মন মেজাজ অতি মাত্রায় খারাপ । লেবার রুমের বাহিরে বসে আছি । ঈশিতা ভিতরে,মাঝে মধ্যে ওর আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে । শরীরের সব শক্তি দিয়ে একেকটা চিৎকার দিচ্ছে মেয়েটা ।ঈশিতা আমার গত দুই বছরের বউ আর ৭ বছরের প্রেমিকা ।আম্মা পাশে বসে দোয়া পড়ছেন ।ঈশিতা একটা করে চিৎকার দেয় আর আমার শাশুড়ি মা উঠে দাঁড়িয়ে পড়েন একবার এ মাথা থেকে ও মাথা হাঁটেন ,আবার এসে আমার পাশের চেয়ার টাতে বসেন । আর আমি বসে আছি বেকুবের মতো । অফিসের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় এসাইনমেন্টের কাজ ফেলে আমি এখানে দুই হাত ফোল্ড করে দুই পায়ের চিপায় দিয়ে বসে আছি ।দারুণ !
এসবই হয়েছে আমার কন্ট্রোল ফ্রিক আব্বার জন্যে ।হঠাৎ ফোন দিলেন উনি “শুভ! বউমাকে হস্পিটালে নিয়ে গেছে।তুমি এক্ষুনি যাও । ” আমি বললাম আব্বা কাজ করছি ,ওখানে তো আম্মা আর ইশতিয়াক আছে ।” তিনি তার বাজখায়ী গলায় ফোনের মধ্যেই আমাকে কাঁপিয়ে ফেল্লেন ” তুমি এখন হস্পিটালে যেতে না পারলে আমার বাড়িতেও ফেরত এসোনা আর ” আমি গোবেচারা মনে হলো কি এক জীবন আমার, নিজের সন্তান হয়ে যাচ্ছে এখনো এই লোক আমার জীবনের কন্ট্রোল রুমের মেইন চেয়ারে বসে আছেন ।তিনি দেখলাম আম্মাকে এই নিয়ে তিনবার ফোন দিয়েছেন ।
আমি এসেছি শুনেছেন আশা করি ।যাই হোক রাত হলে বাড়ি তো ফিরতে হবে নাকি। লোক যেমনই হোক তার বানানো ৪ রুমের ছোট্ট বাড়িটাতেই আমার ঠাঁই । ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে হলো ঈশিতার কান্নার শব্দ বদলে গেছে! । নার্স এসে দেখিয়ে গেলেন ।আমার কন্যা সন্তান হয়েছে ।ঈশিতা ভালো আছে। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে একটু আদর করলাম।মেয়ে মিনমিনে চোখে আমাকে দেখলো ।কি দেখলো জিজ্ঞেস করলাম উত্তর দিলনা। মেয়ের কানে আজান দিলাম। আমি জন্মের পর আজান দিয়েছিলেন আমার মামা ।কারণ আব্বা সেদিন সেখানে ছিলেন না।
রাত পর্যন্ত সেখানে থেকে ঈশিতার সাথে আবার দেখা করে, কথা বলে ,বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলাম।আমার নিজের যেদিন জন্ম হয় আব্বার তখন চাকরীর পোষ্টিং নোয়াখালীতে । আমার জন্মের দিন আব্বা ছিলেন না ।ঢাকা আসতে পারেন নি তিনি ।কোন এক অজানা কারনেই আব্বার সাথে আমার সম্পর্ক অমীমাংসিত ও অসুন্দর।আব্বার জন্যে আমার তেমন একটা ফীল ও হয়না ,আম্মাকে যতটা কাছের মনে হয় আব্বাকে ঠিক ততোটাই দূরের মনে হতো । আব্বাকে ছাড়াই আমার বেড়ে ওঠা ,আর আব্বা আর সন্তান না চাওয়ায় আমার আর আম্মার পৃথিবীর কেন্দ্র আম্মা আর আমি । আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি আব্বা তখন বদলি হয়ে ঢাকায় এলেন ।দুজনের কেউই একে অন্যের সাথে তাল মেলাতে পারছিলাম না। কেমন একটা “পাশের বাসার সলিম কাকা ” টাইপ ফিলিং আমার তার প্রতি ।
এরপর শুরু হলো আমার আর তার অন্য রকম জীবন।আব্বা যা-ই বলতেন আমার মনে হতো বাহিরের কেউ বাড়তি কথা বলছেন । আর আমি যা-ই করতাম আব্বার ধারনা মায়ের আশকারাতেই আমি এসব করছি ।আব্বার সাথে রাগ করে পড়তাম না ।কোচিং ক্লাসের কথা বলে মাঠে খেলতাম।যতক্ষণ ঘরের বাহিরে থাকা যায় আর কি ।রাতে হয়ত ঘরে ফিরতাম আম্মার জন্যে । এই বাবা ছেলের দ্বন্দে সবচেয়ে বড় হার টা ছিলো এস এস সি তে আমার ফেইল ।আব্বা আমাকে সেদিন চড় মারতে গিয়ে মারলেন না । আমাদের গ্রাম থেকে প্রথম স্ট্যান্ড করে বড় চাকরী করা শফিকের ছেলে ফেইল করেছে ,সবাই উহু আহু করে শেষ।শেষে বাবা একদিন বললেন “ফেইল আমার ছেলে করেছে ,ঘুম তোমাদের হারাম হয়েছে, আমিতো দিব্যি ঘুমাই ,তোমাদের ঘুম না হলে আমার ঘুমের ওষুধ একটা খেয়ে দেখো উপকার হয় কিনা।” সেদিনের পর আব্বা আমাকে পড়ানো শুরু করলেন নিজে ।আব্বা কে তখন আর পরপর লাগেনা ,কিন্তু তখন আমি তাকে ভয় পাই ,ভীষন ভয়।
সেই ভয় আমার কখনই কাটেনি আর । ঈশিতাকে যে ভালোবাসি এ কথা টা আমি আম্মাকে বলেছিলাম আমাদের সম্পর্কের একদম শুরুতে ,আর আব্বাকে বলার জন্যে মায়ের সময় লেগেছে ৪ বছর ।আর আমাকে অবাক করে দিয়ে সেই মেয়ে কিনা বিয়ের পর দিন থেকে হয়ে গেলো আমার বাপের ন্যাওটা । “আব্বা চা ,” আব্বা ওষুধ”, “আব্বা চলেন ছাদে যাই ,।আর আব্বার ও” বউমা ,বউমা ,বউমা !!! শুনে শুনে আমি আর আম্মা হতভম্ব ।আম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম ‘ আম্মা , আমি জন্মানোর আগে আব্বা কি কন্যা সন্তানের দোয়া করতেন নাকি? ‘ আম্মা হেসে বললেন মেয়ে চাইলে তো আবার সন্তান নিতেই চাইতেন এমন একটা নিয়ে আমি জীবন পার করতাম না ” কথায় যুক্তি আছে,বিশ্বাসযোগ্য! ঈশিতা একদিন আমাকে বললো “শুভ, আব্বার থেকে আবৃত্তি টাও তো শিখতে পারতে ! ” আমিতো আকাশ থেকে পড়লাম।বাপ রে যেই গলায় আমার সাথে চিল্লায় জীবনেও ভাবিনি এই লোক আবৃত্তি জানে । আম্মাও দেখি বলে তাকে বিয়ের রাতে আব্বা কবিতা আবৃত্তি উপহার দিয়েছিলেন ।কারন তার কাছে বউকে কিছু দেয়ার খুব বেশি অর্থ ছিলনা । ভাবতে ভাবতে ঘরের দরজায় চলে এলাম । কলিং বেল দিতেই আমার বউয়ের ডান হাত শেফালী এসে দরজা খুল্লো ।”শেফু,আব্বা শুইছেন?”
অমনি চাদর মুড়ি দেয়া ষাটোর্ধ আমার জন্মদাতা বেরিয়ে আসলেন। আব্বাকে দেখে আজকে কেন যেন অদ্ভুত একটা ভালো লাগা কাজ করলো । তিনিই আগে জিজ্ঞেস করলেন “খেয়েছো ?” জ্বী । বউমা আর আমার নাতনি ভালো আছে ? জ্বী।আসার সময় ঈশিতার সাথে কথা বলে এসেছি । আব্বা আপনি রাতের ওষুধ খেয়েছেন ? আব্বা মনে হলো একটু অবাক হলেন । হুম খেয়েছি । আব্বা আপনার কি ঘুম পাচ্ছে ? নাহলে চলেন বাহিরে হেটে আসি । হঠাৎ মনে হলো এখনই একটা ঝাড়ি খেয়ে উড়ে যাবো আমি । কিন্তু না চির অপরিচিত আব্বা বললেন “দাড়াও বদলে আসি ,তুমি একটু হাত মুখ ধুইয়ে নাও ।”
ঘড়িটায় চোখ পড়লো,রাত ২টা বেজে ৪১ মিনিটে বাবা ছেলে নেমে পড়লাম রাস্তায় । বের হতেই গায়ে একটা হীম বাতাস লাগলো মনের অজান্তেই ভাবতে লাগলাম মেয়েটার জন্যে নার্সারীতে দিয়ে আসা কাথাটা পাতলা হয়ে যায়নি তো? নার্সারীর নার্স রা মেয়েটার হাত পা বেরিয়ে গেলে খেয়াল করলেই হয়।মাথার উপর দিয়ে নামা না জানা একটা পাখি কিচ কিচ করতে করতে উড়ে গেলে চিন্তায় ফাটল ধরলো! আব্বা বললেন “তোমার ঠান্ডা লাগলে চাদর নিও আমার তেমন ঠান্ডা লাগছেনা” । আমি চশমা টা খুলে চোখ মুছে নিলাম। লোকটার অনুভূতি গুলো আজকে স্পষ্ট আর স্বচ্ছ, এতোদিন যা দেখিনি আজকে চোখে পড়ছে। বাতাস টা বেশি ই স্নিগ্ধ আজ । চায়ের দোকান খোলা দেখে আব্বাকে বললাম চলেন চা খাই । আব্বা কিছু বললেন না ।পিছু পিছু হাটলেন । চা খেতে খেতে আমি আব্বাকে দেখছিলাম । আব্বা আনমনে রাস্তায় শুয়ে থাকা কুকুর দেখছিলেন ।
হঠাৎ বলতে শুরু করলেন ‘ তোমার যেদিন জন্ম হয় আমি সেদিন কিছুতেই ঢাকা পৌছাতে পারিনি ।সব রকম চেষ্টা করার পর ও ।হঠাত থানা ইনভেস্টিগেটর আসাতে সব থমকে গেলো । আমি সেদিন খুব কেঁদেছিলাম । কেউ জানেনা তোমার মা ও না । আজ তুমি জানলে । তোমাকে বলার অবশ্য কারণ আছে । আজ আমি তোমাকে ফোনে বকেছি কারণ আমি চাইনি তুমি আমার মতো এই দিনটা মনে করে কষ্ট পাও। আমি তোমার প্রথম বুলি শুনিনি , তোমাকে প্রথম দাঁড়াতে দেখিনি , তুমি প্রথম যেদিন নিজে ধরে ফীডার খেয়েছিলে ,এ ঘটনা আমি জেনেছি এক মাস পর যখন ছুটিতে ঢাকা এসেছি। মোটামুটি রেডিমেড একটা বড় ছেলে পেয়েছি আমি আমার জন্যে । আমি কোন কিছুতেই তোমার প্রথম হতে পারিনি। ” আব্বা কিছুক্ষণ থামলেন , আমিও কোন কথা বললাম না , এই অনর্গল কথা বলে যাওয়া আব্বাকে আমার ভালো লাগছে , অন্যরকম ভালো । একদম যে ভালো লাগায় হার্ট বীট বেড়ে যায় সেরকম ভালো । যেখানে পরের কথা শুনতে ইচ্ছা হয় কিন্তু আগের কথার রেশ কাটেনা ।
আব্বা আবারে শুরু করলেন , ‘ তোমার আম্মা আরেকটা সন্তানের আশা করেছেন অনেক বার । তার সাথে আমার কয়েকবার ঝগড়া ও হয়েছে । আমরা দুই একবার কথাও বন্ধ রেখেছি । কিন্তু আমি আর সন্তান চাইনি কারন আমি তোমাকে যা দিতে পারিনি অন্যজন কে দিতে চাইনি ।,আবার নিজেকেও ঠিক সমান আগের কষ্ট টা দিতে চাইনি । আমি খেটেছি জীবনের অনেক গুলো বছর একা থেকেছি যেন তোমাকে কখনো এই কষ্ট করতে না হয় । তোমাকে আমি যতই দেই বা যা ই করি তোমার জন্যে কিন্তু তোমার প্রথম কান্নায় আমি থাকতে না পারা টা আমাকে এখনও কষ্ট দেয়। তুমি তো আমার অংশ । তুমি তো আমার।” আমি চুপ করে আছি , ফজরের আজান কানে আসছে । চারিদিকে একটু একটু আলো । আব্বা বললেন ” চলো উঠি।তুমি নিশচয়ই ক্লান্ত”ঃ না আব্বা , চলেন মসজিদে নামাজ টা পড়ে এরপর রাস্তায় রাস্তায় হাঁটি , চলেন আপনার ভার্সিটি এরিয়া তে যাই ।
চায়ের বিল দিতে মানিব্যাগ এর জন্যে হাত দিতেই আব্বা বুক পকেট থেকে ২০ টাকার একটা নোট চা ওয়ালা মামা কে দিলেন আর আমাকে বললেন টাকাটা নিজের মেয়ের জন্যে খরচ করো” শান্তিনগর থেকে হাঁটা শুরু করলাম ঢাকা ভার্সিটির দিকে । পৌছে চুপচাপ বসে থেকে থেকে আমাদের সকাল্ নেমে আসলো চারিদিকে।এর মধ্যে আব্বা আর আমি আরো দু কাপ করে চা খেয়েছি । হঠাত আব্বাকে বললাম “আব্বা আমি আপনার বুকে একটু মাথা রাখি ?” আব্বা আবার কিছুটা অবাক ভাবে তাঁকিয়ে থাকলেন। এরপর উত্তরের অপেক্ষা না করেই নিজের শরীরের যত কম ওজন দেয়া যায় তা দিয়ে বৃদ্ধ বাবার বুকে মাথা গুজে দিলাম । কি সুন্দর একটা গন্ধ , এ গন্ধের নাম বাবা বাবা গন্ধ অন্য নাম নেই , হঠাৎ মনে হলো সব ক্লান্তি মিশে যাচ্ছে , এই যে ফেলে আসা এসাইনমেন্টের টেনশন , নতুন আসা সন্তানের জন্যে সাবকনশাশ মাথায় চিন্তা , সব একদম সব মিশে যাচ্ছে বাতাসে , হালকা হয়ে যাচ্ছি আমি ।
অদূরে এক শিশু তার বাবার হাত ধরে আধ ঘুম চোখে স্কুলের দিকে যাচ্ছে , পাশের চা ওয়ালা মামা দোকানের সামনে টা ঝাড়ু দিচ্ছে , ফুল হাতে কতগুলো পথের শিশু এদিক ওদিক ছোটাছোটি করছে , রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে,আস্তে আস্তে আড়মোড়া দিয়ে ঘুম ভাংছে পৃথিবীর ।আম্মা নিশ্চ্য়ই নামাজ শেষ করে আর ঘুমান নি , ঈশিতা হয়ত ঘুম , আমার সন্তান ও হয়ত শুয়ে ঘুমাচ্ছে । পৃথিবীর কেউ জানেনা এখানে এখন এই মুহূর্তে কি হচ্ছে , সবাই যখন দিনের শুরুতে ছুটছে তখন এখানে সম্পর্কের বরফ গলছে রক্তের উষ্ণতায়, আমি আজ বাবা হয়েছি , বাবা বুঝেছি “। আচ্ছা আমি আব্বার বুকে যে শান্তি পেলাম , আমার মেয়েটাও কি আমার বুকে সেই শান্তিই পিটপিটে চোখে আমাকে জানিয়েছে ? হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লাম ” আব্বা চলেন হাসপাতালে যাই , আমি চাই আমার মেয়ে প্রথম সকালে সে তার দাদাকে দেখুক , আর সে খুব করে আপনার ন্যাওটা হোক। আর তার আগে চলেন শাহবাগে হোটেলে জমপেশ একটা নাস্তা দেই বাপ ছেলে। বিল আপনি দিবেন ।”
শিশুর মতো খুশি হওয়া আমার আব্বা বললেন ” তবে আগে শাহবাগ থেকে ফুল ও নিতে হবে , দাদুনী আর বউমার জন্যে ” এই শিশু বাবাই আমার চাই নয়ত এই শিশু বাবাই আমার খোজ ছিলো সবসময় ।লোকটা সুস্থ শরীরে বেঁচে থাকুক , আমার জীবনের কন্ট্রোল রুমের মেইন চেয়ারের মেইন বাটন টা সারাজীবন উনার হাতেই থাকুক । আমার মেয়ের বাবা তার আব্বাকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছে , একদিন আমিও তার জন্মের দিনের মায়া মেশানো গল্প তার কাছে করবো, ততোদিন এই সুন্দর গল্পটা জমা থাক।
গল্পের বিষয়:
গল্প