আমি ছোট বেলা থেকেই খুব জেদি। আমার খাবারের মেন্যুতে সবসময় মুরগীর মাংস চাই ই চাই। কিন্তু প্রতিদিন তো মুরগীর মাংস রান্না করা সম্ভব না,মধ্যবিত্ত পরিবার বলে কথা। বাবা একটা প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। তাই তার শিক্ষাগুলোও খুব কড়া। বাবা কখনো অনিয়ম পছন্দ করেননা। সময়মত খাবার খেতে হবে, সময়মত ঘুমাতে হবে আরো কত নিয়ম! যেদিন মুরগীর মাংস রান্না হত না সেদিন আমি খাবার না খেয়েই উঠে যেতাম। মা কোথা থেকে যেন এক পিস মুরগীর মাংস এনে খাওয়াতেন। মায়ের মন তো মানে না। তবুও আমি মায়ের মন আর সংসারের অভাবটা বুঝতে চেষ্টা করিনি।
কিন্তু মা যে কোথা থেকে সেই এক পিস মুরগীর মাংস, দুই টুকরো আলু ঝোল সহ এনে দিতেন কখনোই জিজ্ঞেস করা হয়নি। বাবা জানতেন না যে মা আমাকে মুরগীর মাংস এনে খাওয়ান। আজ দুপুরে খাওয়ার সময় বাবা দেখে ফেলেন। রাগী মেজাজে বললেন,,”আমার ঘরে যেন এই কুলাঙ্গারকে আর না দেখি। অনেক মেনে নিয়েছি তার অত্যাচার আর মেনে নেওয়া হবে না এসব। এসব এই বাসায় অন্তত আমি বেঁচে থাকা পর্যন্ত চলবে না।” সেদিন কি ভেবে যেন আমিও খাবার ফেলে বেরিয়ে যাই। পেটে প্রচন্ড ক্ষিধে থাকা স্বত্তেও খাবার ফেলে চলে এসেছি। মা বারবার ডেকেছে কিন্তু ফিরে তাকাইনি,হয়ত বসে বসে কান্না করছে আমার জন্য।
বাবা হুংকার ছেড়ে বললেন,,”ওকে যেতে দেও হৃদয়ের মা। এক রাত বাহিরে থাকলেই বুঝবে ক্ষুধা কি জিনিস?” কাঠফাঁটা রোদে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় অকারণেই হেঁটে বেড়াচ্ছি। বিকেল পর্যন্ত কিছুই খাইনি। ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে টং দোকান থেকে এক কাপ চা আর দুইটা ক্রিম বন খেয়েছি। কিন্তু এতে কি আর ক্ষুধা মেটে? পকেটেও পর্যাপ্ত টাকা নেই যে এক প্লেট ভাত খেয়ে পেটের ক্ষুধা মেটাবো। পকেট হাতিয়ে দেখলাম দুইটাকার একটা আধছেঁড়া নোট পড়ে আছে। এই ব্যস্ত শহরে কেউ কারো নয়। কে খেল কে খেল না সেই খেয়াল কেউ রাখেনা। হঠাৎ ডাস্টবিনে চোখ গেল,এক বুড়ো লোক ময়লার ভেতর থেকে কি যেন হাতড়াচ্ছেন। অনেক হাতড়িয়ে মানুষের মুখের ফেলে যাওয়া অর্ধেক বার্গার খুব তৃপ্তিসহকারে খাচ্ছে। আমার চোখ থেকে কখন পানি বেয়ে পড়ল বুঝতেই পারিনি। মনে মনে ভাবছি আমি তো দিব্যি ভালো আছি রোজ ডাল ভাত খেতে পারছি আর এরা তো!!
তবুও মনের রাগটা কমল না। ফুটপাতে বসে রইলাম। ফোন বের করে দেখি মা ফোন দিয়েছেন কয়েকবার। ইচ্ছে করেই কল রিসিভ করলাম না। ফোন বন্ধ রেখে ফুটপাতের এক সাইডে বসে রইলাম। ঘড়িতে রাত নয়টা। ক্ষিধেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। আর রাতটাও যেন পার হতে চাইছেনা। পকেট থেকে ফোন অন করে ফেইসবুকিং করছি। এই দিকে যে রাতের অর্ধেক সময় পার হয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি। হঠাৎ দেখলাম একটা দশ বছর বয়সী ছেলে দুইটা রুটি আর আলু ভাজি নিয়ে এসেছে। খাবার দেখে আবারো ক্ষিধে পেয়ে গেল। ছেলেটা দেখছি আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। আমি যেখানে বসেছি তার একটু সামনেই এগিয়ে বসল। এরপর পলিথিনের ভেতর থেকেই রুটি দিয়ে আলুভাজি খেতে লাগল।
আমি একমনে তাকিয়ে আছি ছেলেটার খাওয়ার দিকে। ছেলেটা হয়ত কিছু বুঝতে পেরেছিল। সে আমার দিকে রুটি আর ভাজি এগিয়ে দিতেই আমি একপ্রকার সাপের মত ছোবল মেরে খাওয়া শুরু করলাম। দুইমিনিটেই আমার খাওয়া শেষ। রুটি আর ভাজি খাওয়ার পর নিজের মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করতে লাগল। আমি করুণ দৃষ্টিতে ছেলেটাকে বললাম,,”তুমি নিজে না খেয়ে আমাকে দিয়ে দিলে কেন? তোমার তো খুব ক্ষিধে পেয়েছিল। ছেলেটা ফুটপাতে সাদা প্লাস্টিকের বস্তা বিছাতে বিছাতে বলল,,”আমগো না খাইয়া অভ্যাস আছে। কত রাইত না খাইয়া থাকছি। আপনেরে দেইখা ভালা ঘরের পোলা মনে হইতাছে। এত রাইত পর্যন্ত ভালা মাইনষের পোলারা বাইরে থাহে না। আপনে বাসায় চইলা যান। আপনের আম্মা আপনের জন্য অপেক্ষা করতাছে।”
আমি একমনে এইটুকু বয়সী ছেলের কথাগুলো গোগ্রাসে গিলছিলাম। এত সুন্দর করে কিভাবে কথা বলতে পারে?
সে একটা পাতলা আধছেঁড়া কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল। আমার চোখেও প্রচুর ঘুম, কিন্তু এখন ঘুমাবো কোথায়? আর কিছু না ভেবে সেই ছেলের পাশেই শুয়ে পড়লাম। এই প্রথম রাত আমি বাহিরে তাও আবার ফুটপাতে কাটাচ্ছি। এখন আমি বাস্তবতা আর সমাজ উপলব্ধি করতে পারছি। সকালে একজন লোকের চিৎকারে ঘুম ভাঙ্গে। দেখে মনে হল এলাকার দারোয়ান। চোখ কচলে উঠে বসতেই দেখি ছেলেটা আমার পাশে নেই আর আমার গায়ে সেই আধছেঁড়া কাঁথা জড়ানো। ফোন বের করে দেখি আটটা বাজতে চলল।
তাই আর দেরি না করে বাসার দিকে পা বাড়ালাম জানি আজ খুব মার খেতে হবে। মনে একপ্রকার সাহস সঞ্চয় করে বাসায় ঢুকলাম। মা দরজার সামনেই মাথা ঠেকিয়ে বসে আছেন। চোখের দিকে তাকাতেই দেখি রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। মনে হয় সারারাত ঘুমায় নি। আমাকে দেখেই ছুটে এলেন, হাউমাউ করে কেঁদে বুক ভাসিয়েছেন। রুম থেকে বাবা বের হয়ে গম্ভীরমুখে বললেন,,”এক রাত বাহিরে থাকার পর ও যদি তোমার ছেলের বাস্তবতা মেনে নিতে কষ্ট হয় তাহলে তোমার ছেলেকে এক্ষুণি আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বল।”
বাবার চোখের ও একই অবস্থা, তার মানে বাবাও ঘুমায় নি। আমি দৌঁড়ে গিয়ে বাবার পা ধরে বললাম,”বাবা আমাকে মাফ করে দেও। আমি বুঝতে পেরেছি বাস্তবতা কি জিনিস। এই দুনিয়ার মানুষ খুব স্বার্থপর, কেউ কারো নয়।”
বাবা আমার কথা শুনে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। বাবাকে এর আগে কখনো কাঁদতে দেখিনি। বাবা চোখের পানি মুছে মাকে ডেকে বললেন,,”কই গো হৃদয়ের মা ছেলেকে খাবার দেও আমি স্কুলে গেলাম।”
মা গরম গরম ভাত, আলু ভর্তা আর ডাল নিয়ে এলেন। পেটে খুব ক্ষুধা থাকায় আর কিছু না ভেবেই খেতে বসে যাই। হঠাৎ দেখি মা কোথায় যেন যাচ্ছেন আমি ভাত খাওয়া রেখে মায়ের পিছু নিলাম। মা হেঁটে বাসার পাশের হোটেলটায় ঢুকলেন। আমি গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম মা কি করে? এরপর দেখি মা পলিথিনে করে কিছু আনছেন। তার আগেই আমি বাসায় ঢুকে যাই। খাবার টেবিলেই বসে অপেক্ষা করছি। এখন আর ভাত গলা দিয়ে নামছে না। মা এক বাটিতে করে এক পিস মুরগীর মাংস,দু’টুকরো আলুর ঝোলসহ আমার সামনে দিয়ে বললেন,”নে বাবা তাড়াতাড়ি খেয়ে নে। তোর বাবা বাসায় নেই।”
মুরগীর মাংস দেখে আর বুঝতে বাকি রইল না মা তাহলে দোকান থেকেই কিনে এনে আমাকে খাওয়ান। চোখ থেকে অনুশোচনার পানি পড়ছে টুপটুপ করে। আচমকাই বসা থেকে উঠে কাঁদতে কাঁদতে মাকে জড়িয়ে ধরি। হাউমাউ করে কেঁদেই যাচ্ছি । মা তুমি এত স্বার্থপর পর কেন? নিজে না খেয়ে আমাকে খাওয়াও, তবুও তোমাকে বুঝিনি, তোমার কষ্ট বুঝিনি। আমাকে ক্ষমা করে দেও মা। মায়ের চোখেও পানি, মৃদু কাঁপা কন্ঠে বললেন,,”আরে পাগল কাঁদতে হবেনা আর তুই ছাড়া কে আছে আমার বল? তোকে খাওয়াব না তো কাকে খাওয়াবো?” হঠাৎ কাল রাতের ফুটপাতে কথা বলা ছেলেটার কথা মনে পড়ল। মাকে ছাড়িয়ে নিয়ে দৌঁড়ে ফুটপাতের কাছে যাই। অনেক খুঁজে ছেলেটাকে কাগজ কুড়ানো অবস্থায় দেখতে পাই। ছেলেটাকে কিছু না বলেই এক প্রকার টেনে হিঁচড়ে আমাদের বাসায় নিয়ে আসি।
মা আমার সাথে ছেলেটাকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। আর সেও আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি ছেলেটাকে টেবিলে বসিয়ে মুরগীর মাংস আর ডাল দিয়ে ভাত দিলাম। ছেলেটা তৃপ্তিসহকারে খাচ্ছে আর তা দেখে আমি তৃপ্তি পাচ্ছি। এই প্রথম কোন ভালো কাজ করলাম। মাকে সবটা বুঝিয়ে বলার পর আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,,”আমার ছেলে বড় হোক। একটা এতিমখানা যেন তুই তৈরী করতে পারিস।” ছেলেটা খাওয়া শেষে মুখে একগাল হাসি নিয়ে চলে গেল। আর আমি ওর চলে যাওয়ার পথের তাকিয়ে আছি।
গল্পের বিষয়:
গল্প