বাস থেকে নেমে আসাদ অ্যাভিনিউ ধরে পা চালাতে দমকা বাতাসে সে বৃষ্টির গন্ধ পেল। সেন্ট জোসেফ স্কুলের সামনের ফুটপাতে পৌঁছতেই বড় বড় দুটো ঠান্ডা ফোঁটা কপালে আর চশমার ডান কাচে থেবড়ে বসতে জামিল জোরে পা চালাবে, না রাস্তার অপর পাড়ে মাথা বাঁচানোর ঠাঁই খুঁজবে এ-দোটানায় কয়েক সেকেন্ড পার করে ‘নাহ্ বৃষ্টির দেরি আছে’ ভাবতে ভাবতে সোজা পথেই হাঁটতে লাগল। স্বস্তিতে যে পা ফেলছিল বলা যাবে না। বৃষ্টির কী আর ঠিক আছে! রাত দশটার ওপরে বাজে, এ-সময় এ-জায়গায় ফেঁসে গেলে মুশকিল। একটা রিকশা পেলে হতো।
এপ্রিলের শেষাশেষি, মানে এসো হে বৈশাখ এখনো বাসি হয়নি। তবে বৈশাখী ঝড়-বাদলা যেমন হয়, এ-বছর হবো হবো করেও হচ্ছে না। আজ কি হবে? মনে হয় না। বৈশাখী ঝড় নিয়মনীতি মেনে চলে। বৃষ্টির আগে আকাশ কানা করে জোর বাতাসের ধাক্কাগুলো নামে বিকেলে বা সন্ধ্যার মুখে – বরাবর তা-ই দেখে এসেছে।
এখন এত রাতে নিয়ম ভেঙে ঝড়টড় হবে বলে মনে হচ্ছে না। তবে যেভাবে দুটো ফোঁটা টিকটিকির ডিমের মতো আলগোছে কপালে, চশমার কাচে পড়ে ফাটল তাতে অন্তত ঝড় না হোক, বৃষ্টির আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ফাঁকা রাস্তায় রিকশার নাম-নিশানা নেই। মনে হচ্ছে না রাত সবে সাড়ে দশটা, রাস্তাঘাট প্রায় নিঝুম, মাঝে মাঝে দু-একটা প্রাইভেট গাড়ির হুসহাস। ঘড়ি দেখে সে নিশ্চিত হলো, তাই তো, রাত খুব বেশি হয়নি, দশটা বেজে তেত্রিশ। রোজ সে মোটামুটি এমন সময়ই এ-পথে ঘরে ফেরে। আজ অবশ্য কিছুটা দেরি হয়েছে। সলিমুল্লfহ রোড পর্যন্ত হেঁটেই মেরে দেয়। তিরিশ-পঁয়ত্রিশ মিনিটের মতো লাগে।
বৃষ্টি নিয়ে আবোলতাবোল ভাবছে বলে জামিল নিজের ওপর বিরক্ত হলো। ঘরেই তো ফিরছে, বৃষ্টি যদি নামে, ভিজবে। দৌড়ে দৌড়ে ভিজবে। আর
আজ কি না যাকে বলে উইক এন্ড। সামনে দুদিন ধু-ধু ফাঁকা। নামুক, ভিজবে। সামনে হাতের ডানে টাউনহল বাজার। সকালে বেরোনোর সময় ভেবেছিল ফেরার পথে আঞ্জুমের নিউ হেয়ার স্টাইলে চুল কেটে ঘরে গিয়ে লম্বা গোসল দেবে। চুল কাটার কখন যে উপযুক্ত সময়, এই পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সেও ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। নাহ্, আজ চুল কেটে কাজ নেই, আর কাটবেই-বা কোথায়! রাস্তার ওপারে দেখা যাচ্ছে আঞ্জুমের সেলুনের ঝাঁপ ফেলা। সেলুন আঞ্জুমের একটা না। কাছাকাছি এই কাঁটাসুরে, বেড়িবাঁধে নাকি আরো দুটো রয়েছে। সবকটাই চালায় জ্ঞাতি-গোষ্ঠী মিলে। দাদা-পরদাদার ভোজপুরি জবানের সঙ্গে ঢাকাইয়া উর্দু আর কুট্টি বাংলার খিচুড়ি সেলুনে চুল কাটতে আসা লোকজনের ফাও বিনোদন। কাঁচির কিচকিচের সঙ্গে তারা নিজেদের মধ্যে বেদম বাতচিত চালায়। এত যে কথা ওরা বলে, জামিলের মাঝে মাঝে ভয় হয় বেখেয়ালে ঘ্যাঁচ করে গোটা একটা কান না উড়িয়ে দেয়! একবার বলেওছিল কথাটা আঞ্জুমকে। জবাবে সে হাসেনি, বলেছিল, আপ মুঝে চিল সমঝথা? শুনে জামিলের মনে হয়েছিল, কেন মনে হয়েছিল বলতে পারবে না, আঞ্জুম হয়তো চিলে কান নিয়ে যাওয়া ডরপুক বাঙাল আদমিদের নিয়ে একটা মজাক করল।
আরো দুই ফোঁটা পড়ল। নাকি তিন? এবার ঠিক মাথার পেছন দিকে যেখানে ছোট ডালপুরি সাইজের টাক সদ্য-জাগা চর হয়ে আশপাশের ঢেউখেলানো চুলকে শাসিয়ে চলেছে, সেখানে। এবার টিকটিকির ডিম না, গরম কড়াইয়ে তেল পড়ার ছ্যাঁৎ আওয়াজ বুঝি পেল। একটু পর বাঁদিকে জাকির হোসেন রোডে ঢুকতে পা বাড়াবে তখনি পেছন থেকে, বেশ পেছন থেকে একজোড়া পায়ের ভোঁতা, ধুপুস-ধাপুস আওয়াজ কানে আসতে সে বেশ অবাক হলো। এতক্ষণ তো কেউ ছিল না, নাকি ছিল, সে খেয়াল করেনি। আওয়াজটা ভোঁতা হলেও গতির কারণে চটপটে। পেছনে চোখ ফেলে আধো-অন্ধকারে তেমন কিছু ঠাহর হলো না, তবে আন্দাজ করল আওয়াজটা ভারী কেডস পরা পায়ের বলেই সে যা ভেবেছে – ভোঁতা ভোঁতা।
লোকটা অল্পবয়সী ছেলে-ছোকরাও হতে পারে – দ্রুত পা ফেলে যেন তার কাছাকাছি হতে চাইছে। ভাবামাত্র জামিল তার বাটার স্যান্ডেল পরা পা জোড়াকে বেগবান করল। সামনে এগিয়ে শেরশাহসুরি রোড থেকে ডানে বাঁক নিলে তাজমহল রোড, তারপর বাঁয়ে নূরজাহান রোড, শহিদ সলিমুলস্নাহ রোড। কিন্তু ফাঁকা কেন গলির রাস্তা? ল্যাম্পপোস্টের আলোয় যেন রোশনাই কম, সবকটা ল্যাম্পপোস্টে আবার বাতিও জ্বলছে না।
কেডস পরা পায়ের আওয়াজ পিছু ছাড়েনি। পা জোড়া তার পিছুপিছু গলিতেই ঢুকেছে। দ্রুত হাঁটতে গিয়ে এবার চোখে যে-দৃশ্যটা ধরা দিলো তাতে তার চমকানোর কথা। জামিল চমকাল। গজ-কুড়ি সামনে হাতে ব্রিফকেস, ইন করে শার্ট পরা মোটামুটি ধোপদুরস্ত একজনকে দেখল তার চেয়েও দ্রুত পা ফেলে, অনেকটা অলিম্পিকের হাঁটাদৌড় বা রেসওয়াকিংয়ের কায়দায় গোড়ালিতে ভর দিয়ে কোমর মুচড়ে শুধু ছুটছেই না, একটু পরপর পেছন ফিরে তাকাচ্ছেও। লোকটা মনে হচ্ছে জামিলেরই বয়সী, কোমরের ওপরের দিকটা ঝুলঝুলে আর মাথায় জামিলের ফাইভ সেভেনের কিছু বেশিই হবে হয়তো। কিন্তু ছুটছে যে এভাবে, আবার পেছন ফিরে দেখছে – কাকে? তাকেই?
ব্রিফকেস নিয়ে আজকাল কেউ বেরোয়? লোকটা তার বয়সী হলেও ব্যাকডেটেড। ব্রিফকেসে টাকাকড়ি বা দামি জিনিসপত্র যদি থেকে থাকে, গাধাটা এই রাতের বেলা হেঁটে যাচ্ছে কেন? আর ফিরে ফিরে পেছনে তাকানোর মানে কি জামিলের থেকে তফাতে থাকা, যেমন জামিল নিজেও পেছনের কেডসওয়ালা থেকে তফাতে থাকতে জোরে পা ফেলছে?
সন্দেহ নেই ব্রিফকেসওয়ালা তার ভয়েই ছুটছে। না হলে পাঁচ-ছয় কদম এগোতে না এগোতে স্প্রিং লাগানো পুতুলের মতো ঝট করে ঘাড়-মাথা ঘোরাতে যাবে কেন? ছুটন্ত অবস্থায় কাজটা সহজ বলে মনে হচ্ছে না। ভাবতে ভাবতে কী মনে করে সেও ঘাড়-মাথা সামনের লোকটার মতো পুরোটা না, আধাআধি ঘোরাতেই নজরে পড়ল কেডসওয়ালা তার থেকে বড়জোর দশ-বারো গজ পেছনে। গোড়াতে অনেক পেছনে ছিল। তার মানে, জামিল ছোটার বেগ বাড়িয়ে দিতে সেও তা-ই করেছে। আর তার ধেয়ে আসার গতি জামিলের চেয়ে বেশি বলেই দূরত্বটা কমিয়ে এনেছে।
থম ধরা বৃষ্টিটা আর ফোঁটায় ফোঁটায় না, তেরচা ফিনফিনে ধারায় ঝরতে শুরু করলে জামিল ভাবল, বিপদ। কিছুক্ষণ আগে ভেবেছিল বৃষ্টি আসলে আসুক, ভিজবে। তখনকার আর এখনকার পরিস্থিতি এক না। এখন বৃষ্টিই না শুধু, পেছনে ধাওয়ারত কেডস। সামনে আবার ব্রিফকেস। দুইয়ের মাঝখানে সে। পেছনের লোকটা যেন আর একটু হলেই তার ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলবে, আর সামনের জন যতই কোমর মুচড়ে আগে বাড়ার কসরত চালাচ্ছে, জামিল চাইলে খানিকটা বাড়তি চেষ্টায় তার গোড়ালি বরাবর ল্যাং মারলে মারতেও পারে।
তাজমহল রোডে এসে পড়তে মানুষজনের সাড়া মিলল। জামিল শেষবারের মতো ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল। ইচ্ছা করলে কেডসওয়ালা এক লাফে তার ঘাড়ে এসে পড়তে পারে। কিন্তু হঠাৎ সে তার গতি শস্নথ করে দিলো। আশপাশে মানুষজনের সাড়া পেয়েই কি না কে বলবে! এদিকে সামনে তাকাতে দেখল ব্রিফকেসওয়ালাও কোমর মোচড়ানোয় ঢিল দিয়ে ডানে-বাঁয়ে তাকাচ্ছে। ডানদিকে কানাডা টেইলার্সের শাটার নামাচ্ছে রংমলিন লালচে দাড়ি আর কাঁচা-পাকা মাথার আধবুড়ো দর্জি ওরফে খলিফা, ভুল করে নিশ্চয় গলায় ঝোলানো টেপ খুলে রেখে আসতে ভুলে গেছে। বাঁদিকে একটু সামনে তাজমহল তেহেরির খোলা মুখে মনাপাগলা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে দুই হাতে বুক চাপড়াচ্ছে। লোমবোঝাই মিশমিশে উদোম বুকে হাত চাপড়ানোয় তাকে দলছুট বাচ্চা গরিলা ভাবলে ভাবা যেতে পারে।
জামিল যেই মন ঠিক করে ফেলেছে তাজমহল তেহেরিতে গিয়ে ঢুকবে, তখনি দেখল ব্রিফকেস একনজর পেছনে চোখ ফেলে ভেতরে সেঁধিয়ে গেল। জামিল মত বদলাল না, সেও পিছুপিছু ঢুকল। অল্প জায়গা, সব মিলিয়ে গোটাপাঁচেক ছোট ছোট টেবিল। এত রাতেও তেহেরি খাচ্ছে লোকজন। কোণের দিকে একটা টেবিলই নজরে পড়ল ফাঁকা, আর দেখতে না দেখতে ব্রিফকেসওয়ালা সেদিকে এগিয়ে একটা চেয়ার দখল করে চোখ তুলে জামিলকে দেখামাত্র উঠে দাঁড়িয়ে ফের বসে পড়ল। জামিলের কিছু করার নেই একই টেবিলে বসা ছাড়া। চেয়ার টেনে বসতে যাবে, তার আগেই দুটো খালি চেয়ারের একটার যে দখল নিয়ে নিল তাকে চিনতে পায়ের দিকে নজর দিতে হয়। কেডসওয়ালা। ছেলে-ছোকরা বলা যাবে না, বয়স পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বা খানিকটা বেশি হলেও হতে পারে, শক্তসমর্থ শরীর, খোঁচা খোঁচা কালো দাড়ি-গোঁফে গেঁথে বসা বৃষ্টির ফোঁটা আলো পেয়ে জ্বলজ্বল করছে। লোকটা হাঁপাচ্ছে। একনজর তাকিয়ে টেনে ধরা চেয়ারটাতে বসামাত্র মনে হলো লোকটার চেয়ে সে আরো বেশি হাঁপাচ্ছে। আর মুখোমুখি ব্রিফকেসের হাঁপানোটা না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত হতো। হাঁ-মুখটা সে বুজতেই পারছে না। জিভটা ছোট জিয়ল মাছের মতো তড়পাচ্ছে দুই ঠোঁটের গহবরে।
বাচ্চাবয়সী ওয়েটার বা মেসিয়ার পানিভর্তি তোবড়ানো টিনের জগ ঠকাস করে টেবিলে রেখে তাদের দিকে না তাকিয়ে তেহেরি খতম বলে যা বোঝানোর বোঝাল। মাগনা পানি গিলে বাড়ি যাও। জগের দিকে তিনজনেরই নজর। কেডসওয়ালা মুহূর্তেই জগটার গলা চেপে নিজের দিকে টেনে নিয়ে গস্নাস না পেয়ে জগেই মুখ ঠেকাবে, না ওয়েটার ওরফে মেসিয়ারকে ডাকবে এ-দুর্ভাবনা সত্ত্বেও জগটা আঁকড়ে বসে থাকল। এতে একধরনের বিনোদন হয়তো জুটল। জামিল দেখল ব্রিফকেসের জিভ মুখের ভেতর আড়াল হয়ে গেছে, যদিও জোরালো শ্বাস-প্রশ্বাসের দাপট তার ঘামে-ভেজা ফর্সা চেহারায় অটুট। এদিকে তার নিজের হাঁপানো অনেকটাই জামিল সামলে নিয়েছে। গা ঘেঁষে বসা কেডসের অবস্থা যাচাই করতে গেলে পাশ ফিরে তাকাতে হয়, সে-চেষ্টায় না গিয়ে সে ঘড়ি দেখল, এগারোটা পাঁচ। আশ্চর্য, তার ঘড়ি দেখার ফল ওদের দুজনের ওপরও পড়ল, তারাও যার যার ঘড়ি দেখল। ধীরেসুস্থে দেখল, যেন একটা কাজের কাজ পাওয়া গেল।
খেতে খেতে লোকজন কথা বলছে। কার কোথায় জ্যামে আটকে দিন বরবাদ হয়েছে, কার আত্মীয়ের ব্রেন টিউমার ডাক্তার ধরতে পারেনি বলে সারাশরীরে ক্যানসার ছড়িয়ে এখন শেষ অবস্থা এসব। কান খাড়া করে শুনলে একজনের থেকে অন্যজনের কথা কিছুটা আলাদা করা যায়। না হলে তেহেরির গন্ধ-সুবাস ছাপিয়ে কথাবার্তা সম্মিলিত গুঞ্জনের ঘের কেটে মুক্ত হতে পারে না। নতুন অভিজ্ঞতা নয়, তারপরও ভাবতে গিয়ে মনে হলো এভাবে ভাবেনি। তেহেরির গন্ধ-সুবাস কথাটা মাথায় এসেছে বলেই হয়তো জামিল টের পেল খিদায় নাড়ি-ভুঁড়ি মোচড়াচ্ছে।
একটা বিকট মোটাসোটা হুলোবেড়াল এক টেবিলের নিচ দিয়ে অন্য টেবিলে হেলেদুলে চলছে-ফিরছে। জামিলের কেন জানি মনে হলো, তাদের টেবিলের নিচে মাথা ঢোকালেই লাথি খাবে। নির্ঘাৎ খাবে। কেডসওয়ালা সুযোগ ছাড়বে না। কিসের সুযোগ?
লোকজন খাওয়া শেষ করে উঠে পড়ছে। বৃষ্টি মনে হয় ধরে এসেছে। দোকান বন্ধ হতে আর কতক্ষণ? কেডসওয়ালা এ-সময় একটা উদ্যোগ নিল, জায়গায় বসেই পাশের সদ্য-খালি টেবিল থেকে অস্বাভাবিক লম্বা হাত বাড়িয়ে একটা গস্নাস তুলে এনে তাতে জগের ঘাড় কাত করল। গ্লfস থেকে পানিটুকু সে খেল রয়েসয়ে। জগ-গ্লাস টেবিলের মাঝামাঝি ঠেলে পানি খেতে চাইলে খাও এমন ভঙ্গিতে সে পকেট থেকে রুমাল বের করে মাথা-মুখ মুছল।
আরো কিছু সময় গেল। কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না, জগ আর খালি গ্লাস সামনে নিয়ে তিনজনই যেন গভীর চিন্তায় মশগুল। একসময় জামিল খেয়াল করল দোকান খদ্দেরশূন্য। তারা তিনজনই শুধু বসে। এবার কি তবে টেবিল ছাড়ার এলান শুনবে?
হঠাৎ বেশকটা গলার ক্যাঁচমেচে জামিল ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল বাইরে অমত্মত দশ-বারোজন ভিক্ষুক জটলা পাকাচ্ছে। দুজন মেসিয়ার একটা হাঁড়ি ধরাধরি করে বাইরে নিয়ে একহাতা করে তেহেরি সার করে দাঁড়ানো ওদের যার যার থালায় ঢেলে দিচ্ছে। বড়জোর মিনিট পাঁচ-সাতের ব্যাপার, আশ্চর্য শৃঙ্খলায় কাজটা হয়ে যেতে সে ভাবল, কী করবে? সলিমুলস্নাহ রোড মনে হচ্ছে এত দূরে, সারারাত হেঁটেও পৌঁছাতে পারবে না। খিদা থেকে মন সরাতে সে অন্য কথা ভাবল। আচ্ছা, ব্রিফকেসওয়ালা ছুটছিল তাকে পিছুপিছু ছুটতে দেখে, সে ছুটছিল কেডসওয়ালার ভোঁতা পায়ের ধাওয়া খেয়ে, আর কেডসওয়ালাকেও কি কেউ ধাওয়া করছিল – নাকি জামিলকে ধরতেই সে… ? ধরে তো ফেলেইছিল, ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ফেলব ফেলব করছিল। ধরে ফেললে কী করত?
কিংবা এমনকি হতে পারে তারা কেউ কাউকে ধাওয়া করছিল না? অন্তত জামিল যে ব্রিফকেসকে ধাওয়া করছিল না, এর চেয়ে সত্যি কী হতে পারে! আর কেডস যদি তাকে ধাওয়া না করে থাকে (হতেও তো পারে), তাহলে মূল ধাঁধাটার কী হবে? – কেডস ছুটছিল কেন? কে ছিল তার পেছনে? সে কোথায় মিলিয়ে গেল?
ভাইজান হোডেল বন্ করম্নম ঘোষণাটা শোনার বাকি ছিল। বাইরে বেরিয়ে আসতে জামিল খেয়াল করল, আগে বেরিয়েছে কেডস, তারপর ব্রিফকেস, সবশেষে সে। ইচ্ছা করেই কি সে পেছনে থেকেছে? তার মনে হলো সব গোলমেলে লাগছে, যেন এতক্ষণ ব্যাপারটা ঘোরের মধ্যে ঘটছিল, এবার ঘোর কেটে যেতে সে ঠিক করতে পারছে না সামনের ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে থাকবে, নাকি এগোবে! অন্য দুজন কী করবে তার মাথায় এলো না।
এবার কে কার পিছু নেবে? কেডসের পিছু ব্রিফকেস, ব্রিফকেসের পিছু সে, আর তার পিছু… ? সেই মিলিয়ে-যাওয়া অদৃশ্যজন – যার ধাওয়া থেকে রক্ষা পেতেই কি কেডস সবার আগে বেরিয়েছে?
অনিচ্ছাসত্ত্বেও সে সাবধানে, কেউ টের না পায় এমনভাবে ঘাড় ঘোরাল।