জলিল সাহেবের মেজাজটা আজ ভয়ানক খারাপ। সামনে যাকে পাচ্ছেন তাকেই ধরে হুমকি-ধমকি, চড়-চাপড় মেরে যাচ্ছেন সমানে। অথচ সরকারি অফিসে কারো গায়ে হাত তোলা রীতিমতো অসদাচরণের শামিল। নির্ঘাত গুরুদ-। নেহাত অফিসের বড়কর্তা, তাই কেউ সাহস করে জলিলের মুখের ওপর কিছু বলতে পারে না।
এই অফিসের হেডক্লার্ক গোলাম কুদ্দুস। দীর্ঘদিন ধরে আছে, বড়ই সাদাসিধে বোকাসোকা মানুষ। সাত চড়ে রা করে না। আপনমনে থাকে। ঘাড় গুঁজে নীরবে কাজ করে যায়। বস্ত্তত সে কারো সাতপাঁচে নেই। বা, অফিসের কেউ তাকে বিশ^াস বা সমীহের যোগ্যই মনে করে না। বলা বাহুল্য, জলিল সাহেবের সবচেয়ে পছন্দের শিকার কুদ্দুস নামের এই ‘গোলাম’ প্রকৃতির মানুষটি। বসের মেজাজ বিগড়েছে বুঝলেই অন্য সবাই কোনো না কোনো ছুতোয় কেটে পড়ে। কিন্তু কুদ্দুস কোথাও যায়না। অনেকটা ভয়ে বা অভ্যাসের বশে জলিল সাহেবের ক্ষিপ্ত মেজাজের সামনে নিজেকে সে স্বেচ্ছায় সঁপে দেয়। যেন বিসর্জনেই শামিত্ম, সম্ভোগে নয়।
আসব স্যার? জলিলের ঘরের দরজা একটু মেলে ধরে থেঁতানো গলায় কোনোমতে বলতে পারল একান্ত বাধ্যগত হেডক্লার্ক গোলাম কুদ্দুস। সে জানে, স্যার তাকে আজ আর আস্ত রাখবে না। সকালবেলাই স্যারের মেজাজটা যেমন অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো লাফাচ্ছে!
আসবে মানে! এসেই তো পড়েছ? কী চাই বলো। বোকা গাধা কোথাকার! হেঁড়ে গলায় খেঁকিয়ে উঠলেন জলিল সাহেব। বস হিসেবে তার কুখ্যাতি সর্বজনবিদিত। এমন খড়্গহস্ত বদমেজাজি অফিসার ডিপার্টমেন্টে আর নেই। বয়সে জলিলের চেয়ে কুদ্দুস অন্তত বারো বছরের বড়। চুল তার রং বদলেছে। কাঁচাপাকা চুলের মিশেলে কেমন যেন অসহায় ভাব ফুটে ওঠে কুদ্দুসের চেহারায়। নাকি কেরানিরা দেখতে এমনই হয়!
ব্যুরোক্র্যাসিতে একটা বাজে ব্যাপার চালু আছে। বয়সের ফারাক যতই হোক, অধস্তনকে অনায়াসে নাম ধরে তুই-তুমি বলা যেন বসের সহবতের মধ্যে পড়ে। তা সে বাপের বয়সী হলেও।
কুদ্দুস অবশ্য তাতে এমন কিছু মনে করে না। এটাই যেন নিয়ম। ওপরঅলার গোলামি করবে বলেই হয়তো বাপ তার নাম রেখেছিল গোলাম কুদ্দুস। ডাক না পড়লে জলিলের রুমে সে খুব একটা যায় না; কিন্তু আজ দরকারটা খানিক গুরুতর। মেয়েটার জ্বর। রাতে খুব বাড়াবাড়ি হয়, সকালে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে। আবার বিকেলে বাড়ে। বেশ কদিন এমন যাচ্ছে। অডিট শাখার রুহুল সাহেব বলল রক্তপরীক্ষা করাতে। সময়টা ভালো নয়। ডেঙ্গুটেঙ্গু বাঁধালে তখন বিপদে পড়বে।
মেয়ে ময়না খুব বাপ-নেওটা। বাপের হাতে ছাড়া ওষুধ খাবে না। তার কাছেই মেয়ের যত আবদার-আহ্লাদ। ময়না আজ খুব করে বলেছে, যদি পারো তো একটু আগেভাগে বাসায় এসো।
আর-একটা কথা – কেমন এক আকুতি নিয়ে ময়না বলল।
কী কথা মা, বলো কী আনব? মেয়ের কপালে স্নেহের হাত রাখে গোলাম কুদ্দুস।
তেমন কিছু না বাবা। যদি পারো আসার পথে লটকন নিয়ে এসো। আর এক হালি কাগজি লেবু। তাজা দেখে। খুব খেতে ইচ্ছা করছে।
কথাগুলো যখন বলছিল ময়না, ওর দুচোখে কেমন দীপ্তি ফুটে উঠল। যেন জ্বরভোগের ক্লিষ্টতা আর নেই। ঝলসে উঠছে শৈশবের আলো। এত নিষ্পাপ আর প্রাণোচ্ছল দেখতে! কুদ্দুসের খুব ইচ্ছা করছিল একটা দিন অন্তত অসুস্থ মেয়ের পাশে থাকে। অপত্যস্নেহে হাত বুলিয়ে দেয় ময়নার গালে, কপালে, পিঠে।
বসের ঝাড়ি খেয়ে আসল কথাটাই বলতে ভুলে গেছে। বা বলা উচিত কিনা, তাই ভাবছে কুদ্দুস। ওর আর-এক দোষ – মোটেও মিথ্যা বলতে পারে না। তাই ভুলে যাওয়ার ভান করে। এর নাম পলায়নপরতা। নিজের কাছেই নিজেকে লুকিয়ে রাখা। আজকের জমানায় দু-চারটে মিথ্যে না বললে চলে, বলুন।
বদমেজাজি জলিল কুদ্দুসের চোখে চোখ রাখেন। আগুনগলায় বললেন, কী হলো, অমন বুরবকের মতো চেয়ে আছো কেন? বলো, কি জন্য এসেছ? এক্ষুনি বলো, নইলে তোমাকে সাসপেন্ড করব। এসিআরের বারোটা বাজাব। চাকরি যাবে, পেনশনও পাবে না। বউ-পোলাপান নিয়ে পথে বসবে, বুঝলে বেয়াক্কেল!
স্যার, লটকন। বারকয়েক ঢোক গিলে হঠাৎই বলল বশংবদ কেরানি গোলাম কুদ্দুস। গোলামিটা যেন তার অস্থিমজ্জায় মিশে গেছে। খাঁচায় পোরা পাখির মতো। মুক্তির স্বাদটাই যখন ভুলে যায়, খাঁচার ছোট্ট ঘেরাটোপ মুক্ত করে দিলেও সে ওড়ে না। ভয় পায়। নয়তো বড্ড আলস্য পেয়ে বসে।
হোয়াট! লটকান মানে কী! আমার সঙ্গে ইয়ার্কি মারছো! বদমাশ! আমি তোমার চাকরি খাব। খাবই। জানো না, বসের সামনে আর ঘোড়ার পেছনে কক্ষনো যেতে নেই!
টলতে-টলতে বসের রুম থেকে বেরিয়ে আসে কুদ্দুস। বাসায় অসুস্থ মেয়ের কথা, একটু জলদি বাসায় ফেরার প্রয়োজন – কোনোটাই তার মনে থাকে না। বেমালুম ভুলে যায়। সত্যি, আমলাতন্ত্র মানুষকে কেমন কাপুরুষ বানিয়ে দেয়।
কুদ্দুসের অফিসটা মতিঝিল এলাকায়। ভেবেছিল, একটু আগে ফিরতে পারলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিচে যে অস্থায়ী দোকান বসে, সেখান থেকে ময়নার জন্য তাজা দেখে লটকান কিনবে। সন্ধে উতরে গেলে বাজার থাকে না। লটকান বা লেবু কোনোটাই আর পাওয়া যাবে না তখন।
বড্ড মন খারাপ হলো কুদ্দুসের। কেরানি বলে কি সে মানুষ নয়! তার বুঝি কষ্ট পেতে নেই! বা মেয়ের জন্য মনখারাপ! এমন গোলামি খেটে কী লাভ! অনর্থক ছাপোষা জীবন!
খানিক বাদে রুহুল সাহেব বলল, ভায়া, একটুতেই অমনি চোট পেলে চলবে! দুনিয়াটা তোমার শ^শুরবাড়ি বুঝি! যাও, স্যারের মেজাজ এখন শান্ত। সুযোগ বুঝে মনের কথাটা বলে এসো। স্যারকে যত কঠিন মনে হয়, আসলে ততটা নয়। ওটা তার খোলস। জানো তো, স্যারের দুকুলে কেউ নেই। ছেলেপুলে হয়নি। শুনেছি ওঁর স্ত্রীও বিশেষ ঘরমুখো নয়। স্যার বড্ড একা। অমনি একখানা লেজুড় জুড়ে দিলো অডিট শাখার সহকারী রুহুল আমিন।
স্যার আসব?
ও কুদ্দুস? এসো এসো। বলো কী বলবে? স্যার যেন বিনয়ের অবতার। এই জলিলকে কি সে চেনে! কত ভদ্র শান্ত স্বরে কথা বলছেন! আসলে একেকজন মানুষের ভেতর কত মানুষ লুকিয়ে থাকে তার ইয়ত্তা নেই।
কুদ্দুস মেয়ের আবদারের কথাটা বলতে যাবে, ঠিক তখনই ফোন এলো। একবার নয়, বারবার।
কী হলো কুদ্দুস? বারবার কে তোমাকে ডাকছে? ধরো ফোনটা। জলিল সাহেব বললেন। এবারে তার কণ্ঠে ব্যাপক গাম্ভীর্য। একটু আগের সেই মিষ্টতা যেন আর নেই।
কুদ্দুস সহসাই ভয় পেয়ে যায়। জলিল সাহেবের সুর ও স্বরের এই ওঠানামা তার অচেনা নয়। আবার খিঁচরোবেন তিনি। চাই কি ধড় থেকে মু-ু আলাদা করে ফেলবেন।
না মানে স্যার – তোতলায় কুদ্দুস। ব্যুরোক্র্যাসিতে অধস্তনদের এটা একরকম পেটেন্ট করা বিহেভিয়ার – যার অর্থ আমি দুঃখিত স্যার। এবারের মতো মাফ করে দিন। এই নাক-কান মুলছি। আর কখনো হবে না।
বলতে নেই, জলিল কিন্তু মাফ করেননি। স্বরে দুর্বোধ্যতা ঢেলে বললেন, বুড়ো বয়সে প্রেমট্রেমে পড়োনি তো কুদ্দুস! সাবধান! নারী আর নরকের দূরত্ব কিন্তু খুব বেশি নয়। একটু ঢিলে দিয়েছো কি, সে তোমাকে পাতালে টেনে নামাবে।
বোকাসোকা মানুষ কুদ্দুস। এই কথার মানে কী সে বোঝে না। ফিক করে হেসে বলল, আমার মেয়ে ময়না ফোন করেছে স্যার। কদিন ধরে ওর খুব জ্বর। মেয়েটা একটু লটকান খেতে চেয়েছিল। মেহেরবানি করে স্যার যদি একটু আগে ছেড়ে দিতেন!
অমনি খেঁকিয়ে ওঠেন জলিল। যা নয় তাই বলে একরকম গরুপেটা করে তাড়িয়ে দেন অফিসের বিশ্বস্ত কেরানি গোলাম কুদ্দুসকে। এই বলে শাসালেন, হাতের কাজ পেন্ডিং রেখে অফিস লিভ করলে সত্যি-সত্যি তাকে এবার বরখাস্ত করবেন। ওপরঅলাও বাঁচাতে পারবে না।
ব্যস হয়ে গেল! মেয়ে ময়নার জ্বরতপ্ত মুখখানা শতচেষ্টা করেও আর মনে করতে পারল না কুদ্দুস। লটকান দূরে থাক, লেবুও তার মগজ থেকে উধাও। একটাই ভাবনা – হাতের কাজগুলো সব শেষ করতে পারবে তো! দরকার পড়লে রাতভর কাজ করবে। চাকরি বলে কথা।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। পুরো অফিস ফাঁকা। সবাই যে যার মতো বাসায় চলে গেছে। শুধু একলা বসে কলম পিষছে জলিল সাহেবের সবচেয়ে পছন্দের শিকার গোলাম কুদ্দুস। লেবু-লটকান চুলোয় যাক, চাকরি বাঁচানো ফরজ। গোলামের গোলামি গেলে থাকল কী!
ওদিকে অসুস্থ মেয়েটা পথচেয়ে বসে আছে – বাবা তার জন্য লটকন নিয়ে ফিরবে। সে নুন-মরিচ মেখে আয়েশ করে খাবে। আর লেবুর শরবত। সঙ্গে বেশি করে চিনি। ডাক্তার আঙ্কেল বলেছেন, লেবু-চিনির শরবত খেলে গায়ে তাগত আসে। রোগবালাই দূরে যায়।
রাত তখন প্রায় এগারোটা। চোরের মতো চুপিচুপি বাসায় ঢোকে কুদ্দুস। এতো রাতে লেবু বা লটকান কোনোটাই পাওয়া গেল না। তার বউ নাজমা বেগম উৎকর্ণ হয়ে ছিল – কখন ফিরবে মেয়ের বাবা। তিনজনের সংসারে এই লোকটি যে খুব দরকারি। শুধু রুটি-রুজির জন্য নয়, মানুষটাকে বড্ড ভালোবাসে নাজমা। এমন নিপাট ভালোমানুষ আর পাবে কোথায়!
এতো দেরি করলে যে! পথে কোনো ঝামেলা হয়নি তো! নাজমার কণ্ঠে ব্যাকুলতা। কারণ তার স্বামীটি যে নেহাতই ভালোমানুষ এ-কথা অজানা নয় তার। মাঝে মাঝে ভাবে, এই জামানায় এমন মানুষ অচল পয়সার মতোই বিড়ম্বনার।
ময়না ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। ভাগ্যিস জেগে নেই, তাহলে বড্ড লজ্জায় পড়ে যেত গোলাম কুদ্দুস। বাবা হিসেবে তার এই অসমর্থতা লুকাতো কোথায়!
গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারত। তাতে ময়নার জ্বর বা কুদ্দুসের চাকরির বিশেষ কোনো ক্ষতি হতো না। কিন্তু দুনিয়াটা যে এখনো অতটা খারাপ হয়ে যায়নি।
পরদিন সাতসকালে কুদ্দুসের দরজায় কলবেল বাজে। চোখ কচলাতে-কচলাতে উঠে আসে কুদ্দুস নিজেই। নাজমা অনেক রাত করে ঘুমিয়েছে। বউটাকে একটু বিশ্রাম দেওয়া দরকার।
এ কী! কী দেখছে কুদ্দুস! এ-স্বপ্ন নাকি সত্যি! অফিসের প্রবল পরাক্রমশালী বস জলিল সাহেব দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। তার হাতে লেবু আর লটকানের দুটো প্যাকেট। স্মিত হেসে বললেন, তোমার মেয়ে কেমন আছে কুদ্দুস? জ্বর কমেছে তো! তুমিও যেমন বোকা! বলেছি বলেই কি অসুস্থ মেয়েকে ফেলে রেখে অফিসের কাজে মুখ ডুবিয়ে রাখবে! জীবিকা – সে তো জীবনের জন্যই। জীবনটাকে সেলিব্রেট করতে শেখো।
তড়িতাহতের মতো স্থবির দাঁড়িয়ে কুদ্দুস। যেন তার বিশ^াসই হতে চায় না। স্যার এসেছেন তার মেয়েকে দেখতে! তাও আবার লেবু-লটকন নিয়ে! এও কি সম্ভব?
জলিল বোধহয় তার অধস্তনের মনের কথা টের পেয়েছিলেন। বিড়বিড় করে স্বগতোক্তির মতো বললেন – এমন একটা মেয়ে যদি আমার থাকতো! জীবনটা তাহলে এত দুর্বহ মনে হতো না।
বোকাসোকা কুদ্দুস কী বুঝল কে জানে। সে তার বসের গলা নকল করে বেশ ভাব নিয়ে বলল (প্রতিদিন জলিল সাহেব যেমন বলে), আসুন, আসুন। ভেতরে আসুন। ময়না আপনাকে দেখে খুব খুশি হবে। লেবু-লটকান ওর বেজায় পছন্দ।
ওহ্, তাই চলো। হাতের চেটোয় বাঁ-চোখটা মুছে নিলেন জলিল সাহেব।