একিলিস হিল

একিলিস হিল

রাজিক একিলিসের নাম প্রথম শোনে তার বন্ধু হাসনাইন কাদিরের মুখে। হাসনাইন কাদিরের কাছে সে গিয়েছিল টাকা ধার করতে। টাকা ধার পেল না বটে, কারণ হাসনাইনের নিজেরই নাকি নেই। তবে রাজিক একিলিসের কথা শুনল। হাসনাইন কাদির লেখালেখি করে। তাকে দেশের লোকজন চেনে। সে অনেক পুরস্কারও পেয়েছে। প্রায়ই তাকে বিভিন্ন টেলিভিশনেও দেখা যায়, তার বইয়ের সংখ্যাও অনেক। তবে রাজিক তার কোনো লেখা পড়েনি। একবার পড়তে নিয়ে দেখেছিল – কঠিন – গল্প কোত্থেকে কোথায় চলে যাচ্ছে, বোঝাই মুশকিল। এ গেল গল্পের কথা। হাসনাইন কাদির কবিতাও লেখে। কবিতা রাজিক কিছুই বোঝে না।

এই যে রাজিক কবিতা বোঝে না, তার সাহিত্যজ্ঞান নেই, এসব হাসনাইন কাদিরের জানা। তবু, রাজিককে কাছে পেলে সে সাহিত্য নিয়েই আলোচনা করে। আজো যেমন, সাহিত্য নিয়ে কী ভাবছে সে, কোন কোন পরিকল্পনা তার মাথায় ঘুরছে, এসব সে সময় নিয়ে রাজিককে জানাল।

আজ ফোন করার সময় রাজিক গলার স্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেছিল। তার একটা সমস্যা আছে, না, বন্ধুদের কাছ থেকে টাকা ধার করা সে অস্বাভাবিক কিছু মনে করে না, সমস্যা হলো – টাকা ধার চাওয়ার সময় তার গলার আওয়াজ কেমন যেন হয়ে যায়, বন্ধুরা সহজেই টের পেয়ে যায়, সুতরাং সে পুরোপুরি চাওয়ার আগেই বন্ধুরা কথা ঘোরায় কিংবা জানিয়ে দেয় – তার নিজেরই কত অসুবিধা! সুতরাং রাজিক আজ একটা হালকা হালকা ভাব ধরে রাখার চেষ্টা করল, আর হাসনাইন কাদির তাকে বলল – আরে রাজিক, তুমি আছো কই?

আছি, দোস্ত চলতেছে।

সে সবারই চলে। আমারও চলতেছে। খবর থাকলে বলো।

খবর আর কই…।

জিগাইছিলাম – আছো কই? কাছাকাছি থাকলে চইলা আসো।

আছি তো কাছেই। ভাবলাম তুমি ফ্রি থাকলে একবার ঢুঁ মারি।

আসো আসো। আজ সারাদিন আমি বাসায়। মাথায় নতুন গল্প ঘুরতেছে। আউলায় না যায়, সেজন্য বাইর হই নাই। তুমি আসো।

ফোন বন্ধ করে রাজিক ফিরল সীমার দিকে – কইয়া দিলাম – কাছেই আছি। আছি তিন মাইল দূরে। এখন যাইতে…।

সীমা বিরক্ত গলায় বলল – দৌড়াইতে দৌড়াইতে যাও। থামবা না। টানা দৌড়াইবা।

সীমার বিরক্ত হওয়ার কারণ আছে। আজকের দিনটা যদিও পার করা যাবে, হয়তো টেনেটুনে কালকের দিনটাও, তার পরের দিনটা পার করা কঠিন হয়ে যাবে। রাজিকের চাকরি নেই মাসতিনেক। এটা নতুন কিছু না। প্রায়ই তার চাকরি থাকে না। সীমা, এরকম একটা লোকের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে বলে মাঝেমধ্যে খুব আফসোস করে। এই আফসোসের বিপরীতে রাজিকের তেমন শক্ত কোনো যুক্তি নেই। সে বলে, চাকরি সে করতেই চায়, যখন করে তখন যথেষ্ট আন্তরিকতার সঙ্গেই করে, মনোযোগের সঙ্গেও, যেন কোথাও কোনো ভুল না হয়ে যায়। তারপরও যে তার চাকরি থাকে না, এটাকে সে নিয়তি ছাড়া আর কীই-বা বলতে পারে!

সীমা তাকে দৌড়ে যেতে বলল, সেটা সম্ভব না, সে গেল বাসে করে। বাসের ভাড়াও আজকাল কম না। কিন্তু হাসনাইনের সঙ্গে কথা হওয়ার পর তার মন বলছে, হাসনাইন আজ তাকে নিরাশ করবে না। কিছু টাকা আজ নিশ্চয় তার কাছ থেকে পাওয়া যাবে। অবশ্য টাকাটা যে তার খুবই দরকার, এটা হাসনাইন কাদিরকে ভালোমতো বোঝাতে হবে।

পৌঁছাতে, যা লাগার কথা, তার চেয়ে কম সময় লাগল। সে ধরে রেখেছিল দেড়-দুই ঘণ্টা। তার সময় লাগল এক ঘণ্টা দশ মিনিট। হাসনাইন কাদিরকে পাওয়া গেল তার ঘরে। তার একটা আলাদা ঘর আছে। সেটা তার লেখালেখির ঘর। হাসনাইন অবশ্য সে-ঘরের নাম দিয়েছে ‘চিন্তা-ঘর’। হাসনাইন ছিল চিন্তা-ঘরে। রাজিককে দেখে বলল – হোমাররে নিয়া কিছু লিখব ভাবতেছি। হোমার এক আশ্চর্য ব্যাপার।

রাজিক হাসল – দোস্ত, অনেকদিন পর দেখা, আছো কেমন?

হাসনাইন কাদির বলল – এইটা বলো, হাসনাইন কাদিররে তোমার কেমন লাগে?

রাজিক হাসার চেষ্টা করল, পারল না, তবে মুখ সে হাসিহাসি করে রাখতে পারল।

হাসনাইন কাদির চেয়ার ছেড়ে উঠল। ঘরের ভেতর কিছুক্ষণ পায়চারি করল – প্রথমে ঠিক করলাম একটা দীর্ঘ কবিতা লিখব। নামও ঠিক করলাম – হোমারের সঙ্গে কয়েকটি সন্ধ্যা। পরে মনে হলো, না, এটা কবিতায় আনা যাবে না।… যাবে হয়তো, আমি পারব না। তখন ঠিক করলাম উপন্যাস লিখব। নাম অবশ্য এখনো ঠিক করি নাই।

রাজিক এবার হাসিটা ফোটাতে পারল – এসব কি আমি বুঝি?

কিন্তু হোমারের ইলিয়াড, এইটা কী অসাধারণ রচনা, এটা তুমি জানো?

পড়ি নাই তো।

পড়ো নাই!… ও হো হো, তুমি যে পড়ো না, এইটা আমার মাথায়ই নাই।

হোমার কে?

লেখক।… কবি। বহু আগে তিনি দুইটা অসামান্য…।

হাসনাইন, এসব আমি বুঝব না।

অবশ্যই বুঝবে। কারণ তাঁর লেখায় গল্প আছে। দুর্দান্ত গল্প। গল্পের ভেতর আর কী আছে, এইটা তুমি বুঝবা না। কিন্তু সেইটা বোঝারই-বা কী দরকার! বাইরেরটা বুঝলেই তুমি মুগ্ধ।

তুমি কোনটা বুঝো?

কী আশ্চর্য, আমি দুইটাই বুঝি। যেমন কাহিনি তেমন চরিত্র। কী যে চরিত্র একেকটা! কী বীরত্ব, কী দ্বন্দ্ব, চরিত্রে চরিত্রে কী সংকট, কী তাদের বাসনা, কী তীব্র প্রেম, কী প্রবল আত্মমর্যাদা, কী অহংকার।… রাজিক তুমি সত্যিই ইলিয়াড পড়ো নাই!

আমার পড়তে ভালো লাগে না, তুমি জানো। মজা পাই না।

আমি এইটা তোমাকে পড়তে দেবো, দেখবা…।

হাসনাইন…।

আমি উপন্যাসের একটা ছক মোটামুটি তৈরি করেছি। মানে, কীভাবে লিখব উপন্যাসটা। ঠিক করেছি, এভাবে দেখাব – আমি আর হোমার চলে গেছি ট্রয়ের যুদ্ধেক্ষেত্রে ঘুরে বেড়াচ্ছি, যুদ্ধ চলছে তখন, ঘটনা ঘটছে, আর, আমরা দুজন তা বিশ্লেষণ করছি…।

রাজিক বলল – হাসনাইন…।

শুনব তোমার কথা। তুমি কী বলবে, তা আমি জানি। আগে আমার কথা শোনো। চা খেলে ফ্লাস্ক থেকে ঢেলে নাও।… আমার জন্যও ঢালো।… এখন শোনো। অনেক চরিত্র ইলিয়াডে। হেলেন, প্যারিস, হেক্টর, নেস্তর, মেনেলাস, আগামেমনন, রাজা প্রাইম ইউলিসিস, একিলিস… একিলিস। একিলিসের কথা কী বলব তোমাকে! ইলিয়াডের সব চরিত্রই অসাধারণ, কিন্তু একিলিস দুর্দান্ত, এমন একটা চরিত্র যদি কোনো লেখক তৈরি করতে পারেন…।

দুই.

একিলিসের কথা রাজিক সীমাকে বলার সুযোগ পেল রাতে। সন্ধ্যা পর্যন্ত তাদের ঠান্ডা সময় গেল। ফিরতে ফিরতে রাজিকের দেরি হয়ে গিয়েছিল। কারণ হাসনাইন কাদির তাকে একিলিসের গল্প শোনাচ্ছিল। গল্পটা আসলে শুধু একিলিসের না। তবে ইলিয়াড পুরোটা বলতে অনেক সময় লাগবে, তাই হাসনাইন জোর দিয়েছিল একিলিসের ওপর।

সেই গল্প শুনে রাজিক মুগ্ধ – কী বলো তুমি, পুরাই অজের…।

অজেয়।

হ্যাঁ, পুরাই অজেয়, কিন্তু শত বীরের একটা খুঁত।

হুমম, একটাই খুঁত।

ওই একটা খুঁত না থাকলে প্যারিসের তীর তার গোড়ালিতে বিঁধত না?

না।

তাহলে, ওই খুঁত না থাকলে কেউ তাকে হারাতে পারত না?

খুঁত বলো, দুর্বল জায়গা বলো, তোমার-আমার সবার থাকে রাজিক।

বিকেলের দিকে বাসায় ফিরে রাজিক দেখল সীমা আর পাশের বাড়ির শামস ড্রয়িংরম্নমে বসে গল্প করছে। সদর দরজা খোলাই ছিল। রাজিক দরজা ঠেলে ঢুকতে ঢুকতে তাদের হাসির শব্দ পেল। রাজিক অবশ্য দাঁড়াল না। সে চলে এলো ভেতরে। জামাকাপড় বদল করে বিছানায় বসল মাত্র, শামসের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল বাইরে, তাদের বাড়ি ছোট, বেডরুম থেকে দু-পা দূরত্বে ড্রয়িংরুম, তার বাইরে দাঁড়িয়ে শামস বলল – রাজিক ভাই, গেলাম। আপনে ছিলেন না, ভাবি ভয় পাইতে ছিলেন, তাই তারে সঙ্গ দিলাম। এখন আপনে আসছেন, আমি যাই।

রাজিক কোনো উত্তর না দিয়ে বিড়বিড় করে বলল – হারামজাদা, তুমি মজা নাও?

বাইরের দরজা বন্ধ করার শব্দ হলো, তার পরপরই সীমাকে দেখা গেল দরজায় – টাকা আনছ?

রাজিক চুপ করে থাকল।

চুপ কইরা থাকলে আমি কী বুঝব! আনছ?

না, পাই নাই।

কার কাছে গেছিলা?

হাসনাইনের কাছে।

সে টাকা দিব! সে হইতেছে লুচ্চা। বাজারে তার দুর্নাম। অল্পবয়সী মাইয়া নিয়া ঘুরে।

এসব তোমারে কে বলছে।

কানে আসে।… একবার আমার দিকে ক্যামনে তাকাইছিল, মনে নাই?

এইটা তোমার মনের ভুল। সে কিন্তু প্রথমেই বলছিল, তার চোখের সমস্যা যাইতেছে।

তা-ই! আরেকবার ফোনে কী যেন বলছিল…।

সীমা, সেইটা তেমন কিছু না।

তুমি খামোখা বন্ধুরে টাইনো না, তারে সবাই চিনে। বলতে বলতে সীমা তার ব্লাউজের ভেতর থেকে টাকা বের করে রাজিকের দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল – যাও, বাজার কইরা আনো।

টাকা কই পাইছ?

শামস ভাইয়ের কাছে ধার নিছি।

তারে তুমি পাত্তা দাও কেন! দেখলা, যাওনের সময় কেমন ইয়ার্কি মাইরা গেল – তুমি নাকি ভয় পাইতে ছিলা…।

পাইতেছিলাম।… সে রসিক মানুষ।

হ, কত রস।… টাকা ব্লাউজের ভেতর রাখছ কি তার সামনেই?

না, শামস ভাই গুঁইজা দিছে…।

তুমি না… !

রাজিক বিছানায় মুখ কালো করে বসে থাকল। সীমা সেটা পাত্তা দিলো না। সে টাকা বিছানার ওপর রেখে হাতের অন্যান্য কাজ সারতে গেল। রাজিক কতক্ষণ মুখ কালো ও গুম করে থাকার পর উঠে বাজারে গেল। তার অবশ্য বেশ লজ্জা লাগল। শামসের টাকা, শামসের কাছ থেকে সীমা আগেও টাকা ধার করেছে, কিন্তু রাজিক তাকে দেখতে পারে না, ফাজিল একটা, কেনই-বা সীমাকে সে টাকা ধার দেয় আর কেনই-বা সীমা চায়, মানে, চায় বলেই তো, আর, মাঝেমধ্যেই তাদের কীসের এত গল্প, একদিন এই নিয়ে একটা মহাঝগড়া বাধিয়ে দিতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু ঝগড়া বাধিয়ে সীমার সঙ্গে বোধহয় কুলিয়ে ওঠা যাবে না, যেমন শামসের টাকা নিতে তার লজ্জা লাগলেও, জানলে সীমা নিশ্চয় বলবে – কই, না নিয়াও তো পারলা না – এরকম আর কি। সুতরাং ঝগড়া-টগড়া থাক। তার এসব ভাবতে গিয়ে একিলিসের কথা মনে পড়ল। তার মনে হলো, একিলিসের মতো কেউ একজন নিশ্চয় এসব মেনে নিত না। বীরের মতো সে সব মোকাবেলা করত।

একিলিসের কথা সে সীমাকে বলার সুযোগ পেল রাতে। ততক্ষণে তাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। সীমা অবশ্য প্রথম থেকেই স্বাভাবিক, মুখ কালো করে ছিল সে, তবে সে আগেও দেখেছে বেশিক্ষণ সে রাগ বা লজ্জা কোনোটাই ধরে রাখতে পারে না। আজো তার ব্যতিক্রম ঘটল না। ফলে বিছানায় আসার পর থেকে সে একিলিসের গল্প বলার জন্য উসখুস করতে লাগল। একিলিসের গল্প মানে অবশ্য পুরো গল্পটাই বলা, না হলে কেউ তেমন করে বুঝবে না, মজাও পাবে না। তা, বড় গল্প হলে গুছিয়ে বলতে হয়, হাসনাইন কাদির যেভাবে বলে, সে কি আর তেমন পারবে! তবু সাহস করে সীমার কাছে প্রশ্নটা সে রাখল – একটা গল্প শুনবা?

সীমা বলল – তোমার আবার কীসের গল্প!

আমার না। হাসনাইনের।

ওহ, ওই লুচ্চার। কী সেইটা? নতুন কচি মেয়ে পটাইছে?

আরে না। কী বলো! আর, গল্পও ঠিক হাসনাইনের না, গল্প হোমারের।

এই হোমারও লেখে?

কী যে বলো! সে কত বড় লেখক! একিলিসের যে বীরত্বের কথা সে লিখছে!

একিলিসটা কে?

আছে। গল্প শুনলে বুঝতে পারবা। বলব?

সীমা কতক্ষণ বালিশের ওয়াড় ঠিক করল, তারপর হেলাফেলায় বলল – বলো।

শুনবা! রাজিক, সীমা এত সহজে রাজি হয়ে গেল দেখে বিস্ময় বোধ করল। তবে সে দেরিও করল না, সে বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে সীমার দিকে তাকিয়ে গল্প বলতে আরম্ভ করে দিলো। সে গল্প বলার ফাঁকে ফাঁকে, সীমার দিকে তাকিয়েই সে, সীমাকে খেয়াল করল। তার ভেতর গল্প বলার উত্তেজনা আছে, কিছু দ্বিধা ও শঙ্কাও কাজ করছে, সীমা কীভাবে নিচ্ছে, এটা তার বোঝা দরকার। সীমা যদি হঠাৎ বলে ওঠে – ধ্যাৎ, এসব কী বলতেছ, কিছুই তো গুছায়া বলতে পারতেছ না – তবে সে খুবই মর্মাহত হবে। যত না হঠাৎ থেমে যেতে বলে, কারণ সীমা মাঝেমধ্যেই তাকে নানাভাবে থামিয়ে দেয়, তার চেয়ে অনেক বেশি হবে সে একিলিসের গল্প শোনাতে পারল না বলে।

সীমা অবশ্য শুনল। মাঝেমধ্যে এদিক-ওদিক বা হ্যাঁ-হুঁ করল বটে, তবে সে শুনল। শেষ করে রাজিক তাকে জিজ্ঞেস করল – কেমন?

সীমা বলল – খারাপ না।

খারাপ না! এইটুকু?

না, ভালো। সব গল্প খারাপ হয় না।

আমার তো দারুণ লাগছে। একিলিসের ব্যাপারটা খেয়াল করো…।

করলাম।

একটাই তার দুর্বল জায়গা। একটাই খুঁত। সেটাকে বলে একিলিস হিল।

পাহাড়?

আরে না না, প্রথমে আমিও তা-ই ভাবছিলাম।… ধরো এই খুঁত, যেইটারে বলে একিলিস হিল সেইটা না থাকলে সে ছিল অজের…না, অজেয় ছিল, অজেয়।… আর, দেখো তার দুর্ভাগ্য, প্যারিস এমন এইম কইরা তীর ছুড়ল…।

রাজিক, শুনো, চাকরির কিছু ব্যবস্থা করলা?

চাকরি! হঠাৎ থতমত খেয়ে গেল রাজিক, তবে সে সামলেও নিল। আমি চেষ্টায় আছি, সীমা।

থাকো। প্লিজ, থাকো। নাইলে হেলেনের মতো তোমার বউ পালাবে।

মানে! কী বলো! কে পালাবে? তুমি!

হুম, আমি। আর কে!

রাজিক হাসার চেষ্টা করল – কার সঙ্গে পালাবা?

পালাব। সীমা শুয়ে পড়ে গায়ে চাদর টেনে নিল। কী মনে করো – প্যারিস কি পাওয়া যাবে না?

সকালে উঠে, রাজিকের ঠিক খেয়াল নেই, আসলে বেখেয়ালেই যখন সে তার গোড়ালির দিকে তাকিয়ে ছিল, তখন গোসল সেরে ঘরে ঢোকার মুখে সীমা তা দেখে ফেলল, আর, রাজিক এমন ভান করার চেষ্টা করল যেন গোড়ালিতে তার কোনো সমস্যা হয়েছে, ফোঁড়া বা ফুসকুড়ি, এই জাতীয় কিছু, ব্যথা আছে, সে তাই চাপ দিয়ে ব্যথা পরীক্ষা করছে। সীমাকে অবশ্য এই ভান, দ্বিধায় বা ধাঁধায় ফেলতে পারল না, সে কিছুটা অবাক, কিছুটা বিরক্ত গলায় বলল – ব্যাপার কী!

রাজিক বলল – কই।

রাতেও দেখলাম গোড়ালি টিপতেছ।

কী কও! তুমি না রাতে ঘুমায়া পড়লা।

ঘুমের মধ্যেই দেখছি।… শুনো, নিজেরে একিলিস ভাইব না।

তুমি যে এসব কী বলো! একিলিস কেন ভাবব!

তিন.

পরের সপ্তাহে রাজিকের দুটো ইন্টারভিউ ছিল। ইন্টারভিউ দিতে রাজিকের বেশ লাগে। টিপটপ হয়ে যেতে হয়, স্মার্টলি কথা বলতে হয়, গাম্ভীর্যের সঙ্গে উত্তর দিতে হয়। ইন্টারভিউ কীভাবে দিতে হয়, এ বিষয়ক কিছু বইও সে পড়েছে। সীমাকে সে অনেকবার বলেছে, ইন্টারভিউ দেওয়া, বুঝছ সীমা, এইটা ব্যাপার না।

সীমা প্রতিবার একই উত্তর দেয় – বুঝি তো, তোমার যখন চাকরি হয় না, তখন বুঝি।

আহা, সেইটা ভিন্ন ব্যাপার।

ক্যান, সেইটা ভিন্ন ক্যান!

ধরো, নেব দুইজন, ইন্টারভিউ দিতেছে দুইশোজন, এইটা ইয়ার্কি না?

এবারের ইন্টারভিউ দুটোর  ক্ষেত্রেও রাজিক এই একই ব্যাপার দেখল। পদ যতগুলো খালি আছে, তার তুলনায় প্রার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি। ফলে দুবারই ইন্টারভিউ দেওয়ার আগে থেকেই সে হতাশ বোধ করতে আরম্ভ করল। তবু, দ্বিতীয়টির সময় সে বেশ ধীরেসুস্থে গুছিয়ে এগোচ্ছিল। হঠাৎ বোর্ডের একজন জিজ্ঞেস করে বসল – কী হলো, আপনি ওরকম করছেন কেন!

রাজিক অবাক হয়ে গেল – কীরকম করছে সে!

ঝুঁকে পড়েছেন যে! ডান হাত দিয়ে…।

রাজিক জুতো পরে এসেছে, ইন্টারভিউ যখন, সে খেয়াল করল সে বসে থাকা অবস্থায় ডান পায়ের ওপর বাঁ-পা তুলে দিয়েছে, একটু ঝুঁকে সে বাঁ-পায়ের গোড়ালির কাছটা ধরে রেখেছে। সে হাত সরিয়ে নিল, ফ্যাকাশে মুখে সামনে বসা লোকগুলোর দিকে তাকাল। তাদের একজন জিজ্ঞেস করল – আপনি সুস্থ? জি স্যার, আমার জ্বরটরও হয় না।

আপনি মানসিকভাবে সুস্থ?

জি স্যার, একদম… মানে স্যার…।

তো ওটা কী করছিলেন?

কোনটা স্যার?

সেটা আপনিই ভালো জানেন।… ঠিক আছে।

ইন্টারভিউ দেওয়া যদিও কোনো ব্যাপারই না, রাজিকের এরকমও প্রায়ই মনে হয়েছে – আসলে ইন্টারভিউ দিয়ে তার কপালে চাকরি নেই। এমনিতেও, ইন্টারভিউ দিয়ে কত জনেরই-বা চাকরি হয়! এই যে এত এত লোক ইন্টারভিউ দেয়, হয়ে যায় চাকরি? চাকরি, বেশিরভাগ সময়ই আসলে হয় এর-ওর মাধ্যমে, এই যেমন বন্ধু বা আত্মীয়স্বজন, যেমন…। রাজিকের সমস্যা হচ্ছে, তার কোনো বন্ধুর নিজস্ব কোনো অফিস বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নেই। থাকলে, সে সেখানে গিয়ে ধরনা দিয়ে পড়ে থাকতে পারত। কিন্তু তার বন্ধুরা সব মাঝারিমানের চাকরি করে। রাজিককে চাকরি দেওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই। এই অভিজ্ঞতা তার দীর্ঘদিনের। তবু, দ্বিতীয় ইন্টারভিউ দেওয়ার সপ্তাহখানেক পর সে ঠিক করল, একেক করে বন্ধুদের অফিসেই সে যাবে। এর মধ্যে সীমার সঙ্গে তার কয়েক দফা কথা কাটাকাটি হয়েছে। এর মধ্যে শামসও এসেছে কয়েকবার। সীমার সঙ্গে সে ড্রয়িংরুমে বসে গল্প করেছে। রাজিকের ডাক দু-একবার পড়েনি, এমন নয়। তবে ওদের ওখানে বসলে সে একটা-দুটো কি তিনটার পর কথা খুঁজে পায় না। তখন চুপচাপ বসে থাকে, এদিক-ওদিক তাকায়। কখনো ঘরের ছাদের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। সীমা হঠাৎ একদিন খেপেই গেল – আচ্ছা, হইছে কী তোমার?

রাজিক তাড়াতাড়ি ছাদ দেখা বন্ধ করে চোখ নামাল – কই!

গোড়ালি টিপতেছ কেন!

আমি ছাদের দিকে তাকায়া…।

আর এইদিকে গোড়ালি টিপতেছ। তোমার ওই ফাজিল বন্ধু তোমারে কী অসুখ দিলো!

রাজিক চুপ করে থাকল, আর সীমা ফিরল শামসের দিকে – শামসভাই, রাজিকে কী এক গল্প শুইনা আসছে…।

আরেকদিন, রাজিক বাড়ি ফিরেছে, সেদিন অবশ্য শামসকে দেখল না সে, সীমা দরজা খুলে হাত বাড়িয়ে দিলো – দাও।

রাজিক একটু হকচকিয়েই গেল। তার কি কিছু দেওয়ার কথা ছিল, মানে আনার? সে মনে করতে পারল না। মনে না হওয়ায় সে ভয় পেল না বা গম্ভীরও হলো না। সে বরং একটু হাসল – আচ্ছা, এটা কি তেমন কিছু, বিয়ের পর হঠাৎ হঠাৎ সীমা যেমনটা করত। ওই যে, বিয়ের দিনকয়েক পর সে বাইরে থেকে ফিরলে, ফিরতে সেদিন একটু দেরিই হয়েছিল তার, সীমা দরজা খুলে তাকে একটানে ভেতরে নিয়ে হাত বাড়িয়ে বলেছিল – দাও।

রাজিক, মনে আছে তার, সেদিনও হকচকিয়ে ছিল – কী!

ইস, বোঝে না যেন!

সীমার চোখের দিকে তাকিয়ে রাজিক বুঝেছিল। আজো কি সেরকমই কিছু? কিন্তু গতরাতেই… না না পরশু রাতে…। তাহলে কি পরশু রাতে ঠিকই ছিল সবকিছু, সীমা শুধু কিছু ইয়ার্কি, ওর অনেক ইয়ার্কির অভ্যাস, মেরেছিল? রাজিক সামান্য জিজ্ঞাসা নিয়ে সীমার দিকে তাকাল, আর সীমা হেসে উঠল – তুমি কি ভাবছ ওইটা চাই? হায়, কেমনে ভাবলা! পরশু রাতেই না মাঝপথে নেতায়া পইড়া গোড়ালি খামচাইতে আরম্ভ করলা!

হ্যাঁ, তুমি পাইছ এক গোড়ালি, সবকিছুর মধ্যেই গোড়ালি টাইনা আনো।

আমি না, তুমি আনো।

বলছে তোমারে।… কী দিতে কইলা, এইটা বলো।

ট্যাকা।

ট্যাকা কি আননের কথা ছিল?

ছিল। সবসময়ই থাকে।… অ্যাই খবরদার, গোড়ালির দিকে হাত নিবা না।

কী বলো! আমি তো সোজা হয়া খাড়ায়া আছি।

আগে থেকে ওয়ার্নিং দিয়া রাখলাম।

ওহ্।… সীমা, আমি কিন্তু ট্যাকা জোগাড়ের চেষ্টা করতেছি।

আমি একটা ব্যাপার বুঝি না। আর বুঝি না বইলা নিজেরে গালি দিই।… রাজিক, ভাবছ কুনোদিন, তোমার সঙ্গে আমার বিবাহ ক্যান হইল!

এইখানে ভাবনের কিছু নাই। কপালে ছিল, হইছে।

কপাল বদলায়ে ফেলব। পালায় যাব।

এই কথা তুমি আগেও কইছ। কয়েকবার।

একদিন সত্যিই যাব। তোমার সঙ্গে সংসার করনের কোনো যুক্তি আছে?

সীমা, আমি তো সত্যিই চেষ্টা করতেছি।

করো। আমিও এই ফাঁকে ভাবি কার সঙ্গে পালাব।

যে-কথা হচ্ছিল, রাজিক ঠিক করল বন্ধুদের অফিসেই সে আবার এক এক করে যাবে ও যেতেও আরম্ভ করল সে। বন্ধুদের সঙ্গে তার যে-কথা হলো, তা সবমিলিয়ে এরকম। কয়েকজনের সঙ্গে তার কথা হলেও সেটা একজনের কথা বলেও চালিয়ে দেওয়া যায়। তাকে বলা হলো – হ, তর চাকরির জন্য বলি আর বেকায়দায় পড়ি আর কি। তুই দুই মাসের বেশি বেশিদিন থাকস?

রাজিক দুপাশে মাথা নাড়ল – এইটা ঠিক না, দোস্ত। আমি সবচেয়ে কম সময় যে-চাকরিটা করছি, সেইটাও সাড়ে তিন মাস।

ওই একই কথা হইল।

দোসত্ম, আমি কিন্তু সিরিয়াস। চাকরি আর ছাড়ব না।

তর খাসলত জানি।

আর দেখ, চাকরি কি আমি ছাড়ছি, ছাড়ায়া দিছে।

এইটা বসরে কইলে, আমারেও ছাড়ায়া দিব।… তুই বরং এক কাজ কর।

কী?

ব্যবসা কর।

রাজিক হতাশ গলায় বলল – পুঞ্জি কই! বিনা পয়সায় ব্যবসা আছে।

আছে। মারা দেওয়ার।… রাজিক, তুই কি জুতা খুলছস?

মাত্র, তুই কইলি মারা দেওয়ার…।

ভক কইরা মুজার গন্ধ। এহ্! জুতা খুলছস কেন!

রাজিক গোড়ালি থেকে হাত সরিয়ে জুতো পরে বেরিয়ে গেল।

একটা-দুটো দিন চলে আসে, সীমা সহজ গলায় কথা বলে। রাজিক কথাটা বলার জন্য সীমাকে, আর কাকেই-বা বলবে সে, হাসনাইন কাদির তাকে একিলিসের গল্প বলার পর ঢাকার বাইরে চলে গেছে, তার মাথায় নাকি হোমার জট লাগিয়ে দিয়েছে, জট না খুলে সে আসবে না, সুতরাং, হাসনাইন কাদিরকে বললে ভালো হতো, নেই যখন, সীমাকেই বলা।

রাজিক অবশ্য অনেক দ্বিধা করছিল, যথেষ্ট ইতস্তত করছিল সে। তবে এরকমও সে বুঝতে পারছিল, না বললে তার চলছেও না। সে দুপুরে খাওয়ার পর সীমার সঙ্গে রান্নাঘরে হাত লাগাল। তাই দেখে সীমা অবাক – কী ব্যাপার? উদ্দেশ্য কী?

কোনো উদ্দেশ্য নাই। ভাবলাম, তোমার পাশে থাকি।

ওহ্।… তো, হাঁড়ি-পাতিল তো ভালোই মাজতেছ, কোনো বাড়িতে বুয়ার কাম নিবা? সংসারে দুইটা পয়সা আসত।

তোমারে ভালোবাইসা এইটা করতেছি।

ওহ্, এইটা ভালোবাসা। তো, এইটা আমার খুব ভালো লাগে যে অনেকেই আমারে ভালোবাসে। শামসভাই ভালোবাসে…।

সে কি এসব কথা বলছে তোমারে!

বারে, বলবে না কেন! সে ভালোবাসে, রাস্তায় বাহির হইলে মনে হয় আশপাশের অনেকে ভালোবাসে, আবার সেইদিন বাড়িঅলা তিন মাসের বকেয়ার তাগাদা দিতে আসলে মনে হইল, তুমি বাড়ি না-থাকলে সে-ও আমারে ভালোবাসে।

এসব ফাতরা কথা বাদ দাও।

দিলাম।… রাজিক, আবার!

রাজিক কিছুক্ষণ কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে থেকে বলল – সীমা, তোমারে এ-বিষয়ে একটা কথা বলতে চাই। জরুরি কথা, তোমারে বলা দরকার…।

বলো।

এখন না। কাজ শেষ হউক। বিছানায় বইসা বলল।

বিছানায়? বইসা?… বিছানায় তো তোমার পারফরম্যান্স দেখতেছি…।

আহা, এইটা অন্য ব্যাপার।… আর, ওই বিষয়ে যা বলতেছ, একটা ব্যাখ্যা দেওয়া দরকার, খুব টেনশনে থাকি তো, টেনশনে এই সমস্যা হইতেছে।

ওহ্! তা, আজকে বিছানায় বইসা যেইটা বলতে চাও, সেইটাও কি টেনশনের?

এইটা কি টেনশনের কথা না? বলো তুমি। তোমার কী মনে হয়? রাজিক সীমাকে জিজ্ঞেস করল। তখন বিছানায় বসে তাদের কথা বেশ কিছুটা এগিয়েছে। কথা আর কী, রাজিক বিছানায় বসল, আর, সীমা বসতে বসতে বলল – কী বলবা, বলো। সময় নিবা না, আমি ঘুম যাব।

রাজিক বলল – আমি তোমাকে একটা কথা বলব।

আহা, কথাই তো বলবা বললা। বলো।

জিজ্ঞাসা করব আর কি। তুমি কিন্তু সত্য বলবা। ইয়ার্কি মারবা না।

আমি ইয়ার্কি মারি? কখনো দেখছ আমারে ইয়ার্কি মারতে?

রাজিক মৃদু গলায় বলল – নাহ্, দেখি নাই। সে তার পাশে জায়গা দেখিয়ে দিলো সীমাকে – বসো। সীমা বসল। একটু সময় নিল রাজিক, যেন একটু সংকোচ বোধ করছিল, সেটা কাটিয়ে নিল, ডান পায়ের ওপর বাঁ-পা তুলল – এই যে, সীমা, দেখো। রাজিক তার গোড়ালির দিকে ইঙ্গিত করল – দেখো তো একটু।

কী দেখব! তোমার গোড়ালি দেইখা কী করব!

সীমা, এইটা আমার গোড়ালি…।

কী বলো এইসব! এইটা তোমার গোড়ালি, এইটা আমি জানি না।

জানো বইলাই জিজ্ঞাসা করতেছি।… আমার গোড়ালি কি বড় হইছে?

গোড়ালি বড় হইছে মানে? ফোঁড়া হইছে?

না না, ফোঁড়া না, এমনি। বড় হইছে?

সীমা কিছুটা সময় তাকিয়ে থাকল রাজিকের দিকে – সমস্যা কী! তোমার নিজের কি মনে হয় তোমার গোড়ালি বড় হইছে?

হইতেছে।

কই, দেখি।

এই যে, এইখানে দেখো…। আরে, হাসো ক্যান তুমি!

না না, কে কইছে হাসি!… রাজিক…। সীমা মনোযোগের সঙ্গে রাজিকের গোড়ালির দিকে তাকিয়ে থাকল।

কি, বুঝতে পারতেছ?

সীমাকে গম্ভীর দেখাল। সে একবার রাজিকের মুখের দিকে তাকাল, তারপর আবার রাজিকের গোড়ালির দিকে। তারপর গোড়ালির দিকে তাকিয়েই থাকল সে।

কি, বুঝতে পারতেছ? ডাইন পা দেখো। তাইলে সহজে বুঝবা।

সীমা রাজিকের দুই গোড়ালি দেখল, গম্ভীর গলায় বলল – তুমি এইটা কবে টের পাইছ?

পাইছি। বেশ আগেই পাইছি।

তাইলে এদ্দিন বলো নাই কেন!

তুমি যদি বিশ্বাস না যাও…।

হঠাৎ বড় হইয়া গেল?

কইলাম না – হইতেছে।… সীমা, একটু একটু কইরা বড় হইতেছে। দেখো তুমি, বড় হইয়া হাঁটুর দিকে উঠতেছে।

না না, অতদ্দূর উঠে নাই।

উঠতেছে।… একটা কইরা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে, আমি খেয়াল কইরা দেখছি, আর একটু কইরা বড় হয়।

অদ্ভুত ঘটনা যেন না ঘটে, এইরকম ব্যবস্থা নেওয়া যায় না?

এইটা কী বলো! কেমনে বন্ধ করি! এসব ধরো – অদ্ভুত, কিন্তু রোজকার। সেইদিন তুমি বাড়িঅলার কথা বললা। আমারও দেখা হইছিল, তোমারে বলি নাই, এমন খারাপ ব্যবহার করল।

এইটা ধরো অদ্ভুত ঘটনা না। এইটা, এই যে বাড়িঅলা খারাপ ব্যবহার করল, এইটা তোমার প্রাপ্য।

তারপর সেইদিন রিকশাঅলা রিকশা নিয়া প্রায় ঘাড়ের ওপর আইসা পড়ল। হাতে ব্যথা পাইলাম। কিন্তু আমি আর কী বলব, রিকশাঅলা আর প্যাসেঞ্জার কইল, দোষ নাকি আমার। আমার এমন রাগ উঠল – রিকশাঅলারে একটা চড় দিতে গেলাম। তখন রিকশাঅলা আর প্যাসেঞ্জার রাস্তায় নাইমা এমন একটা ধাক্কা দিলো…।

এইটাও কোনো অদ্ভুত ঘটনা না রাজিক। আর কিছু আছে?

থাকবে না ক্যান! বাজারের ঘটনাটা বলব?

বলো।

মাছের দাম জিজ্ঞাসা করছিলাম।… দুইবার জিজ্ঞাসা করলাম, উত্তর দিলো না। তিনবারেও না। চারবারের বার চেইতা গিয়া বলল – দাম জিজ্ঞাসা করতেছেন ক্যান! এই মাছ আপনি কিনতে পারবেন? কোনোদিন কিনছেন? আমার ইচ্ছা করল বঁটি দিয়া মাছঅলারে কোপাই – অই ব্যাটা…।

বড় মাছ?

বড় মাছ।

তাইলে এইটাও অদ্ভুত ঘটনা না। রাজিক, তুমি কি বড় মাছ কিনছ কোনোদিন?

কিনি নাই। কিন্তু মাছের শইলে তেল কী…! দাম জিগাইলে কী অসুবিধা, কও?

মাছঅলার সময় নষ্ট। তুমি সমস্যা করতেছিলা।

সীমা, এসব সময়ে আমার সমস্যা হয়।

কী সমস্যা?

আমি টের পাই আমার গোড়ালি বড় হইয়া যাইতেছে।

ওহ্। এইভাবে গোড়ালি বড় হইলে তো সমস্যা।

এই যে বড় হইতেছে, একদিন দেখব বড় হইতে হইতে হাঁটু পর্যন্ত উইঠা আসছে। তারপর…।

এক কাজ করবা?

করব না ক্যান! বলো।

তুমি তোমার হাসনাইন কাদিরের কাছে একবার যাবা?

আমি নিজেই তার কাছে যাওয়ার কথা ভাবতেছিলাম।

যাও। তারে বলো, তার কাছে একিলিস না কী যেন নাম বলছিলা, তারে ফেরত রাখতে আসছ।

আমি ভাবছিলাম তুমি একটা ভালো কথা বলবা।

রাজিক, সত্য বলবা, তোমার কি এই সংসার নিয়া কোনোই চিন্তা হয় না? আমাকে নিয়া ভাব না? আমরা কীভাবে বাঁইচা থাকব, এইটা মাথায় আসে না! বলো। রাজিক কিছু বলল না, সে চুপ করে থাকল।

কী হইল, বলো। এই সংসারের চিন্তা আমার একার! বলো, আমার একার! আমি থাকব সংসার নিয়া, তুমি থাকবা গোড়ালি নিয়া?

সীমা…।

বুঝ দিও না, সত্য বলো – এই সংসার আমার একার!

সীমা, সেইটা না।… সীমা, তুমি কি গোড়ালি চুলকাইতেছ?

সীমা বড় করে শ্বাস ফেলল। তাকে বেশ নরম ও কোমল দেখাচ্ছিল। সেই কোমল ভাব তার চেহারা থেকে মুছে গেল, সে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল – কেউ তোমার সামনে গোড়ালি চুলকাইতেও পারবে না!… রাজিক, আমার সত্যিই পালানোর সময় হইছে।

হাসনাইন কাদির ফিরেছে, তবে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা কঠিন। রাজিকের মোবাইলে ফোন করে কথা বলার পর্যাপ্ত পয়সা নেই। যেটুকু আছে, ফোন করে ৫-১০ সেকেন্ড কথা বললেই শেষ হয়ে যাবে, ওই সময়ে অবশ্য এটুকু বলা যায় – ব্যালান্স নাই বুঝছ তুমি কল ব্যাক করো, কিন্তু এই পয়সাটুকু খরচ করতে রাজিক রাজি না, কারণ, বলা যায় না, যদিও রাজিক তেমন কিছু দেখছে না, তবু, কে জানে, আরো জরুরি ফোন করার প্রয়োজন পড়তে পারে। রাজিক তাই সীমার ফোন বাগানোর চেষ্টা করল, কিন্তু সেরকম কিছু সম্ভব হলো না। শেষে, একটা কল করার পয়সাও আমার ফোনে নাই – এইরকম ভেবে তার খুব মন খারাপ হলো, ও মন খারাপের এই অবস্থা কাটানোর জন্য সে হাসনাইন কাদিরকে মিসড কল দিতে শুরম্ন করল। খুব সতর্কতার সঙ্গে সে এটা করল, যেন হাসনাইন কাদির তার কল ধরে না ফেলে।

হাসনাইন কাদির তার ফোন না ধরে কল ব্যাক করল – ছোটলোকের মতো মিসড কল দিতেছ কেন!

রাজিক বলল – ছোটলোক আর কী করবে, ছোটলোকের ফোনে পয়সা নাই।

হাসনাইন কাদির বলল – এত ছোটলোকের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা মুশকিল।

রাইখো না। তার আগে তোমারে কিছু কথা বলতে হয়।

বলো। আমার ফোনে ব্যালান্স আছে।

না সামনাসামনি বলব। তুমি কি ফ্রি আছো?

আসবা?… আসো।

তোমার মাথার জট খুলছে?

খোলে নাই। সেইটা সমস্যা না। তুমি আসো।

হাসনাইন কাদিরের বাসা দূর আছে। হেঁটে যাওয়া, কঠিন হবে। আবার, তার কাছে সবমিলিয়ে আছে তেইশ টাকা। এই টাকায় বাসে যাওয়া যাবে, কিছু বাঁচবেও, তবে যা বাঁচবে, তা দিয়ে ফেরা যাবে না। তবে রাজিকের মনে হলো, এটা সমস্যা না, হাসনাইনের সঙ্গে জোরাজুরি করেও শ-পাঁচেক টাকা যদি সে বাগাতে না পারে, হেঁটে ফিরবে। আপাতত তার কাছে যাওয়াটা জরুরি।

রাজিক হাসনাইন কাদিরের বাসায় যখন পৌঁছাল, সে ঘেমে একাকার। বাস নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বেশ কিছুটা পথ হেঁটে আসতে হয়েছে। কন্ডাক্টর কিছু টাকা ফেরত দিতে পারত, কাউকে কাউকে দিয়েছে, যারা আরো দূরের পথের যাত্রী, সে চাইলে বিরক্ত হয়ে বলেছে, আরে আপনারে তো আধা মিনিটও হাঁটন লাগব না। আধা মিনিটের পথ নয়, হেঁটে গেলে ষোলো-সতেরো মিনিট লেগে যাবে, সে বোঝাতে গেলে কন্ডাক্টর তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে একপাশে সরে গেল। রাজিক কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে হাঁটতে আরম্ভ করল।

হাসনাইন কাদির তার চিন্তা-ঘরে। চেয়ারে বসে টেবিলের ওপর পা তুলে টেলিভিশনে খেলা দেখছে। তাকে একপলক দেখে নিল, বলল – ঘামছ কেন! বসো।

রাজিকের মনে হলো, এই এটাই একটা সুযোগ কথা শুরু করার। কথা মানে গোড়ালির কথা। এভাবেই শুরু করতে পারে – আর বইলো না, মাঝপথে বাস নষ্ট – এভাবে শুরু করে – প্রাপ্য টাকা চাইতে গেলে কন্ডাক্টরের দুর্ব্যবহার ও তারপর তার গোড়ালিতে…। রাজিক অবশ্য তখনই শুরম্ন করতে পারল না। কেন, সে বুঝল না, তার লজ্জা লাগল, সে বলল – তোমার খবর কও, এতদিন বাইরে থাইকাও মাথার জট খুলাইতে পারলা না?

হাসনাইন কাদির মাথা নাড়ল – পারলাম না।

পরিকল্পনা বাদ দিলা?

না না, বাদ কেন দিব! অন্যভাবে ভাবতেছি। ধরো, ওই কাহিনির ভেতর থেকে কাহিনি নিয়া কয়েকটা গল্প লিখলাম। টেকনিক আছে। তুমি বুঝবা না।

জানি।… তুমি যে-কাহিনি বলছিলা হাসনাইন, ভয়ংকর।

আমি ভেবে দেখলাম, উপন্যাস পরে। প্রথমে গল্প। কারণ ইলিয়াডের ভেতর অসংখ্য গল্প লুকিয়ে আছে। একেকটা ঘটনা নিয়ে গল্প হয়, আর, একেকটা চরিত্র নিয়ে তো হয়ই।

হাসনাইন,… একিলিস…।

একিলিসকে নিয়া তো লিখবই।

না, মানে ঠিক সেইটা না, একিলিস…।

দুর্দান্ত এক চরিত্র, তাই না?

একিলিসের গোড়ালি কি সবসময় একইরকম ছিলো…?

হায় হায়, এমন গোল মিস করল! হাসনাইন কাদির প্রায় লাফিয়ে উঠল, নিরাশ ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল, তারপর রাজিকের দিকে ফিরল – কী বললা?

একিলিসের গোড়ালি কি সবসময় একইরকম ছিল?

একইরকম ছিল মানে! কী রকম থাকবে!

না, ধরো… আচ্ছা, কখনো ছোট-বড় হয় নাই?

ছোট-বড় কেন হবে!

রাজিক চুপ করে মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকল। নিচে তাকিয়ে থেকেও সে টের পেল হাসনাইন তার দিকে তাকিয়ে আছে। রাজিক বলল – হাসনাইন, আমি তোমারে একটা কথা বলব।

নিশ্চয় বলবা।… তোমার কি কোনো সমস্যা হচ্ছে?

রাজিক মাথা ঝাঁকিয়ে চুপ করে থাকল।

বলো।

আসলে একটা জিনিস দেখাব।

দেখাও।

‘দেখাও’ শুনেও একটু ইতসত্মত করল রাজিক। তারপর জুতো খুলল, মোজা খোলার আগে বাজে কোনো গন্ধ আছে কি নেই, এই ভেবে, আবারো একটু ইতসত্মত করল, কাটিয়ে উঠে মোজা খুলে দু-পা তুলে ধরল – হাসনাইন, কোনো পার্থক্য দেখতেছ?

হাসনাইন রাজিকের পা দেখল।

ওপরে না, নিচে। গোড়ালির কাছে। কোনো পার্থক্য দেখতেছ?

হাসনাইনের চোখ কুঁচকে গেল – কী পার্থক্য?

তুমি বুঝতেছ না?

তুমি বলো আগে, তাহলে সুবিধা হয়।

আমার বাম গোড়ালি একটু বড় হয়া গেছে না?

বাঁ গোড়ালি বড় হয়ে গেছে! দাঁড়াও দাঁড়াও, আবার দেখতেছি।

দেখো। হাসনাইন বাঁ গোড়ালি কিন্তু সত্যিই বড় হইতেছে।

হাসনাইন কাদির রাজিকের দিকে তাকাল – কবে এইটা টের পাইলা?

ওই যে, একিলিসের গল্প বললা, তার কয়দিন পর দেখলাম – হঠাৎ হঠাৎ বাম গোড়ালিতে অস্বস্তি লাগে…।

সেই অস্বস্তি থেকে বড় হতে আরম্ভ করল?

তুমি কি বিশ্বাস যাইতেছ আমার কথা?

হ্যাঁ হ্যাঁ, বিশ্বাস ছাড়া হয় না।… তুমি বলো, রাজিক।

কী বলব, বলো হাসনাইন! তুমি তো আমার কথা জানোই। এইটা জীবন কি না, ধরো, এইটাও বুঝি না। শুধু বুঝি আমার কোনো ক্ষমতা নাই। আমি আর ফকিন্নির পুত হইল একই কথা।… চাকরি নাই, হাতে ট্যাকা নাই, সংসার টিকবে কি টিকবে না, এইটার ঠিক নাই…।

সংসারে আবার কী হইল, রাজিক!

আর বইল না। সে মাঝেমধ্যেই বলে পলাইব।… ইয়ার্কি মাইরা বলে, না…।

তার কি কোনো প্রেমিক আছে?

না না, কিন্তু অভাবের সংসার।… অভাব, ধরো, লাইগাই আছে।

প্রেমিক থাকতেও পারে। তোমার বউ অতিশয় সুন্দরী। আমি তো প্রথম দেখায়ই তার প্রেমে পড়ে গেছিলাম।

এইটা ধরো, তুমি বন্ধু মানুষ, ব্যাপার না। কিন্তু শামস…।

শামস কে?

বাদ দাও।… হাসনাইন, আবার দেখো তো, আমার গোড়ালি কি আরেকটু বড় হইছে?

হাসনাইন কাদির মনোযোগের সঙ্গে তাকাল – সেইরকমই মনে হচ্ছে রাজিক।

এখন ঠিকমতো জুতা পরতে পারি না। বাঁ-পায়ের জুতা মনে হয় টাইট হয়া গেছে। চাপ লাগে। মনে হয়, খালি পায়ে থাকতে পারলে ভালো লাগত।

ডাক্তার দেখাইছ?

কোন ডাক্তার দেখাব! আর, তুমি তো আমার অবস্থা জানো। ডাক্তার মানেই ট্যাকা।

থাক, ডাক্তার দেখানোর দরকার নেই।

কিন্তু না দেখাইলেও সমস্যা। এই যে গোড়ালি বড় হইতেছে, বড় হইতে হইতে কত বড় হইব? ধরো, হাঁটু পর্যন্ত উঠল, তারপর আরো ওপরে, ধরো, তারপর আরো… হাসনাইন, ধরো, একবার ধরো তুমি, গোড়ালি বাড়তে বাড়তে আমার পুরা শরীর গোড়ালির মতন হয়া গেল…।

হাসনাইন কাদিরের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল – এইটা তুমি ভালো বলছ।

তুমি খুশি হইছ! তোমার মুখ বলতেছে – আমার পুরা শরীর গোড়ালির মতন হয়া যাবে শুনে তুমি খুশি হইছ।

রাজিক, এই যে পুরা শরীর গোড়ালির মতন হয়ে গেল – এইটা আইডিয়া হিসেবে দারম্নণ।… রাজিক, আমি তোমারে নিয়া গল্প লিখব।

আমার এই দুর্ভোগ, এই কষ্ট, আর তুমি আমারে নিয়া গল্প লিখবা!

লিখব। গল্পের নাম – রাজিকের গোড়ালি।… না, ভালো শোনায় না। আরো সাধারণ নাম হতে হবে। এই যেমন শরাফুলের গোড়ালি। গল্প তোমার, নাম শরাফুলের।

আমি গোড়ালির মতন শরীর নিয়া রাস্তায় বাইর হবো, এইটা তুমি ভাবো একবার। লোকজন হাসবে না? তারা কী বলবে? সীমা আর সংসার করবে…?

এইটা চিন্তার কথা না, রাজিক। এইটা শুধু তুমি বুঝবে, আর কেউ বুঝবে না।

এইটা ক্যামনে সম্ভব! ক্যান বুঝবে না!

কারণ তাদের শরীরও গোড়ালির মতন হয়ে যাচ্ছে। হয়তো তারা টের পাচ্ছে, কিন্তু বলছে না, কিংবা টের পাচ্ছে না। … এইটা আমার ধারণা, মানে গল্পটা আমি এভাবেই লিখব – এক এক করে সবাই গোড়ালির মতো হয়ে যাচ্ছে।

রাজিক অবাক গলায় বলল – এইটা বোধহয় তুমি ভুল বলো নাই। গত রাতে দেখলাম, সীমা গোড়ালি চুলকাইতেছে।

ওই যে, শামস না কার কথা বললা, খেয়াল করলে দেখবা সেও মাঝেমধ্যে চুলকায়!

সত্য?

খেয়াল করতে হবে, রাজিক, খেয়াল করতে হবে। তুমি খেয়ালই করোনি, আমিও এর মধ্যে দু-একবার গোড়ালিতে হাত দিয়েছি।

তুমিও।

মাঝেমধ্যে খুব মন খারাপ হয়। এই যে এত এত ভালো লেখা লিখলাম, কী পেলাম! না খ্যাতি, না অর্থ, না স্বীকৃতি …। আর, কী এক অজানা ভয়, অস্বস্তি… মাঝেমধ্যে খুব চ্যাঁচাতে ইচ্ছা করে… পারি না।

তুমিও যদি এই কথা বলো!

বলি।… রাজিক, তুমি ওঠো। আমি লিখতে বসব – শরাফুলের গোড়ালি।

চার.

হাসনাইন কাদিরের কাছ থেকে পাঁচশো টাকা পাওয়া গেছে। সে বলছিল – ধার ধার – হাসনাইন কাদির বলল – ধার দিই না আমি, ধার দেওয়ার ক্ষমতা নাই। এমনি নাও।

রাজিক এখন রিকশা করেই ফিরতে পারে। আর, অপব্যয়ী যদি না-ই হয়, বাসে সে ফিরতেই পারে। সে বাসেও উঠল না, পঞ্চাশ টাকা সে ফোনে রিচার্জ করে হাঁটতে আরম্ভ করল। সে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরবে, সময় লাগবে, লাগুক।

হাঁটতে হাঁটতে সে দুপাশে তাকাল, সামনে, কখনো ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনেও। কত কত আর কতরকম মানুষ। কেউ হাঁটছে, কেউ জটলায়, কেউ দোকানের সামনে বেঞ্চে, কেউ বাসের জন্য অপেক্ষায়, কেউ রিকশাচালকের সঙ্গে তর্কে। রাজিক যতদূর সম্ভব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাদের লক্ষ করল। হাসনাইন কাদির যা বলেছে, তা কি ঠিক?

রাজিকের মনে হলো, হ্যাঁ অনেকেই গোড়ালি চুলকাচ্ছে এদিক-ওদিক, দোকানের সামনে যারা বসে আছে তাদের অনেকের গোড়ালিতে হাত। এদের সবার কি তার মতো গোড়ালি বড় হয়ে যাচ্ছে? বড় হতে হতে এদের সবার শরীর কি গোড়ালির মতো হয়ে যাবে। রাজিক নিশ্চিত হয়ে বুঝতে পারল না। তার একবার মনে হলো, হ্যাঁ, ওরকমই মনে হচ্ছে। হ্যাঁ ওরকমই। আবার, তার কখনো এমনও মনে হলো, হাসনাইন কাদির তার সঙ্গে মজা করেছে, ইচ্ছা করে তাকে একটা বিভ্রমে ফেলেছে।

কিন্তু তাহলে তার নিজের গোড়ালি? গত রাতে সীমাকেও দেখেছে সে। হাসনাইন শামসের কথাও বলল, এমনকি তার নিজের কথা। আর এখন সে নিজেও দেখছে তার চারপাশে। কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারলে ভালো হতো – ভাই, আপনাকে কি একটা কথা জিজ্ঞাসা করা যাবে?

রাজিক ভাবল কিছুক্ষণ। কিন্তু কাউকে জিজ্ঞেস করার সাহস তার হলো না। তার বরং ভয় হয়েছে, কেউ যদি রেগে গিয়ে তাকে মারতে আসে – হালায় পাগল!

রাজিক কাউকে জিজ্ঞেস করার ইচ্ছা বাদ দিয়ে এগোতে লাগল। সে টের পেল, তার গোড়ালি আরো একটু বড় হয়েছে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত