হাড্ডি ঠাটে চামড়ার পাতলা খোসা প্যাঁচানো না থাকলে বুড়োকে কিছুতেই প্রাণী মনে হতো না। কোলবাঁকা এই কাঠামোর চোয়াল চিমসে, মাথায় চুলের নামে আছে উসকোখুসকো আগাছা, দুই চোখের কোয়া ঘোলা, তক্ষকের পেটের মতো খরখরে ছবি মিলিয়ে বুড়োকে ইতর জন্তু বলেও শনাক্ত করা যায়। আশ্চর্য! বুড়োর সামর্থ্যের সব শাঁস ফুরালেও কানে সে কম শোনে না। আশপাশের সাড়াশব্দ, স্বর, কাকলি পরিষ্কার ধরতে পারে। যে-কোনো খসখসানি, খুটখাট, খচরমচর হালকা টুঁ-শব্দ পর্যন্ত তাঁর কান ফসকায় না। এমন বুড়ো দাদাকে নিয়ে নাতি হায়দারের বড়ই মুশকিল। খেতে বসে তরকারি শাক, লতাপাতা, ভাত বলো বিভিন্ন শব্দ হায়দারের মুখ থেকে খসে পড়লে বুড়ো তাঁর অকেজো চোখজোড়া নিয়ে স্থির চেয়ে থাকে, যেন তন্নতন্ন সব সে দেখতে পারছে। ‘কী রে, আমারে যে দিলি না’ বলে, দাদা এমন খিনখিনে স্বর তুলে ঘরভর্তি করে দেয় যে, সে বুঝি বঞ্চিত হওয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে। দেখা গেল, পড়ন্ত বিকেলের মাঠভাঙা বাতাসের ঠান্ডা পেয়ে বারান্দার খুঁটিতে হেলান দিয়ে ঘুমুচ্ছে সে, ফস করে জেগে ওঠে তারস্বরে সে কোলাহল চালু করে দিলো – ‘কারে নিয়ে আইছিস? মাইয়াছেলের পায়ের শব্দ পাই।’ এরপর ফাতেমা হায়দারের সঙ্গে কেমনে আগুয়ান হয়। দৌড়ে মেয়েটা গায়েব হয়ে যায়। বুড়োর নির্ভুল কানে শোনার এই আজব ব্যাপারটা হায়দারের কাছে বড়ই বিস্ময়ের।
ছোট ছেলেটাকে ফেলে একরাতে বুড়োর বিধবা পুতের বউয়ের ঘরের কানাচ ধরে কেটে পড়ার সতর্ক পায়ের শব্দও কান থেকে পিছলে যায়নি। কিন্তু কোনো শব্দই করেনি সে। করবে কেন? জোয়ান বয়সের মাইয়েছেলে নিজের ভবিষ্যৎ ভেবে নিঃস্ব, অতিশয় ভাঙচুর-নষ্ট চালচুলোর সংসারে বাকি জীবন মাটি করবে কোন কারণে? বউটা কেবল চার বছরের ছেলেটাকে দাদার কাছে ফেলে যায়। সেই থেকে দাদার কাছে হায়দার। মায়ের জন্য কেঁদেকেটে আকাশভাঙা সে বন্ধ করে দেয়। বড় হওয়ার পর দাদার মুখে শুনেছে, বাপ তাঁর উত্তরে ধানকাটার মৌসুমে গিয়েছিল বেশ দূরের কাজে। মাসদুই পর গ্রামের অন্য কিষেনেরা তাঁর লাশ বাড়ি পৌঁছে দেয়। বিষয় কী? কী এক আনখা রোগে একরাতে হায়দারের বাপটা মারা গেছে। গৃহস্থ ক্ষতিপূরণের নামে লাশ পৌঁছে দেওয়ার পথখরচ, আরো দুই মণ ধান দান করেছে। বুড়োর শরীরে তখন ভাঙন, একা একা জোর পায়ে আর হাঁটতে পারে না। দুধের বাচ্চা রেখে পুতের বউটা চলে গেলে খুব দ্রম্নতই বুড়োর ভেতরটা আরো ক্ষয় হয়ে যায়। ধীরে ধীরে তাঁর মুঠো থেকে কোদাল-মুগুর খসে পড়তে থাকে। একচিলতে জায়গায় শাক-লতাপাতা, কিছু তরকারি, কখনো লাউগাছ করে তা হাটে হাটে বেচে দুজনের পেট দিব্যি চলে যেত। বুড়োর পায়ের বল যেদিন বারো আনাই পড়ে যায়, হায়দার উত্তরের মাঠে তখন একপাল ছেলেপুলের সঙ্গে ফুটবলে লাথি মারছে। মিনিট বিশ হেঁটে গিয়ে দিললাগি বন্ধুর বাপের দোকানে বাকি না পেয়ে খালি হাতে সে ফিরল, তখন দাদার জন্য তার হুহু করে কান্না শুরু হয়। এই অনাবশ্যক খোলা মানুষটাকে ফেলে শহরে চলে গেলে একটামাত্র পেট ভরতে কোনো না কোনো কাজ সে পেয়ে যেতে পারে। ভাবতেই, হায়দার তার হাতজোড়া ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে। তার আঙুলের গাঁটগুলো এত কালো তো ছিল না। দুহাতের চামড়াই-বা এমন শক্ত হলো কবে! পশ্চিম থেকে ক্রমশ অন্ধকার উঠে এসে যখন পাছগাছালি, ঘর-উঠোন, আকাশ ঢেকে ফেলল, হায়দার প্রাপ্ত ওই অন্ধকারের সঙ্গে অতি সাবধানে মিশে গেল। পাইকদের পশ্চিমের বাগানে অনেক সুপারিগাছ। সবুজ ছেড়ে কমলা ধাঁচের হয়ে-ওঠা একগাদা সুপারির ছড়া তাঁর দখলে চলে আসে। সে-ই হায়দারের চুরি শুরু। পাড়াগাঁর বিভিন্ন বাগানের খোঁজ, ঢোকা ও বের হওয়ার পথ তার মুখস্থ হয়ে যায়। কাঁচা আয়ের গরমে এবার তাকে কে পায়? বিকেল হলে কেউ তাকে আর খেলার মাঠে দেখে না। হায়দার কোথায়? তাকে দেখা যায় ভাসার-কচুয়ার-আন্ধারমানিকের হাটে। থলেভর্তি বাজার নিয়ে হনহন পায়ে সে ফিরছে। রান্নার নামে খাওয়া সেদ্ধ করার কাজও এখন সে করে। দেখো, বুড়ো দাদার কী গন্ধশক্তি! তাঁর হাতের তালু শুঁকে পরিষ্কার ভারি স্বরে সে জানিয়ে দেয়, পরের গাছের গন্ধ যেন আর সে না পায়। পেটে পাথর বেঁধে থাকবে তো চুরির আয় সে খাবে না। শুনে হায়দার দাদার পাশ থেকে উঠে দ্রম্নত হারিয়ে যায়। ফিরে আসে মানুষসমান একটা মাঝারি মাপের বাঁশ নিয়ে। – ‘আইসো, ধরো বাঁশ, এইডা তোমার হাডাহাডির লাঠি। চইলো এইবার।’ হায়দারের স্বর ছিঁড়ে যেন মুরবিব-নির্দেশ উড়ে আসে। সেই থেকে দাদা আর নাতিকে কচুয়া থানার সদরে দেখা যায়। পড়ন্ত বেলায় ভ্যানগাড়িতে তারা ফেরে।
পুব থেকে উঁচুতে উঠে রাস্তা ব্রিজের ওপাশে গড়ানে পশ্চিমে গিয়ে নেমেছে। পাশাপাশি সাধারণ কয়েকটা মিষ্টির দোকান। তার এক ফাঁকে বুড়োকে কাগজ পেতে বসে থাকতে দেখা যায়। বাঁশের লাঠি নিয়ে কখনো কখনো উঠে দাঁড়ায়। আন্দাজে এদিক-ওদিক নজর চালিয়ে চলন্ত বাসের শব্দ ধরে সোজা চেয়ে থাকে। হায়দার কই? রিকশা-ভ্যান, ঠেলাগাড়ি নিচ থেকে ব্রিজের ওপর সহজে উঠতে পারে না। পেছন টানে চলে আসতে চায়। হায়দার হাত লাগিয়ে গায়ের জোর উজাড় করে ভ্যান ব্রিজের ওপর তুলে দেয়। থানা সদর থেকে যারা ভ্যানে মাল নিয়ে দোকানে ফিরছিল তাঁরা এই মেহনত বাবদ দু-টাকার একটা নোট হায়দারের হাতে গুঁজে দেয়। পাঁচটা দু-টাকার নোট এভাবে জমা হলেই একদৌড়ে দাদার কাছে সে চলে আসে। – ‘খাবা, কিছু খাবা তুমি? খিদে পাইছে?’ বুড়ো হাঁ-মুখে কপালে হাত ছুঁইয়ে নিজের ফাঁকা তলপেটে আঙুল বুলালে হায়দার নিঃশব্দে সরে যায়। এবার দাদার জন্য একটা পাউরুটি নিয়ে সে ফিরেছে। বুড়ো কাঁপা কাঁপা আঙুলে দু-এক টুকরো ছিঁড়ে এমনভাবে চিবাতে থাকে যেন সে রবার খাচ্ছে। মিষ্টির দোকানের টিউবওয়েল থেকে এক গস্নাস পানি এনে দাদাকে খাইয়ে আবার সে ব্রিজের উদ্দেশে দৌড় দেয়।
দুপুরের গরম রোদ ধীরে ধীরে বাড়ছিল। আকাশ দারুণ নির্দয়। হাটের পরদিন প্রয়োজন না হলে একচিলতে থানা সদরে এমন বিরুদ্ধ সময়ে মানুষের সরব উপস্থিতি থাকে নিতান্ত কম। ব্রিজের নিচ দিয়ে যাওয়া চওড়া খাল দিন দিন চর পড়ে মরে আসছে। সপ্তাহের দুদিন ছাড়া মালবাহী নৌকোর চলাচল তেমন দেখা যায় না। চিতলমারী, দেপাড়া, রঘুনাথপুর থেকে যাত্রী কুড়িয়ে বুড়ো বাসগুলো রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে পিরোজপুরের দিকে চলে যায়। হায়দারের কখনো কখনো ইচ্ছা হয় কোনো একটা বাসে উঠে হঠাৎ হারিয়ে যাওয়ার; কিন্তু মন টলে যায়। বুড়ো দাদাটা যদি মাটির নিচে চলে যেত তবে ঝাড়া হাত-পা নিয়ে, সে কি এই খানাখন্দে পানি-কাদার রাজ্যে পড়ে থাকে? দেখ, পেছন থেকে তার কাঁধ ধরে কে টানছে। ঘাড় ফেরাতেই হায়দার দেখে অচেনা ভদ্রগোছের এক লোক, পরিষ্কার জামা-প্যান্ট পরা, তাকে ব্রিজের পশ্চিমে নিয়ে যেতে চাইছে। ব্যাপার কী? এই মানুষটার কারণে কৌতূহলে মাখামাখি হয়ে মিষ্টির দোকানের ছাউনির ছায়ায় এসে দাঁড়ালে বুড়োর দিকে বয়স্ক আঙুল তোলে,
– ‘কী হয় তোমার?’ ঘাবড়ে যায় হায়দার। কিন্তু এর কণ্ঠ তো মোলায়েম। – ‘দাদা, দাদা হয়।’ হায়দারের জবাবের পেছন পেছন লোকটার স্বর থেকে সিদ্ধান্ত উঠে আসে।
– ‘তোমার দাদারে নিয়ে আমাদের একটা প্রোগ্রামে আজ আসবে। আমরা তোমাদের মতো মানুষ জড়ো করে অনুষ্ঠান করতে চাইছি।’
হায়দার ফ্যালফ্যাল অবুঝ নজরে চেয়ে আছে দেখে লোকটা হাত বাড়িয়ে দেয়। হায়দার লক্ষ করে, দুটি সাদা গেঞ্জি মেলে ধরে – একটা তোমার, আরেকটা তোমার দাদার, বলে, লোকটা পঞ্চাশ টাকার একটা পরিষ্কার নোট তার হাতের মধ্যে গুঁজে দিয়েছে। – ‘থানার পাশের দক্ষিণে যে নতুন রং করা বিল্ডিংটা, ওখানে মাইকের আওয়াজ পাবে, বিকেল চারটার মধ্যে চলে আসো।’
লোকটা এবার ব্রিজ পেরিয়ে ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা অন্য মানুষদের সঙ্গে মিশে যায়।
হায়দার তাজ্জব, লা-জওয়াব হওয়া ধাঁধা থেকে নিজেকে আলাদা করতে পারছে না। সত্যি তো, তাঁর হাতে সুতোর নতুন দুটো পাতলা গেঞ্জি; সঙ্গে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট। টাকা সে চেনে – উ হুঁ, ভুল হচ্ছে না। না, সে স্বপ্নও দেখছে না। জেগেই আছে। থানা সদরে ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে। মাথার ওপর খাড়া সূর্যের রোদ। সাইকেল চালিয়ে ছেলেরা স্কুল-কলেজে যাচ্ছে। – ‘কী রে, কই তুই, ভ্যান ঠেলতি তোরে পালাম না’ বলে, চেনামুখের ভ্যানচালক পুবদিকে নেমে যায়। হায়দার এবার নিজের ওপর বিরক্ত হয়। অত বোঝাবুঝির আছে কি, সে তো রক্তমাংসসহ উপস্থিত। মিষ্টির দোকানে ঢুকে নিজের শরীর চেয়ারে ছেড়ে গরম গরম দুটো শিঙাড়ার অর্ডার দেয় সে। আজকের দিনটা ভালো। দাদার জন্য একটা মিষ্টি নেবে। বুড়োকে নিয়ে আজ এদিকে যখন সে আসে গ্রামের মান্যিগণ্যি মাস্টারসাবকে কোন খেয়ালে সে সস্নামুলাইকুম দিয়েছিল। কী আনন্দ আজ!
দাদার হাত ধরে ধীরেসুস্থে মাইকের আওয়াজের কাছে হায়দার যখন পৌঁছে, ভেতরে তখন অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। তার গায়ের গেঞ্জিটা হাঁটুর কাছাকাছি এসে নেমেছে। নামুক, নতুন এমন একটা গেঞ্জি কেনার ক্ষমতা কি তার আছে? দাদার গেঞ্জিটা গায়ে ঢলঢলে। আরে, এই হাড়ের খাঁচায় মাংস কই, অমন বেঢপ তো দেখাবেই। তবে দাদা খুব খুশি। হাতের বাঁশের লাঠির আওয়াজ রাস্তায় ফেলে সে উজির-নাজিরের চালে এখানে আসতে চেয়েছে। হায়দার বোঝে, দাদার পেটে আজ চার-চারটা আটার রুটি, এক পেস্নট বুটের ডাল চালান হয়ে গেছে, এর প্রভাবে খিদে নিয়ে তাঁকে সহসা ঘ্যানঘ্যান করতে হবে না। এখানে আসার আগে ভরা পেটের আরামে মোড়ের বিশাল বটগাছের ছায়ায় একপ্রস্ত জিরিয়ে নিয়েছে দুজন। এর সুবাদে মাথা এখন সাফ সাফ লাগছে।
গেঞ্জি, টাকা দেওয়া লোকটা নিজের থেকে যেন উড়ে এসে সামনে দাঁড়াল। – ‘আরে আইসো, বসো এহানে’ বলে, সামনের সারির দুটি চেয়ারে তাদের বসিয়ে দেওয়া হলো। মাইকে যে-মানুষটা কথা বলছিল, সে অন্যদের দেখিয়ে হায়দার ও দাদার উদ্দেশে হাত তোলে – ‘এই যে দেখুন, দারিদ্র্যবিমোচনে আমাদের যে-প্রয়াস তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এরাও।’ হঠাৎ জোর হাততালির আওয়াজ ওঠে। বুড়ো ডান হাতে ধরা বাঁশের লাঠিতে ভর রেখে চারপাশে এমনভাবে চাইতে থাকে, যেন এই হাততালির অর্থোদ্ধারের চেষ্টা করছে সে। হায়দার ডানে-বাঁয়ে নজর চালিয়ে দেখে, পাড়াগাঁর থেবড়া পায়ের, হালচষা ঝাঁঝরা চেহারার চাষাভুষো, মাথার ধার পড়ে যাওয়া খুনখুনে বুড়ো হাবড়া, আঁচলে মুখঢাকা মাইয়েছেলেও আছে, চেয়ারে বসে হাঁ-মুখে উঁচু স্টেজের দিকে সবাই চেয়ে আছে। লাল কাপড়ের ওপর সাদা কালি দিয়ে ঢাউস অক্ষরে কী যেন লেখা – হায়দার বুঝতে পারে না। এখন কাকে জিজ্ঞেস করে, সবই তার মতো লেপাপোঁছা মানুষ।
হাততালির অর্থ বোঝা গেল – এই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি, বলা হলো থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন বড় সরকারি কর্মকর্তা স্টেজের দামি চেয়ারে বসতে যাচ্ছেন। ভালো জামা-প্যান্ট পরা মানুষগুলো হাততালি দিতেই হায়দারও দুহাত খুলে হাততালি দেয়। তার হাততালির আওয়াজ অনেক উঁচুতে উঠলে পঞ্চাশ টাকার নোট আরেকবার বুঝি পাওয়া যেতে পারে। হাততালি থেমে গেলে সেও হাত নিষ্ক্রিয় করে আনে। দাদা তার কাহিল বয়সের উদ্বেগের চুরমার শরীর চেয়ারে এমনভাবে ছেড়ে দিয়েছে যে, বসার পরপরই সে ঘুমিয়ে গেছে। জাগতে বললে জাগবে, নচেৎ নজরে পরিষ্কার তো কিছুই ধরা যাচ্ছে না – কান তো খোলাই আছে। হায়দার দেখে, গেঞ্জি শুধু তারাই পায়নি, প্রত্যেক ব্যাটাছেলের গায়ে একই গেঞ্জি। মানুষগুলো, নিশ্চয় সরকারি লোক হবে, ভালো ভালো, তাদের নেকনজরের কারণেই এই খাতির পাওয়া। হতে পারে আরো কিছু তাদের দেওয়া হবে, নইলে এই গরিবগুরবো মানুষগুলোকে এখানে কেন ডেকে আনা?
রুমের চারদেয়ালে মাইকের আওয়াজ গিয়ে আছড়ে পড়ে। কখনো চিকন, কখনো মোটা, সুরেলা ও রুক্ষ স্বর শোনা যেতে থাকে। কানের ভেতর দিয়ে মাথার খুলির নিচে শব্দ পৌঁছে রীতিমতো প্যাঁচ লাগিয়ে ফেলে, এই গিঁট খুলে কিছু বোঝার সাধ্য হায়দারের নেই। আচ্ছা, তার নয় বয়স হয়নি, নাবালকই বলা যায়, এই বয়স্ক কুড়িয়ে আনা চুপসানো মানুষগুলো কি কিছু বুঝতে পারছে? মুখ দেখে মনে হয়, ইহজনমে মাইকে এমন কথাবার্তা তারা পয়লা শুনছে, শিক্ষিৎ মানুষের বোল বোঝার ক্ষমতা তাদের কস্মিনকালেও ছিল না। এরা পথঘাটের আধামরা মানুষগুলো কেন আনতে গেল? দেখো কা-, দুটো জোয়ান ফটাফট ছবি তুলছে। ও মা, একজন তো ছবি তুলতে তুলতে তার যন্ত্র নিয়ে দাদা আর তার ছবিও চোখ মেরে মেরে তুলে নিল। কোত্থেকে একটা ফুলের মালা আনা হয়েছে। মাইকে ঘোষণা দিয়ে উজাড় করা হাততালির ভেতর প্রধান অতিথির গলায় মালাটা পরিয়ে দেওয়া হলো। এমন হাসি হাসি মুখের দৃশ্যের ছবি যন্ত্রের ভেতর ঢুকে গেল। পাশের চেয়ারে যে বুড়ো বসা, চেহারা দেখে মনে হয় বাসেদের বাপ, না অন্য কেউ, সব শব্দ উপেক্ষা করে ঢুলুঢুলু ঘুমে তার মাথাটা হায়দারের কাঁধের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। দেখো তার দাদাকে, বোঝার উপায় নেই সে জেগে না ঘুমিয়েছে, কেমন মাথা খাড়া করে আছে, সে কি দৃষ্টি চালিয়ে সবকিছু দেখতে পারছে, না বহুদিন পর অচল মগজ খোঁড়াখুঁড়ি করে তাঁর পুরনো আমলের কোনো ছবি বা ঘটনা তুলে এনে সেখানে নিজেকে সে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে। ওই টান খুলে এই রুমের মধ্যে যেসব রগুড়ে কা-কারখানা হচ্ছে তার মধ্যে সুড়ুত করে প্রবেশ করা এখন অসম্ভব। কোনটা? ধাক্কা দিয়ে কাঁধের মাথাটা সরিয়ে দিয়ে হায়দার টের পায় একটা পুরনো হাজামজা শুকনো হালকা নারকেল এপাশ থেকে ওপাশে গিয়ে পড়ল। ভাগ্যিস, ঝামা মাথাটা নিয়ে এই কাঠিকাঠামো নিচে গড়িয়ে পড়েনি। পড়লে ভদ্রমানুষদের এমন উৎসব মুহূর্ত মাটি হয়ে যেত। আহা, আজকের দিনটা সত্যি সত্যি ভালো, মাস্টারসাহেবকে আদাব-সালাম দেওয়ায় কিছু সোয়াব মনে হয় কায়েম হয়েছে, নচেৎ তাঁদের মতো ফালতু তুচ্ছ পশুভাগ্যের দোপেয়েদের এখানে বসার সুযোগ হয়! মাস্টারসাহেব কই? এমন ভালো, ফর্সা, পরহেজগার মানুষটাকে এখানে কেন ডাকা হয়নি? সেই তো এই সাহেব-সুবোদের কথা বুঝতে পারত। সে বুঝলে পরে তার কাছ থেকে সব বৃত্তান্ত তারা জেনে নিত। মাইকে শুরু নতুন করে কথা চালু। মোটা-খাটো ঘাড়ে-গর্দানে চর্বিঠাসা মানুষটার মুখ সাময়িকভাবে মাইক পাচ্ছে না বলে মাইকের ডান্ডাটা একজনকে পাশ থেকে ধরে রাখতে হয়েছে। কাঁঠাল সাইজের এই মানুষটার কণ্ঠ অসম্ভব চিকন, পুরোপুরি ধরা যাচ্ছে না। বলছে কী? ধুর, বলাবলির সঙ্গে তার সম্পর্ক কী, টাকা-গেঞ্জি পেয়ে কেটেও তো পড়তে পারত। না, অত অধর্মের কাজ তারা করেনি। এখন এসেই যখন পড়েছে, আরো কিছু না কিছু এরা দেবে, নইলে অত স্নেহনজর দিয়ে চেয়ারে বসার সুযোগ দেয়, ছবি তোলে, মাইকে তাদের কথা শোনায়! এই তল্লাটের সাহেবদের কখনো কি তারা দেখেছে? সাহেবরাও কি দান-খয়রাত বাদ, মনের ভুলে কি রাস্তা হারিয়ে গাঁয়ের ভেতরে পা রেখে তাঁদের ধন্য করেছে? কখনো না। তাহলে গায়ে পড়ে ইট-কাঠের ধবধবে এতবড় একটা ঘরের ভেতর যখন এতগুলো তিনবেলা আহার না-জোটা, পিত্তজ্বালায় ছটফট করা মানুষ নামের কঙ্কাল এনে জড়ো করা, তার পেছনে কোনো গোপন মাজেজা আছে। শোনা যায়, বিশেষ বিশেষ দিনে সরকারি খয়রাত এমন মাইক বাজিয়ে দান করা হয়। উফ্, ভারি আনন্দের একটা দিনে দাদাকে নিয়ে সে বেরিয়েছে! ওই মানুষটা গেল কই? ব্রিজের ওপর টাকা-গেঞ্জি দেওয়া সাহেবকে সামনের ভদ্রমুখের ভিড়ের ভেতর হায়দার খোঁজে। ওই মানুষটার হাত ধরে সে যদি কেঁদে ফেলে – স্যার, আমরা খাঁটি গরিব, আমার বাপ নেই, মা আমারে ছেড়ে গেছে, একটা বুড়ো দাদাকে নিয়ে গোঁজামিল দিয়ে জীবন কাটাই, দ্যান স্যার, একটা কিছু আপনার হাত খুলে ছাইড়া দ্যান, আখেরাতে আপনার কাম হবে। প্রাণভরে, মনখুলে আপনেরে দোয়া করুম। কিন্তু মানুষটা কোথায় গেল? নাকি এরই মধ্যে চেহারা ভুলে সবাইকে একই কারখানার তৈরি বলে মনে হচ্ছে?
মাইকে কথা হচ্ছে : এই যে সামনে যারা বসা এরা সবাই ছিল হতদরিদ্র। আজ এদের ভাগ্যের উন্নতি হয়েছে। আগে এরা খেতে পারত না, অভাব – আজ এরা তিনবেলা খেতে পারছে।
হায়দার মুখ ঘুরিয়ে দাদাকে দেখে। দাদা পয়লা থেকে নড়চড় ছাড়া জমাটভাবে যেভাবে বসা ছিল সেভাবেই আছে। এই ব্যাটা বলে কী মাইকে? দেবে নাকি বাপ-মা তুলে গালি। তিনবেলা তো দূর, একবেলা খাওয়া বলা যায় ভিক্ষে করে, চেয়েচিন্তে পেটের আধাআধি পচাগলা দিয়েও ভরতে পারে না, তাঁরা এখন তিনবেলা খেতে পাচ্ছে। আশ্চর্য, তার আশপাশে, পেছনে-সামনে, কোনাকুনি যেসব মানুষ বসা তারা নিষ্প্রাণ অমন কাঠের পুতুল হয়ে আছে কেন? নাকি কেউই মাইকের আওয়াজ তদের কানের ভেতর নিতে নারাজ। এই সাহেব ব্যাটারা মুখ খুলে, দাঁত খিচিয়ে, পেট ফাঁকা করে কিছুক্ষণ চেঁচামেচি করবে – করুক।
মাইকের আওয়াজ এবার ঘন। স্বরের ফোঁড়ে ফোঁড়ে চাপা উল্লাস। ভরপুর আশার বুনন দিয়ে ভবিষ্যৎকে এমনভাবে বেঁধে রাখা যাবে, শত ঢুঁশ মেরেও গরিবানার আর ঠাঁই হবে না। হায়দার নিঃশব্দে ডান পা দিয়ে নিজের বাঁ-পায়ের ওপর লাথি মারে। সে কি সত্যি সত্যি জেগে আছে, না ঘুমের ভেতর অচিন কোনো জমিনে ঢুকে পড়ে কথার তৈরি মিঠাই-হালুয়া খাচ্ছে। গলা থেকে ফুলের মালা খুলে রেখে সবচেয়ে বড় দামি চেয়ারে বসা সাহেব এবার মাইকের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর মাথার চুল বেশ কালো। আলো পড়লেও কেমন পিছলে পিছলে যাচ্ছে। দাড়ি-গোঁফ কামানো মুখটা সাদা – ঝকঝকে। একেই বলে সাহেব, দেখতে রাজপুত্তুর, ভুল করেও কোনো ভুলে হয়তো কামড় দেননি।
সাহেবের গলা থেকে ঘষামাজা সাহেবি স্বর ছড়িয়ে যায়। আপনারা জানেন, দুর্ভিক্ষ-মঙ্গা দূর করে সরকার দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে স্বল্পসময়ে উলেস্নখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করায় এফএও অর্থাৎ জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বাংলাদেশকে বিশেষভাবে পুরস্কৃত করেছে। সেই উপলক্ষে দেশব্যাপী যে আনন্দ-উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে তারই অংশ হিসেবে আমরাও দারিদ্র্যমুক্ত মানুষদের নিয়ে এই সমাবেশ করছি।
হায়দার অবুঝ মুখে শিশুনজরে চারপাশ দেখে। স্টেজে ও সামনের চেয়ারে ঘ্যাঁট হয়ে বসা সাহেবরা ছাড়া কেউ-ই মাইকের কথাবার্তার প্রতি মনোযোগী না। এক মহিলাকে দেখা গেল, কাগজে মোড়ানো পান বের করে মুখের মধ্যে পুরে দিতে। বুড়ো-হাবড়াগুলো চুল হারানো ঝুনো মাথা নিয়ে এমন সারি সারি চুপচাপ বসা যেন তারা হাটে বিক্রি হওয়ার জন্য প্রস্ত্তত। মাথার ওপরে ফ্যান ঘুরে ঘুরে রুমের ভেতর শুকনো বাতাস ছড়াচ্ছে। দেয়ালের লম্বা লাইট থেকে সাদা আলো আসছে। কোত্থেকে রুমের মধ্যে একটা চড়ুইপাখি ঢুকেছে। এখুনি ঘুরন্ত ফ্যানের পাখার আঘাত খেয়ে পাখিটা দেয়ালে গিয়ে ছিটকে পড়বে। চড়ুইটা তো বের করে দেওয়া দরকার। চেয়ার ছেড়ে হায়দার উঠে দাঁড়াতেই এক সাহেবের হাতের ইশারায় আবার সে বসে পড়ে।
ভারী ভারী ইটের টুকরো ছুড়ে মারার মতো শক্ত শক্ত কথার ভাষণের কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। মাইকে শব্দ হচ্ছে : এক জরিপ অনুযায়ী দরিদ্র জনসংখ্যা ১৯৯০-৯২ সালের ৩৭ দশমিক ৬ ভাগ থেকে ২০১২ সালে ১৬ দশমিক ৮ ভাগে কমে এসেছে। সংখ্যার দিক থেকে হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৩ কোটি ৭২ লাখ থেকে ২ কোটি ৫৩ লাখে নেমে এসেছে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অনুযায়ী ২০১৫ সালে এ-লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করার কথা ছিল। কিন্তু ৩ বছর আগেই বাংলাদেশ তা অর্জন করেছে। দারিদ্র্য ও অপুষ্টি দূর করার ক্ষেত্রে উলেস্নখযোগ্য অগ্রগতি হওয়ায় এফএও বাংলাদেশকে বিশেষভাবে পুরস্কৃত করে।
হায়দারের মাথার খুব গভীরে যেখানে হালকা বোধ-বিবেচনার শাঁস জমেছে, তার ওপর ফুঁসে-ওঠা প্রশ্ন হামলে পড়ে। এই শিক্ষিত মানুষের দামি কথা যদি গরিবদের নিয়ে হয় তা আমরা যারা খাঁটি গরিব, লেখাপড়া জানি না, আমাদের বোঝার মতো করে কেন বলা হচ্ছে না? কোনো মুখ দেখেই মনে হয় না তারা এই ওজনভরা কথা ধরতে পেরেছে।
সাহেব মনে হয় হায়দারের মনের কথা ধরতে পেরেছেন। ওই তো কেমন সহজ করে তিনি ফুকরে উঠেছেন। ২০০৯ সালে একজন দিনমজুর দিনের আয় দিয়ে সাড়ে চার কেজি চাল কিনতে পারত। এখন দিনের আয় দিয়ে প্রায় সাড়ে আট কেজি চাল কিনতে পারে। বাহ্, কী সুন্দর কথা। শুনলেও আর খিদে থাকার কথা না। হায়দারের পেটে হাত বুলোতে ইচ্ছা হয়। সে কি এতগুলো মানুষের মধ্যে দাদার পেটে হাত বুলিয়ে ভাতের দলা পাকানোর মতো করে আঙুলগুলো গোল করে তার মুখের সামনে আনবে।
সাহেবদের হাতের ইশারায় বোঝা গেল – কথাবার্তা শেষ, ছবি তোলাও শেষ। বড় সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠেও দাঁড়িয়েছেন। আশপাশের মাঝারি, ছোট, পাতি সাহেবরা তাকে ঘেরাও করে নিচে নেমে আসছে। চেয়ারে যারা বসেছিল তারাও এতক্ষণ পর কোলাহল করে জেগে উঠেছে। হায়দার দাদাকে আঙুল দিয়ে খোঁচা দেয়। বুড়োর হাতে বাঁশের লাঠি ধরাই আছে। চেয়ারে যেন গোঁ নিয়ে সে বসে আছে – কিছুতেই এই আরাম, এমন ঝকঝকে রুম, আলো-হাওয়া থেকে সে পৃথক হবে না। – ‘দাদা, সবাই চলে যাতিছে। ওডো, যাই আমরা।’ বুড়ো যথাসম্ভব স্বরে গরম এনে নাতির অবুঝপনার উদ্দেশে খেপে যায় – ‘কী কতিছিস? আমি তো নিজের কানে শুনিছি, সাড়ে আট কেজি চাল দেবে। চইলে গেলে চাল পাবানে কোহানে। বয় ছ্যামড়া।’ শুধু ইশারা না, হাঁ-করে বুড়ো গোঙানি দিলে তাও হায়দারের মুখস্থ, অথচ এখন দাদার ধমক দেওয়া কথার বিন্দুমাত্র সে বুঝতে পারছে না।