‘আ য় চই চই চই চই…’
অন্ধকার নেমে গেছে। হাঁসটা আজ এখনো ফেরেনি। বাড়ির কাছাকাছি দুটো পুকুরই টুনির খোঁজা হয়ে গেছে। একটু দূরে একটা টোবাপুকুর আছে। টুনি সেই দিকে গিয়ে একবার ডাকল, ‘আয় চই চই চই…’
হাঁসির জন্যেই টুনিকে এই সন্ধেবেলা টোবাপুকুরের পাড়ে এসে দাঁড়াতে হয়েছে। অন্ধকার হয়ে গেলে এদিকে কেউ আসে না। সবাই এড়িয়ে চলে এই জঙ্গল-পুকুর। তাল, শিরীষ, খেজুর, শাবড়া বড় বড় সব গাছ চারদিকে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের জড়িয়ে উঠে গেছে নানারকম লতাগাছ। পুকুরের জল ঢেকে রেখেছে ভবানীঝাঞ্জি। জলের চারপাশে এক মানুষ মাপের কচুগাছ। তার গোড়া থেকে লতি বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে এদিক-ওদিক। দিনের বেলাতেই সূর্যের আলো ঢুকতে বেগ পায়। এখন তো সন্ধে! অন্ধকারে বেখেয়ালে পা পড়লে হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়তে হবে। পাড়ার বড়রা বলে, এই জঙ্গলে নাকি ভূতেরা বাস করে। টুনির প্রাণ যায় রয় যায় রয়। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চাইছে। সে কাঁপা গলায় আরো একবার ডাকল, ‘আয় চই চই চই…।’
প্যাঁক প্যাঁক প্যাঁক। আওয়াজ এলো ঝোপের ভেতর থেকে।
কিছুটা সাহস পেল টুনি। কোথা থেকে শব্দটা আসছে ভালো করে শোনার জন্যে আরো একবার ডাকল। হাঁসটা বোধহয় টুনির গলা চিনতে পেরেই প্যাঁক প্যাঁক শব্দ জুড়ে দিয়েছে।
কচুগাছগুলো দুহাতে সরিয়ে সরিয়ে শব্দটার দিকে নামতে গিয়ে একটা পা হড়কে গিয়ে পাঁকে ঢুকে গেল হাঁটু অবধি। সেদিকে টুনির খেয়ালই নেই এখন। সে বলল, ‘কী রে হাঁসি, তুই এখানে এলি কী করে আজ! কখন থেকে ডাকছি, শুনতে পাসনি?’
হাঁসি বোধহয় তার দুরবস্থার কথা বলতে গিয়ে না পেরে সমানে প্যাঁক প্যাঁক প্যাঁক করছে আর ডানা ঝাপটাচ্ছে। টুনি ডানাদুটো ধরে তুলতে গিয়ে দেখে – হাঁসির একটা পায়ে লতাগাছ জড়িয়ে গেছে। সে মুখে চুকচুক আওয়াজ করল। ও, তাই বেচারা এখানে পড়ে আছে। ঠিক সময়ে বাড়ি ফিরতে পারেনি। অন্ধকারে হাতড়াতে হাতড়াতে টুনি হাঁসির পায়ের লতাগাছটা ছিঁড়ে ফেলল। এক হাতে বেড় দিয়ে নিয়ে বুকের কাছে তুলে ধরল তাকে। ‘কী রে, ভয় পেয়েছিস? সারা জায়গা ছেড়ে এখানে এলি কেন?’
এতক্ষণে হাঁসি তার খুদে মালিকের হাতে চড়ে গলায়-গালে আদর করতে শুরু করেছে শক্ত ঠোঁট বুলিয়ে।
টুনি হাঁসির ঠোঁটে একটা টোকা মেরে বলল, ‘কোটাচ্ছে না কি?’ বলে সে নিজেই উত্তর দিলো। ‘কোটানোরই কথা। গাছের পাতা পড়ে পচে, সারাবছর ভবানীঝাঞ্জি পচছে। কচুরিপানার নিচের জল তো কালো কুচকুচে হয়ে আছে। আমারই পা কুটকুট করছে।’
হাঁসি বোধহয় বুঝতে পারল না তার মালিক তাকে কী বোঝাচ্ছে। তবু দু-তিনবার প্যাঁক প্যাঁক প্যাঁক করে কথায় সায় দিলো। সে জানে, এবার তাকে নাজেহাল হতে হবে। তার এই ছোট্ট মালিকটি আবার তার কথা বোঝে না। রোজ সন্ধেবেলা ঘরে তোলার আগে তাকে পুকুরের জলে কয়েকবার চুবিয়ে নেয়।
টুনি হাঁসিকে বগলদাবা করে বাড়ির দিকে এগোল। যেতে যেতে তার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলো।
‘তোকে না পেয়ে আমার কী অবস্থা হয়েছিল জানিস?’
প্যাঁক প্যাঁক।
‘তা জানবি কী করে, হাঁসি কোথাকার! কাল থেকে আগে বেরোনো বন্ধ। স্কুল থেকে ফিরে তবেই তোকে ছাড়ব। চোখে চোখে থাকবি।’
চারপাশে জমাট অন্ধকার। কারো কারো বাড়িতে এখন সন্ধে পড়ছে। হাঁটতে হাঁটতে প্রণতিকাকিদের বাড়ির সামনে এসে কথা থেমে গেল টুনির। ওদের ঘরের জানালাটা নিচু। ঘরে আলো জ্বলছে বলে রাস্তা থেকে জানালা দিয়েই সব দেখতে পাচ্ছে টুনি। বগলে চাপা হাঁসি ঝুপঝাপ শব্দ করছে।
হারানিদি বসে আছে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে। হাঁটু মুড়ে তার ওপর দুটো হাত রেখে মাথা গুঁজে দিয়েছে। তার মাথার চুল লম্বা কিন্তু সে তাতে না দেয় তেল, না লাগায় চিরুনি। সেগুলো দড়ির মতো পাকিয়ে দুদিকে ঝুলছে। পাশে তার মা দাঁড়িয়ে। প্রণতিকাকির বাঁ-হাত কোমরে, ডান হাতটা নাচাতে নাচাতে বলছে, ‘এখানে মুখ গুঁজে বসে আছিস কেন? বাইরে থেকে দুদ- ঘুরেও তো আসতে পারিস। নইলে যা বাবা, আমাদের ঘাড়ে চড়ে কতদিন আর জ্বালাবি? এবার একটু শান্তি দে, ফিরে যা।’
কথাগুলো শুনতে শুনতে টুনি বলল, ‘দেখেছিস হাঁসি, বেচারার মা থেকেও জীবনে শান্তি নেই। আর আমার তো মা-ই নেই। বাবা বলে, আমার মা খুব ভালো ছিল। কিন্তু ছোটবেলায় কী অসুখে মরে গেছে। বেঁচে থাকলে আমার সঙ্গে কক্ষনো এরকম করত না। আমি জীবনে বিয়ে করব না আর তোকেও বিয়ে দেবো না, বুঝেছিস? পড়াশোনা শিখে জজসাহেব হবো। তখন সবাই আমার কথা শুনবে। আর কেউ জোর করে মেয়ের বিয়ে দেবে না। টিভিতে দেখায় দেখিস না! কালো জামা পরে চেয়ারে বসে থাকে। হাতুড়ি নিয়ে টেবিল পেটায় আর বলে, অর্ডার অর্ডার। সবাই তার কথা শোনে।’
কথাটা বলেই টুনির বোধহয় অন্য কিছু মনে হলো। সে আবার বলল, ‘কিন্তু মেয়েরা জজ হতে পারে নাকি বল তো? আমি তো দেখিনি।’
প্যাঁক প্যাঁক প্যাঁক…
‘তুই দেখবি কী করে। আমাদের তো টিভি নেই। আমাকেই বলে লোকের বাড়ি টিভি দেখতে যেতে হয়। সেও দেখতে গিয়ে জ্বালা। যাদের টিভি তারা মুখ ঝাড়া দেয়। তুই আমার কথা বুঝেছিস হাঁসি?’ টুনি হাঁসটাকে বুকের কাছে ধরে একটু চাপ দেয়। ‘কী বুঝেছিস তুই-ই জানিস।’ টুনির এখন বারো। তার চেয়ে হারানি পাঁচ-ছ বছরের বড় হবে। ছোটবেলায় একবার মেলা দেখতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিল। সেই থেকে নাম হয়ে গেছে হারানি। অবশ্য স্কুলের খাতায় ছিল নিবেদিতা। সে-নাম খাতায় বেশিদিন থাকতে পায়নি। এইটে পড়তে পড়তেই বাবা-মা স্কুল থেকে নাম কাটিয়ে নিয়ে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল। গ্রামে মেয়ে বড় হলে বাবা-মা চুপ করে বসে থাকতে পারে না। তাড়াতাড়ি ঘাড় থেকে নামাতে চায়। ছেলের বয়স তখন আটাশ। হারানির বিয়ে হয়ে গেল। কিন্তু মাসছয়েক পরেই ফিরে এলো সে। গলায়, পিঠে কাটা দাগ। ঠোঁট ফেটে ফুলে গেছে। তার বর রোজ মদ খেয়ে এসে তাকে পেটায়। বাবা-মার কাছে ফিরে এসে হারানি বলেছিল, ‘তারা বলে, বাপের বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে এসো, নয়তো বেরিয়ে যাও। আমি আর কখনো শ্বশুরবাড়ি যাব না।’
‘যাবি না মানে? তোর নিচে আর দু-দুটো বোন আছে, তার ওপর তুই ফিরে এসে ঘাড়ে চেপে বসলি। এই জন্যে কি টাকা-পয়সা খরচ করে তোর বিয়ে দিয়েছিলাম?’
‘আমি তো পড়তে চেয়েছিলাম মা। তোমরা আমার বিয়ে দিলে কেন? ওরা যে আরো টাকা চায়!’
‘আবার মুখে মুখে কথা বলছিস। শ্বশুরবাড়িতে ওরকম একটু-আধটু ঝামেলা হয়। তোর বাবার সঙ্গে আমার হয় না? আমি কি সব ছেড়ে চলে গেছি?’
হারানিদির এসব কথা টুনির জানা হয়ে গেছে সে ফিরে আসার পরপরই। গ্রামের আরো অনেকেই জানে।
‘টুনি বো… ও… টুনি…’
‘দেখেছিস হাঁসি, বাবা আমাদের খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছে। চল যাই।’ টুনিও জোরে একটা ডাক ছাড়ে, ‘যাই বাবা…’ হাঁসিকে নিয়ে পুকুরের দিকে গেল টুনি। ডানাদুটো ধরে ভালো জলে কয়েকবার চুবিয়ে নিল হাঁসিকে। নিজের পা-দুটোও এক হাতে যতটা পারে ডলে নিল।
ঘরে ঢুকে দেখে তার বাবা দক্ষিণ দিকের দাওয়ায় চাটাই পেতে বসে বিড়ি টানছে। উত্তরদিকে চুলোয় হাঁড়ি বসানো। বউদি তার সামনে বসে কাঠ ঠেলছে। পাশে সব কাঁচা সবজি ঢালা। আলু, বেগুন, পেঁয়াজ, ঢেঁড়শ। রবিন নখে খুঁটে পেঁয়াজ ছাড়াচ্ছে। সে তার মাকে বলল, ‘আইজ কী রাঁধব গা মা?’
টুনি বুঝল বউদি ভাত বসিয়েছে।
দুলাল মেয়েকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোর হাঁসিকে পেলি? কত করে বলেছি চোখে চোখে রাখবি। আজকাল লোকের নজর ভালো না।’
‘হাঁসিকে গা ধুইয়ে তার ঘরে ঢুকিয়ে এসেছি বাবা। জানো বাবা, হাঁসি আজ টোবাপুকুরে চলে গেছিল।’
‘সে কী বো! ওই জঙ্গলে কী করতে মরতে গেল?’
‘ঘুরতে ঘুরতে চলে গেছে হবে।’
‘পেয়েছিস তো? এখন পড়তে বস।’
বউদি রান্নাঘর থেকে হাঁক দিলো, ‘আগে সন্ধেটা দে, তারপর তোর ওই বইয়ের দপ্তর নিয়ে বসবি। সারা সন্ধে হাঁস হাঁস করে কাটল। এখন আবার বিদ্যা অর্জনে বসবেন তিনি। গেরস্ত-ঘরে এখনো সন্ধেটাই পড়েনি।’
টুনির মনে হয়, বউদিটা যেন কেমন! কখনো ভালো করে কথা বলে না। মা থাকলে কত ভালোবাসত। রবিনের মতো সেও সবসময় মায়ের কাছে কাছে থাকত। মা তাকে কত আদর করত। বউদি যেমন রবিনকে করে।
টুনি ঠাকুরের আসনের সামনে প্রদীপ জ্বালাল, ধূপ ধরাল। তুলসীতলায় দাঁড়িয়ে বাঁ-হাতের তিন আঙুলে শাঁখ ধরে ফুঁ দিতে দিতে সেই হাতেরই বাকি দুই আঙুলে ঝোলানো কাঁসরও বাজিয়ে নিল ডান হাতে। তারপর গড় করে নিয়ে ঘরে এসে পড়তে বসল।
রবিনকে বলল, ‘তুই পড়বি না?’
তার মুখ দেখে অবশ্য বোঝা যাচ্ছিল মনের ইচ্ছাটা কী। রবিন পেঁয়াজগুলো বাটিতে রেখে বালতির জলে হাত ধুয়ে কাঁইকুঁই করতে করতে ব্যাগটা আছড়ে ফেলল চাটাইয়ের ওপর। নিজেও ধুপ করে বসে পড়ল। সে পড়ে থ্রিতে। একটু পরেই তার বাবা চলে আসবে। যে কিনা টুনির দাদা গোপাল। পড়া না পারলে মুখে কিছু বলবে না দাদা। আগেই ধাঁই ধাঁই করে কয়েক ঘা বসিয়ে দেবে পিঠে। টুনিকে অবশ্য কিছুই বলে না। পড়া হলো কিনা তার খোঁজও নেয় না। দাদা তার চেয়ে পনেরো বছরের বড় হবে। অত ছোট বোনের খোঁজ নেওয়ার আছেটাই বা কী।
কালকের পড়ায় কয়েকবার চোখ বুলিয়ে নিল টুনি। যদিও এখন তার পড়ায় মন নেই। আগের দিন রাবণ সীতাকে ধরে নিয়ে গেছে। আজ জটায়ু পাখির সঙ্গে লড়াই হবে রাবণের। পড়ে শোনাবে প্রদীপের ঠাকুমা। সবাই যদি এসে যায়, পড়তে শুরু করে দেবে। তার আর শোনা হবে না। তাই খানিক পরেই সে বই বন্ধ করে দিলো। রবিনকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুই যাবি?’
সে বলল, ‘না। বাবা এসে মারবে। তুই যা পেসি। কাল আমায় শুনিয়ে দিবি।’
টুনি বাবার কাছ থেকে টর্চটা নিয়ে বলল, ‘ঠাকুমার বাড়ি যাচ্ছি বাবা। হুড়কো খোলা রেখো।’
দুলাল জানে, পাশের বাড়ির কাকির কাছে সন্ধেবেলা আসর বসে। কাকি পদ্যে রামায়ণ পড়ে শোনায়। তারপর গল্প করে বুঝিয়ে দেয়। তাই সে মেয়েকে কখনো বারণ করে না। দুলাল নিজেও কখনো-সখনো যায় শুনতে। টুনিকে বলল, ‘বেশি রাত করিস না মা। ভাত ঠান্ডা হয়ে যায়।’ বলেই সুরটা আস্তে করে বলল, ‘রোজ রোজ ঠান্ডা ভাতগুলো খাস। কেউ তো গরম করে দেওয়ারও নেই।’
টুনি বেরিয়ে গোয়ালঘরের দিকে গেল। পাশেই তার হাঁসির থাকার ঘর। বাবা বানিয়ে দিয়েছিল। আগে মোরগ আর মুরগি থাকত। বাঁশের বেড়া বেঁধে তার ওপর মাটি লেপে দিয়েছে, যাতে খটাশ এসে হাঁস বা মুরগি নিয়ে পালাতে না পারে। রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে পাড়ার অনেকেরই হাঁস-মোরগ টেনে নিয়ে যায় খটাশ। সে ঝাপড় খুলে দেখল, হাঁসি এক জায়গায় জবুথবু হয়ে বসে। গলাটা ডানদিকে বেঁকিয়ে ডানার ভেতরে মুখ গুঁজে দিয়েছে। চোখদুটো বন্ধ। টুনি বুঝল হাঁসি এখন ঘুমোচ্ছে। সে আস্তে করে ঝাপড়টা নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। প্রদীপ মাত্র দুবছরের। তবু তার নামেই ঠাকুমাকে এখন ডাকে সবাই। তাদের বাড়ি গিয়ে টুনি দেখল অশ্রু, অন্নদা, কচিবুড়ি সবাই এসে গেছে। মাঝখানে পিঁড়ির ওপর রামায়ণটা রাখা। অশ্রু টুনিকে দেখে বলল, ‘কী রে, তোরা আসছিস না বলে ঠাকুমা এখনো শুরু করেনি।’
বলতে বলতে পরমাও পেছনে এসে দাঁড়াল। টুনিদের বাড়ির পেছনের ঘরটাই পরমাদের। টুনি জিজ্ঞেস করল, ‘তোর ভাই এলো না পরমা?’
‘না। তাকে আজ নিয়ে আসিনি। শুধু শুধু বিরক্ত করে। এটা কী করে হলো, ওটা কেন হলো, শুনতেই দেয় না। সে এখন পড়ছে। আমিও পড়ছিলাম। জল খেতে ওঠার নামে পালিয়ে এসেছি।’
‘আয় আয়। সবাই শান্ত হয়ে বস। এবার শুরু করি।’ ঠাকুমা মাঝখানে বসে বই খুলল। সবাই বাবু হয়ে বসে পড়ল ঠাকুমাকে ঘিরে।
পক্ষীর সাহস দেখি ত্রাসিত রাবণ।
ক্রন্দনে চিনিলা সীতা গরুড়নন্দন।
দশরথের বধূ তুমি জনকদুহিতা।
তোমার শ্বশুর দশরথ হন মোর মিতা।
গরুড়নন্দন আমি শুনহ সুন্দরী।
তোমারে উদ্ধারিব আজ রাবণ রাজা মারি।
এতেক বলিয়া পক্ষ উঠিল গগনে।
দশ নখে আঁচড়িল রাজা দশাননে।
আকাশে উঠিয়া বীর ছোঁ দিয়ে পাড়ে।
রাবণের পৃষ্ঠের মাংস খান খান ছিঁড়ে।
জটায়ু পাখি একটা গাছের ডালে ঘুমাচ্ছিল। সীতার চিৎকারে তার ঘুম ভেঙে গেল। জেগে দেখে, রাবণ সীতাকে জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। সে রাবণের পথ আটকে বলল, ‘সীতাকে তুমি ছেড়ে দাও। নয়তো রামের কোপে মরবে। রাবণ তো ভীষণ রেগে গিয়ে জটায়ুকে মারতে গেল। তখন দুজনের জোর লড়াই লেগে গেল।’
‘তারপর কী হলো ঠাকুমা?’
‘রাবণ খড়গ দিয়ে জটায়ুর পাখা কেটে দিলো, তখন সে মাটিতে পড়ে গেল।’
‘তারপর?’
‘আর কী, রাবণ জোর করে সীতার চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে লংকায় নিয়ে চলে গেল।’
গ্রামের কিছু বাড়িতে টিভি এসে গেছে। ক্যাবল লাইনে চলে। সন্ধে হলেই সিরিয়াল শুরু হয়ে যায়। দিন দিন রামায়ণ শোনার লোক কমছে। বুড়োবুড়িরাই এসে বসে। টুনিদের বাড়ির দিকে এখনো টিভি ঢোকেনি। শুধু টিভি কিনলেই তো হবে না। সেট টপ বক্স ছাড়া টিভি চলবে কী করে। এখন আবার ক্যাবলের টাকাও বেড়ে গেছে। যাদের টিভি নেই তারা অন্য বাড়িতে ঢুঁ মারে। ভিড় বাড়লে আবার সে-বাড়ির লোকদের মুখ ভার। রামায়ণ-ঠাকুমার কাছে সেসব নেই।
আরো খানিকটা পড়ে বই বন্ধ করল ঠাকুমা। বলল, ‘আজ এই পর্যন্ত। রাত হয়ে গেছে, আবার পরের দিন হবে।’
সবাই যে যার বাড়ি চলে গেল। যেতে যেতে টুনি ভাবছিল, রাবণ জটায়ু পাখিটাকে মেরে ফেলল! জটায়ু কেমন দেখতে ছিল কে জানে? হাঁস-মুরগির মতো নয় নিশ্চয়ই। আসল পাখি। হাঁস-মুরগিকে কেউ কখনো পাখি বলে ধরেই না। হাঁসিকে খুঁজে না পেয়ে তার ভয় হয়ে গেছিল – মুরগিটার মতো তাকেও কেউ মেরে ফেলেনি তো!
বাবা তাকে দুটো মোরগবাচ্চা কিনে দিয়েছিল কয়েক বছর আগে। নরম তুলতুলে, খয়েরি রঙের পালক, পায়ের সরম্ন সরম্ন আঙুল গোলাপি। তাদের সে খুব ভালোবাসত। রোজ স্কুল থেকে ফিরে এসে ছেড়ে দিত, যাতে চিলে না নিয়ে যায় তাই তাদের সঙ্গে সঙ্গেই থাকত। চালের খুদ খেতে দিত, বাটি করে জল খাওয়াত। আস্তে আস্তে বড় হচ্ছিল তারা। মুরগাটা খুব বদমাইশ ছিল। অন্য বাড়ির মোরগের সঙ্গে মিশে লোকের ক্ষতি করত। ধান খেয়ে নিত, পায়ে পায়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়েও দিত অনেক। লোকে এসে টুনিকে কথা শোনাত। মুরগিটা ছিল ভালো। কিন্তু মুরগাটার সঙ্গে থেকে থেকে সেও দুষ্টু হয়ে উঠছিল।
কিছুদিন বাদে যদিও ডিম দিতে শুরু করে মুরগিটা।
বাবা বলেছিল, ‘এবার তোর সুদিন আসছে টুনি। ডিম বেচে যা টাকা হবে সেই দিয়ে তোর তেল-সাবান এনে দেব। আর তোকে বউদির মুখ চেয়ে থাকতে হবে না।’
কয়েক সপ্তাহ ডিমও দিয়েছিল মুরগিটা। কিন্তু পাশের বাড়ির ওই অনিতার মার তা সহ্য হলো না। ওদের উঠোন নোংরা করেছিল বলে মিনুকাকি দরজায় লাগানো হুড়কো দিয়ে পিটিয়ে তার মুরগিটাকে মেরে ফেলল।
দাদা বলেছিল, ‘মরে গেছে যখন, দুঃখ করে কী হবে। কুটে ফেলি, খাওয়া যাবে। মুরগিটাকে খাইয়ে খাইয়ে মাংস করেছিস ভালো। দু-আড়াই কিলো তো হবেই।’
দাদা যখন কাটল, তার ভেতর থেকে একটা ডিমের থলে বেরিয়েছিল। ছোট-বড়-মাঝারি কত রকমের ডিম।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে টুনির চোখদুটো জলে ভরে যায়। মুরগাটা তখনো ছিল। তবে সেও বেশিদিন টেকেনি। পাড়ার মনসা পুজোয় দুই দিদি আর জামাইবাবুরা আনন্দ করতে বাড়ি এলো। সবার নজর পড়ল মুরগাটার ওপর। বলল, ‘ওর এখন সঙ্গী নেই, তাছাড়া ডিমও দেবে না। অনেকদিন পর সকলে একসঙ্গে হয়েছি। ওটাকে মার, খাওয়া হোক।’
টুনির বাবা কত করে বারণ করল – ‘ওটা টুনির জিনিস, তাকে একবার জিজ্ঞেস কর।’
দুই দিদি বলেছিল, ‘ঘরে আছে, ঘরের খাচ্ছে, ওটা ওর আলাদা জিনিস হয় কী করে?’
কেউ কথা শোনেনি। তার মুরগাটাকেও খেয়ে সকলে হজম করে ফেলেছিল। সেবার সবাই আনন্দ পূরণ করে তবে বাড়ি গেছে। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে বটতলায় বসে একা একা কেঁদে আকুল হয়ে গিয়েছিল টুনি।
তারপর বাবা এনে দিলো এই হাঁসিকে। কত ছোট্টটা এনেছিল আর এখন কত বড়ই না হয়েছে। দেখতেও হয়েছে সেরকম। সাদা সাদা পালকে ভরা। ঠোঁটটা হালকা কমলা। পেটের কাছে কয়েকটা কালো পালক আছে। যখন হাঁসি দুলে দুলে হাঁটে, দেখতে কী ভালোই না লাগে। হাঁসির গায়ে কাদামাটি লাগলেই টুনি তাকে ধুতে নিয়ে যায় পুকুরে।
কয়েকদিন বাদে সেই পুকুরঘাটে গিয়েই টুনি দেখল খুব হইচই।
স্কুলে যাবে বলে পা ধুতে গিয়েছিল। বাঁধানো ঘাট নয়। নারকেল গাছের গুঁড়ি ফেলা সিঁড়ি। তার দুধারে বাঁশের খুঁটি। সেই খুঁটিরই একটা চেপে ধরে বসে পড়েছে হারানিদি। শাড়ি আলুথালু, মাথার চুল ছড়িয়ে পড়েছে। এই পুকুরটা তাদের বাড়ির লাগোয়া। উঠোনে পাড়াতো কাকা, জ্যাঠা, বউদি, ঠাকুমা সবাই গুজগুজ-ফুসফুস করছে। হারানিদির এক জেঠি এসে তার হাত ধরে তোলার চেষ্টা করল। বলল, ‘চল, আমি যাব তোর সঙ্গে। রেখে আসব। ওঠ মা, কোনো ভয় নেই তোর।’
হারানিদি কিছুতেই উঠছে না। আরো জোর দিয়ে শক্ত করে খুঁটিটা ধরে বসে রইল। তখন তিন-চারজন কাকি-জেঠি এসে তাকে টেনেহিঁচড়ে ভ্যানে নিয়ে তুলল। এতক্ষণ টুনি দেখতেই পায়নি – একটা ভ্যান রাস্তায় দাঁড় করানো ছিল। সবাই মিলে জোরাজুরি করে তাকে পাঠিয়ে দিচ্ছে শ্বশুরবাড়ি। কেউ শুনছে না তার কথা। হারানিদি ‘যাব না, যাব না’ বলে চেঁচিয়েই চলেছে। টুনি তো ছোট। সে কী করবে! আর এখানে তো জটায়ু পাখিও নেই।
চেঁচিয়ে, কেঁদেকেটেও কিছু করতে পারেনি হারানি। পুকুরপাড়ের খুঁটি আগলা হয়ে গেছিল টানের চোটে। তাকে যেতেই হয়েছে।
তারপর থেকে রোজ স্কুল থেকে ফিরে হাঁসিকে বাইরে ছেড়ে দেওয়ার আগে টুনি তার ডানাদুটো টিপে টিপে দেখে। হাঁসি উড়তে পারে না। আসল পাখির মতো জোর নেই তার ডানায়। টুনিকে কেউ যদি ধরে নিয়ে যায় – হাঁসি তাকে বাঁচাতে পারবে না। হাঁসি তো রামায়ণও শোনেনি।
হারানিদিকে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার দিন থেকে টুনির কিছুদিন রামায়ণ শুনতে যাওয়া হয়নি। গিয়ে জানতে পারল, অনেকটা পড়া হয়ে গেছে। আজ সীতার অগ্নিপরীক্ষা।
ঠাকুমা জলছড়া দিয়ে, সিংহাসনে ঠাকুরকে ধূপ দেখিয়ে এসে বসল। প্রদীপের মা রাঁধাশালে রাঁধছে। তার বাবা বাড়ি নেই। দাদু ঘরের ভেতরে চাটাই পেতে শুয়ে। প্রদীপ তার মায়ের কাছে বসে কী নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করছে।
আজ রামায়ণ শোনার লোক কম। টুনি, পরমা, অশ্রু আর অন্য দুই ঠাকুমা এসেছে।
প্রদীপের ঠাকুমা বলতে শুরু করল – ‘রাম তো রাবণকে মেরে সীতাকে উদ্ধার করে আনল। এবার সকলের মনে আনন্দ। কিন্তু রামের মনে শান্তি নেই। সে সীতাকে বলল, তোমার সঙ্গে আমি সংসার করতে পারব না। এতদিন তুমি রাবণের সঙ্গে ছিলে। এখন আমি যদি তোমার সঙ্গে থাকি, আমার বংশের বদনাম হবে। কাজেই, তুমি অন্য কোথাও চলে যাও।’
আমার মানুষ নাহি ছিল তোমার পাশে।
শয়ন ভোজন তোমার নাহি জানি দশ মাসে।
সূর্য্যবংশে জন্ম আমার রঘুর নন্দন।
তোমা হেন স্ত্রী মোর নাহি প্রয়োজন।
এই কথা শুনে সীতা বলল, আমি তোমাকে ভালোবেসেছি, এখন তুমি যদি আমাকে ত্যাগ করো, আমার আর প্রাণ রেখে কী লাভ? দেওর লক্ষ্মণকে বলল, চিতা সাজাও, আমি প্রাণ দেবো।
লক্ষ্মণ বউদির আজ্ঞাকারী। সে চিতা সাজিয়ে দিলো।
নানা কাষ্ঠ দিল তাহে অগ্নি রাশি রাশি।
প্রবেশ করিতে যায় সীতা তো রূপসী।
তারপর সীতা সেই জ্বলন্ত আগুনে প্রবেশ করল।
অগ্নি সাক্ষী করি সীতা করিলা প্রবেশ।
হাহাকার উঠিল যত লঙ্কার দেশ।
সীতার অগ্নিপরীক্ষার পর ঠাকুমার পড়া শেষ হলো। আজ কেউ কোনো কথা জিজ্ঞেস করেনি। চুপ করে শুনছিল। শেষেও কিছু বলল না। যে যার মতো বেরিয়ে যাচ্ছিল।
টুনিও বেরিয়ে এলো। রামায়ণের গল্প তো জানা। তবু শুনতে ভালো লাগে। রামের জন্যে সীতাও পুড়ে মরল! জ্বলন্ত চিতায় ঢুকতে হলো তাকে!
বাড়ি ফিরে ঘরে ঢোকার আগে টুনির একবার দেখে নেওয়া চাই হাঁসি কী করছে। তার ঘরের সামনে গিয়ে দরজা খুলে দেখল, হাঁসি ঘুমোচ্ছে। তাকে ঘুমোতে দেখেই টুনির শান্তি। বিড়বিড় করে বলল, ‘সাবধানে থাকিস, কেউ ধরে নিয়ে গিয়ে খেয়ে না ফেলে।’
টুনি বলেছিল বাইরের কথা ভেবে। কিন্তু বিপদ এলো ঘরের ভেতর থেকে।
গ্রামে শীতলা পুজো। তার দিদি-জামাইবাবুরা বাড়িতে এসেছে আবার। তাদের কথা শুনে গা জ্বলে গেল টুনির। পুজোয় এসেছিস, পুজো দেখ, আনন্দ কর। না, তারা পড়েছে হাঁসির পেছনে। হাঁসিটাও হয়েছে তেমনি। জামাইবাবুদের সামনে প্যাঁক প্যাঁক করে ঘুরে বেড়ায়। তারা বলল, ‘অনেকদিন পরে এসেছি, হাঁসটাকে খাওয়া যাবে। সেবার মুরগাটাকে খেয়েছিলাম। খুব ভালো ছিল। এবার হাঁস খাওয়া হোক।’
টুনিও ভেবে নিয়েছে – আগের মতো আর হতে দেবে না। তখন সে ছোট ছিল। এখন বড় হয়েছে। ফোর থেকে ফাইভে উঠেছে। হাঁসির গায়ে কাউকে হাতই দিতে দেবে না।
দিদি-জামাইবাবুরা যতদিন ছিল, হাঁসিকে চোখে চোখে রেখেছিল টুনি। তারা বিদেয় হতে শান্তি। হাঁসি নিজের মতো ঘুরেফিরে বেড়াতে পারছিল। কিন্তু সেই আলগা দিতে গিয়েই কী যে হলো!
সেদিন স্কুল থেকে ফিরে ব্যাগ রেখে জামা ছাড়ছিল টুনি। এমন সময় বাইরে রবিনের বিকট চিৎকার – ‘পেসি, পেসি, ও পেসি -’ বলেই হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে ঢুকে এলো।
‘কী হয়েছে? এত চেঁচাচ্ছিস কেন?’
‘তোর হাঁসি বোধহয় আর বাঁচবে না। দেখবি চল। বড়পুকুরে মুখ গুঁজে পড়ে আছে।’
টুনি ঘরের পেছনে উত্তরের দিকে দৌড়ে গেল।
পুকুরে পড়ে থেকে কালো হয়ে যাওয়া গাছের একটা মোটা ডালের নিচে মুখ গুঁজে জলে ভাসছে হাঁসি। মাথাটা সমানে নেড়ে চলেছে। টুনি তার গলা ধরে জল থেকে তুলেই ভয়ে শিউরে উঠল। এ কী! এটা কী করে হলো! কে করল এমন! ভাবতে ভাবতেই তার চোখের জল নেমে আসছিল গাল গড়িয়ে।
হাঁসির গায়ে একটাও পালক নেই। ঝলসানো মাংসের মতো দেখতে লাগছে তাকে। ডানা ঝাপটাচ্ছে না, কত সুন্দর প্যাঁক প্যাঁক করত – তাও করছে না। একেবারে নেতিয়ে পড়েছে।
টুনি কোনোমতে তাকে ঘরে এনে রবিনের কাছে রেখে বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে জামার ওঁচায় জবাফুলের কতগুলো পাতা নিয়ে ফিরে এলো। হাতে ডলে ডলে হাঁসির গায়ে লেপে দিতে লাগল সে।
‘তোর এই দশা কে করল রে হাঁসি!’
রবিন উবু হয়ে সামনে ঝুঁকে দেখছিল। বলল, ‘এটা কী করছিস রে পেসি?’
টুনি বলল, ‘জানিস না! বউদি যখন তোকে ন্যাড়া করায় তখন জবাপাতার রস মাথায় মাখিয়ে দেয়। দেখিসনি?’
‘কেন দেয় রে পেসি?’
‘যাতে ঘন কালো চুল হয়।’
রবিন সুড়সুড়ি লাগার মতো করে হেসে উঠল। ‘তোর হাঁসির গায়েও কি চুল গজাবে?’
এতক্ষণে টুনি রসসুদ্ধ জবাপাতা হাঁসির গলা থেকে লেজ অবধি লেপে কালচে করে দিয়েছে। তার বোধহয় আরাম লাগছিল। তাই শান্ত হয়ে সব অত্যাচার সহ্য করেছে। টুনি রবিনকে বলল, ‘দূর গাধা, হাঁসের কখনো চুল গজায়! আমার হাঁসির বড় বড় পালক হবে।’
রবিন বলল, ‘জানিস, পরমা পেসি কী বলছিল?’
‘কী?’
‘ঠাকুমা ধান সেদ্ধ-করা চুলায় তোর হাঁসিকে ফেলে দিয়েছিল।’
চমকে উঠল টুনি। ‘সে কী! কোন ঠাকুমা?’
‘প্রদীপের ঠাকুমা।’
টুনি কথাটা শুনে ভ্যাবলা হয়ে রবিনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আসলে তার দৃষ্টি রবিনের ওপর নেই। সে অবাক হয়ে ভাবছিল, ঠাকুমা এরকম কাজ করতে পারে! ঠাকুমা তো ভালো! রামায়ণ পড়ে শোনায়! রাম-সীতার দুঃখে চোখে জল আসে তার। সে এমন করল!
রবিন ওদিকে বলে চলেছে, ‘হাঁসি ওদের সেদ্ধধানে বারবার মুখ দিচ্ছিল। তাই ঠাকুমা রাগে চুলার আগুনে হাঁসিকে ফেলে দিয়েছে।’
টুনি যেন এবার দেখতে পেল – তার হাঁসি জ্বলন্ত আগুনে ডানা ঝাপটাচ্ছে। পালকগুলো পুড়ছে পটপট করে আর সে ছটফট করছে বাঁচার জন্যে, অথচ কেউ তাকে বাঁচাতে আসছে না। আগুন দগদগে করে দিচ্ছে তার গা। ভাবতে গিয়ে শরীরের ভেতরে কী একটা বয়ে গেল। কেঁপে উঠল টুনি।
রবিন এতক্ষণ কী বলছে সে শোনেনি। শেষের কথাগুলো কানে গেল। ‘তুই আর কক্ষনো ওই ঠাকুমার কাছে গল্প শুনতে যাবি না। বাজে ঠাকুমা। বুঝলি পেসি।’
টুনির মুখ থেকে একটাও কথা বেরোল না।
দাদা হাঁসিকে দেখে বলল, ‘এ আর বাঁচবে না। আমাকে দিয়ে দে।’
এবার টুনি বলল, ‘না, দেবো না।’
দাদা বলল, ‘এমনি না দিস, হাফ দামে বেচে দে। কিনে নিচ্ছি তো। সবাই মিলে খাওয়া হোক। কিছুটা তো ছাড়ানোই আছে। বাকিটা আর একবার গরম জলে চুবিয়ে নিলেই হলো।’
‘আমার হাঁসি ঠিক হয়ে যাবে। একেবারে আগের মতো।’
গোপাল বলল, ‘হাফ দামে রাজি হলে ভালো করতিস। এবার আর তাও পাবি না। তুই স্কুলে যাওয়ার পর আমি ওর ব্যবস্থা করে নেব।’
টুনি বুঝতে পারছিল দাদা হাঁসিকে একা পেলে মেরে ফেলবে। তাই সে যখন বাড়ি থাকে না তখন বাবার ওপর ভার দিয়ে যেতে শুরু করল। আর সে যখন থাকে, হাঁসি তার নিজের জিম্মায়।
যেদিন হাঁসি পুড়ে গেল, সেদিন থেকে টুনি আর রামায়ণ শুনতে যায় না ঠাকুমার কাছে। বাবা বলেছিল একবার গিয়ে কথা বলবে। টুনি বারণ করেছে। সে রোজই জবাপাতার রস মাখিয়ে দেয় হাঁসিকে। ঘুমোতে যাওয়ার আগে দেখে নেয় হাঁসি কী করছে। হাঁসি এখন গোয়ালঘরের পাশ থেকে উঠে এসে টুনির বিছানার কাছে জায়গা পেয়েছে। মাথার কাছে একটা ঝুড়ি চাপা দেওয়া থাকে।
সেদিনও মাটিতে পাতা বিছানায় শুয়ে পড়ার আগে টুনি দেখল হাঁসি ঝিমিয়ে রয়েছে। সে গিয়ে বাবার পাশে গড়িয়ে গেল। মাঝে মাঝে হাঁসির নড়াচড়ার আওয়াজ আসছিল। শুনতে শুনতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল টুনি। হঠাৎ ঝুপ করে একটা আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল তার।
টুনি দেখল – ঝুড়ি উলটে পড়ে আছে। হাঁসি দাওয়া থেকে ঘসড়ে উঠোনে নেমে দুলকি চালে প্যাঁক প্যাঁক করতে করতে চলেছে।
ধড়ফড়িয়ে উঠে এলো টুনি। চারদিকে ঘোলাটে আলো। সবে ভোর হচ্ছে। সে চেঁচিয়ে উঠল, ‘কোথায় যাচ্ছিস হাঁসি?’
হাঁসি ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখল। তারপর আবার চলতে শুরম্ন করল। এ কী! টুনি তো অবাক। হাঁসির গায়ে কচি কচি সাদা পালক গজিয়েছে! টুনি তাকে ধরবে বলে দৌড়তে শুরু করেছিল; কিন্তু কিছুটা গিয়েই হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়তে হলো তাকে। এতক্ষণ সে খেয়ালই করেনি – তার নিজের শরীরেও সাদা সাদা পালক গজিয়েছে। কী করে হলো এমন! গায়ে হাত বোলাতে লাগল টুনি। আমি কি হাঁস হয়ে যাচ্ছি? পাখি হয়ে যাচ্ছি না কি আমি! ভাবতে ভাবতেই চোখ তুলে সে আরো অবাক! সামনে দাঁড়িয়ে কে? আরে, এ তো হারানিদি! সে বলেই ফেলল, ‘তুমি এখানে? কোথা থেকে এলে? তোমাকে জোর করে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল যে!’
হারানিদি বলল, ‘ওমা, তুই জানিস না! আমাকে তো ওরা পুড়িয়ে দিলো। ঘরের মধ্যে আটকে রেখে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে এদিক-ওদিক দৌড়াচ্ছি, ঘরেও আগুন লেগে গেল। ঘর পুড়ে গেলে তো মুশকিল। সেই আগুন নিভিয়ে নিল ওরা কিন্তু আমার আগুন আর নেভায়নি। তাই আমি চলে এলাম।’
একটু থেমে হেসে উঠে হারানিদি আবার বলল, ‘তাতে কিছু হয়নি রে, আমার গায়ে কী সুন্দর নরম সব পালক গজিয়ে গেছে দ্যাখ। ওরা তো জানে না, যতবার পোড়াক না কেন, আবার নতুন পালক গজিয়ে উঠবে।’
টুনি দেখতে পেল – হারানিদির গায়ে তারই মতো না কি হাঁসির মতো পালকে ভরে গেছে।
‘তুই কোথায় যাচ্ছিস?’ জিজ্ঞেস করল হারানিদি।
‘আমি যাচ্ছি আমার হাঁসির পেছনে।’ বলে হাঁসির দিকে তাকাল টুনি।
সে টুনিদের কথা শুনছিল, প্যাঁক প্যাঁক করে উঠল।
হারানিদি বলল, ‘আমাকে নিবি তোর সঙ্গে?’
টুনি বলল, ‘যাবে তো চলো না।’ বলেই টুনি পা বাড়াতে যাচ্ছিল। থমকে গেল। ‘না, দাঁড়াও একটু। ওই ওখান থেকে আর একজন কে আসছে বলো তো?’
দুজনে মুখ তুলে দেখল – মাঠ পেরিয়ে আলের ওপর দিয়ে পা ফেলে ফেলে আরো কেউ আসছে তাদের দিকে। কে ও?
আরো খানিকটা এগিয়ে আসতেই তাকে চিনতে পেরে দুজনেই আর চোখ সরাতে পারল না। এ যে সীতা! একটাও গয়না নেই, মাথায় নেই মুকুট। তবু সীতাই তো।
ততক্ষণে সে আল পেরিয়ে টুনিদের একেবারে কাছে এসে পড়েছে। মুখে হাসি নিয়ে সীতা জানতে চাইল, ‘কোথায় যাচ্ছো তোমরা?’
টুনি বলল, ‘আমরা তো হাঁসির সঙ্গে পুকুরে যাচ্ছিলাম। সাঁতার কাটব, জল ছিটাব, ডানায় জল নিয়ে খেলব।’
‘আমাকে তোমাদের সঙ্গে নেবে?’
টুনি মাথা নাড়ল, ‘তুমি কী করে যাবে? আমাদের তো পালক গজিয়েছে। তাই যাচ্ছি।’
‘সে তো আমার গায়েও আছে। এই যে!’ বলেই দুটো হাত সামনে ছড়িয়ে দিলো সীতা।
ঝরঝর করে হেসে উঠল টুনি, ‘ও, তাহলে তো ঠিকই আছে। চলো।’
হাঁসি মুখ ঘুরিয়ে দেখছিল সব। এখন প্যাঁক প্যাঁক আওয়াজ করে ডাকল তাদের।
সামনে হেলতে-দুলতে যাচ্ছে হাঁসি। তার পেছনে হারানি, মাঝখানে সীতা, শেষে আছে টুনি। দুহাত দুদিকে ডানার মতো মেলে দিয়েছে ওরা। আল থেকে মাঠে নেমে এগিয়ে যাচ্ছে পুকুরের দিকে।
ভোরের আলো ফুটছে। তবে কেউ কোথাও জাগেনি। হালকা বাতাসে গাছের পাতা দুলছে আর সরসর করে উঠছে ওদের গায়ের পালক। হাঁসির দল এগিয়ে চলেছে জলের দিকে।