দর্জি কুতুব মিয়া গম্ভীরমুখে বসে আছে। মেয়ে হালিমা এসে বাবাকে বলে – বাবা, আজ তো ভাড়া নিতে আসবে। আপনি কি ভাড়া দিতে পারবেন?
কুতুব মিয়া উত্তর করেন না। তার পকেট শূন্য। কিছুদিন হলো তেমন কোনো কাজ পাননি। টাকা নেই। মেয়ের জন্ম থেকেই হার্টের অসুখ। ওকে ডাক্তার দেখাতে যা ছিল সব শেষ।
বাড়িওয়ালা তো বলছে, ভাড়া দিতে না পারলে বাড়ি ছাড়তে হবে। বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কুতুব মিয়া বলেন – জানি। পুরুষের কাপড় টানিয়ে রাখার জন্য একটা পুরুষ মূর্তি ‘ম্যানিকিন’ আছে। অনেকদিন আগে একজনের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। ‘ম্যানিকিনটা’ দেখলে মনে হয় একজন তরুণ, যার কাছ থেকে পেয়েছিলেন তিনিও ছিলেন দর্জি। তবে অনেক বড় আর নামকরা দর্জি। তার মতো নুন আনতে পানতা ফুরানো দর্জি নয়। সে-ই দিয়েছিল তাকে। বলেছিল – নাও জিনিসটা। আমার এক বন্ধু কোনো এক বিশেষ কাঠে ‘ম্যানিকিনটা’ বানিয়েছে। এখন আমার মরণের সময়। জিনিসটা তোমারে দিলাম। যত পুরুষের কোট, শার্ট বানাবা এইটার ওপর রাখতে পারবা। কুতুব মিয়া তাই করেন। কোনো কোট বা শার্ট বানানো হলে ম্যানিকিনটাকে পরান। তারপর যার নেওয়ার সে নেয়। হালিমা বলে – বাবা, হাসমত চাচা বলছে এইটা যদি বেচ তিনি নেবেন।
কী বেচব?
ওই যে যার ওপর তুমি কোট-শার্ট রাখো। জিনিসটারে পরাও। সেই জিনিস। একটা মডেল মানুষ। যদিও কাঠ আর উল দিয়ে বানানো কিন্তু পোশাক পরালে খুব সুন্দর লাগে দেখতে।
না, এটা আমি বেচতে পারব না। এটা আমার ছেলের মতো। হালিমা বাবাকে এক কাপ চা বানিয়ে বলে – তাহলে? ভাড়া ক্যামনে দিবা।
হালিমাও চায় না জিনিসটা যাক। ওটা ওর সঙ্গীর মতো। মাঝে মাঝে ম্যানিকিনটাকে পরিষ্কার করে। ওর মাথার চুল আঁচড়ায়। কালো সুতোর চুল ম্যানিকিনের তরুণের মাথায়। নতুন কোনো শার্ট বা কোট ওকে যখন পরানো হয়, বেশ লাগে দেখতে। এখন বাবার একটু পুরনো ফতুয়া পরে আছে। কারণ বাবা বেশ কিছুদিন ভালো কোনো অর্ডার পায়নি। ভালো অর্ডার পেলেই আবারো সেসব পরে সুন্দর একজন হবে।
বাড়িওয়ালাকে কুতুব মিয়া এটা-সেটা বলে, আরো কিছু সময় চেয়ে নিয়ে সে-যাত্রা রক্ষা পায়। বলেন বাড়িওয়ালা – এরপর যখন আসব ভাড়া দিতে না পারলে জিনিসপত্র সব ক্রোক করব। থাকার মধ্যে আছে একটা পুরনো দিনের পা-সেলাই মেশিন। সিঙ্গার কোম্পানির। অনেকদিন আগের। আর একটি দুর্লভ ‘ম্যানিকিন’। দুটো চকি, দুটো চেয়ার, পাতিল-হাঁড়ি। কিছু পুরনো কাপড়-চোপড়। কাপড় কাটার কেঁচি। গজ-ফিতা এমনি টুকিটাকি। বউ মারা গেছে পাঁচ বছর আগে। তখন মেয়ে হালিমার বয়স ছিল দশ। এখন পনেরো। মেয়ে বড় হয়ে উঠছে। হার্টে একটু ফুটো নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে। ওর বিয়ের কথা ভাবছেন না দর্জি কুতুব মিয়া। নিজেও আর একটা বিয়ে করেননি। বাপ-মেয়ের সংসার। মেয়েটা মাঝে মাঝে ভালো থাকে, মাঝে মাঝে খাবি-খাওয়া মাছের মতো ছটফট করে। ডাক্তার বলেছেন – বিয়েটিয়ে দিও না। ওসব জীবন ওর নয়। তোমার সঙ্গে থাক। ছেলেমেয়ে সমত্মান হওয়া ওর ভাগ্যে নেই। স্বামীর আবদার সহ্য করার মতো তাজা কলিজা নয় ওর। ফুটো নিয়ে জন্মেছে। ওকে বিদায় করো না। করলে ওই ফুটো কলিজা নিয়ে ফিরে আসবে। তার চেয়ে বরং নিজের কাছে রেখে দাও। সংসারের কাজ, স্বামীর কাজ মেটানোর মতো ওর শরীরের অবস্থা নয়।
কুতুব মিয়া তাই মেয়ের বিয়ে নিয়ে ভাবেন না। মেয়ে আর বাবা চলে যায় দিন। যখন একটু টাকা হাতে পান হালিমার চিকিৎসা করেন। ওর জামা কেনেন। লাল ফিতে আর ক্লিপ কেনেন। ভালোমন্দ খাওয়া-দাওয়া। যখন টাকা থাকে না? কোনোমতে দিন গুজরান। বাবা তখন এটা-সেটা গল্প করে। হালিমা শোনে। বলে – বাবা গল্পগুলো তুমি যদি লেখ অনেকেই সেসব পড়বে।
কী যে বলিস। আমি হলাম দর্জি মানুষ।
এমনিই যখন সময়, বেশ রাতে একজন গ্রাহক এসে দরজায় কড়া নাড়ে। একজন বুড়োমতো মানুষ। দেখতে ঠিক সাধারণ নয়। তবে অসাধারণত্ব কোথায় বুঝতে পারেন না কুতুব মিয়া। ভদ্রলোকের হাতে একটি প্যাকেট। কুতুব মিয়া তাড়াতাড়ি বসতে বলেন। কম পাওয়ারের বাল্বের আলোয় লোকটা সে-প্যাকেট টেবিলে রাখে। বলে – কোট আর প্যান্ট বানাবেন।
ঠিক আছে।
বলে – এই নিন ডিজাইন। ঠিক যেমন নকশা আঁকা আছে তেমন বানাবেন। কুতুব মিয়া চোখে চশমা লাগিয়ে নকশা দেখেন। বিশেষ নিয়মে কোট আর প্যান্ট বানাতে হবে। – আমি কখনো কারো কাছ থেকে এমন নকশার কোট-প্যান্ট বানানোর অর্ডার পাইনি।
পাননি এখন পেলেন।
আসলে আমার পছন্দেই আমি বানাই কিনা। তাই –
আর এই যে ম্যাটেরিয়াল, সেটাও কেমন যেন। ঠিক কাপড়ের মতো নয়। কুতুব মিয়া নেড়ে-চেড়ে ম্যাটেরিয়াল দেখেন। এমন কিছু তিনি আগে দেখেননি। সবকিছুই কেমন রহস্যে ঘেরা।
বানাতে পারবেন কিনা বলেন।
পারব মনে হয়। তবে সেলাই মেশিনে এটা হবে বলে মনে হয় না। পুরোটা সেলাই করতে হবে সুচে। খুবই খাটনির কাজ।
জানি। সেজন্য আপনাকে দশ হাজার টাকা মজুরি দেবো।
দশ হাজার? কুতুব মিয়ার মনে হলো, ও স্বপ্ন দেখছে। বাড়িভাড়া, মেয়ের জন্য ডাক্তার, ওর নতুন সালোয়ার-কামিজ, ভালোমন্দ খাওয়া সবকিছুই হবে এই দশ হাজার টাকায়।
কোট আর প্যান্টটা কি আপনার? প্রশ্ন করেন কুতুব মিয়া।
না। আমার ছেলের।
তাহলে ছেলেকে আনেন। তার মাপ নেই।
ও আসবে না। ওকে চমক দেবো আমি। যে-ডিজাইন লিখেছি সেটা ফলো করলেই এই ম্যাটেরিয়ালে কোট আর প্যান্ট হয়ে যাবে। একটুও কাপড় বাঁচবে না। কাটতে গিয়ে যেসব টুকরো হবে আমাকে দেবেন।
আচ্ছা।
কতদিন লাগবে আপনার?
দিন পনেরো। বলেন কুতুব মিয়া। লোকটা কী ভাবে। তারপর বলে – এগুলো হলে আপনি নিজে এসে আমাকে ডেলিভারি দেবেন। এই আমার বাড়ির ঠিকানা। কুতুব মিয়া ঠিকানা দেখেন। রেলগাড়ি প্রথমে, তারপর পায়ে হাঁটা।
এত লোক বা দর্জি থাকতে আপনি আমাকে কাজটা দিচ্ছেন কেন? আপনার এলাকায় কি আর কোনো দর্জি ছিল না?
ছিল। কেন দিলাম সেটা বলব না। আপনি মন দিয়ে কাজ করবেন সেটা জানি। যাবার খরচ দিলাম। আর আগাম দুই হাজার টাকা। আপনি কাল থেকে কাজ শুরু করেন।
আপনি একটু বসেন। চা-পানি -। লোকটা বলে – না। এখন আমি যাই। এই বলে দরজা খুলে লোকটা যেন অন্ধকারে হারায়। লোকটা যে সত্যি এসেছিল তার প্রমাণ তো এই ম্যাটেরিয়াল আর আগাম দুই হাজার টাকা। হালিমা ঘুম থেকে ওঠে প্রশ্ন করে – কে বাবা?
একজন খরিদ্দার। কোট আর প্যান্ট বানাতে চায়।
ও। খুশি হয় হালিমা। – যাক একটা ভালো কাজ পাইলা। তিনি কী চিমত্মা করতে করতে বাইরে আসেন। না লোকটা নেই। চলে গেছে। অন্ধকারে কোনো মানুষের ছায়া নেই। তিনি দাঁড়িয়ে থাকেন। তারপর ভেতরে আসেন।
বলেন মেয়েকে – তোকে নতুন জামা বানিয়ে দেবো রে মা। আর সেই ওষুধটা আনব যা আনতে পারছি না পয়সার অভাবে।
আর তোমার জন্য কী কিনবা বাবা?
আমার কিছু লাগবে না। পাশের চকি থেকে বলেন।
রাতে কিসব অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেন কুতুব মিয়া। কে যেন বরফের বিছানায় ঘুমিয়ে আছে। তারপর একটা ধারালো চাকু। চাকুটা কেমন যেন বাঘের মতো চোখে তাকে তাকিয়ে দেখছে। শূন্যে ঝুলছে একটা চাকু। তিনি আয়তুল কুরশি পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে ডান কাত হয়ে ঘুমান। হালিমার মাও এমন করত। মেয়েটার ঘুমের শব্দ শোনেন। তারপর এপাশ-ওপাশ করতে করতে ঘুমিয়ে যান কুতুব মিয়া। একসময় সকাল হয়।
পরদিন থেকে মন লাগিয়ে তিনি কাজ করতে গিয়ে বোঝেন ম্যাটেরিয়ালটা সত্যিই অচেনা। কখনো মনে হয় গাছের বাকল। কখন মনে হয় সাপের ছাল। কখনো মনে হয় বাঘের চামড়া। আবার কখনো মনে হয় এটা কোনো চেনাশোনা প্রাণীর চামড়া নয়, একেবারে অজানা কোনো প্রাণীর চামড়া। তবু যে ডিজাইনটা রেখে গেছেন মুনশী আবদুল হাকিম, সেটা দেখে কাপড়টা ধারালো কাঁচিতে কাটেন। কাঁচিটাকে নতুন করে শান দিয়ে নিতে হয়। একটা চকচকে সোনালি আভা সেই ম্যাটেরিয়ালে। যেন ম্যাটেরিয়ালের অন্তরে একটা গোপন সোনালি আলো আছে কোথায়। ঠিক যখন প্রথম সূর্য ওঠে তেমন চমৎকার শিশুরোদ। তিনি একটু অন্যমনস্ক হতেই সুইটা আঙুলে ঢুকে যায়। টুপটুপ করে দুই ফোঁটা রক্ত পড়ে সেই ম্যাটেরিয়ালে। তিনি ভয় পান। এখন যদি দাগ না ওঠে? তিনি তাকিয়ে ভাবছেন কী করবেন, হঠাৎ দেখেন একটা সোনালি আভা এসে কাপড়টার ওপরের রক্তের দাগটাকে এমন করে শুষে নিয়েছে, ওখানে যে কখনো কোনো রক্তের দাগ ছিল তা মনে হয় না। তিনি অবাক হন। হালিমা এক মগ চা আর দুটো বিস্কুট এনেছে বাবার জন্য। ও তাকিয়ে দেখে। বড় বড় চোখে বলে – বাবা এটা তো মনে হয় জাদুর কাপড়। তিনি গম্ভীর গলায় বলেন – এসব নিয়ে কারো সঙ্গে কিছু আলোচনা করবা না হালিমা। এটা যে একটা নতুন কিছু সেটা আমি প্রথমেই বুঝতে পেরেছিলাম।
কার সঙ্গে আলোচনা বাবা? আমার তো কোনো বন্ধু নাই যে এসব নিয়ে আলাপ করব। কেবল রহিমাখালা মাঝে মাঝে আসেন।
ওই খালাকেও বলবা না।
না বাবা।
মেয়েদের পেটে তো কথা থাকে না। খবরদার এসব কথা – বাবা একবার বলছ আবার বলার দরকার নাই। আমি কারো সঙ্গে আলাপ করব না।
তিনি মন দিয়ে ডিজাইন মেনে কোটটা কাটেন। যেসব টুকরো কাপড় এসব কাটাকাটিতে পড়েছে, সেগুলো যত্ন করে তুলে একটা পস্নাস্টিকের ক্যারিয়ার ব্যাগে রাখেন। মুনশী আবদুল হাকিম সবগুলো টুকরো কাপড় চেয়েছেন।
রাতেও কাজ করেন। সব সেলাই নিজের হাতে করেন। এ-জিনিস সেলাই মেশিন দিয়ে হবে না। সেটা প্রথমেই বুঝেছিলেন। চোখ জ্বালা করে। ছানিপড়া চোখ উপেক্ষা করে তিনি চোখে পানি দিয়ে পোশাক বানাতে থাকেন।
এই করতে করতে পনেরো দিনের মাথায় একটা কোট আর একটা প্যান্ট বানানো শেষ হয়। তিনি তাকিয়ে দেখেন। এ কোট আর প্যান্ট যার জন্য করা হয়েছে সে একজন বারো-তেরো বছরের ছেলে। কিংবা আরেকটু বেশি। মুনশী আবদুল হাকিমের এই বয়সের একটা ছেলে আছে? দেখে তো মনে হয় বুড়ো। বুড়োর ছেলে? না নাতি? সে যাক, শেষ হলে আরো আট হাজার টাকা! পুরোটা শেষ হয়ে যাওয়ার আনন্দে পিঠ টানটান করে দাঁড়ান। মেয়েকে বলেন – আগামীকাল এটা দিতে যাব। তিন স্টেশন রেলগাড়ি, তারপর এক মাইল হাঁটা। আমি রাতের মধ্যেই ফিরে আসব। তুই দরজা বন্ধ করে ঘরে থাকিস। ভয় পাস না।
না বাবা। আমি ভয় না পাওয়ার দোয়া জানি।
তিনি মেয়েকে একটু আদর করেন। বলেন – আমার হালিমা মা, আমার কলিজার টুকরো জানে কীভাবে নিজেকে দেখেশুনে রাখতে হয়।
স্টেশন থেকে নেমে ভাবনগর যেতে তিনি একটু পথ হারিয়ে ফেলেন। শেষ পর্যন্ত একটা চায়ের দোকানে ঢোকেন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। এটা ডেলিভারি দিয়ে রাত এগারোটার ট্রেনে তিনি ফিরে যাবেন। একটা লোক চা-পান করছে। তিনি তাকে মুনশীর ঠিকানা দেখান। লোকটা বলে – ওকে আমি চিনি। ও তো প্রায় বিশ বছর হিমালয়ে কোনো এক সাধুর চেলা হয়ে ছিল। তারপর ফিরে এসে বিয়ে করে। তেরো বছর আগে একটা ছেলে হয়। বউটা মারা যায়। এখন বাপ আর ছেলে। ও চায় না, আমরা কেউ ওকে বিরক্ত করি। আপনমনে কী করে কে জানে। ছেলেটাকেও স্কুলেটুলে দেয়নি। ওর খবর তো বেশ কিছুদিন আমি জানি না। নিজের ছেলেটাকে কখনো বাইরে বের হতে দেয় না। তবে সেটা ওর ব্যাপার।
চাওয়ালা যোগ দেয়। বলে – মাঝে মাঝে দেখা যায় বাজারে। নিজের মনে বাজার করে বাড়িতে চলে যায়। বড়ই অদ্ভুত একজন। দু-একজন আলাপ করতে চেয়েছিল, বোধহয় সাধু-সন্ন্যাসীর গল্প শুনতে চেয়েছিল। হিমালয়ে বিশ বছর কী করল লোকটা। সকলে বলে ও নানারকম অসুখ সারানোর ওষুধ জানে। কিন্তু সে-কথা ওকে কে প্রশ্ন করবে? আর প্রশ্ন করলেই ও উত্তর দেবে নাকি? ও তো বাড়ির দরজা বন্ধ করে রাখে। ছেলেটাকেও এমন করে মানুষ করছে। বাবার কথামতো বা ইচ্ছামতো ছেলেটার জীবন চলছে। বোধকরি নিজে যেসব জানে সব ছেলেটাকে শেখাবে। তাই স্কুলে দেয়নি। ওরা দুজন মিলে মুনশীর বাড়ি যাওয়ার রাস্তাটা দেখিয়ে দেয়। কুতুব মিয়া বুঝতে পারেন, একটা ভুল বাঁক নেওয়ার জন্য ও পথ হারিয়ে ফেলেছিলেন। বড় ব্যাগে কোট আর প্যান্ট। কুতুব মিয়া বলেন – না পেলে চলে যাব। বাড়িতে ছোট একটা মেয়ে রেখে এসেছি। বলেন না, কী দিতে এসেছেন। বলেন কেবল – দেখা হলে ভালো। না হলে অসুবিধা নেই। এমন ভাব করেন লোকটাকে না দেখলে ওর কোনো ক্ষতি নেই। আর ওর সঙ্গে যে-জিনিস আছে সে নিয়েও কোনো কথা বলেন না। জানেন, এ-কথা গোপন রাখা ভালো। এটা যে একটা বিশেষ গোপনীয় ব্যাপার, সে-কথা তো তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।
একটা বড় মাঠের শেষ প্রান্তে বাড়িটা। আশপাশে আর কোনো বাড়ি নেই। কেবল নানাসব গাছে ঘেরা একটা পুরনো বাড়ি। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে কুতুব মিয়া গাছগুলো দেখেন। ফলফলারি এ ছাড়া নানা ঔষধি গাছ। বড় বড় পেয়ারা আর জামরুলের গন্ধ। আতাফলের মতো কোনো পাকা ফলের গন্ধ পান। একটা গাছে মাংসের টুকরোর মতো কী যেন ঝুলে আছে। এ আবার কেমন গাছ? মনে মনে বলেন এবং আরো সব অদ্ভুত গাছ ওর চোখে পড়ে। গাছের ফাঁক দিয়ে একটা বড় চাঁদ তাকে দেখছে। সে-আলোতে ঝিমঝিম করছে গাছ, বাগান, চারপাশ। তিনি বেশ কিছুক্ষণ সেসব দেখেন। বুঝতে পারেন, অনেক দুর্লভ গাছ আছে ওর বাগানে। অনেক দুর্লভ লতাগুল্ম। একসময় দরজায় বেল টেপেন। ভেতরে টিংটিং আওয়াজ হয়। দরজায় মুনশী আবদুল হাকিম। তিনি কুতুব মিয়া ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে দরজা বন্ধ করেন। কুতুব মিয়া বলেন – এতসব গাছপালা। বারান্দাতেও গাছ। উঠোনে গাছ। মুনশী বলেন – ওসবই আমাদের ভবিষ্যৎ। খাবার এবং বাঁচার। আমি সবকিছু লিখে যাব, এসব গাছের কথা, লতার কথা। আরো নানা কিছু তারপর বলেন – এনেছেন? কুতুব মিয়া ব্যাগটাকে সজোরে আঁকড়ে বলেন, আগে আমার টাকা দিন। মুনশী কেমন একটু বিব্রত। বলেন, ভেবেছিলাম কিছু টাকা পাব, পাইনি। ভেতর বাড়ির ভেতরেও নানা গাছগাছড়া। বলেন, আমি একটা বই লিখছি। এই একটি বই মানবজাতিকে বদলে দিতে পারে। মানুষ অনেকটা ঈশ্বর হয়ে যেতে পারে।
ওসব শুনতে চাই না। আগে টাকা। তারপর অন্য কথা। মানুষ ঈশ্বর হতে পারে; কিন্তু আমি টাকা না নিয়ে এ-জিনিস দেবো না।
আপনার কি লেখকের জন্য কোনো সম্মান নাই?
আছে এবং আমার নিজের পেটের জন্যও মায়া আছে। মেয়েটা -। থাক, ওসব শুনে আপনি কী করবেন। টুকরো কাপড়গুলোও এনেছি। টাকা দেন, এসব দিয়ে আমি চলে যাব। আমি আলাপ করতে আসিনি। একটা অসুস্থ মেয়েকে বাড়িতে রেখে এসেছি।
হাত বাড়ান মুনশী। বলেন, আমি টাকা দেবো। অনেক টাকা দেবো। কেবল আপনি একটু ধৈর্য ধরেন। আমাকে একটু বিশ্বাস করেন। আমাকে একটু সময় দেন। আপনি ঠকবেন না।
পনেরো দিনের অমানসিক পরিশ্রম। বাড়িভাড়া। মেয়ের ওষুধ। পেটের ক্ষুধা। দীর্ঘ পথ এসে ডেলিভারি। বলেন কুতুব উদ্দিন – না দিলে আমি জিনিস নিয়ে চলে যাব। কেমন যেন হিংস্রভাবে মুনশী তাকান। অন্ধকারে তার দুই চোখ জ্বলে ওঠে। বুড়ো নয়, ভয়ানক এক তরুণের মতো তিনি কুতুব উদ্দিনের ওপর লাফিয়ে পড়তে চান। বলেন হিংস্রভাবে, অসহায়ভাবে – আপনি কিছুতেই ও-জিনিস নিয়ে চলে যাবেন না।
হঠাৎ লাগোয়া ঘরখানায় কিসের যেন শব্দ। তিনি তাড়াতাড়ি সে-ঘরে উঁকি দেন। একটা বেড়াল ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। তিনি তাকান। বিরাট বড় এক কাঠের বাক্স বরফে ভর্তি। তার ভেতরে একজন তেরো বছরের ছেলে শুয়ে আছে। মনে হয় মৃত। কুতুব উদ্দিন আঁতকে ওঠেন। এই সেই স্বপ্নের ছেলে। তিনি বলেন – আপনি তো একটা খুনি। নিজের ছেলেকে মেরে ফেলে এভাবে বরফে রেখে দিয়েছেন। আগে জানলে –
আমি খুনি না। মুনশী আবদুল হাকিম গম্ভীর গলায় জানান। ও মারা গেছে। হঠাৎ হার্ট বন্ধ হয়ে। যে-ছেলেকে আমি আমার সব বিদ্যা-বুদ্ধি দেবো বলে ঠিক করেছি, সে মারা গেছে। আমার একমাত্র ছেলে। আমার উত্তরসূরি। যে আমার সবকিছু প্রচার করবে, যে আমার সবকিছু একদিন জানবে। এ-দুঃখ আমি কোথায় রাখি। আপনাকে বললাম তো, আমি একজন বিশেষ মানুষ। বইটা আগে লেখা হোক। তবে আমার ছেলে অবশ্যই আমার রেখে যাওয়া কাজগুলো করবে। আমি যেসব নিয়ে অনেক ভেবেছি। অনেক গবেষণা করেছি।
মিথ্যাবাদী। ছেলেটাকে মেরে বরফে রেখে দিয়েছেন। তারপরও বলছেন ও সব করবে? পাগল তো আপনি। ঘোর উন্মাদ। কবর দেননি কেন? ও, ধরা পড়ার ভয়?
না না, ওকে কবর দিতে চাই না। ও আমার ছেলে। আমার ভবিষ্যৎ, আমার স্বপ্ন।
আপনি শুধু খুনি নন, মিথ্যাবাদী। ঘোর উন্মাদ! তাই তো বলি, এত লোক থাকতে আপনি আমাকে খুঁজে বের করে এসব বানাতে দিয়ে এলেন কেন। ভাবছেন, আমি চুপচাপ কিছু না বলে পোশাকটা দিয়ে চলে যাব? একটা গরিব দর্জি! আপনার ধমকে ভয় পাব। সেটা হবে না। মৃত ছেলের জন্য এসব? ঠাট্টার তো একটা সীমা আছে। আপনি একটা মহা স্যাডিস্ট। আমি এখনই যাব এবং গিয়ে পুলিশকে বলব, আপনি কী কা- করেছেন। নিজের এলাকা বাদ দিয়ে আমাকে কেন এটা দিয়েছেন এবার সেটা বুঝতে পারছি।
না, আপনি যাবেন না। আপনি কোট-প্যান্ট দেবেন, তারপর যাবেন। মুনশী আবদুল হাকিম একটা ছুরি হাতে। দপদপ করছে তার দুই চোখ। আপনি যদি এটা না দিয়ে যেতে চান, প্রাণে বাঁচবেন না।
পাগল নাকি। আপনি কি পাগল! আপনার মৃত ছেলে এসব পরবে?
আপনি যা জানেন না সেসব নিয়ে কথা বলবেন না। মুনশী চাকু-হাতে কাছে এগিয়ে আসছেন। একটা হারিকেন জ্বলছে। বাতি নেই। অবাক দরজার ওই বেলটা তাহলে বিদ্যুতে চলে না।
মুনশী কেবল ঝাঁপিয়ে পড়তে চান বাঘের মতো গর্জন করে, গর্জন কেবল বাঘের মতো নয়, তাকে দেখতেও লাগছে বাঘের মতো। দপদপ করছে চোখ। তিনি যেন আগের চেয়ে লম্বা আর শক্তিশালী হয়ে গেছেন। মাথার চুলগুলো মাথার ওপর দাঁড়িয়ে গেছে। তিনি কেবল ঝাঁপিয়ে পড়বেন, তখনই কোটের পকেট থেকে একটা ধারালো চাকুতে মুনশীর কলিজা বিদীর্ণ করেন দর্জি কুতুব মিয়া। কেঁচিটা এনেছিলেন, যদি এখানে কিছু কাটাকাটি করতে হয়। বরফের ভেতরে সেই তেরো বছরের ছেলে কি একবার নড়ে ওঠে? তারপর সব শেষ। বেড়ালটা বাড়ি থেকে চলে গেছে। একটা অচেনা পাখি খাঁচায় পাখায় মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে আছে। কয়েকটা গিনিপিগ একটা খাঁচায়। হারিকেন এই ধস্তাধসিত্মতে মাটিতে পড়েছে। কেরোসিন গড়িয়ে পড়ছে। কুতুব মিয়া পাগলের মতো বাড়ি থেকে বের হন। খানিক পর বাড়িটা পুড়ে যাবে। পুড়ে যাবে মুনশী আবদুল হাকিম আর তার মরা ছেলে। টেবিলে যে-বইটা দেখেছিলেন সেটাও পুড়বে। কুতুব মিয়া জানেন না, এই পৃথিবীর একটি অত্যন্ত মূল্যবান বই এসবের সঙ্গে ছাই হয়ে যাবে। পৃথিবীর কোনো মানুষ এমন একটা বইয়ের কথা জানবে না। বিশ বছর ধরে যা জেনেছিলেন মুনশী আবদুল হাকিম তার সব জানা, সারাজীবনের যত জানা, যত জ্ঞান সব তিনি এই বিশাল গ্রন্থে ঢেলে দিতে চেয়েছিলেন। কেউ জানবে না কী শেষ হয়ে গেল এ-মুহূর্তে।
কোনোমতে মাঠের ভেতর দিয়ে ছুটতে ছুটতে কুতুব মিয়া স্টেশনে আসেন। পিছু ফিরে দেখতে পান বাড়িটা পুড়ছে। আগুনে জ্বলছে একটা বাড়ি। একজন জীবিত আর মৃত মানুষ। আর একটি গ্রন্থ। তিনি ছুটে চলে আসেন স্টেশনে। ট্রেন এসে যায়। তিনি লাফ দিয়ে ট্রেনে ওঠেন। পকেটে রক্তাক্ত চাকু। আর সারাশরীরে জবজবে ঘাম।
মেয়েটা জেগে ছিল। বলে – বাবা টাকা পেলে?
তিনি কিছু বলেন না। এরপর ব্যাগ থেকে কোট আর প্যান্ট বের করে ম্যানিকিনটাকে পরান। এগুলো ওর গায়েই থাক। যদি কেউ কিনতে চায় দেবেন। সোনালি আলোর দ্যুতি সেখানে। ঝকঝক করছে সেই অদ্ভুত ম্যাটেরিয়ালের পোশাক। ম্যানিকিনের কালো চুল আর কালো চোখ তাকে দেখছে।
ওনাকে দিলে না এসব? মেয়ে প্রশ্ন করে।
না। এই বলে তিনি বিছানা খোঁজেন। মেয়ে বুঝতে পারে, কোথাও একটা বড় গোলমাল হয়েছে।
ক্লান্ত কুতুব মিয়া বিছানায় যান। সারাদিন না খাওয়া। শূন্য পকেট। ক্লান্তিতে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন আচ্ছন্ন হয়ে।
সাতদিন পরে একটা কাজের অর্ডার নিয়ে বাড়ি আসছেন। রাত প্রায় বারোটা। বড় কাজ। মনটা প্রসন্ন। ঘরের কাছে আসতেই মেয়ের খিলখিল হাসি শুনতে পান। মেয়েটা কার সঙ্গে যেন গল্প করছে। বলছে – বাবা যখন থাকবে না, এভাবে আমরা গল্প করব। কেমন? অন্যপক্ষের গলা শোনা যায় না। বলে হালিমা – বাবাকে বলার দরকার নেই। এই পৃথিবীতে থাকব কেবল তুমি আর আমি। তুমি আর আমি এই বিশ্বের সেরা বন্ধু। বন্ধু আরো কাছে আসো। এই পৃথিবীতে আমার আর কাউকে দরকার নেই। মেয়েটা এমনসব কথা কবে শিখল? ডাক্তার যা বলেছিলেন সে-কথা ভেবে তিনি আতঙ্কিত। দরজা খুলে মেয়েটাকে বকতে যাবেন এমন সময় চমকে তাকান – হেঁটে হেঁটে কাঠের ম্যানিকিন মেয়েটার বিছানার কাছে চলে এসেছে। মেয়েটা অবশ্যই ওই ভারী ম্যানিকিনটাকে এখানে আনতে পারে না। জীবন্ত মানুষের মতো তাকিয়ে আছে সেই ম্যানিকিন কুতুব মিয়ার দিকে। তার গায়ে সেই কোট আর প্যান্ট। সোনালি আলো ঠিকরে পড়ছে সেই কোট থেকে। আর সে-আলোয় ঘরটাও কেমন উজ্জ্বল মনে হয়। কাঠের ম্যানিকিনে প্রাণ এসেছে। এই পোশাকে? তিনি বিড়বিড় করেন? এই পোশাকে ছেলেকে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন আর এক জগৎ থেকে। আর সেসব কথা লিখে রেখেছিলেন বইটায়, যা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তার মাথা ঝিমঝিম করছে। কোন গুপ্তবিদ্যা শিখে এসেছিলেন এই মুনশী আবদুল হাকিম কে জানে? হঠাৎ চমকে তাকান হাত বাড়ায় ম্যানিকিন কুতুব মিয়াকে শেষ করে দেবে বলে। তিনি নড়তে পারছেন না। সম্মোহিত। জ্বলজ্বলে চোখে তাকে দেখছে সেই বিশেষ ম্যানিকিন।
মেয়েটা বাবাকে রক্ষা করবে বলে এগিয়ে আসে না। মুনশী আবদুল হাকিমের নকশায় আর তারই দেওয়া বিশেষ ছালবাকলে বানানো পোশাকে সেই প্রাণ পাওয়া ম্যানিকিন মনে হয় আর কাউকে সহ্য করবে না।