উজানধলে ফেরা

শাহ আবদুল করিমের কলজেটা ছিঁড়ে যেতে চায়! এ কী করলেন হুমায়ূন আহমেদ! এ কী কা- তার! এতো বড় একজন জ্ঞানীগুণী মানুষ, এতো মহাত্মন; বিদায় দেওয়ার সময় সামান্য একটু সৌজন্যমূলক আলাপ করারও প্রয়োজন বোধ করলেন না! নিজে না এসে সম্মানীর টাকাটা কিনা পাঠিয়ে দিলেন ড্রাইভারের হাত দিয়ে! তার কুঁচকে যাওয়া গাল আর কপালের ভাঁজরেখার মাঝখানে গর্তে যাওয়া রক্তবর্ণ চোখে জল ছলছল করে ওঠে! টাকার খামটা হাতে নিয়ে হতবিহবল চোখে তাকিয়ে থাকেন শূন্যের দিকে। বাউলরা কি এতোটাই অস্পৃশ্য! এভাবেই উপেক্ষিত থেকে যাবে যুগের পর যুগ?

তুহিন সেই অন্তর্ভেদী উদাসীন চোখের দিকে তাকিয়ে তাড়া দিয়ে উঠল, ‘চাচা, টাকাটা একবার গুইন্যা দেখুইন!’

ওরে নাদান! আবদুল করিম কি টাকা গুনতে জানে? টাকার কাঙাল সে ছিল কখনো? তুমি কারে গুনতে কইছো টাকা, কারে – যে-মানুষটা কোনোদিন টাকার পেছনে ছোটে নাই, হাঁকপাঁক করছে খালি মানুষের ভালোবাসার লাইগা, সেই ভালোবাসার লাইগা জনমভর ডুবে আছে সুরের লহরে – তুমি গুনতে কইছো টাকা সেই মানুষটারে? তুমি কি জানো না তুহিন, টাকাই যদি গুনতাম, তাহলে আজ ঢাকা শহরের ধানম–তে কেন, বিলাতেও একটা বাড়ি থাকবার পারত! কি পারত না? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেন আবদুল করিম। প্রশ্ন করে আবারো নির্মোহ হয়ে যান।

মনের মধ্যে এসব ভাবনাচিন্তাকে প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক নয়। সারাজীবনই দেননি, তাই আজো সত্যকাম আছেন। টাকা বা খ্যাতি কোনোকিছুর লোভই বশীভূত করতে পারেনি। এমন নয় যে, নিজেকে তিনি বাউল বা ফকির ভাবেন বা ভাবতে চান, নিজেকে অতি সাধারণ মানুষ হিসেবেই গণ্য হয় তার; তাই দেহতত্ত্ব, নবীতত্ত্ব, বাউলতত্ত্ব ও সৃষ্টিতত্ত্বের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য গান বাঁধছেন, হতে পারছেন গণমানুষের শিল্পী! তবে এটাও ঠিক, মানুষের ম্যালে থাকার পরও, যে-বয়সে মানুষের মনে লোভ ঢোকে, লালসা ঢোকে, কামের গন্ধ পায়, জন্ম নেয় মোহ – সে-বয়সে কালনীর ঢেউ তারে উতল করেছে, মনের ভেতর জানি কেমন করে ঢুকে পড়েছে ফকিরির ফিকির। তা অবশ্য ঢুকতেই পারে, কেন ঢুকবে না? অভাবের সংসারে জন্ম নিলে কী হবে, ধলআশ্রমের সেই বাড়িতে জন্ম নিয়েই তো পেয়েছিল চাচাতো দাদা নসীব উল্লাহর স্নেহমাখা কোল! সে যে কী মরমি ছায়ার আশ্রয়ে বেড়ে ওঠা! দাদা তার কোনোদিন কোনো মায়া-মোহের কাছে বন্দি ছিলেন না। বিয়েশাদিও করেননি! সারাজীবন ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশ-বিদেশ! শেষজীবনে মুসাফিরি বাদ দিয়ে বাড়িতেই কাটাতে লাগলেন আল্লাহর জিকির-আসকার করে! মশগুল রইলেন শুধু আত্মসাধনে! দাদার কাছে যে কত ফকির আসত, কত সাধু-সন্ন্যাসী – হিন্দু-মুসলমান। লাউ বাজিয়ে তারা গাইত ভক্তিমূলক গান! আহা রে, কী সুন্দর যে কেটেছে দিনগুলো!

অভাব ছিল, দুঃখ ছিল – ছিল জ্ঞানপিপাসাও! কিন্তু লেখাপড়া যে করবে সে-সামর্থ্য সামান্যও ছিল না। বাবা খালি বলত, ‘আগে হইলো খায়্যা বাঁচা, তারপর লেখাপড়া।’ সেই বেঁচে থাকার তাড়নায়ই, যখন বালবাচ্চারা সব স্কুলে যায়, সে নিল রাখালগিরির চাকরি! বড় সহজ ছিল না সে-দায়িত্ব পালন। সেই কোন ভোরবেলা বড় মোড়লের গরু নিয়া ছোট চকের মাঠে মাঠে, ফিরতে ফিরতে কোনোদিন সূর্যাস্ত যায়, কোনোদিন বা হয়ে পড়ে মিনমিনা অন্ধকার! উদাস চরাচরে গরু রাখতে রাখতেই একদিন হঠাৎ গলা ছেড়ে গেয়ে উঠলেন গান, ‘ভাবিয়া দেখো মনে মাটির সারিন্দারে বাজায় কোন জনে…’। রাখালবন্ধুরা সেই গান শুনে অবাক হয়ে তাকায়। গোল হয়ে ঘিরে রাখে সবার মাঝখানে। বাড়ির মধ্যে পিরদাদার কাছে আসা কোন ফকিরের গানটা যে কবে মনের মধ্যে সেঁধিয়ে ছিল কে জানে? এভাবেই গাইতে গাইতে টের পান, গান তার রক্তের ভেতর! সারিন্দা ছাড়া চলব না কিছুতেই এই জীবনের গাড়ি!

গানের টানেই হোক কিংবা মরমি সাধনার ভেতর টানে – তাগিদ বোধ করলেন অক্ষরজ্ঞানের। নিজের চেষ্টায় ভর্তি হন নৈশ বিদ্যালয়ে। মাও চাইতেন ছেলে লেখাপড়া করুক। কিন্তু মা কি জানতেন, ছেলে লেখাপড়া শিখতে চাচ্ছে জজ-ব্যারিস্টার হওয়ার জন্য নয়? তাহলে কীজন্য? সেটা কি করিমেরও জানা ছিল – কেন ও পড়তে চায়, কেন ও নিতে চায় অক্ষরজ্ঞান? হিসাবের কারবারি যে ও কখনো ছিল না। সেজন্যই বুঝি পিরদাদা যখন মাঠে গরু রাখছিল, তখনই চিরবিদায় নেওয়ার সময় ওকে খুঁজতে খুঁজতে বলে গিয়েছিলেন, ‘আল্লাহর রহমতে সে ভালো পথে যাবে/ সময়ে সৎমানুষের ভালোবাসা পাবে।’

তা সময় কেন, সেই কৈশোরকালেই সৎমানুষের ভালোবাসা ও ঠিকই পেয়েছিল। পুঁথি-পুস্তক পড়তে পড়তে যখন একতারা ধরলেন – বাউল হওয়ার চৈতন্যে আচ্ছন্ন হলো মন; আরো জানার তৃষ্ণায় রাতে খাওয়ার পর সময় পেলেই চলে যান ওস্তাদ করমউদ্দিনের বাড়ি। চলতে থাকে গানের ধ্যানজ্ঞান। গায়েন হিসেবে আশপাশের চার-পাঁচ গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে সুনাম! কিন্তু ধ্যানটা তো শুধু গানেই ছিল না, বাউলমন ডুবে থাকে কত তত্ত্বের ঘোরে; কোথা থেকে আসে নৌকা, কোথা চলে যায়? কোন মিস্তিরি নাও বানাইল কেমন দেখা যায়… যতই বয়স বাড়ে, কিসের তিয়াসে যেন কোন আহবানে – কোনো পির-ফকির বা ওস্তাদ গায়েনের সন্ধান পেলেই হলো, চাতক পাখির মতো ছুটে যান – যদি কোনো দীক্ষা বা নছিহত জোটে! ফেরাননি ওস্তাদ মৌলা বক্স মুন্সি, রশিদউদ্দিন ও উকিল মুন্সি। সাহচর্য দিয়েছেন, দিয়েছেন আলোর ঠিকানা! ওস্তাদ মৌলা বক্স মুন্সির কাছে তো যৌবন আসার দিনই বাবা-মায়ের অনুমতি নিয়ে মুর্শিদ ভজেছিলেন। মৌলা বক্স মুন্সি ছিলেন মহাসাধক আববাস ক্বারির যোগ্য শিষ্য। কী যত্ন নিয়েই না বাবা মারফতির গোপন ভা-ার খুলে দিয়েছেন! সে বড় নিষ্ঠার কাল ছিল! আপন সাধনায় তিনি কখনো ফাঁকি দেননি। সেজন্যই বুঝি মুর্শিদদের কাছ থেকে লাভ করেছেন নিজের বিচার নিজে করার বিবেক-বুদ্ধি সহবত! নিমগ্ন থাকতে পেরেছেন সব লোভ আর পঙ্কিলতার ঊর্ধ্বে ওঠা বিশুদ্ধ এক জীবন-সাধনায়! আর আজ কিনা সেই তিনিই শেষ বয়সে এসে দুইটা টাকা আর টেলিভিশনে মুখ দেখানোর জন্য ছুটে আসবেন ঢাকা শহর! এই গিজগিজা আদমের ঢাকা শহর! এসব কী অনর্থ কাইজ-কারবার!

নাহ্! ঢাকা শহরে তিনি আসতে চাননি। ঢাকা শহরে আসতে তার রুচিতে বাধে! এ-শহরে টাকার লোভ হাওরের কাদার মতো ক্যাতক্যাত করে! সবাই খালি ব্যস্ত ধান্ধা নিয়ে। দাম্ভিকতার এক-একটা যেন কারেন্টের খাম্বা! মানুষ মানুষকে মানুষই মনে করে না। এতো বৈষম্য, এতো ব্যবধান! একবার রেডিওর একটা চেক ভাঙাতে যেতে হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকে! সে অনেক আগের কথা। সেখানে গিয়া ঠিকনাই করতে পারলেন না তিনি, একজন মানুষ গেছেন, না পশু! মানুষই তো যায় মানুষের কাছে। আমি তো কোনো বন্যপশু যাইনি। বন্যপশুরও তো অনেক দাম আছে। এদেশে মানুষের কোনো দাম নেই, মানুষের কোনো ইজ্জত নেই। আমার লুঙ্গিতে না হয় তিনটা তালি বসানো, আমার পাঞ্জাবিটা না হয় ছেঁড়া – তো কী হয়েছে? আমি তো এদেশেরই নাগরিক! আমি তো ট্যাক্স দিই – নাকি! বিমূঢ় হয়েছিলেন সেদিন এ-শহরের মানুষের আচরণ দেখে! এই নাকি স্বাধীন দেশের অবস্থা!

শাহ আবদুল করিম টাকার খামটা টেবিলের ওপর রেখে দেন। অশ্রুসজল চোখ থেকে টপটপ করে দুফোঁটা জল টেবিলের ওপর ঝরে পড়ল। যাওয়ার জন্য উঠবেন কী, সোফায় হেলান দিয়ে নিজেকে আরো ছেড়ে দেন, যেন নিজের দেহভার বইবার আর কোনো সামর্থ্য নেই। রুহি ঠাকুর, আবদুর রহমান, তুহিন তিনজনই এগিয়ে পাশে এসে দাঁড়ায়! রুহি ঠাকুর উদ্বেগে জানতে চায়, ‘কিথা হইছে দাদা! খারাপ লাগছে?’

শাহ আবদুল করিমের জবান বন্ধ। শুধু ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকেন। হাওরের উদাসীনতার মতো থির হয়ে থাকে দৃষ্টি। আবদুর রহমান ওর সোফার গাঁ-ঘেষে বসল। পাঞ্জাবি-পাজামা পরা লম্বা কালো বাবরি চুলের মানুষটার কাতরতা – ‘কিথা হইছে আপনার? ধলে যাইবে না? বাড়ি যাইতে হইব না?’ যেন সে-কণ্ঠ হাওরের মতোই ঝাপসা সাদা ঠেকে। করিমের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না। নিজের ঘোরলাগা জগৎ থেকেই ফিসফিস করে ওঠেন, ‘তোমরা আমারে কিল্যায় ঢাকা শহরে নিয়া আইছ? কিল্যায় নিয়া আইছ ঢাকা শহরে?’

‘এতো বড় একজন মানুষ আমরারে ডাকছেন!’ কথাটা বলেই রুহি ঠাকুর ড্রয়িংরুমের দেয়ালে বাঁধানো হুমায়ূন আহমেদের বিশাল ছবিটার দিকে তাকান; সুস্মিত মুখ, সারল্যের ছাপ চেহারায়! লেখা দিয়ে, নাটক দিয়ে দেশের মানুষকে মোহমুগ্ধ করে রেখেছেন! সেই মানুষটার কাছে আসতে পেরে তো নিজেকে ধন্যই মনে হচ্ছে তার! করিম ওস্তাদের ওপর কী সুন্দর একটা অনুষ্ঠান বানাইছেন জলসাঘর নামে! সে-অনুষ্ঠানে তুহিন গান গাইল, সে নিজে গান করল! সব তো ঠিকই আছে! হঠাৎ ওস্তাদের কী হলো? কেন এতো অভিমান তার! বুঝে উঠতে পারেন না শুকনো চেহারার শ্যামলকাস্তি বাবরিচুলো মানুষ রুহি ঠাকুর। তিনি পাঞ্জাবির খুঁট ধরে একবার আবদুল করিমের দিকে তাকান, তো আরেকবার হুমায়ূন আহমেদের ছবি দেখেন!

শাহ আবদুল করিমও দেয়ালে হুমায়ূন আহমেদের বিশাল পেইন্টিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন! নিথর ভাষাহীন সে-চাহনি দেখে ঠিক বোঝা যায় না – তার অব্যক্ত হৃদয়ে কী যন্ত্রণা লুকিয়ে আছে! হয়তো মনের কথা বলতে পারলে যন্ত্রণার প্রশমন হতো; কিন্তু রুহি ঠাকুর, আবদুর রহমান কিংবা তুহিন কাউকেই বুঝিয়ে বলতে পারেন না – কেন তার অনুযোগ, মনের ভেতরের কোন জায়গায় লেগেছে চোট, কেন! সেই না বোঝানোর অসামর্থ্যের কারণেই যেন ভেতরের অভিমান আরো বেশি গুমরে গুমরে ওঠে, ‘তোমরা আমারে কিল্যায় আনছো! কিল্যায় আনছো তোমরা!’

সত্যিই, শাহ আবদুল করিমের ঢাকা শহরে আসার কোনো ইচ্ছা একেবারেই ছিল না। যখন টনটনা যৌবন, তখনই আসতে চাইতেন না – টেলিভিশনের ক্যামেরার কথা শুনলে উলটাদিকে মুখ ফিরিয়ে রাখতেন। এবারো আসতে চাননি। হুমায়ূন আহমেদের নাম শোনার পরও আগ্রহ হয়নি টেলিভিশনের ক্যামেরার সামনে ইন্টারভিউ দেওয়ার! ওর সেই রুচিটাই নেই। কেমনে কেমনে যে রাজি হয়ে গেল! এই যে তুহিন, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তুহিন, তুহিনের জন্যই আকামটা ঘটেছে! দুই-তিনটা মাস ধরে যে কী নাছোড়ের মতো লেগে ছিল ছেলেটা! গান গায়, ভালোই গান গায় তুহিন, সুনামগঞ্জেরই ছেলে, পড়ে থাকে ঢাকা শহরে! এখনো নওজোয়ান। সুন্দর স্বাস্থ্য, চেহারাটাও ভালো। শুনছে অভিনয়ও নাকি করে! ছেলেটার সামনে অনেকদূর যাওনের রাস্তা। তো, একদিন ওই তুহিনই এসে আবদার জুড়ে দেয়, জনপ্রিয় কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ আপনাকে নিয়ে একটা প্যাকেজ প্রোগ্রাম বানাতে চান, ‘আপনার গান গাওয়া হবে, গানের ওপর আলোচনা হবে, ইন্টারভিউ নেওয়া হবে! আমরা সবাই আপনার গান গাইব!’

তুহিনের প্রস্তাব শুনেই করিম বেঁকে বসেছিল, ‘না না, কাম নাই এইসব করনের।’ তুহিন কি আর শোনে কোনো কথা! ‘চাচা, আমি আপনারে কইয়া গেলাম, এখন আপনে চিন্তা কইরা দেখুইন, আপনার মতো এমন একজন গুণী মাইনষের সারা পৃথিবীর লোকের কাছে পরিচিতির দরকার। আপনার অনেক কথা আছে – যা কোনোদিন কন নাই, সব কথা আপনার কইতে হইব।’ কতভাবে ওকে বোঝানো-পড়ানো! করিমের মন কি আর সহজে ভজে? সত্যি কথা, দেশের মানুষ তার নামটা যেভাবে জানা দরকার, তখনো সেরকম জানত না! আর করিমেরও সেসব নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিল না। খ্যাতির কাঙালিপনা ও কখনো করেনি। তাই তুহিনের প্রস্তাবেও খুব একটা আমল দেয়নি।

এমনি করেই এক মাস যায়, দুই মাস যায়! শাহ আবদুল করিমের মন কিছুতেই ভজানো যায় না। তুহিনও হাল ছাড়ার মানুষ নয়। লেগেই থাকে জোঁকের মতো। ওর সঙ্গে এসে যোগ দেয় সুখ-দুঃখের খবরাখবর রাখে যেসব মানুষ – সিলেটের রুহি ঠাকুর, গানের সমঝদার আবদুর রহমান! সবারই এক কথা, হুমায়ূন আহমেদের মতো মানুষ যখন ডেকেছেন যাওয়া দরকার! এমনকি শেষে ছেলে নূর জালালও তাগিদ দিলো, ‘যাও না বাবা! তোমার গান মাইনষে শুইনা ভালো পায়। তারার দিকে তাকাইয়াও তো যাইতায় পারো!’

এই যে মানুষ, যে-মানুষের জন্যই সারাজীবন গান বেঁধেছেন, সেই মানুষের কথা শুনে মন-দিল কেমন নরম হয়ে গেল। মানুষেতে আছে মানুষ, রয় না মানুষ মানুষ বিনা! সত্যিই! নবীতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, বাউলতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব, পির-মুর্শিদ, অলিতত্ত্ব – সব তত্ত্ব নিয়ে গান লেখার পরও বাউলরা সাধারণত যা করে না, তিনি তাই করেছেন – মানুষ নিয়ে গান বেঁধেছেন। মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, নিপীড়ন-যন্ত্রণার কথা তুলে ধরেছেন। গানকে মনে করেছেন সর্বহারার দুঃখ জয়ের মন্ত্র। আর সেসব গান বান্ধনের জন্যই তো সোহরাওয়ার্দী, ভাসানী, শেখ মুজিবের ভালোবাসা লাভ করেছেন। হ্যাঁ, হ্যাঁ, ভাসানীর স্নেহ, শেখ মুজিবুরের বাৎসল্য! এসব তো অর্জন হয়েছে মানুষ নিয়া গান বান্ধনের কারণেই। সেই মানুষের কথা শুনে তিনি কি আর স্থির থাকতে পারেন! তখন তখনই ছেলের চোখের দিকে তাকিয়ে সায় দিয়েছিলেন, হাঁ যাব, ঢাকা শহর আমি যাব!

তারপর তো বেশ ভালোভাবেই হলো সবকিছু! ওরা সসম্মানেই নিয়ে এলো ঢাকা। স্টুডিওতে একজন প্রবীণ জ্ঞানী-গুণীজন জলসাঘর অনুষ্ঠানের জন্য ইন্টারভিউ নিল। ইন্টারভিউ দেওয়া যখন শেষ হলো, ওরা নিয়ে এলো হুমায়ূন আহমেদের ধানম–র এই ছায়াশীতল দালানকোঠার বাড়িতে। সম্মানীর জন্য। তা সম্মানী দেবে ভালো কথা, আচরণটা কেন হবে দয়াদাক্ষিণ্য দেখাবার মতো? বিদায়বেলায় হুমায়ূন আহমেদ ওর সঙ্গে একটু দেখা করারও প্রয়োজন বোধ করলেন না? সম্মানীর টাকাটা কিনা পাঠিয়ে দিলেন ড্রাইভারের হাতে? এ কেমন আচরণ? কেমন কারবার মানুষটার? কোথায় নিজে এসে হাত মোসাফা করবেন, তা না! অপমানবোধ কিছুতেই কাটে না করিমের। বোঝলাম তাঁর সময়ের দাম আছে, অনেক দাম। একটা বই লিখলেই কোটি কোটি টাকা আসে। তাই দম ফেলবার সময় পান না। না পাওয়ারই কথা! এটাই সত্য, কিন্তু তারচেয়েও বড় সত্য – তুমি মানুষটা টাকার দাস! টাকার গোলাম! টাকা তোমারে ওঠায়-বসায়, টাকা তোমারে নাচায়! কিন্তু আবদুল করিমরে টাকা কোনোদিন বশ করতে পারেনি। করিমের ফিকির হলো ফকিরগিরি! ফকিরের কাছে রাজা-বাদশাহ যা, হুমায়ূন আহমেদও তা-ই।

অপমানের নীলদংশনে জর্জরিত শাহ আবদুল করিম দুহাতে মাথা ধরে বসে থাকেন। ‘দাদা! ধলে যায়বায় না? চলুইন! কিথা হইছে আপনার?’ রুহি ঠাকুরের গলায় কৌতূহল, ব্যাকুলতা। আবদুর রহমানও কিছু বলতে চান, ‘ভাই!’

করিম ভাবনার অতলান্ত জগৎ থেকে উঠে আসেন, সোজা হয়ে বসেন, হাত-ইশারায় ওদের দুজনকে থামিয়ে দেন। কোন সুদূরে হারিয়ে যাওয়া চোখদুটোও চঞ্চল হয়ে ওঠে। ধীরভাবে দোতারাটা হাতে নিয়ে টুংটাং সুর উঠাতে শুরু করলেন। আজকাল গান তিনি গান না। গলায় সুর আসতে চায় না; কিন্তু হাত এখনো চলে। চলতে চায় না অবশ্য আগের মতো। কিন্তু আজ কোত্থেকে হাতে জোর আসছে। রুহি ঠাকুর কী বলতে চান, হাত-ইশারায় ওকে থামিয়ে দেন করিম। দোতারার টনটনানি বেড়ে যেতে থাকে। দোতারার সুরে সুরে হুমায়ূন আহমেদের রঙিন ড্রয়িংরুম সাদা হয়ে যায়, হাওরের সাদা! হাওরের ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তিনি শুনতে পান। হাওরের জলের ছিটায় চোখ ছলছল করে ওঠে। দোতারার টনটনানিতে ভেসে ওঠে ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’ গানের সুর। সুরের গভীর থেকে গভীরে হারিয়ে যেতে যেতে চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক বিশাল দেহ, বিশাল অবয়ব – শেখ মুজিবুর রহমান। একাত্তর কিংবা পঁচাত্তর সালের নয়, ১৯৫৪ সালের নওজোয়ান শেখ মুজিবুর রহমান। কালো ফ্রেমের চশমা। ব্যাকব্রাশ চুল! ধবধবে সাদা শার্ট। তখন স্বৈরশাসক মুসলিম লীগের সমাপ্তি ঘটেছে। চারিদিকে গণতন্ত্রের সুবাতাস। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করে কোয়ালিশন সরকার গঠন করল। শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী আর নওজোয়ান শেখ মুজিবুর রহমান সেই সরকারের কৃষিবিষয়ক মন্ত্রী। মানুষ প্রাণখুলে কথা বলতে পারছে।

সেই সুসময়েই একদিন খবর এলো, সুনামগঞ্জে আসছেন শেখ মুজিবুর রহমান, কৃষিমন্ত্রী তো পরিচয় নয়, পরিচয় আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি; তাঁর হুংকারে কেঁপে ওঠে পাক শাসকের ভিত। সুনামগঞ্জে শেখ মুজিবুর রহমান আসবেন দেশের সন্তান আবদুস সামাদ আজাদকে সঙ্গে নিয়ে। চারিদিকে সাজসাজ রব পড়ে গেল। এমন উৎসাহ আর উদ্দীপনা আগে কখনো দেখা যায়নি সারা সুনামগঞ্জের কোথাও! তখন করিমেরও গান গেয়ে নাম হয়েছে। বাউলগানে তো মানুষের মন ভরিয়ে দেনই, দেশের গান গেয়ে জাগিয়েও তোলেন। আর এই দেশের গান, মানুষের গান গাওয়ার পেছনে আবদুস সামাদ আজাদেরও কিছুটা অবদান অবশ্যই ছিল। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আবদুস সামাদ আজাদ জগন্নাথপুর-দিরাইয়ের রাজনীতির জগতে আবির্ভূত হয়েছিলেন খুব ভালোভাবেই। সাধারণ মানুষের সঙ্গে খুব দিল লাগিয়ে মিশতে জানতেন। মানুষের বাড়িতে বাড়িতে যেতেন, রান্নাঘরে বসে খেতেন। সে-সময়েই একরাত দিরাইয়ে কাটানোর সময় করিমের গান শুনে তিনি মুগ্ধ হয়ে গেলেন। গানের পর করিমের হাত ধরে সব খবরাখবর নিয়ে সকাতরে অনুরোধ জানালেন, দেশে আজ সমবণ্টন নেই। আমরা শোষণমুক্ত একটা সমাজ গঠন করতে চাই। আপনি গানের মাধ্যমে শোষিত মানুষের যন্ত্রণার কথা তুলে ধরেন। উৎখাত করতে হবে এই মুসলিম লীগ সরকারকে। আবদুস সামাদ আজাদের আহবানে বাউলশিল্পী কণ্ঠে ছুটিয়েছিলেন বজ্রনির্ঘোষভরা গণমানুষের গান। বিপুল ভোটে পাশ করেছিলেন আবদুস সামাদ আজাদ। আর তিনি বাউল থেকে হয়ে উঠেছিলেন গণমানুষের শিল্পী। সেই থেকে সুনামগঞ্জের যেখানেই সামাদ আজাদের জনসভা হয়, গান গাইতে ডাক পড়ে শাহ আবদুল করিমের। এবারো শেখ মুজিবুরের জনসভায় ডাক পড়ল গান গাওয়ার!

আহা রে! কত যে মানুষ এসেছিল সেদিন! মানুষে মানুষে ভরে গিয়েছিল সেই বিশাল জনসভা! সবাই স্বচক্ষে দেখতে চায় শেখ মুজিবুর রহমানকে! অল্প বয়সেই শেখ মুজিবুর রহমান পালন করছেন আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব আর কৃষিমন্ত্রীর পদ। কী যে জনপ্রিয় ছিলেন সারাদেশে! মানুষের অন্তরের মণি হয়ে উঠেছিলেন। শাহ আবদুল করিম বসেছিলেন মঞ্চের পাশেই। সম্মানিত মানুষের কাতারে! এ-নেতা সে-নেতার বক্তব্যের পর শেখসাহেব উঠলেন বক্তৃতা দিতে! আকাশসমান তাঁর উচ্চতা! গলায় বজ্রবিদ্যুৎ! সম্মোহিত হয়ে শুনলেন শেখসাহেবের ভাষণ, সেই তেজিকণ্ঠ যেন আজো বেজে চলেছে আকাশে-বাতাসে! কী যে গলায় জোর! সাধে কি আর বাংলার মানুষ তাঁর ডাকে নিজের জানবাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল স্বাধীনতাযুদ্ধে? আর কী সৌভাগ্য! সেই মানুষটার সামনেই কিনা মঞ্চে উঠে গান গাইতে হবে! বুকের ভেতর আনন্দের তুফান বইছিল। তারপর একসময় মাইকে ভেসে উঠল তাঁর নাম – ‘এখন গান গাইবেন দিরাইয়ের গণমানুষের শিল্পী শাহ আবদুল করিম।’

মঞ্চের সামনে বিশাল জনসমুদ্র আর পেছনে তার সমান দীপ্তিময় তেজোদীপ্ত এক অগ্নিপুরুষ! যে-মানুষের হুংকারে কেঁপে ওঠে পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকদের অস্তিত্বের ভিত! শাহ আবদুল করিম সে-মানুষটিকে একনজর দেখে নিয়ে দরদভরা জোরগলায় গেয়ে উঠলেন-

পূর্ণচন্দ্রে উজ্জ্বল ধরা

চৌদিকে নক্ষত্র ঘেরা

জনগণের নয়নতারা

শেখ মুজিবুর রহমান

জাগ রে জাগ রে মজুর কৃষাণ…

আহা রে! কী যে প্রাণের আবেগ মেশানো ছিল মানুষগুলোর মধ্যে। গানের ভেতর নিমজ্জমান হয়েও টের পেয়েছিলেন জনগণের উচ্ছ্বাসভরা চিৎকার! গায়ের লোম কাঁটা দিয়ে উঠেছিল করিমের, ‘জাগ রে জাগ রে মজুর কৃষাণ…’

গান গাওয়া শেষ হতেই সুরের ধ্যানে তন্ময় শিল্পী মঞ্চ ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন; কিন্তু মঞ্চের সঞ্চালক তাঁকে টানতে টানতে নিয়ে গেলেন মঞ্চের মধ্যমণি শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে। শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর হাতটা নিবিড়ভাবে আঁকড়ে ধরলেন, হাতের মুঠোর ভেতর একশ টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘করিম ভাই যেখানে, আমরা আছি সেখানে।’

এই না হলে বড় নেতা! নিজে বড় বলে অন্যকেও বড় ভাবতে জানেন। সম্মান জানাতে ভোলেন না কাউরে! অদ্ভুত এক ভালো লাগার অনুভূতি আর বুকভরা সাহস নিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে এসেছিলেন সেদিন। এরপর নিজের অজান্তেই ওর ভেতরের মানুষটা বদলে গিয়েছিল অনেকটাই! গলায় এসেছিল নতুন জোয়ার! শুধু জগন্নাথপুর-দিরাই নয়, মানুষের চেতনাকে জাগিয়ে দিতে গান গাইতে লাগলেন, যেখান থেকে ডাক আসে সেখানেই, সুনামগঞ্জ ছাড়িয়ে আরো দূর থেকে দূর সীমান্তে। দেশের সবখানে তখন নতুন দেশের স্বপ্ন নিয়ে ভেতরে ভেতরে সবার মনেই দারুণ উত্তেজনা – কেউ কাউকে বলে না ঠিকই, কিন্তু প্রত্যেকেই যেন অনুভব করছিল স্বাধীন হতে হবে। যে-কোনো মূল্যে নতুন দেশে আনতে হবে নতুন এক আকাশ। আর যাকে ঘিরে এই স্বপ্ন – তাঁর নাম শেখ মুজিবুর রহমান! প্রমত্ত এক সাহস আর প্রচ- এক আবেগ! সেই আবেগের জোয়ারে ভেসে যাবে পাকিস্তানিদের যত শোষণ, যত বঞ্চনা।

পাকিস্তানি শাসকরাও যেন বুঝতে পেরেছিল শেখ মুজিবের শক্তিতে কত ঝাঁজ! বুঝতে পেরেছিল মুজিব-জোয়ারে ভেসে যেতে পারে পাকিস্তানের যত চক্রান্ত! তাই যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও তাকে জেলে ভরে রাখল! ইসকান্দর মির্জাকে করা হলো নতুন গভর্নর। জেলগেটে শেখ মুজিব গিয়েছিলেন দাঙ্গা থামাতে, উলটো তাঁকেই দাঙ্গা লাগানোর অভিযোগে ভরা হলো জেলে। কদিন পর যুক্তফ্রন্ট সরকারও দিলো ভেঙে! কী যে ঝড়-তুফানের মতো সময় পার হচ্ছিল! তবে যতই ওরা শেখের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছিল, ততই শেখ হয়ে উঠছিলেন ঘরে ঘরে মানুষের হৃদয়ের মণি! তাঁর ব্যক্তিত্ব  এতোটাই প্রসারিত হয়ে উঠছিল যে, জেলেও বেশিদিন বন্দি করে রাখা সম্ভব হলো না। সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আবারো ১২ সেপ্টেম্বর গঠন করা হলো কোয়ালিশন সরকার। সেই সরকারে একই সঙ্গে মুজিবকে দেওয়া হলো শিল্প-বাণিজ্য-শ্রম ও দুর্নীতি দমনবিষয়ক মন্ত্রণালয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কয়েকদিন পরই মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করলেন তিনি! তখন যে স্বাধীন হওয়ার পালে ভালোই হাওয়া লাগতে শুরু করেছে! জনগণের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলার সময়! তখন কী করে থাকেন তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রে!

সে-সময়ই আরেকবার বিশাল হৃদয়ের মানুষটার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল কাগমারী সম্মেলনে। আওয়ামী লীগে তখন ভাসানীর ভাটিবেলা আর শেখ মুজিবুরের উজানকাল! শেখ মুজিব ভাসছেন গণজোয়ারের বিস্ফোরণে! মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করলে কী হবে, তার কোয়ালিশনের সোহরাওয়ার্দীর সরকারই তখন ক্ষমতায়। সে-সময়েই একদিন সুনামগঞ্জের ডিসি সাহেব বাড়িতে লোক পাঠালেন করিমকে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে হবে। অতবড় মান্যিগণ্যি মানুষ খবর পাঠিয়েছেন, দেখা না করলে কেমন দেখায়! তবে বেশ কৌতূহল হচ্ছিল, কেন হঠাৎ ডিসি সাহেব ডেকে পাঠালেন! ডিসি সাহেবের অফিসে যেতেই কত আদর-আপ্যায়ন! ‘আপনাকে সরকার কাগমারী সম্মেলনে ডেকেছে, গান গাইতে হবে।’

ডিসির কথা শুনে তো করিম অবাক, ‘আমাকে ডাকুইন কিল্যায়? আমি কিতা?’

ডিসি সাহেব মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, ‘মানুষ আপনার গান শুনে জেগে ওঠে! আপনি যাবেন না তো কে যাবে!’ ‘কিন্তু’ তিনি ছেলেমানুষের মতো বলে উঠেছিলেন, ‘আরে! চাইলেই কি যাওন যায়? টাকা পাইমু কই?’

হেসে উঠেছিলেন ডিসি সাহেব। কী ভদ্র আর অমায়িক ছিলেন মানুষটা। তাকে আশ্বস্ত করেছিলেন, ‘আমি ব্যবস্থা করব। আপনার যা প্রয়োজন আমি দিচ্ছি।’ কাগমারী সম্মেলনে যাওয়া উপলক্ষি একটা কম্বল আর একশ টাকা ওর হাতে ধরিয়ে দিলেন। মনে আছে ফেব্রুয়ারির সেই কনকনে শীতে সিলেট থেকে বিশাল একটা বহর গিয়েছিল টাঙ্গাইলের কাগমারীতে। মানুষের মধ্যে যে কী আবেগ-উত্তেজনা, সেই আবেগে ভাসতে ভাসতেই পৌঁছে গিয়েছিলেন কাগমারী! আর সেখানে যে কত বড় বিস্ময় অপেক্ষা করছিল তার এতটুকুও কি আঁচ করতে পেরেছিলেন সামান্য আগেও! শেখ মুজিবুর রহমান ক্যাম্পের মধ্যে বসে ছিলেন বন্ধুবান্ধব সঙ্গে নিয়ে। তাকে দেখেই – শাহ আবদুল করিম ভাবলে এখনো অবাক হয়ে যান, রোমাঞ্চিতও হন, তাকে দেখেই অত বড় নেতা মানুষটা কিনা যেন কতদিনের চেনামানুষের মতো বলে উঠেছিলেন, ‘হে, আমার করিম ভাই এসেছে!’

কী হৃদ্যতাভরা ডাক! শুনেই মন আনন্দে ভরে উঠেছিল। যেন কত আপন একজন মানুষ, অনেকদিন পর কাছে পেয়েছেন এমনই এক মিঠা সুর কণ্ঠে, কাছে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘আপনার শরীর ভালো আছে করিম ভাই?’ শাহ আবদুল করিম আপস্নুত হয়েছিলেন! তার মতো একজন সামান্য গায়েনকে মনে তো রেখেছেনই, কত দরদভরা খোঁজখবর! কোনো কথাই বলতে পারছিলেন না করিম। বোধহয় হৃদয়ের সেই ভাষাই পড়তে পারছিলেন মহীরুহ মানুষটা। চড়া গলা নামিয়ে স্নিগ্ধ-শান্ত স্বরে জানতে চেয়েছিলেন, ‘ডিসি আপনারে খরচ দিয়েছে?’

আবেগতাড়িত গলায় তিনি সায় দিয়েছিলেন, ‘জি। দিয়েছেন।’ সঙ্গে যে একটা কম্বল দিয়েছিলেন সেটাও জানাতে ভুললেন না। তবু যেন সেই চওড়া কপালের মানুষটার ভেতর ঘোর অতৃপ্তি। পাশের এক ভদ্রলোকের উদ্দেশে রাশভারী গলায় বললেন, ‘দেখি তোর কাছে টাকা আছে কত? থাকে যদি তাহলে আমাকে দে তো!’

ভদ্রলোক তার কোটের বুকপকেটের ভেতর হাত ঢোকালেন। সব টাকা খুঁজেটুজে বের করে শেখ মুজিবুরের হাতে ধরিয়ে দিলেন। সব মিলিয়ে দেড়শো টাকা ছিল। মনে আছে, টাকাগুলো হাতে নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান গুনেও দেখলেন না, ভালোবাসার পরম দুহাত দিয়ে ওর হাতটা নিজের মুঠোর ভেতর ভরে নিলেন। টাকাগুলো হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন, ‘এগিয়ে চলেন। কোনো ভয় নাই। গণসংগীতগুলো যেন জোরদার হয়।’ কী যে ছিল সে-কথার ভেতর! কী যে ছিল সেই মোহনবাঁশি! একটা স্পন্দন খেলে গিয়েছিল ওর সর্বসত্তাজুড়ে! যত না কণ্ঠে, তার চেয়ে বেশি উষ্ণতা ছিল সেই হাতের শিরায় শিরায় ভরাট তালুতে। টাকা দিয়েও তার হাতটা অনেক অনেকক্ষণ ধরে রেখেছিলেন! মানুষটার হৃদয়ের তাপ এসে লাগছিল হাতে এবং সেই উষ্ণতার তাপ পেয়েই যেন শাহ আবদুল করিম দোতারা বাজানো থামিয়ে দিয়ে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। তার চোখ-মুখ ঝলমল করছে প্রশাস্তির আলোয়! রুহি ঠাকুর, তুহিন আর আবদুর রহমানের দিকে তাকিয়ে উদ্ভাসিত হাসিতে বলে উঠলেন, ‘চলুইন যাই! দেরি অইত্যাছে!’

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত