ভাইজান, আমার মেয়ের বিয়েতে আপনে যাইবেন না?আপনে গেলে আমার মেয়েটা অনেক খুশি হইবো ভাইজান। আমি বাইরে বের হতে যাচ্ছিলাম, পিছনে তাকিয়ে দেখি আসমার মা। হাতে ঘড়ি পরতে পরতে বললাম, দেখি, যদি সময় পাই তাহলে যাবো। তুমি যাওয়ার সময় তোমার ম্যাডামের কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে যেও। তোমার মেয়ের বিয়ের জন্য। আসমার মা আকুল কন্ঠে বললো, আমার টাকা লাগবো না,ভাইজান। আপনে বিয়েতে গেলে আমি খুশি। আমার মেয়েটা অনেক খুশি হইবো। ঠিক আছে। কাজ কর। দেখি কী করা যায়। আমাদের বাসার কাজের মহিলা আছেন একজন। আমরা তাকে আসমার মা বলে ডাকি। উনার মেয়ের নাম আসমা। তার আসল নাম জানিনা।
আসমার বিষয়ে আমার স্ত্রী আমাকে বেশ কয়েকবার জানিয়েছে। তার জন্য কিছু টাকা আলাদা করে রাখাও হয়েছে। আসমার মা চাচ্ছে আমি নিজে উপস্থিত থেকে তার মেয়ের বিয়ে দেই।সেটা সময়ের অভাবে হবে কিনা বুঝতে পারছি না। তাছাড়া আমি নিজে ততটা সামাজিক নই। ঝামেলা এড়িয়ে চলতেই পছন্দ করি। আসমার মা অনেক দিন যাবৎ আমাদের বাসায় কাজ করছে। বেশ বিশ্বস্ত লোক। এই সময়ে এমন বিশ্বস্ত মানুষ পাওয়া বেশ কঠিন। আসমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। অনেক দিন যাবৎ সে বলে যাচ্ছে, তার মেয়ের বিয়েতে আমাকে থাকতে হবে। সমস্যা হচ্ছে, তার মেয়ের বিয়ের দিনই আমার এক দূর সম্পর্কে বড়লোক আত্মীয়ের মেয়ের বিয়ে। সেখানেও যেতে হবে। গরীবের দাওয়াত মিস করা যায়, বড়লোকের দাওয়াত মিস করা যায় না। কেননা, বড়লোকের বাড়িতে থাকে বিশাল আয়োজন।
আমি ঘরকুনো মানুষ। সাধারণত দাওয়াত ফাওয়াত এড়িয়ে চলতেই পছন্দ করি। বিশেষ ঠেকায় না পড়লে কোথাও যেতে চাই না। আজকাল বাচ্চাদের কারনে যেতে হয়। বাসার সবাই আমার আত্মীয় বাড়ি যেতে চাইছে। আসমার বিয়েতে যেতে কেউ রাজি নয়।আসমার বিয়েতে গেলে বাচ্চাদের মজা হবে না, বড়লোকের বাড়ি গিয়ে হৈচৈ করা যাবে। বিয়ের দুইদিন আগে আসমার মা আমার কাছ থেকে কথা আদায় করে নিল,তার মেয়ের বিয়েতে আমি উপস্থিত থাকবো। বাচ্চাদের জানানো হলো, তারা আমার আত্মীয় বাড়ি যেতে চায়, আসমার বিয়েতে গিয়ে মজা নষ্ট করতে চায় না। বাচ্চাদের অনেক বুঝিয়েও রাজি করানো গেলো না।
তারা অনেক বড়লোকের বিয়েতে গেছে, এই জাতীয় গরীবের বিয়েতে যাওয়া হয়েছে কম। এমন বিয়েতে বেশির ভাগ সময় আমাকে একা যেতে হয়। বাচ্চারা যেতে উৎসাহ পায় না। আমি চাচ্ছিলাম তারা এ বিয়েতে অংশগ্রহণ করুক। এটাও একটা শিক্ষা। বিয়ের দিন আমরা আমাদের বড়লোক আত্মীয়ের বাসায় গেলাম। বিশাল প্যান্ডেল করা হয়েছে। লোকে গিজগিজ করছে। ঠিকমতো হাঁটা দায়। লোকজন ধাক্কাধাক্কি করে প্যান্ডেলে ঢুকছে খাওয়ার জন্য। অনেকে পিছনে চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে আছে, যিনি খাচ্ছেন তিনি উঠে গেলে যাতে টুপ করে বসে পড়া যায়। এইসব ভীড়ের কারণে আমি সাধারণত এসব অনুষ্ঠান বর্জন করি।
আমরা এক কোনায় দাঁড়িয়ে রইলাম। একবার আমার সেই আত্মীয়ের সাথে চোখাচোখি হলো। উনি দেখেও না দেখার ভান করে চলে গেলেন। কেউ যে কারও সাথে মন খুলে কথা বলবে সেই উপায় নাই। চিল্লাচিল্লি হৈচৈ হচ্ছে। বাচ্চারা গরমে অস্থির হয়ে গেল। নিজেকে কেমন যেন অসহায় লাগলো। এখানে কেউ যেন কাউকে চিনতে পারছে না। হাই হ্যালো করেই কথা শেষ। এমন সময় আসমার মা ফোন দিল,ভাইজান আপনে কখন আসবেন? কথা ছিল, এখানে খাওয়া দাওয়া করে আমি একা আসমার বিয়েতে যাবো। মূহুর্তে ডিসিশান পরিবর্তন করে ফেললাম। বউকে বললাম, চল আসমার বিয়েতে গিয়ে খাবো।এখানে এক মূহুর্তও থাকবো না।
আমরা তৎক্ষনাৎ বিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে এলাম। কেউ আমাদের খেয়ালও করলো না। আমার মতো লোক এই বিয়েতে থাকা না থাকা সমান। কারোই কিছু যায় আসে না। আসমাদের বাড়ি কখনো যাওয়া হয়নি। ঠিকানা অনুযায়ী একটা বস্তিতে গিয়ে হাজির হলাম। নোংরা কাঁদা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। অনেক কষ্টে তাদেরকে খুঁজে বের করতে হলো। একটা খুপরি বস্তিতে বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। ছোট্র একটা প্যান্ডেলে মাত্র দুইটা টেবিল সাজানো হয়েছে। অতিথি সামান্য। মাত্র ছয়-সাত জন লোক আসবে আসমাকে তুলে নিতে। আমরা সেখানে উপস্থিত হওয়া মাত্র আসমার মা দৌড়ে এলো। আমাদেরকে দেখে আনন্দে কেঁদে ফেললো। সে তক্ষুনি আসমাকে ডেকে আনলো। মেয়েটা পা ছুঁয়ে সালাম করলো।
আমরা এক টেবিল খেতে বসেছি। আসমা এবং আসমার মা নিজ হাতে আমাদেরকে খাবার পরিবেশন করছে। একজন তালপাখা এনে বাতাস করছে।আমি আসমাকে আমার পাশে বসালাম। তাকে আমার সাথে খেতে বললাম। দেখলাম তার চোখ ছলছল করছে! আমি বললাম, আসমা কাঁদছো কেন? সে কোন কথা বললো না।আসমার মা চোখ মুছতে মুছতে বললো, ভাইজান, ওর বাবা নাই, জীবনে কারও ভালবাসা পায় নাই।আপনি এসেছেন এই আনন্দে কাঁদছে। আমি আসমার মাথায় হাত রাখলাম। মেয়েটা ডুকরে কেঁদে উঠলো। ভাইজান,এখুনি চলন আইসা পড়বো,আপনে থাকেন, আমার মেয়েটারে দোয়া কইরা যাইবেন। আমার মেয়ের জামাই না দেইখা আপনে যাইতে পারবেন না।
আমি আল্লাহ তায়ালাকে ধন্যবাদ দিলাম। যদি ওখানে খেয়ে ফেলতাম, তাহলে এমন ভালবাসা দেখতে পেতাম না।এরা যে ভালবাসা দেখাচ্ছে তা কৃত্রিম নয়।এরা যাকে ভালবাসে, মন থেকেই বাসে। খাওয়া দাওয়ার পর চেয়ার নিয়ে দূরে গিয়ে বসলাম। আসমার মা একজনকে পাাঠালো পাখা নিয়ে বাতাস করার জন্য। আমি আমার স্ত্রীকে বললাম, এই মেয়ের বিয়ে শেষ না করে আমি যাবো না। আমি শেষ পর্যন্ত থাকবো। স্ত্রী বললো,তাহলে আমিও থাকি। বাচ্চারাও বললো, আমরাও থাকবো,বাবা ! আমি বললাম, অবশ্যই তোমরা থাকবে। তোমাদের থাকতেই হবে। আসমাকে সাজিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব তোমাদের। যাও দায়িত্ব পালন কর।
স্ত্রী বাচ্চাদের নিয়ে চলে গেল আসমাকে সাজাতে। আমি মনে মনে আবারও আল্লাহকে ধন্যবাদ দিলাম, এ বিয়েতে উপস্থিত হতে পেরেছি বলে। দশজনের মতো লোক বরযাত্রী হয়ে এসেছে। তাদের খাওয়া দাওয়া হওয়ার পর বিয়ে পড়ানোর জন্য কাজি ডাকতে লোক পাঠানো হলো। কাজি এলেন একঘন্টা পর। বিয়ে পড়াতে গিয়ে সমস্যা তৈরি হলো। একজনকে উকিল বাবা বানাতে হয়। উকিল বাবা খুঁজে পাওয়া গেলো না। শেষে আমি নিজে উকিল বাবা হয়ে গেলাম! শেষ বিদায়ে মেয়েটা আমাকে এবং তার মাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কাঁদলো।কেন জানি আমার চোখেও পানি চলে এলো।
জীবনে অনেক বড়লোকের বিয়েতে অংশ গ্রহণ করেছি। সেখানে কেউ কারও খবর রাখে না।ধাক্কাধাক্কি করে খেতে হবে বলে কতো বিয়ে থেকে না খেয়ে চলে এসেছি,কেউ খোঁজ নেয়নি। তারপরও বড়লোকের দাওয়াত মিস করি না, কিন্তু গরীবের দাওয়াতে যেতে চাই না। আসমা নামক গরীব মেয়েটার বিয়েতে গিয়ে যে ভালবাসা পেয়েছি, তা আমার জীবনে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে!
গল্পের বিষয়:
গল্প