কায়সুল হক বলে একদিন ছিলেন কি কেউ এই পৃথিবীতে, কিংবা মহারাজগঞ্জ বলে কোনো এক গঞ্জ, কালনাগিনী বলে কোনো স্রোতস্বিনী কিংবা বাংলাদেশ বলে কোনো দেশ?
আজ সব স্বপ্নের মতো মনে হয় – যেন বিগত জন্মের দেখা কোনো স্বপ্ন। মাঝরাতে হঠাৎ কোনো কোনোদিন সুষুপ্তিলোক থেকে জেগে ওঠা হাওয়া গাছের ঘুমন্ত পাতার কানে কানে ফিসফিস করে কথা বলতে শুরু করলে আমার মহারাজগঞ্জের কথা মনে পড়ে যেত। গাছের পাতায় বৃষ্টির শব্দে মনে হতো, কালনাগিনীর খালে ভাটায় কুলকুল করে জল নেমে যাচ্ছে। ধড়মড় করে বিছানায় জেগে উঠে ভাবতাম, এই হাওয়া আর বৃষ্টির শব্দকে ছাপিয়ে কেউ যেন এখনি ভরাট গলায় ডেকে উঠবে – উঠুন উঠুন মশাই, একটা নতুন পৃথিবী জন্ম নিতে চলেছে – আর বিছানায় পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছেন আপনি এখনো? এই কি ঘুমের সময়?
আমি উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠে বলছি – সত্যি হকসাহেব? সত্যি? আমাদের দুজনের কল্পনার সেই পৃথিবীটা জন্ম নিচ্ছে তাহলে শেষ অবধি? এও কি সম্ভব?
হক সাহেব একজন কবি বলেই কবির ভাষায় বলছেন, শুনছেন না? বাতাস উলু দিচ্ছে – আঁতুড়ঘরে শিশু জন্মালে আপনাদের মেয়ে বউরা উলু দেয় যেভাবে। অত্যন্ত রোগা দুর্বল চেহারার মানুষ হকসাহেব। মুখাবয়ব ভাঙাচোরা কিন্তু যেন প্রবল ব্যক্তিত্বে খোদাই করা। কালো ফ্রেমের চশমার নিচে চোখদুটো ভীষণরকম উজ্জ্বল। মুখে হাসি আমি অল্পই দেখেছি হকসাহেবের। গম্ভীরভাবে তিনি যেন শুধু দেখেই চলেছেন তার চারপাশে দেখার যোগ্য আছে যা কিছু। যেন দেখা শেষ হলেই সবকিছু বুঝে ওঠার আনন্দে উজ্জ্বল চোখদুটি হেসে উঠবে তার; কিন্তু দেখাই আর তার শেষ হয়ে উঠছে না। চশমার নিচে চোখদুটো তাই তার সবসময়ে গম্ভীর, আত্মমগ্ন।
মহারাজগঞ্জে আমার সবচেয়ে চেনা ও সবচেয়ে অচেনা যে-মানুষ সেই কায়সুল হকের সঙ্গে একটা বিষয়ে আমার খুব মিল ছিল- আমাদের দুজনেরই বাসা ছিল কালনাগিনী খালের পাড়ে – বড়তলা নদী থেকে বেরিয়ে যে-খাল এঁকে বেঁকে বেঁকে চলে গেছে বিশাল সপ্তমুখী নদীর দিকে। খালের জলের ছায়ায় মুখ দেখা বিষ্ণু সামন্তের বাড়ির দোতলায় ছিল আমার ডেরা। দোতলার ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে নিচে তাকালে দেখা যেত নদীপাড়ের প্রশান্ত চাতাল – পূর্ণিমা-অমাবস্যার ভরাগোণে সোলাজল উঠে আসত যে-চাতালে আর শব্দ করত খলাৎ খলাৎ। ছ-মাল্লার মাছ ধরার ছোট ডিঙি, বড় মহাজনী নৌকো সব বৈঠার ঘায়ে জলে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তুলে এসে ভিড়ত সেই চাতালে। তারপর শুরু হতো নৌকোর সঙ্গে নৌকোর, হাওয়ার সঙ্গে জলের, রাক্ষসখালির মাল্লাদের সঙ্গে বুড়োবুড়ির তটের মাল্লাদের হাসি-গান আর কথাচালাচালি। সন্ধের মুখে কাঠের উনুনে রান্না চাপাত মাল্লারা। বাতাসে ফ্যানাভাত, ডালের সম্বরা আর রূপবতী মাছের ঝোলের গন্ধ। বৈতালের (কুমড়ো) খন্দে বৈতাল আর তরমুজের খন্দে তরমুজের গন্ধমাদন পাহাড় নিয়ে নৌকোগুলো যখন এসে ভিড়ত চাতালে, তখন শীত শেষ হয়ে বসন্ত আসি আসি করছে। ঈষৎ তপ্ত দোখে না (দক্ষিণা বাতাস) ভেসে আসছে সমুদ্র থেকে, বয়ে আনছে তরমুজের খড়কুটোর বিছানার কেমন বুনো মিষ্টি গন্ধ।
সেই হাওয়া, সেই অগ্নিকুণ্ড, মাঝি-মাল্লার সেই অদ্ভুত গানের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তাম আমি। জেগে উঠে খালি মনে হতো চোখের সামনে দেখা এই পৃথিবীটা – এ যেন অন্য গোপন একটা পৃথিবীর কথা বলতে চাইছে, যদিও জানি না সে-পৃথিবী আসলে ঠিক কীরকম।
হকসাহেবের বাড়ির সামনের খালটা ছিল কিন্তু নিরালা-নিঃশব্দ। আমার বাড়ির পাশের খালে ছিল লোহার ভারী পুল – মাঝি-মাল্লারা বলত সিসের পুল সবুজ তরমুজ আর হলুদ রঙের পাকা বৈতালভর্তি লরি গমগম শব্দে যেত সেই পুলের ওপর দিয়ে। হকসাহেবের বাড়ির পাশের পুলটা ছিল কাঠের। পথচারীরা হাঁটলে মৃদু শব্দ হতো তাতে। হকসাহেব স্কুল থেকে ফিরে এসে খাটের ওপর চায়ের কাপ আর মুড়ির বাটি রেখে নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকতেন খালের দিকে – যেন এই খালের দুপাড়ের বিরল নির্জন তাই তিনি দুচোখ ভরে দেখে নিতে চাইছেন, যার চেয়ে বেশি যেন আর কিছুই দেখার নেই তার এই পৃথিবীতে। অফিস ছুটির পর আমিও মাঝেমঝে গিয়ে বসতাম হকসাহেবের কাছে গল্পগাছার জন্য। যত টানা কথা বলতাম তার চেয়ে বেশি তাকিয়ে থাকতাম খালের দিকে। আমার ওখানে খালের পাড় থেকে সোজা উঠে গেছে খাপড়া আর টিনের চালের দোকানঘর, মাছের আড়ত, কাঠের গোলা। হকসাহেবের এখানে সরুখালের দুপাড়ে গেয়োগরানের ঝুপসিকালো জঙ্গল। বড় বড় নৌকো কেমন নিঃশব্দে কালো মেঘের মতো আনাগোনা করে খালের জল বেয়ে। আমার ওখানে মাছের আড়ত, কাঠের গোলার গমগম – হকসাহেবের এখানে নিঃশব্দ সমাধিক্ষেত্রের মতো যেন এক ভাঙা ছাপাখানা। মাকড়সার ঝুল, কাঠের কড়িবরগা ঘুণপোকার খাওয়ার শব্দ। পুরনো ভাঙা সিসের অক্ষর ছড়িয়ে থাকে কাঠের গ্যালিতে। খালপাড়ে এত নিচু জায়গায় সে-ছাপাখানা যে, ভাদ্রের ভরাগোণে খালের জল উঠে এসে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ করত ছাপাখানার তালের গুঁড়ির সিঁড়িতে। আবছা আলোয় টেবিলে ঝুঁকে পড়ে মনোহরণবাবু গ্যালিতে টাইপ সাজান – হকসাহেব সেদিকে তাকিয়ে মনশ্চক্ষে সে-দৃশ্যই দ্যাখেন? আসলে এই ছাপাখানাই তোহ কসাহেবের এক নিঃশব্দ গোপন সাম্রাজ্য।
আমি রসিকতা করে বলতাম – চুপচাপ বসে কী দ্যাখেন হকসাহেব? এই অন্ধকারের ভেতর আর এক অন্ধকার? এই কালনাগিনীর ভেতরে অন্য এক কালনাগিনী?
স্বভাবতই চুপচাপ স্বভাবের হকসাহেব ক্ষীণ একটু হাসি হেসে বলতেন – খুব আশ্চর্য অন্ধকার না? আলো মানুষকে কতটুকুই বা আর দেখাতে পারে বলুন তো – অন্ধকার তার চেয়ে কত বেশি দেখায় –
আমি বলতাম, আমার দোতলা বাড়িতে একবার এসে থাকুন হকসাহেব – দেখবেন হাওয়ার চিৎকার, জলের উল্লাস, নৌকোর যাত্রীদের উদ্দেশে মাঝি-মালস্নার রাক্ষসখালি রাক্ষসখালি -ই-ই বলে চিৎকার – যেন এই পুরনো পৃথিবীটাকে খালি করে দিয়ে আশ্চর্য এক রাক্ষসখালির দিকে চলে যেতে বলে তারা। সেখানে যেন অন্য আর একটা জীবন আমাদের জন্য ওঁৎ পেতে বসে আছে। যেন এখনি সে বেরিয়ে আসবে আমাদের সামনে; কিন্তু আসে না। আমিও বসে বসে দেখি – দেখা যেন আর ফুরোয় না। সত্যি কি কোনোদিনই নতুন একটা পৃথিবী দেখতে পাব আমরা? হকসাহেব আমার দিকে তার তীক্ষ্ণ চোখদুটি মেলে দিয়ে বলতেন – আপনিও তাহলে মনে মনে অন্য এক পৃথিবীর স্বপ্ন দ্যাখেন?
আমি প্রায় একরকম অপমানিতই বোধ করলাম কিন্তু তা প্রকাশ হতে না দিয়ে আলমারিভর্তি তার কবিতার বইয়ের দিকে তাকিয়ে বলতাম – কেন স্বপ্ন দেখব না বলুন তো, আপনার মতো কবিতা না লিখলেও কবিতা কিন্তু আমি পড়ি হকসাহেব। পড়তে ভালোবাসি।
একটু লজ্জা পেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হকসাহেব মৃদু হেসে বলেন – কবিতা যাঁরা লেখেন, তাঁদের চেয়ে কবিতা যাঁরা পড়েন তাঁদের আমি কিন্তু কম শ্রদ্ধা করি না। বরং হয়তো একটু বেশিই করি। কবির সৃষ্টির অহমিকা তো আর কবিতাপাঠকের নেই। আমার সৌভাগ্য রতনবাবু যে, আপনার মতো একজন কবিতাপাঠকের সঙ্গে আমার দেখা হলো।
বদলি চাকরির সুবাদে সদ্য মহারাজগঞ্জে আসা আমার সঙ্গে হকসাহেবের একটা বড় ফারাক বোধহয় এই যে, কবে থেকে এই জলজঙ্গল-হাওয়ার দেশের বাসিন্দা তিনি, তা বোধহয় এখানে কেউ আর মনে রাখেনি। বিএ পাশ করে কবে যে হকসাহেব এই গ-গ্রামে স্কুলমাস্টারির চাকরি নিয়ে এসেছিলেন তা হকসাহেব নিজেও কি আর মনে রেখেছেন?
মহারাজগঞ্জে বদলি হয়ে আসার পর হকসাহেবের সঙ্গে যেটুকু আমার পরিচয় তা যেন দূরপাল্লার ট্রেনে পাশাপাশি বসে থাকা একই কামরার দুজন যাত্রীর যে-পরিচয়। মহারাজগঞ্জ যেন ট্রেনের সেই কামরা, যেখানে আমরা দুজন পাশাপাশি বসে আছি। বদলি হয়ে যে-কোনো একটা স্টেশনে আমি নেমে যাব – হকসাহেব কিন্তু নামবেন না এই কামরা থেকে। এই গাড়িতে চড়েই কোন স্টেশনে তিনি পৌঁছে যাবেন কে জানে – কিন্তু আমাদের পরস্পরের আর দেখা হবে না, কথাও আর হবে না কোনো। কেননা, আমাদের গন্তব্য আলাদা।
কিন্তু সেদিন সেই নিস্তব্ধ অন্ধকাররাতে যখন নতুন একটা পৃথিবীর স্বপ্ন আমরা পরস্পরের কাছে ব্যক্ত করলাম, সেদিনই যেন মনে হলো আমরা নিছক আর ক্ষণিকের সহযাত্রী নই, আমাদের দুজনের যাওয়ার জায়গা একই। সেদিনই হকসাহেব বললেন – আমি একদিন যাব আপনার দোতলার ডেরায় রতনবাবু। দেখে আসব কোন পৃথিবীর স্বপ্ন দ্যাখেন আপনি। তারপর একদিন হকসাহেব আসেন আমাদের খালপাড়ের বাড়িতে। অনেক রাত অবধি আমরা দুজনে বসে থাকি বারান্দায়। নিচে ফেরি-নৌকোর মাঝিদের হাঁকডাক -রাক্ষসখালি… রাক্ষসখালি… বুড়োবুড়ির তট… বুড়োবুড়ির তট…। সেই দেশ থেকে যেন ছুটে আসছে হাওয়া; শুনতে শুনতে মাঝে মাঝে ঘোর লাগে। মনে হয়, এই কি সেই নতুন দেশ, যার স্বপ্ন দেখি আমরা?
অনেক রাতে ওঠেন হকসাহেব। আমি তাকে সিসের পুলের গোড়া অবধি পৌঁছে দিই। তিনি কোনো কথা বলেন না, আমিও না, যেন সামান্যমাত্র শব্দ উচ্চারণেই অদেখা যে-পৃথিবীটা আমরা নিজেদের মধ্যে দৃশ্যমান করে তুলতে চাইছি, তা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যাবে।
কাঠগোলার পাশ দিয়ে নিচের রাস্তায় নামার আগে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গিয়ে কেমন যেন আবেশের ঘোরে বলেন – আর একদিন আপনার বাড়ি আসব রতনবাবু, আজ অমাবস্যা গেল, সেদিন থাকবে পূর্ণিমা। আজ আকাশের তারারা ভিড় করেছিল আমাদের অন্য পৃথিবীর গল্প শুনবে বলে, আমরা চুপ করে ছিলাম। সেদিন আমরা গল্প শুনতে চাইব, জানি না জ্যোৎস্নারাত সে-গল্প সেদিন বলতে পারবে কি না।
হেসে বললাম – তাহলে বলুন সে-পৃথিবীটার গল্প আমরা কেউই জানি না। সে-পৃথিবীটা চিরকাল গর্ভেই থাকে, ভূমিষ্ঠ হয় না কখনো। গর্ভের আবার গল্প কি? গল্প তো ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরের গল্প।
হকসাহেব একটু মৃদু শ্বাস ছেড়ে বলেন – সত্যি কি সেই পৃথিবী এই পৃথিবীতে জন্মাত না? কোনো দিনই?
আমি চুপ করে থাকি। আমরা কেউই এর উত্তর জানি না। হকসাহেব অন্ধকারে নিঃশব্দে মিলিয়ে যান।
দুই
তারপর মহারাজগঞ্জের খালপাড়ের দুই প্রামেত্মর দুই বাসিন্দা আমাদের মাঝেমধ্যে এখানে-ওখানে দেখা হয়ে যায়; কিন্তু আমরা সেই স্বপ্নের কথা আর বলি না পরস্পরকে। যেন তা বলার মতো কথাই নয় – নিঃশব্দে নিজের মধ্যে লালন করার জিনিস শুধু তা। কিন্তু এমনিভাবে চলল না বেশিদিন। আমাদের সেই স্বপ্নের পৃথিবীটা যেন এ-মুহূর্তেই হাতের মুঠোয় পেতে চলেছি, এমনিভাবে আমার খাড়া দোতলা সিঁড়ি বেয়ে পড়ি কি মরি কাছে ছুটে এসেছিলেন রোগা মানুষ হকসাহেব। পরিশ্রমে হাঁপাচ্ছিলেন তিনি। আমি তখন সবে সুন্দরবনের দ্বীপে দ্বীপে সার্ভের কাজের শেষে মহারাজগঞ্জে ফিরে দশদিন টানা নৌকোয় বসবাসের ক্লান্তি জলে ধুয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে গায়ে পাউডার দিয়ে একটু বসেছি। তখন এই আবির্ভাব হকসাহেবের। উত্তেজনায় তার শরীরটা যেন বাঁশপাতার মতো থরথর করে কাঁপছে। সব সময়েই তীব্র একটা মানসিক অবস্থায় বাস করার দরুন অনিদ্রা রোগ আছে হকসাহেবের -আর তার ফলে স্নায়ুদৌর্বল্য। সেই স্নায়ুদৌর্বল্যের কারণেই ওর শরীর অমনি কাঁপছিল। আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, রতনবাবু, আমাদের সেই পৃথিবীটার জন্মের শব্দ শুনতে পাচ্ছেন তো -বেশি আর দেরি করতে হবে না আমাদের। কিছু না বুঝতে পেরে আমি বলি -ওই চেয়ারটায় আপনি বসে পড়ুন হকসাহেব। শরীর যেরকম কাঁপছে, পড়ে যাবেন যে। কী ব্যাপার বলুন তো -কী হয়েছে?
ভীষণ উত্তেজিত হয়ে বলেন হকসাহেব -সে কী? আপনি কোনো খবরই রাখেন না? খবরের কাগজ পড়েননি?
-না হকসাহেব। নৌকোয় নৌকোয় আমি এতদিন বাইরের সমুদ্রে ঘুরছিলাম। সমুদ্রে তো আর কোনো কাগজওয়ালা খবরের কাগজ ফেরি করে না। দশদিন আমি এই পৃথিবীর সময়-স্রোতের বাইরে ছিলাম। একরকম নির্বাণে ছিলাম আমি।
-শুনুন রতনবাবু, মুজিবুরকে খানসেনারা গ্রেফতার করে ইসলামাবাদ নিয়ে গেছে। যাওয়ার আগে তিনি দেশের মানুষকে ডাক দিয়ে গেছেন স্বাধীন একটা দেশ সৃষ্টি করার জন্য। ঘরে ঘরে তাঁর জন্য মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। খানসেনার গুলিতে মারা যাচ্ছে শয়ে শয়ে নিরীহ লোক; কিন্তু তাতে ভয় পাচ্ছে না মানুষ। আরো জোরদার হচ্ছে লড়াই। ভাবতে পারেন, শুধু নিজের মুখের ভাষাকে হৃদয়ের কোথায় বসিয়েছে তারা? নিজের ভাষা বলার দাবিতে একটা নতুন দেশ জন্ম নিতে চলেছে পৃথিবীতে – এমনটা হয়েছে আগে কখনো? উত্তেজনায় হকসাহেবের কপালের ডানদিকের রগ দবদব করছিল। দেখে মনে হচ্ছিল, সেই নতুন পৃথিবীটা যেন তার ভেতরেই জন্মগ্রহণ করতে চলেছে। আমি হেসে বললাম -আপনি কবি বলেই বোধহয় ভাষার ভিত্তিতে একটা দেশ জন্ম নিতে যাচ্ছে -তাতে এত আনন্দ আপনার।
হকসাহেব একটু থেমে আস্তে আস্তে বলেন -ঠিক তা নয় রতনবাবু, মুখের ভাষা মানুষের মুখ থেকে কেড়ে নেওয়ার যে গর্হিত অন্যায়, তার বিরুদ্ধে লড়াই করে জন্ম নেবে যে-দেশ, সেখানে কোনো অন্যায় আর কখনো মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারবে ভেবেছেন? না না, ভারি সুন্দর একটা স্বপ্নের দেশ জন্ম নিতে যাচ্ছে, যে-দেশ গন্ধের দেশ, হাওয়ার দেশ, ভৈরবী রাগিণীর দেশ। আপনি আমার কথা বুঝতে পারছেন তো রতনবাবু?
এমনিতে খুবই আত্মমগ্ন স্বভাবের মানুষ হকসাহেব। সবার শারীরিক স্পর্শ এড়িয়েই চলতে চান তিনি; কিন্তু আজ তার কী যে হলো -স্বভাবভ্রষ্ট হলেন তিনি। রোগা হাতে আমার ডান হাত জড়িয়ে ধরে বলেন -চলুন রতনবাবু আপনি তো গান খুব ভালোবাসেন -একটা আশ্চর্য গান শোনাব আপনাকে। ঘোরে-পাওয়া হকসাহেব বিস্ময়াভিভূত আমাকে একরকম প্রায় টেনে নিয়ে যান তার বাড়িতে -খালের দিকের জানালা খুলে দিয়ে দেয়ালের তাকে রাখা রেডিওটা চালিয়ে দিয়ে বলে – শুনুন। কিন্তু এ তো গান নয়, কৌতুকোদ্দীপক এক পুরুষ-কণ্ঠস্বর শুনি আমি…।
– বাংলাদেশের রাজধানী মুজিবনগর থেকে বলছি… হালার পো হালা খানসেনারা অহন গোরুর পালের মতোন ছোটছে -পিছন পিছন পাঁচন হাতে আমাগো কচিকাঁচা পোলাপানরা – হো-হো হাসির শব্দে চমকে উঠে দেখি গম্ভীর প্রকৃতির হকসাহেব পাগলের মতো হাসছেন -প্রবল হাসিতে তার চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এসেছে প্রায়।
-কী বুঝলেন মশাই, ভেবেছিল শয়তানরা যে, বন্দুক-বোমার শক্তিই সব -মানুষের আত্মা বলে যেন কিছু নেই -এবার বুঝুক কত ধানে কত চাল।
আমি অবাক হয়ে বললাম -দেশটার জন্মই হলো না এখনো – এর মধ্যে তার রাজধানীর নামও ঠিক হয়ে গেল?
বিস্মিত চোখ মেলে বললেন হকসাহেব -কে বলল বলুন তো দেশটার জন্ম হয়নি এখনো -আমরা সবাই-ই তো বুকের মধ্যে একটা মুজিবনগর নিয়ে ঘুরে বেড়াই -কিন্তু চোখে দেখতে পাই না তাকে এই যা। চোখ কি আর চোখের মণিকে দেখতে পায়? কিন্তু এবার সেই অসম্ভবও সম্ভব হবে। চোখের বাইরে এবার আমরা দেখতে পাব চোখের মণিকে, যা শুধু একটা ভাব নয় –রক্তমাংসের প্রত্যক্ষ একটা জিনিস। আমাদের আর কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে – শুধু আরো কিছুদিনের অপেক্ষা।
কত রাত অবধি এক অলীক মুজিবনগর থেকে ইথারের ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেসে আসা সেই অলীক যুদ্ধের কথকতা। মাথার ওপর চাঁদ উঠে আসে। হকসাহেব সিঁড়ির মুখ অবধি আমাকে পৌঁছে দিয়ে বলেন, কালও আসবেন কিন্তু, আমরা দুজন সাক্ষী থাকব পরস্পরের, যাতে এ-দিনগুলোর কথা কখনো না ভুলে যাই আমরা।
চশমার নিচে হকসাহেবের চোখদুটিতে কী ব্যাকুল চাহনি। সেই চাহনির টানেই আমি অফিস থেকে ফিরে একটু জলখাবার মুখে গুঁজেই সোজা চলে যেতাম হকসাহেবের বাড়িতে। রেডিওর নব ঘোরানোর আগে হকসাহেব বলতেন -আজ দেখবেন আশ্চর্য একটা খবর পাবেনই -দুর্যোধন আর শকুনিরা কতদিন আর চালাবে এই যুদ্ধ? ব্যাকুল আঙুলে হকসাহেব নব ঘোরানোর সঙ্গে সঙ্গেই ইথার সমুদ্রে ঢেউ উঠত।… ফরিদপুর আবার কব্জা কইর্যা নিছে আমাগো পোলাপানরা। গেরিলাযুদ্ধে সম্মোহন বাণের ঘায়ে পাগলের মতো ছোটতে আছে খানসেনারা নদী-নালার দিকে, যেহানে পানিতে ডুইব্যা মরছে তারা -আহা রে, খরার দেশের খানসেনাগো এই একডা বড় অসুবিধা – বাপ-মা-রা তো সাঁতার শেখায় নাই তাগো। ছি ছি কী গুনা অহন মিঞাগো, মাটির বদলে শ্যাষে কিনা পানির নিচে গোর -আহা দোজখেও তো ঠাঁই হইবে না অগো।
হকসাহেব ছেলেমানুষের মতো উত্তেজনায় হাততালি দিয়ে বলতেন -দ্যাটস দ্য রাইট স্ট্র্যাটেজি। নদীই আমাদের দেশের মা রতনবাবু। নদীই গ্রাস করবে ওদের। শক্ত ডাঙার লোক ওরা ভেবেছিল, জলের দেশের লোকেরা তো খুব নরম, তাই মানুষ নামের যোগ্যই নয়। এবার দেখুক নরমের গরম।
বলতাম -কিন্তু এ-যুদ্ধের কি আর শেষ নেই? যুগ যুগ ধরে চলবে এ-যুদ্ধ? হকসাহেব বলতেন -দশ মাস দশ দিনের গর্ভবাসের পর তো জন্ম নেয় মানুষের সম্মান। এ তো একটা নতুন দেশ – অন্ধকার থেকে সূর্যের মতো উঠে আসা একটা দেশ। এর জন্মের জন্য কিছুটা অপেক্ষা তো আমাদের করতেই হবে রতনবাবু।
কথাগুলো বললেন বটে হকসাহেব; কিন্তু কণ্ঠস্বর কি তার একটু টাল খেয়ে গেল? তাহলে কি তার ভেতরেও আমার মতো একটা সংশয় ঢুকে গেছে যে, যে-নতুন দেশের জন্মের কথা আমরা মনে মনে ভাবছি তার জন্ম কখনো সম্ভব নয়?
পরের দিনটা ছিল রোববার। হকসাহেবের জন্মদিন। নিজের জন্মদিনটা হকসাহেব ব্রতের মতো পালন করেন। প্রায় মৌনতাই অবলম্বন করেন তিনি সেদিন। সারাদিনই প্রায় ঘর বন্ধ করে গীতাঞ্জলি পাঠ করেন।
আমার এ-সংবাদ জানা ছিল না। সকালবেলা তার বাড়িতে পৌঁছতেই হকসাহেব তার মৌনতা ভেঙে বললেন, আজ আমার জন্মদিন রতনবাবু, গীতাঞ্জলি পাঠ করছিলাম। আমার জন্মদিনটা আমি শুধু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কাটাই।
হেসে বললাম -তাহলে বলুন, আমি ধ্যানভঙ্গ করলাম আপনার। কিন্তু রেডিওটা খুলে দেখুন না একবার, এমনও তো হতে পারে যে, আজই হয়তো মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করল খানসেনারা। আজই হয়তো আপনার স্বপ্নের দেশ মাতৃগর্ভ থেকে আলোয় বেরিয়ে এলো। আপনার জন্মদিন আর সেই নতুন পৃথিবীর জন্মদিন একাকার হয়ে গেল।
বিষণ্ণ স্বরে বলেন হকসাহেব -আমার পাগলামি নিয়ে কৌতুক করছেন আপনি -না? বললাম -ছি ছি! কৌতুক করব কেন?
চুপ করে ছিলেন হকসাহেব। হঠাৎ তার চোখে যেন কিসের বিদ্যুৎ খেলে গেল। যেন হঠাৎ খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনে পড়ে গেছে তার। হঠাৎ আমার হাত ধরে প্রায় টানতে টানতে আমাকে নিয়ে গেলেন -পুলের গোড়ায় বাঁশের কড়িবরগা আর দরমার দেয়াল দিয়ে ঘেরা সেই ছাপাখানায়। টাইপ কম্পোজরত মনোহরণবাবু চশমার নিচে একটু ট্যারাচোখে তাকিয়ে বলেন -আবার কি হকসাহেব? এই তো সেদিন আপনার কবিতার বই ছাপালেন এখান থেকে? উহ্, আপনার বই কম্পোজ করতে গিয়ে আমার মাথার চুলটুল সব সাদা হয়ে গেছে। মেরি আঁতানোয়েতের একরাতে মাথার চুল সব পেকে গিয়েছিল; আমার লেগেছে আরো কয়েক রাত -এই যা –
হকসাহেব হেসে বলেন -এবার কবিতার বই নয় মনোহরণবাবু, কবিতার পোস্টকার্ড। এক পিঠে আমার কবিতা থাকবে, অন্য পিঠে রতনবাবুর। জানাশোনা যারা আছে সবাইকে এই কার্ড পোস্টে পাঠাব। আজ আমার জন্মদিন মনোহরণবাবু। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে নাইবা নিতে পারলাম ভীম বা অর্জুনের ভূমিকা, সঞ্জয়ের ভূমিকাটুকু তো নিতে পারি অন্তত। আমার জন্মদিনে নতুন এক পৃথিবীর জন্ম ঘোষণা করে যেতে পারি আমি।
মনোহরণবাবু মৃদু কৌতুকের হাসি হেসে বলেন -আপনার মাথাটা খারাপ মাস্টারমশাই। খানসেনারা লেজ তুলে পালিয়ে গেলেই একটা নতুন পৃথিবী স্বর্গ থেকে টুপ করে খসে পড়বে নাকি? মানুষের চরিত্র সর্বকালে সর্বদেশে যে একই রকম তা আপনার না জানার কথা তো নয় মশাই, আপনি তো কবি। এই জগৎ-সংসারের সব সত্যই তো কবিদের জানার কথা।
হকসাহেব বলেন -মানুষ জগৎ-সংসারের সব সত্য জেনে বসে আছে নাকি? There happen more things in heaven and earth। মনোহরণবাবু, যা আমাদের ধারণারও বাইরে। নাহলে কখনো ভাবতে পেরেছেন ধর্ম নয়, জাত নয়, অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়া নয়, শুধু ভাষার দাবিতে জন্ম নিতে চলেছে একটা নতুন দেশ –
আমি বললাম, আমি কিন্তু কবিতা লিখতে পারব না হকসাহেব। আমি কবিতা পাঠকমাত্র, কবি নই।
হকসাহেব জোর গলায় বলেন -কবিতা আপনাকে লিখতে হবেই রতনবাবু, যাঁরা নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দ্যাখে, তারা সবাই কবি -এর চেয়ে বড় কবিতা আর কী আছে?
বেরোবার সময় কালনাগিনী খালের জল জোয়ারে অনেকটা ওপরে উঠে এসেছে প্রায় দরজা অবধি। খলাৎ খলাৎ শব্দ সিঁড়ির গায়ে।
হকসাহেব হেসে বলেন -আশ্চর্য ছাপাখানা মশাই আপনার। মনে হয় খালের জল যেন ভেতরে ঢুকে পড়ে মানুষের এতদিনের লিখিত সব শব্দ ধুয়েমুছে ফেলে নতুন শব্দ, নতুন সব বাক্য তৈরি করতে চাইছে। সব গ্যালিপ্রুফ ভাসিয়ে না নিয়ে যেতে পারলে আর কিসের ছাপাখানা? খালের জলের ভেতর দিয়ে ছপছপ করে হেঁটে হকসাহেব পুলের গোড়ায় গিয়ে উঠলেন। আমিও নামতে যাব খালের জলে – মনোহরণবাবু কাঁধে হাত দিয়ে ইশারায় ডাকেন আমাকে। ফিসফিস করে বলেন -এই বদ্ধ পাগলের খপ্পরে আপনি পড়লেন গিয়ে কী করে মশাই –
হেসে বললাম -পাগল?
-না তো কী? ওর কবিতার বই ছাপার সময়ে আমার সঙ্গে মশাই কি হম্বিতম্বি! ‘চ’য়ে ‘চ’য়ে যুক্তাক্ষর আছে, ‘ল’য়ে ‘ল’য়ে, ‘জ’য়ে ‘জ’য়ে, ‘ড’য়ে ‘ড’য়ে আছে, তাহলে ‘র’য়ে ‘র’য়ে নেই কেন? র কী দোষ করল? নেই কেন সে-দোষ যেন আমার। খররৌদ্রের তাপ নাকি কিছুতেই বোঝানো যাবে না ‘র’য়ের সঙ্গে ‘র’ যুক্তাক্ষর না লিখলে। আর ওর সেই এক কথা। এই দেশ নাকি পুরনো হয়ে গেছে, পুরনো হয়ে গেছে মানুষ। কিন্তু কোথাও একটা নতুন দেশ নাকি জন্ম নেবেই আর সেখানে নতুন এক বাংলাভাষা পত্তন করবেন তিনি। নতুন মানুষের নতুন ভাষা। সেই নতুন দেশ নাকি এবার জন্ম নিতে যাচ্ছে আর সেজন্যই মাথা খারাপ হয়ে গেছে ওর। আচ্ছা বলুন তো, নতুন দেশ নতুন মানুষ বলে কোনো কিছু হয় কখনো। মানুষ আমূল বদলে যাবে এসব রূপকথার গপ্পো নয় মশাই? মানুষের জীবন যেরকম থাকার সেরকমই থাকবে চিরটা কাল।
মনোহরণবাবুর শেষের দিকের কথাগুলো বোধহয় কানে এসেছিল হকসাহেবের। রাস্তায় যেতে যেতে বলেন -আপনি তো নতুন দেশের কথা বলতেন -এখন কি বিশ্বাস করেন সে-দেশ নেই, হতে পারে না?
আমি জবাব দেওয়ার আগেই হকসাহেব বলেন, সে-দেশ যদি দেখে যেতে না-ই পারলাম, বেঁচে থাকাটা তাহলে কিসের জন্য বলুন তো? বাঁচার কোনো উদ্দেশ্য নেই? সেটা শুধু একটা মেটাবলিক প্রক্রিয়া? থাক, পোস্টকার্ডে আপনি তো আর কবিতা লিখলেন না। ঠিক আছে, আমার কবিতা দিয়েই শুধু পোস্টকার্ড বেরোচ্ছে। দিন তিন-চারের মধ্যে। আপনি থাকবেন সেদিন। আপনাকে দিয়েই প্রথম পোস্টকার্ড বিলি করাব আমি।
কিছুতেই আমি বলতে পারি না হকসাহেবকে যে, কালই আমাকে নৌকো নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে সপ্তমুখীর মোহনায়। সার্ভের কতগুলো কাজ বাকি রয়েছে তা এই সপ্তমী-অষ্টমীর মরা গোণেই সেরে ফেলতে হবে।
তিন
দুদিন পরের সেই এক অপরাহ্ণের কথা চিরকাল মনে থাকবে আমার। তমলুক চরার দক্ষিণে, যেখানে পূর্ব আর পশ্চিম সপ্তমুখী বঙ্গোপসাগরে এসে মিশেছে, সেই সমুদ্রসমান জলরাশিতে ভাসছিল আমার নৌকো। তালপাটির মতো শান্ত নিস্তরঙ্গ জল, কোথাও কোনো গতি নেই, শব্দ নেই। যেন ধ্যানে বসেছে সমস্ত জগৎ-সংসার। এই নৈঃশব্দ্যের যেন কোনো অতীত নেই। ইচ্ছা হচ্ছিল হকসাহেবকে এনে দেখাই। এই অতীতহীন নৈঃশব্দ্যেই যেন একমাত্র জন্ম নিতে পারে নতুন একটা দেশ। বাঁ-পায়ে হাল চেপে ধরে বঁটিতে তরকারি কুটছিল লক্ষ্মণ মাঝি। হঠাৎ ঝুঁকে পড়ে রেডিওটা চালিয়ে দিতেই সমস্ত শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায় আমার। ইন্দিরা গান্ধীর উদ্দীপ্ত কণ্ঠস্বর যেন চারিয়ে যাচ্ছে নৈঃশব্দ্যের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। জাতির প্রতি তাঁর ভাষণ। পূর্ববাংলা থেকে সীমান্ত পেরিয়ে আসা উদ্বাস্তুর চাপ সহ্য না করতে পেরে অবশেষে ভারত যুদ্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হলো পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। তাঁর সেই কথা ভেসে যাচ্ছে নিস্পন্দ নিথর বাতাসে।
আমি চেঁচিয়ে বললাম -মাঝি পাল তুলে দাও শিগগির। এক জোয়ারেই আমাকে মহারাজগঞ্জে ফিরতে হবে। হঠাৎ এই মত পরিবর্তনে লক্ষ্মণ মাঝি হাঁ করে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। আমি ওকে কী করে বোঝাই – এই খবরটা এ-পৃথিবীতে সবার আগে যার শোনার অধিকার সে হলো হকসাহেব। ভারত যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, এবার হয়তো অবসান হবে এই যুদ্ধের আর জন্ম নেবে হকসাহেবের স্বপ্নের সেই নতুন পৃথিবী। সবার আগে আমাকে হকসাহেবের কাছে পৌঁছিয়ে দিতেই হবে এ-সংবাদটা।
বিছানায় বসে হকসাহেব ছেপে-আসা পোস্টকার্ডগুলো নাড়াচাড়া করছিলেন -আমাকে হঠাৎ ঘরে ঢুকতে দেখে অবাক হয়ে বলেন – সে কি? আপনি? কখন ফিরলেন সুন্দরবন থেকে?
-এই এখনি, শুধু একটা খবর দিতে এসেছি আপনাকে। ভারত কিছুক্ষণ আগে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। আর বোধহয় আপনার সেই স্বপ্নের দেশের জন্ম নেওয়ার বেশি দেরি নেই।
হকসাহেব দুহাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন -এবার আপনি কবিতা লিখতে শুরু করুন। কবিতার মতো একটা দেশ -হাওয়ার দেশ, গন্ধের দেশ, জ্যোৎস্নার দেশ জন্ম নিতে চলেছে -এখন কবিতা না লিখলে কবে আর লিখবেন? আর কবিতা না লিখতে পারলে বেঁচে থাকার কী মানে? বলুন তো –
অগত্যা আমাকে আশ্বস্ত করতে হয় হকসাহেবকে -ঠিক আছে আমি লিখতে চেষ্টা করব –
-চেষ্টা নয়, লিখবেন। মনোহরণবাবুর অদ্ভুত ছাপাখানা থেকে ছাপা হবে আপনার প্রথম কবিতা। যে-কবিতায় মেঘের মতো কালো নৌকোর চলে যাওয়ার শব্দ জড়িয়ে থাকবে -যে-নৌকো খালি এক আশ্চর্য দেশের দিকে চলে যেতে চায়।
তারপর কতদিন যুদ্ধ চলল তার সন-তারিখ ইতিহাসের বইয়ে লেখা থাকবে; কিন্তু আমার মনের ভেতরে যেন তা নিরন্তর কালপ্রবাহের একটা অংশ। শুধু মনে আছে, পকিস্তানি সৈন্য ন্যায়যুদ্ধে হেরে যেদিন আত্মসমর্পণ করল মুক্তিযোদ্ধা আর ভারতের সেনাবাহিনীর কাছে, সেদিনই অত্যন্ত কাকতালীয়ভাবে বদলির হুকুম এলো আমার। সপ্তাহখানেকের মধ্যে এলাহাবাদে জয়েন করতেই হবে আমাকে।
একবার ভেবেছিলাম চাকরি ছেড়ে দিয়ে মহারাজগঞ্জেই থেকে যাই না কেন? এই হাওয়া আর জলের শব্দের মধ্যে, গাছের মাথায় বকের পাখার মতো জ্যোৎস্নার মধ্যে, রাক্ষসখালিরাক্ষসখালি বলে অচিন এক পৃথিবীর দিকে ডাক দেওয়ার শব্দের মধ্যে -যার মধ্যে দাঁড়িয়েই শুধু আশ্চর্য এক জীবনের স্বপ্ন দেখা যায়। কিন্তু হাওয়া জল জ্যোৎস্না নিজেদের মতো করে বেঁচে থাকে আর মানুষের জীবন বয়ে যায় মানুষেরই জীবনের মতো।
তিনদিনের মাথায় আমি বাক্সপ্যাঁটরা ভ্যানে চাপিয়ে চলে যাই মহারাজগঞ্জ ছেড়ে, যেখানে কোনোদিনই হয়তো আর ফেরা হবে না। যাওয়ার আগে হকসাহেবের সঙ্গে আমার দেখা হয় কাঠের পুলের গোড়ায়।
বললাম -কাল চলে যাচ্ছি হকসাহেব। আর আপনার সঙ্গে যোগাযোগ হবে কিনা জানি না; কিন্তু চিঠিতে নিশ্চয়ই হবে। এই ঠিকানাতেই নিশ্চয়ই থাকবেন আপনি –
হকসাহেব কেমন আত্মমগ্ন হয়ে বলেন -জানি না, পুরনো পৃথিবীটায় তো অনেকদিন বেঁচে থাকা হলো, নতুন পৃথিবীতে গিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করা যায় কিনা ভাবছি।
-কেন যাবে না হকসাহেব? নতুন পৃথিবীটার ঠিকানাই তাহলে পাঠিয়ে দেবেন আমাকে।
হঠাৎ কেমন হেঁয়ালির হাসি হেসে বলেন হকসাহেব -জানি না, এখানকার কোনো পিয়ন চিঠি নিয়ে পৌঁছতে পারবে কিনা সে-দেশে।
চলে আসার সময়ে শুনতে পাচ্ছিলাম মনোহরণবাবুর ছাপাখানার গায়ে খালের জল ছলাৎ ছলাৎ শব্দ করছে সেদিনের মতোই।
চার
এরপর কতদিন চলে গেছে তার আর হিসাব রাখি না আমি। রেডিও-টিভিতে শুধু খবর পাই সে-দেশেও সেই চিরাচরিত রাজনৈতিক উথালপাথালের। আমি হকসাহেবকে চিঠি লিখি (মোবাইল ফোনের কথা তখন কেউ ভাবতেও পারত না) – খুঁজে পেয়েছেন কি হকসাহেব, সেই নতুন দেশটা? সংক্ষিপ্ত উত্তর আসে হকসাহেবের -এখনো পাইনি, হয়তো অপেক্ষা করতে হবে… আরো অনেক অপেক্ষা…
আততায়ীর হাতে মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার সংবাদ পেয়েই আমি চিঠি লিখি… মনোহরণবাবু কি তাহলে ঠিকই বলেছিলেন হকসাহেব? আপনার মনেই শুধু অস্তিত্ব ছিল সেই নতুন আলো, নতুন অন্ধকার, নতুন জলের শব্দের মতো পৃথিবীর? বাস্তবে কোথাও তা নেই? থাকলে কি আর এ-ঘটনা ঘটত।
এ-চিঠির আমি কোনো উত্তর পাই না। কয়েক সপ্তাহ পর আবার চিঠি দিই -তারও কোনো উত্তর নেই। হকসাহেব কি তাহলে ঠিকানা বদল করে চলেই গেলেন অন্য কোথাও। কিন্তু কোথায় যাবেন তিনি? হঠাৎ আমার মনে হয়, পৃথিবীতে সবারই একটা না একটা দেশ আছে -শুধু তারই কি যাওয়ার মতো কোনো জায়গা সত্যি আছে?
হকসাহেবের চিঠি আর পাইনি কখনো এরপর।
এর বহু বছর পর অফিস যখন হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেয় কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে দিন-পনেরোর জন্য আবার আমাকে মহারাজগঞ্জ পাঠাতে, আমি বিপন্নমুখে জিজ্ঞেস করি ঊর্ধ্বতন অফিসারকে -কয়েকদিনের জন্য মহারাজগঞ্জ গিয়ে কোথায় থাকব আমি? আবার আমাকে নৌকো খুঁজতে হবে? খুশি গলায় জবাব দেন অফিসার – নৌকো কেন? খাল-জঙ্গলের সেই মহারাজগঞ্জ সেরকমই আছে ভেবেছেন? দেখুন গিয়ে সেখানে ক্যাবল টিভি, এটিএম এসেছে। নতুন নতুন হোটেল এমনকি ছোটখাটো মল অবধি। এই মহারাজগঞ্জ সেই মহারাজগঞ্জ আছে নাকি? আমার বুকের মধ্যে কেমন করে। নেই? সেই মহারাজগঞ্জ আর সত্যি কোথাও নেই, যেখানে কাঠের পুলের গোড়ায় এক ছাপাখানার পাশে দাঁড়িয়ে এক নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছিল হকসাহেব। তার দেখাদেখি আমিও।
পাঁচ
বাস থেকে মহারাজগঞ্জে নেমেই আমি বুঝতে পারি, মহারাজগঞ্জ সত্যি আর মহারাজগঞ্জ নেই। নেই স্মৃতির ভগ্নাবশেষটুকুও। চারপাশে সব নতুন নতুন মানুষ, নতুন নতুন মুখ। একটা হোটেলে উঠে পায়ে পায়ে হাঁটি হকসাহেবের বাড়ির দিকে। সেই বাড়ি নেই, সেই খাড়া সিঁড়ি যা বেয়ে দুদ্দাড় করে উঠে যেতাম হকসাহেবের ঘরে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ধারাবিবরণী শোনার জন্য। সেই বাড়ি ভেঙে সেখানে ঝাঁ-চকচকে সাইবার ক্যাফে হয়েছে। লোপাট হয়ে গেছে কালনাগিনী খাল। নৌকো আর ঢোকে না। নদী মাটি দিয়ে বুজিয়ে ফেলে সেখানে তৈরি হচ্ছে বাড়ি। কিন্তু এই হইচই-হট্টগোলের মধ্যে হকসাহেব কোথায়? একজনও চেনা মানুষ নেই, কাকে আমি জিজ্ঞেস করতে পারি -তার কথা? চেনা মানুষেরা সব পুরনো ঝরাপাতার মতো ঝড়ে কোথাও উড়ে চলে গেল নাকি? হকসাহেবকে খুঁজছি বুঝতে পেরে এক বৃদ্ধ শুধু এগিয়ে এসে বলেন -মাস্টারমশাইকে খুঁজছেন? এই বাড়িতেই তিনি থাকতেন মুজিব মারা যাওয়া অবধি। নিজের মনেই থাকতেন। কথাবার্তা বিশেষ কিছু বলতেন না কারো সঙ্গে। কিন্তু মুজিব হত্যার পর কেমন যেন হয়ে গেলেন। রাস্তাঘাটে বেরোলে নিজের মনে বিড়বিড় করতেন।
-সে কি? পাগল হয়ে গিয়েছিলেন নাকি?
-না পাগল ঠিক নয়, নিজের সঙ্গে নিজেই কিছু বোঝাপড়ায় আসতে চাইছেন যেন। এরপর স্কুলের চাকরি, এ-বাড়ি ছেড়ে দিয়ে কোথায় চলে গেলেন তিনি জানি না, কাউকে কিছু বলেও যাননি। আমি মনে মনে বললাম -আবার সেই পৃথিবীর সন্ধানে কি, যে-পৃথিবী কোথাও নেই?
মনোহরণবাবুর সেই ছাপাখানাটা দেখার খুব ইচ্ছা হলো -যেখানে একদিন হকসাহেবের এক অলৌকিক কবিতার বই ছাপা হয়েছিল। কিন্তু কোথায় সেই ছাপাখানা? কাঠের পুলের শেষ মাথায় গিয়ে দেখি দরমাঘেরা টালির চালের সেই আবছা আলোর ঘরটা আর নেই। সেখানে এখন উঠে গেছে দোতলা একটা বাড়ি -একতলার দরজায় সাইনবোর্ডে লেখা – এখানে দেশি ও বিদেশি মদ সুলভে পাওয়া যায়। আমি ঘোরে পাওয়া মানুষের মতো দাঁড়িয়ে থাকি সেখানে। মনে হয় যেন ধুতি-ফতুয়া পরা মনোহরণবাবু এখনই এগিয়ে এসে চশমার ফাঁক দিয়ে ট্যারাচোখে তাকিয়ে বলবেন -কী বে-আক্কেলে বন্ধু মশাই আপনার। একগাদা পাণ্ডুলিপি আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে কোথায় গায়েব হয়ে গেলেন বলুন তো, আর ওগুলো তো বাংলাভাষায় লিখাও নয় মশাই -যে একটা নতুন দেশের কথা বলতেন তিনি -এ বোধহয় সেই দেশের ভাষা। আমি এখন এগুলো নিয়ে কী করি বলুন তো।
আকাশ কালো করে মেঘ ডাকছে। বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ হয়েছে বোধহয়। হোটেলের ঘরে ফিরে আসি আমি। চলিস্নশ বছর আগে এখানেই ছিল এক মেঘময় খিরিশ গাছ -হাওয়া উঠলে যে-গাছ সমুদ্রের মতো শব্দ করত। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই, যে-কবিতা আমার একদিন লেখার কথা ছিল কিন্তু হকসাহেবের হাজার উপরোধেও লেখা হয়ে ওঠেনি, তাই যেন আমার কলমের আগায় হঠাৎ লেখা হয়ে যেতে থাকে।
কায়সুলহকতারছিলএক
বারুণীরকূলেভাঙাছাপাখানা
অর্ধেক তার জলের জঠরে
শুশুকের পিঠ বাকি আধখানা
সে-ছাপাখানায় ছাপা হোতো হাওয়া
যে-কথা বলে নদী নিশুত রাতে
যে-কথা কালপুরুষ বলেনি এখনো
সেসব স্তব্ধতা ছাপা হোতো তাতে
কুহক দেশ এক ছাপা হোতো তাতে।
প্রলয় কালো জল হঠাৎ একদিন
চুমুকে শুষে নেয় আজব ছাপাখানা
ঘূর্ণিপাকে নাচে ঢেউয়ের চুড়োয়
অলীক কবিতা যত ছেঁড়া ভাঙা ডানা
প্রমোদতরী হো হো হেসে তো ভেসে যায়
বারুণী নদীর জলে তুলে ঢেউ
উলুর বনে শুধু উলু-লু দেয় জল
কায়সুল হক বলে ছিলেন কি কেউ?
এ-কবিতা ভালো কি খারাপ সে-প্রশ্ন অবান্তর। শুধু জানি, এটা হকসাহেবের হাতে পৌঁছে দিতে হবে। তিনি আমাকে দিয়ে কবিতা লিখিয়ে নিলেন শেষ অবধি। কিন্তু পৌঁছে দেবো কী করে? পরদিন ভোর না হতেই তুমুল সাইক্লোনের মতো হাওয়া। কিন্তু আমাকে চলে যেতেই হবে। আমি জানি, মহারাজগঞ্জে আর কোনোদিনই ফিরে আসব না আমি। তুমুল হাওয়ায় আজকের মহারাজগঞ্জ শব্দ করছে যেন তিরিশ বছর আগেকার মহারাজগঞ্জের মতো, যেখানে আমি আর হকসাহেব রেডিও খুলে ছেলেমানুষের মতো হাঁ করে শুনতাম এক আশ্চর্য রূপকথা -এক আশ্চর্য দেশের জন্মকাহিনি। আজ বুঝি সে আশ্চর্য দেশটা ছিল একমাত্র হকসাহেবের কল্পনায় -আর কোথাও নয়। সে-দেশ শুধু জন্মের আভাসটুকুই দেখায়। কখনো জন্ম নেয় না। হাওয়ার পাশ কাটিয়ে আমি এগোনোর চেষ্টা করি। আমার হাতে ধরা সেই কবিতা। কী করার আছে আমার এখন এই কবিতা নিয়ে শুধু হাওয়ায় উড়িয়ে দেওয়া ছাড়া? আঙুল একটু শিথিল করতেই ঝোড়ো হাওয়া ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার হাত থেকে কেড়ে নেয় সেই কবিতা; তারপর উড়িয়ে দেয় শূন্যে। ডানাভাঙা পাখির মতো হাওয়ায় উড়তে থাকে সেই কবিতা, হকসাহেবকে খুঁজে পেতে নাকি উড়ে যেতে এক নতুন দেশে, যে-দেশ কোথাও নেই। আমিও হাঁটতে
থাকি বাসস্ট্যান্ডের দিকে -ওই চিঠির কথা অচিরে ভুলে যাব জেনেই।