দিশারি

দিশারি
স্যার কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন আমায়। সামনে ইরা, লিলি, মনি, রিমি, মারিয়া সবাই বসে আছে। অন্যরা স্যারের ভয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকলেও মারিয়া বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছিলো আর চোখ মারছিলো। এ যেনো বুড়ো বাঘের সামনে হরিণ শাবকের খেলা করার মতো দুঃসাহসী ব্যপার! স্যার বাকিদের খাতা দেখছেন। আমি চুপচাপ কান ধরে দাঁড়িয়ে আছি। মারিয়া তার কাজ করেই যাচ্ছে। হঠাৎ করেই নিরবতা ভেঙে স্যার বলে উঠলেন,
– মারিয়া!
– জ্বী স্যার!
– চেয়ারের উপর কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকো। আর রিয়াদ তুমি বসো।
স্যারের গুরুগম্ভীর ভাষায় বলা কথাগুলো যেনো গোটা রুমে আরো তীব্র ভীতিকর পরিবেশের সৃষ্টি করলো। আমি চেয়ারে বসে পড়লাম। মারিয়া চেয়ারের উপর উঠে কান ধরে দাঁড়িয়ে গেলো। এবার আর আমি সাহস পাচ্ছি না মারিয়ার দিকে তাকাতে। যদিও চোখ মারার কোন ইচ্ছেই নেই কিন্তু এমুহূর্তে ওর দিকে তাকাতে পারাটাও অনেক বড় সাহসের বিষয়। আমার সে সাহস হলো না। তাকালামও না। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে স্যার সবার খাতা দেখে নিলেন। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী মারিয়া। বাড়ির কাজ ও-ই সবসময় সবার থেকে ভালোভাবে করে থাকে। আমরাও করি তবে, মারিয়ার গুলো সবসময়ই আমাদের থেকে তুলনামূলক ভালো হয়। স্যার এবার মারিয়াকে নিচে নেমে বসতে বললেন। ও বসলো। স্যার বললেন, শোন, তোমাদেরকে একটি কথা বলি। স্যারের কথা শুনে আমরা সবাই তাঁর দিকে তাকালাম। তাঁর চোখের উপর মোটা ফ্রেমের ঘোলাটে হয়ে যাওয়া চশমার কাঁচের দিকে তাকালাম। স্যার আমাদের আগ্রহ প্রত্যক্ষ করে বলতে শুরু করলেন,
– ধরো তোমরা একটি রাস্তা দিয়ে দূরে কোথাও যাচ্ছো। সবাই নিজেদের সাথে করে পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার ও পানীয় নিয়েছিলে। কিন্তু ঘটনাক্রমে তোমাদের খাবারগুলো তীব্র গরমে নষ্ট হয়ে গেলো এবং শুধুমাত্র পানীয় অবশিষ্ট থাকলো। তখন তোমরা কি করবে; যাত্রা অব্যাহত রাখবে? কোথাও থেমে খাবারের সন্ধান করবে? নাকি ফিরে আসবে? প্রথমে ইরা বলো! ইরা,
– যাত্রা বাতিল করে ফিরে আসবো। স্যার এবার ইরার পরে বসা লিলির দিকে তাকালেন। আমরা বুঝতে পারলাম ক্রমে ক্রমে সবাইকেই বলে যেতে হবে। লিলি বলতে লাগলো,
– আমি ইরার সাথে একমত। যাত্রা বাতিল করে ফিরে আসবো। মনি,
– খাবারের সন্ধান করবো। রিমি,
– ফিরে আসবো। মারিয়া,
– আগে দেখতে হবে যে জায়গায় গিয়ে আমাদের খাবার নষ্ট হয়েছে সেই জায়গা থেকে গন্তব্য আর বাড়ির দূরত্বের পরিমাণ কতো। সেখান থেকে যদি বাড়ির থেকে গন্তব্য তূলনামূলক কাছে হয় তাহলে আমরা খাবার অনুসন্ধান করবো যেনো খাবার খেয়ে সহজেই গন্তব্যে পৌঁছুতে পারি। আর যদি গন্তব্য থেকে বাড়ি কাছে হয় তবে আমরা ফিরে আসবো এবং খাবার নিয়ে আবারো রওয়ানা করবো। কিন্তু যদি গন্তব্য কাছে হয় এবং খাবার অনুসন্ধান করে নাও পাই তবুও বাড়ির পথে না ফিরে গন্তব্যের দিকেই যাবো। স্যার মারিয়ার এমন বুদ্ধিদীপ্ত জবাবে মুচকি হাসলেন। হেসে তিনি আমার কাজটাও সহজ করে দিলেন। আমি বললাম,
– আমি মারিয়ার সাথে একমত। আমিও তাই করবো। কথাগুলো বলে তাকালাম মারিয়ার দিকে। সেও তাকালো। হয়তো শুনতে চাইছিলো আমি কি বলি। ওর সাথে সহমত পোষণ করায় হাসলো কিছুটা। আমিও হাসলাম। এবার স্যার বলতে লাগলেন,
– মারিয়া যথার্থ বলেছে। এমনটিই করা উচিৎ। আর রিয়াদ মারিয়ার সাথে সহমত পোষণ করে সেও বুদ্ধিমানের পরিচয় দিয়েছে। যদিও আমার বিশ্বাস ছিলো এমনটি সে বলতে পারতো না। এখন কথা হলো এর তাৎপর্য কি? তাৎপর্য হলো; যখন তোমরা নিজেদের স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে ছুটবে তখন যে স্বপ্ন দৌড়ে এসে তোমাদের হাতে ধরা দিবে বিষয়টি তেমন নয়। সবসময় পরিস্থিতি অনূকূলে থাকবেনা। পরিস্থিতি মাঝপথে খারাপ হয়ে যেতে পারে ঐ খাবারের মতোই। কিন্তু পানীয় থাকবে। পানীয় কি? সেটা হলো তোমাদের সুশিক্ষা। সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারলে সেটি তোমাদের তৃষ্ণা নিবারণে সহায় হবে।
খারাপ পরিস্থিতিতেও মনে সাহস পাবে। ভাবতে পারবে। যদি এমন হয় যে, স্বপ্ন তোমাদেরকে তোমাদের নিকটাত্মীয়দের থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। তোমাদের মনে হয় যে, তোমরা তাঁদের হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছো। এবং সে অবস্থায় এটাও দেখো যে, স্বপ্ন বাস্তবায়নে আর বেশি সময় বাকি নেই তবে পিছুটান দূরে ঠেলে সামনে এগিয়ে যাবে। সম্ভব হলে খাবার সংগ্রহ করার মতো করে নিকটাত্মীয়দেরকে নিজেদের স্বপ্নের কথা বুঝাতে চেষ্টা করবে। তাঁরা যদি না বুঝেন আর স্বপ্ন কাছেই হয় তবে তাঁরা ঐ বাড়ির মতো গন্তব্যের থেকে দূরে হলেও স্বপ্নের দিকে এগিয়ে যাবে। শেষে বিজয়ী তোমরাই হবে। কারণ, স্বপ্ন যখন ধরা দিবে তখন তোমরা সফল হবে। আর সফল হলে শুধু আত্মীয়রাই নয় বরং যাঁদেরকে তোমরা কখনো দেখোই নি এমন অনেকেই এসে আত্মীয়ের পরিচয় দিবে। তোমাদের তখন শুভাকাঙ্খী আর আত্মীয়ের কোন অভাব হবেনা।
এবার আসা যাক রিয়াদের বিষয়ে। সে মারিয়ার কথায় একাত্মতা পোষণ করেছে। এটা হলো সবসময় সৎ সঙ্গে থাকার লক্ষ্মণ। যাদের মাথায় এসব নেই যে কি করে তারা জীবনের লক্ষ্য স্থির করবে আর কি করেই বা সফল হবে তাদের উচিৎ সৎ ও বুদ্ধিমান লোকদের সাহচার্যে থাকা। সৎ সঙ্গের গুণে তারাও সফলতা পেতে পারে। তাই, নিজে বুদ্ধি করে কিছু করতে না পারলেও নির্বোধ লোকদের সাথে একাত্মতা পোষণ করবেনা। তাদের সাথে চলবেনা। যদি তা করো তবে তোমরাও তাদের মতোই নির্বোধ বলে বিবেচিত হবে। জীবনে সফলকাম হবেনা। স্যারের কথাগুলো আমাদের হৃদয়ে গেঁথে গেলো। সবাই মিলে শপথ করলাম, নিজেরা অজ্ঞ হলেও সবসময় বিজ্ঞদের আশেপাশে থাকবো। তাঁদের অনুসরণ করবো। এবার স্যার যথারীতি বেত নাড়াতে নাড়াতে সবাইকে পড়া বের করতে বললেন।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত