১৯০৩ সালের জানুয়ারির একটি শীতের সকাল। দিনপতি তার আগমনী বার্তা ঘোষণা করে এই ধরণির কোথাও হয়তো ঈষৎ উঁকি দিয়ে বিশ্বচরাচরে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটাতে নিমগ্ন। কিন্তু সেই আলোর আভা তখনো কলকাতার ভবানীপুর ৮৫নং কাঁসারীপাড়া লেনে এসে পৌঁছেনি। ভোরের অন্ধকার কিছুটা কেটে গেলেও পুরোদমে চারপাশে আলোকিত হতে তখনো বেশ খানিকটা বাকি। বৃক্ষরাজির শত-সহস্র পাখির কলতানে যেন মুহুর্মুহু মুখরিত হচ্ছে চারপাশ। তাদের বুঝি কিছুতেই আর তর সইছে না নীড় থেকে বেরিয়ে ডানা মেলে নীল আকাশে হারিয়ে যেতে। কিচিরমিচির ডাকাডাকি এগুলো তো পাখিগুলোর নিত্য-অভ্যাস, তারপরেও কেন তারা হররোজ ভোর থেকেই এমন হলস্না জুড়ে দেয়, সেটি একমাত্র ঈশ্বরই বলতে পারেন। ভবানীপুর ৮৫নং কাঁসারীপাড়া লেনের একটি জীর্ণশীর্ণ পলেসত্মারা খসে যাওয়া বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন শরৎচন্দ্র ও দেবেন্দ্রনাথ। দেবেন্দ্রনাথ হলেন শরৎচন্দ্রের মাতামহ কেদারনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের চতুর্থ ভ্রাতা অমরনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের একমাত্র পুত্র।
সম্পর্কে দেবেন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্রের দূরসম্পর্কের মাতুল। শরৎচন্দ্র হন্তদন্ত হয়ে ও ক্ষিপ্ততার সঙ্গে পা চালাতেই তাঁর মনে হলো দেবেন্দ্রনাথ হাঁটতে গিয়ে যেন পেছনে পড়ে যাচ্ছেন। শরৎ এবার খানিকটা চাপা গলায় দেবেন্দ্রকে উদ্দেশ করে বললেন।
– মামা আপনি দেখছি ক্রমেই পেছনে পড়ে যাচ্ছেন, নিদ্রার ভাব কি এখনো কাটেনি? একটু সাবধানে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে আসুন। দেখবেন জুতোর শব্দে বাড়ির লোক যেন জেগে না যায়। তাহলে কিন্তু আর রক্ষে থাকবে না; আপনি আমার রেঙ্গুন যাওয়া ভ-ুল করে দেবেন দেখছি।
শরৎচন্দ্র আজ পালিয়ে রেঙ্গুন যাচ্ছেন বলে ঘর থেকে ওরকম সাজসজ্জা করে বের হতে পারেননি। আর সাজসজ্জা করবেনই বা কী করে, তার নিজের সেরকম কোনো ভালো জামাকাপড়ও নেই।
আজ তিনি পরেছেন একটি সাদামাটা ফিনফিনে কাপড়ের ধুতি। গায়ে সাধারণ মানের সসত্মা বেনিয়ান। এই বছরটায় শীত বেশ জাঁকিয়ে বসেছে বলে গায়ে তিনি চড়িয়েছেন একটি মোটা শাল। আর পায়ে অনেক দিনের পুরনো পামশু। হাঁটায় সমতা আনার জন্য দেবেন্দ্রনাথ ঈষৎ দ্রুতবেগে ধাবিত হলেন রাসত্মা ধরে।
শরৎচন্দ্র বললেন, ‘মামা আপনি কি গাড়ি ঠিক করে রাখেননি?’
– আমি তো গতকালই ছ্যাকড়া গাড়ির ভাড়া অগ্রিম মিটিয়ে দিয়ে তাকে ভবানীপুর সদর রাসত্মার মোড়ে থাকতে বলেছিলাম। আমি নিশ্চিত, ও ওখানেই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
ভবানীপুর সদর রাসত্মায় পৌঁছাতেই ছ্যাকড়া গাড়ি এবং সহিসকে আবিষ্কার করা গেল। সহিস বেচারা গাড়ির পশ্চাৎ আসনটিতে হেলান দিয়ে আয়েশ করে বসে গদগদ করে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছিল।
– ওহে সহিস বেটা আর কত ঘুমোবি? এবার ওঠ। দেবেন্দ্রনাথের ডাকে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল সহিস বেচারা।
– কর্তামশাই, আমি তো সেই ভোর ৪টায় এসে বসে আছি আপনাদের অপেক্ষায়। অপেক্ষায় থেকে থেকে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই। তাড়াতাড়ি গাড়িতে চেপে বসুন। আমি আপনাদের দ্রুতই নিয়ে যাচ্ছি খিদিরপুর জাহাজ জেটিতে। শরৎচন্দ্র ও দেবেন্দ্রনাথ গাড়িতে উঠে বসতেই ছ্যাকড়া গাড়ি চলতে শুরু করল শকট-গতিতে।
– কলকাতা শহরের বুকে তখনো পাথরের চাঙড় বসেনি, পথঘাটগুলো বেশিরভাগই কাঁচা, পেছনে ধুলো উড়িয়ে ছ্যাকড়া গাড়ি চলছে সামনের দিকে।
দালানকোঠার ফাঁকে ফাঁকে দেখা যাচ্ছে একটা-দুটো পুকুর। শীতের সকালের ঘন কুয়াশাগুলো তখনো স্তরে স্তরে গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে আছে পুকুরগুলোর উপরিভাগে আর সেজন্য দালানগুলোকে ভোরের আলো-অন্ধকারের মধ্যে কিছুটা ভৌতিক দেখাচ্ছে।
ছ্যাকড়া গাড়িটি ভবানীপুর, কালীঘাট, আলীপুর ছাড়িয়ে ফোর্ট উইলিয়ামে চলে এলো। ফোর্ট উইলিয়ামে আসতেই শরৎ একটি জিনিস দেখে বেশ পুলকিত হলেন। কিছু বড় দালানে জ্বলছে বিজলিবাতি। বিজলিবাতি নামক এই জিনিসটি গত বছর অর্থাৎ ১৯০২ সালে প্রথম কলকাতায় এসেছে। লর্ড কার্জন এই বিস্ময়কর জিনিসটির আমদানিকারক। শুধু বিজলিবাতিই হবে কেন, কলকাতার জনগণের মধ্যে জনপ্রিয়তা পেতে লর্ড কার্জন লিফট কিংবা ট্রামের মতো যুগান্তকারী কিছু বস্ত্তও বিলেত থেকে আনিয়েছেন। লিফট নামক বস্ত্তটি নাকি দালানগুলোর ছাদ ফুঁড়ে মানুষজন নিয়ে ওপরের তলায় পৌঁছে দেয় আবার তাদের নিয়ে নেমে আসে নিচে। এই তো গত বছরই কলকাতায় ইলেকট্রিসিটির তিনটি সাবস্টেশন বসানো হলো। আর সেই বিদ্যুতের কল্যাণে কলকাতার অভিজাত এলাকাগুলো আলোয় ঝলমল করছে। কালে কালে আরো কত কী যে নতুন নতুন জিনিস সংযোজিত হবে সেটি ভাবার বিষয় বটে!
আর একটি বিষয় মনে পড়ল শরৎচন্দ্রের; তাঁর আত্মীয় সুরেন্দ্রনাথের এক বন্ধু এসেছিলেন কিছুদিন আগে ঢাকা থেকে, তিনি গল্পচ্ছলে বলেছিলেন, ঢাকায় নাকি ১৯০১ সাল থেকেই রাসত্মায় বিজলিবাতি জ্বলছে। কথাটি কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না শরতের।
শরতের মনে পড়ে গেল, তখন তিনি খুবই ছোট, বয়স আর কতই-বা হবে, চার কিংবা পাঁচ বছর। তখন গ্যাসের বাতি ছিল না, বিজলিবাতির জন্ম হয়নি, কেরোসিনের তেলের আলো ততটা জনপ্রিয়তা পায়নি। সন্ধেবেলায় ঘরে ঘরে ফরাস এসে রেড়ির তেলের আলো জ্বালিয়ে দিয়ে যেত। দিনের পরিবর্তন যেন হচ্ছে বেশ দ্রুতই।
শ্রীকামেত্মর মতোই ছোট একটি লৌহনির্মিত ট্রাঙ্ক ও যৎসামান্য বিছানাপত্র নিয়ে শরৎ যখন জাহাজঘাটায় পৌঁছলেন তখন সেখানে লোকে-লোকারণ্য। বাক্স-পেটরা নিয়ে যে-যার মতো দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করছে। অনেকে আবার সপরিবারে সারারাত বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছে। যদি ভালো ও সুবিধামতো একটু জায়গা পাওয়া যায় জাহাজটিতে। খিদিরপুরের জাহাজঘাটায় শরৎচন্দ্র লক্ষ করলেন তাঁর জাহাজটি ছাড়াও আরো দু-তিনটি জাহাজ ঘাটে নোঙর করে আছে। একটির নাম দ্য সিটি অব প্যারিস, অন্যটি দ্য সিটি অব সাউথ হ্যাম্পটন। একটি জাপানি জাহাজও দেখা গেল। নাম তাকাহাশি, সম্ভবত রেঙ্গুন, সিঙ্গাপুর ও পেনাং হয়ে টোকিওতে যাবে। বিলাতের মেইল নিয়ে যে-জাহাজ কলকাতা থেকে ছাড়ে, সে-জাহাজ তিনদিনে গিয়ে রেঙ্গুন পৌঁছায় আর কেবল ভারতের মেইল নিয়ে যে-জাহাজ কলকাতা থেকে ছাড়ে সেটি দিয়ে রেঙ্গুন যেতে লাগে চারদিন।
শরৎচন্দ্র এরূপ একটি কেবল ভারতের মেইল নেওয়া জাহাজে চড়ে ব্রহ্মদেশে রওনা হয়েছেন। কারণ এই জাহাজটির টিকিট ভাড়া অন্য জাহাজের চেয়ে অপেক্ষাকৃত সাশ্রয়ী। শরৎচন্দ্রকে রেঙ্গুনযাত্রার জন্য তাঁর এক মাতুল উপেন্দ্রনাথের কাছ থেকে চলিস্নশটি টাকা ধার করতে হয়েছে। সেই টাকা থেকে কিছু টাকা তিনি ব্যয় করেছেন টিকিট ক্রয়ে এবং বাকিটুকু হয়তো ব্যয় করতে হবে রেঙ্গুনে নেমেই। যাত্রীরা সবাই সারিসারি লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ব্যাপারখানা কী জানার উদ্দেশ্যে শরৎচন্দ্র জাহাজের জনৈক কর্মচারীকে জিজ্ঞেস করলেন।
– সকলে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ব্যাপারখানা কী একটু বলুন তো ভায়া।
– আপনার কি চোখ নেই মশাই, দেখছেন না? জাহাজে ওঠার আগে সবার ডাক্তারি পরীক্ষা চলছে, যাত্রীদের মধ্যে কোনো পেস্নগের রোগী আছে কিনা? বোম্বাই থেকেই নাকি এ-রোগটি বার্মায় (মিয়ানমারে) ছড়িয়েছে। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে ও সন্দেহজনক স্থানগুলোতে যখন ডাক্তার হাত দিয়ে পরীক্ষা করছিলেন, ভয়ে ও শঙ্কায় শরতের ওষ্ঠনালি থেকে কণ্ঠনালি পর্যন্ত শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছিল। একমাত্র ভগবানই বলতে পারেন ওই রোগের উপসর্গ কী কী?
শরৎ একজনকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কি জানা আছে মশাই এ-রোগের লক্ষণগুলো কী?
– আহা! দাদা আপনি তো দেখছি বড্ড জ্বালাতন করছেন। আপনি পেস্নগ রোগের লক্ষণ জানেন না? তাহলে মশাই জানেনটা কী? আপনি শরীরে হাত দিয়ে দেখুন শরীরের তাপ বেড়েছে কি না? শরৎ ঈষৎ মাথা নেড়ে উত্তর দিলেন, – আজ্ঞে না।
– বমি বমি ভাব হচ্ছে কি? শরীরটি নিস্তেজ মনে হচ্ছে?
– আজ্ঞে তাও না।
– কুক্ষের নিচে চামড়া ভেদ করে ডিম্বাকৃতির মতো কিছু ফুলে উঠেছে কি?
শরৎ বগলে তর্জনী দিয়ে দিয়ে স্পর্শ করে বললেন – না মশাই। সবকিছুই তো স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। লোকটি এবার একগাল হেসে বলল, – আপনার ভাগ্যটি বেশ সুপ্রসন্ন মনে হচ্ছে। পেস্নগ নামক রোগটি আপনাকে এখনো স্পর্শ করতে পারেনি। আপনার রেঙ্গুন যাওয়া কেউ আটকাতে পারছে না দেখছি। ডাক্তারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এবার শরৎচন্দ্র জাহাজে চড়তে উদ্যত হলেন ঠিকই; কিন্তু জাহাজে উঠতে গিয়ে ঈষৎ হকচকিয়ে গেলেন। কারণ জাহাজে চড়ার ব্যাপারটিও বেশ অদ্ভুত ধরনের। কাঁটা-দেওয়া চক্রাকার একটি যন্ত্র সর্বক্ষণ আগুপিছু ঘুরছে।
সেই অদ্ভুত যন্ত্রটির মধ্যে উঠে শরৎ প্রথমে গেলেন একেবারে ওপরে তারপর আবার নামতে হলো তাঁকে জাহাজের গর্ভগৃহে। নিচে নেমে এলেন ঠিকই কিন্তু তাঁর বিছানাপত্র পাতবেন তো অনেক দূরের কথা, এতটুকু নিশ্বাস পর্যন্ত নিতে পারছিলেন না। মানুষজনের চাপে তাঁর নিশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসছিল। তিনি উঠে গেলেন জাহাজের একদম ওপরে। সেখানে গিয়ে কিছুটা স্বসিত্ম পেলেন। তাঁর শতরঞ্জিটি অন্তত পাতার একটা ব্যবস্থা হলো।
শতরঞ্জির ওপর একটা ফরাস পেতে ওটার ওপর আরাম করে বসতেই গঙ্গার হাওয়া এসে শরতের মনপ্রাণ দুটোই জুড়িয়ে দিতে লাগল। এক যাত্রী শরৎকে উদ্দেশ করে বললেন, – দাদা, যদি কিছু মনে না করেন আপনার পাতা ফরাসের ওপর আমি কি একটু বসতে পারি? পরে জাহাজ ছেড়ে দিলে না হয় অন্য কোথাও চলে যাব।
শরৎ ইশারায় লোকটিকে বসতে ইঙ্গিত করলেন তাঁর পাতা বিছানাটিতে।
– তা মশাই এটাই কি আপনার রেঙ্গুনে প্রথম যাত্রা? নাকি এর আগেও যাওয়া হয়েছে সেখানটায়। লোকটি জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে তাকালেন শরতের দিকে।
– না, এটাই আমার প্রথম যাত্রা। এর আগে কলকাতার বাইরেই যাওয়া হয়নি কখনো। কিছুটা আক্ষেপ মিশেল কণ্ঠে কথাগুলো বললেন শরৎচন্দ্র।
আলাপচারিতার এক পর্যায়ে লোকটির পরিচয় পাওয়া গেল। লোকটির নাম জয়ন্ত মলিস্নক। থাকেন ব্যারাকপুরে। রেঙ্গুনে তাঁর কাঠের ব্যবসা, যার পোশাকি নাম টিম্বার মার্চেন্ট আর তিনি ব্যবসার কাঠ সংগ্রহ করেন বার্মা থেকে এবং সেগুলো নিয়ে বিক্রি করেন চট্টগ্রাম, বান্দরবান ও টেকনাফে।
জাহাজটি এর মধ্যে খিদিরপুর জাহাজঘাটা ত্যাগ করে শম্বুকগতিতে সামনের দিকে এগোতে শুরু করল। জাহাজে চড়ায় যাদের পূর্বের অভিজ্ঞতা আছে তাদের কাছ থেকে জানা গেল, গঙ্গা পেরিয়ে সাগরে পৌঁছলে জাহাজের গতি আরো কিছুটা বৃদ্ধি পাবে। গঙ্গার দুধারের প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলি অতিমনোরম। চলমান দৃশ্যাবলির দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকেন শরৎ। আর মনে মনে ভাবেন, এরকম দৃশ্যের সামনে বসে থাকলে দু-চারটি গল্প-উপন্যাস লিখে শেষ করা যায় এক বসায়।
জয়ন্ত মলিস্নক লোকটি বেশ হাসিখুশি ও মিশুক ধরনের। কিছু জিজ্ঞেস না করলেও গড়গড়িয়ে একটানা লম্বা সময় ধরে কথা বলে যান। মনে হয় যেন গল্প বলার মেশিন। তাঁর কাছ থেকে শরৎ জানতে পারলেন, যাত্রীদের মধ্যে এমন কতক লোক আছেন, যাঁরা ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে প্রায়ই জাহাজে যাওয়া-আসা করে থাকেন। আবার যে-কোনো উপায়ে একটি চাকরি জুটিয়ে ভাগ্যটি ফেরানোই কিছু লোকের মুখ্য উদ্দেশ্য। শরৎ একটি বিষয় জেনে বেশ খানিকটা আশ্চর্যান্বিত হলেন যে, কেউ কেউ আবার হিন্দুসমাজের গোঁড়ামি ও অনুশাসনের ভয়ে, ভাব-ভালোবাসার লোকের সঙ্গে পালিয়ে যাচ্ছে বার্মায়। যে-কোনো মূল্যেই হোক তাদের ভালোবাসাটিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে যে।
জাহাজের ডেকের ওপর দাঁড়িয়ে শরৎ বুকভরে নিশ্বাস নেন আর সঙ্গে দুচোখ ভরে দুপাশের অপার্থিব প্রাকৃতিক অপরূপ নৈসর্গিক দৃশ্যের স্বাদ আস্বাদন করেন। জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে নিজেকে মনে হয় মনসামঙ্গলের চাঁদ সওদাগর কিংবা চ-ীমঙ্গলের ধনপতির মতো। মধুকর, দুর্গাবর, শঙ্খচূড়, চন্দ্রপাল, ছোটমুঠি, গুয়ারেখি ও নাটশাল – সপ্তডিঙা সাজিয়ে যেন সিংহলের উদ্দেশে নয়, তিনি যাত্রা করেছেন রেঙ্গুনের পথে।
সাগরের মধ্য দিয়ে দিনতিনেক চলল তাঁদের জাহাজটি। কটকটে রোদের প্রখর সূর্যের তাপ ও সমুদ্রের নোনাজলের আর্দ্রতায় শরতের শরীরখানা ঘেমে-নেয়ে একেবারে একাকার। তাঁর নির্ধারিত বিছানা থেকে উঠে একটু হাওয়া খেতে জাহাজের ডেকের ওপর যেতেই তাঁর নজরে পড়ল, আকাশের এক কোণে কৃষ্ণবর্ণের একটুকরো মেঘ, সেই অল্প একটু মেঘ কলেরা রোগের মহামারির মতো পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ হয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ল আকাশজুড়ে।
প্রথমে অল্প অল্প বৃষ্টি তারপর বাতাসের বেগ যেন ক্রমেই বাড়তে লাগল, সঙ্গে বৃষ্টির তোড়ও কোনো অংশে কম নয়। মুষলধারে বৃষ্টি, জোর হাওয়া, গভীর অন্ধকার তার সঙ্গে সমুদ্রের পর্বতসম ঢেউ – সঙ্গে জাহাজের ক্রমাগত দুলুনি। ভয়ঙ্কর সেই সামুদ্রিক হাওয়ার ঝাপটায় বাঁচাটাই দায় হয়ে দাঁড়াল। বিশালাকৃতির ঢেউগুলো জাহাজটিকে যেন গিলে খেতে চাচ্ছে। পুরোপুরি গিলতে না পারলেও দুপায়ের তলায় সবকিছু পিষে ও থেঁতলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এই বিশাল জলরাশির ওপর। সুপেয় জলেভরা কাঠের পিপেগুলো রাখা ছিল ডেকের একপাশে। জাহাজের দুলুনিতে সেগুলো গড়াগড়ি খেতে লাগল একপাশ থেকে অন্যপাশে। শুধু কি জলের পিপে, হাঁস-মুরগির খাঁচাগুলো কিংবা বিভিন্ন জীবজন্তু, পশুপাখিগুলোও একবারে গড়িয়ে যাচ্ছে একপাশে, এরপর আবার অন্যপাশে। ঝড়জলের সঙ্গে পালস্না দিয়ে চলছিল মানুষজনের আর্তচিৎকার, অনেকেই বমি করে ভাসিয়ে দিচ্ছিল জাহাজটির অঙ্গন।
শরতের একপ্রকার মূর্ছা যাওয়ার মতো অবস্থা। বৃক্ষের শাখা-প্রশাখার মতো সমস্ত আকাশ ব্যাপৃত করে বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় শরৎ স্পষ্ট দেখতে পেলেন এক অসীম আকৃতির কুৎসিত ভয়ঙ্কর দৈত্য যেন দাঁত বের করে হাসছে। আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে জাহাজটিকে আস্ত গিলে খাওয়ার জন্য। এই দৃশ্য দেখার সঙ্গে সঙ্গে শরৎ সংজ্ঞাহীন হয়ে লুটিয়ে পড়লেন জাহাজের এককোণে।
সকালের নতুন সূর্যের নরম আলো শরতের চোখে এসে পড়ল ঠিকই, কিন্তু সে-আলো ঘুম ভাঙার জন্য যথেষ্ট ছিল না। শরৎচন্দ্রের ঘুম ভাঙল জয়ন্ত মলিস্নকের ডাকে –
– এই যে মশাই এবার চোখদুটো দয়া করে খুলুন। আর ভয় নেই। সমস্ত দুর্যোগ কেটে গেছে। আমাদের জাহাজখানা বঙ্গোপসাগর পার হয়ে ইতোমধ্যে ইরাবতী নদীতে ঢুকে পড়েছে। আর মাত্র ২৮ মাইল পাড়ি দিলেই রেঙ্গুন শহর। সবকিছু গুছিয়ে তৈরি হয়ে নিন।
শরৎ চোখদুটো খুলতেই দেখলেন জাহাজের আর্দালি ও মেথরগুলো গতকালের বমি ও আবর্জনা পরিষ্কার করতে লেগে গেছে। তৎক্ষণাৎ শরতের মনে পড়ে গেল গতরাতের ভয়াবহ তা-বের দৃশ্য। অপরাহ্ণের দিকে জাহাজখানা রেঙ্গুনে এসে পৌঁছাল। ইরাবতী নদীর এই চতুষ্কোণ জায়গার একদিকে রেঙ্গুন শহর, অন্যদিকে চৌটাঙ্, আবার একপারে সিরিয়াম ও টঞ্জিন, অন্যপারে ডালা। দূর থেকে রেঙ্গুন শহরটি দেখার জন্য শরৎ জাহাজটির একেবারে ওপরের ছাদে উঠে গেল। কোন ফাঁকে জয়ন্ত মলিস্নক পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন শরৎ সেটি খেয়াল করেননি।
জয়ন্ত মলিস্নক শরৎকে উদ্দেশ করে বললেন – বুঝেছেন ভায়া, ওই যে দূর থেকে টঞ্জিন দেখতে পাচ্ছেন ওখানে বার্মা, অয়েল কোম্পানির কেরোসিন তেল, পেট্রল ও মোমবাতির কারখানা, চৌটাঙয়েও রয়েছে বার্মা অয়েল কোম্পানির ছোট কারখানা, ডালাতে রয়েছে বোম্বে-বার্মা ট্রেডিং কোম্পানির প্রকা- কাঠের কারখানা এবং এর পাশেই ইরাবতী-ফ্রাটিলা কোম্পানির জাহাজ তৈরির ও মেরামতের প্রকা- শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে।
অকস্মাৎ জাহাজের খালাসিরা ডেকের যাত্রীদের শুনিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগল – রঙ্গম শহর, রঙ্গম শহর, সবাই বিছানাপত্র গুটিয়ে উঠে পড়। করনটিনে যেতে হবে, করনটিন না করে কেউ শহরে ঢুকতে পারবে না।
খালাসিদের চিৎকার-চেঁচামেচিতে যাত্রীদের মধ্যে কার আগে কে নামবে এই নিয়ে হুটোপুটি লেগে গেল। জাহাজের খালাসিদের সম্ভবত শিক্ষাজ্ঞান নেই বলে তারা ইংরেজি ক্যোয়রান্টিন শব্দটিকে ভুল উচ্চারণে করনটিন উচ্চারণ করছে। কোনো বন্দরে সংক্রামক ব্যাধি দেখা দিলে সেই বন্দর থেকে অন্য বন্দরে গেলে বন্দরের জাহাজ ভেড়ার আগে জাহাজ বন্দর থেকে কিছুটা দূরে একটা জায়গায় কয়েক দিনের জন্য আটক থাকতে হয়। কারণ যদি পেস্নগ নামক রোগটির জীবাণু কারো শরীরে প্রবেশ করে থাকে তবে ততোদিনে সেটি ধরা পড়বে। সতর্কতামূলক এই আটক থাকার সময়টাকেই বলে ক্যোয়রান্টিন।
শরৎ খালাসিদের উদ্দেশ করে বললেন – আমার করনটিনে থাকার কোনো দরকার নেই। আমি কলকাতায় জাহাজে ওঠার পূর্বেই ডাক্তার দিয়ে পরীক্ষা করিয়েছি। আমার শরীরে পেস্নগের কোনো জীবাণু নেই।
একজন খালাসি শরৎকে ধমক দিয়ে বলল, একটি কথাও নয়। তাড়াতাড়ি করনটিনে চলে যান।
করনটিন না করে কিছুতেই রেঙ্গুনে ঢুকতে পারবে না। পেস্নগের মহামারির ভয়াবহতায় বার্মা সরকার খুবই সজাগ। শহর থেকে আট মাইল দূরে কাঁটাবেড়া দিয়ে অনেক ছোট ছোট কুঁড়েঘরের মতো কিছু একটা তৈরি করা হয়েছে, সেখানেই থাকতে হবে শরৎ এবং জাহাজের অন্য যাত্রীদের নিজের গাঁটের টাকা খরচ করে, নিজেকে রান্না করে খেতে হচ্ছে।
করনটিন নামক এই স্থানটি খুবই অস্বাস্থ্যকর। জায়গাটি যতসব রাজ্যের গরিব ও হতদরিদ্রে ভরা। কিছু সুস্থ লোকজন এখানে এসে অসুস্থ হয়ে পড়ল। আরেকটি চরম সত্য, এখানে এসে শরতের উপলব্ধি হলো, সেটি হচ্ছে, রাজ্যের সমস্ত আইন গরিব মানুষদের জন্য। এই যে জাহাজটিতে এতোগুলো যাত্রী ছিল, সব উঁচু শ্রেণির যাত্রী কীভাবে যেন করনটিন নামক আইনটিকে ডিঙিয়ে চলে গেল রেঙ্গুনে। তাদের এক মুহূর্তও ওই নরকে কাটাতে হলো না। অবশ্য শহরে কারো কোনো পরিচিত লোক থাকলে নানা কৌশলে বেরিয়ে আসা যেত ওখান থেকে। রেঙ্গুনে শরৎচন্দ্রের আত্মীয় ছিল ঠিকই, শুধু কৌশলটিই জানা ছিল না। পকেট থেকে দু-চার কড়ি খরচ করলে ওসব করনটিন-ফরনটিন কিছুই করতে হতো না। শরৎ সেটি বুঝতে পেরেছে ঠিকই কিন্তু অনেক পরে।
অন্যদিকে জাহাজে উপযাচক হয়ে যে-মানুষটি শরতের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন সেই ধনাঢ্য টিম্বার মার্চেন্ট জয়ন্ত মলিস্নকও তাঁকে এড়িয়ে তাঁর অলক্ষক্ষ সন্তর্পণে রেঙ্গুনে চলে গেছেন।
সাতদিন কাটিয়ে অবশেষে করনটিন থেকে মুক্ত হলেন শরৎ। অবশ্য এর চেয়ে বেশিদিন শরৎকে আটকে রাখার উপায়ও ছিল না। কারণ, এই সাতদিনে তাঁর পকেট একেবারে শূন্য, যাকে বলে একদম ফাঁকা গড়ের মাঠ। করনটিন কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়েই তাঁকে ওখান থেকে ছেড়ে দিয়েছে। শরৎ কপর্দকশূন্য তাই রাসত্মা দিয়ে হাঁটা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। জীবনের এই প্রথম শরৎ কলকাতার বাইরে এসেছেন। তাও আবার সেই সুদূর রেঙ্গুনে। কলকাতা থেকে পালিয়ে বাঁচলেও জীবন থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারছেন না তিনি। কলকাতা থেকে পালিয়ে শরতের রেঙ্গুনে আসার আরেকটি কারণ হচ্ছে, রেঙ্গুনে তাঁর এক মেসোমশাই থাকেন, ছোটবেলায় যিনি শরৎকে বেশ স্নেহ করতেন। বর্তমানে তিনি রেঙ্গুনের একজন ডাকসাইটে অ্যাডভোকেট – নাম অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়। শরতের গন্তব্য এখন সেখানেই।
শরৎ রাসত্মা দিয়ে হাঁটছিলেন আর মন্ত্রমুগ্ধের মতো সবকিছু অবলোকন করছিলেন। মার্কোপোলো, হিউয়েং সাং কিংবা ইবনে বতুতার মতো কোনো পরিব্রাজকের দৃষ্টি দিয়ে। শরৎ মনে মনে কলকাতা ও রেঙ্গুনের মধ্যে একটি সাযুজ্য খোঁজার চেষ্টা করছেন। কিন্তু রেঙ্গুনের রাসত্মাগুলো কলকাতার রাসত্মা অপেক্ষা বেশ সোজা ও চওড়া, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। বাড়িগুলোও একেবারে তকতকে। যেটি কলকাতায় অনুপস্থিত। অন্যদিকে রাসত্মাঘাটে মাদ্রাজি, পাঞ্জাবি, গুজরাটি যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে; তার মধ্যে হঠাৎ কোথাও যখন রঙিন রেশনের কাপড় পরা ব্রহ্মদেশের পুরুষ বা নারী দেখতে পাওয়া যায় তখন মনে হয়, এরাই বুঝি বিদেশি।
শরৎ হাঁটতে হাঁটতে একটি বড় বাজারের কাছে চলে এলেন। বাজারিরা নানারকম পসরা সাজিয়ে বসেছে। ফল-ফুল, বাতি ও পূজার অর্ঘ্য বিক্রি চলছে। যারা বেচাকেনা করছে তাদের অধিকাংশই ব্রহ্মদেশীয় নারী।
এসব দেখে শরতের মনে হলো, এখানকার পুরুষেরা নিশ্চয়ই অলস ও আরামপ্রিয়, অন্য দেশের পুরুষদের কাজ প্রায় সমস্তই এখানে মেয়েরা করে থাকে। মুসলমান দোকানদারেরা বিলেতি মনিহারি দোকান খুলে বসে গেছে। একটি বিষয় দেখে শরৎ বেশ অবাক হলেন। এতকিছুর মধ্যেও কোনো হইচই নেই। নেই কোনো বিশৃঙ্খলা কিংবা হট্টগোল। চারধার স্তব্ধ নয়, কিন্তু শান্ত। শরৎ মনে মনে ভাবলেন, এটি নিশ্চয়ই বৌদ্ধধর্মের প্রভাব ছাড়া আর কিছুই নয়। এই ধর্মই তাদের নিভৃত, মৌন, শান্ত হতে শিখিয়েছে।
উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে হাঁটতে শরৎ খানিকটা ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত হয়ে পড়লেন। প্রচ- ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় তাঁর জীবনাত্মা শরীর থেকে যেন বেরিয়ে যেতে চাচ্ছে অথচ পকেটে একটি ফুটো কড়ি পর্যন্ত নেই। বিনে পয়সায় কে খাওয়াবে তাঁকে? বাঙালি ভেবে এক পথচারীকে থামিয়ে শরৎ জিজ্ঞেস করলেন, এই যে মশাই, আপনি কি বাঙালি? প্রতিউত্তরে লোকটি জানালেন যে, তিনি বাঙালি তবে বাড়ি কলকাতা নয়, চান্দগাঁও। রেঙ্গুনে ব্যবসা করেন। শরৎ তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, এখানে কোনো বাঙালি হোটেল পাওয়া যাবে কিনা? পূর্ববাংলার চান্দগাঁও থেকে আসা ভদ্রলোকটি শরৎকে জানালেন যে, কিছুদূর হেঁটে গিয়ে ডানে মোড় নিলেই একটি বাঙালি হোটেল পাওয়া যাবে – নাম ‘দাদাঠাকুরের হোটেল’। সেখানে শরৎ অবশ্যই বাঙালি খাবার পেতে পারেন।
বিগত সাত-আট দিন পর্যপ্ত না খেতে পেরে শরীরটা শীর্ণ ও তালপাতার সেপাইয়ের মতো দেখাচ্ছে। তিনি এমনিতেই দীর্ঘকায় মানুষ, শরীর থেকে কিছুটা মেদ ঝরে যাওয়ায় তাঁকে আরো কিছুটা লম্বাটে দেখাচ্ছে। অনেক কষ্টে নিজের দেহটিকে একপ্রকার টেনে নিয়ে উপস্থিত হলেন দাদাঠাকুরের হোটেলে। হোটেলটিতে এসে জানা গেল, এটি আসলে বাঙালি হোটেল নয়, এর মালিক একজন উড়িয়া ব্রাহ্মণ হলেও এখানে বাঙালি ব্যঞ্জনই বেশি রান্না হয় আর খদ্দেরদের মধ্যে অধিকাংশই বাঙালি। হোটেলের মালিক নরেন্দ্র মোদি শরতের ওপর বেশ দয়াপরবশ হলেন। বেশ কয়েক দিনের অভুক্ত শরৎকে প্রথমে নানারকম ব্যঞ্জন দিয়ে খাওয়ালেন। ভোজনপর্ব শেষ হলে হোটেলটির মালিক শরৎকে জিজ্ঞেস করলেন, তা আপনি রেঙ্গুনে কোথায় এসেছেন? ঠিকানা কিছু আছে সঙ্গে?
– ঠিকানা তো আমার জানা নেই। মেসোমশাই আমাকে বলেছিলেন তাঁকে নাকি রেঙ্গুনে সবাই একনামে চেনে। বললেই বাড়ি দেখিয়ে দেবে।
– তা আপনার মেসোমশাইয়ের নামটি জানতে পারি কি?
– আজ্ঞে, অ্যাডভোকেট শ্রীযুক্ত অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়।
- কী বলছেন মশাই? অঘোরবাবু আপনার মেসোমশাই? এটা আমাকে আগে বলেননি কেন? ওনাকে তো সবাই চেনে। রেঙ্গুনের মস্তবড় উকিল উনি। না চিনে উপায় আছে? আপনার মেসোমশাই দেখতে যেমন সুপুরুষ ঠিক তেমনি তাঁর ব্যক্তিত্ব। আর মনটিও বেশ খোলামেলা। তাঁর মতো এমন ধনী ও সম্মানিত ব্যক্তি রেঙ্গুনে খুব কমই আছেন। শ্রীযুক্ত অঘোরবাবু এসব হেঁজিপেঁজি জায়গাতে থাকেন না। উনি থাকেন অভিজাত এলাকা লুইস স্ট্রিটে। কীভাবে সেখানটায় যেতে হবে আমি আপনাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছি। চিন্তার কোনো কারণ নেই। আপনি অনায়াসে সেখানে পৌঁছে যাবেন আর অ্যাডভোকেট অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের নিবাস রেঙ্গুনের মোটামুটি সবারই জানা।
সূর্য তখন প্রায় মধ্যগগনে পৌঁছেছে। ৫৬/৫৬-এ লুইস স্ট্রিটের বাড়ির অলিন্দে বসে অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়, অস্কার ওয়াইল্ডের সদ্য প্রকাশিত ইম্পর্ট্যান্স অফ বিয়িং আর্নেস্ট নাটকটি পড়ছিলেন। এমন সময় উসকোখুসকো চুল, ছেঁড়া কামিজ, নোংরা জামাকাপড়, খালি পা, কাঁধে গামছাসমেত একজন ব্যক্তি সে-বাড়িতে প্রবেশ করলেন। অঘোরনাথবাবু লোকটিকে ভিখারি মনে করে জোরে চেঁচিয়ে তাঁকে তাড়িয়ে দিচ্ছিলেন। ভদ্রলোকটি এবার আর চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন এবং বললেন,
- মেসোমশাই আমি শরৎ, আমি কলকাতার শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। শরৎ দৌড়ে গিয়ে তাঁকে প্রণাম করলেন। অঘোরনাথ যারপরনাই আশ্চর্যান্বিত হলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, কীরে শরৎ, তুই কোথা থেকে এলি?
শরৎ চোখের জল মুছতে মুছতে বললেন, ওরা আমাকে করনটিনে আটকে রেখেছিল। অঘোরনাথ আরো অবাক হয়ে বললেন, তুই আমার নাম করতে পারলি নে? আমার নাম করে কত লোক পার হয়ে যায় আর তুই পড়ে রইলি করনটিনে? এ কী অবস্থা করেছিস তুই শরীরের?
- সাতদিন হাত পুড়িয়ে রেঁধে খেতে হয়েছে। এ পর্যন্ত যে বেঁচে আছি সেটিও ঈশ্বরের কৃপায়।
- তোরই বোকামি হয়েছে। আমার নাম করলেই কোনো কষ্ট পেতে হতো না, এমনকি আমার নাম করে রাসত্মার কাউকে বললেই তোকে এনে ঠিক বাড়ি পৌঁছিয়ে দিয়ে যেত।
অঘোরবাবু শরৎচন্দ্রকে সাদরেই গ্রহণ করে বাড়িতে আশ্রয় দিলেন। অঘোরবাবুর স্ত্রী অন্নপূর্ণা দেবীও তাঁর জ্যাঠাতুতো ভগ্নির পুত্রকে আদর-যত্ন করতে লাগলেন অকৃপণভাবে।
প্রতি শনিবার অঘোরবাবুর বাড়িতে খুব খাওয়া-দাওয়া ও গানবাজনার আসর বসে। রেঙ্গুন সমাজের সব ভদ্র ও সম্মানিত ব্যক্তিরা আসরে যোগ দিতে আসেন। অঘোরনাথের স্ত্রী সেখানকার আদব-কায়দায় অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। বাজারহাটও তিনি নিজেই করেন। জ্যাকেট, শেমিজ, জুতো-মোজাও পরতে শিখে গেছেন তিনি। এরকম একটা কেতাদুরস্ত সংসারে শরৎ যদিও অনাথের মতো গিয়ে পড়ল কিন্তু এ-সংসারে বাগলপুরের অবহেলা ও উপেক্ষা যেমন ছিল না, তেমনি ছিল না ভবানীপুরের অপমান ও উপদেশ। মেসো বললেন - সবার আগে তুই বর্মি ভাষাটা শিখে আইনের বইগুলো পড়া আরম্ভ করে দে। তারপর তো তুই আমার মতো উকিল হয়ে যাবি। এরই মধ্যে তোর একটা চাকরির ব্যবস্থাও আমি করে দেব। কিছুদিনের মধ্যে অঘোরনাথবাবু শরতের জন্য বার্মা রেলওয়ে অডিট অফিসে একটি চাকরি জুটিয়ে দিলেন।
অঘোরনাথবাবুর বাড়ির আরাম-আয়েশের জীবন শরতের ভাগ্যে বেশিদিন স্থায়ী হলো না। অঘোরনাথবাবু পক্ষাঘাতে কিছুদিন বিছানায় পড়ে রইলেন, তারপর একদিন আচানক হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে দেহত্যাগ করলেন।
শরতের মেসোমশাই অঘোরনাথবাবুর মৃত্যুর পর শরৎ সে-বাড়ি ত্যাগ করে গিয়ে উঠলেন ল্যান্সডাউন স্ট্রিটের একটি দোতলা বাড়িতে। দোতলার পূর্বকোণের একটি ছিমছাম সুন্দর ঘর ভাড়া নিলেন শরৎ। বার্মা রেলওয়ে অডিট অফিস ছুটি হয়ে যায় বিকেল পাঁচটা নাগাদ। অফিসশেষে শরৎ বেশিরভাগ দিন চলে যান বার্নার্ড ফ্রি লাইব্রেরিতে। সেখানে বসে শরৎ নিয়মিত তৃষ্ণার্ত গ্রন্থভুকের মতো বই পড়েন নিভৃতে। ইংরেজি সাহিত্য, সমাজনীতি, রাজনীতি ও দর্শন সম্পর্কীয় মোটা মোটা গ্রন্থ তিনি নিঃশেষ করেন এক নিমেষেই। চার্লস ডিকেন্সের উপন্যাস নিয়ে মেতে রইলেন কিছুদিন। অন্যদিকে জোলার উপন্যাস পড়তেও তাঁর বেশ ভালো লাগে। বিশেষ করে জোলার নানা উপন্যাসটি পড়ে শরৎ যে আত্মতৃপ্তি পেয়েছেন তা অনেক দিন অন্য কোনো উপন্যাসে পাননি। সবসময় শরৎচন্দ্র যে লাইব্রেরিতে বসে বই পড়েন তা কিন্তু না। মাঝেমধ্যে বই ধার করেও নিয়ে আসেন লাইব্রেরি থেকে। সেগুলো রাতে বুকে বালিশ চেপে পড়েন।
শরতের সিংহভাগ সময় বই পড়েই কাটে। যে-পরিমাণ পড়েন সেই তুলনায় লেখেন না কিছুই। লিখতে গেলেই যেন রাজ্যের আলস্য এসে ভর করে শরীরে। কলকাতা থাকতে বড়দিদি, কাশীনাথ, দেবদাসসহ আরো বেশ কয়েকটি উপন্যাস লিখে ইতোমধ্যে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছেন তিনি। দীর্ঘদিন ধরে তাঁর লেখায় ছেদ পড়েছে। শরৎ চরিত্রহীন উপন্যাসটি শুরু করেছিলেন সেই কবে কলকাতাতেই; কিন্তু এটি শেষ করতে পারলেন না এখন পর্যন্ত। মদের নেশাটিও এখন পর্যন্ত ছাড়তে পারেননি তিনি। মাঝেমধ্যেই দ্রাক্ষারসে মাতাল হয়ে ঘুমিয়ে কাটান দু-চার দিন।
শরৎ যে-বাড়িটিতে থাকেন তাঁর নিচতলাটি ভাড়া নিয়েছেন একজন মেকানিক বা কলকব্জার মিস্ত্রি। জাতিতে সে বাঙালি, চক্রবর্তী, ব্রাহ্মণ, বিপত্নীক। স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে বেশ কিছুকাল হবে। সংসারে একটিমাত্র বিবাহযোগ্য অনূঢ়া কন্যা ছাড়া আর কেউ নেই। কন্যাটির নাম শান্তিদেবী।
বেশ কয়েকদিন হলো শরৎ কিছুতেই বই পড়ায় মনোনিবেশ করতে পারছেন না। কারণটি আর কিছুই নয়, নিচতলার চক্রবর্তীবাবুর মদের নেশাটি যেন নতুন মাত্রা পেয়েছে। সন্ধ্যার পর হররোজ তিনি বোতলে বোতলে মদ গলাধঃকরণ করেন। তাঁর এই মদের আড্ডায় জুটেছে আরো কিছু নেশাখোর মাতাল, গেঁজেল কারিগর ও বদমাশের দল।
সূর্য ডোবার পরপরই তাঁরা বসে যান মদ, সিগারেট ও তাস নিয়ে। অনেক রাত পর্যন্ত চলে তাঁদের এই পানাহার ও হুলেস্নাড়। এসব হট্টগোলে শরতের বই পড়ায় কিংবা গল্প লেখায় দারুণ ব্যাঘাত ঘটে।
শরতের মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয় এক লাথি দিয়ে এই আড্ডাটিকে মাটিতে লুটিয়ে দিতে। তিনি নিজেও সোমরসে আসক্ত কিন্তু মাতাল হয়ে হলস্না করা তাঁর চরিত্রবিরোধী। চক্রবর্তীর মেয়ে শান্তিদেবীকে খাটতে হয় এসব পাষ–র নানারকম ফাইফরমাশ। মদের গেলাস ধুয়ে দেওয়া, মুড়ি ভেজে আনা। এছাড়া চক্রবর্তীকে রেঁধে খাওয়ানো, বাসন মাজা প্রভৃতি কাজ তো রয়েছেই।
শরৎ মাঝে মাঝে একটি বিষয় চিন্তা করতেই শরীরের লোমগুলোতে শিহরণ খেলে যায়, একজন পিতা তাঁর এমন রাজকন্যার মতো দেখতে মেয়েকে দিয়ে কীভাবে এমন জঘন্য কাজ করান? শরৎচন্দ্র দূর থেকে আড়চোখে মেয়েটিকে যে দেখেননি, তা কিন্তু নয়। ভারি মিষ্টি চেহারা, গায়ের রং উজ্জ্বল গৌরবর্ণ। শরীরে এতটুকু মেদ নেই। মেদহীন নির্ঝর শরীরের প্রতিটি অঙ্গই সুস্পষ্ট ও আকর্ষণীয়। তবে মেয়েটির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নিজেকে সে সবসময় বেশ পরিপাটি করে গুছিয়ে-গাছিয়ে রাখতে ভালোবাসে। শরৎ একদিন বার্নার্ড ফ্রি লাইব্রেরিতে বসে মনোযোগ দিয়ে একটি বই পড়ছিলেন। বইটি পড়তে পড়তে কখন যে অনেক রাত হয়ে গেছে সেটি তিনি খেয়ালই করেননি। যে-কোনো মজার বইয়ের মধ্যে একবার ঢুকে গেলে যে তাঁর দিনদুনিয়ার খবর থাকে না, এটি তাঁর নতুন কোনো অভ্যেস নয়। একবার তিনি পেগু নামক একটি জায়গা থেকে রেঙ্গুনে আসার পথে একটি বইয়ের ভেতর এমনভাবে ঢুকে গিয়েছিলেন যে, তিনি রেঙ্গুন না পৌঁছে লাংগলাবিনে গিয়ে পৌঁছেছিলেন। শরতের বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল। তিনি দোতলায় উঠে তাঁর ঘরের দরজা খোলার চেষ্টা করতেই টের পেলেন দরজাটি ভেতর থেকে বন্ধ। কে তাঁর ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে কপাট লাগিয়ে দিয়েছে? চোর নয় তো? শরৎ কিঞ্চিৎ চিন্তা করলেন, নাহ, তাঁর ঘরে কিছু বই ও পুরনো জামাকাপড় ছাড়া চুরি করার মতো কোনো দ্রব্যই নেই।
শরৎ দরজায় জোরে ধাক্কা দিয়ে খুলে দেওয়ার জন্য ডাকতে লাগলেন। বেশ খানিকক্ষণ ডাকাডাকির পর দরজা খুলে ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো চক্রবর্তীর মেয়ে শান্তিদেবী। তখনো তাঁর সর্বাঙ্গ কাঁপছে থরথর করে। তাঁর দুচোখ ভেসে যাচ্ছে অশ্রুজলে। শান্তিদেবী দরজা খুলে দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল শরতের বুকে – শরৎবাবু আমাকে বাঁচান, দয়া করে আমাকে রক্ষক্ষ করুন ওই মনুষ্যরূপী হায়েনার হাত থেকে।
শরৎচন্দ্র আচানক এমন একটি দৃশ্যের জন্য মোটেই প্রস্ত্তত ছিলেন না। তিনি বিস্ময়াভিভূত কণ্ঠে শান্তিদেবীকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন যে, চক্রবর্তী তাঁর এক বন্ধু, যিনি ইতোমধ্যে একজন পাকা বদমাশ ও মাতাল হিসেবে সমাজে খ্যাতি অর্জন করেছেন, সেই ঘোষাল বুড়োর সঙ্গে মেয়েটির বিবাহ দিতে প্রতিশ্রুত হয়েছেন। আর মেয়েটিকে বিয়ে দেওয়ার কথা বলে চক্রবর্তী বুড়ো ঘোষালের কাছ থেকে কিছু মালকড়িও ইতোমধ্যে হাতিয়ে নিয়েছেন। আজ নেশার ঝোঁকে সেই লম্পট বুড়ো শান্তিদেবীকে নিজের পত্নী বলে দাবি করে অন্দরের মধ্যে তেড়ে এসেছিল। মেয়েটি ভয়ে পালিয়ে এসে শরতের ঘরে প্রবেশ করে ভেতর থেকে কপাট এঁটে আত্মরক্ষা করেছে। কিন্তু এমন করে আর কতদিন তিনি নিজেকে বাঁচিয়ে চলবেন? মেয়েটি নিজেকে যেভাবে শরতের বুকে সঁপে দিয়েছেন তাতে শরতের সমস্ত শরীরে এক প্রকার হিরণ খেলে গেল। জীবনে আজ পর্যন্ত কোনো নারীই তাঁর কাছে এভাবে আত্মসমর্পণ করেনি। এই পরিস্থিতিতে শরৎ কী করবেন, ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। ইতোমধ্যে মেয়েটি শরতের বুক থেকে আস্তে আস্তে নেমে এলেন নিচে এবং শরতের পায়ে লুটিয়ে পড়লেন। আপনি আমাকে রক্ষক্ষ করুন বাবু।
শরৎচন্দ্র শান্তিদেবীকে সে-রাতের মতো নিজের ঘরে নিশ্চিন্তমনে ঘুমোতে বলে নিজে চলে গেলেন তাঁর বন্ধু জীতেন্দ্রনাথ সরকারের বাড়িতে। মেয়েটিকে উদ্দেশ করে আরো বলেন, তুমি কোনো প্রকার ভয় করো না মেয়ে। কাল সকালে ফিরে এসে এর বিহিত আমি অবশ্যই করব।
শরৎ তাঁর বন্ধু সরকারের বাড়িতে ঘুমোতে গেলেন কিন্তু বিনিদ্র রজনী কাটাতে হলো তাঁকে। এক ফোঁটা ঘুম হলো না রাতজুড়ে। পরের দিন খুব ভোরেই চক্রবর্তীকে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন শরৎ। তাঁর মেয়েটি কোথায়, তাঁর কাছে জানতে চাইলেন। চক্রবর্তী নির্বিকার ভঙ্গিতে শরতের দিকে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তাঁর টালমাটাল অবস্থা। দেখে মনে হয় যেন রাতের নেশা এখনো কাটেনি। এরপর চক্রবর্তীর ওপর চলল শরতের বাক্যবাণের আক্রমণ।
শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীকে উদ্দেশ করে বললেন, আপনি পিতা হওয়ার যোগ্য ব্যক্তি নন এবং চক্রবর্তী যে একটি জানোয়ারের চেয়েও অধম সে-কথাও বলতে ছাড়লেন না তিনি। নেশায় পুরোপুরি মাতাল ছিলেন না বলে পুরোটা সময় ধরে মাথা নিচু করে শরতের সব কথা হজম করা ছাড়া চক্রবর্তীর আর কোনো উপায় ছিল না।
শরতের বাক্যবাণ শেষ হওয়ার পর এই প্রথম চক্রবর্তী মাথা তুলে শরতের দিকে তাকালেন। চক্রবর্তী বললেন – মেয়েটি আমার ঋতুময়ী হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে, তাঁকে কি বিয়ে দিতে হবে না? আমি গরিব মানুষ, এই বিদেশে ঘোষালের চেয়ে ভালো পাত্র আর কোথায় পাব? ঘোষালবাবুর টাকা আছে, এই ভেবে রাজি হলাম যে, ছুঁড়িটা অন্তত ভাত-কাপড়ের কষ্টটুকু তো পাবে না। ঘোষাল একটু নেশা-ভাং করে – সে তো আমিও করি। আর যদি বয়সের কথা বলো বাবু, ব্যাটা ছেলের আবার বয়স কী?
শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করতে লাগলেন – দেখুন চক্রবর্তী মশাই, ঘোষালবাবুর বয়সের সঙ্গে আপনার মেয়ের বয়সের ঢের তফাত। ঘোষালবাবুর বয়স নিদেনপক্ষে
পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন। আর আপনার মেয়ের বয়স সর্বসাকল্যে পনেরো কিংবা ষোলোর বেশি হবে না। ঘোষালবাবু যেভাবে নেশা-ভাং করে তাতে সে যে-কোনো সময়ে ইহলোক ত্যাগ করতে পারে। তখন আপনার কন্যাটি যে অকালেই বিধবা হয়ে যাবে। আপনি ঘোষালবাবুর কাছ থেকে যে-কয়টি টাকা ধার করেছেন আমি তা শোধ করে দিচ্ছি। আপনি তবু মেয়েটিকে ঘোষালবাবুর হাতে তুলে দেবেন না।
চক্রবর্তী এবার তাঁর মুখাবয়ব কিছুটা শক্ত করে বললেন, এতই যদি তোমার প্রাণে দয়ামায়া বাবু, তবে তুমিই কেন এই অভাগী গরিব বামুনের মেয়েটিকে নিয়ে আমার জাতকুল রক্ষা করো না?
এমন একটি প্রসত্মাবে স্তম্ভিত হয়ে পড়লেন শরৎচন্দ্র। বেশকিছু সময় মুখে কোনো কথা ফুটল না তাঁর। নীরবতা ভঙ্গ করে চক্রবর্তীই প্রথম কথা বললেন – বাবু, ঘরে বসে যতই বই পড়ো আর বিদ্যে ফলাও, বাস্তবচিত্র বড়ই কঠিন। মুখে বড় বড় কথা বলা সহজ কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এর ফল উলটোরূপ। সেজন্যই বলছি বাবু। তোমার ওই বইগুলোতে যতই সুন্দর সুন্দর কথা লেখা থাকুক না কেন, ওগুলোর দু-চার আনাও দাম নেই। বাস্তবচিত্র হচ্ছে, আমাদের মতো গরিব মানুষের জন্য ঘোষালবাবু ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। কথাগুলো বলে চক্রবর্তী তাঁর আঙুলে কয়লা লাগিয়ে দাঁত মাজন করতে করতে কুয়োতলার দিকে যাচ্ছিলেন।
শরৎচন্দ্র এবার চক্রবর্তীকে উদ্দেশ করে বললেন, চক্রবর্তী মশাই, আমি আপনার মেয়ের দায়িত্ব নিতে রাজি আছি। আপনি শুভ দিনক্ষণ দেখে বিয়ের ব্যবস্থা করুন। চক্রবর্তী পেছন ফিরে শরতের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন – শুভস্য শীঘ্রম।
শরৎ ঋতুর এক মেঘলা বিকেলে শরৎচন্দ্র বসে আছেন রেঙ্গুনের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া স্রোতস্বিনী হেলিং নদীর তটে। হেলিং নদীটিকে বর্মিরা আদর করে রেঙ্গুন নদী বলেও ডাকে। নদীতটের বিসত্মীর্ণ এলাকায় যতদূর দৃষ্টি যায় সাদা-শুভ্র কাশফুলে পরিপূর্ণ। দিগমেত্মর শেষপ্রামেত্ম আকাশটি যেখানে শেষ হয়ে গেছে, সেখানে সাদা সাদা তুলোর মতো পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ ও আদিগন্ত কাশফুলের বন একসঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
প্রকৃতিতে আজ যেন সাদা রঙের মহোৎসব চলছে। মাঝে মাঝে বাতাসের দমকা হাওয়া কাশবনটির ওপর দিয়ে যখন বয়ে যায়, বনটি তখন ছোট্ট খুকুর মতো নেচে নেচে ওঠে। এসব দৃশ্য দেখতে শরতের আজ ভারি মজা হচ্ছিল। এমন সময় পেছন থেকে কে যেন ডাকল তাঁকে উদ্দেশ করে। শরৎ পেছনে ফিরে তাকাতেই দেখলেন চক্রবর্তীর মেকানিক দোকানের ভৃত্য নগেন তাঁকে ডাকছে – দাদা, বিয়ের জোগাড়যন্ত্র সব প্রস্ত্তত। আপনি একটু দয়া করে বাড়ি এসে নিজেকে তৈরি করে নিলেই বিয়ের কাজটি সম্পন্ন হয়। অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শরতের সেই বিকেলে শান্তিদেবীর সঙ্গে বিয়ে সম্পন্ন হলো। যেহেতু হিন্দুধর্মে বিয়ের প্রথম রাতটি কালরাত সেহেতু সে-রাতে স্বামী-স্ত্রীর মিলন অসম্ভব। তাঁরা সে-রাতটি গল্প-গুজব করে কাটাবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। শান্তিদেবী শরৎকে উদ্দেশ করে বলল – হ্যাঁগো, আপনি সত্যি করে বলুন তো আপনি আমাকে কখনো বিয়ের আগে ভালো করে দেখেছিলেন কি না?
শরৎ স্মিত হেসে উত্তর দিলেন, আমি একজন পুরুষ মানুষ, তুমি কী করে ভাবলে তোমাকে আমি ভালো করে না দেখেই বিয়ের পিঁড়িতে বসে যাব। এতটা বোকা ও মূর্খ আমি নই। তোমাকে বলি শোন – বেশ কয়েক মাস আগে, বারটি সম্ভবত শনিবার হবে। সাপ্তাহিক ছুটির কারণে অফিসে যাওয়া হয়নি। দোতলার অলিন্দে একটি চেয়ার পেতে কী যেন একটি বই পড়ছিলাম। এমন সময় হঠাৎ তোমার পদধ্বনিতে আমার একাগ্রতা ভঙ্গ হলো। মুখ তুলে তাকাতেই দেখলাম তুমি সম্ভবত সদ্যস্নান সেরে সিক্ত বসনে মন্দিরে পুজো দিয়ে ফিরছো। তোমার বুকের কাছে ধরা একটি পিতলের থালায় কিছু পুজোর অর্ঘ্য। দূর থেকে তোমার শরীরের গড়নটি আমার কাছে বীণার মতো লাবণ্যময় মনে হলো। সোনার রঙের মতো ত্বকটি তোমার সাদা, মিহি, সূক্ষ্ম ভেজা কাপড় ভেদ করে ঝলক দিচ্ছিল। তুমি কানে পরেছিলে চম্পক ফুল; ভাগ্যিস ফুলটি তোমার বাম কানে ছিল বলে রক্ষক্ষ। ফুলটি ডান কানে থাকলে আমি নির্ঘাত ধরে নিতুম তোমার হৃদয়টি তুমি ইতোমধ্যে কাউকে দিয়ে দিয়েছ।
– ধুত্তুরি ছাই! কী সব আবোল-তাবোল বকছেন? আমি কি এতকিছু ভেবেচিমেত্ম কানে ফুল পরেছিলাম নাকি? আমার ইচ্ছা হয়েছিল বলে ফুল পরেছিলাম।
– শোন তাহলে। মধ্যযুগে পাশ্চাত্যের মেয়েরা যখন ঋতুময়ী হয়ে বিবাহসম্ভবা হতো তখন তারা কোনো উৎসব কিংবা পালা-পার্বণে কানে ফুল পরে উৎসবে যোগ দিত। কোনো মেয়ে যদি বাম কানে ফুল পরত তবে ধরে নেওয়া হতো যে, সে ভালোবাসার মানুষ খুঁজছে। আর যেসব মেয়ে ডান কানে ফুল পরেছে তাদের ধরে নেওয়া হতো যে, ইতোমধ্যে তাদের হৃদয়টি অন্য কোনো পুরুষকে দিয়ে দিয়েছে। দূর থেকে তোমার ওই রূপের আভা আমি এই প্রথম দেখলাম। এতোদিন ধরে এই বাড়িতে আছি কিন্তু তোমাকে এমন নিখুঁতভাবে দেখার সুযোগ আমার আগে কখনো ঘটেনি। মনে হলো, এই তো আমার স্বপ্নের রাজকন্যা। কিন্তু আমার আচরণে বা চাহনিতে আমি কখনোই তোমাকে সেটি বুঝতে দিইনি।
শান্তিদেবী এবার শরতের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার চোখের দিকে চেয়ে বলুন তো আপনাকে আমি কতটুকু ভালোবাসি?
শরৎ ঈষৎ হেসে বললেন, তোমার চোখের দিকে আমি আগেই তাকিয়ে দেখে যাচাই করে নিয়েছি যে, তুমি আমাকে অনেক ভালোবাস।
– চোখে কি ভালোবাসার পরিমাণ লেখা থাকে নাকি?
– তা লেখা থাকে বইকি?
– কীভাবে বলুন তো?
– তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে তীক্ষন দৃষ্টি দিয়ে দেখলাম তোমার চোখের মণি দুটো স্বাভাবিকের চেয়ে ঈষৎ বড় দেখাচ্ছে। যখন কেউ কাউকে সত্যিকারের ভালোবাসে তখন চোখের মণি সম্প্রসারিত হয়। প্রাচীনকালে ইতালিতে মেয়েরা তাদের প্রেমিকদের কাছে নিজেকে সুন্দর দেখাতে ও প্রগাঢ় ভালোবাসা প্রতীয়মান করতে বেলাডোনা নামক এক গাছের রস দুচোখের মধ্যে ঢেলে দিত। গাছটির রস এতোটাই বিষাক্ত থাকত যে, ওই যুবতীটি হয়তো কিছু সময়ের জন্য সবকিছু ঝাপসা দেখছে। হয়ত কিছু সময় তার প্রাণপ্রিয় প্রেমিককে ভালো করে দেখারই সুযোগ পেত না। কিন্তু তার পরেও নিজেকে বিশ্বস্ত ও সুন্দরী প্রমাণ করতে এহেন কর্ম করতে তারা কুণ্ঠাবোধ করত না। কিন্তু তোমার চোখের মণি দুটো কোনো প্রকার বেলাডোনার রস ছাড়াই বেশ সপ্রতিভ ও সম্প্রসারিত। তাই আমার আর বুঝতে বাকি নেই যে, আমার প্রতি তোমার ভালোবাসাটুকু অপার্থিব ও খাদহীন।
শরৎচন্দ্র অচিরেই তাঁর নববধূটিকে নিয়ে যেন সুখের সাগরে ভাসলেন। শান্তিদেবীকে ছাড়া তাঁর একদ-ও চলে না। তিনি ক্রমেই স্ত্রীর প্রতি বড় অনুরক্ত হয়ে পড়লেন। তাঁর সুহৃদ বন্ধুরা শরৎকে এজন্য তাঁর অগোচরে তাঁকে মহাস্ত্রৈণ বলে উপহাস করতেন। কিন্তু তাতে শরতের এতোটুকু ভ্রূক্ষেপ নেই। রেঙ্গুনে এসে শরৎ এককালে ভালো রান্না শিখেছিলেন। বিয়ের পর তাঁর সেই সুপ্ত প্রতিভা যেন পুনরায় বিকশিত হতে লাগল। প্রায়ই তিনি তাঁর নবপরিণীতা ভার্যার জন্য রান্না করেন।
মাঝেমধ্যেই তাঁর স্ত্রী আহ্লাদি সুরে বলেন, হ্যাঁ গো, তুমি যে কদিন আগে ইলিশের পাতোয়া রেঁধে খাওয়ালে বেশ হয়েছিল কিন্তু। আরেকটি বার রেঁধে খাওয়ালে খুশি হতুম। আর অমনি শরৎ সঙ্গে সঙ্গে রসুইঘরে গিয়ে ইলিশ রাঁধতে লেগে যান।
কখনোবা শরৎ রান্না করেন শান্তিদেবীর প্রিয় সুক্তো কিংবা চিতল মাছের কোপ্তা। শান্তিদেবীর শুধু শরতের একটি স্বভাব পছন্দ নয়। সবসময় তাঁর হাতে বই। অফিস থেকে ফিরেই নাওয়া-খাওয়া ফেলে রেখে কোনো একটি বই তুলে নেন হাতে। শান্তিদেবী মাঝেমধ্যে শরতের সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়ে দেন – বলি, বই ছাড়া কি দুনিয়াতে আর কিছু নেই? ঘরের মধ্যে আমি কি অদৃশ্য কোনো বস্ত্ত? আমি আছি কি নেই তোমার খেয়াল নেই, তুমি পড়ে থাক শুধু বই নিয়ে। পরক্ষণেই শরৎ বই ফেলে বউয়ের সঙ্গে আলাপ জুড়ে দেওয়ার কপট ভান করেন।
এভাবেই সুখে-দুঃখে, হাসি-আনন্দে কেটে যাচ্ছিল শরৎ ও শান্তিদেবীর দাম্পত্য জীবন। এক শরৎ ঋতুতে শরৎচন্দ্র শান্তির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন আবার আরেক শরৎঋতু আসতে না আসতেই শান্তিদেবী সন্তানসম্ভবা হয়ে উঠলেন। একমাস-দুমাস করে গর্ভধারণ ন-মাসে পৌঁছল। শান্তিদেবীর শারীরিক গঠন শীর্ণকায় বলে তাঁর স্ফীত তলপেট দেখলে মনে হয় যে, তিনি ষষ্ঠ মাসের গর্ভবতী। গর্ভবতী শান্তিদেবী গর্ভধারণের পর আরো সুন্দর হয়ে উঠেছেন। এটাই বুঝি প্রকৃতির নিয়ম।
ন-মাস শেষ হতে না হতেই একদিন সন্ধ্যায় এ-পৃথিবী আলো করে শান্তিদেবী প্রসব করলেন একটি পুত্রসন্তান। চক্রবর্তীর মেকানিক কারখানার ভৃত্য নগেনের মা একজন অভিজ্ঞ দাই। তাঁর হাতেই ভূমিষ্ঠ হলো শরতের প্রথম আত্মজ। নগেনের মা মালতী রানী শরতের সদ্যভূমিষ্ঠ শিশুটিকে পুরনো ট্রাঙ্ক থেকে বের করা একটি কাঁথার পুঁটলির মধ্যে পেঁচিয়ে ছোট ছানাটিকে শরতের হাতে তুলে দিলেন – দ্যাখেন বাবু, কী রকম রাজপুত্তুরের মতন হয়েছে।
শরৎ মালতীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ওভাবে বলো না মালতী, মন্দ দৃষ্টি পড়বে যে!
শরৎ একজন ভালো লেখাপড়া করা মানুষ। তাঁর ওপর আবার বিখ্যাত সাহিত্যিক। কিন্তু এর পরেও কিছু কিছু সংস্কার থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা খুবই কঠিন।
ট্রাঙ্ক থেকে বের করা কাঁথার কর্পূরের গন্ধের সঙ্গে শিশুটির গায়ের গন্ধ মিশে এক অদ্ভুত সুন্দর মিষ্টি সুবাসে মনপ্রাণ ভরে গেল শরতের। শিশুটি তাঁর দিকে পিটপিট করে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে। হাতদুটি মুষ্টিবদ্ধ। শিশুটিকে শরতের মনে হচ্ছে এটি কোনো মনুষ্যশিশু নয়, হতে পারে কোনো দেবশিশু।
রেঙ্গুনে পেস্নগ রোগটি আবার মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ছে। চারদিক থেকে আসছে শুধু মৃত্যুসংবাদ। ওলাওঠায় যেভাবে গ্রামশূন্য হয়ে যায় ঠিক তেমনি এবার পেস্নগ রোগের করালগ্রাসে রেঙ্গুনের বেশকিছু পাড়া মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে।
প্রতিদিনই বিভিন্ন এলাকা থেকে শুধু মৃত্যুসংবাদ আসছে। একদিন শরৎ অফিস থেকে ফিরে ঘরে ঢুকেই দেখতে পেলেন মালতী রানী শান্তিদেবীর পাশে বসে আছে। শরৎকে দেখেই বলে উঠল, বাবু, তাড়াতাড়ি ডাক্তার ডেকে আনুন। শান্তি মা জননীর শরীরখানা যে জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।
শরৎ শান্তির কপালে হাত রাখতেই হাতের তালুটি যেন ছ্যাঁৎ করে পুড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। এ কি! এ তো দেখছি জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।
শরৎ দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন ডাক্তারের সন্ধানে। ডাক্তার হরিশংকরবাবু সব কিছু ভালো করে পরীক্ষা করে বললেন – শরৎবাবু! সর্বনাশ হয়ে গেছে! আপনার স্ত্রীকে পেস্নগে ধরেছে। অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন। কী যে হয় একমাত্র ভগবানই জানেন। আর আপনার নবজাতক বাচ্চাটিও যেহেতু মায়ের বুকের দুধ খেয়েছে তারও যে-কোনো সময় এ-রোগের লক্ষণ ফুটে উঠতে পারে। আমি ওষুধ দিয়ে দিচ্ছি। দেখুন ভাগ্যে কী লেখা আছে।
শরৎ সারারাত পড়ে রইলেন শান্তিদেবীর বিছানার পাশে। কখনো মাথার জলের পট্টি পরিবর্তন করে দেন কিংবা কখনো
হাত-পায়ে তেল ঘষে দেন। এরই মধ্যে ছোট শিশুটিরও গায়ে জ্বর উঠে এলো। জ্বরের প্রখরতায় অবোধ শিশুটি একটানা তারস্বরে কেঁদে যাচ্ছে। দিগ্বিদিগশূন্য হয়ে শরৎ ভাবেন, কী করবেন তিনি? মালতী রানীকে বললেন, তুমি একটু আমার ছেলেটির প্রতি লক্ষ রাখো। আমি শান্তির পাশে রয়েছি। শান্তিদেবী বারকয়েক বমি করে ঘর ভাসালেন। দুর্গন্ধে ঘরের মধ্যে টেকাই দায় হয়ে দাঁড়াল। শরৎ অনেক কষ্টে সেসব পরিষ্কার করলেন। ওদিকে ছোট শিশুটির সমস্ত গা-জুড়ে ছোট ছোট ফুলকির মতো উঁচু হয়ে ফুলে উঠেছে।
শিশুটি চিৎকার করতে করতে একসময় নিথর ও স্তব্ধ হয়ে গেল। শরৎ নগেনকে পাঠালেন দৌড়ে ডাক্তার নিয়ে আসার জন্য। ডাক্তার এলেন আধঘণ্টা পর। ততক্ষণে সব শেষ হয়ে গেছে। ডাক্তার শরৎকে বললেন, এতোটুকু একটি শিশু এতোবড় একটি রোগ শরীরে আর সইতে পারছিল না। আমি পৌঁছার পূর্বেই সে দেহত্যাগ করেছে। ডাক্তারবাবু কিছুসময় শান্তির পাশে বসে থেকে রাত্রি দ্বিপ্রহরের দিকে বাড়ি ফিরে গেলেন।
শরৎ নিজেও একজন জীবন্মৃতের মতো বসেই রইলেন শান্তিদেবীর পাশে। কুইনাইন ওষুধটি খাওয়ানো হচ্ছে একটু পরপর। কিন্তু অবস্থার এতটুকুও পরিবর্তন নেই। শান্তিদেবী বারকয়েক তাঁর নয়নের মণি সাত রাজার ধন ছোট বাচ্চাটিকে দেখতে চাইলেন।
শরৎ আবেগাপস্নুত গলায় বললেন, ওগো এখন তুমি অমনটি করো না। তোমার ছেলে ভালো ও সুস্থ আছে। পেস্নগ রোগটি যে বড় ছোঁয়াচে। ওকে তোমার কাছে নিয়ে এলে ওকেও যে রোগে ধরবে। তুমি আগে সুস্থ হয়ে নাও। তারপর ওকে যত ইচ্ছা আদর-সোহাগ করো। কথাগুলো বলতে গিয়ে শরতের কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল।
শান্তিদেবীর বিছানার পাশে বসে থেকে শরতের কখন যে একটু তন্দ্রার মতো ভাব এসেছিল সেটি তিনি খেয়ালই করেননি। তন্দ্রার ভাবটি কেটে যেতেই চোখে পড়ল শান্তিদেবী সম্পূর্ণ শান্ত হয়ে পড়ে আছেন বিছানায়। শরৎ শশব্যস্ত হয়ে তাঁকে ডাকলেন একবার, দুবার, বহুবার কিন্তু শান্তিদেবী সবাইকে যেন শান্তি দিয়ে এই জগৎ, সংসার, ইহলোক ত্যাগ করে চলে গেলেন না-ফেরার দেশে।
কোমল হৃদয় শরৎ বালকের মতো অধীরভাবে কেঁদে বুক ভাসালেন। তাঁর সেই সকাতর অশ্রু বিসর্জন দেখে রেঙ্গুনে তাঁর পরিচিত বন্ধুবান্ধবও চোখের জল রোধ করতে পারলেন না। রেঙ্গুনের প্রসিদ্ধ ঠিকাদার জিএন সরকার কিংবা গিরীন্দ্রবাবু শরতের এই অকুলপাথার বিপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। বললেন – শরৎ, কেঁদে বুক ভাসিয়ে আর কী হবে? যারা চলে গেছে তারা তো আর কখনো ফিরে আসবে না। তুমি মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলে যে – মৃতদেহের সৎকারের ব্যবস্থা যে করতে হয়।
গিরীনবাবু রেঙ্গুন সেবক ও সৎকার সমিতির সম্পাদক। তিনিই দৌড়ঝাঁপ করে শবদেহগুলোর সৎকারের ব্যবস্থা করলেন।
মন্দিরের পাশ দিয়ে যে-সড়কটি নদীর দিকে চলে গেছে সেটি ধরে একটু এগোলেই এক বিশাল সাদা-শুভ্র কাশফুলের বন। সেই কাশবনের পাশেই শ্মশানঘাট। শান্তিদেবীকে দাহ করার জন্য চিতাটি সেখানেই সাজানো হয়েছে। আর নবজাতক শিশুটির বয়স তিন-চারদিন হওয়ায় তাকে কবর দেওয়া হয়েছে চিতা থেকে ঈষৎ দূরে নদীটির পাশ ঘেঁষে।
শরৎ শান্তিদেবীর মুখাগ্নি করতে কাশবন পেরিয়ে শ্মশানঘাটায় চলে এলেন। আজ তিনি পরেছেন সাদা ধবধবে ধুতি ও গায়ে চড়িয়েছেন একটি সাদা চাদর। কাশফুলের সাদা রঙের মধ্যে শরৎ যেন আজ একেবারে মিশে একাকার হয়ে গেছেন। বেদনার্ত হৃদয়ে তিনি ভাবেন, আজ যদি তিনি এই সাদা কাশবনের মধ্যে একেবারে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারতেন তাহলে হয়ত বুকের মধ্যে জমাটবাঁধা ব্যথা-বেদনা হতে রেহাই পেতেন।
গিরীনবাবু শরৎকে ধরে নিয়ে এসে চিতার সামনে দাঁড় করিয়ে মুখাগ্নি করতে ইঙ্গিত করলেন। শরৎ চিতায় আগুন জ্বেলে দিতেই দাউদাউ করে জ্বলে উঠল আগুনের লেলিহান শিখা। শরৎ অশ্রুসিক্ত নয়নে ভাবতে লাগলেন, চোখের সামনে যে-আগুন জ্বলছে সেটির ক্ষক্ষপ্ততাই বেশি নাকি তাঁর হৃদয়ে যে-আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে সেই আগুনের প্রখরতা বেশি! আর এসব ভাবতে ভাবতে চারদিকে ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে এলো।