আমার জীবনে এখন সবই অন্ধকার, শুধু আলো হয়ে বেঁচে আছে জেসমিনের স্মৃতি। আমার শরীর ও মন ভেঙে চুরে মিশে যায় পথের ধুলোয়। গোপীবাগ একনম্বর গলির একেবারে শেষ মাথায় আমার ছোট্ট পৈতৃক বাড়িতে আমি বেঁচে আছি। আমার বয়স কত? অনেক সময়ই আমি বয়স মনে করতে পারি না, শুধু জানি, আমি এখন মাঝবয়স পেরিয়ে গেছি। কখনো আমার জন্মতারিখের সঙ্গে হিসাব করে যখন আমার বয়সটা মেলাই, তখন আমি রীতিমতো আঁতকে উঠি। হিসাব মেলাতে গিয়ে দেখি, আমার বয়স হয়ে গেছে ৪৬ বছর তিন মাস। আর কদিন আমি বাঁচব? জানি না, মৃত্যুর সুনীল স্পর্শ আমাকে ছুঁয়ে যায়; তখন হয়তো একটু দমকা হাওয়া উড়ে যায় আমাদের ছাদের ওপর দিয়ে, আমি সেই খোলা ছাদে অনেক রাতে একা একা বসে থাকি আর ভাবি জেসমিনের কথা। জেসমিন এখন গুলশানে এক ধনী ব্যবসায়ীর স্ত্রী। জেসমিনের ছোট বোন ইয়াসমিনের বিয়ে হয়ে গেছে অনেকদিন, সে আছে স্বামীর সঙ্গে আমেরিকায়। শুধু এখন আছে ওদের ছোট বোন নাজনীন। সে একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে বিবিএ পড়ে। খুব সুন্দরী ও লাবণ্যময়ী। ওদের বাড়িও আমাদের বাড়ির পাশে। ওদের বাড়ি দোতলা আর আমাদের বাড়ি একতলা। গোপীবাগের নব্যধনীদের অ্যাপার্টমেন্ট অরণ্যের একপাশে আমাদের এ দুটি বাড়ি টিকে আছে সাবেকি আমলের স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে। নাজনীনদের দোতলা বাড়ির নিচতলায় থাকে ভাড়াটেরা আর ওপরতলায় বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকে নাজনীন। ওদের কোনো ভাই নেই। অনেকদিন পাশাপাশি থেকে আমরা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মতো হয়ে গেছি। ওদের সংসারের অনেক কাজ, যেমন ডাক্তার ডাকা কিংবা বাড়ির খাজনা-ট্যাক্স বা বিদ্যুৎ বিল জমা দেওয়া প্রভৃতি দায়িত্ব আমি সানন্দে পালন করে থাকি। নাজনীনের বাবা-মা আমাকে যথেষ্ট স্নেহ করেন।
আমার সংসারে আছে শুধু আমার বৃদ্ধা মা। মা ছাড়া এই পৃথিবীতে আমার সত্যিকার আপন বলে কেউ নেই। আজ অনেক রাতে আমি একা একা ছাদে বসে আছি, এমন সময় মা সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠে এলেন। মা বললেন, ‘কাদের মিয়া তুমি একা একা ছাদে বইসা থাকো কেন? আমার ভয় লাগে। রাইতে জিন-পরী আকাশ থেইকা নামে। দেখবা, তুমি একদিন খুব বিপদে পড়বা।’ মায়ের কথায় আমি নীরবে হাসি, ‘বলি, মা, তুমি ঘুমোতে যাও, আমি আরো কিছুক্ষণ ছাদে থাকব।’ মা বলেন, ‘টেবিলে ভাত বাড়া থাকল। তুমি মনে কইরা খাইয়া লইয়ো।’ এরপর মা চলে যান। এমন প্রায় প্রতিদিন হয়।
দিনের বেলায় আমি মতিঝিলে একটি দৈনিক পত্রিকায় সাব-এডিটরের চাকরি করি। মফম্বলের খবর সম্পাদনার দায়িত্ব আমাকে পালন করতে হয়। সন্ধ্যাবেলায় বাসায় চলে আসি। তারপর ছাদে উঠে আকাশ দেখি। আর খুব সকালে আমি জেসমিনের বাড়ির সামনের বকুল গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে থাকি। তখন ঘাসের ওপর পড়ে থাকে অনেক ঝরা বকুল। মনে পড়ে, সেই কবে আমি আর জেসমিন ঝরা বকুল কুড়োতাম সকালবেলায়। জেসমিনকে আমি ভালোবাসতাম। শুধু মুখ ফুটে বলা হয়নি। সেই জেসমিনের একদিন বিয়ে হয়ে গেল এক তরুণ ব্যবসায়ীর সঙ্গে।
এরপর প্রায় পনেরো বছর কেটে গেছে। আমি এখনো জেসমিনের বাড়িতে গিয়ে ওর বাবা-মায়ের খোঁজখবর নিই। তাদের দরকারি কাজ করে দিই।
আজ সন্ধ্যাবেলাতেও গিয়েছিলাম। জেসমিনের বাবা-মা অর্থাৎ হাসেম চাচা ও চাচি আমার সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করলেন। এ সময় নাজনীন হঠাৎ করে বলল, ‘কাদের ভাই, আপনার সঙ্গে জরুরি কিছু আলাপ আছে। চলুন আমার ঘরে যাই।’ নাজনীন আমাকে ওর ঘরে নিয়ে গেল।
নাজনীনকে আমি ছোটবেলায় খুব স্নেহ করতাম। ও আমার কাছে এখনো সেই ছোট্ট মেয়েটি আছে। ও যে কবে বড় হয়েছে খেয়ালই করিনি। কিন্তু সেই নাজনীন যা বলল তা রূপকথাকেও হার মানায়। এবং তা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। সত্য অনেক সময় উপন্যাসকেও হার মানায়।
সেই সন্ধ্যাবেলায় নাজনীন ঘরে আলো জ্বালাল না। বলল, ‘কাদের ভাই, আজ আপনাকে আমার একটা কথার জবাব দিতে হবে।’
আমি একটু অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম। বললাম, বলো।
নাজনীন বলল, ‘আপনি জেসমিন আপাকে খুব ভালোবাসতেন। কিন্তু কোনোদিন মুখ ফুটে বলেননি। তাই না?’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ বাসতাম। কিন্তু তুমি এসব কথা বলছ কেন? এবার নাজনীন আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, ‘কাদের ভাই, আপনি বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না। আপনাকে একটি সত্যি কথা বলি। আমি আপনাকে ভালোবাসি। এবার আমি আপনার জবাব চাই। আজ নয়। একটু ভেবেচিমেত্ম আগামীকাল দেবেন।’ এই কথা বলে নাজনীন ফিক করে হেসে ফেলল। আমি জানি, নাজনীন আমাকে নিয়ে একটু মজা করল। কিন্তু কেন করল তা জানি না। ও যে অন্য একটি ছেলের সঙ্গে প্রেম করে তা আমি জানি। ওর প্রেমিক মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র। নাজনীন কি আমাকে পাগল ভাবে? তবে ও এমন নির্মম রসিকতা আমার সঙ্গে করল কেন?
নাজনীনের কথা শুনে আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমি শুধু বললাম, ‘তুমি কখনো আমার সঙ্গে এমন দুষ্টুমি করবে না।’ আমি ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি এবং প্রতিদিনের মতো আজ রাতেও আমাদের বাড়ির ছাদে বসে আছি। আমি জানি, জেসমিন যেমন আমাকে কোনোদিন ভালোবাসেনি, তেমনি নাজনীনও আমাকে ভালোবাসে না। শুধু আমাকে নিয়ে মজা করার জন্য আজ সন্ধ্যায় এ-নাটকের আয়োজন। নাজনীন আসলে আমাকে নিয়ে নির্মম রসিকতা করেছে। আমি ওর একটি কথাও বিশ্বাস করিনি। গোপীবাগ গলির একেবারে শেষ মাথায় আমাদের এ দুটি বাড়ি। আমি অনেক রাতে ঘুমোনোর আগে একা একা এলাম জেসমিনদের বাড়ির সামনে সেই বকুলতলায়। চারদিকে বকুল ফুলের গন্ধ। মনে হচ্ছে অন্তহীন ঝরা বকুলের কান্না যেন আমি শুনতে পাচ্ছি। আমার ভালোবাসার সীমাহীন বঞ্চনায় ওরা কাঁদছে। আমি জানি, ঝরা বকুলের কান্নার স্মৃতি নিয়ে একদিন পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হবে একা। জেসমিন ও নাজনীন তখন সুখের প্রজাপতি হয়ে গান গাইবে ওদের নিজ নিজ সংসারে। আমাকে নিয়ে এতটুকুও ভাবার সময় ওদের থাকবে না।