খুনি বলতেই চোখে যে নৃশংস, পাশবিক, ক্ষিপ্ত এক অবয়ব ভাসে – সামনে যে মায়াবী তরুণীটি দাঁড়িয়ে, তাকে কোনো অবস্থাতেই সেরকম উন্মত্ত খুনি বলে আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় না। কারো অজানা নয়; একটি মানুষ যে-মুহূর্তে খুন করে, সে-মুহূর্ত থেকে সে খুনি – তার আগের মুহূর্তটিতেও সে স্বাভাবিক মানুষদেরই একজন – এসব বিবরণ আমাদের জানা। তার পরও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা হোসনে আরা বকুলকে খুনি হিসেবে ভাবতে আমাদের কষ্ট হয়। গোলগাল মিষ্টি একটা মুখ, কত বয়স হবে? মেয়েদের, বিশেষ করে গ্রামের মেয়েদের বয়স আমি বুঝতেই পারি না; তারপরও ১৯-২০-এর বেশি হবে বলে মনে হয় না – কোমর ছাপানো চুলের প্রপাত, হাত-পা শক্ত-সমর্থ, পুরুষ্টু ঠোঁট, বড় বড় চোখ – এককথায় বলা যায়, হোসনে আরা বকুল সুন্দরী, সুন্দরী। তবে কি যে হত্যা বা অপমৃত্যুর রহস্য উদ্ঘাটনে উদ্যোগী ও নেতৃস্থানীয় জনাকয়েক নারী উন্নয়নকর্মীর সঙ্গে আমরা গোটা দুই সাংবাদিক, এতো দূরে, ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া পার হয়ে বাদিহাটি নামের ঘনগ্রামের এক প্রান্তে পৌঁছি – তার পেছনে বকুল নামের এই মেয়েটির সৌন্দর্য দায়ী? অন্যদের কী মনে হয় জানি না, আমার তা-ই মনে হতে থাকে; এমন চোখকাড়া সৌন্দর্যের একটি মেয়ে কেন তার স্বামীকে খুন করতে যাবে? এটি কীভাবে সম্ভব? হাস্যকর মনে হবে – তারপরও আমার মনে হতে থাকে – কোনো খুনি এতো আয়তচক্ষু, স্মিত ওষ্ঠের মায়াবী সৌন্দর্যম–ত হবে? নাহ্। মেয়েটি খুনি – আমি বিশ^াসই করি না।
‘তুমি বকুল? হোসনে আরা বকুল?’ বেসরকারি সংস্থার নারী উন্নয়ন নেত্রী শিরীন মুস্তাফা বলেন।
‘জি’ – বকুল, নতমুখে বলে।
‘বসো তুমি। দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো’; শিরীন মুস্তাফা বলেন। বক প্রিন্টের শাড়ি পরা বকুল আঁচল টেনে ঘোমটা দিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে। আমরা বাদিহাটি বাজারে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার আপিসে – ঢাকায় সংস্থাটির মূল আপিস ও শিরীন মুস্তাফা এর প্রধান। বাদিহাটিতে একটি শাখা আপিস তাদের; এরই সম্মেলন কক্ষ – মাঝারিমাপের কক্ষে একখানা টেবিল ঘিরে সাত-আটটি চেয়ার, একখানা আলমিরা, ঘূর্ণায়মান ফ্যান – চার উন্নয়নকর্মী আর আমরা দুই সাংবাদিক বসেছি – বকুল বসে শিরীন মুস্তাফার মুখোমুখি চেয়ারে; উন্নয়ন সংস্থার স্থানীয় সমন্বয়ক রুহুল আমিন তার পাশের চেয়ারে।
‘শোনো। কোনো কিছু গোপন করবে না। আমরা তোমাকে সহায়তা করার জন্য এসেছি।… যদি গোপন করো তো আমরা তোমার কোনো সাহায্যেই আসতে পারব না’ – শিরীন মুস্তাফা চেষ্টা করেন বকুলকে সহজ করে তোলার জন্য; বকুল কথা বলে না, মাথা নিচু করে ঘামতে থাকে।
বৈশাখ মাসের প্রচ- তাপ বাইরে, আমরা যে-কক্ষে বসি, তার চাল টিনের তৈরি, রোদে টিন গমগমে হয়ে আছে, ঘূর্ণায়মান ফ্যানের বাতাসে মনে হয় তাল তাল গরম কেটে খ–বিখ- হয়ে ছড়িয়ে যায়। আমার মনে হতে থাকে, আলাপ দীর্ঘক্ষণ চলবে; দুপুরের খাবার খেয়ে বসলেই হতো। সেটি তো আর বলা যায় না; আমি এখানে শিরীন মুস্তাফার আহবানে এসেছি, তার সঙ্গে পরিচয়-আলাপ বছরকয়েক আগে সেগুনবাগিচার আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এক অনুষ্ঠানে। তারপর থেকে শিরীন মুস্তাফা বিশেষ কোনো অনুষ্ঠান-আয়োজনে বরাবর আহবান করেন। ধীরে ধীরে তার সঙ্গে আমার এক ধরনের পেশাগত নৈকট্যও তৈরি হয়; ভালো লাগে শিরীন মুস্তাফার স্পষ্ট-সুন্দর কথাবার্তা; চল্লিশের মতো বয়স; তবে বয়স তার মনে হয় আরো দশ বছর কম! একদিন হাসতে হাসতে এ-কথা বলায় তিনি হেসেই উত্তর দিলেন, ‘এটাকে গুড না ব্যাড কমপিস্নমেন্ট ভাবব… ভেবে দেখতে হবে।’ জেনেছি, তিনি বিবাহিত। স্বামী ইনডেনটিং ব্যবসা করেন, দুটো ছেলেমেয়ে নিয়ে তারা বনানীতে থাকেন। বলতেই হয়, ঝকঝকে স্মার্ট শিরীন মুস্তাফা নিজের কাজের ব্যাপারে যেমন দক্ষ, তেমনি তিনি মন দিয়ে কাজ করতে ভালোবাসেন। খেয়াল করেছি, প্রতিটি কাজে সংস্থার প্রধান হিসেবে অতটা প্রত্যক্ষ উপস্থিতি অংশগ্রহণ তার প্রয়োজন না হলেও তিনি সর্বদা যত ছোট কাজই হোক না কেন, তাতে নিমগ্ন। যত দেখি শিরীন মুস্তাফাকে, তার ব্যক্তিত্বের দ্যুতি আমাকে মুগ্ধ করে।
দিনদুই আগে শিরীন মুস্তাফা বললেন, ‘ময়মনসিংহের বকুলের কথা তো জানেন। পত্রিকায় এসেছিল মাসখানেক আগে। স্বামী হত্যায় পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। আমাদের ফাইন্ডিংস বলছে, মেয়েটি জটিল একটা পরিস্থিতির শিকার। আমরা আসলে সত্যটা জানতে চাই। আমরা তার পাশে দাঁড়াতে চাই।’
‘নিশ্চয় দাঁড়াবেন। আমরা সবাই মিলে তার পাশে দাঁড়াব।’
‘ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৭ ধারায় মহিলা বিবেচনায় দায়রা জজ তাকে বিশেষ জামিন দেয়। আমরা যাচ্ছি সেখানে, আপনিও চলুন। সেরকম মনে করলে পত্রিকায় রিপোর্ট করবেন।’
আমি নবযুগ পত্রিকার সিনিয়র রিপোর্টার। আমার নানা কাজ-অকাজের প্রিয় এক সঙ্গী – আলতাফ ভাই; যুগবার্তা পত্রিকার সাংবাদিক আলতাফ হোসেন; তাকে ফোন করি – ‘ভায়া, এক্সক্লুসিভ একটা কেস আছে ফুলবাড়িয়ায়। মৈমনসিংয়ের ফুলবাড়িয়া। দু-তিন দিন থাকতে হতে পারে। থাকা-খাওয়া সব ‘দিশা’ এনজিও বহন করবে। চলেন যাই।’ আমরা শিরীন মুস্তাফার দিশা এনজিওর বনানী আপিস থেকে মাইক্রোতে মোট ছয়জন সকাল ৮টায় রওনা দিয়ে দুপুর ১টার আগেই বাদিহাটি বাজারে পৌঁছে যাই; রুহুল আমিনকে আগে থেকে বলা থাকে। সে সরাসরি আমাদের স্থানীয় দিশার সভাকক্ষে নিয়ে বসায়।
গরমে বিশাল বপু আলতাফ ভাইয়ের অবস্থা শোচনীয়; তিনি ঘামতে ঘামতে বলেন, ‘শিরীন আপা, রুহুল আমিন আগে ডিটেইলস বলুক। তারপর বকুলের কথা আমরা শুনি।’
‘ঠিক আছে। সেটা ভালো হবে। রুহুল আমিন… বলেন, বকুলের ঘটনাটা এ-পর্যন্ত কী অবস্থায় আছে?’
রুহুল আমিন শুরু করে – ‘বকুল বাদিহাটি বাজারের জুতা ব্যবসায়ী নিজামউদ্দীনের কন্যা। স্থানীয় কলেজে মানবিক বিভাগে ইন্টার পরীক্ষার প্রস্ত্ততি নিতেছিল। সিদ্দিক সরকার এলাকার ধনী, কয়েক পুরুষের জোতদার। তিন বছর আগে তার ছেলে শিহাব সরকার পছন্দ করে বকুলকে। শিহাবের প্রথম স্ত্রী তার কিছুদিন আগে আত্মহত্যা করে। সেই ঘরে তার দুই ছেলেমেয়েও আছে। স্ত্রীর মৃত্যু নিয়া অনেক গুজব আছে।… শিহাবের বয়সও বকুলের প্রায় ডবল। তার চল্লিশ হয়া গেছে! বকুলরে পছন্দ করে। জোর করে একদিন তারে উঠায় নিয়া যায় দলবল নিয়া। তারপর তাদের বিয়ে হয়। এটা তিন বছর আগের কথা। এই তিন বছরে বকুল বাপের বাড়িতে দু-একবারের বেশি আসে নাই বা কলেজেও যাইতে পারে নাই। সবাই ভাবছে, ঠিক আছে – বিয়া হইছে। শিহাব যেমন চায়, তেমনই থাকুক তার বউ। বকুলের বাপও ভাবছে, বড়ঘরে মেয়ের বিবাহ হইছে… কিছুদিন পর সব ঠিক হবে। এর মধ্যে এক মাস আগে শিহাব নিহত হয় নিজ বাড়িতে। শ^শুরবাড়ির অভিযোগ – শিহাবের মাথায় বকুল ধান মাড়াইয়ের মুগুর দিয়া মারছে। তাতেই শিহাব মরছে। তারা মামলা করছে। বকুল এখন বিশেষ জামিনে আছে। সাধারণত এই কেসে জামিন হয় না। ম্যাডাম শিরীন মুস্তাফার নির্দেশে আমাদের সংস্থা থেকে ভালো আইনজীবী নিয়োগ দিয়া তার জামিনের ব্যবস্থা করি আমরা।’
‘আসল ঘটনাটা কী? এই মেয়েই খুন করছে?’ আলতাফ ভাই বিস্ময়ের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করেন।
‘আমাদের ধারণা – বকুল পরিস্থিতির শিকার। এখন বকুলই বলতে পারে আসল ঘটনা। আমাদের মনে রাখতে হবে, শিহাবের আগের বউ আত্মহত্যা করছিল!’ রুহুল আমিন বলতে থাকে – ‘এদিকে সিদ্দিক সরকারের ছেলেরা… আর তাদের দলবল পুরা এলাকার সন্ত্রাসের মূল হোতা! তাদের ভয়ে সবাই তটস্থ থাকে। বুঝতেই পারেন আপনারা, বকুল আর তার ফ্যামিলির কী সিচুয়েশন!’
আমরা লক্ষ করি, রুহুল আমিনের বয়ানের পুরো সময়টা বকুল আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে থাকলেও শেষের দিকে হু-হু করে কাঁদতে শুরু করে।
আমরা সবাই নিশ্চুপ থেকে বকুলকে কাঁদতে দিই; আমরা জানি কাঁদতে কাঁদতেই সে সহজ হবে এবং বলতে শুরু করবে। কিন্তু আমাদের ধারণা ভুল। সে কাঁদতেই থাকে। বেশিরভাগ সময় নিঃশব্দে, খানিক পর একটু জোরে জোরে এবং তা চলতেই থাকে; শিরীন মুস্তাফা বলেন, ‘আমরা সময় নিয়ে এসেছি। জোরাজুরির কিছু নাই। বকুল, আজ যাও। পরে কথা বলব।’
বকুল উঠে যাওয়ার পর শিরীন মুস্তাফা আমাদের বলতে থাকেন, ‘বকুল লেখাপড়া করতে পারেনি; আসলে শিহাব তাকে পড়তে দেয়নি। শিহাবের বয়স চল্লিশ পার – একটা লম্পট। তার প্রথম স্ত্রীর অপমৃত্যু হয়েছে, লোকে জানে – সে আত্মহত্যা করেছে। এদিকে বকুল ক্লাসের ভালো ছাত্রী ছিল, তার অন্যান্য ভাইবোন দিব্যি পড়াশোনা করছে; সেখানে সবচেয়ে মেধাবী হয়েও বকুলের জীবন থমকে যায়। এর মধ্যে এই ঘটনা ঘটে। কিন্তু ঘটনাটি কে ঘটিয়েছে, সেটা আমাদের জানতে হবে। যদি বকুলই খুন করে থাকে; তা হলে কেন সে খুন করল – এইটা আমাদের জানতে হবে! এই মেয়েটি একটা সত্যিকারের সিম্বলিক কেস হতে পারে; সারকামস্টেন্স যাকে সাডেন ভায়োলেন্ট করেছে।’
‘তবে খুনিকে আমরা কোনোভাবেই সাপোর্ট করতে পারি না।’ আলতাফ ভাই বলেন।
‘সাপোর্টের প্রশ্নই আসে না। তবে একজন কেন খুনি হয়ে ওঠে – এটা সোশ্যাল সায়েন্সের পার্ট। কনটেমপোরারি স্টাডিতে বকুল তাই জরুরি।’ শিরীন মুস্তাফার আপিসেরই আরেকজন তরুণ কর্মী মুরতাজা বেশ জোরের সঙ্গে বলে।
‘বকুলের বিরুদ্ধে বড় অন্যায়টি হয়েছে তিন বছর আগে। তাকে জোর করে উঠিয়ে নিয়ে বিয়ে করে শিহাব সরকার। বোঝা যায়, মাসলম্যানশিপই এখানে জয়ী হয়; মেয়েটির ইচ্ছার কোনো দাম দেওয়া হয় না। মেয়েটির পরিবারও রুখে দাঁড়াতে পারেনি।’ – আমাদের সঙ্গে আসা নারী উন্নয়নকর্মী পারভেজ হোসেন বলেন।
‘তবে, এটাও একটা সোশ্যাল ফেনোমেনা – মেয়েরা পরিস্থিতি মেনে নিয়ে চলতে চায়। বকুল কিন্তু বিয়েটা মেনে নিয়েই সংসার করছিল।’ – আলতাফ ভাই বিষয়টিতে চারদিক থেকে আলো ফেলার তাগিদ দেন।
‘এছাড়া তার কোনো উপায়ও ছিল না’ – তরুণ কর্মী মুরতাজা বলেন।
কথা বলতে বলতে আমরা উঠে যাই। এনজিও আপিসেই আমাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা; সুন্দর ব্যবস্থা বলতে হবে – ওপরে টিন হলেও বাংলো প্যাটার্নের বাড়িটাতে কমপক্ষে ছয়টি ঘর, এখানে নারীদের নানা ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় বলেও জানলাম। ঢাকা থেকে আসা আমাদের দল একসঙ্গে খেয়ে নিজেদের জন্য বরাদ্দ করা কক্ষে বিশ্রাম নিতে চলে যাই। আলতাফ ভাই আর আমার জন্য একটি কক্ষ বরাদ্দ।
‘নাহে ভায়া! একটা প্লেইন অ্যান্ড সিম্পল মার্ডার কেস। এখানে বকুলের সুন্দর চেহারা দেইখা আমাদের ভুললে হবে না!’ – আলতাফ ভাই আধশোয়া হয়ে বলেন।
‘একেবারে প্লেইন ভাবছেন কেন! মেয়েটা তো সব মেনে নিয়ে শিহাবের সংসার করছিল। এতোদিন পর সে খুন করতে যাবে কেন?’ – আমি আলতাফ ভাইকে বলতে থাকি – ‘পরকীয়া-টরকীয়ার ব্যাপার আছে নাকি! মেয়েটা যা সুন্দর!’
‘পরকীয়া হলে এতোদিনে সেইটা চাউর হইত! লোকজন রসালো গল্প বের করত।… কী জানি, বকুলকে দেখে অবশ্য মায়া হয়; এরকম মায়াবতী একটা মেয়ে কেমনে খুন করবে?’ আলতাফ ভাই চিস্তিত মুখে বলেন।
সন্ধ্যায় আমরা বাজারে যাই, সরগরম একটা চায়ের দোকান খুঁজে বের করি – হাসমত আলীর চায়ের দোকান, অনেকে বসে আড্ডা দিচ্ছে; আমরা দুজনে এক কোনায় বসি, সেখানে আতাহার আলী ঝন্টুর সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয় – স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য; তিনি বলেন, ‘হ, হুনছি। আপনেরা আসছেন। কুনো লাভ নাই! বেচারা বাঘের সঙ্গে লাগতি গ্যাছে।’
‘আচ্ছা, ব্যাপারটি কী? আপনারা কিছু জানেন এ-ব্যাপারে?’ তাকে জিজ্ঞেস করি।
‘ব্যাপার আবার কী? বকুলের মতো আদাইলা একটা মাইয়া এতোবড় টেরররে মাথায় মুগুরের বাড়ি দিয়া মারছে! এইটা কুনো কথা হইলো! শিহাব যদি ফুঁ দেয় তো মাইয়া উইড়া যাইত!’…আতাহার আলী ঝন্টু আধবোজা চোখে বলেন।
‘তাইলে ঘটনাটা কী?’
‘আছে কিছু। একেকজন একেক কথা কয়। আমি ভাই কুনো কথার মইদ্যে নাই। পুলিশ বুঝুক। কুন কথা কয়া কুনটার মধ্যে জড়াই!’ ঝন্টু মিয়া আর এই বিষয়ে কথা বাড়াতে চান না বলেও চোখ প্রায় বন্ধ করে বলেন, ‘বড় ফ্যামিলি। অনেক ক্যাচাল। ইন্টারকেলাস…বুঝছেননি? জমিজমা দখলফখল কইরা এরা বিতিকিচ্ছিরি করে। কয়েক জেনারেশন ধইরা… কী থিকা কী হইছে কেমনে কই…!’
আমরা বানাড় নদীর তীরে যাই, সন্ধ্যা হয়ে আসে – ক্ষীণকায় নদী, তবে আশ্চর্য সুন্দর এর জলপ্রবাহ – আলতাফ ভাই অবশ্য বিরক্ত হতে শুরু করেন, ‘মিয়া! কবি হবার আর জায়গা পাও না! কোথায় রুমে গিয়া রিলাক্স করুম… না, হাঁটাবাবা হইতে হইবো!’ তিনি রাগে প্রায় গজগজ করতে থাকেন, ‘এইসব খুনখারাবির মধ্যে নদীর তীরে হাঁটাহাঁটি… নাটক-সিনেমায় এইগুলা মানায়…’
‘আহা রে, রাগেন কেন? এসব নিয়েই তো জীবন।… এমন সুন্দর নদী! আরেকটু হাঁটি চলেন…।’ বলতে বলতে দেখি শিরীন মুস্তাফা তার সংস্থার তিন সহযোগী আর রুহুল আমিনকে নিয়ে গাড়ি থেকে নামেন; আমাদের দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এলেন তারা – ‘জানতাম, আপনারা এখানেই থাকবেন। এতো সুন্দর নদী! এখানে এলে মনে হয়, নদীর পাশেই বসে থাকি।’ – শিরীন মুস্তাফার কথা শেষ হওয়ার আগেই রুহুল আমিন আপত্তি তোলেন – ‘ম্যাডাম, নদীর পারে বসে থাকা খুবই বিপদ ডাইকা আনবে। অলরেডি দেখেন কয়টা মোটরসাইকেল চক্কর দিয়া গেল! পলান সরকারের দলবল। সিদ্দিক সরকারের আরেক পুলা পলান। আপনারা কী কারণে আসছেন – এইটা জানাজানি হয়া গেছে, আমার মনে হয় – কাইল সকালেই ঢাকায় রওনা দেন ম্যাডাম।’
‘তার মানে তো সিম্পল ইকুয়েশন রুহুল আমিন। পলান সরকারের লোকজন যেভাবেই হোক বকুলকে স্বামী হত্যায় ঝুলিয়ে দিতে চায়! ওর পক্ষে কোনো ভয়েসই শুনতে চায় না।… তার মানে কী দাঁড়ায়?’ বলতে বলতে শিরীন মুস্তাফা আমার দিকে তাকান, ‘দ্যাখেন আমাদের অবস্থা! একটা খুন হলো, বুঝলাম লোকটা সুবিধার না – সন্ত্রvসী। ধরা হচ্ছে, তার বউ তাকে খুন করেছে। কেন খুন করল? মোটিভটা কী? এখানকার কেউ তা জানতেও যেন চায় না… ব্যাপারটা যেন যার যা ইচ্ছা বুঝুক… আমার কী?’
নদীর তীরঘেঁষে কাঁকনপুর এলাকায় বকুলের বাবা নিজামউদ্দীনের বাড়ি; আমরা তার বাসায় সদলবলে পৌঁছে যাই। তিনি আমাদের দেখে শুরুতে রীতিমতো ভয় পেয়ে যান। অচিরে বুঝতে পারেন -এরাই এখন পর্যন্ত তার জন্য একমাত্র আলোর ইশারা বিন্দু – তিনি অঝোরে বলতে শুরু করেন; বুঝতে পারেন, শিরীন মুস্তাফা এই দলের নেতা, তাকে উদ্দেশ করেই তার কথার স্রোত বয়ে চলে, ‘আমার মেয়েটারে ওরা ফাঁসিতে ঝোলাবে। ওদের কা-কারখানা… ওদের কা-কারখানা দেইখা ফেলছে সব। তাই মেয়েটারে ফাঁসিতে ঝোলাবে। আগের বউটারে মাইরা বলছে – আত্মহত্যা করছে।’
বকুলের মা আম্বিয়া খাতুন এ-পর্যন্ত নিঃশব্দ ক্রন্দনরত ছিলেন। স্বামীর কথা শুনে চিৎকার দিয়ে উঠলেন, ‘এহন গুষ্টিসুদ্ধা মরবার চান? যা হবার হইছে… এখন এইসব বইলা লাভ কী! আমাদের পুলাপান নিয়া তো বাঁচতে হবি।’
‘বকুলকে বাঁচাতে হবে না?’ আমাদের একজন প্রশ্ন করে।
‘সেইটা বাঁচান আপনেরা। আমরার ক্ষেমতা কতটুক… আমরা জানি। বকুলরে যখন উঠাইয়া নিছিল… কেউ আসছিল দাঁড়াইতে… উঠাইয়া নিয়া বিয়া করছে; একটা বুড়া… দোজবর… তার সঙ্গে ভালোবাসা বইলা চালানো হইছে…’ কাঁদতে থাকেন আম্বিয়া খাতুন, ‘আমার সোনার টুকরা মেয়ে! আমরার ক্ষেমতা কতটা… জানি তো…এখন এইখানে চিল্লাপাল্লা কইরা আমরার মরার কুনো মানে নাই।’
এসব যখন চলছে, ভেতরবাড়ি থেকে বকুল এসে দাঁড়ায় আমাদের সমুখে; দুপুরের বিধ্বস্ত বকুল যেন কেঁদে কেঁদে কিছুটা ধাতস্থ। শিরীন মুস্তাফার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ম্যাডাম, আমারই সব দোষ। এতো মেয়ে থাকতে শিহাব সরকার দলবল নিয়া মোটরসাইকেলে বাড়িতে আইসা আমারে তুইলা নিয়া যায়। বলে, এক্ষুনি বিয়া করুম। কে আটকায় দেখি!… আবার শিহাবের ফ্যামিলি এখন চায়, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমারে ফাঁসিতে ঝোলাতে! জামিনই পাইতাম না; আপনেরা না থাকলে!’
‘তুমি তো আসল সত্য জানাচ্ছো না আমাদের!’ শিরীন মুস্তাফা বকুলকে বলেন।
‘আমি যাব আপনার কাছে।’ বকুল আস্তে করে বলে ভেতরে চলে যায়।
আমরা বেসরকারি সংস্থার ডরমিটরিতে ফিরে রাতের খাবার খেয়ে টেলিভিশনকক্ষে বসে গল্প জুড়ি। একে একে সবাই যার যার ঘরে চলে যায়; আলতাফ ভাইও ওঠেন, আমি আর শিরীন মুস্তাফা গল্প চালিয়ে যাই। আমি বলি – ‘আপা, আপনার কী মনে হয়; বকুল খুন করেছে? নাকি এর পেছনে অন্য কিছু আছে?’
‘খুনের চেয়ে এখানে আমাদের মেইন অবজেক্ট – আমাদের দেশের মেয়েদের সামাজিক অবস্থানটা আরেকবার তুলে ধরা! একটা তরুণীকে এক দুর্বৃত্ত তুলে নিয়ে যায় সবার সামনে। সে দাবি করে, মেয়েটিকে সে ভালোবাসে এবং সে তাকে তখনই বিয়ে করবে! কারো কিছু বলবার থাকে না। এমন দুর্বৃত্ত সে, তার বউ, তার দুটো বাচ্চার মা – সেই বউটি কিছুদিন আগে; আমার ধারণা নিহত হয়। তাকেও আত্মহত্যা বলে চালায় তারা। এখন বকুল কী করেছে, সেটা তার কাছ থেকেই আমরা শুনবো।… বকুল আসছে এখন।’ শিরীন মুস্তাফা বলেন।
‘…এখন রাত প্রায় ৯টা; বকুল আসবে এখন?’
‘খেয়াল করেননি। রুহুল আমিন ওদের বাসায় রয়ে গেছে। সে নিয়ে আসছে বকুলকে।’ শিরীন মুস্তাফার কথা শেষ হতে না হতে দেখি বকুল এসে টেলিভিশনকক্ষে তারই সোফার একপাশে বসে; এখন অনেকটাই সহজ ও সাবলীল সে; সম্ভবত শিরীন মুস্তাফার অমায়িক ও অন্তরঙ্গ ব্যবহার তার ভেতরকার অস্বস্তি দূর করে দিয়েছে।
‘হ্যাঁ, বকুল, এখন লোকজন একেবারেই কম। সোজা বলে ফেলো তো ঘটনাটা কী?’ শিমুল মুস্তাফা জিজ্ঞেস করেন বকুলকে।
‘আমার তো জামিন হবারই কথা না। অজামিনযোগ্য কেস। আপনি নামকরা উকিল নিয়োগ দিছেন বলে জামিন পাইছি। পলান সরকারদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে।’
‘ওরা তোমাকে ঝোলানোর জন্য এতো মরিয়া কেন?’
‘খুনটা আমিই করছি।’ ঠান্ডা গলায় বলে বকুল। আমরা চমকে তাকাই। আমি দেখি – মেয়েটির চোখের একটি পাতাও কাঁপছে না। সে বলতে থাকে – ‘আমার আইএ পরীক্ষার আগে বাড়িতে গিয়া তুইলা নিয়া যায় শিহাব সরকার। রীতিমতো গু-ামি। বলে কিনা… ভালোবাসি। আমিও আর উপায় না দেখে ভাবলাম, এইটাই ভালো। বিয়ে তো হবে! আমাদের বিয়ে হলো। আমি মাইনা নেওয়ার চেষ্টা করতেছিলাম। আমার নিজের ঘর হইছে বইলা ভাবছি। আমি সেইটাই আঁকড়ায়ে বাঁচতে চাইছি। তারপর দেখি, একটা জেলখানায় আমারে বন্দি করলো। পড়ালেখা না, কারো সঙ্গে কথাবার্তা না; আমার বাপ-মার সঙ্গে দেখাশোনা না পর্যন্ত! তার মা-মরা দুই ছেলেমেয়েকে মানুষ করা আর যখন-তখন তার হাতে চড়-থাপ্পড় খাওয়া আমার কাজ হয়ে দাঁড়ালো!’
‘নিয়মিত চড়-থাপ্পড় মারতো?’
‘কথায় কথায় চড়-থাপ্পড়, কিল-ঘুষি… আমি যেন একটা… বোধবুদ্ধি নাই। সেইটাও মাইনাই নিছিলাম… একটা জীবন… সেদিন যে কী হইলো… বাইরে থেকে আসছে – পুলাপান দুইটা স্কুল থেকে আসে নাই কেন এখনো, খোঁজ নিই নাই কেন – বইলাই দিলো এমন জোরে একটা থাপ্পড়… মাথাটা ঘুইরা গেল… দরজার পাশে কেন যে সেদিন একটা মুগুর ছিল; জানি না, আমি মুগুর তুইলা ওর মাথায় মারছি। সঙ্গে সঙ্গে শ্যাষ। এখন মনে হয়, বড় পাপ করছি; ফাঁসিই আমার প্রাপ্য। আমি দোষ স্বীকার কইরা ফাঁসিতে যামো ম্যাডাম।’ হু-হু করে কাঁদতে থাকে বকুল; আর দেখি শিরীন মুস্তাফার ফর্সা মুখটি মুহূর্তে কালো হয়ে যায়। স্তব্ধ হয়ে শিরীন বসে থাকেন। বকুল বলতে থাকে – ‘যখনই মারতো লোকটা, আমি চোখ দুইটা বন্ধ করে মাটির দিকে তাকায়া দুই হাত দিয়ে দুই কান বন্ধ করে দিতাম আর মার খাইতাম… দিনের পর দিন। সেইদিন… ঘটনার দিন… চোখ-কান সব খোলা রাখলাম যে ক্যান…!’
বিস্ময়-বিস্ফারিত শিরীন মুস্তাফার চোখ জলে টলমল করে; অনেকক্ষণ নিঃশব্দ থেকে জোরে একটি নিশ্বাস নেন – তিনি যেন আয়নায় নিজেরই প্রতিচ্ছবি দেখেন, এমনই আত্মমগ্ন কণ্ঠে আস্তে আস্তে শিরীন মুস্তাফা বলেন, ‘তুমি তো তাও পারছো একদিন
চোখ-কান খুলে দেখতে… আমি একদিনও পারি নাই! আমাকেও যখন মারে – থাপ্পড় দেয়, ঘুষি দেয়; আমি তার আগেই চোখ বন্ধ করে দুই হাত দিয়ে কান ঢেকে ফেলি। আমার মাথাটাও তখন মাটির দিকে নিচু হয়ে থাকে।’