ছড়ছড়-ফরফর-খরখর।
এখানে দাঁড়ানোর পর থেকেই হারাধনকে বিরক্ত করে চলেছে অযাচিত-অপরিচিত সব শব্দগুচ্ছ।
যে-বটতলায় দাঁড়ালে পুরো আকাশ আর নদী চোখের মণিকোঠায় আশ্রয় নেয়, মনে হচ্ছে, সেখানেই শব্দের উৎস; নদী থেকে হাওয়া এসে দোল খাচ্ছে গোলগাল লেজওয়ালা বটপাতায় – হাওয়ার সেই মাতম কানে ঝাপটা মেরে বারবার হারাধনকে টেনে আনছে মাটিতে – সঙ্গে সঙ্গে জলের ঘূর্ণির মতো বুক খালি করা এক শূন্যতাবোধ ওকে খামচে ধরে – বুকের একেবারে গহিন থেকে দলা-দলা কান্নার দীর্ঘশ্বাস ঠেলে এসে ফের বাতাসে মেশে – যেন তছনছ করা কূল-কিনারাহীন এক আবর্তে পড়ে রিক্ত-নিঃস্ব হওয়াটাই ওর নিয়তি।
গাঙপাড়ের এই নিরালা ভোরবলোয় সে একটুখানি শান্তি, একটুখানি দরদ, একটুখানি ভালোবাসা আর স্বসিত্মর পরশ পেতে এসে দাঁড়িয়েছে। অথচ এসব কর্কশ শব্দ-শর ওর আকুল-ব্যাকুল তৃষ্ণার্ত হৃদয়কে বারবার ঘায়েল করে দিচ্ছে; অপারগ উদাসীনতা নিয়ে তাকানো ছাড়া কিছু করার নেই ওর। চোখের সামনে কিছু দেখতেও পাচ্ছে না যে, সে ক্রুদ্ধ হয়ে তেড়ে যাবে সেদিকে। তাইলে গায়েবি এসব শব্দ আসছে কোত্থেকে? নিজেকে প্রশ্ন করে পরক্ষণে সাধু-সমেত্মর মতো নির্বিকার-উদাসীন হয়ে সে দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে।
মাথার ওপর গাছটার দিকে বারকয় তাকায়। কার্তিক মাসের নানারকম রোদেলা ছাঁচ এখন পাতার ফাঁকে। নদীর ঢেউয়ের মাথায় সকালবেলাকার রুপালি সোনা ঝরছে আকাশ থেকে। সেই সোনার স্পর্শ পাচ্ছে বটের সবুজ-বাদামি পাতারা।
চারপাশের ক্ষেত-খামারে চলছে রোয়াবোনা পার্বণ। উঠতি বয়সের পোলাপান কাদায় পা ডুবিয়ে রেখার পর রেখা এঁকে চলছে ভেজা-নরম থকথকে জমির অন্তরে। ধানের কচি-সবুজ রোয়া তো নয়, যেন শিশুর মুখের অপরূপ দুধদাঁত, মাটিতে গেড়ে বসে চারপাশে সবুজ আলো ছড়াচ্ছে।
পাশ দিয়ে একটা মেঠো রাস্তা ঢুকে পড়েছে গ্রামে। দুপাশের বড় বড় সব সামাজিক বনায়নের মেহগনি-চম্বল-আকাশি; ফরফর করছে নদীর হাওয়া পেয়ে। দলবেঁধে গ্রামের কিছু নারী-পুরুষ ঊর্ধ্বশ্বাসে হেঁটে বড় রাস্তার বাস ধরতে চাইছে। এরা শহরে নানারকম চাকরির সঙ্গে জড়িত। আগে এ-গ্রামে কোনো মুদিদোকান, চা-স্টল ছিল না। এখন রাস্তার মোড়ে মোড়ে পলিরাংতায় মোড়ানো রংঢংয়ের দোকানের অভাব নেই। এগুলোর মালিক বেশিরভাগ ওরাই। চাকরির গরমে এরা এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে। হারাধনের মনে এদের সম্পর্কে বিষ জমা রয়েছে। সামান্য লেখাপড়ার জোরে এরা এখন গ্রামকে শহর বানানোর পাঁয়তারা করছে। টেলিভিশন, মোবাইল, ফ্রিজ – কী নেই তাদের জিম্মায়?
ওদের দেখে দেখে হারাধনও ওর কুমোরত্ব হারিয়ে মুদিদোকানদার বনে গেছে। দূরদেশের স্বপ্নের মতো টাকার হাতছানি সে অস্বীকার করতে পারেনি; হাঁড়ি-পাতিলের একঘেয়ে প্যাককাদায় আর হাত ডুবিয়ে রাখতে হয় না। কাঠকয়লায় সেসব পোড়ানোর হুজ্জোতি নেই। হাড়ভাঙা খাটুনিটাও দূর হয়েছে; অথচ দ্বিগুণ-তিনগুণ টাকা উপচে পড়ছে। একটা ডায়রিয়ার স্যালাইন তিন টাকায় কিনে পাঁচ টাকায় বেচতে পারে। একটা বিস্কুট পঞ্চাশ পয়সায় কিনে দেড় টাকা হাতিয়ে নিতে পারে। এক কাপ চায়ে এক টাকা খরচ হলে তিন-চার টাকা এর মূল্য দাঁড়ায়। এমন ব্যবসা না হলে কি কপাল ফেরে?
আবার শব্দটা সে পাচ্ছে। এবার মনে হচ্ছে ঘুণপোকা; একেবারে ওর গা-ঘেঁষে শব্দ হচ্ছে; যেখানটায় সে দাঁড়ানো, এর লাগোয়া যে-বিশাল বৃক্ষের শেকড়, সেখানেই।
সে মাটির ওপর বিশালদেহী রাক্ষসের পায়ের আঙুলের মতো ছড়িয়ে থাকা শিকড়ের ওপর গিয়ে বসল। শব্দ-সংকেত বুঝবে বলে কান খাড়া করে রইল ক-সেকেন্ড। কই, এবার তো কোনো শব্দই হচ্ছে না?
অগত্যা, হারাধন দৃষ্টি বিছিয়ে দিলো গাঙের ওপারে। এখনো ওপারের ঘাট থেকে কোনো নৌকা ছেড়ে আসেনি; সে যেজন্য এই নিরিবিলি-নির্জন জায়গাটায় এসে দাঁড়িয়েছে, সে তো কোনো অহেতুক অপ্রয়োজনীয় শব্দ শুনতে নয়। সে এসেছে খুকিকে নিয়ে যেতে। আরে, খুকি হচ্ছে ওর জান। ও আজ নাইওরি হয়ে এ-ঘাটে পা রাখবে। কতদিন শ্বশুরবাড়ি ছিল – সবার মন জুগিয়ে ষোলো-সতেরোর এটুকু মেয়ে না-জানি কত কাহিল হয়ে পড়েছে। একটুখানি স্বসিত্ম, একটুখানি আরাম আর একটুখানি বিনোদনের চিত্রকল্প মা-বাড়ি আজ ফিরবে সে। সেজন্যই ওর এই প্রতীক্ষা। ওর নিজেরই তো যাওয়া উচিত ছিল ওপারে; সময় হয়নি কাজের চাপে পড়ে। তাই বলে এপারেও দাঁড়াবে না?
প্রতিদিন ভোরবেলায় নদী-পারাপার শুরু হয় এখানে। চলে সেই সন্ধ্যা অবধি। অথচ কখন থেকে একটা নিরীহ চারাগাছ হয়ে সে দাঁড়িয়ে রয়েছে গাঙপাড়ের একটা বিশাল বৃক্ষের নিচে। সময় যায়, বেলা বাড়ে। ভোরের সূর্য শৌর্যে-বীর্যে তাততে শুরু করে; তবু নৌকার দেখা নেই; বাতাসে আশ্বিনের হিমেল প্রলেপ কখন কেটে গেছে। একটু আগের শিশু-সরল সকালটা এখন বড় মানুষের মতো হারাধনের চোখের সামনে অঙ্গভঙ্গি করছে। তবু দেখা নেই খুকির।
মাঝে মাঝে যে কী হয় হারাধনের মাথায়; সে খুকিকে স্পষ্ট দেখতে পায় এপার থেকে। নৌকায় উঠতে গিয়ে ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠছে। ডাঙার মাটি থেকে নৌকার পাটাতন পর্যন্ত কলাগাছের বাকল দিয়ে দুটো মুলিবাঁশ একসঙ্গে বাঁধা। এর ওপর সতর্ক পা ফেলে ধীরেসুস্থে জলে ভাসা দোলনা-নৌকায় চড়তে হয় সবাইকে। খুকির কিশোরী শরীর এঁকেবেঁকে যাচ্ছে বারবার; এই বুঝি ধরাশায়ী হয়ে জলে হাবুডুবু খাবে মেয়েটা। একসময় নৌকায় পা রাখতে সমর্থ হয় খুকি; তখন সে কি হাসি ওর; মনে হচ্ছে এইমাত্র ভরা গাঙ সাঁতরে পার হয়েছে। কিশোরী উচ্ছ্বাস আর নৌকার চারপাশের কচি ঢেউয়ের কলকলানি মিলেমিশে একাকার তখন।
আবার সেই শব্দটা। এবার মনে হচ্ছে গাছটার ভেতরে কেউ যুদ্ধ করছে। ঘরঘরঘরঘর। ছ্যারছ্যারছ্যার। একটু পর সব নিঃশব্দ-নিশ্চুপ। বাতাস, দু-চারটা পাখির শিস আর ভাঙা পরিত্যক্ত খেয়াঘাটে অসহায় রিক্ত অথচ ভালোবাসায় টলোমলো ঢেউয়ের উপচে পড়ার শব্দ ছাড়া আর কিছু নেই।
দূরে গাঙের বুকে পিলার উঠছে। ব্রিজ হবে; গাড়ি আর ফেরিঘাটে থামবে না। সোজা এক টানে গাজীপুর থেকে ময়মনসিংহের গফরগাঁও। শাল-পিয়ালের বন থেকে অন্য কোনোখানে। হাজার হাজার দিশি কিংবা ভ্রমণ পাখি, সবাই এপার-ওপার বাধাহীন উড়ে যায়। সাপ-সরীসৃপ সব নির্দ্বিধায় এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায়। তাহলে মানুষ নয় কেন? মানুষ তার শক্তি দিয়ে গাঙের বুকে পেরেক ঠুকে তার ওপর পাটাতন বসাচ্ছে; সেই পাটাতনের ওপর দিয়ে ছুটবে বলে আনন্দে মশগুল ওরা। এজন্য গাঙের বুক শূন্য হলেও ক্ষতি নেই, জীবনে গতি এলেই হলো। হারাধন চোখ ঘুরিয়ে নেয় সেখান থেকে।
ওর পরনে শুধু একফালি গামছা। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চোখ দুটো লাল করমচা। সারারাত শ্মশানে বসে গাঁজা টানার পর সে গাঙপাড়ে এসে দাঁড়িয়েছে খুকিকে একপলক দেখবে বলে; মেয়েটার হাতের ওপর হাত রেখে সস্নেহে ওকে জানাবে, ‘খুব শুকাইয়া গেছস রে মা। আয়, আয়। তাগদা কইরা বাড়ি চল, মা।’
সুযোগ পেলেই হারাধন এখানে এসে দাঁড়ায়। এখানটায় না দাঁড়ালে ওর হয় না। কারণ, এ-খেয়াঘাট থেকে খুকিকে প্রথম ওপারের নৌকায় নিজহাতে তুলে দিয়েছে কাঁদতে কাঁদতে।
লক্ষ্মী তখন বর্ষার ভরা গাঙ। গফরগাঁইয়া জামাই নিত্যচরণ ওর পাশে। বহু বছরের প্রেম ওদের। সফলকাম খুকি তাই পাড়ি জমাচ্ছে স্বামীর ঘরে। ভালোবাসা আর আনন্দ ডাহুক পাখির মতো ওর চোখমুখের আড়ালে টঁউ টঁউ করে ডাকছে।
শোভা রানী সে-দৃশ্য চোখের সামনে রেখে স্বামীর কানে ফিসফিস করে ঢেলে দেয়, ‘রাজি ত আছলা না। অহন দেকছ? পোলাডা কেমুন কারতিক পাইছ।’
হারাধন বিরক্তিভরা চোখে স্ত্রীর দিকে তাকায়। সে এ-বিয়েতে কখন বাদ সাধল তা ওর জানা নেই। আসলে, এ-ধরনের প্রেমের সম্পর্ক সহজে পরিবার-পরিজন কেউ মানতে চায় না। সেই গ্যাঁড়াকলের ভেতর পা ঢুকে গেছে ওর। সবাই ওকেই সামনে ঠেলে দিয়ে বলেছে, ‘মাইয়ার বাপ ত রাজি নাই।’ অথচ রাজি-অরাজি কোনো কিছুতেই ওর কোনো ভূমিকা নেই। যা কিছু সব শোভা আর মেয়ে লক্ষ্মীর হাতে। কাপড়ের দোকানের কর্মচারী গফরগাঁওয়ের বাসিন্দা নিত্যকে খেলিয়ে খেলিয়ে বিয়ের পিঁড়ি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার কূট-কৌশল সব ওদেরই!
হারাধনের চোখভরা নির্বোধ দৃষ্টি। সে শুধু মেয়েকে সুখী দেখতে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা। নিজের দুই বিঘা জমি বেহাত হয়েছে মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে, তাতে ওর কোনো দুঃখবোধ নেই। মনের মতো একটা পাত্র যে পেয়েছে, তাতেই গর্বে আটখানা। মনে হচ্ছিল, বড় একটা বোঝা মাথা থেকে নেমে পড়ল। আহ্! কী অপার শান্তি। একটাই সন্তান; বিয়ের পর দশ বছরের মাথায় আচানক দৈব-দুর্বিপাকে পাওয়া এ-আশীর্বাদ। ওর জন্মের পর হারাধন পাল কুমোরের কাজ ছেড়ে মুদিদোকান দিয়ে বসল পাড়ার মুখে। মেয়েকে পড়িয়ে কিছু একটা বানানোর স্বপ্ন চোখের তারায়। লাভহীন সম্মানহীন জাতিপেশাকে আগলে রাখার মোহ আর নেই। এখন যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে হবে। সেভাবেই হারাধন হয়ে পড়ল মুদিদোকানদার। কুমোর-আঁটির মুখে ওর মুদিদোকানটা তখন বেশ চাঙ্গা। সবার মুখে হাসি – সিদ্ধান্তটা যে ভুল ছিল না সেজন্য হারাধনের ছাতিভরা রাশি রাশি গর্ব।
তবু পুজো-পার্বণে সুযোগ মিললেই মৃন্ময় মূর্তি, সরা, ফুলদানি, ধূপদান, হাঁড়ি-পাতিল তৈরি করার জন্যে ওর আঙুল কেবলি নিশপিশ করে। এঁটেল মাটির ঢিবিটা ঠিকই বাড়ির সামনে কাঙালের মতো পড়ে রয়েছে। ওদিকে চোখ গেলেই চাকের পাশে বসে পড়ে সে। এঁটেল মাটি, বালি, রং, খড় নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি-কচলাকচলি করতে গিয়ে সুখে মন ভরে যায়। নিজেকে নিজের মতো লাগে। মুদিদোকানে বসলে, যতই আয়-রোজগার বাড়ুক, মনের সুখটুকু নিজের কাছে আর থাকে না। গচ্চার খাতায় উঠে পড়ে। বিরক্তি আর একঘেয়েমিতে মনটা একেবারে পাথর হয়ে খায়। অকারণে মেজাজ খিঁচড়ে থাকে সারাক্ষণ। তখন চাকের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লে জাদুর মতো আপনাআপনি চড়া মেজাজ পড়ে যায়। মনে হয় গ্রীষ্মের দাবদাহে পুকুরপাড়ের আমগাছতলায় শীতলপাটি বিছিয়ে শুয়ে রয়েছে সে। কোনো ভাবনা নেই, দুশ্চিন্তা নেই – তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে কেবল শীতল আবেশ!
মেয়েটা তখন হামাগুড়ি দিয়ে ওর কোল ঘেঁষে এসে বসে থাকে। মাঝে মাঝে ওর কাজকর্ম সব ভ-ুল করে দিয়ে অকারণে খিলখিল করে হেসে ওঠে।
খুকির কচি ডাঁটার মতো আনাড়ি দুটি হাতের দিকে তাকিয়ে হারাধন ভাবত, বড় হয়ে মেয়েটা বুঝি ডাকসাইটে কোনো মৃৎশিল্পী হবে। সেজন্যে, ওকে সে এসএসসির পর ঢাকার আর্ট কলেজে পড়াবে বলেও মনস্থির করে ফেলেছিল। কিন্তু লক্ষ্মীর মন যে মজে রয়েছে নিত্যচরণে; সব ছেড়েছুড়ে ওর বউ হবে বলে আর্তনাদ, কে ঠেকাবে?
হারাধনের চোখে কিছু এড়ায় না। সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, একটা নৌকা রওনা দিয়েছে গফরগাঁওয়ের ঘাট থেকে। শীতলক্ষ্যার জল থইথই করছে কার্তিকের বাতাসে। শীতকাঁটা দিচ্ছে শরীর। মাঝে মাঝে সকালের নরম রোদ নদীর জলে ঝিকমিক করে উঠলেও শরীরে উষ্ণতার জোগান দিতে পারছে না। বেলা যত বাড়বে তত রোদে তপ্ত হবে চারপাশ; তত শরীর সুখ পাবে।
হারাধন আকুল চোখে নৌকাটার দিকে তাকিয়ে থাকে। এতে করেই ওদের খুকি ওপারে গিয়েছিল স্বামীর ঘর করবে বলে। বেশ ক-বছর ওদের সংসার ছিল শীতের সকালের রোদের মতোই উষ্ণ ও সরল। যেদিকে এলিয়ে পড়ত সেদিকটাই সঙ্গে সঙ্গে উজ্জ্বল হয়ে উঠত। মোহরেণু ছড়িয়ে পড়ত পুরো চত্বরজুড়ে।
লক্ষ্মী-নিত্যচরণের প্রাণের ঢেউ আছড়ে পড়ত এপারেও। শনশন হিমেল বাতাসের ভেতরও ওরা চকমকি পাথর হয়ে জ্বলত। হারাধন আর শোভা সুখের সেই ওম নিয়ে প্রশান্তি ও তৃপ্তির ঘুম যেত যখন-তখন।
পাড়া-প্রতিবেশীরা তাজ্জব হয়ে দেখত, হারাধনের ভাগ্য কোত্থেকে কোথায় নিয়ে চলেছে ওকে। এক মুদিদোকান দিয়ে কীভাবে ভাগ্য ফিরে গেল ওর; এর ওপর একমাত্র মেয়ের এমন সুখ-উপচানো বিবাহ; জ্ঞাতি ভাইবোনদের সবার চোখে ঈর্ষার কাজল। তাতেই হারাধন-শোভার সুখ বাড়ে। অকারণে নিজেদের রাজা-রানি ভাবতে ভালো লাগে। গায়ে পড়ে সবার সঙ্গে গল্প-গুজবে মেতে থাকতে ইচ্ছে করে। বিপদে-আপদে সবাইকে কোঁচড় ভরে মুড়ি-মুড়কি বিলাতে চায় মন। কেউ রিক্ত হয়ে কান্নাকাটি করলে দু-চারশো টাকাও গুঁজে দেয় ওরা। এ এক আনন্দ আর ঈর্ষা জাগানোর সময় ওদের জীবনে। বুকের ভেতর লক্ষ্মীপুজোর নিখুঁত সরা বানানোর তৃপ্তি। আহ!
হারাধন তাকিয়ে রইল নদীর দিকে। নৌকাটা ঘাট ছেড়ে আসতে শুরু করেছে। সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে লক্ষ্মী আর নিত্যচরণ ভেসে ভেসে আসছে ওর দিকে।
কন্যার আকুল দুটো চোখ ডাকছে , ‘বাবা, আমি আইসা পড়ছি। আর কয়েকটা মিনিট।’ সূর্যের দশ ব্যাটারির টর্চটা মেয়েটার মুখের ওপর। এপার থেকেও স্পষ্ট সে ঠাহর করতে পারে। লক্ষ্মীর চোখের মণিতে ছায়া ফেলছে ওর বাপের বাড়ি। ওর আদরের ডালিম গাছটায় ফুল ফুটেছে। পোষা বেড়ালটার বাচ্চা হয়েছে চারখানা। বাড়িজুড়ে সারাদিন মা আর বাচ্চাদের সম্মিলিত মিউমিউ। সে সেখান থেকে দুটো বাচ্চা শ্বশুরবাড়ি নেবে – এই তার বায়না। বাপের হাতের একটা মাটির ব্যাংক শ্বশুরবাড়ির খাটের নিচে লুকিয়ে রাখবে আর নিত্যচরণের কাছ থেকে পকেট-কাটা পয়সা জমাবে সবার অগোচরে – এটাও একটা খায়েশ ওর। নিমের ডাল কখানা দরকার – নিত্যচরণের দাঁতন। তারপর নারকেলের নাড়ু আর মুড়ির মোয়া তো থাকবেই।
বিয়ের ক-বছর তো লক্ষ্মী এরকম মিষ্টি সব বায়না দিয়ে ভরিয়ে রাখত ওদের। কলকল করে শ্বশুরবাড়ির গল্প ঝরত মেয়েটার মুখ থেকে। দেবরটা বউদির জন্য গরম গরম নিমকি-ভাজা কিনে নিয়ে আসে বাজার থেকে – শ্বশুর ওর রান্না করা মুগের ডালের বড় ভক্ত – একমাত্র বিবাহিত ননদ-বউদির কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা – বউয়ের চেহারা কালো হবে ভেবে শাশুড়ি রান্নাঘরে ঢুকতে দেয় না – এরকম একশ আটটা সুখের গল্প দিয়ে রচিত লক্ষ্মী-নিত্যচরণের সংসার।
সেই সংসারের নৌকাটা এখন ভাসছে মাঝ-গাঙে এসে। নদীর যা চরিত্র – একটু পরপরই পালটায়। শীতে এক, বর্ষায় উলটো। যে-নদীর শীতল জলে রোদ ঝলকে উঠলে উষ্ণ ভালোবাসায় মনে ভরে উঠত, সেই নদী বর্ষায় এসে হুংকার ছেড়ে একের পর এক পাড় ভেঙে জানান দেয়, সে কত শক্তিশালী।
হারাধন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেও মাঝে মাঝে খেই হারিয়ে ফেলে। মরীচিকার মতো এই আছে তো এই নেই। সহসা নৌকার ছইটা সে দেখে আনন্দে গদগদ হয়ে ওঠে। ওই তো লক্ষ্মী হাসছে; পাশে নিত্যচরণ। গাঙ হাসে, রোদ হাসে আর সেই সঙ্গে লক্ষ্মী।
‘এ্যাই, তুমি একলা এইখানে দাঁড়ায়া কী করো? চলো, বাড়ি চলো।’ শোভা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে দাঁড়ায় হারাধনের পাশে। ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে স্বামীকে ঘরে না পেয়ে ছুটে আসে এখানে। রাতের বেলায় কখন যে হারাধন শ্মশানে চলে গেছে, টেরই পায়নি শোভা।
‘ওই যে লক্ষ্মী আয়ে। দেহ না ?’ চোখ কুঁচকে তাকায় স্ত্রীর দিকে।
‘আইলে লক্ষ্মী বাড়ি চিনে। অহন চলো।’ ওকে টেনে নিয়ে নিয়ে যেতে চায় বাড়ির দিকে। শোভার চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছে।
‘আইয়া পড়ছে তো। ওই দেহ তাই হাত নাড়াইতাছে। কতদিন পর আইবো। আমি বুজি ঘরে বইয়া থাহুম?’
‘চলো না। গামছা পইরা খালি গায়ে দাঁড়ায়া আছ। জ্বরজারি আইবো ত?’
‘দেহ, নিত্যচরণ পোলাডার ভাবগতিক বালা মনে অয় না। আতকা ধইরা হে চাকরি ছাইড়া ঘরবৈঠা অইল কেরে?’
‘জানি না। অহন তুমি চলো ঘরে।’
‘চুপ করো। তুমিই নাডের গোড়া। তুমি তাইরে ঠেইলা-ঠেইলা হউর বাড়ি পাডাইছ। তাই যাইতে চায় না, তবু। এইবার আইলে আর কুনদিন ওই যমের ঘরে পাডামু না।’ আদুরে গলায় অনুযোগের সুর পিতার।
‘পাডাইয়ো না। আগলাইয়া রাইখো। কিন্তুক খুকিরে কই পাইবা গো লক্ষ্মীর বাপ? তাই যে ফাঁকি দিয়া গেছে গা।’ বলে হো-হো করে কেঁদে ওঠে শোভা। চোখের সামনে সুবর্ণঅঙ্গের লক্ষ্মীর পোড়ামুখ ভাসে।
মেয়েটা অনেকদিন নাইওর আসে না; কোনো খবর নেই। নিত্যচরণকে মোবাইল করলে একই উত্তর, ‘একটা পচা মাল গছাইছেন। আবার অত খবর লওনের কি আছে?’
‘বাবা, মাইয়াডারে একবার পাডাও। কতদিন দেহি না।’ ককিয়ে ওঠে হারাধন।
‘অত কুয়ারা করণ লাগদ না। ঘর তুলনের দুই লাখ ট্যাকা ফেলান। হেরফরে সব কতা।’ একসময়ের মিষ্টভাষী বিনয়ী সদাহাস্যময় জামাতা নিত্যচরণের কর্কশ ও নির্দয় উচ্চারণ।
‘বাবা রে, আমি অত ট্যাকা পামু কই? মুদিদোকানটা বেইচা কয় ট্যাকা পামু আর?’
‘জমি বেচেন।’
‘বিয়াত তো সব শেষ। অহন হুদা ভিডাডা।’
‘মাইয়ারে পাইতে চাইলে ভিডা বেচেন। ভিডা দা কিতা করবেন?’
‘একটু দয়া করো, বাবা।’
‘কুনু দয়া নাই। বহুত দয়া করছি। পচা মালের ওপর দয়া চলে না।’
মোবাইলের লাইনটা কেটে দিলো। সে-রাতেই সবার চোখ এড়িয়ে খুকি চলে এলো এপারে। দরজায় টকটক শব্দ। খুলতেই আলুথালু পাগলপ্রায় লক্ষ্মী।
‘মা, একটু জল।’ মুখে জল তুলে দেয় উদ্ভ্রান্ত-হতচকিত ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন মা-বাবা। গভীর রাতে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে মাঝির হাত-পা ধরে চলে এসেছে শেষ আশ্রয় মা-বাবার কাছে। যদি বাঁচতে পারে, এই আশায়।
‘আমি আর যামু না, মা। হেরা আমারে মাইরা ফেলাইবো।’ বলে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে খুকি। বুকভাঙা সেই কান্না নিশুতিরাত খানখান করে দেয় নিমিষে। কুমোরপাড়ার রংবিলাসী অকর্মণ্য-অপদার্থ জ্ঞাতিগোষ্ঠী একে একে জড়ো হয়। বহুদিন পর হারাধনের আঙিনায় বায়োস্কোপ দেখানো হচ্ছে; সবাই তা-ই দেখতে এসেছে মুখে
আহা-উহু আর চোখভরা টলোমলো জলের শোভা দেখাতে।
‘আমি তর জামাইর দাবি মিটাইয়া দিমু রে, মা। কডা দিন সময় দে।’
‘ট্যাকা দিলেও হে আমারে বাঁচতে দিত না। আমার পেডের বাইচ্চাডারেও হে… মা, আমি যামু না। আমি যামু না, বাবা।’ গলা ছেড়ে কেঁদে ওঠে লক্ষ্মী। পাশেই ওর একসময়কার পোষা বেড়ালটা মার্বেলচোখে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। একটা পেঁচা ডেকে ওঠে নারকেলগাছের চিরল পাতার ফাঁক থেকে। সঙ্গে সঙ্গে বাদুড় ডানা ঝাপটায় গয়াম গাছের মগডালে। দু-চারটা পাকা পেয়ারা ঝরে পড়ে টিনের চালে। সেই শব্দ লক্ষ্মীর কান্নাকে আরো তীব্র ও মর্মবিদারী করে তোলে।
তবু সেই রাতেই খুকিকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দেয় শোভা। খুকি ছোট্ট শিশুর মতো কেঁদে কেঁদে যত বলে ‘মা, আমি যামু না’ তত শোভা বোঝায়, ‘এরহম করিছ না, মা। স্বামীর ঘরই মাইয়াগো আসল ঘর। তুই যা গা। দেহিছ, একদিন হের মন ফিরবই তর দিকে। পুরুষের মাথা হগ্গল সময় ঠিক থাহে না।’
‘মা, মা গো।’
‘যাহ্, ফিইরা যা।’ শোভা আঁচলে চোখ মুছে মেয়েকে ফিরে যেতে বলে শ্বশুরবাড়ি।
গভীর রাতে মাঝিকে ঘুম থেকে জাগিয়ে খুকিকে হারাধন তুলে দেয় ছইওলা নৌকায়। সে ভাসতে ভাসতে ওপারে চলে যায়। ঘুটঘুটে সেই আঁধার-রাতের সাক্ষী থাকে শ্মশানে জেগে থাকা গঞ্জিকাসেবী এক সাধু, ভুতুড়ে সব গাছপালা, মুখ লুকানো কিছু নিশাচর-উভচর-জলচর, কজন ঈর্ষাকাতর জ্ঞাতি-স্বজন আর মহাশূন্যে পিটপিট করা ইঁদুরচোখের মতো ঝুলে থাকা হাজার তারা।
এর এক সপ্তাহের ভেতর গভীর রাতে ফের দরজায় খটখট। খুলে দিতেই দ্রিম করে মেঝের ওপর পড়ে গেল খুকি। ঠোঁটের কষ বেয়ে ঝরছে সফেদ গ্যাঁজলা।
‘মা, পেডের বাইচ্চাডারে আমি মারতে চাই না বইলা হেরা আমার মুহে জোর কইরা বিষ ঢালছে। ওয়াক্, ওয়াক্। আমারে মাফ কইরো। আর কুনদিন তুমরার অবাধ্য অইয়া বিয়া করুম না। হাছা কইতাছি। বিশ্বাস করো।’ একসঙ্গে একনিশ্বাসে এতগুলো কথা বলতে বলতে চোখ উলটে যায় খুকির। হাসপাতালে নেওয়ার আগেই সব শেষ।
সেই খোয়া-যাওয়া খুকিকে বুকে ফিরে পেতে বারবার গাঙপাড়ে ফিরে আসে হারাধন। মেয়েটাকে দেখার জন্যে রাতভর সে শ্মশানের সাধুর কাছে বসে গাঁজায় দম লাগায় আর ভোর হতে না হতেই এখানে এসে অপেক্ষা করে খুকির জন্য। কিছুতেই সে বিশ্বাস করতে চায় না, আদরের লক্ষ্মী আর নেই।
গাঙপাড়ের উতল হাওয়া ভাসমান সেই কষ্টগুলোকে উড়িয়ে নিয়ে চলে এ-মাথা থেকে ও-মাথায়। হয়তো এ-দুঃখগাথার অশ্রম্নবিন্দুগুলো বাষ্প হয়ে চলে যায় ওপারে। তিন মাস জেল খাটার পর প্রমাণের অভাবে যে নিত্যচরণ বেরিয়ে এসে ধুমধামের সঙ্গে আরেকটা বিয়ে করেছে, এ দুঃখবাষ্প ওর মাথার ওপর দিয়ে ভেসে বেড়ালেও মোটেই ওকে স্পর্শ করতে পারে না। কারণ, ওর মুখজুড়ে রয়েছে ক্রূর-করাল এক হাসির রেখা; আর এ-হাসি যারা হাসে, হারাধন ভাবে, এরা মানুষ নয়, মানুষের কোনো দুঃখ এদের স্পর্শ করে না!
শোভা ফ্যালফ্যাল করে অসহায় স্বামীর অপারগতাকে লক্ষ করে। বিপন্ন, বিপর্যস্ত, দুঃখভেজা স্বামীর পাটকাঠি দেহখানা ঠান্ডা হাওয়ায় ঠকঠক করে কাঁপছে। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না সে; গায়ের সমস্ত শক্তি গলায় জড়ো করে আধাপাগল ছন্নছাড়া হারাধনের উদ্দেশে আর্তনাদ করে ওঠে, ‘আমরার লক্ষ্মী নাই গো। তুমি তাইর শ্বশুরবাড়ির ঘর তুলনের ট্যাকা দিতে পার নাই বইল্যা তাইর পাঁচ মাসের বাইচ্চাডাসহ জোর কইরা মুহে বিষ ঢাইল্যা মাইরা ফেলাইছে। তুমার লক্ষ্মী ছমাস আগেই নাই। চলো। নদীর দিকে চাইয়া থাকলে তাই ফিইরা আইত না গো। আমরার লক্ষ্মী আর ফিরত না।’ বলে শোভা স্বামীকে শরীরের সমস্ত উত্তাপ দিয়ে জড়িয়ে ধরে।
তবু হারাধনের দৃষ্টি ভাবলেশহীন; কোনো কথাই আর ওর কানে ঢুকছে না। এসময় ফের ওর কানে আসে সেই খচখচ-ফরফর শব্দ। চট করে সে ফিরে তাকায় বটগাছটার দিকে। কী ভেবে নুয়ে গুঁড়িটা পরখ করতে থাকে। সহসা একটা খোড়লের ভেতরে চোখ গেল ওর। হারাধন মাটিতে হামাগুড়ি দিয়ে গর্তটায় দৃষ্টির টর্চ ফেলে রাখে কিছুক্ষণ। একসময় হাত ঢুকিয়ে একটি বেড়াল বের করে এনে পাগলের মতো হো হো করে সে হেসে ওঠে আপন আনন্দে, ‘লক্ষ্মী, তুই এইখানে? আর আমি তর লাইগা গফরগাঁর গোদারাঘাটের দিকে ভোরবেলা থেইক্যা চাইয়া রইছি? আয় মা; বুকে আয় মা। আর তরে যমের ঘরে যাইতে দিমু না। আয় মা।’ বলে পরম মমতায় দুহাত দিয়ে খুকির পোষা বেড়ালটাকে চেপে ধরে বুকের সঙ্গে। ওম পেয়ে সে ক্ষণে ক্ষণে মিউ বলে সোহাগ ছড়ায়।
শোভা বুঝতে পারে না, এই সাতসকালে বেড়ালটা বাড়ি ছেড়ে কীভাবে এখানে এসে পৌঁছাল। শেষবার যখন খুকিকে গভীর রাতে নৌকায় তুলে দিয়েছিল তখনো এ-বেড়ালটা লক্ষ্মীর পিছু নিয়ে খেয়াঘাট পর্যন্ত চলে এসেছিল।
সেই পোষা বেড়ালটাই এখন লক্ষ্মী সেজে ওম নিচ্ছে হারাধনের বুকে। শোভা কান্না থামিয়ে ভেজা গলায় বলে, ‘তুমার লক্ষ্মীরে পাইছ তো? এইবার ঘরে চলো। চলো না?’ বলে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে পা বাড়ায় সামনের দিকে।