পাসকোর্সে বি.এ. পাশ করে, রুবাই তখন ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরছে। সদ্য বাবা মারা গেছে। মায়ের উইডো পেনশনের অতিসামান্য কটা টাকায়, তিন তিনটে মানুষের ভরণপোষণ করতে-করতে, সংসারের দুচোখে তখন নিকষ কালো অন্ধকার। চাকরির কমপিটিটিভ পরীক্ষা আজকাল কোথায়! অবশ্য, তাতে বসলেও রুবাই পাশ করত কিনা সন্দেহ। ছাত্র হিসেবে সে অতিসাধারণ। রোজগারের ধান্দায় রুবাই তখন বাড়ি-বাড়ি মনিহারি জিনিসপত্র বেচে বেড়াত। তবে, তাতে লাভ অতি যৎসামান্য। সে কীভাবে ছোটভাইকে মানুষ করবে, দুবেলা তিনজনে পেটভরে ডাল-ভাত খাবে, ভাবতে বসলে ঝিমঝিম করে উঠত গোটা শরীর। নিজের চবিবশ বছরের চেনা শরীরটাকে তখন সে দুহাতে ঝাঁকাত, ঝাঁকাত, ঝাঁকিয়েই চলত অবিরত। আর, অদ্ভুত বিজবিজে ঘামে কেমন ভেসে যেত সে। পাড়ার রকে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় বা ঝলমলে কলকাতার হাজারো শব্দ আর কোলাহল ভেদ করে হাঁটতে-হাঁটতে সে অনুভব করত, নৈঃশব্দ্য, কেবল নৈঃশব্দ্যই শিকড় নামাচ্ছে শরীরে। ওইভাবে, তখন, অতিসাধারণ, অথচ অতিসুভদ্র এবং অতিদরিদ্র রুবাই এক অন্ধকার আগুনে ঝলসে যাচ্ছিল।
সমীদা সে-অবস্থায়, প্রায় রাস্তা থেকে তুলে, অযাচিতভাবে, নিজের মাঝারিমাপের অ্যাড এজেন্সিতে চাকরি দিলেন। তা প্রায় পাঁচ বছর হয়ে গেল। অ্যাড এজেন্সিটা সুবোধ মলিস্নক স্কয়ারে। রুবাইয়ের মানিকতলার বাড়ি থেকে যেতে বেশি সময় লাগে না। চাকরিতে ঢোকার সময় মাইনে ছিল চার হাজার টাকা। সমীদা বলেছিল – মন দিয়ে লেগে থাক। প্রমোশনও দেবো। মাইনেও বাড়াব।
এখানে তার কী যে প্রমোশন হবে, রুবাই বিশেষ বুঝে পায় না। রুবাই এজেন্সির ক্লার্ক কাম পিয়ন। তার কাজ পেমেন্ট ভাউচার বানানো, পেমেন্ট আনতে যাওয়া, খবরের কাগজের অফিসে আর্টপুল পৌঁছে দেওয়া, ছোটখাটো চিঠির ড্রাফট বানানো। কখনো-সখনো, খুব প্রয়োজন পড়লে তাকে অ্যাকাউন্ট এক্সিকিউটিভের কাজও করতে হয়। ওই ডামি আর্টপুল পৌঁছে দেওয়া, স্পেস বুকিংয়ের অর্ডার আনা ইত্যাদি। তবে, গোদা বাংলায় তা আসলে নিখাদ পিয়নের কাজ। সমীদা রুবাইয়ের ভিজিটিং কার্ড ছাপিয়ে দিয়েছে। সেখানে রুবাইয়ের নামের তলায় লেখা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার। তলায় কেতাবি ঢংয়ে এজেন্সির নামটি লেখা – ড্যাগমার। জয়েন করার দু-চারদিন পর রুবাই সমীদাকে জিজ্ঞেস করেছিল ওই ড্যাগমার নামটির অর্থ। প্রশ্ন শুনে গভীর চোখে হাসতে-হাসতে সমীদা বলেছিল – বাহ্, তোমার কৌতূহল দেখে ভালো লাগল। ড্যাগমার মানে ডিটারমাইনিং অ্যাডভারটাইজমেন্ট গোল ফর মেজারিং অ্যাডভারটাইজমেন্ট রেজাল্টস। লেগে থাকো রুবাই। একদিন কথাগুলোর পেটের ভেতরের মানেটা বুঝে যাবে নিজেই। মানেগুলো আজো অনুভব করেনি রুবাই। কেবল বুঝেছে সরকারি অফিসের এজেন্সি সিলেকশনের ঘাতঘোত। অবসর সময়ে দুচোখ ভরে দেখে গেছে আর্টওয়ার্ক ডিজাইনার বা কপিরাইটারের কাজ। তাদের বানানো ডামি ডান হাতে চেপে ধরে, বিভিন্ন অফিসে জমা করে, অ্যাপ্রম্নভালের জন্য সোফায় বসে অপেক্ষা করেছে। তিন-চারটে ডামির মধ্যে অ্যাপ্রম্নভড ডামিটা তুলে দিয়েছে সমীদাকে। সমীদা অনেক সময়েই তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে – বুঝলি রুবাই, সবকটা গাড়ল। এইটে ছিল অনেক বেশি কনভিনসিং আর অ্যাগ্রেসিভ। বিজ্ঞাপনে তোমার অ্যাপ্রোচ হবে ডাইরেক্ট, অ্যাগ্রেসিভ, আর তবেই সেটা হবে কনভিনসিং। আইডা মডেলটা কজন ঠিকঠাক বোঝে বলতে পারিস রুবাই? অ্যাটেনশন, ইন্টারেস্ট, ডিজায়ার উইল লিভ টু অ্যাকশন।
রুবাই তখন বাড়ি থেকে বয়ে আনা আটার রুটির সঙ্গে সবজি চিবোয়। এতক্ষণ দৌড়ঝাঁপের পর পেটটা দুহাত বাড়িয়ে কেবল খাবার চায়। সেটাই তখন শরীরের ডিজায়ার। দ্রুত রুটির গরাস গিলে, অ্যাকশনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে রুবাই। এভাবে রুবাই আইডা বুঝে নেয় ঠিকঠাক। তবে, সমীদা কথার খেলাপ করেনি। চার হাজার টাকা মাস মাইনেতে ঢুকে, এই পাঁচ বছরে রুবাইয়ের মাইনে পাঁচ হাজার সাতশো। সমীদা মাঝেমধ্যে, খুব খুশির কোনো সময়ে বলে ফেলে – ছেলেটা তুই মন্দ নয় রে রুবাই। কেমন ভূতের মতো খাটিস। আমাকে আর একটু দাঁড়াতে দে। আরো মাইনে বাড়াব তোর। প্রমোশনের কথাটা মনে করিয়ে দিস না কেন? পাঁচ কাজে এমন জড়িয়ে থাকি! ভুলে যাই।
রুবাই কিছু বলে না। চুপ করে থাকে। তিনশো ভিজিটিং কার্ডের সবকটা শেষ হলে, প্রমোশনের কথাটা তুলবে রুবাই। তারপর, নতুন ডেজিগনেশন ছাপানো ভিজিটিং কার্ড নিয়ে, ডামি আর্টপুলের গোছা বইতে-বইতে বিভিন্ন কোম্পানিতে হানা দেবে পিয়ন রুবাই। কখনো-বা পেমেন্টের তাগাদায় ছোট-মাঝারি কোম্পানিগুলোর দরজায় হত্যে দিয়ে বসে থাকবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ভয়ানক খিদে পেলে সে বাড়ি থেকে বয়ে আনা পাঁচ-পাঁচটা আটার রুটির স্বপ্ন দেখবে। সঙ্গে কী সবজি দিয়েছে মা? আলু-ঢেঁড়স? আলু-বরবটি? আলু-কুমড়ো? বাঁধাকপি দিলো নাকি মা আজ?
পাঁচ বছর সমীদার কাছে কাজ করে, সংসারের চাহিদা সাধ্যমতো মিটিয়ে, বান্টির বইপত্র, টিউশনের খরচ জুগিয়েও দিব্যি এগারো হাজার টাকা জমিয়ে ফেলেছে রুবাই। মাঝেমধ্যে, রাতে ঘুম না এলে, সে ব্যাংকের পাশ বইটার দিকে চেয়ে থাকে। কেন জানি, এত পরিতৃপ্ত লাগে তখন। এক অলৌকিক জ্যোৎস্না যেন ভিজিয়ে দেয় তার গোটা শরীর। সে শ্বাস টেনে নেয় একেবারে মাথা পর্যন্ত। বোঝে, প্রগাঢ় শামিন্তর ঘুম কেমন আলাদা করে দিচ্ছে তাকে।
যাতায়াতের বাসভাড়া ছাড়া, রুবাইয়ের নিজের দৈনন্দিন খরচ বিশেষ নেই। মানিব্যাগে তার সর্বদা রাখা থাকে পাঁচশো টাকা। টাকাগুলো সেই কবে থেকে চ্যাপ্টা হয়ে শুয়ে থাকতে-থাকতে, মিইয়ে গেছে কেমন। মাঝে-মাঝে ওই টাকায় হাত বোলায় রুবাই। আসলে চারপাশে এত টাকা! ব্যাংকের পাশ বইয়ে টাকা। মানিব্যাগে টাকা। বাড়িতে, দেরাজে সংসার চালানোর টাকা। মায়ের উইডো পেনশনের বাইশশো টাকা। মাঝেমধ্যে রুবাই তাই যেন তাড়িয়ে-তাড়িয়ে টাকার পাহাড় বেয়ে ওঠার শৌখিন স্বপ্নটি দেখে ফেলে। এবং ঘুমোয়।
এবার পুজোর মাসে, মাইনের সঙ্গে বোনাস মিলিয়ে, সাড়ে আট হাজার টাকা তুলে দিলো সমীদা। তারপর গোল্ড ফ্লেক কিংসে লম্বা টান মেরে, ধোঁয়া ছাড়তে-ছাড়তে বলল – কী রে রুবাই, খুশি তো! নাকি আর পাঁচশো দেবো?
– না-না, আর লাগবে না সমীদা।
– তুই কেমন ছেলে রে রুবাই? টাকা দিতে চাইলে নিস না?
– অনেক তো দিচ্ছেন সমীদা। পথ থেকে কুড়িয়ে এনে চাকরিটাই তো দিলেন।
– বাদ দে ওসব। শোন, বোনাসের টাকায় ভাই আর মায়ের জামা-কাপড় কিনবি। আর নিজের এই শার্ট-প্যান্টটা বানাবি। বলে, টেবিলের দেরাজ খুলে দারুণ দামি শার্ট আর প্যান্টের কাপড় বের করে সমীদা। বলে – রেমন্ডসের। তোকে মানাবেও ভালো। এবার থেকে এসব পরে কোম্পানি ভিজিট করবি। কালে দিনে আরো দেবো রুবাই। মনে রাখিস। তুই কেবল খেটে যা। ও হ্যাঁ, শার্ট-প্যান্টের মেকিং চার্জও পাবি।
বাড়ি ফিরে অতগুলো টাকা বিছানায় পেতে দিয়ে দুষ্টুমির হাসি হাসে রুবাই। মৃদুস্বরে বলে – মাইনে পস্নাস বোনাস। নাও, বান্টির শার্ট-প্যান্ট, তোমার কাপড়-জামা সব কিনে ফেলো। আমার জন্য কিছু কিনতে যেও না। বলে কাঁধে ঝোলানো কাপড়ের ব্যাগ থেকে নিজের শার্ট-প্যান্টের পিস বিছানায় ফেলে। মা সব দেখে কেমন থই পায় না। শরতের সকালের মতো হাসি বিন্দু-বিন্দু করে ছড়িয়ে পড়ে গোটা শরীরে। তার থেকে মাত্র একুশ বছরের বড়, অকালবিধবা মাকে বড় সুন্দর দেখতে। রুবাই দুচোখ মেলে, এখনকার খুশিয়ালি সুন্দরী মাকে দেখে। বোঝে, প্রগাঢ় গর্বে ভরে উঠছে তার বুক।
রাতে সে আর মা খেতে বসে। ডাল, রুটি, সবজি। সঙ্গে একটু আচার। আজ খুশির দিন বলে রুবাই আর বান্টিকে একটা করে পোলট্রির ডিম ভেজে দিয়েছে। ভেতরে কাঁচালংকা আর পেঁয়াজের কুঁচি ঠাসা। মা বলে – এবার একটা বিয়ে কর খোকা।
– তুমি পাগল হলে মা! দাঁড়াও, আগে বান্টিটা নিজের পায়ে দাঁড়াক। নিশ্বাসের শব্দে মা বলে – কিন্তু, তোর বয়স তো বসে থাকবে না রুবাই।
– হবে, হবে, সব হবে। বান্টিকে একটু বড় হতে দাও। নববই পার্সেন্ট পেয়ে মাধ্যমিক পাশ করল। সায়েন্স নিয়ে পড়ছে। ডাক্তার হওয়ার কত স্বপ্ন ছেলেটার। নিজে সংসার করতে গিয়ে এখনই সব গুলিয়ে ফেলতে পারব না মা। পারব না।
-তাই বলে-
-দাঁড়াও, মাইনেটা আরো খানিকটা বাড়ুক। তখন-
গভীর রাতে, রুবাই নিজের ছোট্ট ঘরের, ছোট্ট বিছানায় শুয়ে বুঝল, তার গভীরের অশ্বত্থ গাছটি কেবল ডালপালা ঝাঁকিয়ে চলেছে। বাতাস ফিসফিস করে কীসব বলছে। সাদা জ্যোৎস্নাটি কেমন জাদুকরী হয়ে নেমে এসেছে বুকের ওপর। প্রশ্রয় পেয়ে তার নিজের শিকড়টি ঊর্ধ্বমুখী হয়ে যেন ছুঁতে চাইছে আকাশ। এবং, এক আনকোরা কাম যেন শরীর ফুঁড়ে বেরোনোর পথ খুঁজছে। শস্য রোয়ার জন্য খুঁজে বেড়াচ্ছে আবাদ। সে, ওই মধ্যরাতে, বিছানায় কেমন বিহবল হয়ে বসে থাকে। অচেনা, অদেখা, অস্পষ্ট এক মানবী তার মাথার মাঝখানে বসে ঠ্যাং দোলায়। দাঁত দিয়ে শূন্যতা চিবিয়ে যায় রুবাই।
শ্যামবাজারে শাড়ির দোকান বা গহনার দোকানগুলোতে পেমেন্ট আনতে যাওয়া এক ঝকমারি। কটা দিন সবুর করুন। আজ হবে না, কাল আসুন – এসব তো লেগেই আছে। এই একই গল্প কলেজ স্ট্রিটেও। সমীদা, এই দুটো জায়গায় পাঠালে গায়ে যেন জ্বর নামে রুবাইয়ের। আজ এসেছিল শ্যামবাজারে। দোকানের মালিক আকর্ণ হেসে বললেন – আপনার পেমেন্ট আজই চুকিয়ে দেব বুঝলেন। তবে ঘণ্টা দু-আড়াই পরে আসুন। এখন এই আড়াই ঘণ্টা কী করবে রুবাই! প্রবল যানজটে ফাঁসতে-ফাঁসতে অফিসে ফিরে, আবার এখানে আসতে মন চাইছিল না। রুবাই সময় কাটাতে, এলোমেলোভাবে ফুটপাতে হাঁটছিল। ফুটপাতের আধখানাই হকারদের দখলে। হাঁটা বড় দুষ্কর। বাধ্য হয়ে পথে নেমে এল রুবাই।
শ্যামবাজার ট্রাম ডিপো পেরিয়ে সে হাঁটছিল হাতিবাগানমুখী। একসময় এই অঞ্চলটির প্রসিদ্ধি ছিল সিনেমা আর থিয়েটারপাড়া হিসেবে। ছিল কত সিনেমা হল। মিনার, শ্রী, উত্তরা, মিত্রা, পূর্ণশ্রী, রূপবাণী, রাধা আর দর্পণা। থিয়েটার হলও কম ছিল না। রঙ্গমহল, স্টার, বিশ্বরূপা, রঙ্গনা, বিজন থিয়েটার আর সারকারিনা। সবকটা থিয়েটার হলই বর্তমানে বন্ধ। সিনেমা হলের মধ্যে মিত্রা, মিনার, দর্পণা এখনো চলছে। স্টার হয়ে গেছে মাল্টিপেস্নক্স।
সময় কাটাতে একটা সিনেমা হলের সামনেই দাঁড়িয়ে পড়ল রুবাই। এখানে চিরকালই হিন্দি সিনেমা চলে। হলের বাইরে সলমন খানের বিশাল কাটআউট। পাশে নায়িকার লাস্যময়ী মুখ। সিনেমা-থিয়েটার দেখার সময়ই পায় না রুবাই। হা-ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাড়ি ফিরতে-ফিরতেই রাত নটা বেজে যায় রোজ। মাঝেমধ্যে টিভিতে সিরিয়াল দেখে সময় কাটায়। নয়তো, হাত-মুখ ধুয়ে, চা খেয়ে বেরিয়ে পড়ে আড্ডায়। পৌনে তিনটে বাজে। হাতে এখনো দুঘণ্টা সময়। দুটো ঘণ্টা সিনেমা হলে কাটিয়ে, সে ফের শাড়ির দোকানে হানা দেবে। রুবাই হলে ঢুকে পড়ল।
কিন্তু, তার কপাল মন্দ। এতকাল বাদে যদিও-বা সিনেমা দেখতে এলো, ম্যাটিনি, ইভনিং দুটো শো-ই হাউসফুল। কেবল নাইট শোয়ের কটা টিকিট পড়ে আছে। সিনেমা হলের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছিল সে। যদি শেষ মুহূর্তে কেউ এক্সট্রা টিকিট বিক্রি করে! কোথায় কি! হুড়মুড় করে সবাই হলে ঢুকে যাচ্ছে। কেমন যেন ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে সিনেমা হলের সামনেটা।
রুবাই বেরিয়ে আসছিল প্রায়। বেশ খিদে পাচ্ছে। কোথাও বসে হালকা কিছু খেয়ে নেবে। তারপর, শ্যামবাজারের কাজ মিটিয়ে, অফিস ফিরে টিফিন খাবে। মাঝখানের দুটো ঘণ্টা না হয় এলোমেলো হেঁটেই বেড়াবে সে।
ঠিক সেই সময় তার চোখ গেল সিনেমা হলের লাল-হলুদ আলো জ্বলা ওয়েট মেশিনটির দিকে। ওয়েট মেশিনটির ঠিক পাশে, দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো একটি মেয়ে চোখের ইশারায় যেন তাকে ডাকছে। প্রথমে কেমন অবাক হলো রুবাই। প্রায় ফাঁকা হয়ে যাওয়া সিনেমা হলে, একটি সম্পূর্ণ অপরিচিত মেয়ে তাকে ডাকবে কেন? তবে কি এক্সট্রা টিকিট আছে? কী মনে হতে পায়ে-পায়ে এগিয়ে গেল রুবাই।
কাছে যেতে মেয়েটা ফিসফিস করে বলল – টিকিট লাগবে? ব্যালকনির একদম সাইডের! বলে, দুচোখের তারা নাচিয়ে হেসে উঠল নিঃশব্দে। রুবাই সেই হাসির কোনো অর্থ বুঝতেই পারল না। নিজেকে কেমন বিভ্রান্ত লাগছিল! এক্সট্রা টিকিট বিক্রি করতে এত হাসিরই-বা কী আছে বুঝে উঠতে পারছিল না সে।
সে বলল – একটা লাগবে। কত?
– দুটো নিতে হবে। মোট একশ ষাট। তুমি আমাকে তিনশো দেবে।
– তিনশো! আমার দুটো টিকিট তো দরকার নেই।
সেই রহস্যের হাসি। – আমার তো আছে। আড়াই ঘণ্টা অন্ধকার হলে এমন মসিন্ত দেবো! আগে কখনো আসোনি বুঝি?
– আপনি কী বলছেন কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার টিকিট লাগবে না।
– তুমি টিকিট না নিলে বড় লোকসান খাবো গো। নাও না, না হয় পঁচিশ টাকা কমই দিও।
মেয়েটির মুখটি করুণ দেখায় নিমেষে। রুবাই তাকে দেখে। শ্যামলা রং, একমাথা চুল, নাক, চোখ, চিবুকের একটা আপাত কোমলতা অযত্ন আর অপুষ্টিতে কেমন চাপা পড়ে আছে। তবে, স্থির তাকালে, দুচোখের দীঘলতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
– দুশো পঁচাত্তরই দাও। ওতেই ঠিক পুষিয়ে নেব। কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি। এমনই কপাল, একটা কাস্টমার পেলাম না।
জীবনে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি কখনো হয়নি রুবাই। তার সবকিছু কেমন গোলকধাঁধার মতো লাগছিল। উচিত-অনুচিতের বেড়াজাল টপকে একটা কিসের প্রাবল্য পাক খেয়ে উঠছিল গোটা শরীরে। সে মেয়েটিকে দেখছিল। ওদিকে, শো শুরু হয়ে গেছে। এখন, রুবাই টিকিটদুটি না নিলে একশ ষাট টাকা লোকসান হবে মেয়েটার। মাথা নিচু করে ভাবতে গিয়ে, সে দেখল, মেয়েটির পায়ে মলিন রবারের স্যান্ডেল। কবে যেন আলতা পরেছিল। সেই রং এখন ফ্যাকাশে, বড়ই ম্রিয়মাণ। এক অদ্ভুত অস্থিরতায় রুবাই কেমন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। যেন এক অজানা আশঙ্কায়, কিসের সব শিহরণে, তার বুকে কাঁপ লাগে অবিরত। নৈঃশব্দ্যে শিকড় নামিয়ে চলে।
– কী হলো, টাকাটা দাও, আর চলো। দেখবে, কেমন আরাম দেবো। তখন বুঝবে টাকাটা জলে যায়নি। নাও, টাকা দাও। বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে।
আর ঠিক তখনই রুবাইয়ের মনে পড়ে যায় মার মুখটি, বান্টির দুষ্টুমি-মাখানো হাসি, সমীদার নিবিষ্টমনে লেখালেখির ছবি। তার চেনা, বহুকালের পরিচিত দুনিয়াটি যেন দুহাতে আঁকড়ে ধরে থাকে। এক চুম্বকের আকর্ষণী শক্তির ঘূর্ণনে সে কেমন স্থির হয়ে যায়। নড়তে-চড়তে পারে না। আবার, কিসের অমোঘ টানে, সে পারে না মেয়েটির সামনে থেকে সরে যেতে। তারপর, আচম্বিতে, যেন নিজেকে চমকে দিয়ে, সেই প্রাচীন সুতোটি ছিঁড়ে যায় নিঃশব্দে। সে প্যান্টের ব্যাক পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে। প্রায় নেতিয়ে-যাওয়া পাঁচশো টাকা থেকে, তিনশো টাকা তুলে দেয় মেয়েটাকে।
– এ-মা, সব একশ টাকার নোট! আমার কাছে পঁচিশ টাকা খুচরো নেই। মা কালীর দিব্যি!
– তিনশোই রেখে দিন।
হঠাৎ, কেমন ফুরফুরে হাসিতে যেন ভরে ওঠে মেয়েটা। চোখে, চিবুকে, ঠোঁটে, মুখের সর্বত্র যেন স্ফূর্তির ঢেউ। সেই সুযোগে খানিকটা বাতাস এসে, উড়িয়ে দেয় তার মাথার চুল। কটা চুল কপালে এসে পড়ে। রুবাইয়ের মনে হয়, আচম্বিতে কেমন যেন অন্যরকম দেখাচ্ছে মেয়েটাকে।
সে কলকল করে বলে ওঠে-আমাকে আপনি, আজ্ঞে, করছো কেন? আমাদের আপনি বলে কেউ! যাহ্! নাও, চলো-
হলের ভেতর ঢুকে, নিজে-নিজেই সিট খুঁজে নেয় মেয়েটি। ফিসফিস করে বলে – দাঁড়াও, আগে আমি ঢুকি। আমার বাঁ-পাশে বসবে।
রুবাই দেখে, একদম শেষ সিটটায় মেয়েটা বসে পড়ছে। পাশের সিটে বসে পড়ে রুবাই। পেছনে দেয়াল। এটাই শেষ রো। রুবাইয়ের বাঁপাশে বেশ অনেকটা ওপরে, একটা চৌকো গর্তের মধ্য দিয়ে স্ক্রিনে ছুটে যাচ্ছে প্রজেকশনের আলো। আর স্ক্রিনে দৌড়চ্ছে সলমন খান। আর, সেই নাম না-জানা লাস্যময়ী নায়িকা। তারপর, গান শুরু হয়ে গেল। নিশ্চয় খুব সুপারহিট কোনো গান। একতলার একদম ফ্রন্ট রো থেকে উড়ে আসছিল অজস্র সিটির শব্দ। তারপর, ডানদিকে, মেয়েটার দিকে তাকাল রুবাই। অন্ধকার হলে, স্ক্রিনের আলোর হালকা প্রতিফলন তার মুখের শীর্ণতা ঢেকে দিয়েছে যেন। তার গালদুটি লাগছে বেশ ভরন্ত। ডানদিক থেকে তাকে দেখতে খুব খারাপ লাগছে না রুবাইয়ের। এবং জীবনে এই প্রথম সে এক মহিলার সঙ্গে সিনেমা দেখতে এলো; কিন্তু পরক্ষণেই কেমন যেন চমকে উঠল রুবাই। কী করছে মেয়েটা! ও কী!
সে দেখল, মেয়েটা শাড়ির তলা দিয়ে বস্নাউজের সব বোতাম খুলে ফেলেছে। তারপর, সে সোজাসুজি রুবাইয়ের দিকে তাকাল। খুব মিষ্টি করে হাসল। বলল – এবার নাও।
– কী নেবো? অবাক হয়ে গেল রুবাই।
– এ দুটো ধরো। একটা হাত পিঠের পেছন দিয়ে গলিয়ে দাও। তারপর ধরো। এখন আড়াই ঘণ্টা আমি তোমার। যা খুশি করো। হাফটাইমে কেবল একটু বাদাম খাইও। নাও ধরো। আমি রেডি।
– এসবের কোনো দরকার নেই। কোনো দরকার নেই।
– বিজনেস না করে আমি মাগনায় পয়সা নিই না। আচ্ছা ঢ্যামনা লোক বটে তুমি। মেয়েছেলে ভাড়া করে হলে ঢুকলে, অথচ বলছো গায়ে হাত দেবে না।
– চুপ করো, চুপ করো। সবাই শুনছে।
– না ধরলে অ্যাইসা চেল্লাব! পাবলিক কেলিয়ে বাপের নাম খগেন দাশ করে ছাড়বে। ধরো বলছি। তার প্রায় ত্রিশ বছরের নারী-বিবর্জিত জীবনে প্রথম কোনো নারীর স্তনে হাত রাখে রুবাই। নরম বুকে মৃদু চাপও দেয়। তারপর, অবাক হয়ে যায় কেমন। সে, তার ডান হাতটি যেন নাড়তে পারছে না। সেটি মুহূর্তে কেমন অসাড় হয়ে যায়। কব্জিতে নেমে এসেছে বিশাল ওজনের ভার। আর এক অদ্ভুত ক্লামিন্ততে ছেয়ে যাচ্ছে গোটা শরীর। তার যেন মনে হয়, মা, বান্টি, সমীদা, তার সব বন্ধুবান্ধব, অবাক বিস্ময়ে তাকে দেখছে। এ কোন রুবাই! নিজেই নিজের কাছে হয়ে উঠছে চরম অপরিচিত। তবু, অদ্ভুত, সে মেয়েটার স্তন থেকে হাত ওঠায় না। নিঃসাড় বসে থাকে কেবল। অতিক্রম করতে চায় সময়। সময়ের স্বল্প ব্যবধানও যেন দীর্ঘ, দীর্ঘতর হয়ে ওঠে। নিজের মধ্যেই, সে নিজের চেনা রুবাইকে খুঁজে চলে অনবরত।
– ভালো লাগছে না বুঝি!
– ঠিক আছে।
– আগে কখনো বুকে হাত দাওনি? এতদিন বুক ধরোনি মেয়েদের?
– না। একটু চুপ করো।
– আমার বুকদুটো খারাপ?
– সারাক্ষণ বুক, বুক শুনতে ভালো লাগছে না। এখন থাক।
বলে, রুবাই হাত সরিয়ে নেয়। কেবল বোঝে, মেয়েটার বুকের ঘামে চটচটে হয়ে গেছে তার ডান হাত। সে স্তর্পণে প্যান্টে হাত মোছে। তারপর বলে – কী নাম তোমার?
– কী হবে জেনে?
– বলোই না।
– কাটু। কেমন নামটা! বাবা রেখেছিল।
– ভালোই। কী করে তোমার বাবা?
– কোথায় বাবা! প্রাইভেট বাসের হেলপার ছিল। নিজের বাসের তলাতেই চাপা পড়ল।
– ও।
– ভাগ্যিস, বুকদুটো ছিল! নইলে তিনটে ভাইবোন, মা, আমি কী খেতাম বলো! কী হলো, হাত গুটিয়ে নিলে কেন?
– অনেকক্ষণ তো হলো! চলো, বাইরে যাই! আলুর চপ দিয়ে চা খাবে!
– এ-মা, সিনেমা শেষ হওয়ার আগেই আমাকে ছেড়ে দেবে? আর একটু হাত দাও! লোক ঠকাতে বড্ড লজ্জা করে। খেটে রোজগার করায় আলাদা আনন্দ। তুমি বুঝবে না।
– হয়তো বুঝব না। জামায় বোতাম দাও। চলো…
আলুর চপে জোর কামড় লাগায় কাটু। তারপর গোগ্রাসে খেতে খেতেই বলে – মা আজ এত দেরিতে ভাত বসাল! খাওয়াই হলো না। খেতে বসলে ম্যাটিনি শো ধরতে পারতাম না।
– এখন কী করবে কাটু?
– কেন? ইভনিং, নাইট দুটো শোতেই কাজ করব। আমার সব টিকিট অ্যাডভান্স কাটা থাকে।
– আর দুটো আলুর চপ খাবে?
কাটু নীরবে মাথা হেলায়। তারপর বলে – তুমি মাইরি আজব লোক! অতগুলো টাকা জলে দিলে। সিনেমাটা দেখলে না? আমাকে…
– থাক না কাটু।
– জানো, কত লোক ইন্টারভ্যালেও কনুই দিয়ে গোত্তা মেরে যায়। দুটাকার বাদামও খাওয়ায় না। অ্যাই, তুমি আর চপ খাবে না?
– দুটো তো খেলাম। এবার চলো চা খাই। আমাকে আবার কাজে বেরোতে হবে।
– চাকরি করো বুঝি?
রুবাই মাথা হেলায়। তারপর, কাটুর পাশাপাশি হাঁটে। সামনেই চায়ের দোকান। শ্যামবাজারের এই অঞ্চলটায় এত মানুষ, এত কলরব। তার মধ্যেই ট্রাম, বাস, ট্যাক্সি, মিনিবাস, প্রাইভেটকার অতি মন্থরগতিতে চলছে। সর্বত্র কেবল মানুষ। দুধারের ফুটপাতে অসংখ্য দোকান। এবং, সর্বত্র উজ্জ্বল আলো ঝলমল করে উঠছে। বেশ খানিক পর সন্ধ্যা নামবে। গুমোট বাতাসে লাট্টুর মতো ক্রমাগত পাক খেয়ে চলেছে ডিজেলের ধোঁয়া।
ফুঁ দিয়ে চা খায় কাটু। কতকগুলো আলুর চপ খেয়ে তার মুখ এখন খুবই পরিতৃপ্ত।
– তোমার নাম কী গো?
– রুবাই।
– শোনো রুবাইবাবু, আমার কাছে যেন আর এসো না। সিনেমা দেখতে ইচ্ছা হলে আগেভাগে টিকিট কাটবে। শুধু-শুধু কতগুলো টাকা নষ্ট করলে, ভাবো একবার।
– এক কথা বারবার বলো কেন কাটু? আমি এবার চলি।
– যাও। আমিও হলে ফিরে যাই। বলে, কাটু আর দাঁড়ায় না। দ্রুতপায়ে সিনেমা হলের দিকে ফিরে যায়। খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে রুবাই। ন্যায়-অন্যায় বোধকে অতিক্রম করে, একটা আনকোরা অনুভূতি কেমন দাঁত বসিয়ে চলে শরীরে। নিরবচ্ছিন্ন চিন্তার কীসব স্রোত মাথার মাঝখান দিয়ে কুলকুল করে বয়ে যায়। নিজের সঙ্গে তাল রাখতে পারে না রুবাই। বোঝে, সে কেমন নিজের কাছ থেকে পিছিয়ে পড়ছে ক্রমাগত। আসেন্ত-আসেন্ত হাঁটতে শুরু করে রুবাই।
রুবাইকে চমকে দিয়ে, সেদিন গভীর রাতে স্বপ্নে হানা দিলো কাটু। রুবাই স্পষ্ট দেখল, কাটু কেমন করে একটা স্রোতস্বিনী নদী হয়ে গেছে। সেই নদীতে রোজ স্নান করে রুবাই। কাটু হালকা নরম স্রোতে রুবাইকে যেন কোথায়, কোন দূরদিগস্তে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায়। রুবাই তুখোড় সাঁতারে ক্রমাগত সামলে চলে কাটুকে। কাটু ফিক করে হেসে ফেলে। বলে – খুব মজা না! রোজ-রোজ আমার জলে সাঁতার কাটা! দাঁড়াও, খুব শিগগির হেজেমজে শুকিয়ে কাঠ হবো। তারপর, তোমার বউ হয়ে জন্মে, রোজ তোমার ঘাড় মটকাব দেখো।
ঘুম ভেঙে উঠে বসে রুবাই। কোথায় কাটু, কোথায় নদী! জানালা গলিয়ে কেবল নেমে এসেছে সাদা জ্যোৎস্না। মাঝরাতে ঘুমভাঙা চোখে, বিশাল আকাশের দিকে তাকিয়ে, বিহবল হয়ে বসে থাকে রুবাই। জ্যোৎস্না, পথের গাছপালা, সীমাহীন আকাশ, আশপাশের বাড়িঘর, পৃথিবীর হাজারো রহস্য কেমন যায় গুলিয়ে। যেন, সে এক অলৌকিক সময়ের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। যার কোথাও কোনো বাস্তবতা নেই, কার্যকারণ নেই। এক অদ্ভুত সময়ের মধ্যে সে কেমন হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে এবং এভাবে রুবাই মধ্যরাতের নিটুট নির্জনতার মুখোমুখি দাঁড়ায়। তারপর চমকে ওঠে, শিহরিত হয়। তার মনে হয়, এবার কাটু নদীর রূপ ছেড়ে, জ্যোৎস্না সেজে জানালা টপকে ঘরে ঢুকে, তাকে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে।
– সারাদিন এমন গুম হয়ে বসে থাকিস কেন? কী এত ভাবিস বল তো রুবাই? সমীদা সপ্রশ্ন তার দিকে চেয়ে থাকে। সমীদার পেছনের জানালা দিয়ে আকাশ দেখা যায় স্পষ্ট। রুবাই অল্প হাসে। কিছু বলে না। দেখে, অনেকদূর আকাশে উড়ে চলেছে একঝাঁক পাখি। নানান প্যাটার্নে। নিজের মধ্যে কেমন একটা অস্থিরতা টের পায় সে। সমীদা সিগারেট খাচ্ছে। তামাকের গন্ধে ভারি হয়ে আছে ঘরের বাতাস। সে হঠাৎ ভাবে, কাটু পাখি হয়ে, তার শোবার ঘরের জানালায় যদি বসে আজ মধ্যরাতে? তার চোখের দৃষ্টিটি কেমন অস্পষ্ট হয়ে যায়। সমীদা যেন তার চোখে কেমন ঝাপসা, অস্পষ্ট হতে থাকে।
– তোর কি কোনো কারণে মনমেজাজ খারাপ?
– না, না।
– তোর মতো এত ভালো ছেলে… তুই আমার অ্যাসেট রুবাই।
রুবাই চুপ করে থাকে। নিজের মধ্যে কেমন ঘন হয়ে ওঠে।
– কোনো প্রবলেম হলে অবশ্যই আমাকে বলবি! আমি সাধ্যমতো হেল্প করব রুবাই।
রুবাই নীরবে ঘাড় হেলায়। কিছু বলে না। কী বলবে?
সেদিন অফিস ছুটির পর, আবার সিনেমা হলের দিকে যাওয়ার বাসে ওঠে রুবাই। রাস্তায় এত যানজট! বাস চলে ধিকিয়ে-ধিকিয়ে। তারপর যখন হলে পৌঁছয়, শো শুরু হয়ে গেছে। ওয়েট মেশিনের পাশটা ধু-ধু মাঠের মতো যেন। কেবল লাল আর হলুদ বাতিগুলো জ্বলছে। নিভছে। আবার, জ্বলছে। মাঝখানের চাকাটি থেমে আছে স্থির। রুবাই সেই ওজন যন্ত্রটির গায়ে হাত রাখে। কেমন এক আপাত শীতলতা জেঁকে ধরে তাকে। হাত সরিয়ে নেয় রুবাই। কেবল বোঝে, অন্ধকার, কেবল অন্ধকার নেমে আসছে তার বুকে। কাটুর চোখ দুটির দীঘলতা, শীর্ণতার মধ্যে চাপাপড়া তার মুখের কোমলতা, জলছবির মত দুচোখের সামনে ভেসে ওঠে কেবল বারবার। মন্থরপায়ে ফিরতে থাকে রুবাই।
কয়েকদিন পর, রুবাই আবার হানা দেয় সেই সিনেমা হলে। এবারো তার দেরি হয়ে যায়। সে কাটুকে পায় না। কেন এমন হচ্ছে রুবাইয়ের! কেমন দুর্বোধ্য লাগে তার। সে নিজের মধ্যে চুপ করে যায় কেবল। মস্নান মুখে ধীরপায়ে সে বাড়ির পথ ধরে।
বেশ কয়েকদিন ছেড়ে, আবার সিনেমা হলে যায় রুবাই। এবং বুকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এক চমৎকার আলো। ঝমঝম করে কী যে বেজে ওঠে গোটা শরীরে। ওয়েট মেশিনের পাশেই কাটু। তবে, তার মুখটা কেন যে আরো শুকনো লাগছে!
– কেমন আছ কাটু?
– আবার এসেছ?
– এই নাও তিনশো টাকা।
– আমি তোমার কাছে টিকিট বেচব না। কিছুতেই বেচব না।
– ধরো, ধরো অমন করো না। জানো, আগে দুদিন এসে ফিরে গেছি। তুমি ছিলে না।
– তুমি আমাকে দুশো টাকা দাও।
– কেন কাটু, তোমার টিকিটের দাম তো তিনশো।
– আহ্, দুশো দাও না। আর কিন্তু কখনো আসবে না।
রুবাই টিকিটদুটো নিয়ে কুঁচিয়ে দেয়। বলে – আমরা হলে যাচ্ছি না কাটু। মোগলাই-পরোটা খাবে? চলো।
কষা মাংস দিয়ে তারা মোগলাই-পরোটা খায়। এলোমেলো কত কথা বলে। দুজনেই। বাইরে ট্রামের ঘণ্টি, বাসের হর্ন, হকারের চিৎকার।
আলোয় ঝলমল করছে শ্যামবাজার।
– তুমি কোথায় থাকো কাটু?
– কেন বলো তো, তুমি কি আমার প্রেমে পড়লে? ওসবের ফুরসত নেই আমার। পরের দিন এলে সত্যি আর টিকিট বেচব না।
– বলো না কোথায় তোমার বাড়ি?
– শ্রী সিনেমার পাশের গলির বসিন্ততে। মাইরি তোমায় নিয়ে হয়েছে বড্ড জ্বালা। আমাকে জ্বালিয়ে মারছো কেন রুবাইবাবু? ভুলে যাও কেন, আমরা হলের মেয়েছেলে। সিনেমা হল অন্ধকার হয়ে গেলে, আমরা কাস্টমারদের মসিন্ত দিই। শো শেষ হলে কেউ ফিরেও তাকায় না আমাদের দিকে। অনেকে আবার যাওয়ার আগে এমন চিমটি দিয়ে যায়। বুকটা ব্যথায় টাটিয়ে ওঠে। ওই ব্যথা নিয়েই পরের শোয়ের জন্য দাঁড়াই। হলের লাইটম্যানদের রোজ একশ টাকা দিতে হয়। টিকিট কাউন্টারেও পয়সা দিই। নইলে টিকিট দেবে না। আমার মতো মেয়েছেলের প্রেমে কেউ পড়ে রুবাইবাবু?
রুবাই কেমন চুপ করে যায় নিজের ভেতর। সে নিজেও যেন বুঝে ওঠে না, কেন, বারবার সে পাগলের মতো ছুটে আসে এই সিনেমা হলে! এক গোলকধাঁধার মধ্যে সে পাক খেয়ে যায় অবিরত। আর, দুচোখ মেলে কেবল কাটুকে দেখে। দেখেই চলে।
– অন্তত তিন মাসের আগে খবরদার এদিকে আসবে না রুবাইবাবু। এলে এমন চেঁচাব! বুঝবে তখন। মনে থাকবে?
রুবাই নীরবে মাথা হেলায়। জল খায়। বলে – চা খাবে কাটু!
তিন মাস নয়, দেড় মাসের মাথায় আবার সিনেমা হলের দিকের বাসে উঠে পড়ে রুবাই। ব্যাংক থেকে পাঁচশো টাকা তুলেছে রুবাই। টিকিটের দাম আর রেস্টুরেন্টের খরচ। আর, আর এই দেড়টা মাস ঘুমে, জাগরণে, বাস্তবে, অলীকে সর্বদা তাকে ঘিরে থেকেছে কাটু। কাটুকে কি রুবাই ভালোবেসে ফেলল? না, তা নয়। তবু, কাটুর মুখোমুখি বসে থাকতে, কথা বলতে, চুপচাপ চেয়ে থাকতে তার বড় সাধ হয়। তার মনে হয়, সে কেমন এক অলৌকিক জগতে হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে। সে, দীর্ঘক্ষণ খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখে কাটুর দীঘল দুটি চোখ, আপাত-কোমল মুখ, ভ্রূপলস্নব। এবং কেন কে জানে, নিজের মধ্যে ঘন, গভীর হয়ে কেবল কাটুর কথা ভেবে সে বড় খুশি হয়ে ওঠে। এক অদ্ভুত আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তার শরীর, মন।
সিনেমা হলের ওয়েট মেশিনটির কাছে গিয়ে চমকে ওঠে রুবাই। শো শুরু হতে এখনো অনেক সময় বাকি। কিন্তু, কাটু কোথায়? তার জায়গায় দাঁড়িয়ে একটি অন্য মেয়ে। কাটুর চেয়ে গায়ের রং তার অনেক পরিষ্কার। স্বাস্থ্যও যেন অফুরন্ত। চোখ-মুখের চেহারা অনেক ঝলমলে। রুবাইকে দেখে মেয়েটি হাসে। বলে – টিকিট নেবেন? সাড়ে তিনশো। তারপর, চোখের কীসব ইঙ্গিত করে। মাথার চুল ঝাঁকায়। আঁচল এলোমেলো করে, দেখাতে চায় বুকের স্বাস্থ্য। শরীরের মাংস।
– কাটু কোথায়?
– কাটু আর আসবে না।
– কেন?
– ওর বুকে কীসব হয়েছে। পাড়ার ডাক্তারবাবু বলেছেন, কাটু আর বাঁচবে না। আপনি কি টিকিট নেবেন? না হয়, তিনশোই দেবেন।
তারপর রুবাই যেন উড়তে থাকে। এভাবে ছোটে কেউ?
অ্যাক্সিডেন্ট হবে যে রুবাইয়ের! সে যানবাহন, মানুষজন কোনো কিছুর তোয়াক্কা করে না। রুবাই কেবল ছুটতে-ছুটতে, যেন-বা, উড়তে-উড়তে, শ্রী সিনেমার পাশের গলির অভ্যন্তরে, হাজারো মানুষকে জিগ্যেস করতে-করতে, ঠিক কেমন পৌঁছে যায় কাটুদের অন্ধকার ঘরটির সামনে। সে কাটুর নাম ধরে ডাকে। বারবার। কে বেরিয়ে আসে?
কাটুর মা! হবে হয়তো।
ক্ষীণ গলায় বলে – কাটুর বড় অসুখ। কাটু বোধহয় আর…
তারপর, রুবাই কাটুর বিছানার সামনে এসে দেখে, শ্যামলা রঙের, দীঘল চোখের কাটু, যেন মিশে গেছে বিছানায়। সে খুব আসেন্ত ডাকে, কাটু!
কোনো সাড়া পায় না। গুমোট ঘরের ভ্যাপসা গরমে রুবাই দরদর করে ঘামে। সে আবার কাটুর নাম ধরে ডাকে। আবার।
এবার, চোখ মেলে কাটু। কাটুর মা বিছানার বাঁ-পাশের টেবিলে একটা লম্বা মোমবাতি জ্বেলে দিয়ে যায়। মোমবাতির ধোঁয়ায় দম যেন আটকে আসে রুবাইয়ের। সে কাটুর বিছানায় বসে পড়ে।
– কাটু, আমাকে চিনতে পারছো না!
– তুমি এখানে কেন এলে রুবাই সোনা?
– কী হয়েছে তোমার কাটু?
কাটু রুবাইয়ের বাঁ-হাতটা তুলে নেয়। তারপর, চেপে ধরে তার বাঁ-দিকের বুকে। মুহূর্তে চমকে ওঠে রুবাই। শিহরিত হয়। সারা শরীরের রোমরাজি খাড়া হয়ে ওঠে। বিজবিজে ঘামে সে ভেসে যায়। তার চোখের তারা হয়ে ওঠে বিস্ফারিত। কাটুর বাঁ-বুকে প্রকা- একদলা মাংসপি-!
– বড় যন্ত্রণা রুবাই সোনা। বড় ব্যথা। তুমি চলে যাও। আর কখনো এসো না।
– ডাক্তার দেখাওনি কাটু?
– ডাক্তারবাবু বলেছেন অপারেশন করতে। অত টাকা আমরা কোথায় পাবো বলতে পারো?
– তুমি কিছু ভেবো না কাটু। আমি তো আছি।
– তুমি কেন টাকা নষ্ট করবে রুবাই সোনা! কেনই-বা করবে? আমি কে তোমার? আমি সিনেমা হলের মেয়েছেলে রুবাই সোনা।
– আমার কিছু জমানো টাকা আছে কাটু। কাল সকালেই তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবো। তুমি ঠিক সেরে উঠবে কাটু।
– সেরে উঠে লাভ কী বলতে পারো? বুকটাই না থাকলে…
রুবাই খানিক চুপ করে থাকে। কীসব ভাবে। তারপর, যেন নিজেকে বোঝায়, সে আর কাটু এই লড়াইয়ে ঠিক জিতে যাবে। ঠিক টিকে যাবে তারা। যাবেই। তাছাড়া, তারা তো দুজন নয়। কাটুর মা টেবিলে মোমবাতি জ্বেলে গেছে। দেয়ালে ফুটে উঠেছে স্পষ্ট, মোমবাতির প্রলম্বিত আরো দুটি ছায়া। তার আর কাটুর। চারজনে এই লড়াই ঠিক জিতে যাবে। অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে রুবাই। তারপর, বড় নিবিষ্ট মনে, সে কাটুকে তার স্বপ্নগুলো বলতে থাকে। সেই কাটুর নদী হয়ে যাওয়ার, পাখি হয়ে যাওয়ার, জ্যোৎস্না হয়ে ওঠার হরেক স্বপ্নের গল্প। চোখ বন্ধ করে কি সেসব শোনে কাটু? নাকি গভীর শ্রামিন্ততে পড়ে ঘুমিয়ে? রুবাই সেসব কিছুই দেখে না। সে গভীর মনে বলে চলে অনর্গল। মোমবাতির ছায়াদুটি তখনো স্পষ্ট ঘরের দেয়ালে।
এভাবে, গল্প তো শেষ হয় না। একটা গল্প থেকে জন্ম নেয় আর একটি গল্প। সেখান থেকে আরো একটি। গল্প এভাবে চলতেই থাকে। অস্থিমজ্জার মতো, একটি অপরের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে আষ্টেপৃষ্ঠে। তাদের আর পৃথক করা যায় না। তবে, সব গল্পই রুবাইদের টিকে থাকার, লড়াই করার, বেঁচে থাকার গল্প…।