খোঁড়া

খোঁড়া
নাসরিন আমার বিয়ে করা বউ হলেও তার সাথে শুইতে আমার গা ঘিন ঘিন করতো। সরকার বাড়ির এই বিধবা মেয়েটিকে বিয়ে করে আনার পর থেকে আমার কেবল মনে হতো একটা সেকেন্ডহ্যান্ড জিনিস কিনে আনলাম। কিনলাম আর কোথায়? তাকে বিয়ে করে যৌতুক বাবদ আড়াই লাখ টাকা গুনতে ভুল করিনি আমি। বাড়ির পাশে মুদির দোকানটি সেই টাকাতেই দাঁড় করিয়েছি।
আমার তো এক পা খোঁড়া। খুঁড়িয়ে হেঁটে দেড় মাইল পাড়ি দিয়ে গঞ্জে গিয়ে কোনো কাজ করার সামর্থ্য নেই আমার। একসাথে মোটা অঙ্কের টাকাটা পেয়ে আমার বাবা যেমন সালাউদ্দিনের সরকারের কথায় রাজী হয়ে গেলেন। আমিও আর অমত করিনি। শুধু পাড়া প্রতিবেশীরা গুঞ্জন করে বলতো, “মেয়েটা বিয়ের সাত মাসের মাথায় জামাইটারে খাইলো। নাজমুল সে মেয়েটাকেই বিয়ে করলো টাকার লোভে। কী যে আছে তার কপালে আল্লাহ-ই জানে।” আমি সেসব কথায় কান দেই না। বরং মনে হতো, টাকার লোভে তো বিয়ে করিনি। খোঁড়া মেয়েকে বিয়ে করেছি। আমার যেমন এক পা খোঁড়া। আমার বউয়েরও আগে বিয়ে হয়েছে তাই সেও আমার মতো খোঁড়া।
বিপত্তি হলো আমার মনে। বড় একটা অসুখ বেঁধেছিল মনের ভিতর। সপ্তাহে তিন চারদিন রাতে তার শরীর ডিঙ্গাতে পিছপা হই না। কেন পিছপা হবো? সে আমার বিয়ে করা বউ। এতটুকু আমার পাওনা। কিন্তু কোথায় যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। গা ঘিন ঘিন করতো আমার। তাকে ছুঁইলে মনে হতে থাকে, আমার আগেও নাসরিন অন্য পুরুষের সাথে ঘুমাইছে। অন্য পুরুষ তাকে চুমু খেয়েছে, গালে গাল ঘষেছে, আর ভাবলেই কেমন গা গুলিয়ে আসে। তবুও তার শরীর ডিঙ্গাতে হয়। না ডিঙ্গিয়ে তো উপায় নেই। বিয়ে করে আড়াই লাখ টাকা নিলাম যে। গতবারের বন্যায় যখন সব ফসল পানির নিচে। অভাবে পড়ে বাবা বাছুরসহ গাভী বিক্রি করে দিলেন। তারপর আমাকে বললেন, গোরু বেচার টাকা খাওয়া শেষ হলে পরে কী খাবি? এবার তো কিছু একটা করা দরকার।
গোরু কিনে নিলেন সালাউদ্দিন সরকার। তখন সাত মাস হলো বিধবা নাসরিন বাবার বাড়ি এসে উঠেছে। বাবাকে ডেকে সালাউদ্দিন সরকার প্রস্তাব দিলেন, “তোমার ছেলেটার বেশ সুনাম আমাদের এলাকায়। গরীব ঘরে জন্মেও খোঁড়া পা নিয়ে মেট্রিক দিলো। এলাকার মানুষের বিপদে খোঁড়া পা নিয়েই ঝাপিয়ে পড়ে। আমার মেয়েটা বেশিদিন জামাইর ঘর করতে পারেনি। কারেন্টের শকে মরে গেছে। আল্লাহর কাজ সবই ভালো। আমি বলি কী? আমার মেয়েটারে নাজমুলের বউ কইরা নেও। আমি লাখ দুয়েক টাকা দিব, বাড়ির পাশে একটা মুদির দোকান দিয়ে বসুক। আর বিপদে আপদে আমি তো আছিই।” বাবা তো রাজী হলো-ই, খুশি মনে আবারো সরকার বাড়ির কথাটুকু বাবা আমাকে শুনালেন। আমি খোঁড়া মানুষ, আর অমত করতে পারিনি।
আমাদের দুইজনের মাঝখানে একটা কোলবালিশ থাকতো। যখন শরীর ডিঙ্গাতে হতো, বালিশ সরিয়ে ফেলতাম। আবার বালিশ মাঝখানে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। শ্যামবর্ণের নাসরিন আমাদের বাড়ি আসার পর তাকে সাজতে দেখিনি। কথাবার্তাও খুব কম বলে। নম্র, ভদ্র হয়ে থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু আমি কেন যেন মন থেকে মেনে নিতে পারি না। কখনো মনে হয়, শরীরের প্রয়োজনে বিয়েটা করা না-কি টাকার প্রয়োজনে? আমার মনের প্রয়োজন তাহলে কোনটা? একরাতে নাসরিন আমাকে কোলবালিশ দিয়ে ধাক্কা দিয়ে ডাকছে। আমি জেগে উঠলাম বালিশের ধাক্কায়। জানতে চাইলাম, কী হয়েছে? উত্তরে বলল, বাইরে শেয়াল ডাকছে। ফিসফিস করে বাইরে কে যেন কথা বলে। আমার বড্ড ভয় লাগছে।
আমি বললাম, বাতি জ্বালিয়ে ঘুমাও। তাহলে আর ভয় করবে না। বাতি জ্বালিয়ে ছোট বাচ্চাদের মতো ঘুমানোর চেষ্টা করছে। একবার খুব ইচ্ছে হলো, মাঝের কোলবালিশটা চিরতরে সরিয়ে দেই। নাসরিনকে বুকে টেনে বলি, আমি আছি তো। ভয় পাচ্ছ কেন? বলা হয় না। কোথায় যেন একটা গা গুলানো ব্যাপার। রাতে শরীর ডিঙ্গানোর সময়ও আদর করে তাকে চুমু দেয়া হয় না। কী বিশ্রী এক অসুখ ধরেছে আমার মনে। আমাকে নিয়ে যখন সরকার বাড়ি অর্থাৎ বাবার বাড়ি যায়। কত প্রাণ চঞ্চল মেয়েটা। দুই ঘরের ভাবির সাথে গলাগলি ভাব করে হেসে লুটিয়ে পড়ে। আমি তখন সালাউদ্দিন সরকার মানে শ্বশুরের সামনে বসা থাকি। তিনি তার জমি সংক্রান্ত কথা বলেন।
আমাকে বসে বসে সেসব শুনতে হয়। কথা একটু বেশি বলেন। তাছাড়া বিপত্নিক হয়ে বড্ড একাকী জীবন তার। কথা বলার মানুষ পেলে ছাড়তে চান না। আমি শ্বশুরের সামনে বসে আড়চোখে নাসরিনকে দেখি। জলপাই খাচ্ছে হাতের তালুতে লবন নিয়ে। আর কী এক কথা বলে চূলার পাড়ে দুই ভাবীর সাথে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। আবার কেমন হিংসে হতে লাগলো। আমাদের বাড়ি গেলে তার হাসি নেই। চুপচাপ থাকে সারাদিন। অথচ এখানে তার কত আনন্দ। আমি কি তার আনন্দ কেড়ে নিয়েছি? আমি কী করলাম? বারো তের ঘন্টা দোকানে বসে দুই চার পয়সা রোজগাড় তো করে আনি। অন্য পুরুষদের মতো তো মদ খেয়ে নটিবাড়িতে পড়ে থাকি না। তার বাবা আমার কত সুনাম করে। সুনাম আমার এলাকাতেও। শুধু পা একটা খোঁড়া। এমন জামাই পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।
-বাবা নাজমুল। তোমার কোনোকিছু লাগলে আমাকে বলবা। আমার একটাই মেয়ে। আমি দু’হাত ভরে মেয়েটাকে দিতে চাই। মা মরা মেয়েটা তবুও হাসিখুশি থাকুক। আমি কথার জবাব দেই না। মনে মনে ভাবি, একটা সূতার নাল-ও নেব না। যা নিয়েছি পারলে সেটাই ফেরত দেব। বিকেলে বাড়ি আসার পথে নাসরিনের বড় ভাইয়ের বউ আমাকে ডাকলো। আমি কাছে যেতেই ভাবী আমাকে বললেন, সারা বছর তো দোকানদারি করলেন। এবার কয়েকটা দিন আমার ননদটারে সময় দেন। এখন কিন্তু ননদ একা না, পেটে আরেকজন আছে। এটা শোনার পর থেকে আমার মনে নতুন করে অসুখ করলো। দোকানে মন বসে না। মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেল। গা গুলানোর ব্যাপারটা, ঘিন ঘিন করতে থাকা বেড়ে গেল। আমি নাসরিনের দ্বিতীয় বর। তার পেটে বাচ্চা এলো।
কিন্তু আমার মনে অসুখ। কিসের অসুখ তা কিছুটা আন্দাজও করতে পারি। তবুও মনে শান্তি পাচ্ছিলাম না।
নাসরিনের পেটে বাচ্চার বয়স যখন ছয় মাস তখন থেকে তার মানষিক অবস্থার পরিবর্তন হলো। রাতে খেয়াল করতাম সে বালিশ ডিঙ্গিয়ে আমার গায়ে হাত দিয়ে রাখতো। আমার হাত চেপে ধরে রাখতো। আমি তার হাত সরিয়ে দিতাম। একদিন সে কী মনে করে বলল, “আমাকে তুমি মন থেকে আজও মানতে পারোনি। তাতে আমার দুঃখ নেই। কিন্তু আমাদের সন্তানটাকে মেনে নিও। এই সন্তান তোমারই। আমি আগে যার সাথে সাত মাস সংসার করেছি, সেখানে আমাদের সন্তান আসেনি। আর আমি যদি মরেও যাই, তুমি বিয়ে করিও। আর সন্তানটাকে মেনে নিও। তবুও যদি তোমার মানতে কষ্ট হয় তাহলে আমার বড় ভাবীকে দিয়ে দিও, বিয়ের পর থেকে ভাবীর সন্তান হয় না।”
আমার অসুখ হঠাৎ করে সেরে গেল। মনের অসুখটার মুখে যেন ঔষধ পড়লো নাসরিনের কথাগুলো। আমি কী মনে করে যেন মাঝের কোলবালিশটাকে মেঝেতে ফেলে দিলাম। নাসরিনের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, “আমাদের সন্তান আমি কাউকে দেব না। এটা আমার সন্তান। আমি প্রথমবারের মতো মন থেকে নাসরিনের কপালে চুমো দিলাম। বললাম, আর কখনো মরার কথা বলবে না। কোনো সমস্যা হবে না তোমার, আমি আছি তো।” যে মেয়েটা বাবার বাড়িতে এতো হাসিখুশি। সে মেয়েটা হঠাৎ শব্দ করে কেঁদে উঠলো। আমি তাকে ফিস ফিস করে বললাম, এভাবে কাঁদলে বাবা মা কী ভাববে বলো তো? এই কথা শুনে নাসরিন হেসে উঠলো। এই অবস্থায় মেয়েদের বুঝা বড় দায়। এই হাসবে, এই কাঁদবে। কখনো রাগে ফোঁসতে থাকবে। এটা যেন প্রকৃতির খেলা।
গোরুর গাড়িতে করে বাবা আর নাসরিনের ভাই-ভাবী নাসরিনকে গঞ্জের হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। আমি যাচ্ছি হেঁটে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে আজ শান্তি পাচ্ছি না। এই প্রথম মনে হলো, পা দুটো ভালো থাকলে দৌঁড়ে চলে যেতাম হাসপাতালে। ভোর সকালে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে বলল, আমার জানি কেমন লাগছে। আমি ব্যথা সহ্য করতে পারছি না। আমার খুব কান্না পাচ্ছে। তুমি আমাকে শক্ত করে ধরে রাখো। আমি নাসরিনকে শক্ত করে ধরে বললাম, এই সময়ে অবশ্যই মা চাচীদের ডেকে আনতে হয়। তুমি একটু সহ্য করো, আমি মা’কে বলি দাই নিয়ে আসতে।
দাই এসে বলল, হাসপাতালে নিয়ে যান তাড়াতাড়ি। আমি পারব না। আর প্রশ্ন করিনি কেন পারবে না? সরকার বাড়িতে খবর পাঠানোর পর গোরুর গাড়ি পাঠিয়ে দিলো। নাসরিন যাবার সময় আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল, জানো? আমার খুব বাঁচতে ইচ্ছে করছে। তোমার বুকে মুখ লুকিয়ে ঘুমানোর জন্য। এই প্রথম নাসরিনের জন্য আমার চোখ ভরে পানি এলো। আমি বললাম, তুমি ফিরে আসবে। আমার খাঁ খাঁ করা বুকটার পূর্ণতা দিতে তুমি অবশ্যই এই বুকে ফিরে আসবে। মাটির রাস্তায় গোরুর গাড়ির একেকটা ঝাঁকুনিতে নাসরিনের কেমন কষ্ট হচ্ছে সেটা ভাবতেই বুকের ভেতরটা কেমন জানি করে। আমি মেয়েটাকে অনেক অবহেলা করেছি। বিধাতার কাছে হাতজোর করে মিনতি, মেয়েটাকে বাকি জীবন যেন ভালোবাসতে পারি সেজন্য হলেও তাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিও।
গঞ্জের কাছাকাছি বাঁশের সাকু পেরিয়ে যাবার পর দেখি নাসরিনের বড় ভাই মিষ্টি নিয়ে আসছে। আমাকে দেখে বলল, হা করো। একটা মিষ্টি মুখের ভিতর ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, গ্রামের সবাইকে গোরু জবাই করে খাওয়াবে বাবা আগেই বলেছে। তোমার ছেলে হয়েছে মিয়া। তাড়াতাড়ি যাও। ছেলে হবার আনন্দ আমাকে আনন্দিত করতে পারেনি। আমার ভিতরে শুধু নাসরিন। সে ভালো আছে তো? হাসপাতালে ঢুকার পর নাসরিনের ভাবী বলল, জায়গা দাও বাচ্চার বাবা আসছে। নাসরিন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তার পাশে বসার পর নাসরিন আমাকে বলল, “তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? আমাদের ছেলে হওয়াতে তুমি খুশি হওনি? ছেলেকে কোলে নিবা না?”
আমি নাসরিনের হাত ধরলাম। একটু কাছে গিয়ে বললাম, তুমিই তো আমার সব খুশি। বাচ্চা তো কেবল উপলক্ষ।
নাসরিন মুচকি হেসে ফিসফিস করে বলছে, এখন আবার বেশি খুশিতে চুমো দিও না। ভাবীরা আছে, বাবা ঔষধ আনতে গেছে। যেকোনো সময় আসতে পারে। আমি লজ্জা পাবো। মনে মনে ভাবলাম, নিষেধ করল না সম্মতি দিল? আমি ফিস ফিস করে কথা বলার ছলে কপালে চুমু এঁকে দিলাম। দেখতে পেলাম অপূর্ব সৌন্দর্য, বউটার লজ্জারাঙ্গা মুখ।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত