লীলা

বিজলি বাত্তি – ইলেকট্রিক আলোর কোনোরকম গুঞ্জাইশ নেই কোথাও। যেটুকু যা রোশনাই, সবই তো পেট্রোম্যাক্স, ডে লাইট, নয়তো হ্যাজাক থেকে। আলোর জন্য আগুন জ্বাললেই তা থেকে অবিরাম একটা শোঁ-শোঁ – শোঁ-শোঁ শব্দ ছুটে এসে কানের ভেতর ঢুকে প্রায় পরদা ফাটিয়ে দিতে চায়। সেইসঙ্গে আছে হ্যাজাক পাম্প দেওয়ার একঘেয়ে ঘস ঘস ঘস ঘস শব্দ। এই দুটো – দুধরনের আলাদা আলাদা আওয়াজ ক্রমশ জড়িয়ে গিয়ে মিশে যেতে চায় বাতাসে।

আগুন ক্রমশ তার স্বভাবধর্মে হয়ে ওঠে আলো। সেসব আগুনে আলোর হাতছানির ওপর উড়তে উড়তে এসে আছড়ে পড়ে মরতে চাওয়া আলোপোকারা মওতের আগে আগে দূরে দূরে দলবেঁধে, কখনো-সখনো-ক্বচিৎ কখনো একা একাই চক্কর কাটতে থাকে অগ্নি আর আলোছায়ার নান্দীরোলের মধ্যে।

এরই মধ্যে আগুনে বাতির গায়ে হালকা ঠোক্কর খেয়ে যে পোকারা প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মুখ থুবড়ে পড়ে, তাদের দিকে আলাদাভাবে তাকানোর সময় নেই কারো। এমনকি এসব আলো-কীটেরা মরে যেতে যেতে কি এক পট পট পট পট, ফট ফট ফট ফট করে এক ধরনের হালকা হালকা – আবছা শব্দ হয়ে যায়, সেই দিকেও তাকিয়ে দেখার, নজর করে করে মরুঞ্চে শব্দ শোনার সময়ই-বা কোথায়?

ভাদো – ভাদ্রমাস খতম হয়ে আশ্বিন এসে গেল। তবু বাতাসে এখনো ভ্যাপসা, ঝিমঝিমে ভাদুরে গরম মিশে আছে।
ভাদো-সংক্রান্তির দিনই তো বিশ্কর্মা – বিশ্বকর্মা পূজা। তা বনারসের এই ভেলুপুরায় বেশ কয়েক বছর ধরেই বিশ্কর্মাজিকা পূজা হয়, বেশ কয়েকটা। দফতরউফতর-অফিসউফিস – সব আছে না। ভাদো-সংক্রান্তির পরই তো ক্যালেন্ডারে নিয়ম অনুযায়ী পয়লা আশ্বিন। আশ্বিনের মাসপয়লা। তারপরই তো আশিন মাহিনার দো – দু তারিখ। এই দোসরা আশ্বিন থেকেই তো শুরু হয়ে গেল লীলা।

প্রতি রাতে – ব্যাসকাশী মানে রামনগরে। তুলসীদাসজির রামচরিত মানসের অযোধ্যাকা-, কিষ্কিন্ধ্যাকা-, উত্তরকা- – সবকিছু একটু একটু একটু একটু করে ফুটে উঠতে থাকবে লীলায়, প্রকাশিত হবে।

সাধু-মহাত্মারা এমনিতেই বলে থাকেন – কাশী হলো গিয়ে প্রকাশী। সবকিছুই প্রকাশিত – বিকশিত – ফুটে ওঠে এই বারাণসী ধামে। তা সে সাধু, প–ত, গণিকা, বাইজি, নর্তকী – তওয়ায়েফ-কোঠাওয়ালি – যাই বলা যাক না তাদের, সেইসঙ্গে গণতকার – জ্যোতিষী, গায়ক, বাজনদার – বাজনা বাজিয়ে, পহেলওয়ান – যেই হোক না কেন, প্রকাশের জন্য – নিজের প্রচারের জন্য তাকে তো কাশীধামে আসতে হবেই হবে। এ-কথা অনেক অনেক যুগ ধরেই ঘোরেফেরে কাশীর বাতাসে।

কাশীর রাজা – কাশী নরেশ তাঁর লোকজন-তোপচি দিয়ে নিজের তোপ দাগান – কামান দেগে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন, লীলা শুরু হওয়ার দিনটিতে।

ধু-উ-ড়ু-ম – ধু-উ-ড়ু-ম – ধু-উ-ড়ু-ম – কাশীরাজের হুকুম মোতাবেক তিন তিনবার তোপ ডেকে উঠলে, সেই গর্জনের রেশ উত্তরবাহিনী গঙ্গার এপার-ওপার – দু-পাড় থরথরিয়ে দিলে তারপরই তো লীলা শুরু।

বনারসের ভেলুপুরার কেদারঘাট থেকেও শোনা যায় কামান দাগার সেই অতিগুরুগম্ভীর – কানের পরদা প্রায় ফাটিয়ে দেওয়া আওয়াজ। সেই গুরু-নিনাদে দু-কানের ভেতর তালা লেগে যাওয়ার দশা – হালত প্রায়।

এসবই জানা আছে ভেলুপুরায় রাস্তার ওপর, বলতে গেলে রাস্তা ঘেঁষে দাঁড়ান গলেস্নকা দুকান – মুদিখানার মালিক মহেশপ্রসাদ জয়সোয়ালের। মহেশপ্রসাদরা আদতে ইলাহাবাদের মানুষ। তার পরদাদা-ঠাকুরদার বাবা জগদীশপ্রসাদ মিউটিনি – বাগি সিপাহিদের জং শুরু হতে না হতেই ইলাহাবাদ ছেড়ে তুলনায় কম বগাবতের সম্ভাবনাঅলা জায়গা বনারস চলে আসেন। জগদীশপ্রসাদের বন্ধকী – ব্যায়াজ উসুলের কারোবার ছিল। তিনি বেঁচে ছিলেন মাত্র সাঁইত্রিশ বছর। ব্যায়াজ – সুদের হিসাব নিয়ে কোনো একজনের সঙ্গে দাঙ্গা-ফাসাদে তিনি বেশুমার ঘায়েল হন। জগদীশপ্রসাদ জয়সোয়াল জাতে সোনার – স্যাকরা না হলেও কর্মচারী, কারিগর রেখে সোনা-চান্দি – সোনা-রুপোর জেবর – গহনা তৈরি, কেনা-বেচা, সেইসঙ্গে চড়া সুদে টাকা ধার দিয়ে বন্ধকীর ব্যবসা করতেন। সোনে-চান্দির সিক্কা – আকবরি – আকবর বাদশার সময়কার সোনার মোহর, জাহাঙ্গীর বাদশার আমলের সোনে কা সিক্কা, ডুকাট মোহর, এমনকি আকবর বাদশার অতি পেয়ারা – লাডলা শেখুবাবা – জাহাঙ্গীরের লাড পেয়ারের বিবি নূরজাহান বেগমের মুখছাপা মোহরও ছিল তাঁর সংগ্রহে।

এই মানুষটি কাশীর রাস্তায় দু-দু-দুজন তলোয়ার আর লাঠিধারী, বড়া মুছেদার পহেলওয়ান সঙ্গে নিয়ে ঘোরাফেরা করতেন, দুশমনের মোকাবিলা করার জন্য। এছাড়া নিজের কাছে তিনি কিরিচ আর তামানচা – তখনকার পিস্তল রাখতেন। তবু শেষ রক্ষা হলো না কিছুতেই। ব্যবসায়িক রেষারেষি – দুশমনির ফলে তুমুল হামলা – জানলেবা হামলা – প্রাণঘাতী হানাদারি হয়ে গেল তাঁর ওপর। সঙ্গের পহেলওয়ানরা কিছু করতে পারল না। হামলাদাররা
এসেছিল তিন দিক থেকে, তাজা – দমদার আরবি ঘোড়ায় চেপে। পরদাদা জগদীশপ্রসাদ জয়সোয়াল সেই মহাখতরনাক হামলাতেই প্রায় মারা পড়লেন!

অনেক কবিরাজি-হেকিমি দাওয়া, খান-পান, লেপন – কিছুই তার গহেরা ঘাওকে অতিসহজে সারাতে পারছিল না, তার ওপর কপাল থেকে মাথা বেরিয়ে, সেইসঙ্গে সঙ্গে কলিজা-বুকের আঘাত-চোট ছিল অতিগভীর – গহেরা। প্রচুর রক্তপাত – খুন বহেছিল সেই আঘাতে। একদম মার খুন মার খুন – একেবারে খুনে খুনে লথপথ – ভেজা যাকে বলে, সেরকম একটা অবস্থা।

কবিরাজ-হেকিমদের পরামর্শে দাওয়া-দারু, মলমপট্টি করে অনেকটা সেরে উঠতে উঠতে কী যে হলো জগদীশপ্রসাদ জয়সোয়ালের, সিনা – বুকে অতিতীব্র ব্যথা, তারপর চোখের সামনে সব কেমন অন্ধকার হয়ে গেল, এরপরই তো সব শেষ।

মণিকর্ণিকায় – মহাশমশানঘাটে আলিশান চিতা জ্বলল জগদীশপ্রসাদ জয়সোয়ালের, চন্দন কাঠের চিতা। মণ মণ কাঠ আর ঘি পুড়ল শমশান-ক্রিয়ায়। মহেশপ্রসাদের তিন তিনজন পরদাদির মধ্যে কেবল বড় পরদাদি মোহিনী মণিকর্ণিকায় চিতায় উঠে ‘সতী’ হলেন পরদাদা জগদীশপ্রসাদের সঙ্গে সঙ্গে।

এসব গল্প কথায় কথায় – কথার ফেরে কানে এসেছে মহেশপ্রসাদের। জগদীশপ্রসাদের তিন বউ মিলিয়ে ছিল সাত ছেলে, তিন মেয়ে। তারা বড় হতে লাগল দুই মায়ের ছায়ায়।

দাদারা বড় হলে বন্ধকী – সোনা-চান্দি, গহনা, জেবর, মণি-মাণিক্য – হিরে-পান্না-চুনি – সবকিছু নিয়ে দোকানদারি উঠে গেল আসেত্ম-ধীরে। মানে এই বেওসা – দুকানদারি ক্রমে ক্রমে তুলে দিলেন দাদিরাই – আতংকে।

জগদীশপ্রসাদ জয়সোয়ালকে কতল – খুন করতে আসা কাতিল – ঘাতকদের মধ্যে কেউ একজন – তারা সকলেই তো ছিল নকাবপোশ – কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা। জগদীশপ্রসাদের ওপর সেই জানলেবা – প্রাণঘাতী হামলা চালান কাতিলদের মধ্যে জনাদুই গুর্রায়ে – চাপা গর্জনের সঙ্গে সঙ্গে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বলেছে, শালে কালোয়ার! ইলাহাবাদ সে বনারস আকে সোনার বনকে ব্যয়ঠে হ্যায়। জগদীশপ্রসাদের প্রথমা স্ত্রী মোহিনী কাশীর কন্যা। সংকটমোচনের কাছাকাছি তার ম্যায়কে-বাপের বাড়ি। খুব মন দিয়ে চশমুদ্দি গাওয়া – প্রত্যক্ষদর্শীদের কথা শুনেছে মোহিনী। তারপর যা বোঝার বুঝে নিয়েছে।

নিজে স্বামীর সঙ্গে সহমরণ – চিতারোহণে যাওয়ার আগে মোহিনী প্রায় মাসখানেক সময় তো পেয়েইছে। সেই কালখ–ই তো একটু একটু করে সুস্থ হয়ে উঠছিল জগদীশপ্রসাদ কবিরাজি আর হেকিমি দাওয়া-দারু, খান-পান, মলমপট্টিতে।

দাওয়ার সঙ্গে অনুপানের আয়োজনও অনেক। পেতলে তৈরি ছোট, মাঝারি হামান-দিস্তা, পাথরের খলনুড়ি – তার মধ্যে খাঁটি শহদ – মধু, মকরধ্বজ, সোহাগা, মুক্তভস্ম, স্বর্ণভস্ম, সেই সঙ্গে প্রলেপ দেওয়ার জন্য নানারকম প্রাকৃতিক তেল, মলমপট্টি করার জন্য কত কত পানপাতা যে আনান হলো, বঙ্গাল মুলুক থেকে! আর এসবই তো হয়ে চলল মোহিনীর চোখের সামনে – অনেকটা তারই তত্ত্বাবধানে, নির্দেশে।

সোনার দোকান, সোনে-চান্দি, আশরফি, হীরা, জেবরাত, ব্যায়াজখোরি – টাকা দাদন দিয়ে তা থেকে চড়া দরে সুদ জোগাড় করা – এসবই জয়সোয়ালরা ছাড়ল – মানে ছাড়তে বাধ্য হলো ওই মনহুস – ভয়ানক হামলাদারির পর। জগদীশপ্রসাদের দেহান্তের পর মণিকর্ণিকায় শমশানঘাটে স্বামীর সঙ্গে চন্দনের চিতায় চড়বার আগে তার আরো দুই জা – সদ্য বেওয়া – সবে বিধবা হওয়া সুনেত্রা আর কৌশল্যাকে বলে গেছে মোহিনী এই
সোনে-চান্দি, জেবর-জেবরাত, আশরফি, বন্ধকী কারবার – সবকিছু – সবটাই ধীরে ধীরে তুলে দিতে। দুই বিধবা সহমরণে যাওয়ার আগে তাদের বড় জায়ের দেওয়া শলাপরামর্শ মাথা নিচু করে মেনে নিল। সোনা-রুপো-হিরে-জহরত, মোহর-আশরফির কারোবার একটু একটু করে কাপড়ের দোকানদারির মধ্যে নিজেকে মিশিয়ে দিলো। বেনারসি শাড়ির ব্যায়পার – দোকানদারি, সেই সঙ্গে কাশীর রেশম – সিলিক – আংরেজ – ফিরিঙ্গিরা যাকে বলে সিল্ক। দাদা – ঠাকুরদা গণেশপ্রসাদ কবিতা লিখতেন কাপড় – বেনারসি ব্যবসার গদি সামলে।

তিনি ছিলেন তখনকার কাশী নরেশের বন্ধু। পূর্বতন কাশীরাজের সঙ্গে বন্ধুত্ব – দোস্তানির সূচনা হয়েছিল জগদীশপ্রসাদের সময়ই। অনেক অনেক নজরানা – ভেট – উপঢৌকন দিয়ে তিনি তৎকালীন কাশী নরেশের মন জিতে নিয়েছিলেন। হয়ে উঠেছিলেন তাঁর অন্যতম প্রিয় বয়স্য। এই বয়স্য হয়ে ওঠার পেছনে আকারে বড়সড় বেশ কয়েকটি হিরের উপহার খানিকটা অতিরিক্ত আলো দেখিয়েছিল, এমন কথা কোনো কোনো ঠোঁটকাটা-নিন্দুক – দুর্মুখেরা বলে থাকে।

তো সে যাই হোক, ভেলুপুরায় বড় রাস্তার ওপর মহেশপ্রসাদের গলেস্নকা দুকান। সোনে-চান্দি, আশরফি, জেবরাত-জহরতের লেনাদেনা, সে তো কবেই খতম হয়ে গেছে জগদীশপ্রসাদের বেমওত দেহান্ত – অপঘাত মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে। বন্ধকী কারোবার, ব্যায়াজ – টাকা দাদন দিয়ে তার বদলে গুনে গুনে সুদ নেওয়ার বিজিনেস, সেও তো কোন কালেই ঠপ – শেষ। রেশম শাড়ি, সিলিকের অন্য অন্য কাপড় বিক্রি – কেনাবেচা তাও তো বন্ধ হয়েছে বহু বছর। এখন এই গলেস্নকা দুকান – মুদিখানাই সম্বল মহেশপ্রসাদের।

ভেলুপুরা আড়মোড়া ভেঙে, ভালো করে জেগে উঠতে বেশ একটু সময় নেয়। এই ভাদো মাহিনায় সাড়ে ছে, সাত বাজার আগে তেমন করে দুকান লাগে না। ভ্যানে ভ্যানে হরি সবজি – ব্যয়গন, হরিধনিয়া, টমাটর, লউকি – লাউ, কোঁহরা – কুমড়ো, পরোল – পটোল। এসব জিনিসের দাম খুব। মহেঙ্গাই ক্রমশ বাড়ছে। কেউ দেখার নেই। এবার খুব বারিষ হলো। সেই ঘনবর্ষা – প্রবল বারিপাতের পর গঙ্গাজি তার ঘাটের বাঁধন উপচে চলে এলো শহরের ভেতর। কোথাও কোথাও তো এক কোমর, এক কোমর জল। তারপর সেই পানি সরে গেলে গন্দগি, গন্দগি – ময়লা, কিচড় – কাদা, দুর্গন্ধ – বদবু। গন্দগি তো ফ্যায়লাল, সেইসঙ্গে সঙ্গে
রোড-উড – সড়কের অবস্থা একদম খারাপ। রাস্তা দিয়ে অটো, বাইক, সাইকিল – সবকিছু চালানোই দিককত কি বাত।

এই বারাণসী ছেত্র থেকে চুনাও জিতে যিনি এখন হিন্দুস্থানের পরধানমন্ত্রী, তিনি তো কিছুই করলেন না এই শিবছেত্র – শিবক্ষেত্রর জন্য। সড়ক বেহাল, চারপাশে গন্দগি। বিজলির অসুবিধা। এসব কথা হোঁঠ – মুখে আনলেই সেন্টারবালারা বলবে, চুপ যা! ইস রাজ্য কা যো সরকার হ্যায়, ওহি কুছ নহি দেখ রহে হ্যায়। কসুর উসকা হ্যায়, সেন্টার করে গা কেয়া? এসব বহেস – তর্ক-বিতর্ক, এক কথার পিঠে অন্য কথার ছোরা ভোঁকাভুঁকি – ছুরি চালনা, যুক্তি-পালটা যুক্তি শুনতে শুনতে মহেশপ্রসাদের কান বহেরা – কালা হওয়ার উপক্রম। এ ওর ঘাড়ে দোষ চাপায়, তো ও তার ঘাড়ে। আর শেষমেশ আমজনতার ফুটি কৌড়ি – কানাকড়িও জোটে না।

আশ্বিনের গোড়ায় গোড়ায় ভেলুপুরার দোকান-বাজার একটু যেন দেরি করেই জেগে উঠতে চায়। এটাই তার বহু – বহু বছরের অভ্যাস। যদিও গঙ্গাজি নহানের জন্য কেদারঘাটে ভোর ভোর যে লোকজন আসে, সেসব পুণ্যার্থীর ভিড় সারা বছর প্রায় একই রকম। তবে হ্যাঁ, চায় কা দুকান সব খুলে যায় সকাল সকাল।

ভেলুপুরার রাস্তায় রাস্তায় বেওয়ারিশ ষাঁড়েদের অনায়াস পুরীষ ত্যাগ, ছ্যারছেরিয়ে মোতা, রাস্তার কুকুরদের পেট পরিষ্কারের চিহ্ন তো যত্রতত্র। সেই সঙ্গে গরুর গোবর, সাতসতেরো হাবিজাবি – ফলের খোসা, সবজির চোকলা – এসবও তো থাকে।

এই শহরেই দামি আতর দিয়ে দিয়া – প্রদীপ জ্বেলে সেই আলোয় কবিতা লিখতেন কবি হরিশ্চন্দ্র। তিনি কবিতাচর্চা করতেন কাশিকা ভাষায়। কাশিকাতে লেখা তো দূরস্থান। কথা বলার লোকই নেই প্রায় এখন। অথচ মহেশপ্রসাদদের বাল্যকালে কাশিকা বোলির চর্চা ছিল।

কবি হরিশচন্দ্র ছিলেন তখনকার কাশী নরেশের বন্ধু। মহেশপ্রসাদের কোনো এক দাদা কি পরদাদা – পিতামহ
অথবা প্রপিতামহকে তিনি চিনতেন। কারণ সেই ঠাকুরদা বা বুড়ো ঠাকুরদাটির কবিতাচর্চার বাতিক ছিল। নাহ্, তিনি গণেশপ্রসাদ নন, তিনি অন্য কোনো পূর্বজ হবেন, এমনই ভেবে নিতে থাকে মহেশপ্রসাদ! গণেশপ্রসাদ কবি হরিশ্চন্দ্রের পরিচিত হলে সেই বিষয়ে আরো প্রচার – ঢোল-সহরত থাকত। আপাতত ভেলুপুরায় একদম পাক্কি সড়ক – পাকা রাস্তার ওপর দাঁড়ান গলেস্নকা দুকান খোলার পর শিউজি – বাবা বিশ্বনাথ, মা অন্নপূর্ণার ছবির সামনে সুগন্ধি ধূপ জ্বালিয়ে নিজের মনে জমে থাকা ছোট ছোট প্রার্থনা জানাতে জানাতে মহেশপ্রসাদ দেখতে পেল তার দুকান আয়তনে – আড়ে-বহরে তেমন বড় না হলেও ভেতরে সামনে একেবারে লাদান – ঠাসা। গরমের দিনে এই গলেস্নকা দুকান খুলতে খুলতে সুবা সাত তো বাজেই। শীতের সময় – জাড়া কা টেইম আরো আধা ঘণ্টা পর খোলে, মানে খুলতে খুলতে সাড়ে সাত।

গরমি কা মাহিনায় সকাল সাতটাতে দোকান খুলে দেয় মহেশপ্রসাদের বড়া লড়কা ধরমেন্দর। মাঝলা লড়কা – মেজো ছেলে জিতেন্দর এসে হাত লাগায় একটু পরে। ছোটা লড়কা ববি পঢ়াই – পড়াশোনা করছে এখনো, কালেজ যায়, তাই সময় পায় না সেভাবে দোকানে আসার।

দোকানে ঢোকার আগে দোতলার ঘরে পূজাউজা সেরে, দেওতা, ভগোয়ানদের ফুল, গঙ্গাজল, পরসাদি দেওয়ার পর আগরবাত্তি-ধূপ জ্বেলে, তা ভালো করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ধূপদানিতে রেখে দোতলা থেকে একতলায় নেমে দোকানে বসতে বসতে মহেশপ্রসাদের কোনো কোনোদিন একটু দেরি হয়ে যায়। উম্র – বয়সের হিসাবে ষাট পার করার পরও কেদারঘাটে পয়দল গিয়ে হররোজ – প্রতিদিন গঙ্গাজি নহান – কি শীত, কি গ্রীষ্ম, কি বর্ষা তাতে কোনো বাধা বিরতি – রুকাবট ছিল না। রুকাবট তৈরি হলো বছরচারেক আগে, একটা বিমারির পর। লকোয়া মেরে – অবশ হয়ে গেছিল হাত-পা, মুখ বেঁকে গেছিল। বদন – শরীরের একটা হিস্যা দায়না তরফ – ডান দিকটা পুরোপুরি অকেজো।

সেরিব্রাল! সেরিব্রাল স্ট্রোক – লকোয়া বিমারি, কথাটা মনে মনে এখনো উচ্চারণ করে থাকে কখনো কখনো। উফ, লকোয়া অ্যাটাক করার পর কী ভয়ংকর সে-অভিজ্ঞতা। তারপর তো অনেকটা সময় ধরে ইলাজ – চিকিৎসা। দাওয়া – ওষুধ-বিষুধ – মাসাজ। শিউজি – ভোলে বাবা বিশ্নাথ আর মা অন্নপূর্ণার কিরপা সেই সঙ্গে ডাগদারবাবুদেরও মেহেরবানি।

দূর অন্ধকারে তেলের আলোরা দুলে দুলে উঠছে। সেই কেরোসিন – মিট্টিকা তেল পোড়ানো আলোরা জ্বলতে জ্বলতে অবিরাম
শোঁ-শোঁ – শোঁ-শোঁ শব্দ করে যাচ্ছে। কাশী নরেশ – কাশীর এখনকার রাজা বসে আছেন তাঁর পোষা হাতির পিঠে। হাওদার ওপর থেকেই তিনি নজর করছেন লীলা। অনেক – অনেকটা ছড়ান ময়দানের ওপর আলোয়-ছায়ায় মিশে আছে মহাধনুর্ধর – মর্যাদা পুরুষোত্তম রাম, সেইসঙ্গে রাজা জনক, বশিষ্ঠ মুনি।

আশ্বিনের দু তারিখে অনন্ত চতুর্দশী। এদিনই নাকি জন্ম হয়েছিল লঙ্কেশ রাবণের। দশাননের জন্মতিথি ধরেই এক মাসের লীলা শুরু।

প্রতিবছর – হরসাল একদম নিয়ম করে লীলা দেখতে রামনগরে যান মহেশ। বড়া লড়কা – বড় ছেলে, নয়তো মঝেলা – মেজো, তাদেরই কেউ একজন মোটরবাইকের পেছনে তাদের বাবাকে বসিয়ে নিয়ে আসে ব্যাসকাশীর লীলা ময়দানে।

লকোয়া বিমারি – সেরিব্রাল স্ট্রোকের আগে আগে নিজেই ফটফটিয়া – মোটরসাইকিল চালিয়ে লীলা দেখতে যেতেন ব্যাসকাশী – রামনগরে একা একাই। তখন মনে জোশ কত। কি জোশ, কি জোশ! বয়স বাড়লে – জওয়ানি খতম হয়ে বুঢ়াপা চলে এলে একটু একটু করে শরীরের দুরস্ত – তাগদ কমে। তারপর যদি বড়সড় কোনো বিমারি – অসুখ এসে যায়, তাহলে তো আর কথাই নেই। সব কুছ বরবাদ হো যায়ে গা। বারাবাজ যায়ে গা। সমস্ত কিছুরই বারোটা বেজে গেল তখন।

শরীরটা খারাপ হয়ে গেলে মনও হয়ে যায় কমজোরি। সেই দিমাগি কমজোরিকে নতুন করে তাগড়া – দুরস্ত করে তোলা খুবই কঠিন। তখন খালি মনে হতে থাকে এই কাজটা ঠিকঠাক করতে পারব তো? করে ফেলতে পারব? সেরে উঠব? তবু তো মন্দের ভালো যে, ইলাজ – চিকিৎসার পর ভগওয়ানের কিরপায় সেরিব্রাল অ্যাটাকের পর আসেত্ম আসেত্ম একটু একটু করে ফিরে এসেছে হাত-পায়ের জোর। এজন্য বাবা বিশ্নাথকে, মা অন্নপূর্ণাকেও সর্বদা নমন – প্রণাম করে মহেশপ্রসাদ, গোড় লাগে বাবা কালভয়রোঁর – কালভৈরবের। বজরঙ্গবলী – হনুমানজির।

ওই তো, ওই তো চলেছেন কাশীরাজ তাঁর পালতু – পোষা হাতির পিঠে রাখা হাওদার ওপর বসে বসে। গজগমনে যে-হালকা হালকা দুলুনি, তাতে কাশী নরেশের পিঠও উঠছে দুলে দুলে। পেট্রোম্যাক্সের আলোকে গিলে খাচ্ছে প্রথম আশ্বিনের অন্ধ অন্ধকার। তবু তা থেকেই যেটুকু যা বেঁচেখুচে আছে, তাই ছিটেফোঁটা হয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে রাজার জামায়, হাওদায় আঁটা রুপোর ছত্রী – রাজছত্রের গায়ে গায়ে।

খানিক দূরে উত্তরবাহিনী গঙ্গা। সেই গঙ্গাজিকে ব্রিজ মারফত পার করেই তো চলে আসতে হয় ব্যাসকাশীতে।

কেদারঘাটের খাড়াই সিঁড়ি, অনেক অনেক পাথুরে ধাপ পেরিয়ে ভেলুপুরার রাস্তায় উঠে আসতে বেশ হাঁপ ধরে যায়। দম বেরিয়ে আসে। পায়ের ঘুটনা – হাঁটুতেও তকলিফ – কষ্ট হতে থাকে। বয়স যত বেড়েছে, ততই তকলিফ বেড়ে গেছে গঙ্গাজিতে নহান সেরে ওপরে উঠে আসার ব্যাপারে। মনে আছে কম বয়সে – মানে আজ থেকে বছরপঞ্চাশ আগে গঙ্গাজিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নহান – স্নান, – ত্যায়রানা – সাঁতার কাটার স্মৃতি। ঘাটের মাল্লাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাঁতার দেওয়া, কখনো কখনো তাদের নৌকোতেই ভেসে যাওয়া দূ-রে – আরো দূ-রে কোথাও প–ত মদনমোহন মালব্যজির নামে তৈরি হওয়া ব্রিজের ওপর গুড়িয়া য্যায়সা – পুতুল-পুতুল মানুষজন, গাড়ি।

তখনো অস্সি, বরুণা – এদের লহর – স্রোত একটু একটু যেন চেনা যায় আলাদা করে। মণিকর্ণিকায় শমশান ঘাটে চিতা জ্বলে দিন-রাত। রাজঘাট, দিঘাপতিয়াঘাট, অহল্যাবাঈঘাট – সব পরপর পেরিয়ে এলে অস্সিঘাটের দিকে সম্পূর্ণ অন্যরকম হয়ে থাকে আকাশটা। মণিকর্ণিকা আর রাজা হরিশচন্দ্রর নামে তৈরি হওয়া শমশানঘাটে মুর্দা জ্বালানো ধোঁয়া কু-লী পাকাতে পাকাতে আকাশ চেটে নিতে চায় একসময়। সেসব কু-লী হঠাৎ দেখলে মনে হবে রাখছস – রাক্ষসের শর – মু-ু। আর গঙ্গাজি ত্যায়রতে ত্যায়রতে – সাঁতরাতে সাঁতরাতে উত্তরবাহিনী গঙ্গার জলে নেমে আসা সূর্যকেও ছুঁয়ে ফেলা যায় অনায়াসেই।

ওই তো ওই তো লীলা দৌড়চ্ছে!

কাশী নরেশকে পিঠের হাওদায় বসিয়ে দৌড়চ্ছে রাজহসত্মী। তার দুলন্ত হাওদার সঙ্গে লাগানো চান্দির – রুপোর ছত্রী, তাও এই পেট্রোম্যাক্সের আলোমাখা অন্ধকারে আকাশ থেকে নেমে আসা কোনো অলৌকিক গাছ হয়ে উঠেছে। কাশীরাজের পেছনে পেছনে দৌড়চ্ছে – দৌড়ে চলেছে তাঁর প্রজারা।

মহেশপ্রসাদ জানেন এভাবেই লীলা চলতে থাকবে টানা এক মাস। কার্তিক মাসের প্রথম দিন – কুঁয়র পূর্ণিমায় শেষ হবে লীলা। তখন রাম আর সীতা মাইয়া দাঁড়াবেন পাশাপাশি। রাম রাজা হবেন।

নিজের দোকানে টাটে বসলে তখন গাহক – খরিদ্দারদের মাঙ্গ – চাহিদা অনুযায়ী সামান সাজিয়ে দিতে হয় – জোগান দিয়ে যেতে হয় পরপর।

লালাজি, মেরে কো য়ো চাইয়ে।

লালাজি, মেরে কো ফলানা চাইয়ে – এরকমই সব ফরমাইশ বাণী রোজই শুনতে হয় মহেশপ্রসাদ জয়সোয়ালকে – দোকানে বসলে।

চাওল, দাল, কড়ুয়া তেল – সরষোঁ কা তেল সাবুন – য়ো ভি অলগ অলগ, এক তো কাপড়চোপড় কাচা – পছাড়নেকে লিয়ে সাবুন। সেই সঙ্গে সঙ্গে নালায়েক বিদ্যার্থী – ছোট ছোট – নাদান বাচ্চা – স্কুলপড়ুয়াদের জন্য কাপি-উপি – খাতা, সেই সঙ্গে পেনসিল, রবার, মলাট দেওয়ার কাগজ, সস্তার ডটপেন – এসবই জুগিয়ে যেতে হয় গাহকদের হাতের কাছে। কারণ গাহক – খরিদ্দার লছমি – লক্ষ্মী।

লকোয়া বিমারি – সেরিব্রাল স্ট্রোকের পর, সবকিছু পরপর, ঠিকঠাক মনে করতে পারেন না মহেশপ্রসাদ। কেমন যেন গুলিয়ে আবছা হয়ে যেতে থাকে সবকিছু। এমনকি পূজা-উজা করার সময় ভগোয়ানজির নাম, তাও তো অনেক সময় গুলিয়ে, ঘুলিয়ে, ঘেঁটে – একেবারে তালগোল পাকিয়ে আটকে যেতে থাকে মাথার ভেতর। তারপর সব ফরসা – শাদা – আগাগোড়া – ধুনধলাসা – ঘোলাটে। কোনো কিছুই আর মনে পড়ে না।

ডাগডরসাবকে এসব নিয়ে বললে-টললে উনি সবটাই কেমন যেন হালকা করে দিয়ে ঘাড় নিচু করে প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে বলেন, ও তো এরকম একটু-আধটু হবেন। ওসব নিয়ে জাদা সোচনা মত – বেশি ভাববেন না আপনি। যা দাওয়া লিখে দিচ্ছি খেয়ে যান নিয়ম করে। আর একদম টেনশন করবেন না। – টেনশন মে সবই বিমারি বঢ়তে হ্যায়। সব বিমারি কা জড় – মূল হলো টেনশন।

কৌশিশ তো করি ডগদরসাব, কিন্তু হয় কোথায়?

লড়কাদের ওপর ছেড়ে দিন সব। ওরা তো সবাই বেশ বড় – সেয়ানা হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে সঙ্গে যথেষ্ট বুঝদারও। দায়িত্ব দিন ওদের, দেখবেন ঠিক সামলে দেবে। নিন, জিভটা একবার দেখান। বলতে বলতে মহেশের থেকে প্রায় বছরকুড়ির ছোট ডাক্তার ইলাজ – চিকিৎসার ব্যাপারে পরামর্শ দিতে থাকে মহেশকে।

দাওয়ার গোলি কি কমল ডাগদারসাব, নাকি যা ছিল, তাই…!

নাহি, সব একই রইল। যেমন ছিল তেমন। বলতে বলতে ডাক্তার মহেশপ্রসাদকে শুয়ে পড়তে বলে। এম জয়সোয়াল জানেন এবার তাঁর প্রেসার মাপা হবে।

মহেশপ্রসাদ তাঁর ইলাজ – চিকিৎসা করা ডাগদারসাবকে বলতে চাইল এই বিমারির পর থেকে অনেক কিছুই কেমন যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে ইয়াদদাস্ত – স্মৃতি। মনে থাকে না বেশকিছু জিনিস, কথা। মনে থাকছে না।

নীরজ সাকসেনা খুব ব্যস্ত ডাক্তার। নামের পাশে বেশ কয়েকটা লম্বা-চওড়া ডাক্তারি ডিগ্রি আছে। মহেশ, ধরমেন্দর বা জিতেন্দর একই সওয়াল – প্রশ্ন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে করে যায় প্রতি মাসে, ডাক্তার দেখাতে এসে। এসব জিজ্ঞাসার কোনো জবাব চট করে দেয় না নীরজ। বেশিরভাগ সময়ই চুপ করে থাকে।

 

আশ্বিনের শুরুতে গঙ্গার দিক থেকে আসা বাতাস মাঝে মাঝেই লীলা চলতে থাকা ময়দানকে বেশ খানিকটা আরাম, স্বসিত্ম দিয়ে যায়। বছরকুড়ি আগে যখন মহেশ তাঁর নিজের কালো রয়্যাল এনফিল্ড চালিয়ে লীলা দেখতে আসত, তখন কিংবা তারও কয়েক বছর আগে এই গঙ্গাজি ছোঁয়া হাওয়ায় সামান্য হলেও মিশে থাকত শীতের শিরশিরানি। মহেশের তখন জোয়ান বয়স। ধরমেন্দর, জিতেন্দর, ববিদের মা রুক্মিণী বেঁচো। রুক্মিণীতে নিয়ে রাসপূর্ণিমার দিন রাজঘাটে আলোর সাজ দেখতে যাওয়া। সে তো দেব দীপাবলির আলোকমালা দেখার জন্য। সেদিনই আবার গুরু-নানকজির জন্মদিন।

রাজঘাট আলোয় আলো।

সেই আলোকমালার রেশ গঙ্গাজিতেও।

এঘাট, ওঘাট, সেঘাটে লাখ লাখ তেলের প্রদীপের জ্বলে ওঠা, জেগে ওঠা।

তখন আকাশজুড়ে ভরা চাঁদ। তখন সন্ধ্যা লেগে গেছে সমস্ত বারাণসী জুড়ে। কার্তিকী পূর্ণিমার জ্যোৎস্না আর প্রদীপের রোশনিতে চারপাশ আলোয় আলো।

এরকম কত কি যে মনে পড়ে মহেশের। মোটরসাইকেলে বসে যেতে-আসতে মহেশ টের পান দিনে দিনে কাশীর রাস্তাঘাটের হালত আরো খারাপ হচ্ছে। প্রতিটি ঝাঁকুনিতেই তা টের পাওয়া যায় হাড্ডিতে হাড্ডিতে – হাড়ে হাড়ে।

মাথার ওপর প্রথম আশ্বিনের ঝকঝকে তারাভরা আকাশ। সেই আকাশের গায়ে আসন পেতে বসে থাকা সিতারা – নক্ষত্রেরা নিজের নিজের কেরদানিতে খেল-কুদ – খেলাধুলো না দেখিয়ে একদম চুপচাপ বসে।

ফাঁকা মাঠে বসে, হেঁটে, অল্প দৌড়ে লীলা দেখলে আকাশ থেকে চুইয়ে নামা হালকা হালকা হিম গনজা – টাক মাথার ওপর
নেমে এলে বুখার, শরদর্দ, জুখাম – খাঁসি  অবধারিত। ডাগদারসাব নীরজ সাকসেনা বারবার মহেশকে বলেছেন ঠান্ডা না লাগাবার জন্য। হিম যাতে না লাগে তার জন্যই মহেশপ্রসাদ জয়সোয়ালের প্রায় বিকচ – কেশবিহীন মাথায় নিয়মিত গামছা বেঁধে নিতে বলেছেন ডাগদারসাহেব।

ডাগদারসাব ও বড়া লড়কা ধরমেন্দরের পরামর্শ অনুযায়ী তাই করে থাকেন মহেশ। গামছা – রঙিন গামছায় ভালো করে ঢেকে নেন মাথা, কান, সেইসঙ্গে সঙ্গে মুখেরও খানিকটা।

পেট্রোম্যাক্স, ডে লাইট, হ্যাজাক বা অন্য অন্য তেল-পোড়ানো আলোয় বেশ জমে উঠেছে লীলা। কোথাও কোনো মাইকও নেই, সব খালি গলায়। নিজের পোষা হাতির পিঠে বর্তমান কাশী নরেশও আবছা আবছা আলো-ছায়ায় কেমন যেন একদমই অন্যরকম।

গজপৃষ্ঠে সওয়ার কাশীরাজ চলেছেন লীলার পিছু পিছু। তাঁর পেছনে পেছনে চলেছে দলবাঁধা প্রজারা।

লীলা দৌড়চ্ছে। মানে যারা যারা লীলাতে কথা বলছে, গান গাইছে, তারা চলেছে সবার আগে। লীলা দাঁড়িয়ে গেল তো রাজাও – কাশী নরেশ দাঁড়িয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে মূর্তি হয়ে গেল তাঁর প্রজারাও। আকাশে ভাসমান – ভেসে থাকা আশ্বিনী চাঁদ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল এসব লীলাধর-লীলাধরী – বিদ্যাধর-বিদ্যাধরীদের দিকে।

এই সমস্ত লোকজন, ভিড়, কথাবার্তা, তেল-বাত্তির আলো – সবার মধ্যে হঠাৎই নিজের চিমত্মার সুতো কেমন যেন এলোমেলো – তিতর-বিতর – ছন্নছাড়া হয়ে গেল মহেশের। তাঁর মনে হলো মাথার ভেতর একসঙ্গে শ কি পচাশ পচাশ হাথৌড়া – হাতুড়ি দিয়ে কেউ যেন জমাট, শক্ত কোনো পাথর ভেঙে চলেছে।

বুকের ভেতর ধক ধক, ধপাস ধপাস – ধড়াস ধড়াস ধড়কন – শব্দ শুনতে পাচ্ছেন মহেশ। আপনা দিল – নিজের দিল কা আওয়াজ অ্যাত অ্যাত জোরালো – তীব্র হয়! হতে পারে? কে জানে! নদীর বুক থেকে উঠে আসা বাতাসী দীর্ঘশ্বাস কাশী নরেশ তাঁর হাতি, লীলার চলমানতা, পেট্রোম্যাক্সের আলো – সবকিছুকেই যেন হালকা – ধিমি কুয়াশার আড়ালে নিয়ে যাচ্ছে। হালকা হালকা পাসিনা – ঘামে ভিজে যাচ্ছে মহেশপ্রসাদের গায়ের জামা। সেই কামিজের বোতাম একটু আলগা করে দিতে পারলে হয়তো আরাম হতো সামান্য। কিন্তু কে এখন খুলবে, খুলে দেবে বোতাম! কাছাকাছি তো দেখা যাচ্ছে না ধরমেন্দরকেও। মাইক ছাড়া ভেসে আসা লীলার গান, কথা – সবই তো কেমন যেন আবছা, ঘোরলাগা – ধুনধলাসা হয়ে গেল। তবু এই ভিড়, লোকজন, আবছা আবছা কোহরা – কুয়াশার মধ্যে কেমন করে যেন রুক্মিণীকে বারদুই ভেসে উঠে আবারো ডুবে যেতে দেখতে পেলেন মহেশপ্রসাদ।

আশ্বিনের আবছা আবছা কুয়াশা, যা আজ থেকে তিরিশ, চলিস্নশ, কি পঞ্চাশ বছর আগে নেমে আসত সমস্ত লীলা ময়দানজুড়ে, সেই ফিকা – হালকা হালকা প্রাচীন পরদা কি নেমে এলো নতুন করে, বহু বছর পর?

রুক্মিণীর অস্পষ্ট মুখশ্রী – মুখাবয়ব একবার, দুবার এই লীলা-দর্শকদের অজস্র মুখের মধ্যে ভেসে উঠেই কাত হওয়া ডুবন্ত নৌকো হয়ে কোথায়, কোথায় যেন হারিয়ে গেল। এই লীলা-দঙ্গল – লীলা-ভিড়ের মধ্যে হাতড়ে হাতড়ে রুক্মিণীকে পেতে চাইল। মহেশপ্রসাদ জয়সোয়াল। একই সঙ্গে চাইলেন মাথার সঙ্গে কান, মুখের খানিকটা বেড়িয়ে টানটান বাঁধা গামছাটাকে ঢিলা করতে।

চেষ্টা করলেন মহেশ। অনেক চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। কোনোভাবেই পেরে উঠলেন না গামছা আলগা করতে।

মণিকর্ণিকার চিরায়ত চিতার আগুন কখনো নেভে না। ‘রাম নাম সত্ হ্যায়’, ‘রাম নাম সত্ হ্যায়’ – এমন আধফোটা ধ্বনিমালা অনবরত ভাসতে থাকে মণিকর্ণিকা আর রাজা হরিশচন্দ্র-নামাঙ্কিত শমশানঘাট জুড়ে।

শবদাহের কু-লী পাকানো ভারি ধোঁয়া আকাশের দিকে উঠে আসতে চায়। কাঠ ও নরমাংস, সেই সঙ্গে ঘি-পোড়াতে পোড়াতে সর্বগ্রাসী অগ্নি তৈরি করে নেয় এই ধূম্র গোলক। আকাশের চাঁদ পাশা খেলার অতি ধূর্ত ঘুঁটি হয়ে স্থির থাকে।

কেন জানি না এখনই পরদাদি মোহিনীর কথা একবার বিছের কামড় হয়ে খামচে ধরে মহেশপ্রসাদের মাথার ভেতর। তারপর আবার এই স্মৃতি-বিস্মৃতির আলো-আঁধারি – সবটা সরে গিয়ে সুনসান ময়দান যেমন, সেভাবে জেগে উঠল সামনে।

দাহ হতে থাকা মুরদা – শবের কটুগন্ধ লীলা চলতে থাকা মাঠের বাতাস কি একটু একটু করে ঢেকে দিতে থাকল! চারপাশ ঢাকতে চাইল? চিতাগন্ধ, চিতাগ্নি – সবই কেমন যেন জুড়ে গেল একসঙ্গে।

ভিড়ের ভেতর থেকেই ধরমেন্দর বেশ জোরেই একটু যেন চেঁচিয়ে উঠল – বাবুজি! বাবুজি! সেই আর্ত-পুকার – ডাক কোনোভাবেই পৌঁছল না মহেশপ্রসাদের কানে।

লীলা ভিড়ের মধ্য থেকেই কারা কারা কত, কত কী যেন বলে উঠতে থাকল একসঙ্গে। সেই আবছা – ছেঁড়া ছেঁড়া টুকরো টুকরো কথাকাঁটা ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারল না মহেশ। কেবল তার হাঁ একবার, দুবার, তিনবার খুব বড় করে বাতাস ছুঁতে চাইল। অনেকখানি হাওয়া একসঙ্গে টেনে নিয়ে এসে – একেবারে যাকে বলা যেতে পারে গ্রাস করে ঢুকিয়ে নিতে চাইল বুকের ভেতর।

পারল না।

ব্যর্থ হলো মহেশপ্রসাদ।

তার সামনে গোটা দুনিয়াটা ছোটবেলায় ঘোরানো কাঠের লাট্টু হয়ে ঘুরে উঠল বনবন বনবন করে। রুক্মিণীর মুখশ্রী আবছা হয়ে একবার ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল দূরে।

ঠিক তখনই কাশী নরেশের নিজস্ব হাতি – রাজহসত্মী এগিয়ে যাওয়া লীলার পেছনে পেছনে আরো – আরো জোরে পা চালিয়ে দিলো।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত