সালমা আপার যখন দ্বিতীয় বিয়ে হলো তখন তার তিন বছরের ছেলে আবাবিলকে লুকিয়ে রাখতে হয়েছিল। আপা তো কিছুতেই মানতে চাইছিলেন না এটা। বারবার তিনি বলছিলেন,’আমি পারবো না আমার কলিজার টুকরোটাকে এখানে রেখে গিয়ে অন্যের ঘর সংসার করতে!’ কিন্তু আমাদের সবার জোর-জবরদস্তিতে তাকে মানতে হয়েছিল সেবার। অবশেষে আপার একটি সন্তান আছে এই কথাটি লুকিয়ে রেখেই বিয়ের কাজ সমাধা হলো। বিয়ের পর এক বছর পেরিয়ে গেলে কীভাবে যেন ঘটনা টা জেনে ফেললেন আপার শাশুড়ি। এরপর একে একে দুলাভাই সহ তাদের বাড়ির সবাই।আপা তো এ নিয়ে চিন্তায় অস্থির! তিনি আম্মাকে ফোন দিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন। আম্মা আতঙ্কগ্রস্ত গলায় বললেন,’কী হয়েছে মা তোর? কাঁদছিস কেন এভাবে?’ আপা বললেন,’আম্মাগো আম্মা, আমার বুঝি কপাল পুড়ছে!’
বলে আবার কান্নায় ভেঙে পড়লেন আপা।আম্মাও মেয়ের কান্না শুনে কেঁদে ফেললেন। কিন্তু আসলে কী হয়েছে তিনি কিছুই জানেন না। আম্মা কান্নাভেজা গলায় বললেন,’কী হয়ছে মা বল আমারে!’ আপা কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,’তোমাদের জামাই,তার মা,আর বাড়ির সবাই জেনে গেছে আবাবিলের বিষয়ে। আমার শাশুড়ি বিকেল বেলায় আমায় ডেকে বলেছেন ,বউমা, রাতে ঘরে সালিশ বসবো। তুমি আবার ঘুমাইয়া যাইওনা। আম্মাগো আম্মা,আমি বুঝতাছি না কী যে হয় আমার! যদি তোমাদের জামাই অন্য কিছু ভাইবা বসে!’ কথাগুলো বলতে বলতে আপার কী কান্না!তার কান্না শুনে আম্মাও কাঁদছেন। আম্মার কান্না দেখে আমরা সব ভাই- বোন একসাথে জড়ো হয়েছি। আব্বা সবকিছু শুনে কেমন জানি বেকুব বনে গেছেন। তিনি কোন কথা বলছেন না। শুধু রোয়াকে মাটির উপর বসে নিঃশ্বব্দে নিরবে দু ফোটা চোখের জল ফেলে দিলেন।
আবাবিলের বয়স এখন চার।ছেলেটা এখন সবকিছু বুঝে।তার মায়ের যে অন্য এক জায়গায় বিয়ে হয়ে গেছে তাও সে জানে। এবং বিয়ের কদিন পর থেকেই মায়ের জন্য সে খুব একটা কান্নাকাটি করে না। কীভাবে যেন সে বুঝে গেছে তার সারাটা জীবন মা ছাড়াই কাটাতে হবে। ওদিকে বাবা তো অন্য এক মেয়ে নিয়ে দেশ ছেড়েই পালিয়েছে!
আবাবিল বসে আছে আম্মার কোলে।আজ তার মুখও কেমন বিষন্ন। ছোট্ট সুন্দর চোখ দুটিতে ঝিলিক দিচ্ছে মুক্তোর মতো জলের ফোটা। আম্মা সেদিকে তাকালেন। তাকিয়ে ওকে জাপটে ধরে বুকের সাথে মিশাতে মিশাতে বললেন,’আহারে আমার কপালপোড়া!’ আবাবিল আম্মার বুকের ভেতর ছোট্ট একটা চড়ুই ছানার মতো গুটিসুটি মেরে বসে আছে যেন।একটুও নড়ছে না। আমি লক্ষ্য করলাম। শুধু তার সুন্দর চোখ থেকে দু ফোটা সাদা মুক্তো তরল হয়ে গড়িয়ে পড়েছে গালের উপর।
সন্ধ্যার পর থেকেই আপা ছটফট করতে শুরু করলেন। খানিক পর পর তিনি আম্মাকে ফোন দিয়ে কাঁদছেন। আম্মা কী বলে তাকে সান্ত্বনা দিবেন? তিনি বললেন,’মা, আল্লাহকে ডাকো। আল্লাহ ছাড়া আর কোন উপায় নাই এখন। আমরা ভাই-বোনেরাও মনে মনে আল্লাহকে ডাকছি। এমনিতেই আপার এটা দ্বিতীয় বিয়ে। প্রথম স্বামী তো ছিল তার চরিত্রহীন।অন্য একটা মেয়ে নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। তারপর কত কষ্ট করে তার দ্বিতীয় বিয়েটা হলো। এখন যদি আবার কোন সমস্যা হয় তখন কী আপা বাঁচবে! রাত নয়টার পর সালিশ শুরু হলো। আপার বুক কেমন ধড়ফড় করে কাঁপছে। ভয়ে সে কেমন গুটিয়ে যাচ্ছে। এই সময় আপার শাশুড়ি ডাকলেন,’বউমা?’ আপার মাথা যেন কেমন চক্কর দিয়ে উঠলো।এক মুহুর্তের জন্য তার নিজেকে মনে হলো এই বুঝি তার ফাঁসির দণ্ডাদেশ হয়ে গেল।
আপা যখন তার শাশুড়ির ডাকে সাড়া দিলেন তখন তার শাশুড়ি বললেন,’বউমা, মানুষ তো তার জীবনে দোষের কিছু ঘইটা থাকলে তা লুকায় কিন্তু তুমি তোমার সন্তানের কথা লুকাইলা কেন মা?’ আপা কী বলবে তখন!ভয়েই তো তার শরীর জমে যাচ্ছে। অজানা এক আশঙ্কায় তখন সে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। আপার শাশুড়ি তৎক্ষণাৎ তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,’কাইন্দোনা গো মা। শোন, সন্তান-সন্তুতী হইলো আল্লাহ পাকের বিশেষ দান। এরা হইলো মায়ের কইলজার টুকরা।সাত রাজার ধন। নিজের সন্তানরে দূরে রাইখা একজন মায়ের প্রতিটা দিন শুরু হয় কষ্টের নিঃশ্বাস দিয়া গো মা। সন্তান ছাড়া কী পারবা তুমি তোমার সারাটা জীবন কাটাইতা?’
আপা কাঁদছে। কান্নার জন্য সে কোন কথাই বলতে পারছে না।তার শাশুড়ি নিজের আঁচল দিয়ে আপার চোখ মুছিয়ে দিতে দিতে বললেন,’মাগো,আমি তোমার বিরুদ্ধে অবিচার করবো না। আমার নিজেরও মেয়ে আছে। তাদের জীবনেও এমন ঘটতে পারতো।সব আল্লাহর ইচ্ছা। আগে আমি জানতাম না যে তোমার সন্তান আছে।জানলে সন্তান সহ তোমারে এই বাড়িতে আনতাম। এখন যেহেতু জানছি তাই আমি আদেশ করতেছি, তুমি তোমার ছেলেরে আগামীকাল এইখানে আমার বাড়িতে নিয়া আসবা। এইখানে আইসা মায়ের ছায়ায় মায়ায় বড় হইবো তোমার ছেলে। তুমি আনবা না মা তোমার ছেলেরে?’ আপা এখনও কাঁদছে।কষ্টে নয় আনন্দে। সে তার শাশুড়িকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে মনে মনে বলছে,’মাগো,ওমা, আপনাকে আল্লাহ উত্তম মর্যাদা দান করুন।’
পরদিন সকাল বেলা আপা আর দুলাভাই আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। এবার আর আমাদের আবাবিল কোথাও লুকিয়ে থাকেনি।সে সব সময় তার মায়ের পেছনে পেছনে ঘুরঘুর করেছে। একটু পর পর ডেকেছে,মা মা।
এতে দুলাভাই রুষ্ট। কারণ ছেলে তাকে বাবা ডাকছে না।আপা তখন আবাবিল কে ধমক দিলেন। বললেন,’ইনি তোমার বাবা। তোমার বাবাকে তুমি একশো একবার ডাকবে ‘বাবা’ ।’ সমস্যা হলো আবাবিল একশো পর্যন্ত গণণা জানে না।সে জানে চল্লিশ পর্যন্ত। আবাবিল চল্লিশ পর্যন্তই আঙ্গুলের কড়ি গুণে গুণে ডাকলো,’বাবা,বাবা বাবা।
গল্পের বিষয়:
গল্প