ভবের পাগল

ভবের পাগল
শিলমান্দী এলাকায় সপ্তম শ্রেণীর এক ছাত্রীকে ধর্ষনের পর হত্যা করে কলাবাগানে ফেলে রাখা হয়েছে। জাতীয় কোনো দৈনিকে খবরটি ছাপা হয়নি। ছাপা হয়েছে নরসিংদীর সাপ্তাহিক পত্রিকা “সাপ্তাহিক নরসিংদী বাণী” পত্রিকায়। ঘটনা ঘটেছে আরো পাঁচদিন আগে। সাপ্তাহিক পত্রিকা হওয়াও গত রবিবারের খবরটি আজ ছাপা হয়েছে। আমি চায়ের দোকানে বসে রুটি খাচ্ছিলাম চা দিয়ে ভিজিয়ে।
আমি পাগল মানুষ, পত্রিকা কিনে পড়ার মানেই হয় না। প্রতিদিন চায়ের দোকানে আসি, মানুষ পত্রিকা পড়ে। আমি মাঝে মধ্যে চোখ বুলাই বা তারা যখন পত্রিকা পড়ে তখন শুনতে পাই। আচকের পুরো পত্রিকায় আলোচিত খবর এটাই। যেহেতু শীলমান্দি আমাদের এলাকা থেকে বেশি দূরে না। হেঁটে যেতে আধা ঘন্টার মতো লাগে। যদিও শীলমান্দী আমাদের সদর উপজেলায় না। পলাশ উপজেলায় পড়েছে। আমার ভিতরে জেদ চাপতে লাগলো। এই ধর্ষককে আমার খুঁজে বের করতেই হবে। কঠিন শাস্তি দিতে হবে তাকে। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা কখনো তাদের শাস্তি দিতে পারবে না। আমাকে অনেকেই পাগল নামেই চিনে। বছর চারেক ধরে আমার নিজের নামটা মানুষ ভুলতে বসেছে। তবে এখনো কেউ কেউ আজিজ পাগলা বলে থাকে। কিন্তু আজিজ দারোগা নামে কেউ আর চিনে না আমাকে। চার বছরে মানুষ প্রায় ভুলেই গেছে আমি এক সময় দারোগা ছিলাম।
এখন তো আমার সাথে বেশিরভাগই ছোট পুটলা থাকে। অনেকে বলে পুরিয়া, গাজার পুরিয়া। কেউ বলে সিদ্ধি। বড়লোকের ছেলেপুলে খেয়ে এটার আধুনিক নাম দিয়েছে সবজি। আমি প্রতিদিনই এই সবজি সেবন করি। তারপর ঝিম ধরে বসে থেকে একটা ভাবে আসি। আমি পাগল কিন্তু ভাবের পাগল, ভবের পাগল। ভবঘুরে এই আজিজ পাগলা কারো ক্ষতি করে না বললে ভুল হবে। যে জুলুম অত্যাচার করে তার ক্ষতি আমি কখন কীভাবে করে দেব টেরও পাবে না। শীলমান্দীর পথে রওনা হলাম। সাথে একটি নাইন এম পিস্তল। এটি অবৈধ পিস্তল। কোনো লাইসেন্স নেই। দারোগা থাকা অবস্থায় পিচ্ছি রুবেলকে ধরতে গিয়ে তার সাথে দুইটা পিস্তল পেয়েছিলাম। একটা পুরাতন পিস্তল সাথে দিয়ে নাইন এম রেখে দিয়েছিলাম।
পিচ্ছি রুবেল দুইটা খুন করার পরও তাকে জামিনে ছাড়িয়ে এনেছে ওয়ার্ড কমিশনার। খুনি সন্ত্রাসীদের এত কষ্ট করে গ্রেফতার করার পর যখন শুনি জামিনে বেরিয়ে এসেছে তখন বিচার ব্যবস্থার প্রতি ঘৃণা তৈরী হতে থাকে। সেই ঘৃণা থেকেই মূলত চাকরি ছেড়ে দিয়ে ভবের পাগল হয়ে গেছি। আর মনের মধ্যে জিদ চেপে গেল একটা একটা করে অত্যাচারী, খুনিকে নিজ হাতে শাস্তি দেব। যে দেশের আইন সন্ত্রাসীদের কিছু করতে পারে না, সেখানে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়াকে আমি অপরাধ মনে করি না। পিচ্ছি রুবেলের সাথে ফের দেখা হয়েছিল গত দুই মাস আগে। আমাকে খবর দিয়েছিল আমার সহকর্মী মিজান। যে আমাকে পিস্তলের গুলি দিয়ে সহায়তা করে। কোথাও থেকে পিস্তল, গোলা বারুদ উদ্ধার করতে পারলে পিস্তল থেকে গোপনে গুলি বের করে আমার জন্য রেখে দেয়। আমি গিয়ে নিয়ে আসি আমার মিশনের জন্য। রুবেলকে পেয়েছিলাম সন্ধ্যারাতে।
চারিদিকে মানুষের আনাগোনা। গুলি করলে শব্দ হবে, মানুষের কাছে ধরাও পড়তে পারি। সেজন্য সুযোগের সন্ধানে ছিলাম। সতেরো আঠারো বছরের একটা ছেলে কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। ভবিষ্যতে অন্য মানুষদের খুন করার আগেই তাকে সরিয়ে ফেলতে হবে পৃথিবী থেকে। থানার পেছনের পুকুরপাড়ের পর নবাববাড়ি থেকে কাঠবাগানের একটি রাস্তা আছে। নিরিবিলি থাকে সেই সরু রাস্তাটি। আমার মাথা আর মুখ কালো চাঁদরে প্যাঁচানো। রুবেল আমার সামনে, গুনগুন করে গান গেয়ে হেঁটে যাচ্ছে। আমি দ্রুত পা চালিয়ে তার কাছাকাছি গিয়ে পিস্তল বের করলাম। ভাবলাম গায়ে গুলি করলে একের অধিক গুলি করতে হবে বা বেঁচে যেতে পারে। পিস্তল তাক করে আস্তে করে বললাম, রুবেল।
মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে ফিরতেই কপালে গুলি করে দিলাম। কথা বলার সুযোগ পায়নি, দাঁড়ানো থেকে পড়ে গিয়ে শুয়ে পড়ল। দুইবার পা নাড়িয়ে আর নেই। আমি দ্রুত পা চালিয়ে তিন রাস্তার মোড়ের দিকে যাবার সময় দুইটা বাড়ির গেইট খোলার শব্দ পেলাম। আরেকটু জোরে হাঁটা দিয়ে বড় রাস্তায় উঠে গেলাম। এখন সামনে পিছনে মানুষ আছে। ভয়ের কারণ নেই, তবুও আমি একটা রিক্সা দাঁড় করিয়ে উঠে বসে পড়লাম। দুই মাসেও রুবেল হত্যার খুণীকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। পাবে কীভাবে? আমি তো পাগল, ভবের পাগল। আমি মানুষ খুন করতে পারি? দাঁড়ি, গোঁফ আর চুলে এমন অবস্থা আমার রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলেও মানুষ বুঝে যে পাগল হেঁটে যাচ্ছে।
শিলমান্দী পৌঁছে পত্রিকার ছেঁড়া অংশটুকু নিলাম। গতকালের পত্রিকা ছিল। রাতে যখন চায়ের দোকানদার পানি আনতে গেল তখন দোকার প্রায় ফাঁকা। আমি পত্রিকার ধর্ষনের খবরের অংশটুকু ছিঁড়ে পকেটে ভরে নিয়েছিলাম। এখন বের করলাম দেখার জন্য শিলমান্দী কোথায় ঘটেছে ঘটনা। সেখানে লেখা শিলমান্দী আব্দুল বাতেন হাইস্কুলের পেছনের কলাবাগান থেকে লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। আমি স্কুলের দিকে যাচ্ছি আর মনে মনে ভাবছি কে ধর্ষণ করেছে এই খবরটা কার কাছে পেতে পারি? কীভাবে জানবো কে ধর্ষণ করে মেরে ফেলেছে মেয়েটাকে। আমার যে পাগলের বেশ কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করলেও তো কেউ কোনো জবাব দিবে বলে মনে হয় না।
পত্রিকার ছেঁড়া অংশ বের করে আবার দেখে নিলাম, মেয়েটির নাম নাসরিন। বয়স তেরো বছর। আমি স্কুলের কাছে গিয়ে দেখি ছাত্র-ছাত্রী ক্লাসে। শিক্ষকরা পড়াচ্ছেন। কোনো ছাত্র-ছাত্রী বাইরে নেই। স্কুলের পাঠ পেরিয়ে এক ঝালমুড়ি বিক্রেতা আরেকজন আইসক্রীম বিক্রেতা বসে আছে। অপেক্ষা করছে কখন টিফিন দিবে। তখন তাদের বিক্রি শুরু হবে। আমার পকেটে দুইশত সত্তর টাকার মতো আছে। পাঁচ টাকা কম হতে পারে, গত রাতে চায়ের বিল দিলাম। কলাবাগানের দিকে ঘুরে পকেট থেকে পাঁচ টাকা বের করলাম। ঝালমুড়ি বিক্রেতার কাছে গিয়ে বললাম, ঝালমুড়ি, ঝালমুড়ি। টাকাটা বাড়িয়ে দিতেই বিক্রেতা বলল, ঝালমুড়ি খাবি? দাঁড়া দিচ্ছি। জগতের পাগলদের বেশির ভাগ মানুষই তুই তোকারি ব্যবহার করে। আমার এতে মোটেও রাগ করলে চলবে না। কিঞ্চিত রাগ অবশ্য হচ্ছে। একটু পর সিগারেটে ভরে গাজা খেয়ে নেব তখন মনটা সরল হয়ে যাবে।
দুইটা ছেলে এলো। হাতে বেসলেট। গলায় পিতলের চেইন। একজনের চুলের স্টাইল সজারুর কাটার মতো। মনে হয় জেল দিয়ে এমন করেছে। শিলমান্দী একটি ইউনিয়ন। পল্লী গ্রাম, মানুষের বসতি কম। এখানে এমন স্টাইলিশ ছেলে মানেই বদ ছেলেপুলে। গ্রামে ভদ্র ছেলেরা এমন অদ্ভুত স্টাইল করবে না। এসেই ঝালমুড়ি বিক্রেতাকে বলল, কিরে? ঝালমুড়ি খাওয়াবি না? এই সপ্তাহের দুইশত টাকাও তো দিলি না। ঝালমুড়ি বিক্রতা ভয়ে কাচুমাচু হয়ে বলছে, একটু খাড়ান। আমি ঝালমুড়ি দিতাছি। ঝালমুড়ি খাওয়া শেষ করে সিগারেট ধরিয়ে একজন আরেকজনকে বলছে স্কুল ছুটি হতে দেরি আছে। আর পক্ষীগুলা ঐ রাস্তা দিয়াই যাইবো। চল সামনে যাই, এখানে স্যাররা দেখলে আবার গোপনে কারে না কারে ফোন দেয় কে জানে। দুইজন সিগারেট টানতে টানতে চলে যাচ্ছে। ঝালমুড়ি বিক্রেতা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। আইসক্রীম বিক্রেতা বলল, কেউ ওদের দিনে দুপুরে রাস্তায় মেরে ফেলতে পারে না? মরলে মসজিদে দশটা টাকা দিতাম।
ঝালমুড়ি বিক্রেতা বলল, মেয়েটারে মারছে সপ্তাহ ঘুরে নাই। এখনো সিনা টান করে ঘুরে বেড়ায়। ডর ভয় কিচ্ছু নাই।
আইসক্রীম ওয়ালা বলল, থানা হইছে দুনিয়ার এক মাথায় আমাদের গ্রাম আরেক মাথায়। পুলিশ আইতে আইতে পেট ভইরা ভাত খাইয়াও পালাইতে পারবো। আমি তাদের পিছু নিলাম। বুঝতে বাকি নেই এরাই নাসরিনের ধর্ষণকারী। ঝালমুড়ি ওয়ালার কথা এখনো শোনা যাচ্ছে, মাইয়াটা আমার কাছ থেইকা ঝালমুড়ি খাইতো আর বলতো মজা হইছে মামা। মাটির রাস্তার উপর কালবাট। দুইজন পাশাপাশি বসে কথা বলছে। আমি ধীরে ধীরে যাচ্ছি। আমাকে দেখলেও আমার প্রতি তাদের কোনো আগ্রহ নেই। পাগলের প্রতি আগ্রহ না থাকারই কথা। ওদের কাছাকাছি গিয়ে বললাম, মামা একটা সিগারেট দিবেন? গাঞ্জা খাইতাম।
ওরা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে সজারুর কাটার মতো চুলওয়ালা ছেলেটি বলল, গাজা আছে তোর কাছে? আমি বললাম তিন পুটলা আছে। ছয়টা স্টিক হইবো। খাইবেন আপনারা? সাথের ছেলেটা দ্রুত বলল, খাব না মানে? বের কর তাড়াতাড়ি। আমি তিনটা পুটলাই ওদের কাছে দিয়ে বললাম, এক কাজ করেন। একসাথেই বানান, আমারে একটা দিলেই চলব। দুইজনই গাজা পুটলা থেকে বের করে ছিঁড়ে রেডি করা শুরু করেছে। চারিদিক কত নীরব। নরসিংদী যে কলার জন্য বিখ্যাত তা এখানে প্রমাণ পাওয়া যায়। যতদূর চোখ যায় শুধু কলাবাগান।
ওরা দু’জন নিচের দিকে ঝুঁকে গাজা সিগারেটে ভরা শুরু করেছে। দুইচা ভরা শেষ। আমি কোমড় থেকে পিস্তলটা বের করে সজারুর কাটার মতো চুলওয়ালার ঘাড়ে গুলি করলাম। অপরজন মাথা তুলে তাকাতেই কপালে গুলি করে দিলাম। একজন কালবাট থেকে নিচে পড়ে গেল, অপরজন এখানেই পড়ে আছে। আমি বানানো স্টিক দুইটা থেকে একটা কানে গুঁজে নিলাম। লম্বা চুলের কারণে দেখা যাচ্ছে না। অপরটি ঠোঁটে নিয়ে আগুন দিলাম। টানতে টানতে রওনা দিলাম।
স্কুলের পাশ দিয়ে যাবার সময় আইসক্রীম ওয়ালা জিজ্ঞেস করল, এই পাগল। কিসের আওয়াজ হইছেরে ঐদিকে?
আমি বললাম, দিনে দুপুরে কে যেন ঐ ছেলে দুটোকে রাস্তায় মেরে ফেলে রেখেছে। ঝালমুড়ি আর আইসক্রীম বিক্রেতা দু’জনই হা করে তাকিয়ে আছে। বুঝার চেষ্টা করছে কী ঘটলো। ততক্ষণে আমি আরেক কলাবাগান পেরিয়ে রাস্তা বদল করে হাঁটতে লাগলাম। কালকে আবার শান্তিভাওলা যেতে হবে। সেখানে একজনকে নিজের হাতে শাস্তি দিতে হবে।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত