এখনো কি পাঁচিল তুলছ?
তুমি বলেছিলে,
বাড়িতে পাঁচিল নেই তো সম্মানও নেই। পাড়ার লোকজন হেলাফেলা করে। ফালটুস ভাবে। এই তো সেদিন নীলুদা ঢুকে পড়ল। বলল, আমার গাড়িটা খোলা জায়গায় রাখলাম। লক্ষ রাখিস। চ্যাংড়াগুলো নতুন গাড়ি আঁচড়ে দেয়। হিংসে। ওদের গাড়ি নেই, তাই হিংসে। পাথর ঘষে গাড়ির গায়ে নাম লেখে। নোংরা শব্দ লেখে, ছবি আঁকে। যেন পাবলিক পেচ্ছাবখানা বা শ্মশানের দেয়াল। খেয়াল রাখিস!
বলেছিলে,
তুমিই বলো, ঘরের কাজ করব, না অন্যের গাড়ি পাহারা দেব? ওই যে বলল ‘খোলা জায়গা’, অমনি অমনি বলেনি। খোলা জায়গাটা কাদের? তা তো বলল না। বলতে পারত, তোদের বাড়ির খোলা জায়গা। সেটা বলেনি। যেন বেওয়ারিশ জমি। আবার বলল, আমার গাড়ি। পাহারা দিতে বলল। এভাবে ওরা গরিবকে অপমান করে। আমাদের ঘরবাড়ি-জমি যেন থাকতে নেই। বলতে পারত, তোদের উঠোনে রাখব? রাখার আগে বলার ভদ্রতা। সেটা বলল না। আমরা যে ফালটুস। নীলুদারা মানী লোক। কোনোদিন হয়তো বলবে, এখন থেকে গাড়িটা এখানেই থাকবে। নোংরা করিস না। এদিকে নোংরা ফেলিস না।
বলেছিলে, পাঁচিল হলে, মান হয়। পাঁচিল বাড়লে, মান বাড়ে। এই তো সেদিন, সুখুর দলবল দুপুরবেলা জুয়া খেলতে এল। বলা নেই কওয়া নেই গাছতলায় বসে পড়ল। আমি কি ওদের সঙ্গে পারি? বলে কিনা এটা যে তোমাদের জমি, তোমাদের গাছ, কোনো প্রমাণ আছে? কাগজ আছে? ডকুমেন্ট আছে? আসল ডকুমেন্ট জাল হয়ে যাবে বেশি তেড়িবেড়ি করলে। জানিস তো, আমাদের মিউনিসিপ্যালিটি, আমাদের সরকার। আমরা যা বলি সেটাই আসল। একখান সাক্ষী পাবি না। তোদের পেছুতে লাগতে যাব না। চুপচাপ খেলব, চলে যাব। কে যেন বলল, সরকারের ঘরে হাজার হাজার পোষা ইঁদুর। পুলিশের ভুঁড়ির মত মোটকা। বাড়িতে ঢুকিয়ে দিলে পালিয়ে কূল পাবি না।
তুমি বলেছিলে,
ওরা হা-হা হাসলে আকাশ কা-কা ডাকে ভরে যায়।
এখনো পাঁচিল গাঁথছ, বুঝি?
বলেছিলে,
প্রথমে ছোট পাঁচিল দেওয়ার কাজ শুরু করলাম। মাটি থেকে এই দু-ফুট আর কী! টাকা কোথায়, উঁচু করব যে? জমা টাকা ভাঙলে খাব কী? তার ওপর রোজ সুদ কমছে। জিনিসের দাম বাড়ছে, সুদ মারছে, বেকার বাড়ছে। তো, অনাথবাবু, আমাদের গ্রামদেশের বুদ্ধিজীবী, অনাথ দাস, বললেন কিনা, তোদের যে পয়সা নেই, সেটা বুঝতে দিবি কেন? তোর স্বামীটা কাজ করে না। সবাই জানে। দুটো কাজ পাইয়ে দিলাম। গেল না। ঘরে বসে খাবে। তোর ঘাড়ে চেপে খাবে। অন্যভাবে ধরিস না, কী শরীর নিয়ে বউ হয়ে এলি। দুবছর না ঘুরতেই কী হাল! দেখ, আমি তোর গুরুজন। নজরে সব পড়ে। স্পষ্ট কথায় কষ্ট নেই। সোজা মানুষ বাঁকা চল জানে না। সুবলের ঘরে কি তোকে মানায়? নিজেকে জিজ্ঞাসা কর। ঘরে ছাদ দিয়েছিল সুবলের বাপ। দেখভাল, মেরামতি না হলে জল তো পড়বেই। ভাঙা দেয়ালে সাপের বাসা হয়। রাতের অন্ধকারে বা দুপুরে বন্ধঘরে আলগা শরীরে ঘুমোস, সাপে কামড়ালে কী হবে? কাছের হাসপাতাল সাত মাইল। নিয়ে যেতে যেতে মুখে ফেনা তুলে ঢলে পড়বি। আর তোর কোলের বাচ্চাটা আমার মত অ না থ হবে। অন্যভাবে ধরিস না, ভাঙা শরীরেও সাপের বাসা হয়। দেখভাল লাগে। মেরামতি লাগে। তোর স্বামী তো খালি ওষুধ খায় আর ঘুমায়। জাগা থাকলেও ঘুমায়। কেমন যেন মড়া মানুষের মতন। রাগ করিস না। আমি তোর গুরুজন। কষ্ট হয় তাই বললাম। সুবলের কোনো উন্নতির আশা আছে? ডাক্তার কী বলে? বরাবরই রোগা। কাজের কথা শুনেই হাঁফায়। তার ওপর মাথার ব্যামো। ওর বাপ দুঃখ করত। একটা মাত্র সন্তান। বিয়োনোর দু-আড়াই মাস বাদে বউ গেল মরে। কত দুঃখ-যন্ত্রণা, আদরে-আহ্লাদে মানুষ করলাম। ধরল মাথার রগের অসুখে। ওর মায়ের ছিল। কী হবে। কে দেখবে। সুবলের বাপকে বোঝাতাম, তোমার যা সাধ্য করেছ। এবার ঠাকুর দেখবেন। জীব দিলেন যিনি, দেখার মালিক তিনি। তুই যখন এলি, বুঝলাম, ঠাকুর পাঠালেন। আমি তোর গুরুজন। সোজা মানুষ বাঁকা চল জানে না। সুবলের পাশে তোকে মানায়? গ্রামের লোকজনকে জিজ্ঞাসা কর। তোর বন্ধুদের জিজ্ঞাসা কর। মরা খাতে জল ডাকলে নদীর সাধ্য কী? বান হবেই। জল নষ্ট হবেই। নতুন মেয়ে নতুন শরীর নিয়ে প্রথম পুরুষের কাছে এসে খাটের গায়ে খোদাই-করা লতাপাতায় আঙুল বুলোবে সারারাত, রাতভর? শোন, মেয়েদের ব্যাপার কিছুটা বুঝি। বয়স তো হলো। একটা বাচ্চা হয়ে যাওয়া কোনো প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হল, ওষুধ খেয়ে বর ঘুমায়, আর বউ রাত জাগে। প্রশ্ন হলো, বর নাক ডাকে, আর বউয়ের শরীর চুপে-চুপে ডাকে। শোনো, আমি তোমার গুরুজন। উঁচু করে পাঁচিল দাও। সব জিনিসের ব্যবহার লাগে। টাকা লাগে দেব। পরে শোধ দিয়ো। না দিলে না দিয়ো।
ঝুমি, কয়েকটা কথা ছিল। আমার, তোমার, আমাদের। যেসব কথা একা একা বয়ে বেড়াই। শুনবে, ঝুমি?
বলেছিলে,
তোমাদের শহরে অনাথ দাস অগুনতি আছে। খবরে দেখি, বস্তা বস্তা অনাথ মেয়েছেলে নিয়ে ফুর্তি করে। ঘরে তাদের বউবাচ্চা উঁচু পাঁচিলের গার্ডে থাকে। তো, অনাথ দাস সেই বুদ্ধি দিলো। উঁচু পাঁচিলের বুদ্ধি। প্রথমে ঠিক করেছিলাম, গাছপালা দিয়ে বাড়ির সীমানা ঘিরে দেব। যাকে বলে বাউন্ডারি। গাছ কত ভালো। সবদিকে উপকারী। গাছ থাকলে পাখি আসে। পাখি গান গায়। পাখি দেখলে মন ভালো হয়, জীবন সরল হয়। আকাশ কাছে আসে। পাখি দেখলে স্কুলে হারানো খাতাটা যেন ফিরে পাই। কুয়োতলায় বাবার স্নান করার শব্দ পাই যেন। মায়ের বকুনি ভেসে আসে ঝিমসন্ধ্যায়। জানি, জমি তো বিবাদের জন্মঘর চিরকাল। ঘিরে রাখতে হয়। সেবার মিন্টুদের ক্লাব আমাদের জায়গায় পিকনিক করবে বলে জানাল। ওদের জানানো মানে হুকুম। করব তো করব। এতে কোনো দু-কথা নেই। আমি ওদের সঙ্গে পারি কি? তবু বললাম, ওই ডিসকো জকি বাজালে আমার মাথা ঘোরায়, বমি হয়। বাচ্চাটা ভয় পায়। আর, আমার হাজব্যান্ড, জানোই তো, ওষুধ খেয়ে ঘুমায়। ডাক্তার বলেছে, বেশি করে ঘুমাতে হবে। না হলে মাথার রগ ছিঁড়ে যেতে পারে।
বলেছিলে,
শুনে মিন্টুর দল খ্যা-খ্যা করে হাসল। বাতাস কা-কা ডাকে ভরে গেল।
বলেছিলে,
কে যেন বলল, পেছনে ডিসকো জকি ভরে দেব যে, এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা লাফাবে। রাতভর বউকে দাপাবে। বুঝলাম, সীমানা মানে সীমানা। ওটা শক্ত করে বাঁধতে হয়। ঢিলে রাখলে বিপদ। খোলা সীমানা, মুক্ত সীমানা এসব মন-রাখা কথা, ইমিটেশন গয়না। গনুদা, পাশের গ্রামের গনুদা, মানুষের উপকারের মানুষ, একটা পা ছোট, লেংচে হাঁটে, তার ওপর ভারী শরীর, লোকজন তো খোরাক পেলেই হলো, আড়ালে বলে ‘ল্যাংড়া গনু’, ‘গনু ল্যাং’, হাঁটা নকল করে দেখায়, রগড়ের হাসি পুকুরপাড়ে কলমি আর বুনোকচুতে লুটোয়। যত ভালো মানুষ তত জ্বালা ওদের, নষ্ট মানুষে সমাদর। তো আমার হাজব্যান্ডকে ডেকে গনুদা বলেছিল, সীমানা ছাড়া রাখিস না। ঢুকে পড়বে। গরু ছাগল মোষ কুকুর। দোকান বসিয়ে দেবে একটা পতাকা ঝুলিয়ে। যেমন করে হোক বেড়া দে। যেমন-তেমন হোক। বেড়া দে। অনাথ দাসের কাঠের ব্যবসায় ঘুণ লেগেছে। মড়ার কাঠের ব্যবসা খুলবে। তোদের বাড়িতে গুদাম বানাবে।
ঝুমি, এসব কথা আজ যদি না শুনি, যদি না শুনতে চাই, রাগ করবে? আমাদের কটা দিন, মাত্র কটা দিন হাজার হাজার বছর জুড়ে আছে। সেসব দিনের কথা বলতে ইচ্ছে করছে, শুনতে ইচ্ছে করছে। কালবৈশাখি থেমে গেলে আকাশ আলোয় ফুটল, মাঠের একধারে এক আঁজলা জমা জলে রোদের রং লাগল। তুমি ডাকলে আমার নাম ধরে। সেই প্রথম আমার নাম থেকে তোমার ডাকে দাদা খসে গেল, ঝুমঝুমি। ঠিক তার আগের না-ফুরোনো বিকেলের কাঁপা কাঁপা আবছায়ায় ‘তুই’ থেকে ‘তুমি’তে এলাম তোমার ঘেমে-যাওয়া গাল-কপালের নিকট সম্বোধনে, ঝু-মি।
বলেছিলে, অনাথ দাসের মতলব শুনে হাত-পা অবশ হয়ে গেল। তিনি গ্রামদেশের বুদ্ধিজীবী। আমি কি ওনার সঙ্গে পারি? আমার হাজব্যান্ড খালি ওষুধ খায় আর ঘুমোয়। নিসেত্মজ। জাগলেই চেঁচামেচি করে। আমাকে বলে ‘ছাগল’। আমি চলে গেলে বেচারা মরে যাবে। কাকে বলি? কার সঙ্গে পরামর্শ করি? উঁচু পাঁচিলের বুদ্ধির পেছনে শ্মশানের কাঠের গুদামের ছক থাকতে পারে। অনাথ দাসের কাছ থেকে টাকা নেওয়া যাবে না। লোকটা সেদিনও দাঁড়িয়ে বলল, উঁচু কর, পাঁচিল উঁচু কর। বাইরে থেকে তোদের ঘরের দাওয়া দেখা যাবে না। ঘরের ভেতর দেখা যাবে না। সরলতাজা মেয়ে, জিয়লমাছের খেলা শরীর জুড়ে, প্রেম-ট্রেম তো আসেই। শাড়ি-জামা অসাব্যস্ত হতেই পারে। সেটাই স্বাভাবিক। আমি গুরুজন। সোজা মানুষ বাঁকা চল জানে না। যা বুঝি, স্পষ্ট করে বলি। পাঁচিল উঁচু কর। টাকা দেব। শোধ পারলে দিয়ো, না পারলে কথা নেই। অন্যভাবে দিতে পারো। কতকাল বেহুলা হয়ে ভাসবে? ঝুমঝুমি, এরকম দুষ্টু নষ্ট মানুষের কথায় খবর ভরে থাকে। সবাই জানি। আজ যা শুধু আমরাই জানি, সে দুটো কথা কি বলবে না, শুনবে না? এক আকাশ গন্ধরাজের পাশে দাঁড়িয়ে তুমি প্রদীপ জ্বালছিলে। চিনিদিদিমা দাঁড়িয়ে ছিলেন। বললেন, হাত দেখেছিস ঝুমঝুমির। মাজাঘষা পেতলের মতো। ঝলমল করে। তুমি আমার দিকে তাকালে। আমি কিছু বলি কিনা বুঝতে। তোমার চোখের তারায় প্রদীপের শিখা। পাশে এক আকাশ গন্ধরাজ। চিনিদিদিমার সাদা শাড়িতে সাঁঝবেলায় জমা হতে থাকা মুখরবেলার মৌনতা। ঝুমি, তোমার হাতের দিকে তাকিয়েছিলাম।
বলেছিলে,
অনাথ দাসের কাঠের গোলাটা আমাদের বাড়ির রাস্তার মুখে। দিনভর কাঠ চেরাইয়ের শব্দ আসত। গন্ধ আসত। একদিন বলল, আমার গোলা থেকে চিরুল আনতে পারিস তো। চিরুল মানে ফিনফিনে ঘষা কাঠ, যা পাকিয়ে থাকে, কোঁকড়া চুলের মতো। সত্মূপ করে রাখা গোলার এক কোণে। অনাথ দাস বলল, গ্যাসে রাঁধিস কেন? ওতে ক্যান্সার হয়। চিরুল পুড়িয়ে রাঁধ। স্বাদে ভালো, স্বাস্থ্যেও ভাল। গাঁটিকচু পাঁঠার মাংসের মতো লাগে। নিয়ে আসিস গোলা থেকে। আমি যখন থাকব, আসিস। গ্যাসের খরচ বেঁচে যাবে। পাঁচিলের টাকা নিবি তো? লজ্জা কিসের? আমি তোর গুরুজন। শোধ পারলে দিবি। না পারলে অন্যকিছু। মুখ ফুটে কী বলি। সেই অনাথ দাস খুন হয়ে গেল। গাছের কারবার নিয়ে। চোরাই কাঠের কেস। যেখানে-সেখানে গাছ কেটে গোলায় চালান। সব জানে পুলিশ ও বুদ্ধিজীবীরা। গাছ মরেছে দলে দলে। পুলিশ পয়সা খায় যুগে যুগে। তো, যারা ওকে গাছ কেটে এনে দিত, তারা এতদিন যে বুদ্ধিজীবীতে ছিল, সেটা ছেড়ে অন্য বুদ্ধিজীবীতে গেল। তারাই ঝেড়ে দিলো। চেরাকাঠের গন্ধ আর অনাথ দাসের রক্তের গন্ধে কয়েকদিন থানা-পুলিশের গন্ধ খুব মিশে ছিল। এবার ঠিক করলাম, উঁচু পাঁচিল দিতেই হবে। জমা টাকা ভেঙে পাঁচিল উঁচু করতে হবে। অনাথ দাসের আত্মার স্মৃতি ধরে অন্য বুদ্ধিজীবীরা ঢুকে পড়তে পারে। আমার হাজব্যান্ড তো নিসেত্মজ। ঝগড়া করতে পারে না। হাঁফায়। ওষুধ খায় আর ঘুমায়।
ঝুমি, অন্ধকারে মাঠ পেরোনোর প্রস্তাবটা তুমিই দিলে। আমার আপত্তি ছিল। নির্জনে অন্ধকারে তোমার সঙ্গে। চিনিদিদিমা রাগ করবেন। লোকে কী বলবে। তুমি শুনলে না। জেদ করে বললে মাঠ ভেঙে গেলে পাঁচ মিনিট। ঘুরে গেলে পনেরো মিনিট। কেন খামোকা ঘুরতে যাব। মনে পাপ না থাকলে ভয় কীসের? ভয় এলো সাপ হয়ে। দু-তিন হাত দূর দিয়ে যাচ্ছিল। তোমার চোখে পড়ল। আমার হাত ধরে টানলে। আমাকে থামালে। আমার মুখ চাপা দিলে। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। তোমার উষ্ণ দুধের বাটিতে আমার হাত লেগে আছে। সাপটা চলে যাচ্ছে। তোমার বুকের তাপ আমার শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে বাষ্প হয়ে। কোনোদিন তো জানি না এত তাপ এত ভাপ। আমার তলপেট থরথর করে উঠেছিল অদ্ভুত ব্যথায়। তোমাকে জড়িয়ে ধরেছি। বাধা দাওনি। তারপর কান্না এলো কেন? তোমার হাত অনেক অনেকক্ষণ ধরে, সেই অন্ধকারে, শুধু ঘষেছি কেন? আদরে নয়, আমার পাপ মুছে ফেলার জন্য, ঝুমি। তোমার হাতে লেগে থাকা আমার পাপ। তোমার সারা শরীরে লেগে থাকা আমার পাপ। শরীর তো মুছিয়ে দিতে পারি না। শুধু হাতে-হাতে ঘষি। আজো ঘষি। একা একা। জানো। তোমাকে বলতে পারিনি। তোমাকে চাই। বিয়ে হয়ে গেল তোমার। তুমিও তো চাওনি।
বলেছিলে, আমার হাজব্যান্ড খুব ভালো। আমাকে চোখ বুজে বিশ্বাস করে। শুধু যে আমাকে করে, তা নয়। সবাইকেই করে। বাজারের লোক ওকে ঠকায়। তিন নম্বর ইট দিয়ে এক নম্বরের দাম নেয়। নদীর বালি দেয় খাদের বালির দামে। পাঁচিলের জোর হবে কী। সিমেন্টের দামও বাজারছাড়া। কী বলব, লোক খাটাতেও পারে না। গাছতলায় বসে এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে, দু-চার কথা বলতে-বলতে ঘুমিয়ে পড়ে। ওষুধের সাইডএফেক্ট। মাথার রগ ঠান্ডা রাখতে শরীরের সব রগ অচল করে দেয়। আমাকেই সব করতে হয়। জমির দাগ দেখতে হয়। ভিতের গর্ত মাপতে হয়। মিস্ত্রিরা খালি চা আর বিড়ি খাবে ঘণ্টায়-ঘণ্টায়। কিছু বললে উলটো শুনিয়ে দেবে। গোলাঅলার কাছে ধার পড়েছে। মাল দেবে না বলে দিয়েছে। কী করি? বালা বন্ধক দিয়ে টাকা আনলাম।
ঝুমি, নিজের পায়ে দাঁড়াবে বলেছ। কাজ করবে। সব কাজেই মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে। কেন পারবে না? ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে পড়াবে। আমাদের দোতলার বারান্দায় সারা দুপুর ছড়া মুখস্থ করত শিশুরা। মনে আছে ঝুমি? ছবির বই এনে দিতে বলেছিলে? বলেছিলে একটা আলপনার বই এনে দিতে, মনে পড়ে? ছাদের সিঁড়ির পাশে বসে আমি দেখতাম। একটি স্বপ্ন-দেখা মেয়ের পাশে থেকেছি। তুমি গান গাইতে বললে কখনো ‘না’ বলিনি। জানতে ছেলেটা একা একা গান গায়। বুঝেছিলেন চিনিদিদিমা। তুমিও বুঝেছিলে। তাই কি পালালে? মনে হলো একটা পাপ তোমাকে অনুসরণ করছে স্বপ্নের মুখোশে? এসো, আজ একবার এসো, দূর-দূরে একটা-দুটো কথা বলি। দূরের কথা কাছে নিয়ে আসি। ইচ্ছে কি করে?
বলেছিলে,
হাজব্যান্ডের কী দোষ বলো? জানতাম, ও অসুস্থ। ওষুধ খায়, আর ঘুমায়। কাজ করতে পারে না। কাজের নামে ভয় পায়। কেঁদে ফেলে। জেনেই তো এসেছি। আমাকে তোমার মতো ডাকে, ঝু-মিইই। অ্যাই ঝুমি, জল দেবে। ওষুধ দেবে। দুটো বিস্কুট দাও। রাতে খাইয়ে দেবে তো। ঘুমে আমি খেতে পারি না। কখনো ডাকে, ঝুমু। আমার পাশে বসো না একটু। কথা বলো। আবার কখনো, তখন শরীরটা হয়তো খানিক তাজা, হাঁটতে-চলতে ইচ্ছে করছে, বলে, ঝুমঝুমি, দাও না আমি বাজার করে আসি। খুব সরল তো, আমার হাজব্যান্ডকে সবাই ঠকায়। মনামুদি একটা বিড়ি জোর করে খাইয়ে, যোগে পাঁচ টাকা বেশি নেবে, আর বউয়ের গল্প শুনবে। আমি কিছু বললে হাসতে হাসতে বলবে, তুই একটা ছাগল। অ্যাই ছাগল, সারা দুপুর অত খাটিস কেন? এই ঝাঁঝা রোদে? আমার পাশে চুপ করে শুয়ে থাকতে পারিস না? এসব কথা আমার ভালো লাগে। সংসার দেখতে হবে। আরো বড় দায়িত্ব। হাজব্যান্ড একদিন বিছানা ছেড়ে উঠতে পারবে না। মেয়েটা বয়সে যাচ্ছে। দিনকাল ভালো নয়। পাঁচিল উঁচু করতেই হবে। পাঁচিল নয়, বর্ডার। আমি বর্ডার তুলছি। বর্ডারে তারকাঁটা দিতে হবে।
ঝুমঝুমি, আমার বলা কোনো কথা বর্ডার পেরোতে পারে না।