চলো পাল্টাই

চলো পাল্টাই
বিয়ের পর আজ প্রথম নিজ হাতে রান্না করে তা ডাইনিংয়ে পরিবেশন করলাম। বুকের ভেতরটা কেমন যেনো ধুকধুক করছে। মনে মনে আল্লাহকে ডাকছি খাবার খেয়ে সবাই যেনো তৃপ্তি পায়। কিছুক্ষণ পরই বাবা-মা আসলেন। আসলো ননদ, দেবরও। সবাই আসন গ্রহণ করেছে। মা জানতে চাইলেন,
– রিয়াদকে দেখছিনা যে। কোথায় ও? বললাম,
– রুমেই হয়তো আছে। বসুন আমি দেখছি। এই বলে রুমের দিকে পা বাড়াতে যাবো এমন সময় ও চলে আসলো। তাঁকে দেখে মা বলে উঠলেন,
– আয় বাবা! তোর কথাই বউমাকে জিজ্ঞেস করছিলাম। খেতে বস। ও টেবিলের উপর চোখ বুলিয়ে নিলো একবার। বললো,
– বাহ! আজ তো দেখছি আমার সব প্রিয় খাবারগুলো টেবিল দখল করে আছে। তানহা, তুমি তো দেখছি সবকিছু প্রথম দিনেই রান্না করে ফেলেছো। বসো তাহলে শুরু করা যাক। দেখি তোমার হাতে কেমন জাদু আছে।
আমি বসতে চাইলাম না। খাবারের মাঝখানে কখন কার কিসের প্রয়োজন হয় কে জানে। তখন না আবার উঠতে হয়। এবার মায়ের কথায় বসতে বাধ্য হলাম। সবাই ‘বিসমিল্লাহি ওয়া আলা বারাকাতিল্লাহ্’ বলে খাওয়া শুরু করলো! হ্যা, এটা খাবারের আগের দোয়া। এটি পড়া সুন্নত। এসবের প্রচলন মুসলিম পরিবারগুলোয় এখন আর তেমন দেখা যায়না। দূরের কথা আর কি বলবো, আমি নিজেও বিয়ের আগে এই অভ্যাসে অভ্যস্ত ছিলাম না। এখানে এসে দেখলাম এঁরা সবাই খাওয়ার আগে ও পরের দোয়া নিয়মিত পড়েন। খেতেও বসেন সবাই একসাথে। কাজের মেয়েটি গত সন্ধায় বলে গিয়েছিলো আজ আসবেনা। আর সেই সুযোগেই আজ মায়ের পারমিশন নিয়ে কিচেনে ঢুকে গেলাম আমি।
সবাই এতক্ষণে দু-তিন লোকমা খাবার খেয়ে নিয়েছেন। কিন্তু কেউই খাবার কেমন হলো না হলো তা নিয়ে মুখ খুললো না। এদিকে আমার টেনশন বেড়েই যাচ্ছিলো। ঘামতে লাগলাম আমি। নাকের ডগায় মুক্তোর দানার মতো ঘাম জড়ো হতে লাগলো। মনে হচ্ছিলো নাকের ডগাটা গোল চত্বর আর সেখানে সমাবেশ ডেকেছে ঘামেরা! উফ! মানুষগুলো কি। এখনো কেনো কেউ কিছু বলছেনা। খাবারে আমার মনযোগ নেই। অপেক্ষা করছি কে কখন খাবার নিয়ে মুখ খুলে। এমন সময় নিরবতা ভেঙে দিয়ে বাবা জিজ্ঞেস করলেন,
– বউমা, তুমি কার কাছ থেকে রান্না শিখেছো?
– মায়ের কাছ থেকে। কেনো বাবা, রান্না কি ভালো হয়নি? আমার প্রশ্নে বাবা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন,
– সেটা না হয় তোমার মায়ের কাছ থেকেই জেনে নাও। বলো রেহানা বউমার রান্না কেমন হয়েছে।
– বলবো?
– হ্যা বলো।
– আমারো মনে হচ্ছে বেয়াইনের কাছ থেকে গিয়ে শেফের ট্রেনিং নিয়ে আসি।
দারুণ রেঁধেছো মা। তোমার হাতের রান্না খেয়ে আমার তো রীতিমতো হিংসে হচ্ছে। এবার তো তোমার দায়িত্ব বেড়ে যাবে। এঁরা আর আমার হাতের রান্না খেতে চাইবে না। তোমাকেই রান্না করতে হবে। মায়ের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে রিয়া বলে উঠলো,
– আমি এতোসব বুঝিনা। আমাকে সবধরনের রান্না করা শেখাতে হবে ভাবী। আমিও আপনার মতো রান্না করতে চাই।রিয়ার মুখে এমন কথা শুনে বাবা বললেন,
– হুম, অবশ্যই শিখবে। কিন্ত তার আগে পরীক্ষাটা ভালো করে দাও। তারপর যা খুশি শেখো। বাবাকে থামিয়ে দিয়ে এবার মা বললেন,
– তুমি আর কথা বলো না তো। তোমার মেয়েকে আমি শত চেষ্টা করেও কিচেনে ঢোকাতে পারিনি। আমি কি আর কম চেষ্টা করেছি ওকে রান্না করা শেখাতে। আজ বউমার কাছ থেকে রান্না শিখবে বলে রাজি হয়েছে। এতে পড়ার কোন ক্ষতি হবেনা। ‘যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে’ বুঝলে। পরীক্ষার পরপরই তো এদিক-ওদিক থেকে বিয়ের সম্বন্ধ আসা শুরু হবে। বিয়ের আগে মেয়েকে সবকিছু শিখিয়ে তৈরি করে তুলতে হবে। আর সেটা করবে আমাদের বউমা।
আমার স্বামী কোন কথা বলছিলো না। ও নিরবে খেয়েই যাচ্ছিলো। সামনে থাকা বুনা খাসির গোশতের বাটিটা ইতোমধ্যে খালি করে ফেলেছে ও। নজর দিইনি। তবে আত্মাটা শীতল হয়ে গেলো আমার। আমি পেরেছি। মনের অজান্তেই রবের প্রশংসায় বলে উঠলাম আলহামদুলিল্লাহ্।
কজন মেয়েই বা এমন একটা গোছানো সংসার পায়। বাবা পেনশনের টাকায় বাসা করে ব্যবসা দিয়েছেন। সেটা সামলানোর দায়িত্ব এখন আমার স্বামীর উপর। ননদ আর দেবর পড়াশোনা করছে। এমন খুব কমই পাওয়া যাবে যে বউ-শাশুড়ির মধ্যে ঝামেলা হয়না, অশান্তি হয়না। কিন্ত বউ-শাশুড়ির মাঝে চিরচেনা ঝগড়া, মনমালিন্যতা ইত্যাদি এসব যে হতেই হবে সেটা কি কোন সংস্কৃতি? সমাজের পরিস্থিতি তো বলে এটাও এখন একটা সংস্কৃতি তবে সুস্থ নয় অপসংস্কৃতি। এর নির্মূল প্রয়োজন। আর সেটা হবে আমার শাশুড়ির মতো শাশুড়িদের হাত ধরেই। রুমে বসে আছি এমন সময় দরজায় কেউ নক করলো। সাথে মায়ের কণ্ঠে ভেসে আসলো,
– বউমা আসবো?
– জ্বী আসুন মা। দরজা ঠেলে ভেতরে আসতেই আমি উঠে দাঁড়ালাম। বললেন,
– রেডি হয়ে নাও। আমরা একটা বিয়ের দাওয়াতে যাচ্ছি। আর রিয়াদ বাইক নিয়ে আমাদের সাথে পথে মিলিত হবে।
– আচ্ছা মা রেডি হচ্ছি।
– আর শোন, সেদিন যে নীল থ্রি-পিসটা এনেছিলাম সেটা পরো। তারপর উপরে বোরকা পরে নিও। সিএনজি কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে। একটু তাড়াতাড়ি করো কেমন!
– জ্বী ঠিক আছে।
মা চলে গেলেন। আমিও ঝটপট তৈরি হয়ে গেলাম। তৈরি হয়ে বসে আছি এমন সময় ও ফোন দিলো। রিসিভ করলাম। ওপাশ থেকে,
– আসসালামু আলাইকুম মহারানী। তৈরি হয়েছো?
– ওয়ালাইকুমুসসালাম। হ্যা, বসে আছি মায়ের জন্য। সিএনজি দিয়ে নাকি যাবো আমরা?
– হুম। তবে অন্যরা সিএনজি দিয়ে যাবে। তুমি নও।
– তাহলে আমি কি করে যাবো?
– তোমাকে পঙ্খী রাজ ঘোড়ায় চড়িয়ে নিয়ে যেতে রাজকুমার আসছে তো। একটু অপেক্ষা করো।
– তাই! কিন্ত মা যে বললেন তুমি আমাদের সাথে পথে মিলিত হবে।
– মাকে ইতোমধ্যে ফোন করে বলে দিয়েছি আমি। ভেবোনা। বোরকা কোনটা পরেছো?
– কালোটা।
– ওহ আচ্ছা। আমি তাহলে এখন রাখছি। এক্ষুনি দোকান বন্ধ করে রওয়ানা হবো। মায়েরা যদি বেরিয়ে যান তাহলে মূল গেটে তালা দিয়ে রেখো। সব দরজা লাগিয়ে রুমে বসে থেকো। বেরোবে না একদম।
– জো হুকুম জাঁহাপনা। মায়েরা চলে গেলেন। গেট লাগিয়ে দরজা লাগাতে যাবো এমন সময় বাইকের হর্ণ কানে ভেসে আসলো। চলে এসেছে ও। ডাকলো বাইরে থেকে। গেট খুলে দিলাম। বললো,
– দু’মিনিট সময় দাও চেঞ্জ করে নিই।
– হুম। কি পরে যাবে?
– বলো কি পরে গেলে তোমার ভালো লাগবে?
– নীল পাঞ্জাবি আছে না একটা, ওটা পরো। তোমাকে বেশ মানায় সেটা।
– তাই?
– হুম।
ও তৈরি হতেই সবকিছুতে তালা দিয়ে বাইরে চলে এলাম আমরা। বাইকের পেছনে উঠে বসলাম। মাথায় পরে নিলাম হেলমেট। ও বললো,
– বসেছো?
– হুম বসেছি।
– বোরকাটা দেখো তো বাইকের চাকার উপর ঝুলে পড়ে আছে কিনা? দেখলাম একটা অংশ ঝুলে পড়েছিলো। টেনে সেটা তুলে নিলাম। বললো,
– শুধু এখন নয়, ভবিষ্যতেও যখন বাইকে বা রিকশায়, সিএনজি ইত্যাদি ধরনের গাড়িতে চড়ো তখন দেখে নিও নিজের পরিধেয় বস্ত্রের কোন অংশ এদিক-সেদিক ঝুলে আছে কিনা। কথাটা যেনো মনে থাকে।
– হুম মনে থাকবে। আমি ওর কাঁধে হাত রাখলাম এবার। বাইকটা চলতে লাগলো গন্তব্যের দিকে। ওর পেছনে বসে মনে হচ্ছিলো সত্যিই যেনো ও রাজকুমার আর আমি রাজকুমারী। দুজনে পঙ্খী রাজ ঘোড়ায় আরোহন করে চলেছি।
প্রায় আধঘন্টা পর এসে আমরা বিয়ে বাড়িতে পৌঁছুলাম। আসতে আসতে জানতে পারলাম যে মেয়ের বিয়ে হচ্ছে তার বাবা আমার শশুরের সাথে একই ক্যাম্পে বহুদিন ছিলেন এবং সেখান থেকেই দুজন একসাথে অবসরে আসেন। আমাকে নামিয়ে দিয়ে ও বাইকটা পার্কিং এড়িয়ায় রেখে আসতে গেলো এমন সময় বাড়ির পেছন দিক থেকে হট্টগোলের আওয়াজ ভেসে আসতে থাকে। হট্টগোল এতই বেশি ছিলো যে বিয়ে বাড়িতেও এর প্রভাব পড়ে এবং চারিদিকে হইচই শুরু হয়ে যায়। আমাকে বাড়ির ভেতরে মায়ের কাছে রেখে ও বেরিয়ে যায়। উনারাও সবেমাত্রই এসে পৌঁছেছেন। আমরা কিছুটা পরে আর ধীরেসুস্থে আসায় কাছাকাছি সময়েই সবাই পৌঁছুলাম এসে। বাড়ির প্রায় সব পুরুষরাই চলে গেলো ঐ বাড়িতে। আমরা চিৎকার চেচামেচি শুনতে পেলেও ঘরেই অবস্থান করলাম।
মিনিট পাঁচেক পর ও কল দিলো। রিসিভ করলাম। ওপাশ থেকে,
– যা বলছি শোন। মা আর রিয়াকে বলবে একদম যেনো ঘর থেকে বের না হয়। তুমিও না। এখানে এক গৃহবধূর ঝুলন্ত লাশ পাওয়া গেছে। শশুর-শাশুড়ি পলাতক। পাশের ঘরের লোকজন যতক্ষণে সবকিছু টের পায় ততক্ষণে তারা লাপাত্তা। এক্ষুণি হয়তো পুলিশও চলে আসবে। আমি না আসা অবদি ঘরেই থেকো।
এই বলে ও লাইনটা কেটে দিলো। মাকে সব খুলে বললাম আমি। ততক্ষণে বিয়ে বাড়িতে আসা প্রায় সব মহিলারাই বিষয়টি সম্বন্ধে অবগত হয়ে গেছেন। ঐ বাড়ি আর এ বাড়ির মাঝে প্রথমে একটি ছোট্ট দেয়াল আর তারপরই একটি পুকুর রয়েছে। জানালা দিয়ে দেখলাম সেগুলো। ঘন্টা খানেক পরে ওরা ফিরে আসলে যা জানতে পারলাম তাতে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেলো। ঐ গৃহবধূর উপর নাকি তার শশুর বাড়ির লোকেরা প্রায়সই অত্যাচার করতো।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পুলিশের প্রাথমিক ধারণা হলো গৃহবধূটিকে মেরে তারপর গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে দেয়া হয় আত্মহত্যা বলে জেনো চালিয়ে দেয়া যায়। কিন্ত পরক্ষণেই ওরা ঘাবড়ে গিয়ে পালিয়ে যেয়ে থাকতে পারে এমনটিই পুলিশ মনে করছে। মানুষ কতো নিষ্টুর হলে একটি মেয়ের সাথে এমনটি করতে পারে ভাবা যায়। সব শাশুড়ীরা কেনো তাদের পুত্রবধূদেরকে নিজের মেয়ের মতো করে দেখতে পারেনা। কেনো তারা মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন আর সবকিছু ফেলে চলে আসা একটি মেয়ের উপর এভাবে ক্ষুদার্ত নেকড়ের মতো ঝাপিয়ে পড়ে। মানুষ কিভাবে পারে এসব।
নিজের মেয়ের বিয়ের দিনে পাশের বাড়িতে এমন একটি লোমহর্ষক ঘটনা ঘটে যাওয়ায় স্বভাবতই রাজিব সাহেব ভেঙে পড়েন। তিনি শঙ্কায় পড়ে যান, তাঁর মেয়ের সাথেও যদি এমনকিছু ঘটে! বিয়ে বাড়ির আনন্দ সব মাটি হয়ে যায়। সন্ধায় বাইকের পেছনে বসে যখন বাড়ি ফিরছিলাম তখন ভাবছিলাম, ‘আমিও এক গৃহবধূ আর যে মেয়েটিকে মেরে ফেলা হলো সেও গৃহবধূই ছিলো। তাঁর শশুর শাশুড়ি তাঁকে মেরে ঝুলিয়ে রেখে পালিয়েছে। আর আমার শশুর শাশুড়ি আমাকে তাঁদের মেয়ের মতো করে বুকে টেনে নিয়েছেন। পৃথিবীর সকল শশুর শাশুড়িরা কেন আমার শশুর শাশুড়ির মতো হয়না।
কেনো শশুর শাশুড়িরা অত্যাচারী হবে। কেনো তারা খুনি হবে। কেন একটি মেয়েকে বধূ সাজে সেজে কান্নায় ভেঙে পড়তে হবে এটা ভেবে যে, হায় আল্লাহ্, আমি তো আমার বাবা-মা আর ভালোবাসার সকল বাঁধন ছেড়ে চলে যাচ্ছি। সেখানে আমার জন্য বেহেশতী সুখ নাকি জাহান্নামের আজাব অপেক্ষা করছে কে জানে! কেনো এমনটি হবে, হয়, হচ্ছে আর কেনোই বা এই ধারা অব্যাহত থাকতে হবে। এর কি শেষ নেই। এর শেষ হোক। সমাজ পাল্টে যাক। শুরু হোক আপনার আমার থেকেই। আসুন পাল্টে দিই সমাজটাকে। চলো পাল্টাই।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত