শেষ সর্বনাশটুকু করে দিলো আমার কজন পাঠক আর অঝোরধারার বৃষ্টি। কুমুকে নিয়ে যে-গল্পটি আমি গত কদিন আগে ফেসবুকে পোস্ট করেছিলাম তার ওপর অনেক মন্তব্য এসেছে, লাইক পড়েছে। একজন পুরুষ পাঠক লিখেছেন, তার জীবনে কোনো কুমু নেই, তবু গল্পটি পড়ে তার বিষণ্ণতা কাটেনি অনেকক্ষণ। আমিও বিষণ্ণ ছিলাম ওই মন্তব্য পড়ে।
একজন মহিলা পাঠক লিখেছেন, তিনি চোখের পানি রাখতে পারেননি। তিনি কেঁদেছেন। তার মন্তব্য পড়ে আমিও কেঁদেছি।
আরো একজন কেঁদেছে – আমার স্ত্রী শিউলি। শিউলি কেঁদেছে আমার এই ফেসবুক মন্তব্যগুলো দেখেই।
আগে এসব ছিল না। যখন কুমু ছিল, তখন এদেশে এই ডিজিটাল মাধ্যমটি চালু হয়নি। তখন শিউলি কোনো তথ্য-উপাত্ত না নিয়ে বরং আমার ভালোবাসাকে মর্যাদার আসনে বসিয়ে রাখত। কিন্তু এই ফেসবুকটি এখন আমার আর শিউলির মাঝে বড় অন্তরায় ও কুরুক্ষেত্র তৈরির আয়োজন করছে।
এমনটি হয়তো আরো অনেক ঘরেই হচ্ছে, যার খবর আমরা জানি না। তবে আমার ব্যাংকার বন্ধু জাহাঙ্গীর আদিল কদিন কষ্টে ছিল এসব নিয়ে। আদিল আমার ঘটনা শুনেই বলে ওঠে – বন্ধু ওসব বাদ দাও। পুরনো প্রেমের ঘটনা জানাজানি হলে প্রথম প্রথম সব স্ত্রীই একটু ক্ষমার চোখে দেখে; কিন্তু যেই সংসার বড় হয়, স্টাবল হয়, তখনই এসব ছোটখাটো বিষয় নিয়ে ঝগড়া হয়। তুমি তো লেখক মানুষ, তোমাকে আর জানাব না তাহলে আমাকে নিয়েও লিখবে।
আমি কৌতূহল নিয়ে বলি – বলো বলো, লিখব না। লিখলেও ছদ্মনামে লিখব। যেন তোমার ঘরে আগুনের তাপ না লাগে।
আদিল জানে আমি নাছোড়বান্দা। জানে ঘটনার গাছপালা, শিকড়ের সন্ধান নিতে আমি ওসত্মাদ। তাই আর না পেঁচিয়ে বলে – আমার ছোটভাই রায়হানকে তো চেন? ওই ফেসবুকের চ্যাটিং দেখে ওর স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। একবছরও টিকল না। অথচ কত শখ করে মেয়েটিকে বাবা এনেছিলেন বউ করে। খুব সিম্পল ব্যাপার। ছোট ভাইয়ের মোবাইলে কোনো অপরিচিত মেয়ে কী মেসেজ পাঠিয়েছে তা দেখেই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল মেয়েটি। বাড়তে বাড়তে ডিভোর্স। রায়হান কতবার বোঝাতে চেষ্টা করেছে, আর হবে না এরকম। আর অপরিচিত মেসেজের অ্যাকাউন্টহোল্ডার ফেইকও হতে পারে; না, সে শুনলই না। রায়হান কোরানের কসম দিয়ে বলেছে – দেখো, তার সঙ্গে কোনোদিন দেখা হয়নি। তাতেও বউয়ের মনে বিশ^াস ঢোকানো গেল না। বিশ^াস এমন এক জিনিস, একবার ভেঙে গেলে তা আর লাগানো যায় না।
আদিলের সব রহস্য আর ওর ভাইয়ের বেদনাদায়ক কষ্টটি আমার অন্তরেও গেঁথে গেছে ভীষণভাবে। তাও অত বছর পর শিউলি কেন যে আজ অমন আচরণ করল আমি বুঝতে পারছি না। সব দোষ দেবো আজকের সকাল থেকে টানা বৃষ্টিকে।
হ্যাঁ। আজ সকাল থেকে টানা বৃষ্টি হচ্ছে।
ঘুম ভেঙে গেল বৃষ্টির শব্দে আর হালকা ঠান্ডা আবহাওয়ার কারণে। দোকানে যাওয়ার তাড়াহুড়া। শিউলি গ্রিজার অন করে রেখেছে টাইমলি। আমি গরম পানি না হলে গোসলে সুখ পাই না। বাথরুম সেরে নাসত্মার টেবিলে বসেই দেখি শিউলির মন খারাপ। প্রশ্ন করি – কী প্রবলেম, মন খারাপ কেন?
– না, কিছু না। মন খারাপ না। তুমি কী খাবে ডিম মামলেট নাকি সেদ্ধ? ডিম না খেলে পনির দিয়ে ব্রেড করে দিই।
– তোমার যা ভালো লাগে দাও। সমস্যা নেই। তবে একটা কলাও সঙ্গে।
আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, শিউলির মন খারাপ। কিন্তু স্বীকার করছে না। দোকানে যাওয়ার তাড়া আমার। বাইরে ঠান্ডা, কী পরব বলতেই শিউলি মেয়েকে বলে দেয় – আলমারিতে দেখো পুরনো শার্ট আছে হ্যাঙ্গারে ঝোলানো, ওটা বাবাকে এনে দাও।
আমি ওর এ-ব্যবহারেও আশ্চর্য হই। কারণ এই প্রথম মেয়ে আমার বাইরে যাওয়ার পোশাক বের করে দিচ্ছে। আমি একবার ভালো করে শিউলিকে নিরীক্ষণ করার চেষ্টা করি। কিন্তু তখনো মনে পড়েনি যে, আমার ওই গায়ের শার্টের প্রভাবই তার ভেতরে আগুনের শিখার তাপ ছড়াচ্ছে। বুঝেছি আরো পরে, পথিমধ্যে যখন তার ফোন পাই।
আমার সন্তান। ওই ছোট মেয়েটি মায়ের কথামতো যে-শার্টটি আমাকে এনে দিলো, তা দেখে এবং গায়ে জড়িয়ে আমার মন আরো খারাপ হয়ে গেল। আজ কি তবে বৃষ্টির দিন? আজ কি তবে মন খারাপের দিন? আজ কি শিউলির সঙ্গে ঝগড়ার দিন?
কোনো কথা বলি না। মেয়েকে একবারও বলিনি, নিয়ে যাও এই শার্ট। ওকে বুঝতে দিই না এই শার্টের কাহিনি। মেয়েটি জানুক এরকম কোনো অঙ্গভঙ্গি বা তর্কের দিকে না গিয়ে আমি আবার শিউলির চোখে চোখ রাখি। শিউলি চলে যায় তার অন্য কাজে।
আমি শার্টটি গায়ে দিয়ে শার্টের দিকে তাকাই। তাকাই একজন মানুষের দিকে। তাকাই সেই মানুষের মুখের দিকে। তার হাতের দিকে, পায়ের দিকে, পোশাকের দিকে, হাঁটাচলার ভঙ্গির দিকে। তার কণ্ঠের প্রতি আমার ধ্যান বাড়ে, তার হাসির প্রতি আমার মন উড়াল দেয়, তার হইচই-আনন্দের প্রতি আমি আরো ধ্যানস্থ হই।
আমার মেয়ে জানে না। ওই শিশুটি বোঝে না, কী কষ্ট এই পোশাকটি ঘিরে। কেন আজ শিউলি আমাকে কষ্ট দিলো? কী করেছি ওই পনেরো বছরের পুরনো শার্ট নিয়ে? আমি তো কোনোদিন বলিনি ওই শার্টের কথা – বলিনি ওই শার্টের বোতামে বোতামে কারো স্পর্শের কথা। বলিনি ওই শার্টের সুতোয় সুতোয় বুননে কারো ছোঁয়ার কথা, বলিনি ওই শার্টের কলারে-বুকপকেটের কোনো স্মৃতির কথা।
তাহলে?
কেন আজকের দিন শুরু হলো সকালের কান্নার সঙ্গে – আবেগের সঙ্গে – ঝগড়ার সঙ্গে। আমি তো সত্যি শিউলিকে নিয়ে অসুখী ছিলাম না। ওকে বলিনি, আমি কারো মাঝে ধ্যানস্থ আছি। বলিনি, কারো স্মৃতি নিয়ে পনেরো বছর তার সঙ্গে বুকে বুকে মিশিয়ে রাত কাটাচ্ছি। হায় নারী! তুমি পুরুষের কষ্ট বোঝো না অথবা বুঝেই আবার কেন পুরনো স্মৃতিকে-কথাকে ঠেলে দিয়ে নিজের শান্তি নষ্ট করো?
আমি লালবাগের কেলস্নার গেট অতিক্রম করছি। ওই শার্টটির এক কোনায় বৃষ্টির ছাঁট লাগে। আমি ওটিকে সরাই। ভিজতে দিই না। ওখানে কুমুর স্মৃতি। কেলস্নার গেটের দিকে মুখ ফেরাই। ওখানে যেন কুমু দাঁড়ানো। অতটা বছর প্রায় প্রতিদিনই যাই এই পথে কিন্তু সত্যি বলছি, কুমুকে আজকের মতো করে ভাবিনি।
আজ বৃষ্টির দিন বলে ভাবছি? বৃষ্টি আমাকে বিমর্ষ করে। বৃষ্টির জল আমাকে আবেগী করে – কাঁদাতে চায়।
দেখি, রিকশাটি ধীরগতিতে আমার নতুন ব্যবসাস্থল মগবাজারের দিকে যাচ্ছে। টিএসটি চত্বর পার হচ্ছি, আবার হচ্ছি না। কুমু আমাকে ডেকে ওঠে – অত বৃষ্টির মধ্যে বের হয়েছ কেন। ঠান্ডা লাগবে তোমার – সোনা।
পেছনে তাকাই। ওপাশে-এপাশে – কুমু নেই।
শিউলি একবারও বলেনি – আজ বৃষ্টি, যেও না। একদিন না গেলে কী হবে? কর্মচারীদের বলো ম্যানেজ করবে। বলেনি – সাবধানে যেও।
শিউলি সাদামাটা গৃহিণী হয়ে যাচ্ছে। আগের মতো টান নেই। আবেগ-প্রেম নেই। সেই যে মাওয়াঘাটে লঞ্চের মধ্যে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল – ভেবো না, আমি জানি সব কথা। কষ্ট পেও না। আমি তো আছি।
না, এখন আর যেন সেই শিউলি নেই। একই ঘরে আছি, সে নেই। একই খাটে শুয়ে থাকি, সে নেই। একই শরীর পনেরো বছর যাবৎ স্পর্শ করছি, সে নেই। এ যেন অন্যরকম শিউলি। সে এখন শুধুই বোঝে সন্তান, বিত্ত আর রান্নাবান্না।
অথচ কুমু বৃষ্টি এলে বা খুব রোদ পড়লেই বলে উঠত – বের হবে না, রোদে পুড়বে না। আমাকে তার কেয়ারিংগুলো আজ এই সকালে ভাবিয়ে তোলে। ইচ্ছে করে, আবার ফিরে যাই মাওয়াঘাটে। ইচ্ছে করে, ফিরে যাই ওদের বাড়ির উঠোনে পুকুরের পাড়ে হাঁস-মুরগি গবাদিপশুর বিচরণে বৃক্ষের ছায়াতলে। খুব ইচ্ছে করে, ওই সড়কের মধ্যে গিয়ে বসে থাকি কুমুর হাত ধরে।
একবার ওদের বাড়ির কাঁচা সড়কে হাঁটছিলাম। ওর হাত ধরে চিমটি কেটে বোঝাতে চাইলাম – কুমু তোমাকে এই সড়কেই আদর করতে ইচ্ছা করছে। আরো আরো জড়িয়ে রাখতে ইচ্ছে করছে। তখন চাঁদ তার আলো ছড়িয়েছে মাত্র। পূর্ণিমা হবে বলেই আগে থেকে দুজনই সিদ্ধান্ত নিয়ে বাড়ি গিয়েছিলাম।
আজ চাঁদ ওকে কী বোঝাল, বাঁশঝাড় ওকে কী বোঝাল, ঝিঁঝি পোকা ওকে ডেকে কী বলল। বসমেত্মর হাওয়া ওকে কী শিখিয়ে দিলো। কুমু আমার কানে কানে বলল – সোনা চলো না একটু বসি।
– ওই মাটিতে?
– হ্যাঁ, সমস্যা কী। ময়লা লাগলে আমি তোমার প্যান্ট ঝেড়ে দেবো। ধুয়ে দেবো। বসে দেখো, ভালো লাগবে। আমরা বসি। অত কাছে আগে বসিনি। জড়িয়ে বসি। ধরে বসি। মুখ কাছে নিয়ে ঠোঁট লাগিয়ে বসি। এক সময় বুক লাগিয়ে আরো গভীর আলিঙ্গনে বসি।
ওটাই ছিল আমাদের প্রথম আর শেষ আলিঙ্গন।
কী করে ভুলি? কী করে ভোলা যায় জীবনের প্রথম স্পর্শ, প্রথম ভালোবাসা? আমি সেদিন চাঁদকে বলেছিলাম – আরো আলো দাও। বাতাসকে বলেছিলাম – আরো বয়ে যাও শীতল হাওয়ায়। ঝিঁঝি পোকাকে বলেছিলাম – আরো শব্দে গান করো যেন আমাদের কথা অন্য কেউ না শোনে।
টিএসটি পার হয়ে শাহবাগে আসি। কুমু আসে আমার সঙ্গে। ধমক দিয়ে ওঠে – তোমাকে বললাম বৃষ্টির মধ্যে বের হবে না। আবার এসেছ? যাও বাসায় যাও, না হলে আমি কিন্তু সারাদিন ভিজব এখানে। আহ্ কুমু, আমার কুমু। আমার জান, আমার কলিজা, আমার শ^াস-প্রশ^াস। আমার জীবন-মরণ।
– না না কুমু, তুমি ভিজবে না। পিস্নজ তুমি হলে ফিরে যাও। তোমার ক্লাস নেই আজ?
– না, আমি ক্লাসে যাব না। তুমি বলো আর ভিজে অসুখ বাঁধাবে না?
আমি কিছু বলি না। আমি নজরুলের কবর দেখি, কী বিষণ্ণ একাকিত্বের ছোপ ওখানে। চারুকলার বৃক্ষগুলো থেকে জল গড়াতে দেখি, যেন কুমুর বিরহে কাতর। গ্রন্থাগারের চত্বর জলে সয়লাব – সিঁড়িগুলো কাঁদছে ইনিয়ে-বিনিয়ে কুমুর জন্য। দেখি শাহবাগ – দেখি কুমু নেই। জাদুঘর দেখি – কুমু নেই। ফুলের দোকান বন্ধ – কুমু নেই। ট্রাফিক আছে, কুমু নেই। বৃষ্টি আর বৃষ্টি। পথে লোক আছে কয়েকজন, কুমু নেই। আমি ফিরে যাই না বাসায়। যাই না শিউলির কাছে।
এই বৃষ্টির মধ্যেই শিউলির কল আসে। ভারি কণ্ঠে বলে, নিশ্চয়ই আজ তোমার দিন ভালো কাটবে? ওই শার্টটি কুমু দিয়েছে, তাই না? পনেরো বছর তোমাকে পরতে দেখিনি, তবু যত্ন করে রেখেছ। তোমার ড্রয়ার ভাঁজ করতে গিয়ে আরো বছরখানেক আগেই একটি চিঠি পেয়েছিলাম বলিনি। জানলাম ওটি কুমুর দেওয়া। তাই আজ পড়তে দিলাম।
শিউলির রাগ-রহস্য পেলেও শান্তি পাচ্ছি না। আমি আবার কুমুকে খুঁজি। পনেরো বছর আগে পদ্মায় হারিয়ে যাওয়া স্পিডবোটে মানুষরূপী জানোয়ারদের দ্বারা ধর্ষিত হওয়া… আহ্ আহ্!… আমার কুমু…! তুমি নিশ্চয়ই অনেক হাতজোড় করেছ ওদের, নিশ্চয়ই ওদের বাবা-ভাই বলে নিজের সম্ভ্রম রক্ষার চেষ্টা করেছ, নিশ্চয়ই পানিতে ঝাঁপ দিয়ে বাঁচতে চেয়েছ।
…আমি বাঁচতে চাই না কুমু, আমি আর বাঁচতে চাই না। দেখো, এই দেখো, এই শার্ট – তোমার দেওয়া পনেরো বছর আগের স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছি।
আমি রিকশাচালককে বললাম, ভাই মগবাজার যাব না। তুমি গুলিসত্মান যাও – মাওয়া যাও – পদ্মায় যাও – স্পিডবোটে আমাকে নামিয়ে আসো।
বৃষ্টি? বৃষ্টিরে? ও বৃষ্টি, আজ কেন তুই অমন করে আমাকে কাঁদালি। আকাশ? ও আকাশ, কেন আজ ঝরে পড়লি?
আমার চোখের বৃষ্টি কেউ দেখে না।