-আচ্ছা তোমার বয়স কি বাড়তেছে নাকি কমতেছে?
-শরীরের বয়স বাড়তেছে আর মনের হলে কমতেছে! আর কি এমন বললাম যে এরমধ্যে আমার বয়স নিয়ে আসতে হলো?
-এতো রাতে জনাব এক মগে কফি খেতে খেতে জোৎস্না বিলাস করতে চাইবেন আর আমি বয়স আনবো না?
-তুমি কি আসলেই আমার নীলিমা? নাকি অন্য কেউ?
-না, আমি এখন এক বাচ্চার মা। এবার চুপচাপ ঘুমাও তো! তোমার আর কি, সকাল সকাল তো উঠতে হয় আমাকেই।
-এক সকাল একটু দেরি করে উঠলে তেমন কিছু হবে না! চলো না, গল্প করি!
-আমার ঘুম পাইছে, তোমার গল্প তুমি নিজে নিজে কর!
-এখন তো মনে হচ্ছে আমার না তোমার বয়স গুণোত্তর ধারায় বেড়ে চলেছে। বুড়ি ঢেঙ্গি একটা!
-কি বললা?
-যা শুনছো সেটাই বলছি!
(বলেই সে পাশ ফিরিয়ে শুয়ে রইলো, এদিকে আমিও মুচকি হেসে ঘুমিয়ে পড়লাম) কিছুক্ষণ বাদে কান্নার শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায়। চোখজোড়া খুলতেই দেখতে পেলাম সে দোলনার পাশে বসে দোল খাওয়াচ্ছে আর আমাদের মেয়েটা হাসছে। মেয়ের হাসি দেখে সেও হাসছে! তাদের দুইজনের হাসির মধুর শব্দ যেন ঘুম নাশক, নিমেষেই আমার ঘুম উবে গেল। মধুমাখা সেই হাসি আরো সামনে থেকে হৃদয়ে বেঁধাতে দোলনার পাশে গিয়ে বসতেই,
-তুমি আবার উঠতে গেলে কেন? আমি তো আছি, তুমি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়!
বলেই সে আবার মেয়েকে নিয়ে খুঁনসুটিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আর আমি শুধু তাকিয়ে দেখছি তাকে। নাহ, এক বিন্দুও বদলায় নি সে। ঠিক তেমনটাই আছে যেমনটা আট বছর আগে ছিল! এখনো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি মুখে সেই লেপ্টে থাকা হাসি! গত আট বছরে হাজারো চড়াই-উতরাই যে হাসি তার মুখ থেকে কেড়ে নিতে পারে নি। বিয়ের ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও আমার কোল জুড়ে কোন সন্তান আসে নি। এই নিয়ে আমাদের হীনমন্যতার শেষ নেই। পরিচতদের অনেকেই বলত, ‘এভাবে আর কতদিন?’ আবার কোন কোন আত্মীয়রা বলেই ফেলত, ‘এবার তো চিকিৎসা করাও।’ অথচ আমরা জানি আমাদের কোন শারীরিক সমস্যা নেই।
এভাবে প্রতিনিয়ত তিরষ্কার আর অপমানে যখন আমি ভেঙে দুমড়েমুচড়ে যেতাম তখন সে-ই আমার পাশে ছিল এক স্বান্তনার নগরী হয়ে। কিন্তু কারো কোলে বাচ্চা দেখলে সেও নিজেকে সামলে রাখতে পারত না। তার দিকে তাকালেই দেখতে পেতাম চোখেমুখে ফুটে ওঠা ‘বাবা’ ডাক শোনার ব্যাকুলতা৷ তার সেই ব্যাকুলতায় আমাকে পাল্টে দেয়৷ অহেতুক তার সাথে রাগ করে থাকতাম, অভিমান করতাম অকারণে, দুইজনে দুই রুমে থেকে আমাদের মাঝের দূরত্বটা বাড়িয়ে করতে চেয়েছিলাম দুই দেশের দুই সীমান্ত। চেয়েছিলাম যেন আমার প্রতি তার বিরক্তি আসে৷ কিন্তু যতদিন যায় তার ভালোবাসা বাড়ে, বিরক্তি না৷ এমনও এক সময় এসেছিল, যখন আমি নিজেই তাকে বলেছিলাম আরেকটা বিয়ে করে নিতে। কিন্তু তার ছিল আল্লাহ আর আমাদের ভালোবাসার প্রতি অগাধ আস্থা! সে বলত,
-দেখবে আল্লাহ আমাদের নিরাশ করবেন না! আল্লাহ চাইলে যে কোন সময় সন্তান আসবে আমাদের ঘরে। এভাবে দিন গড়ায় আর সে আমার খেয়াল আরো বেশি করে রাখতে শুরু করে, আমাকে সবসময় ভুলিয়ে রাখতে চেষ্টা করত ‘আমাদের একটা সন্তানের অভাব!’ প্রায়ই হুটহাট অফিস থেকে ছুটি নিয়ে এসে বলত,
-তাড়াতাড়ি রেডি হও তো, ঘুরতে বের হব।
আবার কান্না মাখা রাতগুলোতে যখন আমার চোখে ঘুম ধরত না, ওপাশ ফিরে কান্না লুকানোর চেষ্টা করতাম, তখন ঠিকই সেটা বুঝে ফেলত আর আমাকে ডেকে নিয়ে যেত বারান্দায়। এভাবে কত রাত তার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছি আমার ঠিক জানা নেই! এক সকালে অসুস্থ হয়ে পড়লাম। এ যেন এক সুখের অসুখ। অদ্ভুদ সেই অসুস্থতা। নিজের ভেতরে অন্য আরেক সত্ত্বাকে অনুভব করতে লাগলাম। যা খাই বমি পায়, সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে কিন্তু আমি তাকে কিছু বলি না, শুধু তার বুকে মুখ লুকিয়ে কান্না করি। সেই কান্না যে আনন্দের সে হয়তো তখনো বুঝতে পারে নি। তাই আমার এমন অদ্ভুত আচরণে তার ভয় আরো বেড়ে যায়। আমি শুধু তাকে বলি,
-“আল্লাহ তোমার ব্যাকুলতা দূর করতে আমাদের দুইজনের ঘরে তৃতীয় একজন পাঠাচ্ছেন।”
এই প্রথম আমি তাকে চুপ থাকতে দেখলাম। সেদিনই প্রথমবার তার চোখের পানিতে নিজেকে ভিজিয়েছি। এরপর থেকে সে একদম লুকিয়ে রাখতে শুরু করল আমাকে, যেন পৃথিবীর কোন খারাপ আলো বাতাস না লাগে আমার গায়ে! তারপর আরেক সকালে হাসপাতালের দরজার সামনে এক পৃথিবীর সব দুশ্চিন্তা নিয়ে এপাশ থেকে ওপাশ হাঁটতে থাকে! তার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে নার্স একটু পরে ফুটফুটে একটা পুতুল এনে তার কোলে দেয়। অন্যরকম লাগছিলো, তার আনন্দমাখা চোখে অস্ফুট ভেজা দৃষ্টি দেখে নিজেরই ঈর্ষা হতে শুরু করল। কি এক অদ্ভুত মায়া, বলে বোঝানোর মত নয়! আমি চোখের ইশারায় হাতছানি দিয়ে তাকে ডাকি। পুতুলটাকে কোলে নিয়ে চোখে চোখ রেখে মা হওয়ার শুভেচ্ছা জানাতে জানাতে বললো,
-মেয়ে তো মাশআল্লাহ রাজকন্যার মত হয়েছে। দেখ, নাকটা আমার নাকের মত উঁচু কিন্তু চোখ দুইটা ডাগরডাগর, একদম তোমার মত! সেদিন হাসপাতালের বেডে শুয়ে তার চোখে যে ভালোবাসা দেখেছিলাম, আজো সেই একই ভালোবাসা তার চোখে ভাসছে! তার পাশে চুপটি করে বসে রইলাম। খানিকক্ষণ মেয়ের উপর তো খানিকক্ষণ তার দিকে চেয়ে থাকি। কিন্তু তার সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। সে আছে মেয়েকে কোলে নিয়ে। রাগ হলো, উঠে ফিরে দাঁড়াতেই তার নজর একটুর জন্য আমার দিকে ফিরলো!
-উঠলে নাকি? আর কিছুক্ষণ বসো!
-বসে কি করবো? তুমি তোমার মেয়েকেই কোলে নিয়ে আদর কর, আমি বরং ঘুমাতে যাই। বলতে বলতে উঠে দাঁড়াবো এমন সময় সে মেয়েকে দোলনায় রেখে আমাকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,
-আমি শুধু মেয়েকে না এখনো মেয়ের মাকেও কোলে তুলে আদর করতে পারি, দেখলা?
-ইস! মেয়ের বাবার কি আর তার বউকে ভালোবাসার সময় আছে?
-ভেবো না মেয়ে তোমার ভালোবাসায় ভাগ বসিয়েছে। বরং তোমার জন্য আমার ভালোবাসা দিনদিন বাড়ছে। যেমন ভাবে তোমার ওজন বেড়ে চলেছে। কি ওজন রে বাবা! এতো ভারী কেন তুমি?
-কি বললা? মোটেও আমার ওজন বাড়েনাই।
-তাহলে মনে হয় আমারই কোমড়ের জোর কমতেছে!
-হিহিহি। এটাই হবে। এবার নামাও! দেখো মেয়ে আবার কাঁদতেছে!
-আমার মনে হয় কি মেয়ে কাঁদতেছে না, নালিশ দিচ্ছে!
-ওমা তাই? তা কি নালিশ শুনি?
-সে নালিশ দিচ্ছে তার নাকি একটা ভাইয়া চাই!
-সারাদিন বউকে ভুলে মেয়ে নিয়ে থাকলে তার জন্য ভাই কি করে আসবে?
-ওইত্তেরি! আসলেই তো!
এবার নীলিমা হেসে উঠল, ফুটে উঠল তার মুক্তোয় বাঁধানো দাঁত। যেই হাসিতে আজ কিছুটা লজ্জা মেশানো। ঠিক যেন নতুন বিয়ে করা বউয়ের হাসি! এখন সে এক সন্তানের মা হলেও আমার কাছে এখনো সেই আগের নীলিমাই রয়ে গেছে।
এরই মধ্যে তার খোপাও খুলে গেছে। কোমড় ছোঁয়া খোলা চুল, চোখের সেই চাহনি, রাগ ভরা নাক আর তাতে রাতের আকাশের তারাটা যেন পাথরের সাদা নাকফুল হয়ে মিটিমিটি জ্বলছে। অন্যদিকে মুক্তো ঝরানো দাঁতের হাসিতে নামানো জ্যোৎস্না যেন তার নিষ্পাপ মুখে মেখে দিয়ে যাচ্ছে। খেয়াল করলাম নীলিমার চোখে মেঘ ভিড়েছে, যেকোন মুহূর্তে বৃষ্টি শুরু হবে বলে। কোল থেকে নামিয়ে নীলিমাকে বুকে জড়িয়ে নিলাম। মুহূর্তের মধ্যেই তার উষ্ণ বৃষ্টি আমার বুক ভিজিয়ে শীতলতা ছড়িয়ে যাচ্ছে। আমি আরো শক্ত করে তাকে জড়িয়ে নিলাম। কারণ তার এই সুখের অসুখ কান্না হয়ে ঝরে পরে যাওয়ার জন্য নয়, এই অসুখ যে আমার বুকে পুষে রাখার জন্য।
গল্পের বিষয়:
গল্প