ে বললেন, যেমনটা দিদি বললেন, না আদার বেপারীরাও জাহাজের খবর রাখে, সমুদ্রের হালহকিকত জানে। আর এই কেসে একজন আদার বেপারী আছে। সে হলো নৃপেণ চট্টরাজের তুতোভাই মোহন বসু। দিদিমণি বললেন
– কোর্ট প্রসিডিংসে আছে যে, মোহন বসু ডিফেন্সের প্রশ্নের উত্তরে খিদিরপুরে তার ঘড়ি সারাইয়ের দোকান।
সৌভিক উত্তেজনায় অস্ফুটে কিছু শব্দ করে উঠল।
– ইয়েস, মোহন বসুই আসলে রাখহরি ঘোষাল। সে ইংরাজের রাজসাক্ষী হতে পারে; কিন্তু সে আসলে মোক্ষম ডবল এজেন্ট। সে স্বদেশি, ইংরাজ রাজসাক্ষী নয় সে, আসলে ফরাসি চর। সে স্বদেশিদের বিশ্বাসঘাতকতা করে ইংরাজ সাক্ষী বনেছে আর ইংরাজদের বিশ্বাসঘাতকতা করে ফরাসি সরকারের চর বনেছে। ইংরাজরা রাজসাক্ষী বানিয়ে নৃপেণকে ফাঁসাতে চাইবে বুঝে মোহন বসু প্রথমে ইংরাজের হাতে ধরা দেয়। তারপর ইংরাজের দমননীতিকে ধুলো দিয়ে রাজসাক্ষীর প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়।
কিন্তু তার রাজসাক্ষী হওয়ার পেছনে আসল উদ্দেশ্য ছিল অন্য। মোহন ইংরাজ অফিসারদের ঘনিষ্ঠ হতে চেয়েছিল।
সৌভিক কানাইয়ের কথার সূত্র ধরে বলল, তা না হলে সে নৃপেণের যাত্রার খবর পেতে পারত না। কারণ পোর্টের কোনো নথিতে নৃপেণের নাম নেই। যুগান্তরের বিজ্ঞাপনে যাত্রী হিসেবে নৃপেণের নাম নেই। নিশ্চয়ই বাছাই করা লালবাজারের কিছু অফিসারই এই জাহাজযাত্রার খবর জানত। রাজসাক্ষী হয়ে মোহনও গোপন খবরটি জেনে যায়।
– এরপর আর কী! মোহন বসুকে রাজসাক্ষী বানাতে পেরে ইংরাজরাও খুব খুশি হলো। নৃপেণকে কালাপানির সাজা দেওয়া গেল। অন্যান্য রাজশক্তি থেকে নৃপেণকে দূরে রাখা যাবে। মোহন বসুর নামে মাসোহারা ধার্য হলো। এদিকে নৃপেণকে মামুলি কারাবাস থেকে কালাপানি অবধি টেনে নিয়ে যেতে পেরে মোহন বসু নিজেও মোক্ষম চাল দিলো। বাঘের ঘরে ঘোগ, আর ঘোগের ঘরে ফেউ। এইবার মোহন বসু তার আসল খেল দেখাবে। খিদিরপুরে ঘড়ির দোকানের সূত্রে সে পদুচেরি উইন্ড সম্পর্কে অবহিত ছিল, ওস্তাদ মাসুদকেও সে চিনে থাকবে। সুতরাং সে রাখহরি ঘোষাল নামে জর্জ দ্য সেভিওরের টিকিট কেটে ফেলল আর বাকিটা তো ইতোমধ্যেই বলে দিয়েছি। সৌভিক তুই আরো নিশ্চিন্ত হতে চাইলে ১৯৩০-এর পরে পদুচেরির আশ্রমে ঋষির শিষ্যদের তালিকাটা একটু দেখে নিস। আমার ধারণা, ফরাসি সার্ভিস থেকে অবসর নিয়ে নৃপেণ আর মোহন আশ্রমেই পাকাপাকিভাবে আশ্রয় নেয়।
সৌভিক হাত তুলে বলল, লাস্ট কমেন্ট, এরপরই বিল মিটিয়ে উঠব, দিদিমণিকে ড্রপ করতে হবে। ব্রিটিশ স্পেশাল ব্রাঞ্চ এই কেসটা সলভ করতে পারল না!
কানাই পেস্নটের লাস্ট পকোড়াটা মুখে পুরে হাসলেন, একশ বছরের মধ্যে লালবাজারে শুধুই কি ডিজিটালাইজেশন, লাইব্রেরি আর মিউজিয়াম হয়েছে! কো-অর্ডিনেশনটাও কি বেটার হয়নি? বলে দিদিমণির দিকে তাকিয়ে সিনিয়র ইন্সপেক্টর কানাইচরণ তার সহকর্মী সৌভিককে বললেন, তুই বরং আরেকটা পেগ মার, দিদিমণিকে আজকে আমিই ড্রপ করে আসছি।