পরিচয়

পরিচয়
আজ আমার বিয়ে। আমার দ্বিতীয় বিয়ে। প্রথম বিয়ের মতো এবারও আমার ইচ্ছের কোন মূল্যায়ন করা হয়নি। আনিচ্ছা নিয়েই হয়ে গেলাম অন্যের বউ।
আমি মৌ। সদ্য আঠারতে পা দেওয়া চঞ্চল এক তরুণী।ভাইদের আদরে আর বাবার শাসনে স্কুল জীবন শেষ করেছিলাম। কিন্তু কলেজে উঠার আগেই অন্যের বউ হওয়া ছিল আমার নিয়তি। বাবাকে ভয়ার্ত কন্ঠে বলেছিলাম’ “করব না এখন বিয়ে”। কিন্তু জমিদার পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক তৈরির সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাননি বাবা। আমার ডাক্তার ভাবি বললেছিলেন,”জসিম শিক্ষিত ছেলে। ও তোর পড়াশোনা থামাবে না। দেখ না, তোর বড় ভাই আমার পাশে এসে না দাঁড়ালে আমি ডাক্তার হতে পারতাম?সুতরাং বিয়ে করলে পড়াশোনা করা যাবে না এমন কিন্তু নয়।”
বাবার ব্যবসাটা যখন লাভের মুখ দেখছিল না বাবা তখন অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখনই বড় ভাইয়া সংসারের হাল ধরে নেন। তারপর ভাইয়ার জীবনে ঊনিশ বছরের এক তরুণীর আগমন ঘটে। ভাইয়াকে লীনা ভাবি কাঁপা গলায় বলে সে পড়তে চাই। ভাইয়া সকলের সাথে যুদ্ধ করে ভাবিকে পড়তে দেয়। মনে মনে দোয়া করছিলাম সে যেন আমার স্বপ্নকে ভালবাসে। যেমন করে ভাইয়া ভালবাসে লীনা ভাবি আর তার স্বপ্নকে।
বাসর রাতে পড়াশোনার কথা বলতেই যখন চড় খেতে হল তখন বুঝতে পারলাম আমার দোয়া কবুল হয়নি। জসিম বলেছিল, “তোমাকে আমার পরিবারের সেবা করতে এনেছি। তুমি তাই করবে। নারীদের কাজ সংসার করা তাই করবে। বিলেতি নারী হওয়ায় চেস্টা করবে না।” এ বলেই আমার উপর ঝাপিয়ে পড়ল সে।স্ত্রীর অধিকার আদায় করে নিল। মাকে পারের দিন বলেছিলাম চড়ের কথা। মা বলেছিলেন, “মেয়েদের মানিয়ে নিতে হয়।” মায়ের কথায় আবাক হলেও চুপ করে ছিলাম। চিৎকার করে ভাবিকে বলতে ইচ্ছে হয়েছিল ‘ভুল বলেছ তুমি ভাবি’। কিন্তু মায়ের কড়া আদেশ, ভাই ভাবিকে কিচ্ছু বলা যাবেনা।
উপায় না পেয়ে মানিয়ে নিলাম। কিন্তু পান থেকে চুন শুনতে হতো নানান কথা। যে শরীরে আঘাত করত সেই শরীর থেকে তৃপ্তি নিতে ভুলত না আমার স্বামী। এভাবে কয়েক মাস যাওয়ার পার বুঝতে পারলাম আমার মাঝে বড় হচ্চে আরেকটি জীবন। জসিম জানার পর থেকেই আমি তার চোখের মনি। শাশুড়ী মা আমার বাড়িতে মিস্টিও দিলেন। এই প্রথম আমার বাড়ি থেকে নেওয়ায় বদলে দিলেন। তিনি আমাকে ডেকে বললেন, “দেখ মা, যা হয়ছে মনে নিও না। দু চারডা কথা বইলা ফেলায়ছিলাম আরকি। এখন আমার পোলার ছেলেটার একটু যত্ন নিও।” ছেলে! বুকের ভেতর ছেৎ করে উঠল। মানে মেয়ে হলে? এই ভয়টা নিয়েই কেটে গিয়েছিল কয়েকটি মাস। এই কয়েক মাসে যত্নের কোন অভাব হয়নি। জসিমের আদরে সিক্ত ছিলাম আমি। একদিন তার সাথে হাসপাতালে গিয়েছিল চেকআপের জন্য। ডাক্তার আপা খুশি হয়ে বলেছিলেন মা ও অনাগত মেয়ে সুস্থ আছে। সাথে সাথেই জসিমের চোখ রক্তবর্ন হয়ে গিয়েছিল আর আমি ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছিলাম।
ঘরে ফিরার পরে অকথ্য ভাষায় গালি শুনতে হয়েছিল, সাথে পিঠে কয়েকটা আঘাত। আমার সহ্যের বাধ তখন ভেঙেছিল যখন জসিমের একটি লাথি পেটে পড়েছিল। হয়ত হত্যার দায় নিতে চায়নি তাই হাসপাতালের বেডে জায়গা পেলাম। সেবার ‘মানিয়ে নেওয়ার’ ভুলটা করিনি। বড় ভাইয়াকে সব বলে দিয়েছিলাম। কিন্তু আমার রাজকুৃমারীকে এই পৃথিবীর আলো দেখাতে পারিনি। সেই ঘটনার আজ দুই বছর। জসিমকে হাজতে আটকে রাখা যায়নি। হয়ত জমিদারদের জন্য এটি তৈরিই হয়নি। কিন্ত এক বছর আগে গাড়ি চাপায় একটি পা হারিয়ে ফেলেছে শুনলাম। এই জন্য নতুন বউ ছেড়ে চলে গিয়েছিল। এখন একাই আছে সে। লীনা ভাবির ডাকে ভাবনায় ছেদ পড়ল।
“এভাবে কি ভাবছিস?”
“বিয়ে করতে চাইনা ভাবি।”
“একা থাকা যায় না মৌ। সব পুরুষ এক হয় না। আমি আমার ভাইকে চিনি। ও তোকে ঠকাবে না।”
“এত উচ্চশিক্ষিত ভালো চাকরি করা সুদর্শন পুরুষ আমাকে বিয়ে করতে চাই কেন?”
“বেশি কথা বলিস তুই। দেখি হাতে আর কয়েকটা চুড়ি পড়ে নে।”
এ বলেই পালাল ভাবি। হয়তো কোথাও কান্না করছে। খুব ভালবাসে আমাকে। ভাবির ধারনা তার পরামর্শ আমার এই অবস্হা করেছে। তাই হয়ত নীল ভাইকে বাধ্য করছে আমাকে বিয়ে করতে। বাধ্য করে কি ভালবাসা পাওয়া যায়?
এই ভাবেই দ্বিতীয় বিয়েটা হয়ে গেল।
বাসর ঘরে ঘোমটা টেনে বসে আছি। আজ চড় খেয়ে চুপ করে থাকব না এই শপথ করছিলাম। হঠাৎ দরজার ছিটকিনির শব্দে ঘুরে তাকালাম। সাদা পাঞ্জাবিতে একটু দূরে দুষ্ট হাসি ঝুলিয়ে দাড়িয়ে আছে নীল। তার হাতে এক গুচ্ছ সাদা গোলাপ। আামার প্রিয় ফুল! আমার দিকে নীলের এগিয়ে আসার প্রত্যেকটি মূহুর্তে কেঁপে উঠছিলাম আমি। দোয়া করছিলাম এবার যেন সুখ পাই। আমার দিকে ফুলগুলো এগিয়ে দিয়ে বলল,”এই মেয়ে, আঠারো বছর হয়েছে তোমার।” থতমত খেয়ে বললাম,”হ্যাঁ।এখন একুশ। কোমল কন্ঠে বলল,”যখন সতের ছিল ভেবেছিলাম এই ভাবে গোলাপ দেব। তোমার প্রিয় ফুল বলে কথা। এখন তোহ নাও।” আমার বিস্ময় যেন আকাশ ছুঁই। হাত যেন চলছেই না। সে কীভাবে জানে আমি সাদা গোলাপ ভালবাসি? আমার বিস্ময় আরও বাড়িয়ে দিয়ে নীল আমার হাতে ফুল দিয়ে বলল,”ভালবাসি মৌ।”
আমার অবাধ্য চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, “তোমাকে যখন আমি প্রথম লীনা আপার বিয়েতে দেখি তখন তুমি নিতান্তই বাচ্চা। কিন্ত পাঁচ বছর পরে আবার যখন দেখি তোমার চঞ্চলতা আমাকে আকর্ষন করেছিল খুব।তখন বলতে না পারার ভুলের কারনে হয়ত তোমাকে কস্ট পেতে হয়েছিল। তুমি এখন থেকেই তোমার অতীত ভুলে যাও। কারন আমি আমার ভুল সংশোধন করতে চাই। আমি তোমার না পাওয়া সব ভালবাসা দিতে চাই।” কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল, “পড়বে মৌ?” সেইদিন আনেক কেঁদেছিলাম। নীলের বুকে মাথা রেখেই দোয়া কবুলের জন্য শুকরিয়া জানালাম আমার রবকে। হয়তো এবার সুখ আসবে আমার জীবনে। পাঁচ বছর পর আমি মৌ। মিসেস নীল,আমার মেয়ে মেঘের মা। আমার আরেকটি পরিচয় আছে। একজন মেজিস্ট্রেট।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত