পাড়াগাঁর লক্ষ্মী বিকেল ফুরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুতই বদলে যেতে থাকে ধূমল আকাশের রং। ডাঙা ও প্রান্তরের বাকি ফিকে আলো মুছে ছাইছায়া ঘাসে-পাতায়-মগডালে জুড়ে বসার জন্য ব্যস্ত। তালেশ্বরের হাট-লাগোয়া খরজলভর্তি খালের কোল থেকে একে একে হাটুরেরা তাঁদের নৌকো খুলে উঠে পড়ছে। বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ আর নোনা ঢেউ পেয়ে চরের সর কাদায় দৌড়ে ফেরে পেটুক খুদে কাঁকড়া। খাবারের কণার খোঁজে ছেঁড়া ঠোঙায় চঞ্চল কাক ঠোঁটে-নখে শেষ ছোঁ মারছে। খালের ওপারের পালপাড়ার ছোট ছোট দোচালা ছাউনির ফালি আঙিনায় ঢিপ করে রাখা সংসারের নিত্য জিনিস এখন আবছা দেখা যায়।
ভৈরবের ঘোলা জল নিয়ে বেমরতা হয়ে রথখোলা, পুবে মোচড় কেটে নাটইখালির দিকে চলে গেছে খালটা। এর দক্ষিণে বিসত্মৃত ধানিজমি, তার মধ্য দিয়ে বিটুমিনের চওড়া রাস্তা গেছে কচুয়ার থানা সদরে, আরো ওধারে সানপুকুরিয়া, গ্রাম-গেরস্তদের পাশাপাশি বসত। এখান থেকেও ব্যস্ত পায়ে ঝাঁকা-ধামা-থলি-বস্তায় মাল এনে মানুষ বেচাকেনা করে।
আজকের মতো হাট শেষ। খরিদ করা সওদাপাতি, ঘরসংসারের ভোগ্য বিষয়াদি নিয়ে গাঁয়ের গাবদাগোবদা জোয়ান গুটানো পায়ে শেষ আলোর মধ্যে ফিরছে। বয়সীদের ত্বরা বেশি। আঁধার ঘন হওয়ার আগেই আগুয়ান পায়ে তাঁরা নিজের সাকিনে ফিরতে চায়। দোকানিদেরও কেউ কেউ শরীর তুলছে – ফেরার উদ্যোগে যে-যার বেসাত গোছগাছে মনোযোগী। পাশের শূন্য মাঠ আর বিলি কেটে দূরে উধাও সরু খাল, নল শরবনের ওপর দিয়ে দস্যি হাওয়া বহে এসে হাটের মুখের বড় গাছের গোল গোল পাতায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ছমছমে আওয়াজ তুলছে। হাটে আসার পর পরান ম-লের মন এখন যথেষ্ট খারাপ। আশাভঙ্গের দুঃখে ভেতর থেকে বুজে আছে সে। বেচার জন্য হাটে থলেভর্তি খাঁড়ি সুপারি এনেছিল। উপযুক্ত দাম পায়নি সে। তার ইচ্ছা ছিল সুপারি বিক্রির টাকায় কেরোসিন, রান্নার তেল, লবণ, কেজি দুই আটা, ব্যঞ্জনাদির মশলা কিনবে। মনের চাহিদা পূরণ হলো না। গত হাটের পর সুপারির দাম হঠাৎ করে কমেছে, ধুরন্ধর পাইকার থেকে আদৌ যোগ্য উত্তর জানা যায়নি। তার মতো যারাই সুপারি এনেছিল, সবাই পড়তি দামেই বেচে দিয়েছে। উপায় নেই – ঘর-খরচার জন্য আর রোজগার কই! পরান ম-লও রোদ খাওয়ানো বাছাই করা খাঁড়ি সুপারি ঠেকায় পড়ে ছেড়ে দেয়। বাধ্য হয়ে প্রাপ্ত টাকার কেনাকাটায় হাত তাকে খাটো করতে হলো।
এতোক্ষণ ক্ষুণ্ণমনে পরান ম-ল মানুষের বিরক্তির হট্টগোল থেকে খানিক বাইরে একফালি ঘেসো জমিনে বসা। এভাবে সে আর কতক্ষণ থাকবে? গুষ্টির সেবার চাপে, কি প্রায় তিনকাল বয়সের ভারে একলা হলে নিঃসঙ্গতায় নিজেকে তাঁর অসহায় মনে হয়। সুধীর গেল কই? ছেলে না-এলে তো সে রওনা দিতে পারছে না। ভিড়ের ফাঁকে দুবার চেহারা দেখিয়ে বাপের সামনে থেকে নিজেকে মুছে দেয় ছেলেটা। তাঁর ভঙ্গি হচ্ছে, সুপারি এনেছো বেচো তুমি, হাটের এতো লোকচোখের সামনে অমন সস্তা কাজে নিজের দাম পয়মাল করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব। ফাজিল ছেলে, বাড়ির অন্নজল খাচ্ছিস, বুড়ো বাপের খাটুনির ওপর এখনো বেঁচেবর্তে আছিস, তার জন্য মুখের আহার্য জোগাড়ের কোনো চেষ্টা থাকবে না। ঘোর কলিকাল, চাষাভুষোর বাচ্চারাও পারলে হালের গরু বেচে সরগরম ফুর্তিফার্তা করে। এই যে সুধীর, আয়-কামাইয়ে মুরোদ নেই, হাত নিষ্কর্ম রেখে মুখে খই ফোটাচ্ছে, হাটের কোথাও এখন ইয়ার-দোস্তদের সঙ্গে গুলতানিতে মশগুল। বাজার নিয়ে কাহিল হাতে টানতে টানতে একাই তাকে ফিরতে হলে মাঝপথে ঝুপঝাপ নেমে আসা অন্ধকারের মুখোমুখি হতে হবে, তখন উপায়! কোনো আক্কেল আছে ভেরেন্ডাবাজ ছেলেটার? ধুর, বিরক্ত হয়ে পরান ম-ল হাঁটুতে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ান। তখুনি কোত্থেকে সুধীর হুট করে এসে হাজির। এতোক্ষণ সে যেন জন্মদাতার পেছনেই দাঁড়ানো, ডাকতে হবে কেন, মাথায় তার ঘিলু আছে না। চোখ কি তার আজকে ফুটেছে। বাবার জন্য দায়িত্ব পালনে তার বুদ্ধিশুদ্ধি কি কম। হাত বাড়িয়ে বাজারের থলেটা তুলে নিয়ে সুধীর তাড়া দেয় – ‘চলো, বেলা পইড়ে গ্যাছে।’ বুড়ো বাবাই বুঝি অযথা সময় নষ্ট করেছে।
তালেশ্বরের এবড়োখেবড়ো রাস্তা ধরে মালবোঝাই ভ্যান ফিরছে। কিনারায় সরে তাই জায়গা ছাড়তে হচ্ছে। বাবার বাঁ-কনুই আঁকড়ে ধরে আছে সুধীর। নিচের অনাবাদি মাটির খাদে সে ভুল করে যেন গড়িয়ে না পড়ে। তাহলে দুর্দশার শেষ থাকবে না – হাত-পা গুঁড়ো হতে পারে। হুঁশিয়ার হয়ে সুধীর তাই বাবাকে নিয়ে দ্রুত সরু রাস্তার দূরত্ব ভাঙছে। কানের কাছাকাছি ছেলের ঘন শ্বাস ফেলার শব্দ ধরে পরান ম-ল পরিষ্কার বোঝে, এটা জলদি পা ফেলার কারণ না, হাটে খোকা তাঁর জোর বিড়ি টেনেছে, ওই ধোঁয়া সেবনের প্রভাবে এমন দম ফেলছে সে।
মঘিয়ার মাঝামাঝি রাস্তার দুপাশে সারিসারি বটগাছ, এখানে এসে অন্যদিনের মতো পরান মণ্ডল উত্তরে মুখ করে দাঁড়িয়ে যায়। একাত্তরে রাজাকাররা ভাসার বাজার থেকে হাটুরে পঁচিশ-ত্রিশজনকে ধরে এনে দাঁড় করায়। কচুয়া অবধি নিয়ে যেতে যেতে মঘিয়া আসতেই প্রায় সন্ধ্যা। মুক্তিবাহিনীর ঝটিকা আক্রমণের ভয় আছে। আটক সবাইকে রাস্তার পাশের গাছের সঙ্গে রাজাকাররা বেঁধে ফেলে। সে কি আজকের কথা! ছেচল্লিশ বছর আগের মানুষ মারার ঘটনা। দিনক্ষণ সব পরান ম-লের মনে আছে। আশ্বিনের আটাশ তারিখ, শুক্রবার ছিল। হোক বয়স, শরীর রুগ্ণ, দুর্যোগ যায়-আসে, তবু একাত্তরের স্মৃতির ওপর কিছুতেই সে ধুলো জমতে দেয়নি। কপালে এখন প্রতিমুহূর্তে মরণ, বাঁচার জন্য দৌড়ঝাঁপ, কেমনে ভুলবে মানুষ! রাজাকারদের হাতে রামদা, রাইফেল – এক-একটা কোপ দিয়ে কারো দেহ থেকে মাথা কেটে ফেলে। কারো কারো ঘাড়ে-বুকে গুলি ও বেয়নেট ঢোকানো হয়। উল্লাসের সঙ্গে রাজাকারদের মুখে গালির তোড় – কুত্তার বাচ্চারা সব মালাউন, জয়বাংলা মারাও, শেখ মুজিব তোগো বাপ, তোরা মুক্তিবাহিনীরে খাতির করিস? বেছে বেছে ম-ল, হালদার, পাইক, সমাদ্দার, মিলিয়ে মোট পনেরোজনকে রাজাকাররা এখানে হত্যা করে। বাকিদের মারধর করে ছেড়ে দেয়। এরা সবাই ছিল সরল-নিরীহ কৃষিজীবী, ক্ষেত-খামারি, মাটির ঢেলায় মুগুরমারা খাটুয়ে, আটপৌরে সংসারী। সাতে-পাঁচে না-থাকা নিতান্ত সাদা লোক। ভাগ্য বটে পরান ম-লের! ভাবলে আজো নিজের কপালে সে হাত ঠেকায়। নিশ্চয় বাপ-দাদার পুণ্যফলে ওইদিন বেঁচে গেছে সে। রাজাকারদের অতর্কিত হামলার আগে আগে কী খেয়ালে সে বাজার ছেড়ে চলে এসেছিল। বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে সে গুলির শব্দ পায়। বাতাস পীড়ন করে অতগুলো মানুষের মরণ আর্তনাদ উড়ে এলে ভয়-তরাসে পুরো তল্লাট চমকে যায়। মঘিয়ার প্রাণনাশের ওই বধ্যভূমির সামনে এলে মানুষগুলোর উদ্দেশে পরান ম-ল আজো প্রণাম করে। আহা রে, একাত্তরে অগুনতি মানুষ মরল, হাটে-মাঠে-ঘাটে-জলে রক্ত আর রক্ত, অথচ এতো বছর হলো যুদ্ধে ছিন্নভিন্ন দেশের ভীষণ ক্ষতি এখনো সারল না। কোথাও শাস্তির ছিটেফোঁটাও নেই। গ-গোল, ভাঙচুর থেকে রেহাই পাচ্ছে না, জনপদ মফস্বল গ্রাম দেশ।
পুরনো ও হালফিল অবস্থা নিয়ে জেগে ওঠা আফসোস বাতিল করে পরান ম-ল পেছন ঘুরতেই কেবল তার ছেলে সুধীর না, খুব কাছাকাছি পারলে পা-র মধ্যে ঢুকে যায় এমন আরো কয়েকটা মুখ দেখে সেই মুহূর্তে স্থির হয়ে যায়, সে কি ঠিক দেখছে? নাকি আঁধার পুরোপুরি ঘেরাও হওয়ার আগেই চোখে সে ভুল দেখছে? রাস্তার দুপাশের সরকারি গাছের ডালপালা ধরে দ্রুতচারী আঁধার নেমে আসছে। ওই সদ্য অন্ধকার সন্ধ্যাতারার উদয়কে স্বাগত জানাতে উঠে পড়ছে আকাশমুখে। কিন্তু কারা এরা? এগুলো কি মানুষের মুখ, না দানব-কিসিমের ষ-া – কোনটা? ভুঁইফোঁড় চেহারাগুলোয় যারপরনাই নজর ধরার আগেই এক গোঁয়ার গলার ঘড়ঘড়ে আওয়াজে চরাচর বুঝি কেঁপে যায় – ‘ওয় মালাউন বুইড়া, অ্যাই দ্যাশে কি থাকতে চাও? মনে কয় চাও। তয় আমাগো জন্যি খাতির-উতির তো চাই। খরচাপাতি না দিয়া ভিডেমাডিতে ক্যামনে থাকবা তোমরা? আমাগো সিদ্ধান্ত, কাইল তোমার বাড়িতে যাবোআনে। ট্যাকাপয়সা রেডি রাইক্ষো। কাউরে কইছো তো কল্লা নাই। এহন মুখ বুইজ্যা ভালোয় ভালোয় যাও।’ কোনো এলাহী ব্যাপারের জন্য এই ইষ্টদেবতারা এমন জরুরি নির্দেশ যেন জারি করল। একযোগে সবাই পায়ের তলে ক্ষুর ঘষে। এতেই পরান ম-লের ইহজীবনের পরিণতি পরিষ্কার হয়ে যায়।
খামোকা সুধীরের ঘাড়ের ওপর মর্দানি দেখানো থাপ্পড় মেরে রুষ্ট জন্তুগুলো নখপায়ে সরে যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় পরান ম-ল আকাঠ। কোনো নড়াচড়া নেই। তাঁর মাথার মগজ কি গলে গেছে? না হয় কোনো জাগরণ, কোনো ভাবনা কেন কাজ করছে না? বিস্ময়ে জমে যাওয়া বাবার হুঁশ ফিরিয়ে আনার জন্য তাঁর হাত ধরে সুধীর টানে – ‘এই দ্যাশে থাকতি হলি এমুন কত্ত কী হবে।’ পরান ম-ল আরেক দফা চমকে যান। এ কি তাঁর ছেলের স্বর, নাকি কোনো মুরবিব মনঃকষ্ট নিবারণে তাঁকে প্রবোধ দিচ্ছে। – ‘ছেইলেগুলো কারা রে?’ পরান ম-লের কাঁপুনিধরা আধফোটা জিজ্ঞাসায় সুধীর অত্যন্ত পিষ্টস্বরে ঠোঁট উলটায় – ‘আর কারা? যাগো দ্যাশ, তাঁরা।’ ছেলের হাতের মুঠোয় কাবু বাহু চলে গেল পরান ম-লের, এবার সত্যি সত্যি মনে হয় সে যেন উড়ে চলেছে।
পরদিন ঝকঝকে দুপুরের টাটকা রোদ মাত্র চড়েছে, নিশিভেজা উঠোন, টিনের চাল, ক্ষেত-খামার, তল্লাট শুকিয়ে ক্রমে উষ্ণ হয়ে উঠছে, তখুনি উত্তরের খোলা প্রান্তর পাড়ি দিয়ে পাঁচ জল্লাদ হেস্তনেস্ত জোশে উঠোনে এসে দাঁড়ায়। এদের চোয়াল কিড়িমিড়ি, কোমরের লুঙ্গি ভাঁজ দিয়ে হাঁটু পর্যন্ত গুটানো। পারলে এখুনি গোড়ালি ঘষে উঠোনের মাটির চর্বি কেটেকুটে এরা কুচিকুচি করে দেবে।
নষ্টজন্ম থেকে এদের মেজাজ যেন জিহবার সঙ্গে ফিট করা আছে। হেঁড়ে বুলি তাই বদকণ্ঠ ছিঁড়ে উড়ে আসতে দ্বিধা করে না – ‘বুইড়া মালুডা কই? মাউলার ছাগলা ছেলেডা বা কই? কাইল কইয়া দিছি না, চান্দা রেডি রাহিস। কই গ্যাছে মাউলার বাচ্চারা?’
কার এই ঘেয়োকুত্তা গলার নোংরা হুঙ্কার। রঘুনাপুরের মহেরউদ্দিনের, কুদ্দুসের, না চাড়াখালি গ্রামের সাইদুলের, না শুক্কুরের? নাকি গোটা এলাকার ঘাড়ে বাড়ন্ত পরখেকো লুটেরাদের দূষিত স্বর একযোগে ফুকরে উঠেছে?
এ-সময় সুধীরের কনক বর্ণের মালতী বোনটা দক্ষিণের জঞ্জালের গাদায় পুজোর বাসি ফুল ফেলে ঘরের কানাচ ধরে দেবীপায়ে ফিরছিল, এতোগুলো অচেনা লোভী নজর থেকে রক্ষা পেতে মেয়েটা দ্রুত রান্নাঘরের আড়ালে সরে যায়। এক মদ্দার ধারালো নজর তখনো ফসকায়নি, তাঁর কণ্ঠার খাঁজে লঘু রস কোলাহল করে ওঠে – ‘মালডা তো চোমৎকার।’
পরান ম-ল তাঁর পুরনো খড়ো দোচালার মধ্য থেকে নিতান্ত নগণ্য পোকা হয়ে বেরিয়ে আসে। হাত জোড় করে গলে যেতে যেতে নিজের শিরদাঁড়া এবার হারিয়ে ফেলে সে। তাঁর গলায় প্রাণ বাঁচানোর ভেজা গোঙানি – ‘বাবারা, আমি হচ্ছিগে ভাঙাচোরা, গরিবগুর্বো মানুষ। আমার আর আয় কী? কলাডা, শাক-লতাপাতা, কয়ডা ধানের বিচি, সুপোরি-উপোরি বেচে খাই। তোমাগো সনমান করার উপযুক্ত আমি না। ক্ষমা-ঘেন্না করে আমারে তোমরা রেহাই দাও।’
কেউই পরান ম-লের ছেঁদো কথায় পাত্তা দেয় না। তার উপেক্ষিত বচন উঠোনে খসে পড়ে এলোমেলো ছড়িয়েই থাকে। বরং উত্তরের বাগান ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা আরো দুই ক্ষণচরকে পরম সখাজ্ঞানে জড়িয়ে ধরতে দুর্বৃত্তরা এগিয়ে যায়। নিচুস্বরে নিজেদের মধ্যে কীসব কথা বলে। এরপর তাদের খুশির জোর হল্লার ধাক্কায় ঘর-দরজা, উঠোনের এককোণে খুদকুঁড়ো খুটে খাওয়া শালিকগুলোও ভয়ানক চমকে যায়। একজনের গলায় অধিক উচ্ছ্বাস – ‘আমি চিনিরে। দামি মাল। দর মেলা হবেনে। গাছডায় সার আছে। বুঝিছিস তোরা, ওডাই ফাইনাল।’
দুই গাইগরুরে ভাতের ফ্যান খাওয়াতে সুধীর ছিল গোহালে। এখন খালি বালতি নিয়ে লটপট দোলার চালে উঠোনে ফিরে মুহূর্তে গেঁথে যায় সে। চলৎশক্তি বুঝি হারিয়ে ফেলে। চাহনিতে ধাঁধা লাগার আগেই তা বাঁকা হয়ে যায়। কাল হাটফেরত সন্ধ্যার মুখে এই নিষ্ঠুর দাঙ্গাবাজরা হুমকি রেখে এক রাত পর দিনদুপুরে সত্যি সত্যি বাড়ি এসে চড়াও হবে – এতোটা সে অনুমান করেনি।
সুধীরদের নড়বড়ে বাড়িটা শূদ্রপাড়ার শেষ মাথায় – খানিকটা জঙ্গুলে পরিবেশে। চৌহদ্দির পাশে আর ঘরবসতি নেই। জলকাদা, ঝোপঝাড়ে ঘেরাও এই গ– থেকে ডাকাতপড়া ত্রাহি চিৎকার করলেও কেউই সাড়া দেবে না। বরং হাঁকডাক-চেঁচামেচির কারণে আখেরে বিপদ। হাটে-মাঠে যে-কোনো আঘাটায় এই দুষ্কর্মকারীদের অতর্কিত আক্রমণে প্রাণটা যেতে পারে।
বিকটাকার পেটা শরীর, থ্যাবড়া পা, চৌকো চোয়ালের কালো এক অসুরের গলা সম্মিলিত পরামর্শশেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে – ‘ওই বুইড়া, তোমার বাগানে অ্যাট্টা গাছ বাছাই করছি আমরা। ধরো, ওডাই তোমাগো চান্দা। দিছো আমাগো। আমরা মহববতের সঙ্গে নিছি। ঠিক আছে। আর কোনো কতা না।’ থেমে নতুন করে দম নিয়ে সে যেন চাঙ্গা হয় – ‘তয় গাছ যুদি না দাও, ফাল পাড়ো, তয় কই, তোমার মাইয়েডা তো খুবসুরত -।’ হাতের তুড়ি বাজিয়ে দানবটা দুশ্চরিত্র ইচ্ছার জানান দেয়।
মাইয়েডা শুনতেই সুধীরের হাতের বালতি আলগোছে খসে পড়ে। এই পতনের শব্দ জব্দ করার বা ভয় দেখানোর কারণ ধরে এক গাভুর সুধীরের উদ্দেশে তেড়ে গেলে আরেক গাবদা তাকে নিবৃত্ত করে – ‘ধুর, রাখ অ্যাইসব। সোময় কম। গাছ নিতি আইছি, গাছ নেবো, নেয়াডা আগে।’ দলের একজনকে সুধীরের কেমন চেনাচেনা লাগে। স্মৃতির ওপর স্মরণ টেনে গেলে মনে পড়ে, বয়ারসিংহ গ্রামের বাবলু মোল্লা। বছরখানেকেরও কম এই ফাজিলটা স্কুলে তাদের ক্লাসে ছিল। তারপর সে হাওয়া। সুধীরের তন্নতন্ন দৃষ্টির সামনে চেনামুখ ঢাকতে বাবলু কোমরের গামছা খুলে মাথায় ঘোমটার মতো পেঁচিয়ে নেয়।
এতোগুলো চোখের রুক্ষ নজরদারির সামনে নিরুপায় পরান ম-ল এখন কী করে? পারলে গোকুলের সব ষাঁড়ের সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে ঘোর বিপদ থেকে এখন সে উদ্ধার পেতে চায়। ছেলের ওপর সে গুপ্ত বিবেচনা ছুড়ে দেয়। এমন চাওয়ার একটাই অনিবার্য অকথিত মানে – আগে জীবন, বাঁচলে পর গাছ লাগালে গাছ হবে। হিন্দু প্রাণের যেখানে কোনো মূল্য নেই তো গাছ। এই দেশে এই মাটিতে তারা বুঝি অস্থায়ী বাসিন্দা, যেন পরবাসী। যাগো দ্যাশ তাদের সঙ্গে আবার কোন্দল? এতো সাহস গলায় তুলসীর মালা আর ধুতিপরা ম-ল কেমনে রাখে।
বজ্জাত হিংস্র জোট উঠোন ছেড়ে উৎসব তৎপরতা নিয়ে এবার বাগানে ঢুকে যায়। সুধীরকে দূরে কোথাও গা-ঢাকার ইশারা দিয়ে সাবধানী পায়ে পুকুরপাড়ের উঁচু খ– এসে পরান ম-ল দাঁড়ায়। এখানে গাছপালার জড়াজড়ি বেশি হলেও তার ফাঁকে ফাঁকে চোখের আলো মেরে দেখাদেখি তার জোড়া দিলে সে পরিষ্কার হয় – উত্তর-পশ্চিমের সবচেয়ে বড়, পগারের পাশে দাঁড়ানো প্রায় পনেরো-ষোলো বছরের চাম্বল গাছটাই দুরাত্মাগুলো দখল করেছে। ওই চাম্বলের কাঠে দারুণ সব টেবিল-চেয়ার-খাট আসবাবপত্র হবে। যথেষ্ট দাম উঠবে গাছটার। মালতীর বিয়ের খরচের মোটা একটা অংশ বাবদ চাম্বল গাছটা পরান ম-ল ধরে রেখেছিল। প্রলয়ঙ্কর সিডরের পর ভেঙেপড়া গাছ বাঁশ কেনার তল্লাশে আসা ভিন চাকলার কাঠুরিয়ারা তখুনি সটান চাম্বলের জন্য বাইশ হাজার টাকা বলেছিল, দেয়নি সে। দেখো, এই বয়সে কী ধুরন্ধর এরা, গাছকাটার ব্যবস্থা ঝোপের মধ্যে আগেই লুকিয়ে রেখে বাড়ির মধ্যে ঢুকেছিল। না হয় কুড়াল-করাত কোত্থেকে এলো।
কুড়ালের পয়লা শক্ত কোপের খরখর আওয়াজ বাগানজুড়ে হাহাকার রচনা করে পরান ম-লের কাছে উড়ে এলে তার বুড়ো বলশূন্য শরীর সহসা কেঁপে ওঠে। এই চাম্বল গাছের মোটা সারালো গোড়ায় কোপ অনেক লাগবে, কাজটা অতো সহজ না, কিছুতেই গাঁটের অংশ, গেরো-জোড়, ডালপালা, উপরিভাগ, আগা, মাথা খ- খ- হয়ে মাটি ছোঁবে না। পরের ভারি ধারালো আঘাতের চোট সব এবার বুঝি চাম্বল হয়ে পরান ম-লের সর্বাঙ্গে এসে পড়ে। আহা, এতোদিন চোখে চোখে যত্নে-রাখা গাছটা পর হয়ে গেল ভাবতেই তাঁর বুকের খুব গভীর থেকে আসা অবাধ্য কান্না এখন কেমনে সে সামাল দেয়।