দেয়াল

অফিস থেকে বেরিয়ে দারা দেখল, শেখ মুজিব সড়কটার মাঝামাঝি আড়াআড়িভাবে একটা দেয়াল উঠে গেছে, সড়কটাকে একেবারে আটকে দিয়ে। সারা সড়কে বাস-ট্রাক-রিকশা থমকে দাঁড়িয়ে হর্ন বাজাচ্ছে এমন জোরে যে, আগ্রাবাদের আকাশটাই যেন খানখান হয়ে ভেঙে পড়ছে। সামনে যেতে পারছে না একটা গাড়িও; মানুষজনও আটকা পড়েছে। যেটুকু শামুকগতি আছে তা আশপাশের রাস্তায় এসবের ঢুকে পড়াতে। অফিসফেরত মানুষ দেয়ালটার বাধার মুখে পড়ে কিছুক্ষণ হতবুদ্ধি দাঁড়িয়েছে, তারপর যে যার মতো পেরেছে এদিক-ওদিক পা চালিয়েছে। কিন্তু গাড়ি-ঘোড়া? ঘোড়া নেই বটে, কিন্তু মোটরসাইকেলগুলো, শত শত মোটরসাইকেল তো এ-যুগের ঘোড়া। সেগুলোও নিষ্কৃতি খুঁজছে। এক মহাভজঘট; প্রাণান্তকর অবস্থা।

দারা ভেবে পেল না, দেয়ালটা কে তুলল, কীভাবে তুলল। সকালে যখন সে অফিসে আসে, কোনো দেয়াল তো দূরের কথা, দেয়ালের ছায়াটাও কোথাও ছিল না। তাহলে দেয়ালটা তুলল কে? শহরের মেয়র, তার নির্বাচনী কোনো প্রতিশ্রুতি পালন করতে? নাকি চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংস্থা, যার চেয়ারম্যানের কৃতীর ইতিহাস এ-শহরে আসার পর সে নানা পোস্টার পড়ে জেনেছে? নাকি যারা দামি-দামি ফ্লাইওভার বানিয়ে শহরটাকে শ্রীহীন, রুচিহীন এক দোতলা শহরে পরিণত করতে চাচ্ছে, তারা? তারা কি এই দেয়াল তুলে প্রমাণ করতে চাইছে, তাদের করা ফ্লাইওভারের মতো এই রাস্তারও পরিচয় যাতায়াত অসমর্থতার ওপর। দেয়ালটার সামনে গিয়ে দারা আরো অবাক হলো, নিরেট সিমেন্ট-পাথরের দেয়াল, যা তুলতে অন্তত এক মাস – আর ফ্লাইওভারওয়ালাদের হাতে পড়লে এক বছর – লাগত। সে মনে মনে একটা হিসাব  কষে নিল দেয়ালের প্রতি বর্গফুট তৈরি করতে যদি অন্তত দশ হাজার টাকা লাগে, এর নিচে এত মজবুত দেয়াল করা সম্ভব নয়, তাহলে কত লাখ লাখ টাকা যে লেগেছে বানাতে। এজন্য কবে টেন্ডার হলো? এই প্রকল্পটা কে করল, কে তা পাস করল?

এই হিসাব নেওয়ার ব্যাপারটা দারার কাজের মধ্যেই পড়ে। এক বহুজাতিক জাহাজ কোম্পানির হিসাব নিরীক্ষণ অফিসের সে এক কর্তা। সে জাহাজব্যাপারি হলেও আদা-রসুনের খবর রাখে। সে জানে, সিমেন্ট-পাথরের দেয়াল তুলতে কত টাকা-ডলার যায়। কিন্তু হিসাব মাথায় থাক। দেয়ালটা যে দাঁড়াল, কীভাবে? কেন? কখন?

সে কয়েকজন পথচারীকে জিজ্ঞেস করল। তারা প্রশ্ন শুনে খুব অবাক হলো। কেউ কেউ পালটা জিজ্ঞেস করল, দেয়াল যে উঠেছে, উঠতে পারে, তা দারা কি জানে না? কে জানে না?

কিন্তু সকালে তো দেয়ালটা ছিল না? দারা আবার জিজ্ঞেস করল।

এক কলেজছাত্রী অবাক হয়ে বলল, তাতে কী হলো? এক স্যুট পরা ভদ্রলোককে মরিয়া হয়ে দারা জিজ্ঞেস করল, আপনি অবাক হননি দেয়ালটা দেখে?

ভদ্রলোক বললেন, হোয়াট শুড আই বি? দারার মাথাটা ঘুরতে  থাকল। সে এক হুজুরকে জিজ্ঞেস করল, গাড়িবাসগুলো হর্ন বাজাচ্ছে কেন?

হুজুর হাসলেন। এটা আমাদের অভ্যাস। তবে, তিনি একটু থেমে বললেন, তারা হয়তো ভাবছে জোরে হর্ন বাজালে দেয়ালটা সরে যাবে। কিন্তু দেয়াল তো নিজ থেকে সরে না।

কলেজছাত্রীটি দাঁড়িয়ে ছিল। কী করবে, হয়তো তা ভাবছিল। দারা চোখে প্রশ্ন তুলে তার দিকে তাকালে সে বলল, হুজুর ঠিকই বলেছেন, দেয়াল নিজ থেকে সরে যায় না। তবে নিজে থেকে দাঁড়িয়ে যায় না।

তারা কেন দাঁড়ায়? দারা জিজ্ঞেস করল।

তা নিয়েই তো ভাবছি মহাশয়, মেয়েটি হেসে বলল।

দারাকে এখন আগ্রাবাদের দুদিকের কোনো দিকে বেরিয়ে ওয়াসার মোড়ে পৌঁছতে হবে। কিন্তু কীভাবে, সে বুঝে পেল না। শহরে সে নতুন, রাস্তাঘাট চেনে না, অথচ শহরটাকে তার খুব ভালো লেগেছে, অফিসশেষে হেঁটে হেঁটে সে যায় ওয়াসার মোড়ে। সেখান থেকে আরো একটুখানি হেঁটে শিল্পকলা একাডেমির পেছনে একটা তিনতলা বাড়ির তিনতলায় পৌঁছে যায়। দুই বেডরুমের একটা ফ্ল্যাট সে ভাড়া নিয়েছে। সেই ফ্ল্যাটে এক মাস পর দুর্বা এলে তারা সংসার শুরু করবে। দুর্বা বলেছে, তুমি কিছু কিনবে না। সব আমি কিনব। জীবনের প্রথম এবং একমাত্র সংসার। শুরুটা সে নিজে দেখেশুনে করবে, দারাকে সঙ্গে নিয়ে, কিন্তু দারাকে একা কিছু করতে দেবে না।

দারা অলস মানুষ। মনে মনে খুব খুশি। পারলে দুর্বা এলে নিজের জামাকাপড়গুলিও কিনতে দেয়।

দুর্বার চিন্তা মাথায় এলে দারার হতভম্ব ভাবটা কেটে গেল। সে পাশের একটা রাস্তায় ঢুকে এক সিএনজি স্কুটারকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, ওয়াসার মোড়।

স্কুটারের ড্রাইভার বলল, তিনশো টাকা।

তাই সই।

স্কুটারে বসে দারা দুর্বাকে নিয়ে ভাবতে থাকল। তার মুখে একটা প্রীতির ভাব এলো, যে একটা আলো ফুটল। সারাদিনের ক্লাস্তি ভুলতে দুর্বার নামটা সে বারেবারে বলতে থাকল – সাবরিনা রাবিব দুর্বা, সাবরিনা রাবিব দুর্বা। একটু পর তার প্রীতিময় নামতা থামিয়ে স্কুটারওয়ালা বলল, ডেইলি দেয়াল ওঠে। ভাল্লাগে না।

ডেইলি দেয়াল ওঠে? দারা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল। সেই অবাক ভাব দুর্বা-ভাবকে দূরে নিয়ে গেল।

স্কুটারওয়ালা কোনো উত্তর দিলো না। দারা খুব চিন্তায় পড়ল।

রাতে সে দুর্বাকে ফোন করল। দুর্বার মাস্টার্স পরীক্ষা শেষের দিকে। পরীক্ষাশেষে ভাইভা। সেজন্য কথা বলার সময় কম। তারপরও সব শুনল দুর্বা। কিছুটা চিস্তিত হলো। তুমি কিছু         খাচ্ছ-টাচ্ছ নাকি?

মানে?

মানে বার্মা থেকে কক্সবাজার হয়ে যা আসে। ইয়া-টিয়া না কি?

তুমি একটা পাগল।

তাও ভালো। তুমি পাগল হলে আমি যাব কোথায়?

দেয়াল নিয়ে দুর্বার ভাবনা কিছুই জানা গেল না। রাতে টিভি খুলে সে আরো অবাক হলো। কোনো চ্যানেলেই আগ্রাবাদের দেয়াল আগ্রাসন নিয়ে টুঁ-শব্দ নেই। চট্টগ্রামের জনসংখ্যা তো মোটামুটি ঢাকার অর্ধেক, অথবা তিন ভাগের এক ভাগ। কিন্তু একটা টিভি চ্যানেলও এই শহরের নিজের নেই। এতো বড় শহর, অথচ কিনা ঢাকার মাত্র দু-একটি টিভি চ্যানেল শহরটা নিয়ে চট্টগ্রামের খবর নামের ৫-১০ মিনিটের দয়া দেখানো সম্প্রচার করে। উন্নয়নের শহরে দৃশ্যমাধ্যমের উন্নতি নেই, উন্নতি যা সব অদৃশ্যের।

তবে আগ্রাবাদের দেয়ালটা দৃশ্যমান। এটি উন্নতি বোঝাচ্ছে না অবনতি? দারা নিশ্চিত হতে পারল না।

দু-তিনদিন পর সে দুর্বার কাছে দেয়াল প্রসঙ্গটা আবার পাড়ল। এবার কিছুটা মন দিয়ে দারাকে শুনল দুর্বা, কিন্তু একসময় তাকে অবাক করেই মেয়েটি বলল, দেয়াল তো শুধু ইটপাথরের হয় না, তাই না!

মানে?

মানে বুঝতে হলে একটু-আধটু সাহিত্য পড়তে হয়। শুধু হিসাববিজ্ঞান পড়লে ইটপাথরের বাইরে হিসাবটা চোখে পড়ে না।

দুর্বার কথাগুলো টিভি নাটকের সংলাপের মতো – সস্তাগন্ধের। দারার মনে সস্তা সংলাগ দাগ কাটে না। দারা চায় হয় প্রতিদিনের হিসাবের কথা হোক, না হয় রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রের ভাষাটা হোক। দুর্বা জানে না, দারা, যাকে বলে, ছিন্নপত্র-ভক্ত। তার প্রিয় বাক্য রবীন্দ্রনাথেরও প্রিয় বাক্য, ‘সে আর কি বলব।’

দারা চিন্তায় পড়ল। রবীন্দ্রনাথের চিঠিগুলোতে দেয়ালের কথা আছে, সে জানে, যে-দেয়াল ওঠে মানুষের আর প্রকৃতির মাঝখানে, এক মানুষের নিজের ভেতর এবং বাইরের মাঝখানে। হিসাববিজ্ঞানের ছাত্র হলেও তার ভেতর যে সাহিত্য নেই, তা নয়। সাহিত্য বরং নেই ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী দুর্বার কথাবার্তায়, তার মনে। অথচ সাহিত্যের ভাব দেখায়, পারলে চবিবশ ঘণ্টাই!

দারার মনে একটা বিরক্তির ভাব এলো। এই বিরক্তির ভাবটা নিয়েই সে আজকাল অফিসে যায় আসে। আগ্রাবাদের দেয়ালটা কঠিন দাঁড়িয়ে আছে। তবে দুদিনেই সবার গা-সহা হয়ে গেছে দেয়ালটা। যেন প্রাকৃতিক কোনো স্থাপনা, অথবা ঘটনা। অথচ শেখ মুজিব সড়ক দিয়ে বন্দরে যেতে হয়, বিমানবন্দরে যেতে হয়, ইপিজেড যেতে হয়। পুরো শহরটাই তো অচল হওয়ার কথা, কিন্তু চট্টগ্রাম তার আপাত-অচলত্বে একটুও বিচলিত হলো না।

মানুষগুলো তাহলে বন্দরে, কাস্টম হাউসে, শাহ আমানতে যায় কী প্রকারে?

বিষয়টা তাকে ভাবায়।

পাঁচদিনের মাথায় দারা আরেকবার হোঁচট খেল। অফিসে গিয়ে সে দেখল, সাততলা দালানের পাঁচতলায় তার অফিসের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে এক দেয়াল। এই দেয়ালটা অবশ্য ইটপাথরের নয় – স্টিল, ক্রোম আর কাঁচের। যেরকম দেয়ালকে করপোরেট দেয়াল বললে যথার্থ বলা যায়। বিস্মিত দারা দেখল, বসদের এবং তাদের আড়াল করা দেয়ালের ওদিকটা সম্পূর্ণ অদৃশ্য, দুর্লঙ্ঘ্য। এদিকটায় যারা আছে,  তাদের মধ্যে সে মোটামুটি ওপরের দিকেই। তারপরও এক অধীনস্থকে সে জিজ্ঞেস করল, দেয়ালটা কে তুলল, কেন তুলল?

কেন দারা ভাই, ছেলেটি বলল, আপনি জানেন না? অনেকদিন থেকেই তো এটি উঠছে।

দারার বিস্ময় বাড়ল। অনেকদিন থেকে উঠছে? তার কেন চোখে পড়েনি।

সে আরেকজনকে জিজ্ঞেস করল, একটি লাল-সোনালি রং দেওয়া চুলের মেয়েকে, কথাটা কি সত্যি?

মেয়েটি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, দেয়াল এসব সত্যি সত্যি কেয়ার করে না। দেয়াল ইজ দেয়াল।

দুপুরে দেয়ালটার একখানে একটা কপাটের মতো দেখা গেল। সেটি খুলল। এক বস ঢুকে দারাকে ডেকে নিয়ে গেল। ওইদিকে সভা চলছে। তার ডাক পড়েছে।

সভা শেষ হতে হতে সে জানল, ওইপার থেকে এইপারে একজন শিগগিরই যোগ দেবে, এবং যে যোগ দেবে, সে আর কেউ নয়, রং দেওয়া চুলের সেই মেয়েটি, যদিও দারা থেকে সে বয়সে এবং অভিজ্ঞতায় ছোট।

দারা স্তম্ভিত হলো, স্তম্ভিত হলেও তার উচিত ছিল জানতে চাওয়া, কেন তাকে পাশ কাটিয়ে জুনিয়র মেয়েটিকে বসপাড়ায় ঢুকতে দেওয়া হবে। একটা ব্যাখ্যা সে দাবি করতেই পারত। কিন্তু তা না, সে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, স্যার, দেয়ালটা কেন?

হোয়াট দেয়াল? বিস্মিত বস পালটা প্রশ্ন করলেন। দারা দেয়ালটা দেখাল।

ও, দিস ওয়াল! বস হেসে বললেন, এটি তো ঠিক দেয়াল না।

তাহলে এটা কি?

তুমি যা ভেবে নেবে তাই। এখন যাও, গিয়ে সানজানাকে পাঠাও। সানজানা সেই চুলে রং দেওয়া মেয়ে।

রাতে অনেক উত্তেজনা নিয়ে সে দুর্বাকে ফোন করল। করপোরেট দেয়ালের কথা বলল। সানজানার প্রমোশনের কথা বলল।

দুর্বা কিছুক্ষণ ভাবল, তারপর হেসে বলল, সাজগুজু মেয়েরা তোমার থেকে দূরে থাকলেই ভালো। অবশ্য এটি বলা শেষ হলে সে গলায় কিছুটা শেস্নষ ঢেলে বলল, একটা পুঁচকা মেয়ে তোমাকে ডিঙিয়ে ওপরে উঠে গেল, তুমি করলেটা কী?

আমার কী করার ছিল, বলো?

করার তো ছিলই, অন্তত বসে বসে আঙুল তো চুষতে পারতে। দারার মুখে কথা জোগালো না। মনে হলো দুর্বার কথাগুলো তার কথা বলার সব ঠোঁট সেলাই করে দিলো।

 

দুই

ছুটির দিনে দারার ইচ্ছা হয় শহরটা একটু ঘুরে দেখবে। ঘুরে দেখতে হলে হাঁটাটাই উত্তম, দারাও তার পা দুটোকে ভরসা করে বেরিয়ে পড়ল।

ছুটির সকালটা মায়াময়। স্কুলের তাড়া নেই, রাস্তাগুলো তাই নিশ্চিন্তে শুয়ে শুয়ে দম ফেলছে আর রোদ পোহাচ্ছে, শীতটা একটা চনমনে ভাব নিয়ে এসেছে, রোদও পরিষ্কার, কুয়াশাও আধা দিন জুড়ে রোদ ঢেকে রাখছে না। হাঁটতে হাঁটতে স্টেডিয়ামপাড়া হয়ে চিটাগাং ক্লাবকে ডানে রেখে লালখানের দিকে এগোলো দারা। তারপর ইস্পাহানী বিল্ডিংয়ের সামনে এসে বড় রাস্তায় পড়ল, রাস্তার নামটা সে জানে না, তবে এটা ধরে একটু ডানে এগোলে ওয়াসা মোড়, তারপর জিইসি মোড়। জিইসির বায়ে খুলশী। এইটুকু সে মোটামুটি জানে।

কিন্তু দামপাড়া পর্যন্ত আসতে আসতে সে বুঝল, একটা কিছু সমস্যা হয়েছে। দামপাড়ার কাছে হান্ডি রেস্টুরেন্টের কাছে তৈরি হতে থাকা বিতিকিচ্ছিরি ফ্লাইওভারটা আস্ত ধসে পড়েছে। একটা নিরেট দেয়াল হয়ে ফ্লাইওভারের ভাঙা অংশ পথটা দখল করে নিয়েছে। এই পথে এখন ওয়াসা মোড় যাওয়াটাও অসম্ভব।

হান্ডি রেস্টুরেন্টটা দারা রেকি করে রেখেছে। এরকম রেস্টুরেন্ট দুর্বার খুব প্রিয়। দারা ভেবেছে দুর্বা এলে প্রথমেই তাকে হান্ডিতে নিয়ে যাবে। সে গুড়ে এখন তাহলে বালি।

আবার পিছু হেঁটে স্টেডিয়াম-সার্কিট হাউস-আলমাস হয়ে সে বাড়ি ফিরে গেল। তার মেজাজটা খারাপ হয়েছে। আরেকটা দেয়াল। হান্ডিকে, ওয়াসা মোড়কে আড়াল করে ওঠা, অথবা নামা, আরেকখানা দেয়াল। সে যাবে কোথায়?

দুর্বাকে ফোন করল। ফোনে সে দেয়াল আর হান্ডির প্রসঙ্গ তুলল।

হান্ডির কথা শুনে দুর্বা হাসল। দারাকে বলল, তোমার চোখটা কখনো ওপরে উঠল না।

মানে?

মানে তোমার ঘরের কাছেই র‌্যাডিসন হোটেল উঠেছে। র‌্যাডিসনের রেস্টুরেন্টে আমার বন্ধু ডলি খেয়েছে, আর ওয়াও, ওয়াও করে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছে।

তাহলে র‌্যাডিসনেই যাব, শুকনো গলায় বলল দারা।

হুঁ, আমি বললাম বলেই তোমার র‌্যাডিসনকে মনে ধরল। নিজের মনে ভাবতে পারো না?

 

তিন

দুর্বা চট্টগ্রাম আসবে, প্লেনের টিকিট কাটা হয়েছে। কিন্তু কী কারণে কে জানে, সে মনস্থির করেছে চট্টগ্রাম আসবে এক অফিস দিনে।

অফিস থেকে ছুটি নিতে হয়, কিন্তু সারাদিন অপেক্ষা করেও অফিসের দেয়ালের কপাট খুলল না। সে অস্থির হয়ে পড়ল। ফোনে বসকে বলল, স্যার পরশু ছুটি চাই।

বস বলল, ফোনে না, হাতে হাতে অ্যাপিস্নকেশন নিয়ে এসো।

কীভাবে আসব?

বস যে চোখ কপালে তুললেন, তার যেন একটা শব্দ উঠল এবং তা দারার কানে এসে বাজল। বস বললেন, কীভাবে আসবে মানে?

স্যার, দেয়ালের কপাটটা যে খুলছে না।

দেয়াল? বস বললেন, হোয়াট দেয়াল? তারপর ফোন রেখে দিলেন। দুদিন পর হাতে অনেকটা সময় নিয়েই বাসা থেকে রওনা হলো দারা। তার মাথায় আগ্রাবাদের দেয়ালের হিসাব। আজকাল বাসা থেকে ভিন্ন পথে স্টেডিয়াম হয়ে বড় রাস্তায় এসে দেওয়ানহাটের হল পার হয়ে দেয়ালটার পাশে এসে সে থামে। তারপর আশপাশের রাস্তা ধরে অফিসে যায়।

এই হিসাব তাকে এখন অধিকার করে রেখেছে। দুর্বার বিমান এগারোটা চল্লিশে। তাকে আনতে যাওয়ার জন্য সে যে-দিনটি ছুটি চেয়েছিল, তা মঞ্জুর হয়েছে। দারা অফিসশেষে বাইরে আধাঘণ্টা দাঁড়িয়ে বসকে সামনাসামনি পেয়ে চিঠিটা দিতে পেরেছিল।

ঘড়িতে ১০ : ৫৫। নৌবাহিনীর দালানকোঠা টানা দেয়াল পার হয়ে হাতের বাঁয়ে মোড় নিতেই সে দেখল, পুরো রাস্তা ধরে একটা দেয়াল। দেয়ালের সামনে কাস্টমসের উর্দি পরা, নৌবাহিনীর উর্দি পরা, বাংলাদেশ বিমানের পাইলটের উর্দি পরা নানা মানুষ চলাফেরা করছে। তাদের মুখে একটা সংকল্পের চিহ্ন। সংকল্পটা কী? ভাড়া করা মাইক্রোবাসের জানালা নামিয়ে দারা একজনকে জিজ্ঞেস করতেই তা প্রকাশ হলো। বিমানবন্দরের আর সমুদ্রবন্দরের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে, সেরকম খবর পাওয়া গেছে। দেয়ালটা তাই তোলা হয়েছে একটা সুরক্ষা দেয়াল হিসেবে। দারা গাড়ি থেকে নেমে এসে দেখল, উর্দি পরা র‌্যাব-পুলিশ আছে। হুলস্থহূল কা-।

বিমানবন্দরে যাওয়া যাবে?

যাবে না কেন, পতেঙ্গা দিয়ে যাওয়া যাবে, একজন বলল। মাইক্রোবাস এরপর ছুটল পতেঙ্গা দিয়ে।

ঢাকা থেকে বিমান এসে গেছে পনেরো মিনিট আগে। দারা ঘেমে উঠল। দুর্বার জন্য এক তোড়া ফুল নিয়ে এসেছে সে। অর্কিড। দুর্বার প্রিয়। সেগুলো তাকে দেখামাত্রই দেওয়ার আশা ছিল তার। সেটি ভেঙেছে সুরক্ষা দেয়ালটি। এখন তার আসার দেরি দেখে দুর্বা কী বলে, সে ভাবতে পারে না, চায়ও না, তারপরও ভাবল। রাগবে? অভিমান করবে?

কিন্তু দুর্বা কোথায়? অনেকক্ষণ সে এদিক-সেদিক ঘুরল। ভেতরে উঁকি মারল। পুলিশ আনসারকে জিজ্ঞেস করল।

না, দুর্বা কোথাও নেই।

পকেট থেকে ফোন বের করে সে বোতাম টিপল। কয়েকবার রিং বাজল, তারপর ফোন ধরে ফিসফিস গলায় দুর্বা বলল, একটা ইন্টারভিউয়ে আছি। একটু পরে ফোন দেব।

তারপর ফোন কেটে দিলো।

দারার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। সারাটা দিন তার গেল দুর্বা কেন তাকে কিছুই জানাল না, তার একটা অর্থ করতে। প্লেনের টিকিট কাটা, আসার দিনক্ষণ ঠিক, সকালে উঠেই সে ফোন করেছে দুর্বাকে। সব ঠিক তো? সে জিজ্ঞেস করেছে। অবশ্যই, বলেছে দুর্বা। শুধু ওই একটি কথাই, দুর্বা ব্যস্ত। তারপর তো না আসার কোনো কারণ থাকে না, যদি না দারাকে নিয়ে ঠাট্টা করার একটা উদ্দেশ্য থাকে দুর্বার। কিন্তু তা কেন হবে? দুর্বা চট্টগ্রাম আসবে, তাদের সংসার শুরু হবে, একটা আস্ত দিন ছুটি নিয়েছে দারা। কাল-পরশু এমনিতেই ছুটি। আজ রাতে র‌্যাডিসনে খেতে যাবে, তাও ঠিক হয়ে আছে।

যা দারাকে সব থেকে বেশি অবাক করল, আহত করল, আঘাত দিলো, তা হচ্ছে, সময়মতো তাকে ওই ফোনটা আর না করা। অনেক অনেক পর ইন্টারভিউশেষে বাসায় ফিরে দুপুরের খাবার খেয়ে প্রায় আধা বিকেলের দিকে, যেন হঠাৎ মনে পড়েছে ব্যাপারটা, সেরকম করেই দুর্বা ফোন করে বলেছে, শিট! চাকরিটা হলো না।

কোন চাকরিটা?

একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ইন্টারভিউতে ডাকল। দুই ঘণ্টা বসিয়ে রাখল। ইন্টারভিউ নিল। তারপর জানিয়ে দিলো, এমএ পরীক্ষা মাত্র দিয়েছে, রেজাল্ট বেরোনোর অনেক দেরি। এখন চাকরি দেওয়া যাবে না। ইউজিসির নিষেধ আছে।

কার নিষেধ? দারা জিজ্ঞেস করল।

তা দিয়ে তোমার কী? তুমি কি বুঝতে পারো না, আমার কতটা খারাপ লাগছে। আমি চাকরিটা পাওয়ার জন্য যোগ্য কি না, তাও তো জানাল না।

তোমার তো আজ চট্টগ্রাম আসার কথা ছিল।

ছিল, কিন্তু তোমাকে পরশু দিনই তো জানিয়ে দিলাম দেরি হবে। শিট, এই নামী প্রাইভেটে অ্যাপস্নাই না করে একটা সাধারণ প্রাইভেটে অ্যাপস্নাই করলেই হতো।

তুমি আমাকে জানিয়েছ যে তুমি আজ আসবে না?

অবশ্যই, তবে তুমি শুনতে শুনতে কেবল মাতম করছিলে দেয়াল দেয়াল করে।

তাই তো।

দুদিন আগে টিকিট ক্যান্সেল করেছ, তাতে নিশ্চয় পুরো ভাড়াটা ফেরত পেয়েছ, তাই না।

হুম্।

যাক, হুম হুম করতে হবে না। আমি এখন একটু ঘুমাবো। দারার জানা হলো না, ঠিক কোন দিন দুর্বা আসবে। একটা টিকিটের পুরো দামটা পানিতে গেল। এখন আবার টিকিট কিনতে গেলে দুর্বার আসা নিয়ে একেবারে নিশ্চিত হতে হবে।

বারান্দায় পাতা একটা কাঠের চেয়ার। একটাই, সেই চেয়ারে বসতে বসতে তার কেন জানি মনে হলো, এই বারান্দায় হয়তো বাড়িওয়ালার একটা মন্তব্য – মন্তব্যটা, দুপুরে বাইরে খেয়ে বাড়ি ফেরার পর সিঁড়ির নিচে তার সঙ্গে দেখা হওয়ার এবং দুর্বা যে আসেনি সে-খবর শোনার পর একটা বাঁকা হাসি হেসে বাড়িওয়ালা বলেছিলেন – ম্যাডাম কি আদৌ আসবেন, নাকি ম্যাডাম আসলেই আছেন?

দারা কোনো উত্তর না দিয়ে ওপরে উঠে এসেছিল। না, মূল কারণটা তা না, মূল কারণটা দুর্বার গলায় হঠাৎ তার অফিসের দেয়ালের ওই পারের বসের গলাটা শুনতে পাওয়া। দুর্বার গলায় কেন বসের গলা শুনবে সে?

রাতে অফিসের রুমী এলো, হাতে অনেক কাগজ নিয়ে। দারার স্বাক্ষর লাগবে। রুমী জানাল, সে কাজ ছেড়ে দিচ্ছে, মালয়েশিয়াতে চলে যাচ্ছে। একটা তেল কোম্পানির চাকরি। নিজের কথা বলতে বলতে হঠাৎ রুমী বলল, তাদের জাহাজ কোম্পানির কপালে দুঃখ আছে।

কেন?

বেআইনি কাজ?

রুমী কোনো উত্তর দিলো না। যাবার সময় শুধু বলল, পারলে এখনই কেটে পড়েন। যত দেরি হবে, সমস্যা বাড়বে।

দুদিন পর দারা দেখল, দেয়াল আরো দুটি দাঁড়িয়ে গেছে। একটি নালার ওপর দাঁড়ানো এক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে যে জায়গাটা, যার নাম প্রবর্তকের মোড়, সেখানে দুই প্রস্থ দেয়াল উঠেছে। ফলে সেখান দিয়ে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। আবার অক্সিজেন মোড়ে বিশাল দেয়াল উঠে যাওয়ায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়াটা বিরাট সমস্যা হয়ে গেছে। বাস যাচ্ছে না। কিছুই যাচ্ছে না।

এসব দেয়ালকে কীভাবে বর্ণনা করা যায় – মেডিক্যাল দেয়াল, বিশ্ববিদ্যালয় দেয়াল, নাকি অক্সিজেন দেয়াল, প্রবর্তক দেয়াল? কাকে আড়াল করছে দেয়ালগুলো? কাকে আড়ালে রাখছে, অথবা আড়াল নিশ্চিত করছে?

একটা বিশ্রী দেয়ালের শহর হয়ে গেছে শহরটা।

 

চার

দুর্বা খুব মিষ্টি করে ফোনে কথা বলে। আর দারাকে মনে করিয়ে দেয়, সংসারটা সে-ই শুরু করবে। দারা যেন মোটেও এটি ভাবে না যে, সংসারের মোড়ক উন্মোচন তার হাত দিয়ে হবে।

কিন্তু কবে?

শিগগিরই। ফল বেরোতে আর দুই মাস। তারপর একটা চাকরি।

চট্টগ্রামে?

চট্টগ্রামে ঢাকায় – একখানে হলেই হলো।

তুমি তাহলে কিছুদিন চট্টগ্রাম ঘুরে যাও। ঘরটা তোমাকে চাইছে।

যাব, তবে আগে আমার একটা হিল্লা হোক। সংসার তো আর ভেঙে ভেঙে শুরু করা যায় না। একসঙ্গেই শুরু করব, যখন করব।

তা বটে।

 

পাঁচ

দেয়াল বাড়তে বাড়তে চট্টগ্রামের সব পাড়া-মহল্লা যেন অন্তরালের পথে চলে গেল। বাড়িওয়ালা দারাকে বাড়িটা ছাড়তে বলেননি, যদিও কোনো ম্যাডামের দেখা এখনো মেলেনি। একদিন বাড়ির বারান্দায় রাখা একমাত্র চেয়ারে বসে দারার মনে হলো, যেন সে নিজেই একটা দেয়াল হয়ে গেছে।

রক্ত-মাংসের তৈরি এক দেয়াল হয়ে গেছে। জানে না কী তার কাজ, বাইরেটা ভেতর থেকে আড়ালে রাখা, নাকি ভেতরটা বাইরে থেকে আড়ালে রাখা।

 

ছয়

একদিন অফিসে দেয়ালের কপাট খুলল। ওই পারের মোটাতাজা এক বেয়ারা এসে দারাকে বলল, স্যার, ওনারা সালাম দিয়েছেন।

দেয়াল গলিয়ে ওই পারে গিয়ে শুনল সানজানা চাকরি ছেড়ে দিয়েছে, রানীও, আরো কে কে। এখন থেকে দারাকে সানজানার টেবিলে বসতে হবে। তবে তার পদ বাড়বে, বেতন বাড়বে। দায়িত্ব, বলাই বাহুল্য।

তার মানে আমি এখন দেয়ালের এই পারে বসব?

হোয়াট দেয়াল, বড় বস মেজাজ খারাপ করে বললেন। মাথাটা তাজা রেখো। একটা ক্রাইসিসে পড়েছি। এখন কাজ সব করতে হবে ঠান্ডা মাথায়। কোনো হ্যালুসিনেশন এখন অ্যালাও করা যাবে না।

তাই তো। রুমী তো তাই বলেছিল।

আর শোনো, বস বললেন, ক্রাইসিসটা সাকসেসফুলি মিট করতে পারলে অনেক রিওয়ার্ড আছে।

আশ্চর্য, পরদিন থেকে দেয়ালের এই পারে বসতে বসতে দেয়ালটা আর চোখে পড়ল না দারার। সে জানে একটা দেয়াল আছে বটে, তবে সেটা নিয়ে সে মাথা ঘামায় না, ঘামানোর মতো বিষয়ের তো অভাব নেই।

এই প্রমোশনের বিষয়টা কেন জানি দুর্বাকে জানাবার তার ইচ্ছা হলো না।

 

সাত

অনেকদিন পর, কতদিন পর হিসাব করাটা হিসাবরক্ষণ বিষয়ে উচ্চশিক্ষিত দারার পক্ষেও মনে করা সম্ভব হয় না, দুর্বা জানান, সে আসছে। দারার বাড়িওয়ালা এর মধ্যে তাকে বলেছেন, দারা সাহেব, আপনার জীবনে কোনো ম্যাডাম কোনোদিন না এলেও এই বাড়িতে আপনি যতদিন ইচ্ছা হয় থাকুন। মোস্ট ওয়েলকাম। মানুষটা আপনি ভালো, ব্যাচেলর হলেও।

দারা হ্যাঁ-না কিছু বলল না।

আরেকদিন বাড়িওয়ালা উত্তেজিত পায়ে সিঁড়ি ভেঙে এসে বললেন, দেখলেন দারা সাহেব, আমার বাড়ির সামনে ওয়ার্ড কাউন্সিলরের লোকজন একটা দেয়াল তুলে দিলো। একবার জিজ্ঞেসও করল না। ওটা কেমন হলো?

দারা জিজ্ঞেস করল, দেয়ালটা কোথায়?

বাড়িওয়ালা অবাক হয়ে বললেন, কেন, দেখছেন না? ওই তো। ওই তো মানে দারার এক চেয়ার-বারান্দার ঠিক সামনে। বাড়িওয়ালার আঙুল অনুসরণ করে বাইরে তাকিয়ে দারা বলল, কই, কোনো দেয়াল দেখছি না তো। পিট পিট চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বাড়িওয়ালা চলে গেলেন। এবং নিশ্চিত ধারণা নিয়ে গেলেন, দারার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। বাড়িওয়ালা চলে গেলে দারা নিজেকে জিজ্ঞেস করল, দেয়ালগুলো গেল কোথায়? সে খুব অবাক হলো, চারদিকে তাকাল, কিন্তু কোনো দেয়াল চোখে পড়ল না। অথচ মাস ছয়েক আগেই তো সারা শহরে গিসগিস করত দেয়াল। এই ছয় মাসে এমন কী হলো তাহলে? বিশেষ করে শেষ কয়েক সপ্তায়?

 

আট

শেষ পর্যন্ত দুর্বা এলো। একটা মাইক্রোবাস নিয়ে অনেক ঘুরপথে এয়ারপোর্ট গিয়ে তাকে বাড়ি নিয়ে এলো দারা। কেন সে এতো ঘুরপথে যাওয়া-আসা করল বলতে পারবে না যেহেতু তার চোখে কোনো দেয়াল তো আর পড়ে না। সে মাইক্রোবাস চালককে       কথাটা জিজ্ঞেস করতে পারত, কিন্তু সে হয়তো বলত এতোদিনের অভ্যাসটা ভোলা তো মুশকিল স্যার।

মুশকিলই বটে।

দুর্বার জন্য অর্কিড হাতে দাঁড়িয়েছিল দারা। দুর্বা অ্যারাইভাল লাউঞ্জ থেকে বেরিয়ে দারাকে দেখে অভিভূত হলো দারার হাতে অর্কিড দেখে। তার মনে হলো, জীবনটা সত্যি সুন্দর। পরীক্ষার ফল বেরোবার পর তিন-চার মাসে একটা চাকরি জোগাড় করতে না পারার পরও, জীবনটা তার সুন্দর মনে হলো।

গাড়িতে উঠে দুর্বা জিজ্ঞেস করল, সংসারের কিছুই কেনোনি তো?

দারা হাসল। মুখে বলল, না, কিছুই না।

কিন্তু মনে মনে একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল, সংসার!

গাড়ি যত চলল, দুর্বার বিস্ময় তত বাড়ল, এটা কোন শহর? চট্টগ্রাম? চট্টগ্রামই যদি হয়, তাহলে কোন চট্টগ্রাম?

বাড়ির সামনে গিয়ে গাড়িটা দাঁড়াতেই বাড়িওয়ালা এগিয়ে গেলেন। তিনি খুব আনন্দ পেয়েছেন ম্যাডাম এসেছেন, সেজন্য। মোস্ট ওয়েলকাম, ম্যাডাম – তিনি বললেন।

থ্যাংক ইউ, দুর্বা বলল। তার ধন্যবাদ দেওয়ার সুরে একটা শুকনো ভাব, যেহেতু একটা প্রশ্ন তাকে অস্থির করে দিচ্ছে। বাড়ির সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে সে অস্থির প্রশ্ন করল, বাসার সামনে এই দেয়াল কেন? সারা শহরেই বা এতো দেয়াল কেন?

কোথায় দেয়াল, দারা জিজ্ঞেস করল।

এবার বাড়িওয়ালার দিকে তাকাল দুর্বা। তার চোখে একই প্রশ্ন। যেন সে বাড়িওয়ালাকেই ভরসা মানছে। বাড়িওয়ালা বললেন, মোস্ট ওয়েলকাম, ম্যাডাম।

দুর্বা অবাক হয়ে দারার দিকে চোখ ফেরালো। ঠিক আছে, চলো, ভেতরে চলো, সে বলল।

চলো, দারা বলল। দুর্বা একটু ভাবল, তারপর বলল, সংসারটা আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে – এ-কথাটা একবারও বললে না তুমি?

দারা হাসল। তুমিই তো বলে ফেললে কথাটা, বলা তো হয়ে গেল, তাই না? এখন চলো।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত