স্বপ্নেই দেখতে পেলাম আমার মৃতদেহ পড়ে আছে আমারই অপরিপাটি বিছানায়। কী করে হয়! তেমন কোনো ঘাতক রোগের ছিটেফোঁটা দুদিন আগেও আমাকে নিয়মিত দেখার ডাক্তারের চোখে পড়েনি। বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি দেখছি। মুখে মৃত্যু-যন্ত্রণার কোনো গুরুতর চিহ্নও নেই, নিয়মিত গোমরা-ঘেঁষা এক নিঃসঙ্গ মুখম-ল, ডানদিকের ওপরের ঠোঁটের নিচে ছেলেবেলায় শোবার ঘরের মাচা থেকে পড়ে গিয়ে কাটার দাগটিও জ্বলজ্বল করছে। সে-বছর অসময়ে পাহাড়ি ঢল নেমে বান হওয়ায় ঘরের ভেতর উঁচু মাচা করেছিল কাঠ ও বাঁশ দিয়ে। ওটা আর ভেঙে ফেলা হয়নি বান চলে যাওয়ার পরও। কোমরসমান উঁচু সেই মাচায় উঠতে হয় হাঁটুসমান উঁচু করে পোঁতা মোটা একটা খুঁটিতে পা দিয়ে। সেখান থেকে পা পিছলে পড়ে গিয়ে আমার ঠোঁটে চিরস্থায়ী দাগটা বসে যায়। ওখানে সেলাইয়ের চিহ্নটাও আছে। আর মৃত্যুর সময়ের ক্ষীণ বেদনাটাও থেকে যায়! ওখানে অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে চুম্বনের স্মৃতিরাও আছে।
নিঃসঙ্গ জীবনের সঙ্গীহীন মৃত্যু দেখে খুব একটা চিন্তার উদয় হলো। সঙ্গে সঙ্গে সেই চিন্তা ডালপালা মেলে বেড়ে যেতে লাগল। জীবন্ত আমির সামনে শুয়ে আছে আমার সদ্য মৃতদেহ, যা একেবারেই অসম্ভব, অথচ তা ঘটমান বর্তমান হয়ে আছে। এই মৃতদেহ নিয়ে এখন আমি কী করি! রাত কত জানি না, রাতের খাবার খেয়েছি কিনা, উচ্চ রক্তচাপের নিয়মিত ওষুধ সকালে খেয়েছিলাম কিনা, ঘুমোবার আগে সর্দির পিরিটন বড়িটা পানি ছাড়া খেয়েছি নাকি ভুলে অন্য কোনো ওষুধ খেয়ে ফেলেছি তা মনে করতে গিয়ে নাগাল পেলাম না। দেয়ালঘড়িটা তিনটা তিন মিনিটে আটকে পড়ে আছে নিশ্চিন্তে। হৃষ্টপুষ্ট টিকটিকিটাও দেয়ালের কোথাও নেই। চোখ না ফোটা ছয়টি ইঁদুরছানা খুব আস্তে আস্তে ঘরময় হাঁটছে, ওদের মা কি মরে গেছে বলে ওরা ক্ষিদে-পেটে খাবার খুঁজতে বেরিয়েছে!
তার চেয়ে আসন্ন চিন্তা হয়ে পড়েছে আমার মৃতদেহ আমিকে নিয়ে। সকালে আমার মৃতদেহটি নিয়ে যে-সমস্যার উদ্ভব হবে তা একা আমি সামলাব কী করে! আমি আগ বাড়িয়ে পাশের বাড়ির লোকজনকে ডাকতে যাব, নাকি কেউ এসে দেখে ফেললে আমি তৎপর হয়ে উঠব! সকালে হুট করে কেউ এসে পড়বে, তাও প্রায় হওয়ার কথা নয়। কাজের মেয়ে রোকাইয়া তিনদিন আসে তো চারদিন আসে না। মাঝে মাঝে ওর মাকে পাঠিয়ে দেয়। রোকাইয়াকে নিয়ে আরো সমস্যা আছে। সে প্রায় সময় আমার স্নানঘরটি নিজের মতো ব্যবহার করে বসে মজার লুকোচুরি খেলার মতো। সেসব সমস্যা সমাধানের সময় এখন নয়। তার আগে দরকার মৃতদেহটি সরিয়ে ফেলা। ওটা যে আমার মৃতদেহ নয়, তাও বলব কী করে! আমার ডোরাকাটা পাজামা, গায়ের বুকখোলা ফতুয়া, পাশে পড়ে থাকা নীল-সাদা রুমাল, বুকের ওপর আঙুল রেখে বন্ধ বইটি, আর বইটিও ২০০৫ সালের ১৫ জুনে উপহার পাওয়া, লেখক ইয়াসুশি ইনোয়ের দ্য হান্টিং গান, যেটি আবার পড়ব বলে গতকাল খুঁজে বের করেছি। তার আগে এখন প্রধান কাজ হচ্ছে আমার মৃতদেহের উপযুক্ত সৎকার করা। তাও গোপনেই করতে হবে। আগামী সকালে হলে জানাজানি হয়ে যাবে, মহা হইচই ও কেলেঙ্কারিতে পড়ে যাব। হ্যাঁ, তা আমার এই বেঁচে থাকা দেহটি যদি আমার হয় তা হলে মৃতটি কে! আর মৃতটি যদি আমি হই তা হলে বেঁচে থাকা আমিটিই-বা কে! ওহ্।
আমার ঘরের তিনটি কামরা। পুরনো আমলের। দক্ষিণমুখী ও সামনে খোলা বারান্দা। কড়িকাঠ দিয়ে ছাদ ও বারান্দা খিলানো। একচিলতে উঠোন ঘিরে আছে নারকেল ও তালগাছ। মেঘ, রোদ, হাওয়া, জ্যোৎস্না ও বৃষ্টির খেলার জন্য ওদের মধ্যে নিজেকে কখনো একা মনে হয় না। পৈতৃকসূত্রে পেয়েছি সাত কাঠার ওপর শহরের এই বাড়ি। বাড়িতেই আমার মৃতদেহ সমাহিত করব সিদ্ধান্ত নিলাম। উঠোনের কোণে বা ঘরের পেছনের একচিলতে জায়গায় আমাকে ঠেসে দিতে পারব না। আকাশের তারারা এসে বললেও নয়, যদিও জানি যে, এই আঁটকুড়ে স্বভাব কখনো ওদের মধ্যে গজায় না। নিচের পড়ার ঘরেই সমাহিত করার জ্বলন্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ শুরু করে দিলাম। আশ্চর্য, এই কাজে একটুও বেশি সময় লাগল না গাছপালা পরিচর্যার শাবল-গাঁইতি দিয়ে নিজের কবর খুঁড়তে। ঘরের মেঝে লেপা-পোঁছা করে লেফাফা-দুরস্ত করতেই সময় লাগল বেশি। পাতকুয়ো থেকে পানি আনতে হলো না শেষ পর্যন্ত। নিজের লাশকে শেষবার স্নান করা থেকে বিরত রাখতে পারলাম না। এই সংস্কার কয় হাজার বছরের তা জানি না। তারপর নিজের স্নানও খুব দরকার হয়ে পড়েছিল পড়ন্ত গরম ঋতুতে। আহা স্নান, অবগাহন এবং নিজেকে নিজে সমাহিত করার দুর্লভ সুযোগ, যা আগে কেউ কোনোদিন করতে পেরেছে বলে আমার জানা নেই। আমার মা আমার ছেলেবেলায় একবার বলেছিলেন, তিনি তাঁর মৃত্যুর ঘটনা দেখতে পেয়েছিলেন। মায়ের যে-তিনটি স্মৃতি মনে আছে তার মধ্যে এটি অন্যতম। সেই থেকে আমিও আমার মৃত্যু দেখার জীবন্ত কল্পনা করতে করতেই কি এই অবস্থায় এসে পৌঁছেছি? ধোপার কাছ থেকে এনে রাখা সাদা চাদরটি দিয়ে আমার মুখটি ঢেকে দেওয়ার সময় ঠোঁট কেঁপে ওঠার বিরল দৃশ্য দেখেছিলাম। পাশে অন্য কেউ কি না থাকায় অবাধে দেখতে পেয়েছিলাম! আমার মৃত্যু সম্পর্কে সেটিই আমার শেষ সুখস্মৃতি। জীবনের জন্য মৃত্যু যে অবিচ্ছেদ্য তা মৃত আমি আমাকে নিজের মুখে বলে গেছে সেদিন। আমার মৃত্যুর শোক কাটাতে এই স্মৃতি আমাকে খুব সাহায্য করেছে, তবে এ-কথা আমি আজ পর্যন্ত কাউকে বলতে পারিনি।
এরই মধ্যে আমার ঘর সম্পর্কে প্রধান একটা কথা বলা হয়নি। আমার ঘরটি তিন কামরার হলেও তার নিচে ভূগর্ভে সেরকম তিনটি কক্ষ রয়েছে। নিচে নামার সিঁড়িটি বেশ প্রশস্ত করে বানানো হয়েছে, বোধকরি ঘরের জিনিসপত্র খুব সহজে যাতে নামানো-ওঠানো করা যায় সেজন্য। তার মধ্যে একটি কক্ষে বইপত্র ও একটি ছোট প্রাচীন পালংক আছে। আরেকটি কক্ষ এখন প্রায় ভাঁড়ার ঘরের রূপ নিয়েছে। ওখান থেকে হরিণ-মোষের শিংসহ মাথার কঙ্কালের মাত্র দুটি পড়ার ঘরের দেয়ালে ঝোলানো হয়েছে। হরিণ ও বাঘের চামড়াদুটি এখনো অক্ষত আছে। আরেকটি কক্ষ প্রায় খালি, সঙ্গে আছে শৌচাগার। আমার ঘর রক্ষাকারী দীর্ঘদিনের পরিপোষক আবদেল খুড়োকে গ্রামে পাঠিয়েছি জমিজমার কাজগুলো করে আসতে। ওসব কাজ এখন আমার আর করতে ইচ্ছা করে না। গ্রামের বাড়িটাও একজন পাহারাদারের জিম্মায় পড়ে আছে। এ সবকিছুর চেয়ে এখন বড় হয়ে উঠেছে আমার সদ্য-মৃত শরীর, যার আপাত-ব্যবস্থা একটা করে নিয়েছি। ওটা গোপনীয় বলেই প্রধান সমস্যা হয়ে আছে। কাউকে খোলাখুলি বলে যে ভারমুক্ত হব তাও হওয়ার নয়। সবাই নানারকম পরামর্শ দেবে, ডাক্তারের কাছে যেতেও বলতে পারে। আর অনেক ভুঁইফোড় হিতৈষীও জুটে যেতে পারে, এবং প্রকাশ্যে।
পরদিন ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামতেই সদ্যপরিচিত অপ্রতিরোধ্য এক মহিলার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আমি ওকে এড়ানোর জন্য পেছন হয়ে ঘরের ফটকের দরজায় তালা দিয়ে উলটোদিকে চলে যেতে পা বাড়ালাম। সে ছুটে এসে একথা-ওকথা বলে তালা খুলে ঢুকে পড়তে বাধ্য করল একরকম। ঘটনার শিকার হয়ে ওকে নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে সে প্রায় প্রগলভ হয়ে উঠল। এঘর-ওঘর ঘুরে দেখতে দেখতে সে আবিষ্কার করে ফেলল ভূগর্ভঘর। অবাক হয়ে সে আমার গা-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ডান হাতখানা তুলে নিল। আশ্চর্য কোমল ওর করতল ও আঙুল। আঙুলগুলো প্রায় স্বচ্ছ। চোখাচোখি হতেই দেখি ওর চোখ-দুটো ছোট হয়ে আমার মুখ থেকে আস্তে আস্তে শরীরের বহু ভেতরে চলে গেছে। একসময় সে আমাকে বগলদাবা করে নিয়ে ঢুকে পড়ছে পড়ার ঘরে। হরিণ ও মোষের শিঙের কঙ্কালের নিচে দাঁড়িয়ে পড়ল। ঠিক তার নিচেই আমার সদ্য কবর শান্ত-কল্যাণ হয়ে আছে। সঙ্গে আমার মাথা ঘুরে উঠল, একই সঙ্গে সে আমার চুমোর জন্য তপ্ত হয়ে উঠল প্রগলভতায়। নির্ভীক ও অকুণ্ঠিত। দেয়ালের মোষের শিংসহ কৃত্রিম চোখদুটো জ্বলজ্বল করে উঠল। হরিণের চোখদুটো স্নিগ্ধ ও তরল-কোমলতায় ঢেউ খেলে চলেছে। আমার আরো মনে হলো, আমাদের পায়ের নিচের কবরটি মহিলাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। আমি জোর করে আমার অদ্ভুত শিহরণ নিবারণ করতে চেষ্টা করছি। সেও বোধহয় ওর শিহরণজনিত আবেশে আরো কাছাকাছি ঘিরে এসে আমার কাঁধের ওপর মাথা রেখে ফিসফিস করে বলল, আমি নতুন একরকম শিহরণ অনুভব করছি। আরো বলল, আমার খুব তেষ্টা পেয়েছে, একটু পানি দেবে।
আমি তাড়াতাড়ি ওকে ধরে নিয়ে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে টেবিলের ওপর থেকে গ্লাস নিয়ে বোতল থেকে পানি ভরে নিলাম। পুরোটা শেষ করে সে আবার চাইল। টেবিলের ওপর মিছরির বোতল আছে, সেটা নিয়ে বললাম, একটু মিছরি খেয়ে নাও আগে। তখন আমার দিকে সরাসরি তাকাল সে। ওর চোখে কি লজ্জা ছিল? অন্য কিছুর কথাও মনে এসেছিল। সেটা থাক।
পানি খেয়ে সে আমাকে ধন্যবাদ জানাল। ওর সুন্দর পা দুখানি থেকে পাদুকা খুলে রেখেছিল ঘরের দরজায়, সিঁড়ি দিয়ে নামার সময়। আমি ভেতরে ভেতরে এত উত্তেজনা অনুভব করতে লাগলাম যে, আমার মাথা ঘুরে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে আমিও পানি খেয়ে নিলাম। কী সুন্দর ওর ভুরু, নাক, কাঁধ ও বাহুযুগল! ওর লালচে হওয়া গাল ও কানের লতি স্বাভাবিকরূপে ফিরে আসাতে আরো সুন্দরী হয়ে উঠেছে। এ-সময় ওর শরীর থেকে যেন নারীর সুবাস বেরিয়ে আসতে শুরু করল। সে ঘরের একমাত্র চেয়ার ছেড়ে দিয়ে পালঙ্কের ওপর গিয়ে বসল। এদিক-ওদিক দেখার সময় ওর সুন্দর চোখদুটি দেখলাম ঢেউ তুলছে ভদ্রভাবে সামান্য ধাক্কা দিয়ে। এই সরল সামান্য ঠোকাঠুকির মাধুর্য আমাকে মুগ্ধতার আবেশে ভরে তুলতে লাগল। কিন্তু ও যদি জানতে পারে যে, এই ঘরের মধ্যে আমি একটি মৃতদেহ লুকিয়ে রেখেছি, তখন সাংঘাতিক তোলপাড় পড়ে যাবে। ওর এখনকার ঘন ও তরঙ্গায়িত মাধুর্য দমকা হাওয়ার মতো উধাও হয়ে যাবে, এমনকি ভয় ও বিস্ময়ে ঘর থেকে ছিটকে বেরিয়ে পড়ে লোক-জানাজানি করে দেবে। আবার ওর চোখে আমার চোখ পড়ল এবং সেখানে আমাকে গভীরভাবে জানার অনুসন্ধানী তৃতীয় একটি চোখ ফুটে উঠতে লাগল। মুহূর্তের মধ্যে দেখতে পেলাম আমার মৃতদেহটি সে দেখতে শুরু করেছে। ভয়ে আমি কেঁপে উঠলাম, আর সেটাও সে দেখে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে আমি ওর পেছন থেকে পাখির পালকের কোমল বালিশটি টেনে নিয়ে ওর শোবার ব্যবস্থা করে দিলাম। সেও কী এক আদরের সুবাস পেয়ে এলিয়ে পড়ার বাসনায় বিদ্ধ হয়ে উঠল। আমার আরো মনে হলো, এরই মধ্যে সে আমার মৃতদেহ কবরস্থ করার সব বৃত্তান্ত জেনে ফেলেছে। আর বালিশে মাথা রেখে আয়েশে ডুবে যাওয়ার আগে তেমনি নরম কোলবালিশটা ওর ভরা নদীর মতো ঊরু একটি তুলে চোখে-মুখে হাসি ফুটিয়ে জানিয়ে দিলো আমার মৃতদেহ কবরস্থ করার গোপনীয়তা। আমি বুঝে উঠতে পারলাম না, সে কী করে জানতে পারল আমার এই একমাত্র গোপনীয়তা। অমনি আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম আমার মৃতদেহের সঙ্গে ওরও কবর পাওনা হয়ে গেছে – ওর চোখে-মুখে তখন ভালোবাসা করার অগ্নিশিখা জ্বলজ্বল করছে।