ঢ্যাঙা, উদখুলে চেহারার লোকটা দোকানে ফিরে আসতেই ক্যাশবাক্স থেকে মালকিন বলল ললিতকে, যান এবার।… পূজা দ্যান গিয়া… জুতা, গঙ্গাজলের বোতলটা থাউক এখানে… ফিরে এসে চা-ফা খাবেন তো এখানে?
ললিত মুখুজ্জে তদ্গত। খালি পায়ে বেরিয়ে এসে বউকে বলে, ডালির দোকানটোকান দেখো।… কত টাকার পুজো দেবে?
সুনন্দা সামান্য মেজাজ খিঁচড়ে বলে, কেন? সঙ্গে থাকবে না তুমি?
আমার থেকে কী হবে!… অত বিশ্বাস-টিশ্বাস নেই আমার।
সুনন্দা চুপচাপ বিনা জবাবে এগোতে, ললিত বুঝে নিল স্বামী-স্ত্রীর সংস্কার-বিশ্বাসের খিচিরমিচির পথেঘাটে চেপে রাখাই শ্রেয়।
বে-শ! চলো!
তখনো ললিত ভাবতে পারেনি, সন্ধ্যার পর আকাশপানে চাইলেই দেখতে পাবে পৌষসংক্রান্তির আগের দিনে পূর্ণিমার একটি গোল চাঁদ এবং অস্ফুট বিস্ময়ে অবাক হবে, পুরনো ঘা থেকে টপটপ রক্ত ঝরছে ওখানে।
উনুন থেকে উদখুলে চেহারার লোকটা অযাচিত, মুখটা এগিয়ে চেঁচাল, বাঁয়ের গলিটা দিয়ে মন্দির… হ্যাঁ, হ্যাঁ।
খ্যা-খ্যা হাসি দিয়ে ফের চেঁচিয়ে বলল, ভালো দিনে এয়েচেন… কাল হলে ভিড়ে ঢুকতেই পাত্তেন না।
মেলা বসবে কাল থেকে। সংক্রান্তিতে ভক্তরা দিগ্বিদিক থেকে এসে মন্দিরে মুলো অর্পণ করবে। মণকে মণ মুলো। এবং তিনদিনের মেলা।
পুরনো অঞ্চল, চাপা চাপা গলি, গঙ্গাপাড়ে শীতবিকেলের ঝিরকুটি পরিবেশে এখন শুধু কাঠ-পেরেকের খটখটাস ঠুকঠিকিস আওয়াজ। দোকানপত্তর সাজবে। ঠেলেঠুলে যদি শয়ে শয়ে মানুষ ঢোকে এখানে, ললিত-সুনন্দাদের মতো নির্ঝঞ্ঝাটে প্রবীণ নাগরিকদের দমফরাস অবস্থা।
সুনন্দা কি দিন-তারিখ বুঝেই এসেছিল, নাকি সত্যিই অগোচরে মা-কালী টেনে এনেছেন?
দুজন বাঁয়ে ঢুকে পড়ল। ঘিঞ্জি দোকানপাটের ঘেরগুলোর মধ্যে, তস্যচিকন ঘুপচিতে ঘুরপাক খেতে খেতে, জনৈক পসারিণী দেখিয়ে দিলো, মন্দির? ওই তো সামনে যান!
ঠান্ডা, ধুলো আর খালি পায়ে এতটা স্যাঁতসেঁতে অবস্থায়, ললিতের আফসোস হয় চায়ের দোকানে জুতোজোড়া না ছেড়ে এলেই হতো। দূরত্বটা বুঝে উঠতে পারেনি। উঁচু চাতাল, সিঁড়ির গোড়াতেই কয়েক জোড়া ভক্তের জুতো – কে আর চুরি করত?
বারোটা শিবমন্দির – দুপাশে ছয় ছয়। মধ্যিখানে মায়ের মূর্তি। পেতলের মস্ত সিংহাসনে ছোট দৈর্ঘ্যের দক্ষেণা কালী – অলংকার ও অজস্র জবার মাল্যে মূর্তি বরাভয়। কালো কুচকুচে পাষাণী চোখ ও পেতলের একটুকরো জিভ। সংলগ্ন নাটমন্দিরটিতে আপাতত বাঁশের বাধায় ঢোকা বন্ধ। তারই দোরগোড়ার সামনে পুরনো একটা কাঠগড়া। বহু প্রাচীন রক্তের ছাপ, গোড়ার কাঠে ক্ষয়ের চিহ্ন। গাছপালা, বিজনতা ও জলাজঙ্গলের সীমানার ওপাশ দিয়ে গঙ্গাটি বয়ে গেছে। মন্দিরের মোট এরিয়া খুব ছোট নয়। কিছু মানুষজন, মহিলা ও তাদের সমত্মানরা চুপচাপ ছড়িয়ে বসে আছে। যেন, একটা দিনের অবসরে, সংসারবৃন্ত খসে, শীতের ঝুক্কুরি বিকেলে যার যার মিথভাবনায় ওম দিচ্ছে।
সুনন্দা দু-একজন ভক্তকে ডালি হাতে চাতালে হাঁটাচলা করতে দেখে বুঝে নিল ওই ঘিঞ্জিটার মধ্যে ডালির দোকান। মন্দিরের ভেতরে কোথাও নয়। তবে এখানে অবারিত প্রহরেই পুজো গ্রহণের ব্যবস্থা। মায়ের ঘরের দরজাতেই মোটামতো টাকলু পুরোহিতটি দাঁড়িয়ে। কপালে ঊর্ধ্ব রক্ততিলক, মলিদার টুকরোতে বুকটা প্যাঁচানো, খাটো ধুতি। ডান কনুইয়ের ওপর একগাদা তাবিজ। মাথার পেছনে অবশিষ্ট চুলকটি বড়িখোঁপায় বাঁধা।
ললিত দাঁড়িয়ে সিঁড়ির গোড়ায়; সুনন্দা উঠে গিয়ে পুরুতের মুখোমুখি, দ্রম্নত ফিরে আসতেই ‘কী হলো’? স্বামীর কৌতূহলে সাড়া দিলো না। ভেতরে মজা পায় ললিত – বউয়ের অভিমানটুকু এখনো পুরো কাটেনি।
ললিত বুঝে গেছে মন্দিরের ভেতরে নয়। বাণিজ্যস্থান থেকেই ডালি কেনার দস্ত্তর। পবিত্র মন্দির কর্তৃপক্ষ সবকিছু মুঠোয় রাখতে চায় না। সুনন্দা দু-পা এগিয়ে হাঁটছে, পেছন পেছন ললিত। সেই পসারিণীটি সাগ্রহে বলে উঠল, ডালি লাগবে?
ডালি রাখেন আপনি?… এই যে দাঁড়াও। শুনছো? ললিত যেন প্রয়োজনের সমাধান করে ফেলেছে। সুনন্দা ফিরে তাকাল। নিম বিরক্ত। তবু ডালির আহবান এড়াতে সংস্কারে বাধে। জাগ্রত দেবী কীভাবে নেবেন, বলা তো যায় না।
সুনন্দা স্বামীর সব ব্যাপারেই না-সিরিয়াস হওয়ার জন্য অতৃপ্ত। সামনেই সার সার তিন-চারটে সাজানো দোকান। জবার মালাগুলো বেশি তাজা, অতিরিক্ত টকটকে, পেড়াগুলো যেন সযত্নে সাজানো। মানুষটা কি অন্ধ? নাকি চারদিক তাকায় না?
আসলে মানুষটা বিশ্বাস নিয়ে ছিনিমিনি খেলে গেল।
পসারিণীর জিজ্ঞাসায় ‘কত টাকার নেবেন’? সুনন্দার মহিলাসুলভ সুলুকসন্ধান ‘কী কী দামের রাখেন’? ‘সবচে কম একুশ।… ওপরে একান্ন, একশ এক, দুশো এক আছে… যার যেমন!’
ললিত মুখুজ্জের হাত পকেটে। প্রস্ত্ততি নিয়েই এসেছে। একশ এক বললেও এ-ব্যাপারে সুনন্দাকে বাধা দেবে না।
একুশ টাকার একটা দিন! সুনন্দা অর্ডার করল।
সামান্য বিস্ময়। ললিত ভেবেছিল সুনন্দা অন্তত একান্নরটা অর্ডার করবে। তা বলে, পসারিণীর মধ্যে যত্ন-আত্তির বৈষম্য নেই – ললিত লক্ষ করল। একুশের ডালিটিকেও সমান যত্নে, পেড়া, ফুল, কলাপাতায় গোলা সিঁদুর লাগিয়ে বলল, মায়ের পায়ে দিয়ে আসুন… ফিরবেন যখন পস্নাস্টিকে বেঁধে-ছেঁদে দেবো!
ডালা বইবার কোনো পাত্র-টাত্র নেই… ? ললিত চাইতেই, পসারিণী ছোট একটা পস্নাস্টিক ঝুড়ি দিলো। এটাই দস্ত্তর এখানে।
আর অপেক্ষা নয়, দুই করতলে ডালিটি নিয়ে সুনন্দা সোজা মন্দিরের দিকে। পেছনে ললিত।
সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়াতেই, চাতাল থেকে ‘কী ওপরে উঠবে না তুমি?’ স্ত্রীর গলার আধা-হুকুম, আধা-প্রত্যাশা, ললিতের বুকে দুর্বল রহস্য হয়ে বাজতেই, সে উঠে এলো।
একত্রিত দুজনে সামনে দাঁড়াতেই, ‘ধূপকাঠিগুলো পাশে গিয়ে জ্বালান’ বলে রক্ততিলকধারী ডালিটি সুনন্দার হাতে থেকে ‘কার নামে হবে?’ বলতেই, ‘ললিত মুখার্জি’ শুনে ফের ‘গোত্র’? জিজ্ঞাসা করতেই, সুনন্দার জবাব ‘ভরদ্বাজ’। একটু পরই, পুরুতের মন্ত্রোচ্চারণে ললিত আপন নামটির আজন্ম সংস্কারের বিপরীতে প্রতিধ্বনি শুনেই কেমন চুপটি রয়ে গেল। চারপাশের বস্তুজগতের কাজ চালানো পুরুষকারের এতগুলো বছরের রক্তছায়ার প্রবাহে একটি চড়া জেগে উঠতে দেখল যেন। কিছু খসে পড়ার অস্বসিত্মবোধ। কিন্তু সুনন্দাকে তিলক লাগানোর পরই, আপসে নিজের মাথাটি নোয়াতে মোটা আঙুলের ডগার একটি স্পর্শ। কিছু খুচরো পয়সা দাও তো! সুনন্দা হাত পাতল। মায়ের পায়ের প্রণামির মুদ্রা ছাড়াও অতিরিক্ত কিছু চাইল সে।
শিবলিঙ্গগুলোয় লাগবে… আসবে তুমি?
আমি বরং ধূপকাঠিগুলো ঘুরিয়ে দিই!
গটগট করে নয়, সুনন্দা শান্তছন্দে হেঁটে চত্বরের প্রান্তভাগে চলে গেল। ললিত নেমে গিয়ে নাটশালার পাশে কাঠের বেদিতে জ্বলন্ত ধূপকাঠি গুঁজতে ব্যস্ত।
চওড়া চত্বরটায় সুনন্দা এখন যেন মিথকল্পের মধ্যে আছে। স্বামীর ওপর ইদানীং ক্ষোভ জন্মায় বটে, মিথ্যা বলবে না, আজ এতটা দূর আসার ঝক্কি নিতে গাঁইগুঁই করেনি। হাঁপের কষ্ট সয়েও। বুকটায় কিছু নেই ওর। পাটের কলে কেরানিগিরি করে ফুসফুস দফারফা। দেশ ছেড়ে এপারে এসে উপায় কী ছিল? সুনন্দা নরম হলো।
সুনন্দার মনে কয়েকদিন ধরেই স্বসিত্মবোধ ছিল না। প্রায়ই স্বপ্নে দেখছিল, নদীর জলে কখনো কোনো মন্দিরে মায়ের মূর্তি কোলে নিয়ে বসে আছে। স্বপ্ন! বলে অনেকেই, স্বপ্নের ভেতর ভবিষ্যতের কিছু ইঙ্গিত উহ্য। মানুষ নাকি ঘটার সম্ভাবনায় স্বপ্ন দেখে।
যা হোক, কয়েকটা দিন সংসারের নানা কাজকম্ম ও ইতস্তত চিমত্মায়, সুনন্দা কেন জানি আজ সকালে মুখফুটে বলে ফেলেছিল, আজ তোমার শরীরটা ঠিক আছে?
কেন?
একটা কথা বলতাম। রাখবে?
ললিত একটু রহস্যে, কুণ্ঠা কেন? বলেই ফেলো!
পুজো দিতে যাব?
হঠাৎ? কোথায় যাবে?
সুনন্দা স্বপ্নের ব্যাকগ্রাউন্ডটি কুণ্ঠা নিয়ে বলে ফেলতেই ললিত বলে, তোমরা পারো বটে!
সুনন্দা চুপ। ফের ললিত, ঠিক আছে!… নিছক চরণদার হিসেবে…ভক্তি-টক্তি নেই আমার!
সুনন্দা শিবলিঙ্গগুলোর উদ্দেশে কয়েনের নৈবেদ্য ছুড়তে ছুড়তে স্বামীর লম্বা নীরোগ আয়ুর কামনায় ব্যস্ত। সত্যি বলতে, পথের কষ্টে মানুষটা রা কাটেনি, দু-একবার ইনহেলার নিয়েছে, কিন্তু কোনো কাঠগোঁয়ারির লক্ষণ নয়। উপরস্ত্ত টিকিট ও রাহা-খরচা সবই পকেট থেকে মিটিয়েছে – রিটায়ার্ড প্রাইমারি শিক্ষিকার ঘাড় ভাঙেনি।
শীতের মরশুম পড়লেই মানুষ যেন পাগল। বাসে-ট্রেনে ওঠে কার সাধ্য! কি দুপুরে, কি বিকেলে! যাত্রীর চাপে সুনন্দার নিজেরই বোধ হচ্ছিল দমবন্ধ হয়ে যাবে। তাই নির্দিষ্ট স্টেশনটিতে নেমেই, ছিটকে এসে পাথরের বেঞ্চিতে বসে পড়েছিল।
‘দাঁড়াও একটু জিরিয়ে নেই! ছোটলোকের মতো ভিড়!’ স্টেশনটি থেকে মন্দির হাঁটাপথ – এই যা ভরসা! এখন ধূপকাঠি হাতে ললিত মুখুজ্জে দেখে, কাঠের বেদিটা জুড়ে ফোঁড় দেওয়া অজস্র পোড়া ধূপকাঠির খোঁচা। কত মানুষের গোপন অব্যক্ত কামনার চিহ্ন। নিজের কাঠির ধোঁয়া মুক্ত বাতাসে চাতালের দিকে ধাইতে, বহু পুরনো অচেতন গুহা থেকে কিছু স্মৃতি উঁকি দিলো ললিতের। অতিশৈশবে অস্পষ্ট জেনেছিল, তাদের পূর্বপুরুষদের ভিটায় বিগ্রহের নিত্যসেবা ছিল। দক্ষেণা কালীর। ঠুকুদ্দার নিকট-শাখার দু-একজন নাকি শবসাধক ছিলেন। অতিবাল্যে দেশভাগ হলে, এ-ভূখ– এসে কলোনির দিন আর পাটকলের মেশিন-ঘর্ঘর। স্মৃতি হারিয়ে,
চেতনা-গৌরবে কোনো মিথভাবনা সৃষ্টি হয় না।
ললিত বেরিয়ে এসে কাঠগড়াটার সামনে দাঁড়াল। পুবমুখো। গঙ্গাকুলের লতাজঙ্গলের জাল ভেদ করে পশ্চিমের শীতের দুর্বল সূর্যটি। ছোট্টবেলা যাইযাই করছে। কতকালের বাসি-পচা একটা বাছুরসদৃশ ঢোপ শান্ত জলে ভাসছে। উত্তরমুখীন ছোট্ট একটি জেলেডিঙি ধীরক্লান্ত গতিতে। মন্দিরজমির সীমারেখার ছাইগাদায় মোটা ঝাড়ালো মানকচুর গাছ। হঠাৎ নজরে পড়ে নাটমন্দিরটির মাথায় একজনের ছবি। প্যাঁচানো আভিজাত্যের পাগড়ি পরা। মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা-জমিদার সম্ভবত। অল্প আলোয় নাম ঠিকঠিক পড়া গেল না।
সুনন্দা এতক্ষণে কর্তব্য সেরে। পেড়ার টুকরো আর একচিলতে জবার পাপড়ি মাথায় ছোঁয়াতে বলে ললিতকে।
চলো, চলো!… পায়ে ফুটছে বড্ড! ললিত বলে।
ফের সেই পসারিণীর উদ্দেশে যত্নে মোড়ানো ডালাটি ব্যাগে ভরে হাঁটা দিলো সুনন্দা।
‘ক-ত ভালো ভালো দোকান ছিল!’ স্ত্রীর এই খেদোক্তিকে ললিত পাত্তা দিলো না। মানুষের স্বভাব, নদীর ওপারটা সুন্দর দেখে।
দোকানটায় পৌঁছতেই, থপথপে চেহারার বিধবা মালকিন বেঞ্চটা মুছে দিয়ে বলে, বসেন!
জগটা দেখিয়ে পা ধোয়ার জলের ইঙ্গিত করল। ঢ্যাঙা, উদখুলে লোকটা ঠায় বসে। কেমন দেকলেন?
ভালো। ললিত সংক্ষেপ্তে সারে।
কটা চা? মালকিনের প্রশ্নে ললিত বলে, ভালো বিস্কুট আছে?… হ্যাঁ-হ্যাঁ, নোনতা!
ললিত এবার সৌজন্যে ঢ্যাঙা লোকটাকে বলে, আপনি খাবেন?
লোকটা মাথা নেড়ে বলে, সেবা ছাড়া দান কিছু নেই না।
বেশ তো! চা সেবা করুন!
ললিত দেখে মানুষটার মুখ খুশিয়ে উঠেছে। অর্ডার দিলো মালকিনকে, তিনটে চা আর বিস্কুট তিনটে! দোকানটির ধার ঘেঁষেই গঙ্গার আভাস, বিপুল প্রাচীনতা নিয়ে একটি অশ্বত্থগাছ। তার ছায়ায় ভূতপূর্ব জমিদার বা চলতি বুলিতে রাজার বাড়িটা বাহির পিলারের টুকরো অবশিষ্ট রেখে নিশ্চিহ্ন। এখন গোধূলিতে পর্যাপ্ত আলোর অভাবে, আশপাশের ঘিঞ্জি মহল্লার স্বদেশি বাচ্চারা পস্নাস্টিকের ব্যাট-বল নিয়ে ঝিঁঝির ঐকতান তুলছে।
সুনন্দা ফিসফিসিয়ে ললিতকে বলে, গঙ্গাজলটা!… এনে বসো!
কৃতজ্ঞ লোকটি শুনতে পেয়েই, দ্যান আমি আনছি!… এটা পারঘাটা… টিকিটঘরের সরু রাস্তা… তিনি পারবেন নিকো!
পারঘাটা? কোথায় পারাপার করে? ললিতের কৌতূহলে লোকটা হাসে, ওপারে চটকল গো!… ডিউটির প্যাসেঞ্জার বেশি!… না, না, ভুটভুটি সব নয়… নৌকোতেও হয়!
ললিত তাকিয়ে দেখে, পারাপারের ব্যস্ততা আছে; সে এদের মেলার মানুষ ভেবেছিল। তা লোকটা যদি জল ভরে আনার হ্যাপা কমায়, ক্ষতি কী?
হঠাৎ সুনন্দার গোপন আঙুলের খোঁচায়, পবিত্র গঙ্গাজলের রহস্য ললিতের সংস্কারে গেঁথে যায়। ফেরিঘাটটা একটু ঘুরে দেখার ছলে ললিত নিজেই বোতলটা নিয়ে হাঁটা দিলো।
মালকিনের চায়ের স্বাদ বাহারি। ক্লান্তি দূর করে দেয়। ললিত চুমুক দিয়েই আয়েসে লোকটিকে বলল, মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা কে?
রাজা! ছবি দেখেননি নাটশালে?
নামটা পড়া গেল না!
কী এক ঠাকুর যেন!
ঠাকুর? রবীন্দ্রনাথদের? ললিত বলে।
ঢ্যাঙা লোকটা গস্নাসটা রেখে, প্রত্যয়ে মাথা নাড়িয়ে বলে, ওই ঠাকুররা না।
পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুররা?
হবে হয়তো।… তেনারাই রাজা ছিলেন… এই গোটা অঞ্চলটার!
আঙুলে বড় অ্যারিয়া দেখিয়ে লোকটা বলে, ওই যে ভাঙা থামগুলো দেকবেন… মাঠটা জুড়েই তো রাজার বাড়ি।
ললিত মনে মনে শুধরে নিয়ে ভাবে, বাবু রাজা-ফাজা নয়, জমিদার!
কিন্তু লোকটাকে যতটা উটকো এবং ফোতো ভেবেছিল, তা নয়। কলকাতার ঠাকুর পরিবারদের যে দু-দুটি শাখা – ইতিহাস জানে। আঙুলের সেই বড় অ্যারিয়ার মধ্যে, ললিত দেখতে পেল, ইস্টিশন-ফিস্টিশন ছাড়িয়ে বহুদূরের জমিজমা ঢুকে পড়েছে।
মায়ের মূর্তি তো রাজার স্বপ্নে পাওয়া – লোকটা শুরু করতেই, ললিত কেন জানি মালকিনের সঙ্গে দোকান ভাড়া, একদিনের মেলার খাজনা, মন্দিরের রোজগার, কারা বর্তমানে আদায় করে, বংশধরদের কোনো ওয়ারিশান বেঁচে আছে কিনা – জটিল আইনকানুনের গল্পে উৎসাহিত হয়ে গেল।
সুনন্দা আগ্রহে জানতে চাইল, কী রকম স্বপ্নে পাওয়া?
শুনিচি যা, চোকে দেকিনি তো! বাপ-ঠাকুদ্দাদের মুকে শুনিচি!… মিথ্যে হলে ত্যানারা বলবেন কেন?… ঠাকুররাজা একবার সপরিবারে রয়েচেন এখানে… একমাত্তর কন্যাটি… নাবালিকা তকন, দশ-এগারো বয়েস… আবদার কললে গঙ্গায় নাইবে… এই যে পারাপারের ঘাট… তকন তো রাজার খাস ওটা… তো ঘের দিয়ে মেয়ের নাইবার ব্যবস্থা হলো… হঠাৎ হাত ফসকে সেই যে তলিয়ে গেল… বহু জাল ফেলেও খোঁজ মিলল না।… রাজামশাই শোকে কাতর… শয্যা নিয়েচেন… শেষে একরাতে স্বপন শুনলেন, অবিকল মেয়ের গলায় কে যেন বলচে, আমি পাষাণ হয়ে চড়ায় বন্দি…আমায় প্রতিষ্ঠা কর… লোকলশকর নেমে পলল… নদীর ওদিকটায় তখন চড়া জাগছে… সত্যিই দেকা গেল ওই মায়ের মূর্তি কাদা-বালিতে আটকে… তখন জঙ্গল কেটে মন্দির, পাষাণমূর্তি প্রতিষ্ঠা… সত্যিই জাগ্রত… মোদের কাকা-জেঠারা বলতেন সে-কালে মূর্তির সামনে এক-আধখান নরবলিও হয়েচে… সত্যি-মিথ্যে জানিনে।… এখন সংক্রান্তির দিন মুলো পড়ে!… মণখানেক তো হবে!
সুনন্দা কপালে আঙুল ঠেকায়। কিন্তু ললিত কিছুক্ষণ ভিন্ন স্মৃতিতে বুকে মোচড় অনুভব করে। একটা ঝিলিক। ওর পিঠোপিঠি যমজ বোন দুবছরে পুকুরের জলে ডুবে মরে ছিল। অকস্মাৎ স্মৃতি মুচড়ে উঠল। আজ সে বেঁচে থাকলে? কেমন হতো? কোনো অবয়ব জাগল না। সে আজ কোন দেশে? সে-ভূখ- আজ ললিতের নয়। বোনের অতি শৈশবের স্মৃতি যেন তারকাঁটায় গেঁথে রয়েছে। মনের পথেও চলাচলে নিষেধ।
ফিরতি পথে দুজন চুপচাপ। ঠক ঠুক ঠাক শব্দের সমুদ্র দিয়ে চাপা গলি ধরে ওরা স্টেশনের উদ্দেশে। সন্ধ্যা উতরে গেছে। ফের সেই ট্রেন। হাঁসফাঁস ভিড়ের ট্রেন। হাঁ করে কী গিলছিলে? ললিত হঠাৎ দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
কেন? সুনন্দা ফোঁস করে উঠল।
ললিত হালকা গলায়, ব্যাটা উঞ্ছবৃত্তি করে!… ও-কথার দাম কী? স্বপ্ন হচ্ছে যত নষ্টের গোড়া… ভুজুংভাজুং মিথ্যে গুল…!
সবাই গুল দেয়?… মালকিনও সায় দিচ্ছিল… অশিক্ষিত বলছ যে, ঠাকুর বংশের শাখা-প্রশাখার খবর কজন ভদ্দরলোক জানে?
স্টেশনে পৌঁছতেই ললিত সুনন্দার সঙ্গে আপস করেছিল।
কিছু খাবে?
না!
খিদে পায়নি? কখন খেয়ে বেরিয়েছ। গরমগরম ভাজছে, দুটো করে কচুরি?
সুনন্দা চুপচাপ। চত্বরে ঢুকে নিজের মানিব্যাগ খুলে এক প্যাকেট আলুচিপস ও জর্দাপান কিনল। চিপস নেবে? ললিত শুনে হেসে বলল, না বাপু!
সুনন্দা দু-এক খ- চিবোতে চিবোতে, তোমরাই যুক্তিতক্কে চলো, বাকি দুনিয়া গুল মারে।… জলে ডুবে নাবালিকা তলাতে পারে না?
ললিত কাঁপাগলায় জবাব দেয়, খু-উ-ব পারে!… অনেক দূরের অতীতের কথা… কত রং চড়েছে!
রং? রঙের কথা উঠছে কেন?
একটুকরো লোহা পড়ে থাকলেও জং ধরে… আর এসব তো ইতিহাসের ঘটনা।
তো?
ললিতের চোখে গোপনে জল এলো।
অদ্ভুত কাকতালীয়, মাইকে অকস্মাৎ ঘোষণা এবং ওদের নির্দিষ্ট ট্রেনটি হাজির। ভীষণ ফাঁকা। দুজন পাশাপাশি আসন পেয়ে গেল। খুশিতে ললিত ভাবে, এসেছি কী ভিড়টা ঠেলে!
অদ্ভুত বৈপরীত্য!
এক-একটা স্টেশন আসে, ঝাঁপিয়ে লোকজন ওঠে না। অদ্ভুত! ললিত ভাবে, সুনন্দা হিসাব করে আজকের দিনটাতেই বেছে নিল কীভাবে?
কাল থেকে মেলা তুমি জানতে?
না! না!
আজই এলে? একটা দিন পরে এলে কী ঠ্যালা হতো?
ঢুকতেই পাত্তাম না! সুনন্দা বিশ্বাসে মিলায় বস্তু-গলায় বলল, কয়েকদিন ধরেই টানছিল… এখন তোমার গা ছুঁয়ে বলছি!
ইচ্ছাটা কালও হতে পারত? ললিত জানতে চায়।
পারত! হলো না কেন?
আশ্চর্য! ললিত বলে, এটাই ইতিহাস।
বাড়ির স্টেশনে নেমে, ললিত একা। সুনন্দা টুকটাক কিনতে লাইন পেরিয়ে বাজারের দিকে গেছে। ললিত একা একা হাঁটতে থাকে।
হঠাৎ একটু নিরিবিলিতে, আকাশে হঠাৎ মাথা তুলতেই, দেখতে পায় পুবে সম্পূর্ণ গোল একটি শীতচাঁদ। পূর্ণিমা কি আজ? বাহ্! কাকতালীয়! সুনন্দা নিশ্চয়ই হিসাব করেনি। আজকের শুভদিনে যাওয়াটা কেমন তালমিলে ঘটে গেল।
রাতে বিছানায়, ললিত মন্দির-চাতাল-শিবলিঙ্গ ও জাগ্রত দেবীমাহাত্ম্যের সবটুকু চেতনার রিল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বহু পুরনো কিছু সংস্কারের বাঁধন আলগা করে দিলো। হঠাৎ অবচেতন গুহা থেকে বহুদূর পুরনো লাভার মতো, ঘণ্টাধ্বনি উঠে এলো। তার পূর্বপুরুষ। তাদের ভিটে, মন্দির, জমি, বাড়ির পেছনে নির্জন পুকুরটা, দুবছরের পিঠোপিঠি বোনটা! সব হারিয়ে গেছে। দেশটা ভাগ না হলে, অনেক কিছু থেকে যেত। এভাবে উলঙ্গ, পাটকলের হেপো কেরানির প্রবীণ জীবনটা বয়ে বেড়াতে হতো না। এসব বিপর্যয়ের সবকিছু অপরাধের মূলে তিনজন। নেহরু-প্যাটেল-জিন্নাহ।
অথচ… অথচ সাত দশক ধরে সীমান্তের দুপাশে ইতিহাসের দুটি খ- পড়ে আছে। কত জংধরা, কত স্বপ্নের বাধার পাঁচিল হয়ে।
চাঁদটার দিকে চোখ নিয়ে ভাবে, তিনটি নাম শুধু মাছি হয়ে ক্ষতের রসে বারবার এসে বসে। তখনই ওর গা থেকে রক্ত পড়ে, ক্ষত শুকোতে চায় না।