সে পাহারাদার, সুতরাং নারী ও রাত তার কাছে অতৃপ্তির আধার।
গল্পটা একজন পাহারাদারকে নিয়ে অথবা একজন পাহারাদারের গল্পও হতে পারে। গাছ গাছই, যে-নামেই ডাকা হোক না কেন! তারপরও কেউ কেউ বৃক্ষ নামে ডাকে বা ডেকে আনন্দ পায়। পাহারাদার শব্দটা কারো কারো কাছে খারাপ লাগতে পারে, কেউ কেউ নৈশপ্রহরী বলতে পছন্দ করতে পারে; কিন্তু গল্পকার হিসেবে লোকভাষ্য অনুযায়ী পাহারাদার নামেই তাকে আমরা ডাকব। পাহারাদার পাহারাদারই। এটাই নাউন, নাম। আমরা রাম শ্যাম আকাশ বাতাস যদু মধু ইত্যাদি নামের মধ্যে প্রবেশ করব না। পাহারাদারই আমার ও পাঠকদের কাছে নাউন, ব্যাকরণসম্মত।
পাহারাদার লোকটা দশাসই। একহারা গড়ন। পেটা শরীর। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায়, শরৎ কিংবা হেমন্তে পাহারার সময়ে কাঁধে একটা মোটা কাপড়ের চাদর নিয়ে হাঁটে। এক হাতে থাকে লম্বা শক্ত একটা লাঠি। অন্য হাতে বাঁশি। যে-এলাকায় পাহারা দেয়, সে-এলাকাটার নাম রামপুরা। রামপুরা অনেক বড় এরিয়া। পাহারাদার পাহারা দেয় বিরাট এরিয়ার সামান্য অংশই। ওয়াপদা রোডের কয়েকটি উপগলির রাতের রাজা সে, রাত বারোটা থেকে সকাল ছয়টা পর্যন্ত।
উপগলির বাসিন্দারা রাতে যে-কাজেই যেভাবেই থাকুক না কেন, কানে বাঁশির তীক্ষ্ণ শব্দ প্রবেশ করলেই বুঝতে পারে – পারাহাদার এসেছে এবং রাত কাঁটায় কাঁটায় বারোটা। মনুষ্য মানবিক দুর্বলতার কারণে কাঁটায় কাঁটায় বারোটার পর হয়তো মাসে দু-একবার অতিরিক্ত এক কিংবা দেড় মিনিট দেরি হয়েছে পাহারাদারের পাহারায় আসতে। গত কয়েক বছরে ওয়াপদা রোডের উপগলির মানুষেরা পাহারাদারের বাঁশির শব্দে ঘুমোতে যায়, কেউ পড়তে বসে, কেউ নিজস্ব কাম রচনায় মগ্ন হয়। তার সঙ্গে এলাকার অনেকে হাঁটতে হাঁটতে গল্প করে, গলির মোড়ে দাঁড়ায়, কুশল জিজ্ঞেস করে, পাহারাদার হেসে হেসে উত্তর দেয়। কেউ কেউ দু-একটা সিগারেট বাড়িয়ে ধরলে বিনয়ের সঙ্গে গ্রহণ করে। দুগ্ধপোষ্য বাচ্চারা দিনে কিংবা রাতে অথবা সন্ধ্যায় ঘুমোতে কিংবা খেতে না চাইলে পাহারাদারের ভয় দেখায় মায়েরা, ডাকব বাঁশিওয়ালাকে? বাঁশির সুরে সুরে ডেকে নিয়ে যাবে অথই অন্ধকারে।
অন্ধকার নামক অদ্ভুত জীবজন্তুতে বাচ্চারা ভয় পায় এবং দ্রুত ঘুমায় অথবা দ্রুত খাওয়া শেষ করে।
মোটকথা, রামপুরা এলাকার ওয়াপদা রোডের কয়েকটি উপগলির পাহারাদার সবার কাছে পরিচিত। সজ্জন মানুষ। দায়িত্ব ও কর্তব্যকর্মে নিষ্ঠাবান একজন পাহারাদার সে। প্রশ্ন উঠতে পারে পাঠকদের কাছ থেকে – তাহলে বাপু, এরকম নিস্তরঙ্গ, সামাজিকভাবে নিম্নস্তরের একজন প্রাণীকে নিয়ে গল্প ফাঁদা কেন? গল্প এতো তরল পদার্থ নাকি নাম-গোত্রহীন কাউকে নিয়ে একটা কিছু লিখলেই গল্প হয়? হতে পারে? যাদের জীবনে বৈচিত্র্য নেই, জৌলুস নেই, তাদের নিয়ে গল্প হয় কেমন করে?
প্রিয় পাঠক, পিস্নজ একটু সময় দিন। পাঠ করুন না আরো কয়েকটি লাইন, গল্প কেমন অশরীরী আর দানবীয় হয়ে ওঠে, অস্থিমজ্জায় টের পাবেন। না না, আমি আপনাদের ভয় দেখাচ্ছি না। আমার সৌন্দর্য আপনারা। আপনারা ভয় পেলে গল্প নিয়ে কাদের কাছে যাবো? গল্পটা পড়তে পড়তে আপনি কিংবা আপনারাও গল্পেরাও গল্পের অংশ অথবা চরিত্র হয়ে ওঠেন কিনা, আমার ভয়টা সেখানেই। চলুন, গল্পের কলকব্জায়।
পাহারাদার ভোর ছয়টায় পাহারার কাজ শেষ করে নিজের ডেরায় ফেরে। পাহারাদারের স্ত্রী কুলসুম দরজা খুলে দিলে ভেতরে ঢুকে স্ত্রীর পরিত্যক্ত গরম ওমের বিছানায় শুয়ে পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘুমের দেশে হারিয়ে যায়। একনাগাড়ে ছয় ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা, ক্রমাগত হাঁটা, চারদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা, বাতাসে পাতা নড়লে লক্ষ করা, থেকে থেকে বাঁশি বাজানো ইত্যাকার কাজে সে খুব ক্লান্ত থাকে। সুতরাং গরম বিছানা পেলে সঙ্গে সঙ্গে শরীর উলটপালট করে ঘুম তো আসবেই। পাহারাদার ঘুমিয়ে গেলে কুলসুম রান্না চড়ায়। রান্না শেষ করে নিজেরটা খেয়ে, পাহারাদারের জন্য রেখে বেরিয়ে পড়ে কুলসুম। বড় রাস্তার মোড়ে ছোট একটা পান-সিগারেটের দোকান চালায়।
কুলসুম চলে যাওয়ার ঘণ্টাখানেক পর দরজায় টোকা পড়ে। প্রথমে আস্তে আস্তে, পরে টোকাটা ধাক্কায় রূপান্তরিত হয়। সাধারণত এমন হয় না। কুলসুম ফিরবে সেই দুপুরে। দুপুরে এসে দেখবে পাহারাদার, তার স্বামী বিছানায় উঠে বসেছে। কিংবা হাত-মুখ ধুয়ে বউয়ের প্রতীক্ষায় অপেক্ষা করছে। কুলসুম শারীরিকভাবে খুবই সুন্দরী। মাঝারি স্বাস্থ্য। গায়ের রং ফর্সা। একবার দেখলে আরেকবার তাকাতে ইচ্ছা করে যে-কোনো পুরুষের, অবশ্য সেই পুরুষ যদি সৌন্দর্যপিপাসু হয়, তবেই। সবকিছু ঠিকই আছে পাহারাদার আর কুলসুমের সংসারে একটা সমস্যা ছাড়া।
সমস্যাটা হলো, কুলসুম মা হতে পারছে না। বিবাহিত জীবনের এগারো বছরে এখন পর্যন্ত পেটে সন্তান ধারণ করতে পারেনি। এ নিয়ে কুলসুমকে কোনো প্রশ্ন করেনি পাহারাদার, এমনকি পিতা না হওয়ার বেদনাও প্রকাশ করেনি। বরং কুলসুম এ নিয়ে বলতে গেলে পাহারাদার সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গে এসেছে।
কুলসুম, খামাখা মাইয়া-পোলা অয় না – এসব লইয়া চিন্তা কইরো না।
ক্যান?
মাইয়া-পোলা না থাকলে একরকম জ্বালা। আর থাকলে হরেকরকম জ্বালা। সহ্য করার মতো না।
আবোল-তাবোল কী কইতাছো?
বিড়িতে সুখটান দিয়ে হাসে পাহারাদার, আমার কথাডা শুনতে ভালা লাগবো না তোমার।
কও, ভালা লাগবো – জেদ ধরে কুলসুম।
হুনবাই?
হয় হুনমু। তুমি কও।
মাইয়া-পোলা না থাকলে মাইনষে আমাগো আঁটকুড়া কইবো, কউক। আপত্তি নাই। কিন্তু যহন মাইয়া-পোলা অইবো, খাওয়াইতে পারমু না, পরাইতে পারমু না, স্বাদ-আল্লাদ মিটাইতে পারমু না, তহন কী অইবো? কেউ কি আমাগো দুঃখ বুঝবো?
কুলসুম অবাক হয়ে তার পাহারাদার স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকে। মানুষটাকে সবাই নির্বোধ বা বোকাসোকা মনে করে। অথচ আজ কী শোনালো? পুত্র-কন্যা সম্পর্কে এভাবে যে চিন্তা করা যায়, কোনোদিন ভাবেনি সে।
পাহারাদার আরো যোগ করে, পোলাপান যে অয় না হেইডা ভালাই। যা কামাই করতে পারি দুইজনে খাই আর ঘুমাই, দিন চইলা যায়। কারো কাছে হাত পাততে অয় না। কারো কাছে পাওনাদার না আমরা। তাছাড়া পোলাপানরে খাইতে দিতে না পারলে বাপ-মায়ের কষ্ট অয়।
তুমি এতোসব কেমনে জানলা?
পাহারাদারের মুখে ম্লান হাসি – জানছি আমার বাপ-মায়ের কাছ থেইক্যা।
আমরা আছিলাম সাত-আট ভাইবোন। দিনের পর দিন, রাইতের পর রাইত না খাইয়া কাটছে। মায়ে আমাগো বুকে জড়াইয়া কানতো, আহা রে কী কান্না – বলতে বলতে ব্যথা অথবা তিমির স্মৃতির পাতা উন্মোচনে চোখে পানি আসে পাহারাদারের, কণ্ঠ ধরে আসে অশ্রুপাতে।
কুলসুমের অবাক হওয়ার পালা। মানুষটার সঙ্গে এতোদিন ঘরসংসার করছে অথচ এতোকিছু জানে না মানুষটা সম্পর্কে। কুলসুম আরো জেনেছে, মানুষটা যেমন সরল, তেমনি খেয়ালিও।
পাহারাদার এখনো শৈশব-কৈশোরকালের কোনো সঙ্গী পেলে সেই সময়ের আশ্চর্য সব গল্প বলে। এলাকার শীতের সময় ধান ওঠার মৌসুমে যাত্রাগানের দল আসতো। রাতের পর রাত জেগে মানুষটা সেই যাত্রা দেখতো। তখন তার বয়স ছিল বারো-তেরো বছর। দিনে-রাতে হাঁটতে-বসতে যাত্রার গান থাকতো মুখে মুখে। গলাটা নাকি ছিল খুব ভালো। যে শুনত, মুগ্ধ হতো। যাত্রাদলের অধিকারীও একদিন মানুষটার গান শুনেছিল এবং গান ও গলার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিল।
সাত-আটদিন পর যাত্রাদল চলে যায় তাদের নিজস্ব আয়োজন শেষ করে, সঙ্গে নিয়ে যায় এই মানুষটাকে। যাত্রাদলের সঙ্গে ছিল টানা দশ বছর। গাইতো বিবেকের পাঠ। খুব সুনাম কুড়িয়েছিল মানুষটা। বিবেকের গানের সুরে-তালে-লয়ে এমন মাধুর্য আর হিমশীতল সৌন্দর্য থাকতো যে, লোকেরা কাঁদতো! সেই যাত্রাদল ভেঙে গেছে, কে কোথায় ছড়িয়ে পড়েছে, কারো কোনো ঠিকানা নেই। মানুষটা ফিরে আসে গ্রামে। বাবা ইতোমধ্যে পরপারে জায়গা নিয়েছে। মা বিয়ের ব্যবস্থা করে।
সেই থেকে কুলসুমের সঙ্গে মানুষটা অথবা মানুষটার সঙ্গে কুলসুম ঝুলে আছে সুতায় বাঁধা লাটাই আর ঘুড়ির সম্পর্কে। মানুষটা অসম্ভব ভালোবাসে কুলসুমকে। কুলসুমও ভালোবাসে মানুষটাকে। দুজনার কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। দুজনেই শান্ত। দুজনেই কলহ অপছন্দ করে। বিয়ের পর বাপের ভিটায় আরেকটি ছোট্ট দোচালা ঘর উঠিয়ে সংসার রচনা করে। মানুষ যদিও দুজন, পেটও তো দুটো। মুখে তো খাবার দিতে হয়। মানুষটা গৃহপালিত তেমন কোনো কাজ পারে না। যদিও কোনো বাড়িতে দুদিন কোনো কাজ করে তো পাঁচদিন শুয়ে থাকতে হয় শরীরের ব্যথায়। কুলসুম পাশের মহাজন বাড়িতে কাজ করতে চায়, অসুরের শক্তিতে ক্ষেপে ওঠে মানুষটা।
মহাজনরে তোর পছন্দ অইছে? যা, গেলে আর আমার ঘরে আবি না।
কন কী আপনে?
যা কইতাছি বুঝতাছোস না? আমি তো জানি, তুই সুন্দর! তোর দিকে রাস্তাঘাটের বেবাক কুত্তার নাহান চাইয়া থাহে। তোরে কত লোভ দেহায়, আমার ঘরে তুই থাকবি ক্যান? খাইতে, পিন্দন দিতে পারি না। যা যা – মানুষটা মাটিতে বুক দিয়ে শুয়ে পড়ে। হতভম্ব কুলসুম। মানুষটা এমন করে কেন? এমন তো ছিল না। আসলে পেটে খাবার না থাকলে সুস্থ মানুষ অসুস্থ হয়ে যায়। ক্ষুধার্ত মানুষের আত্মসম্মানবোধ তীক্ষ্ণ। কুলসুম আর পারে না সহ্য করতে। স্বামীকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে এক রাতে তারা চলে আসে ঢাকায়। অনেক কষ্ট আর দুর্দশার পর তারা ডেরা বাঁধে ওয়াপদা রোডের বস্তিতে। মানুষটা কাজ পায় পাহারাদারের।
দেখুন তো পাঠক, কোথায় পাহারাদারের দরজায় ধাক্কা আর কোথায় আপনাদের নিয়ে এলাম! নিশ্চয়ই বিরক্ত হচ্ছেন! একটু ধৈর্য ধরুন, গল্পটাকে দুমড়ে-মুচড়ে একটা জায়গায় নিতে হবে তো। সে-কারণে গল্পটাকে একটু প্রশ্রয় দেওয়া দরকার। চলুন, আমরা দরজা ধাক্কার খবরটা নিই।
দরজা ধাক্কানোর শব্দে বিরক্তির সঙ্গে উঠে বসে পাহারাদার! ধাক্কানোর শব্দটা ক্রমেই ভয়ংকর হয়ে উঠছে। চোখ কচলাতে কচলাতে দরজা খোলে পাহারাদার। কিন্তু দরজা খুলে যাদের সে দেখে, তাদের যেন কখনোই আশা করেনি। পাহারাদার ভেবেছিল, কুলসুমের হয়তো পায়খানা চেপেছে; কিন্তু…
আপনারা?
হাসে দাঁড়ানো মানুষ দুজন। একজন পরিচিত, এলাকার দাগি চোর। বেশ কয়েকবার জেল খেটেছে। সাঈদ নাম লোকটার। সঙ্গের লোকটাকে সে চিনতে পারে না, তবে কোথাও দেখেছে, মনে করার চেষ্টা করে।
কী মিয়া দরজায় খাড়াইয়া রাখবা নাকি ভেতরে ঢুকতে দিবা? প্রায় জোর করে তাকে ধাক্কা দিয়েই ভেতরে ঢুকতে চায় সাঈদ।
পেছন থেকে টেনে ধরে সঙ্গের লোকটা …হান্দানোর দরকার নাই। বাইরে খাড়াইয়া কথাডা কইয়া যাই। ওইদিকে পার্টি অপেক্ষায় আছে।
আইচ্ছা… সাঈদ তাকায় পাহারাদারের দিকে কুতকুতে চোখ তুলে… তোমারে ভাই একটা কাম কইর্যা দিতে অইবো।
কী কাম?
ঠিক কাম না, আমাগো লগে একটু সহযোগিতা করবা। করলে… সাঈদ টাকরার সঙ্গে জিহবার অদ্ভুত সংযোগ ঘটিয়ে ছন্দময় এক শব্দ উদ্গিরণ করে, সঙ্গে সঙ্গে ডান চোখটাও একটু টিপে দেয়। বাকিটা বলে সঙ্গের লোকটা …আমাগো সহযোগিতা করলে তোমারে আর রাইত জাইগ্যা, বৃষ্টিতে ভিইজ্যা পাহারা দিতে অইবো না। এক রাইতে রাজা-বাদশা অইয়া যাইবা।
পাহারাদার বিরক্তিতে-রাগে ভেতরে ভেতরে কাঁপতে থাকে কিন্তু বাইরে প্রকাশ করে না। ঘুমটা পর্যাপ্ত না হওয়ায় শরীরের অবকাঠামোতে, চোখে জ্বালা শুরু হয়েছে। দাঁতে দাঁত কামড়ে সব সহ্য করে দাঁড়িয়ে আছে।
তাইলে রাজি? সাঈদ প্রশ্ন করে।
কামডা কী?
কামডা অইলো, সাঈদ সামান্য সময় ভাবে …কামডা অইলো আমাগো লগে থাকবা।
মানে?
হাসে সঙ্গের লোকটা বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে খিকখিক করে… বুঝলা না? আমাগো লগে রাইতের কাম করবা। একটা খেপ ঠিকমতো মারতে পারলে সোনাদানা, টাকাপয়সা…
তোমরা আমার বাসা থাইক্যা বার হও… পাহারাদার গম্ভীর কণ্ঠে বলে। দুজনার কুৎসিত হাসিতে চারপাশটায় ভৌতিক ছায়া নামায় ঘরটার মধ্যে, ভাসতে থাকে পাহারাদার। মনে হচ্ছে এই ঘরটা পাহারাদারের নয়, ঘরটা ওদের। ওরা দখল করে নিয়েছে। পাহারাদার ভাড়াটে, উদ্বাস্ত্ত। যে-কোনো সময়ে ওরা পাহারাদারকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে পারে। যদিও এই ছোট্ট ঘুপচি বাসাটা পেয়েছে সে পাহারার চাকরিসূত্রে। এলাকার একজন ধনবান মানুষের জায়গা, রাস্তার পাশে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়েছিল।
পাহারাদারের চাকরিসূত্রে থাকার ব্যবস্থা হিসেবে ঘর উঠিয়ে থাকতে দিয়েছে। যার জায়গা, তার জায়গার দখলও বজায় থাকলো, পাহারার কাজও চললো। পাহারাদার অতশত হিসাব করেনি, করতে পারেনি। থাকতে পারছে, মাসে মাসে ভাড়া শুনতে হচ্ছে না… এটাই যথেষ্ট তার কাছে।
হাসতে হাসতে সাঈদ তৈলাক্ত নোংরা বিছানায় বসে। বসে বসে হাসে। হাসতেই থাকে। দরজার বাইরে দাঁড়ানো লোকটা ধমক দেয় …এতো হাসার কী অইলো?
যদিও সে ধমক দিয়েছে, তবু তার ধমকের মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন হাসির দোলা আছে, অনেকটা উপহাসের।
সাঈদ দোলে ডানে-বাঁয়ে… হাসি আইলে কী করমু? কানমু? বলতে বলতে সাঈদ গম্ভীর হয়… শোনো মিয়া পাহারাদার, তোমারে আসল কথা কই… মাসে মাসে যা পাও, আমরা তোমারে এক রাতেই হেইডা দিমু। তোমার কষ্ট কইর্যা আমাগো লগে যাওনেরও দরকার নাই, খালি বাসায় থাকবা, ভাবি আছে না – চোখ টিপে সাঈদ, সুন্দরী ভাবিরে লইয়া কেচকি মাইর্যা ঘুমাইয়া থাকবা। এলাকার লোকরে কইবা, তোমার শরীরভরা অসুখ, পেটে ব্যথা। কি, পারবা না?
সাঈদের প্রস্তাব শেষ হতে পারে না, দরজার পাশে দাঁড়ানো লোকটা ভেতরে ঢোকে, লোকটার শরীর থেকে পচা মাছের বিশ্রী গন্ধ আসে, পাহারাদার কিংকর্তব্যবিমূঢ় দাঁড়িয়ে থাকে। লোকটা পাহারাদারের সামনে এসে দাঁড়ায় …শোনো, তোমারে আরেকটা প্রস্তাব দিতাছি। আমার মনে কয় এইডা অনেক ভালা। সাপও মরব, মাগার লাঠিও ভাঙব না। তোমারে আমরা দড়ি দিয়া আচ্ছা কইর্যা বাইন্দা রাখমু রাস্তার মোড়ে, মুখে লাগাইয়া দিমু স্কচটেপ, ওই যে চ্যাপ্টা বড় স্কচটেপ পাওয়া যায়, লাগে চাকু দিয়া ঠ্যাঙে কিংবা পাছায় হালকা দুইডা পোঁচও দিলাম। এলাকার লোকজন তো ভালো, পুলিশের বাপও তোমারে সন্দেহ করতে পারবো না। মাঝখান থাইক্যা এক রাইতের কামাই বিশ হাজার টাকা।
তোমরা এহন যাইবা নাকি এলাকার লোকজন ডাকমু? পাহারাদারের ভরাট কণ্ঠের গম্ভীর উচ্চারণে সাঈদ এবং তার সঙ্গী পরস্পর তাকায়।
পাহারাদার, সাঈদ উঠে দাঁড়ায় …আমাগো ভয় দেখাইতাছে? ঠান্ডা-নিস্পৃহ গলা সাঈদের। চোখ কোটর ছেড়ে বাইরে আসতে চায়।
সাঈদের সঙ্গী লোকটা হঠাৎ গলে নরম হয়ে যায় …হোনো, তুমি ভাই বুঝতে পারতাছো না। আমরা তোমার বন্ধু, শত্রম্ন তো না। বেশি না, এক রাইতের একটা কাম করমু। আমরা খোঁজখবর লইয়াই তোমার কাছে আইছি। সামনের গলির মাথায় যে তিনতলা বাড়ি, হেই বাড়ির পোলা বিদেশ থাইক্যা আইবো, প্রচুর টাকা-পয়সা আনবো… একটা সুযোগ দাও ভাই। তোমারও লাভ, আমাগোও লাভ।
পাহারাদার আরো ঠান্ডা গলায়, নিস্পৃহভাবে জবাব দেয় …তোমরা যাও, আমি ঘুমামু।
অবাক তাকায় দুজন দুজনার দিকে।
আমাগো কথা রাখবা না? সাঈদ খুব সরলভাবে বলে।
না।
ভাইবা দেহো।
দেখছি। এই এলাকার মানুষেরা আমারে বিশ্বাস কাইরা পাহারাদার বানাইছে। হ্যাগো নেমক খাইয়া বাঁইচা আছি। আমি নেমকহারামি করতে পারমু না।
আবার হাসে দুজন। হাসতে হাসতে দুজন গড়িয়ে পড়ে দুজনার গায়ে। দুজনার হাসি অবাক হয়ে দেখে পাহারাদার। হাসি থামিয়ে সাঈদের সঙ্গের লোকটি আরো কাছে আসে পাহারাদারের, কাঁধে হাত রাখে সে খুব আন্তরিকতার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে – এই দেশে নিমকহারাম কে না কও দেহি! শিক্ষিত লোকেরাই বেশি নিমকহারামি করে। পত্রিকা পড়তে পারো? দেহো না, প্রতিদিন ব্যাংক ম্যানেজার, ব্যাংকের এমডি, চেয়ারম্যান, ডাইরেক্টররা টাকা মারে। মারতে মারতে ব্যাংক খালি কইরা ফালায়। মামলায় কিন্তু হেগো না ধরে পুলিশে, না ধরে আইনে। হ্যারা মন্ত্রী-মিনিস্টারগো লগে ঘুইর্যা বেড়ায়, হাওয়া বাড়ির হাওয়া খায়। রাজনীতিবিদরা অইলো বড় ডাকাইত। হ্যারা গাছেরডা খায়, তলারডাও খায়। মোরা জনগণ, মোগো কিছু অয়? অইবো? তয় দোস্ত, তুমি আর না কইরো না। রাজি হইয়া যাও – কথা বলতে বলতে লোকটা প্রায় জড়িয়ে ধরে পাহারাদারকে।
পাহারাদার নিজেকে লোকটার দুহাতের বন্ধনী থেকে ছাড়িয়ে নেয় এবং বেশ জোরের সঙ্গে জানিয়ে দেয় – আমি এক কথার মানুষ। যহন না খাইয়া রাস্তায় ঘুরছি – এই এলাকার লোকেরা আমারে কাম দিছে, থাকতে দিছে। আমি হ্যাগো লগে বেইমানি করতে পারুম না। তোমরা যাও, আর থাকলে কিন্তু ভালো অইবো না। আমি লোকজন ডাকমু।
সাঈদ সঙ্গী লোকটার হাত ধরে, চল বুঝছি।
দুজনে দরজার বাইরে আসে। সাঈদের সঙ্গী ঘুরে দাঁড়ায় – পাহারাদার কাজটা তুমি ভালা করলা না।
দুজনেই চলে যায়। পাহারাদার অবশ শরীরে আবার বিছানায় যায়। শুয়ে শুয়ে সে ভাবতে থাকে – কাজটা কি ঠিক করল? ওরা যদি কোনো ক্ষতি করে? কী ক্ষতি করবে? কী আছে তার? সে নিজে, স্ত্রী কুলসুম আর ছাপরা ঘরটা। ধন-সম্পদ কিছুই নাই। হাসে আপনমনে পাহারাদার। হাসতে হাসতে একসময়ে ঘুমিয়ে যায়।
পাহারাদার ঘটনাটা প্রায় ভুলেই গেছে।
প্রায় মাসখানেক আগে তার ঘরে সাঈদ আর ওর সঙ্গী এসেছিল। কথাটা কাউকে বলেনি। বললেই ঝামেলা। নানা প্রশ্ন। কেন এসেছিল? কী বলেছিল? শেষে হয়তো চাকরিটাই হারাবে! না কাউকে বলবে না। এমনকি কুলসুমকেও ঘটনাটা বলেনি। অথচ প্রতিরাতের পাহারার নানা ঘটনা কুলসুমকে পরের সন্ধ্যায় ভাত খেতে খেতে বলে। কখন কোন কুকুরটাকে কোথায় দেখেছিল, রাস্তায় হঠাৎ একটা লোকের সঙ্গে দেখা হলে লোকটা তাকে দেখে কী ভয় পেয়েছিল, সব, সব বলে।
অথচ সাঈদ এবং ওর সঙ্গীর প্রসঙ্গটা একদম বলেনি। না বলার কারণে পাহারাদার কখনো কখনো অনুতপ্তও বটে। কিন্তু অনেক দিন হয়ে যাওয়া ঘটনা এখন বললে কুলসুম খুব রাগ করবে। গভীর নিস্তব্ধ রাতের একটা বুনো সৌন্দর্য আছে – সে-সৌন্দর্যটা কেমন, কীভাবে আসে মানব চরাচরে পাহারাদার বুঝতে না পারলেও কিছুটা হলেও অনুভব করে। রাতের এই হিরণ্মময় নিস্তব্ধতা আর কুলসুমের গভীর শরীর তাকে খুব আকর্ষণ করে। বিশাল এই পৃথিবীতে এই দুটির প্রতিই তার প্রবল নেশা। অনেক সময় গভীর রাতে রাস্তার নিয়ন সাইনের আলো-আঁধারির খেলায় হাঁটতে হাঁটতে, চারদিকে সজাগ চোখ রাখতে রাখতে বুঝতে চেষ্টা করে তার কাছে কে বেশি আকর্ষণীয়! এই গভীর রহস্যময় রাত নাকি কুলসুম, কুলসুমের ভরাট নিপাট শরীর, শরীরের গভীর সুড়ঙ্গ? হিসাব মেলাতে পারে না। কখনো কখনো রাতে কুলসুমের নেশা পেলে দৌড়ে চলে গেছে ঘরে। দরজা খুলিয়ে হঠাৎ বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে সে কুলসুমের ওপর। কুলসুম প্রথমে ঘুম-জড়ানো চোখ ও কণ্ঠে আপত্তি জানালেও কিছুক্ষণের মধ্যে সেও গভীর রমণ-উষ্ণতায় সাড়া দেয় পাহারাদারের সঙ্গে।
আবার লাঠি হাতে পাহারাদার এসে দাঁড়ায় রাস্তায়।
আজ রাতে আকাশে একটু একটু মেঘ জমেছে। টুপটাপ দু-এক ফোঁটা বৃষ্টিও পড়ছে। পাহারাদার পাহারায় মগ্ন। সারারাত পাহারায় থেকে খুব সকালে সে বাসার দিকে যায়; কিন্তু দরজার কাছে এসে অবাক। দরজা খোলা। দরজা খোলা কেন? ভেতরটা অন্ধকার। কুলসুম কি বাইরে গেছে? না, কুলসুম তো কখনো রাতে বাইরে যায় না। রাতকে সে খুব ভয় পায়। একা রাতে বাইরে যায় না। পাহারাদার ভেতরে ঢোকে। অদ্ভুত একটা শব্দ শোনে সে; দ্রুত সুইচ টিপে লাইট জ্বালায়। আলোয় যা দ্যাখে, তা দেখার জন্য মোটেও প্রস্ত্তত ছিল না পাহারাদার। গভীর রাতের রহস্যময় সুন্দরের মতো তার স্ত্রী কুলসুম ক্ষতবিক্ষত হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে। এক অসহ্য যাযাবর-কষ্টে কুলসুম বোবা। ঘটনার আকস্মিকতায় পাহারাদার কয়েক মুহূর্ত থমকে যায়। সারা মুখ-শরীরে কামড়ের দাগ। রক্ত পড়ছে। এলাকার লোকজনকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে। লোকজন পাহারাদারের স্ত্রীকে হাসপাতালে পাঠায়। হাসপাতালে কিছু সময়ের জন্য কুলসুমের জ্ঞান ফিরে এলে সে জানায়, সাঈদ ও তার চার সঙ্গী তার মুখে কাপড় গুঁজে দিয়ে একের পর এক বলাৎকার করেছে আর বলেছে – পাহারাদার, মাইনষের ঘর ভালো কইর্যা পাহারা দে।
সুধী পাঠক, গল্পের শুরুতে আপনাদের কাছে সময় প্রার্থনা করেছিলাম। গল্পটা শেষ প্রায়। প্রায় বলছি এ-কারণে যে, উপসংহার বাকি আছে। এ পর্যন্ত পড়ে কী মনে হয়েছে আপনাদের? আসলেই আমাদের দেশটা কুলসুমের ঘরের মতো অরক্ষিত কিনা?
আপনি, আমরা অথবা পলিটিশিয়ানদের কথা অনুসারে আমরা সাধারণ জনগণ অরক্ষিত কিনা? যদি সত্যি হয়, গল্পটাও সঠিক। একটি অরক্ষিত গল্প এটি। আসুন, গল্পের উপসংহারে প্রবেশ করি।
হাসপাতালে পাহারাদারের স্ত্রী কুলসুম অসহ্য যন্ত্রণায় কয়েকদিন পর মারা গেছে। কুলসুমকে বাঁচানোর কোনো পথ ছিল না। কারণ পাষ-রা কুমিরের মতো ধারালো দাঁতের আক্রমণ চালিয়েছিল ওর শরীরের অধিকাংশ জায়গায়। মানুষের শরীরে মানুষের কামড় নয়, এটা ছিল মানুষের শরীরে শুয়োরের নৃত্য। আমাদের সমাজ-সংসারের পরিপ্রেক্ষেতে কুলসুম কিন্তু মরে গিয়েই বেঁচে গেছে।
শেষের গল্প
পাহারাদার এখনো রামপুরার ওয়াপদা রোডের উপগলি পাহারা দেয়। বাসার দরজাটা এখন আর বন্ধ থাকে না, দিন-রাত থাকে খোলা। কারণ জানে, কুলসুম মারা যাওয়ার পর পুরো বাংলাদেশটাই অরক্ষিত, খোলা। সেখানে ছোট ঘরটায় তালা দেওয়া আর না দেওয়া সমান।