দশ বছর পর নিজেকে কোথায় দেখতে পান আপনি? – এরকম একটা প্রশ্ন করা হয়েছিল আমাকে, ইন্টারভিউ বোর্ডে, অনেক বছর আগে। আমি তখন তরুণ ছিলাম, প্রথমবারের মতো চাকরির চেষ্টা করতে গিয়ে মুখোমুখি হয়েছিলাম সেই ইন্টারভিউ বোর্ডের। সেখানে যারা ছিলেন সবাই মিলে যেন পণ করেছিলেন – কোনো অবস্থাতেই হাসবেন না। গম্ভীর-ভীতিকর সেই পরিবেশে প্রশ্নটি ছিল আমার কাছে একেবারেই নতুন এবং ভড়কে দেওয়ার মতো। আমি অবশ্য ভড়কে যাইনি। সেই দৃপ্ত যৌবনকালে আমি ছিলাম বেপরোয়া, কিছুতেই কিছু যেত-আসত না, চাকরি হলে হবে না হলে নাই – এরকম একটা ড্যাম কেয়ার ভাবও ছিল। বারবার ব্যর্থ হয়ে নিজের ওপর যে-অনাস্থা জন্মায়, আত্মবিশ্বাস তলানিতে গিয়ে ঠেকে, আমার সেসব সমস্যাও ছিল না – ওটা ছিল আমার প্রথম চাকরি-প্রচেষ্টা, সে তো আগেই বলেছি। তবু প্রশ্নটি নিয়ে আমি মিনিট-খানেক ভাবলাম। ইন্টারভিউ বোর্ডে প্রার্থীর এক মিনিটের নীরবতা আসলে এক ঘণ্টার সমান, তবু তারা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করলেন। নিজেকে দশ বছর পর কোথায় দেখতে পাই সে-কথা ভাবা তো দূরের কথা, কোথায় দেখতে চাই সে-কথাও ভাবিনি কোনোদিন; এত সহজে কি এ-প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায়? যিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন তার সম্বন্ধে আমার কিছুই জানা ছিল না, এমনকি বয়সটাও আন্দাজ করতে পারছিলাম না, চল্লিশোর্ধ্ব তো হবেনই, তবু একটু ভেবে সাহস করে বলে ফেলেছিলাম – আপনার জায়গায় দেখতে পাচ্ছি, স্যার।
ভদ্রলোক মৃদু হেসেছিলেন। সেই হাসির অর্থ বোঝার সাধ্য আমার ছিল না। সত্যি বলতে কি আমি কোনোদিনই কারো মৃদু-রহস্যময় হাসির অর্থ বুঝতে পারিনি। অবশ্য তার হাসিটি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, অচিরেই স্বমহিমায় ফিরে গিয়ে, যথাযথ গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলেছিলেন – আমার কিন্তু এখানে আসতে পনেরো বছর সময় লেগেছে!
আমি সেই পথ দশ বছরেই পার হতে পারব বলে মনে করি স্যার।
কনফিডেন্ট?
জি।
গুড, আপনি আসতে পারেন।
আমি ধরেই নিয়েছিলাম, চাকরিটা হবে না। ওই প্রশ্নটা করার আগে কেবল দু-চারটে সৌজন্যমূলক কথা-বিনিময় হয়েছে, আমার কাগজপত্রগুলো নেড়েচেড়ে দেখা হয়েছে, তারপর ওই অতটুকু কথোপকথন। ইন্টারভিউ এত সংক্ষিপ্ত হয় নাকি? কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে সপ্তাহখানেক পর নিয়োগপত্র এলো আমার ঠিকানায়। আনন্দিত হয়েছিলাম, বিস্মিতও। এত সহজে, প্রথম চেষ্টাতেই, চাকরি হয়ে যাবে কেইবা তা আশা করে? হয়তো সেই আনন্দেই নিজের সামর্থ্যের সর্বোচ্চটুকু ঢেলে কাজ করছিলাম। চাকরিতে যোগ দিয়ে জেনেছিলাম, সেই প্রশ্নকারী ভদ্রলোক আমাদের এজিএম। দশ বছর পর নিজেকে সত্যিই দেখেছিলাম ওই পদে, বিস্ময়করভাবে।
আর এখন? পাঁচ বছর পর, এমনকি দু-বছর পরও, কল্পনায় নিজেকে কোথাও দেখতে পাই না। ঘাতক-ব্যাধি বাসা বেঁধেছে শরীরে, কিডনি অচল হয়ে পড়ছে ক্রমশ। ব্যাপারটা ধরা পড়েছে বছরখানেক হলো। এ-রোগের কোনো চিকিৎসা নেই, ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে হবে। কতদিন পর আসবে সেই মৃত্যু, তাও বলা যায় না। দু-বছর, পাঁচ বছর, দশ বছর বা বিশ বছরও লাগতে পারে। মৃত্যু তো আসবেই, সবার জীবনেই আসবে, কিন্তু এরকম ঘোষণা দিয়ে আসাটা বেশ অমানবিক, এরকম অনিশ্চিত অপেক্ষায় রাখা আরো অমানবিক। কাউকে বলিনি, একাই বয়ে বেড়াচ্ছি এই দুঃসহ দুঃসংবাদের ভার। হয়তো একা বইছি বলেই এত ভারী লাগে, এত হাহাকার জেগে ওঠে জীবনের জন্য। দুটো সন্তান আমার আর তাদের মমতাময়ী মা, ওদের মুখের দিকে তাকাতে পারি না। মনে হয়, আমি চলে গেলে ওরা বাঁচবে কী করে? অবশ্যই সবাই বাঁচে, আমি যেমন বেঁচে আছি আমার মা-বাবা চলে যাওয়ার পরও, তবু কষ্ট হয়, বুক ভেঙে আসে। ছেলেমেয়েরা যখন তাদের ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করে – কোথায় বেড়াতে যাবে, বড় হয়ে কী পড়বে, কী হবে, ওদের মা যখন দুষ্টুমি করে একগাদা নাতি-নাতনির জন্য আবদার জানায় ওদের কাছে, আর ওরা লজ্জায় লাল হয়ে বলে ওঠে – ধুর মা, তুমি যে কী, কোন কথার মধ্যে কোন কথা নিয়ে এলে; তখন আমি নিজেকে কোথাও দেখতে পাই না। এসব যখন ঘটবে, কিংবা অন্য কিছু, তখন কি আমি থাকব? আমার ছেলেমেয়ে দুটো বড় হবে, ভালো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করবে, হয়তো বিদেশে যাবে উচ্চতর শিক্ষা বা গবেষণার জন্য, কিংবা দেশেই থাকবে উচ্চতর পেশাগত অবস্থানে; শুধু পদ-পদবিতে নয়, মানুষ হিসেবেও হয়ে উঠবে অনেক বড়; পীড়িত-দুর্গত মানুষের দিকে বাড়িয়ে দেবে সহযোগিতার হাত, ওদের দৃপ্ত হাত ধরে উঠে দাঁড়াবে অনেক অসহায় মানুষ; ওদের বিয়ে হবে, বাচ্চাকাচ্চা হবে, শিশুদের কলরোলে ভরে উঠবে আমাদের ঘরদোর; আরো কত কি হবে – আমি কি তখন থাকব?
দুই
ছোটবেলায় একবার হারিয়ে যাওয়ার ঝোঁক চেপেছিল মাথায়। কোনো কারণ ছাড়াই। কিংবা কারণ হয়তো ছিল কিছু একটা, এখন আর মনে পড়ে না। সেই ঝোঁক এমন বিপজ্জনকভাবে বাড়তে লাগল যে, পালানোর নানা ফন্দি-ফিকির করতে লাগলাম। পালানোর জন্যও যে খানিকটা প্রস্তুতি লাগে তা বোঝার মতো বুদ্ধি আমার হয়েছিল। ছোট হলেও ততটা ছোট তো আর ছিলাম না! স্কুলে পড়ি তখন, ক্লাস নাইনে; ওই বয়সে ঠিক হারিয়ে যাওয়া যায় না, বড়জোর পালিয়ে থাকা যায়; পালালেও যে ফিরে আসতে পারব সে-কথাও জানা ছিল।
প্রস্তুতি চলল ধীরে ধীরে। সে-সময় সবার হাতে এত টাকা ছিল না, মা-বাবার হাতে তো নয়ই। স্কুলে যেতাম বাসে চড়ে, টিফিনের পয়সা মিলত হিসাব করে। বাবা সরকারি চাকরি করতেন, কলোনিতে বাসাও পেয়েছিলেন। তিন রুমের সেই বাসায় দাদা-দাদি, মা-বাবা আর আমরা চার ভাইবোন মিলে মহাআনন্দে ছিলাম। আমরা কখনো আলাদ রুমে থাকার কথা ভাবিনি, প্রাইভেসি নিয়ে ভাবিনি। ড্রয়িংরুম বলতে কিছু ছিল না, যেখানে ড্রয়িংরুম হওয়ার কথা সেখানে
অল্প-দামি কিছু সোফার সঙ্গে একটা খাটও ছিল, বাবা ঘুমাতেন সেখানেই। মা-র সঙ্গে ঘুমাত বোনটা আর আমরা তিন ভাই এক রুমে। একজন আমার বড়, একজন ছোট। একজন সৎ চাকরিজীবীর পক্ষে এরকম একটা পরিবারের ব্যয় বহন করে ছেলেমেয়েদের খুব বেশি টিফিনের পয়সা দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না। যৎসামান্য যা পেতাম সেখান থেকেই একটু একটু করে বাঁচিয়ে, কখনোবা মা-র ব্যাগ থেকে দু-পাঁচ টাকা চুরি করে ঘর ছাড়ার মতো একটা পরিমাণ দাঁড়িয়ে গেল বেশ অনেক দিনের চেষ্টার পর। কিন্তু শুধু টাকা হলেই কি পালানো যায়? দু-একটা জামা-কাপড়ও তো দরকার! এককাপড়ে কদিনইবা থাকা যাবে? সেজন্যও বেশ কায়দা-কানুন করতে হলো। খুব গোপনে, মা যেন কিছুতেই টের না পায় এমনভাবে, একটা একটা করে কাপড় গোছাতে লাগলাম বাসার এক গোপন কোণে। তারপর একদিন সকালে স্কুলের ব্যাগ থেকে সমসত্ম বই-খাতা সরিয়ে কাপড়গুলো ভরলাম, একটা খাতা আর একটা কলমও নিলাম সঙ্গে – যা কিছু দেখব সব লিখে রাখব বলে, স্কুল ড্রেস পরে সুবোধ বালকের মতো নাস্তা করে দাদা-দাদি আর মা-র কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বাবা আগেই অফিসে চলে গেছেন, ভাইবোনরাও
স্কুল-কলেজে। আমিও প্রতিদিন ওদের সঙ্গেই বেরোই, যদিও একই স্কুল নয়, আজ ইচ্ছা করেই একটু দেরি করেছি। কেউ তো আর জানে না, আমার মনে কী আছে!
বাসা থেকে বেরিয়ে সোজা চলে গেলাম কমলাপুর রেলস্টেশনে। কোনো একটা ট্রেন ধরতে হবে। হারিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট কোনো ট্রেনে ওঠার দরকার নেই, একটাতে উঠলেই হলো। গিয়ে দেখলাম একটা ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। টিকিট-চেকার টিকিট দেখে দেখে উঠতে দিচ্ছে, আমার তো টিকিট নেই, দেখাব কী করে? সুযোগের অপেক্ষায় রইলাম এবং একসময় একদল যাত্রীর সঙ্গে টুক করে উঠে পড়লাম একটা বগিতে। রেলস্টেশন বা ট্রেনে ওঠার ব্যাপারগুলো আমার কাছে নতুন নয়। প্রতিবছরই দু-তিনবার করে বাড়িতে যাই সবাই মিলে, ট্রেনে চড়েই। তো, উঠে দেখলাম আসনগুলো তখনো ফাঁকা, যাত্রীরা সবাই এসে পৌঁছেনি হয়তো। দেখেটেখে জানালার পাশে একটা খালি আসনে বসে পড়লাম। বসেই মনে হলো, আমার পরনে স্কুল ড্রেস, যে-কেউ হয়তো আমার পালানোর ব্যাপারটা ধরে ফেলবে। তাড়াতাড়ি টয়লেটে গিয়ে স্কুলের শার্টটা খুলে ব্যাগ থেকে আরেকটা শার্ট বের করে পরে নিলাম। প্যান্ট না বদলালেও চলবে, ওটাতে তো আর স্কুলের নাম লেখা থাকে না, অহরহই মানুষ নীলরঙের প্যান্ট পরছে। পরছে সাদা রঙের শার্টও, সমস্যা হচ্ছে ওই কম্বিনেশন, আর শার্টের পকেটের ওপর স্কুলের মনোগ্রাম এবং নামটা। ফিরে এসে দেখলাম, সেই আসনে আরেকজন লোক বসে আছে। থাকবেই তো! কার না কার সিটে বসেছিলাম! তবে তখনো অনেকগুলো আসনই ফাঁকা, তারই একটাতে গিয়ে বসলাম আবার। টিকিটের মালিক এলে ছেড়ে দিতে হবে জানি, অন্তত কিছুক্ষণ তো বসি! একজন-দুজন করে যাত্রী ওঠে আর আমার বুকের ভেতরে ধক করে ওঠে, এই বুঝি এসে বলবে – ‘এই সিটে বসেছ কেন? ওঠে।’ শেষ পর্যন্ত অবশ্য তেমন কিছু ঘটল না। বেশকিছু ফাঁকা সিট নিয়েই ট্রেন ছেড়ে দিলো। আহ্! আমি তাহলে সত্যিই পালিয়ে যেতে পারছি! ট্রেনের গতি বাড়ছে ধীরে ধীরে, আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছি। মাকে মনে পড়ছে, বাবাকে মনে পড়ছে, দাদা-দাদিকে মনে পড়ছে, ভাইবোনদের মনে পড়ছে আর বুকের ভেতরটা কেমন যেন হুহু করে উঠছে। আমি হয়তো আর ফিরবই না কোনোদিন, হয়তো আর কোনোদিন দেখাই হবে না কারো সঙ্গে। খুঁজতে খুঁজতে একদিন সবাই হাল ছেড়ে দেবে, তারপর একসময় ভুলেই যাবে যে আমিও ছিলাম। সত্যিই ভুলে যাবে? নাহ্, তাই কি আর হয়? মা-বাবা কি ভুলে যেতে পারে তাদের সন্তানকে? দাদা-দাদি তাদের নাতি-নাতনিকে? ভাইবোনরা কি ভুলতে পারে তাদের ভাইকে? আমাদের একটা ছোট্ট বোন ছিল, অসুখে ভুগে মারা গেছে বছরকয়েক হলো। এখনো তার কথা ভেবে মা-বাবা কাঁদেন, দাদা-দাদি কাঁদেন, ভাইবোনদের চোখের কোণও ভিজে ওঠে। আমরা কেউই তার কথা বলি না, যেন এই নামে কেউ ছিল না কখনো, তবু সবার ভেতরেই ও আছে। আমিও হয়তো তেমন করেই রয়ে যাব।
এসব ভাবতে ভাবতে কখন এয়ারপোর্ট স্টেশনে ট্রেন থেমেছে বুঝতে পারিনি। এখান থেকেও বেশকিছু যাত্রী উঠল, আসন খুঁজে খুঁজে যে-যার মতো বসে পড়ল, আমি যথারীতি টেনশনে ঘেমে উঠলাম, কিন্তু কী আশ্চর্য, কেউ এসে বলল না – এই ওঠো, এটা আমার সিট! ট্রেন ছাড়ল আবার। আমি যে শেষ পর্যন্ত বসেই যেতে পারছি সেই আনন্দেই বিভোর রইলাম কিছুক্ষণ। টিকিট-চেকার এলে বিপদে পড়ব, সে-কথাও ভাবছিলাম অবশ্য। কিন্তু চিন্তাটা উড়ে গেল সামনের দিকে তাকিয়ে। আমার মুখোমুখি কয়েক সারি সামনে বসেছে একটা মেয়ে। আমার চেয়ে বয়সে বড় হবে নিশ্চিত, তবে খুব বেশি বড় নয় বলেই মনে হলো। শাড়ি পরা, কোলে একটা শিশু, পাশে একজন লোক। এমন অনিন্দ্যসুন্দর মুখ আমি এর আগে কখনো দেখিনি। সত্যি বলতে কি, পরেও কখনো দেখিনি। আমি অপলক চেয়ে রইলাম তার দিকে। মানুষ এত সুন্দর হয়? কীভাবে? কেন? শিশু-কোলে তাকে লাগছিল রাজ-রাজেন্দ্রাণীর মতো। মনে হচ্ছিল, তার জন্ম এই পৃথিবীতে নয়, অন্য কোনো গ্রহে। এসব ভাবছিলাম তার দিকে তাকিয়ে। সে কি দেখেছিল আমাকে? হয়তো। কয়েকবার চোখাচোখি তো হলো, মিষ্টি করে হাসলও কয়েকবার। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, এই মেয়েটি যেখানে নামবে, আমিও সেখানেই নামব। কোথায় থাকে সে, চিনে নেব। বড় হয়ে আবার আসব তাকে দেখতে।
কিন্তু টিকিট-চেকারের আগমনে এতসব মধুর ভাবনা মাটি হয়ে গেল মুহূর্তেই। তাকে ঢুকতে দেখেই আমি চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান ধরে মটকা মেরে পড়ে রইলাম। সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়ব, ভাবিনি। ঘটল সেটাই। যখন ঘুম ভাঙল তখনো ট্রেন ছুটে চলেছে, কিন্তু সেই মেয়েটি আর নেই। তার পাশের লোকটিও নেই। হয়তো কোনো স্টেশনে নেমে গেছে! মন খারাপ হয়ে গেল আমার, পরের স্টেশনে কিছু না ভেবেই নেমে পড়লাম। আমার তো কোনো গন্তব্য নেই, এক স্টেশনে নামলেই হলো। কোথায় নেমেছিলাম তা এখন আর মনে পড়ে না, তবে খুব বড় কোনো স্টেশন ছিল না সেটি। টিপিক্যাল মফস্বলি স্টেশন। ট্রেন এলে সেখানে একটু আলোড়ন পড়ে, বাকি সময় নিতান্তই অলস-স্থবির হয়ে পড়ে থাকে স্টেশনটা। একজন অন্ধ গায়ক সেই স্টেশনের স্থায়ী বাসিন্দা, অন্য সবাই অস্থায়ী। ট্রেন এলে সে তার একতারা বাজিয়ে গান ধরে। কেন এই নির্দিষ্ট সময়েই সে গান গায়, আমি তা তখনো বুঝিনি, এখনো বুঝি না। যাত্রীরা ট্রেন থেকে নেমেই বাড়ি ফেরার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে, একমুহূর্তও স্টেশনে দাঁড়াতে চায় না – গান শোনা তো দূরের কথা। তাহলে তাদের গান শোনানোর এই চেষ্টা কেন? আমি অবশ্য তার সেই গান শুনেই স্টেশনে রয়ে গিয়েছিলাম তিনদিন। মনে পড়ে, ট্রেন থেকে নামতেই কানে ভেসে এসেছিল তার অদ্ভুত উদাসীন কণ্ঠের গান –
কে যেন আমারে অতি সাধ করে
হাত দু’খানি ধরে
কাছে টেনে নিতে চায়
মন মাঝে কার যেন ডাক শোনা যায়
কতদিন হয়ে গেল, ওই গানের মর্ম আমি উদ্ধার করতে পারিনি; যদিও সেই সুর, সেই কথা আজো কানে বাজে।
বেশিদিন পালিয়ে থাকতে পারিনি। পকেটের টাকা ফুরিয়ে আসছিল, এরপর কী হবে ভেবে কূল পাচ্ছিলাম না। খাব কী? কেইবা খাওয়াবে? স্টেশনে কুলির কাজ করা যায় অবশ্য, কিন্তু অত কষ্ট তো করিনি কোনোদিন! তাহলে কি ফিরে যাব? তাইবা কী করে হয়? একবার যে ঘর ছেড়ে পালায়, তার কি আর ঘরে ফেরা উচিত? এতসব চিন্তা আমার ছোট্ট মাথায় সইছিল না। আর তখনই ধরা পড়ে গেলাম। তখনকার দিনে রেডিওতে নিখোঁজ সংবাদ প্রচারিত হতো, পত্রিকায়ও ছবিসহ নিখোঁজ মানুষের সন্ধান চেয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া হতো, বাবাও তাই করেছিলেন। হয়তো সেজন্যই আমাকে চিনে ফেলল লোকজন, জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো আমাকে, আমিও ‘হারিয়ে গেছি’ বলে দাবি করলাম, খবর দেওয়া হলো বাবাকে, তারপর একজন সদাশয় লোক আমাকে পৌঁছে দিয়ে গেলেন বাসায়। কোনো এক ফাঁকে বুদ্ধি করে পরে নিয়েছিলাম স্কুল ড্রেসের শার্টটা, ব্যাগটাও ফেলে দিয়েছিলাম – যেখানে ছিল আমার লেখার খাতাটাও, বাসায় ফিরলাম স্কুল ড্রেস পরেই। ভয় পাচ্ছিলাম, না জানি কী অপেক্ষা করছে আমার জন্য – এই ভেবে। কিন্তু খারাপ কিছু ঘটল না। মা জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন অনেকক্ষণ, কাঁদলেন দাদিও। বাবা আর দাদা শক্ত মানুষ, তবু চোখ মুছলেন কয়েকবার। ভাইবোনদের কাছেও আমি হয়ে উঠলাম বিশেষ একজন। আমি যে পালিয়েছিলাম সে-কথা বেমালুম চেপে গেলাম, হারিয়ে যাওয়ার কথাই বললাম সবাইকে, কীভাবে যে অন্য এক শহরে গিয়েছি, কে যে নিয়ে গেছে, কিছুই জানি না – এরকম ভাব দেখালাম। ভাবলাম, এ যাত্রা পার পেয়ে গেছি আর এ-ধরনের অ্যাডভেঞ্চার করা যাবে না। কিন্তু রাতে, মা আমাকে নিয়ে ঘুমাতে গেলেন। বুকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলেন – হারালি কীভাবে? এত বড় ছেলেরা কি হারায়?
কী জানি মা, বলতে পারব না।
সত্যিই হারিয়েছিলি, না পালিয়েছিলি?
পালাব কেন? কী যে বলো না তুমি!
তোর স্কুল ব্যাগটা কোথায়?
ওটাও হারিয়ে ফেলেছি।
তুই তো সেদিন বই-খাতা নিয়ে বেরোসনি। সব বই-ই তো তোর টেবিলের ওপর। এদিকে তোর কিছু জামা-কাপড় পাওয়া যাচ্ছে না। বই-খাতা রেখে জামা-কাপড় নিয়ে কোথায় গিয়েছিলি?
মৃদুকণ্ঠে, মমতাভরে, বুকে জড়িয়ে মা যখন এসব জিজ্ঞেস করছিলেন, আর আমি বুঝতে পারছিলাম ধরা পড়ে গেছি, তখন আর অস্বীকার করার ঝুঁকি নিলাম না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম – মা, আমি হারাইনি, পালাতে চেয়েছিলাম। বাবাকে বলো না, হ্যাঁ?
মা কিছু বললেন না, হুহু করে কাঁদতে লাগলেন, তার চোখের জলে আমার গাল ভিজে গেল। এখনো আমি মায়ের সেই অশ্রুভেজা আদরের স্পর্শ অনুভব করি। কান্নার বেগ একটু কমলে মা ফিসফিসিয়ে বললেন – তোকে নিয়ে আমার ভয় হয়। তোর কেন পালানোর কথা মনে হলো? আমরা তো তোকে বকি না, মারি না, তবু তোর কেন মনে হলো?
আমি উত্তর না দিয়ে ঘাপটি মেরে শুয়ে রইলাম। কীইবা বলব? আমি নিজেও কি জানি, কেন আমার ওরকম ইচ্ছা হলো?
তিন
আমাকে নিয়ে মা-র শঙ্কাটা হয়তো কখনোই কাটেনি। সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখতে চাইতেন, বাসায় ফিরতে দেরি হলে অস্থির হয়ে উঠতেন, ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন যতক্ষণ না আমাকে দেখতে পেতেন। বড় হয়ে যাওয়ার পরও তার এই শঙ্কা ছিল। ঢাকার বাইরে কোথাও বেড়াতে যেতে চাইলে না করতেন না, কিন্তু সঙ্গে কোনো বন্ধুকে নিয়ে যাওয়ার শর্ত যুক্ত হতো। তারপর সেই বন্ধুকেই দায়িত্ব দিতেন, যেন আমাকে দেখে রাখে, যেন ঠিকঠাকমতো ফিরিয়ে আনে। বিব্রত হতাম, কিন্তু কিছু বলতাম না। মায়ের এই উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর শঙ্কাকে আমি আনন্দের সঙ্গেই গ্রহণ করেছিলাম। হয়তো সেই উৎকণ্ঠার জন্যই আমাকে বিয়ে করিয়ে সংসারের বন্ধনে বাঁধতে চেয়েছিলেন। আমার প্রথম সন্তান যখন হলো তখন মায়ের মুখে রীতিমতো বিজয়ের হাসি দেখেছি – যেন এতদিনে বাঁধা পড়ল তার ছেলে, আর পালাতে পারবে না।
অথচ আমি বিয়েই করতে চাইনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একটা মেয়ের সঙ্গে আমার প্রেম হয়েছিল। প্রেমই, অন্য কিছু নয়। ততদিনই আমরা ভালো ছিলাম যতদিন বিয়ের প্রসঙ্গ আসেনি। তখনকার দিনে মেয়েদের বিয়ে হয়ে যেত একটু তাড়াতাড়িই। ওর বিয়ের কথাও উঠেছিল পরিবারে আর ও তখন আবদার করে বসেছিল – আমি বাবাকে তোমার কথা বলেছি, তুমি একদিন এসো বাসায়, মা-বাবার সঙ্গে কথা বলো।
আমি আঁতকে উঠেছিলাম – বলো কী? আমাকে জিজ্ঞেস না করেই বাবাকে বলে দিয়েছ?
তাতে কী হয়েছে? বাবা জানতে চাইলে বলব না?
বলবে। কিন্তু এখনই বিয়ের কথা আসে কীভাবে?
এখনই তো বিয়ে করতে বলছি না। বাবা তোমাকে দেখতে চেয়েছেন, তারও তো একটা নিশ্চয়তা দরকার! কার সঙ্গে মেয়ে বিয়ে দেবেন দেখবেন না?
কিন্তু আমি তো বিয়ের কথা ভাবিইনি।
আহা তোমাকে এখনই কে ভাবতে বলেছে? তুমি শুধু একবার দেখা করবে, এটুকুই।
দেখা করে কী বলব? আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চাই – এরকম কিছু?
হ্যাঁ, বলবে। বিয়ে তো করবেই, বলতে আর অসুবিধা কী? – মেয়েটির কণ্ঠে লজ্জা ছিল, আনন্দও ছিল। কিন্তু আমি তেতে উঠলাম।
তোমাকে আমি বিয়ে করব সে-কথা কখনো বলেছি?
মানে?
আমি কি কখনো তোমাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছি?
প্রেম তো করেছ!
হ্যাঁ করেছি। তো?
কেন করেছ? বিয়ে করবে না, তাহলে প্রেম করেছ কেন?
আমি তোমাকে ভালোবাসি বলে!
সেই ভালোবাসার কোনো পরিণতি থাকবে না?
ভালোবাসার আবার পরিণতি কী?
আমরা বিয়ে করব না? আমাদের সংসার হবে না? একসঙ্গে থাকব না সারাজীবন? আমাদের বাবু হবে না?
কী উত্তর দেবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। আমি তো এতকিছু ভেবে প্রেম করিনি। বিয়ে-সংসার-বাচ্চাকাচ্চা! ওহ্! এই মেয়ে বলে কী! ভাবতেই তো আমার মাথা ঘুরছে! অসহায় ভঙ্গিতে আমি ওকে বললাম – আমাকে দুদিন সময় দাও। একটু ভেবে দেখি।
ভেবে দেখার কী আছে? তুমি বাবার সঙ্গে দেখা করবে, এটাই শেষ কথা।
আচ্ছা করব। আমাকে দুটো দিন সময় দাও। – আমি আবার মিনতি করলাম।
মেয়েটি একটুক্ষণ চুপ করে থেকে মৃদু হেসে বলল – আচ্ছা, দুদিন পরেই জানিয়ো, কবে যাবে!
আমি ওর হাসি দেখে বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম। কী ভাবছে ও? সত্যিই আমি যাব? এই মুচকি হাসির অর্থ কী? ও কী ভাবছে, আমি বাঁধা পড়ে গেছি, ছাড়তে পারব না? নাহ্, বোঝা যাচ্ছে না এই রহস্যময় হাসির অর্থ।
সেই ‘দুদিন পর’ আর কখনোই আসেনি। আমি স্রেফ পালিয়ে এসেছিলাম ওর কাছ থেকে। আর কোনো যোগাযোগই করিনি। তখন যোগাযোগের এত সহজ মাধ্যমগুলো ছিল না। সেলফোন তো দূরের কথা, সারা শহরে ল্যান্ডফোনও ছিল হাতেগোনা, ইন্টারনেটের তো নামই শোনেনি কেউ, ফলে যোগাযোগ-বিচ্ছিন্ন থাকা আমার জন্য খুব কঠিন কিছু হয়নি। মেয়েটি অবশ্য আমার খোঁজে ওর এবং আমার বন্ধুদের পাঠিয়েছিল, আমি ধরা দিইনি।
এর অনেকদিন পর, মায়ের পীড়াপীড়িতে আমি যখন বিয়ের কথা ভাবতে লাগলাম, তখন আবার ওর কথা মনে হলো। মাঝখানে কয়েক বছর পার হয়ে গেছে, ওর কী হয়েছে না হয়েছে কিছুই জানি না, এতদিন পর ওর কাছে গিয়ে দাঁড়ালে প্রতিক্রিয়া কেমন হবে তা না ভেবেই ওর বাসায় গিয়ে হাজির হলাম। আমাকে ড্রয়িংরুমে বসতে দেওয়া হলো। কিছুক্ষণ পর মা-র বয়সী এক মহিলা এলেন। যদিও এর আগে মাত্র একবার দেখেছি তাকে, তাও দূর থেকে, তবু চিনতে অসুবিধা হলো না আমার। তিনি জিজ্ঞেস করলেন – তুমি কে বাবা?
এ প্রশ্নের কী উত্তর দেওয়া যায়? নিজের নাম বলব? নাকি বলব, আমি আপনার মেয়ের বন্ধু? দ্বিতীয়টাই বললাম। তিনি একটু অবাক হয়ে বললেন – বন্ধু! তোমাকে তো দেখিনি কোনোদিন!
কখনো আসিনি তো, তাই দেখেননি।
তা এতদিন পর কী মনে করে এলে?
ওকে একটু ডেকে দেন, আমার খুব জরুরি দরকার।
ও তো শ্বশুরবাড়িতে। ডেকে দেবো কীভাবে?
শ্বশুরবাড়িতে! বিয়ে হয়ে গেছে!
হ্যাঁ, সে-তো কতদিন আগেই। তুমি জানো না? কেমন বন্ধু তুমি?
না, আমি জানতাম না।
তুমি আসলে কে বলো তো?
আমি প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই উঠে দাঁড়াই, বলি – আমি তাহলে আসি। অসময়ে আপনাকে বিরক্ত করলাম। ক্ষমা করবেন!
সে কী! যাবে কেন? চা খেয়ে যাও।
না ঠিক আছে। আমি আসি।
ভদ্রমহিলার বিস্মিত দৃষ্টি উপেক্ষা করে বাইরে বেরিয়ে এলাম আমি। হঠাৎ করে জগৎটাকে শূন্য মনে হতে লাগল। বহুদিন যোগাযোগ নেই, তবু হয়তো অবচেতনেই আমি ভাবতাম – সে আমার অপেক্ষায় আছে! আজ যেন সব জানা হয়ে গেল, ফাঁকাও হয়ে গেল সব।
কয়েকদিন গুম মেরে রইলাম। এদিকে মা-র পীড়াপীড়ি চলছেই, জানতে চাইছেন আমার পছন্দের কেউ আছে কি না! কয়েকদিন আগেও এ-প্রশ্নের উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বলা যেত, ওর সঙ্গে কথা না বলে বলতে চাইনি, এখন আর হ্যাঁ বলার কোনো সুযোগ নেই। আহা মেয়েটার বিয়ের শখ ছিল, আমার সঙ্গে সংসার করার সাধ ছিল, আমার বাচ্চাকাচ্চার মা হওয়ার সাধ ছিল! আমি সেগুলোকে পাত্তাই দিইনি!
মাকে বলে দিলাম – আমার কোনো পছন্দ নেই, তোমরা পাত্রী দ্যাখো।
পাত্রী দেখা হলো। মা দেখেশুনে একটা লক্ষ্মী-টাইপ মেয়ে নিয়ে এলেন আমার জন্য। তার পরের ঘটনা তো সাদামাটা। সংসার-সন্তান-চাকরির ঘেরাটোপে বন্দি জীবন। সেই জীবন থেকে পালানোর কোনো পথ আমার জানা ছিল না। কিন্তু মুক্তির একটা উপায় আমি ভেবেছি সবসময়। ভেবেছি, কোনো এক বৃষ্টিভেজা বিকেলে সেই মেয়েটির সঙ্গে আবার দেখা হয়ে যাবে আমার। ওরকম বিকেল আমাদের দুজনেরই খুব পছন্দের ছিল। কত যে বৃষ্টিমুখর বিকেল আমরা রিকশায় চড়ে ঘুরে বেরিয়েছি, কতবার যে ভিজেছি দুজন একসঙ্গে, তার কোনো হিসাব নেই। ভেবেছি, আবার দেখা হলে ওর হাত ধরে ক্ষমা চেয়ে নেব, আরেকবার হুডখোলা রিকশায় চড়ে ভিজতে ভিজতে কাঁদব দুজন। বৃষ্টিজলের সঙ্গে আমাদের দুজনের চোখের জল মিশে গিয়ে ধুইয়ে দেবে আমাদের সমস্ত অপ্রাপ্তি, বেদনা, গ্লানি ও পাপ; মুক্তি ঘটবে আমাদের। হয়নি। এক শহরে থাকি, তবু ওর সঙ্গে আর কখনোই দেখা হয়নি আমার।
চার
এভাবে কখন যে বেলা পড়ে এসেছে বুঝতে পারিনি। শরীর জানান দিচ্ছে – বয়স হচ্ছে, বয়স হচ্ছে, মাঝেমধ্যেই বিগড়ে যাচ্ছে সে, এই অসুবিধা, সেই অসুবিধা। প্রথমে পাত্তা দিইনি। পরে মনে হলো, একজন ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া দরকার। তিনি চেকআপ করতে বললেন আর তখনই ধরা পড়ল – আমার কিডনি বিকল হতে শুরু করেছে বেশ আগেই। এখন থেকে নিয়ম-টিয়ম মেনে চললে হয়তো বিকল হওয়ার হার হ্রাস করা যাবে। কতই-বা আর হ্রাস করা যাবে? শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর একটা বিকল হতে থাকলে অন্যগুলোও যে অবলম্বনহীন হয়ে পড়ে! নানাদিকে জটিলতা বাড়ে, আয়ু ক্রমশই কমে আসে। আমারও আয়ু ফুরিয়ে আসছে, বুঝতে পারছি। এবার আমার জীবন থেকে পালানোর পালা – গোপনে, নিঃশব্দে।
ইদানীং প্রায়ই গায়ে গায়ে জ্বর থাকছে। এ-কথাটাও মা-র কাছ থেকে শেখা। গায়ে গায়ে জ্বর। মানে হলো, ততটা প্রবল নয়, বোঝা যায় কি যায় না, কিংবা যার জ্বর সে ছাড়া আর কেউ বুঝতেই পারে না। মা তাহলে বুঝতেন কী করে? কীভাবে বলতেন তার সন্তানদের গা ছুঁয়ে এ-কথা?
হয়তো জ্বরের কারণেই এই গরমেও কেমন শীত শীত লাগে। কিন্তু কাউকে বলি না সে-কথা। বউ ঘুমিয়ে গেলে সংগোপনে একটা কাঁথা বা চাদর গায়ে টেনে নিই। ইচ্ছা করে, গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকি মা-র কোলের ভেতর। ওখানেই যত কোমলতা, যত স্বস্তি। মা-র কোলের সেই ওম আমি কোথায় পাব এই জ্বরতপ্ত শীতার্ত শরীরে? এসব ভাবি আর তখন মনে পড়ে মা-র কবরের কথা। একটা ছোট্ট নদীর পাড়ে গভীর নির্জন এক গোরস্তানে তিনি শুয়ে আছেন। তার কবরে সারা বছর বেলিফুল ফোটে, সৌরভে ভরে থাকে চারপাশের হাওয়া। আমি যদি শুয়ে পড়ি তার পাশে বেলিফুলগুলো কি আমাকেও খানিকটা সৌরভ বিলাবে না?