মাঝরাতের ঝগড়া, আস্তে আস্তে নয়, আবার তুমুলও বলা যাবে না। জহিরউদ্দিনেরই গলা শোনা যায়, ঝগড়ায় চন্দ্রার সংগত আছে বোঝা যায়, গলা তেমন শোনা না গেলেও।
উঠান পেরিয়ে বড় ছেলে তমিজের ঘর। তমিজের বউ ছেলের মুখ থেকে দুধটা সরিয়ে নিতে নিতে গজগজ করে, রাইতদুফুরে কী শুরু করলো তোমার বাপে! কাইল সন্ধ্যায় সতেরো দিন পর হাসপাতাল ছাইড়া আইলো মাইয়ারে নিয়া! মাইয়া ভালো আছে, আরামে ঘুমাবি, না মাঝরাইতে ঝগড়া! তমিজ মিয়া শব্দ করে না, বস্তুত বাপের দ্বিতীয় বিয়ে সে মেনেই নেয়নি, তো গত চার বছর বাপের সাতেপাঁচে নেই।
সন্ধ্যায় মেয়ে নিয়ে ফিরে এসছে জহিরউদ্দিন, ষোলো মাসের মেয়ে, বুকচেরা অস্ত্রোপচার। যাওয়ার সময় সবাই তো মেয়েকে চিরবিদায় দিয়েছিল, এখন সে ফিরেছে, আল্লাহ তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। কী সাধ্য চন্দ্রা তাকে বাঁচিয়ে আনে, বাঁচিয়েছে আল্লাহ!
আট মাস বয়সে ধরা পড়ে তামান্নার হৃৎপিণ্ড দুটো ফুটো, একাধিক প্রতিবন্ধক। কান্না করলেই নীল হয়ে অজ্ঞান। স্বামীর সঙ্গে সেই যে ঝগড়া শুরু আর মেটেই না। ডাক্তার দেখাবি ক্যান, এমনিই সারবো, মানুষের বাচ্চার কত কী হয়, মরে কই!
খুবই তেঁদড় কিছিমের চন্দ্রা, মেয়েকে সে ডাক্তার দেখাবেই। মায়ের কাছ থেকে হাজারখানেক টাকা জোগাড় করে, ডাক্তার দেখেশুনে বলে, আপনাকে তো সাতদিন সময়ও দেওয়া যায় না মা, মেয়ের অপারেশন করান মেয়ে চাইলে!
বাড়ি এসে ফের ঝগড়া, জহিরউদ্দিন বলে, ডাক্তাররা এমনই কয়, কিয়ের অপারেশন এতদ্দুর দুধের মাইয়ার!
সাদুল্যাহপুরের জহিরউদ্দিন টাকার স্বপ্নে গোলাপবাগানে সেচ দেয়, সার দেয়, আগাছা পরিষ্কার করে, নতুন চারার জন্য জংলি গোলাপের গিঁট ধরে ধরে ডাল পোঁতে। চোখ কলম করে হাজার হাজার চারাগাছ তৈরি করে গভীর মমতায়। চারা বেচে টাকা পাবে। টাকায় কি না হয় … সর্বদা তার মুখে এই।
প্রথম ঘরে তার তিন ছেলে রেখে বউ মরেছে, আধপোয়া শুকনা মরিচ তিনদিনে খেলে তার বাঁচার দরকার কি! মরেছে না মেরেছে, কে রাখে অবলা নারীর খবর! আর ভাগ্যবানের তো বউই মরে! চন্দ্রাকে বিয়ে করার সময় পরিষ্কার বলে দিয়েছে তার ছেলেমেয়ের দায়িত্ব সে নেবে না, তারা আসতেও পারবে না এ-বাড়িতে। ড্রাইভার স্বামী নিখোঁজ হওয়ার তিনদিন পর চন্দ্রা ভেবে রেখেছিল ফিরে এলে সে কী করবে। এত অভিমান সে জলে যেতে দেবে না। আবার মৃত্যুভয়ও পেয়েছিল। ঠিক যা হলো। এগারো দিন পর আনজুমান মুফিদুল ইসলামের বেওয়ারিশ হিসেবে লাশ দাফন হয়ে যাওয়ার নয়দিন পর পায় পলাশে, লাশের দিকে তাকিয়ে চন্দ্রা বলে, তোমার ভাত আল্লায় আমার বন্ধ করল।
ভাইয়েরা তাকে জায়গা দেবে না দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে। স্বামী শ্বশুরের পালিত পুত্র হওয়ায় শ্বশুরবাড়িতেও জায়গা না পেয়ে কিছুকাল একটা মাদ্রাসায় পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ নেয় আর সারারাত সেলাই, জীবনটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিয়েছিল … হ্যাঁ, সে বলেছিল মাকে, আমি পারমু মা, ভয় কইরো না! সাধারণ একটা হাতচালিত সেলাইকল, তাই দিয়ে সে রাজ্য জয় করতে চেয়েছিল, না কেন! বাবার হাতের! সেলাইকলটাও একটা ছোট্ট ইতিহাসের সাক্ষী, বাপ দিয়েছিল স্বামীর মৃত্যুর পর। দিয়ে বলেছিল, নতুন মায়েরে কওয়ার দরকার নাই। চন্দ্রার বাপের পরিচয় দিলে উহাকে সবাই চিনিয়া লইবেন, তাই তাহা উহ্য রহিল! একটু না বলিলে আবার খুঁতখুঁতও লাগে। তিনি জনপ্রিয় লোকশিল্পী, যিনি অপূর্ব চন্দ্রা নামটা রেখেছিলেন একমাত্র কন্যার। এবং নাম রাখার এক সপ্তাহের মধ্যে তিনি দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করেন। সারাবছর দল নিয়ে সারাদেশ ঘুরে বেড়ান, বিদেশেও যান বইকি। আসর মাত করতে যার জুড়ি নেই। চন্দ্রার নানি তার গান শুনে এতই আপ্লুত হন যে, মেয়েকে গোপনে বোনের বাড়ি নিয়ে গিয়ে বিয়ে দিয়ে দেন এই শিল্পীর সঙ্গে। এই বিয়ের কারণে তিনি বাকি জীবন স্বামীর গঞ্জনা সয়েছেন, গান ভাল্লাগলে তুই বিয়া বইতি, মাইয়ারে কেন দিলি! চন্দ্রার মা খুবই আত্মভোলা রূপবতী রমণী ছিলেন, কিন্তু বোকার হদ্দ। আজো শাড়িটা গুছিয়ে পরতে পারলেন না। চুল আউলাঝাউলা দার্শনিক আচরণ, কেউ কিছু চাইলে দিয়ে দেন অবলীলায়, জিজ্ঞাসা করেন, বলবে, টাকা-পয়সা বুঝি আমার! ও আল্লার দান, যে কেউ নিতে পারে।
দুই ছেলের পর চন্দ্রা পেটে থাকতে ছলাকলায় পটু কাজের মহিলাটি চন্দ্রার শিল্পী বাপের সবটুকু দখল করে নিলে কিশোর দুই ছেলে আর তিন মাসের চন্দ্রাকে নিয়ে বাপের ভিটায় সাদুল্যাপুর ফিরে আসেন। না, তিনি নিজে আসেন নাই, শিল্পীস্বামী নিজে পৌঁছে দিয়ে গেছেন। তাতেও তার বিশেষ বিকার দেখা যায়নি।
তো চন্দ্রার ঝাড়ুদারের চাকরিটা ভাইয়েরা ভালো চোখে দেখল না, মান-ইজ্জতের প্রশ্ন! বছর না ঘুরতেই কাছাকাছিই পাত্র মিলে গেলে মা-ভাইয়েরা ধরেবেঁধে বিয়ে দিয়ে দিলো এই বাপের বয়সী লোকটার সঙ্গে। যার কি না বিবাহিত তিন ছেলের ঘরে ডজনখানেক নাতিনাতকুর। না, নাতিনাতকুরে চন্দ্রার কোনো আপত্তি নাই, আপত্তি শুধু তার নিজের ছেলেমেয়ে দুটো এ-বাড়িতে ঢুকতে না পারার প্রতিবন্ধকতা নিয়ে। কেন তারা আসতে পারবে না! মেয়েটা তো সুন্দর করে এই বুড়ো লোকটাকে আব্বু ডাকে। মাদ্রাসার হোস্টেলে থেকে পড়ে। গরিব বলে বেশি টাকা তারা নেয় না, মাসে মাত্র এক হাজার টাকা, সেটাও রাত জেগে জেগে সেলাই করেই চন্দ্রা কামাই করে। সেখানেও জহিরউদ্দিনের প্রবল আপত্তি। আরো কিছু দরকার হলে মা মিটিয়ে দেয়, বাপের বাড়ির অংশ থেকে যা পায় তা থেকে মেয়েকেই টানে বেশি, আর এখানেই তো ভাইদের মহাআপত্তি। আর সেভেনে পড়া ছেলেটাকে নানি আগলে রাখতে যতই চেষ্টা করুক না কেন। ছেলে পড়ালেখা ছাড়ল আর মাকে মা বলা বন্ধ করল, কথাও তেমন একটা বলে না। মেয়েটাও বছরখানেক ঠিক থাকার পর সমস্যা শুরু করল, ফোন দিয়ে ডাকে, কাছে গেলে রোজ একটা করে স্বপ্ন বলে, মা তিনটা লোক বাবাকে ধরে নিয়ে গেছে, বাবাকে কিন্তু মারতে পারে নাই। যে-লাশটা আমরা দেখছি সেটা কখনো বাবার নয়। আরেকদিন ডেকে নিয়ে গিয়ে বলে, আব্বু তোমারে মেরে ফেলবে মা, আমি জানি কেমনে মারবে!
চন্দ্রা বুঝল কত বড় সর্বনাশ তার হয়ে গেছে! যে-সন্তানের জন্য সে জীবন বাজি রাখতে রাজি ছিল, ভাইদের যন্ত্রণায় তা নরকে পরিণত হলো!
সে যাক, ডাক্তারের কথায় জহিরউদ্দিন পেসাবও করে দিলো না, ডাক্তাররা তোরে তাবিজ করছে! ডাক্তারগো লগে রংঢং মারার জন্য তুই কায়দা শুরু করছস! আমি বুড়া বইলা আমারে তোর পছন্দ না! আমার মাইয়ার কিছু হয় নাই।
তামান্না কাঁদে কম, ফুটফুটে মেয়ে; কিন্তু কাঁদলেই নীল হয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। চন্দ্রার ঢাকা শহরে ডাক্তার দেখানো থামানোর জন্য ছুটে এলো ননদেরা। হেসে কুটিকুটি, আরে তোর মাইয়ারে নীলপরি ধরছে, একটু ঝাড়ফুঁক করলেই ঠিক হয়ে যাবে। চল, আবদুল্লাহপুর মরিয়ম বিবির কাছে। ঝাইড়া দিবে, নীলপরি পলাইব।
চন্দ্রা জানে এটা মরিয়ম বিবির কাজ না, ডাক্তার তো বলেছেই, মেয়ে তোমার খুব কষ্টে আছে, যা করবে তাড়াতাড়ি করবে, সময় কম।
আবদুল্লাহপুরের মরিয়ম বিবি নীলপরিকে ঘরে নামায়, ঘর নাকি নীল হয়ে উঠেছিল, কাপড়ের নীল, রবিন লিকিউড ব্লু। বিবিই প্রশ্ন করে আট মাসের মেয়েকে, কবে যাবি রে? বিবিই উত্তর দেয়, বস্তা দিলে যামুগা। – ঠিক কস? – ঠিক।
তামান্নার দুহাত এমন শক্ত করে ধরে রাখে বিবি যে ও ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে বলে, না না না।
বিবি আরো জোরে চেপে ধরলে ও কাঁদে।
চন্দ্রা বলে ওঠে, বস্তা কী জিনিস বুজান!
ননদেরা ধমক দেয়, চুপ কইরা শোন!
এক হাজার এক টাকার বিনিময়ে এক শিশি পানি পায় আর পরের সপ্তাহে যেন দুশো দুই ঘর থেকে চালডাল মেগে তার কাছে পৌঁছে এক শিশি জোয়ারের পানি নেয়। বাড়ি ফিরে পরদিন ভোরে ননদেরা চালডাল মাগতে বেরিয়ে পড়ে। পাঁচদিনে দুশো দুই ঘরের বস্তা বস্তা চালডাল শোয়ার ঘর আগলে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে চন্দ্রা দাঁতে দাঁতে ঘঁষে বলে, দাঁড়াও নীলপরির বাচ্চা! তোমার পিরগিরি ছুটাইতেছি!
ভোররাতে স্বামীকে বলে, আমি এগুলি দিয়া আসি আপনে একটু পরে বাগানে যাইয়েন, তামান্না থাকল। জহিরউদ্দিন জিজ্ঞাসা করে না কাকে দিতে যাচ্ছে।
– ওরে নিবা না?
– এই কামে কাউরে নেওন যায় না।
মেয়ের মাদ্রাসার পাশেই একটা এতিমখানা, ভ্যানে চরে মাত্র পনেরো মিনিট। মাদ্রাসার সেক্রেটারিকে ডেকে বলে, কাউকে কিছু বলবেন না, এতিমগো খাওয়াবেন।
বাড়ি ফিরে দুই ননদের হুলস্থুল, চালডাল তারা মেগে এনেছে বাড়ি বাড়ি ঘুরে, চন্দ্রা শুধু অন্যায় করেনি, গুনার কাজও করেছে। এতিমরা খাইলে আমার মেয়ের জন্য দোয়া করবে আপনার ভণ্ডপীররে আমি বিশ্বাস করি নাই। পুরা ভাওধরা পির, নিজে প্রশ্ন করে নিজে উত্তর দেয়!
ফলাফল একটাই, তিন ভাইবোন মিলে মেরে চুল ধরে বাঁশঝাড়ে বেঁধে রেখে আসে। সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজে সন্ধ্যায় জ্বর আসে। মেয়েকে গরুর দুধ খাওয়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে হয়রান হয়ে বাড়ি ফিরিয়ে আনে চন্দ্রাকে।
দশ মাস বয়সে তামান্নার স্ট্রোক করলে হতবিহ্বল জহিরউদ্দিন বউয়ের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারে না। নিচুস্বরে পিনপিন করে একবার বলে, তোমার কথা শুনলেই পারতাম, কিন্তু ট্যাকা কই পাইতাম?
ফুল বিক্রির পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে সোহরাওয়ার্দীতে ভর্তি হয়ে দিন গোনে। মৃত্যুর খুব কাছ থেকে ফেরে মেয়ে, খাবার গিলতে পারে না, নাকে খায়। বাঁ হাত-পা অবশ আর মা-বাবাকে দেখে আর উৎফুল্ল হয় না মেয়ে। পুরনো কথাই বলে নতুন ডাক্তাররা, আরো বলে এবার অপারেশন ঝুঁকিপূর্ণ, একটা বড় অ্যাটাক হয়ে গেছে ওর ব্রেনে। চন্দ্রা এবার দৌড়ায় ব্রেনের ডাক্তারের কাছে, যে কি না ব্রেন শব্দটাও শুদ্ধ করে বলতে পারে না। বলে, ব্রেন্টের ডাক্তার। যা হোক, ব্রেনের ডাক্তার আর নতুন কী বলবে? অপারেশন করান, তাড়াতাড়ি করান। আর চন্দ্রাকে বলে, আপনিই ওর ডাক্তার, নিজেকে চিনান, তার সঙ্গে সবসময় ভালোবাসার স্বরে কথা বলবেন, উষ্ণতা দেবেন, নিরাপত্তা দেবেন।
চন্দ্রা ফিরে গেল সাদুল্যাপুর, মেয়েকে নিয়ে সারাবেলা, তার যে আরো জগৎ আছে, আরো কিছু আছে সব ভুলে গেল। জহিরউদ্দিন সারাদিন বাগানে, শীতের শুরুতে সে অনেক টাকার চারা বেচল, ফুলের দাম কম কিন্তু সামনে সিজন, ফেব্রুয়ারি মাস পুরোটাই ফুলের সিজন, দিন গোনে, অনেক টাকার। চন্দ্রা জানুয়ারিতে আবার ঢাকা আসে, ব্রেনের ডাক্তার বলে, মেয়ে তো আগের চেয়ে ভালো, অপারেশন করান।
– এত টাকা তো নাই স্যার।
– কত জোগাড় করতে পারবেন?
– পঞ্চাশ হাজারের বেশি পারব না স্যার।
ঠিকানা দেয় ডাক্তার, বিনা-পয়সায় অপারেশন করাবে, কিছু পরীক্ষা হয়তো আপনাকে করতে হবে।
সাদুল্যাহপুর ফিরে জহিরউদ্দিনকে সব খুলে বলে চন্দ্রা, এবার সে একাই গিয়েছিল, দিনে দিনে ফিরে এসেছে মেয়েকে নিয়ে। সবই শোনে মন দিয়ে। পঞ্চাশ হাজারের কথা শুনে লাঠি নিয়ে আসে মারতে আর চন্দ্রার চরিত্র নিয়ে … যা হোক। মেয়েকে তারা মরিয়ম পিরের কাছে নেবে ফের। আগেরবার চালডাল দিলে আর মেয়েকে হাসপাতালে ভর্তি করা লাগত না, মেয়ের হাত-পা অবশ হতো না …। চন্দ্রাকে মেরে ঘর থেকে তাড়ায় জহিরউদ্দিন। তিন ছেলের পর মেয়ে তার, তার কি দরদ কম নাকি?
দুদিনে মেয়ের মরমর অবস্থা। দশ মিনিটে পায় হাঁটা রাস্তা বটে। মেয়ে নিয়ে হাজির, বলে দশ হাজার টাকা দিতে পারি, ঢাকায় যাও, যা পারো করো।
চন্দ্রার মা দিলো ত্রিশ, মোট চল্লিশ আর একটা ঠিকানা ডাক্তার সেলিমের। গত দু-সপ্তাহের ঝড়-তুফান যা গেছে ঠিকানাটা সে আগলে রেখেছে ব্যক্তিগত ব্যাগে।
উঁচুস্তরের হাসপাতাল বটে, চারটা বেড দরিদ্র শিশুদের জন্য বিনামূল্যে বরাদ্দ। বড় কয়টা কোম্পানি মিলে চারটা বেড চালায়। চন্দ্রা ঠিকঠাক খুঁজে পায় হাসপাতাল, ডাক্তার সেলিমকেও। আট ব্যাগ ‘এ’ পজিটিভ রক্ত জোগাড় করতে ওর ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা, ব্লাডব্যাংক আশ্চর্যভাবে শেষ মুহূর্তে তাকে সাহায্য করে।
ডাক্তার সাহেব জিজ্ঞাসা করেন, কত জোগাড় করে এনেছেন? চন্দ্রা বুদ্ধিমতী, বলে, স্যার ত্রিশ পারছি।
– অসুবিধা নাই, দুইটা পরীক্ষা বাইরে থেকে করে আনেন পনেরো হাজার লাগবে, এখানে কিছু লাগবে না। বাকি পনেরো নিজের কাছে রাখেন। এ কয়দিন নিজেদেরও তো খরচ আছে!
তামান্না তো আর আগের মতো হাসে না, ভালো করে তাকায় না; কিন্তু সুস্থ হাত-পাটা নেড়ে নেড়ে কখনো একটু খেলে। জহিরউদ্দিন মাঝে মাঝে শাসায়, ভালা মাইয়া না মইরা যায়! চন্দ্রা বিরক্ত মুখে বলে, তোমার চিন্তা কী! মেয়ে মরলে তোমার ভাত আমি একদিনও খামু না, মেয়ে দিয়াই তুমি আমার স্বামী বুঝছ!
জহিরউদ্দিন বিরক্ত, কিছুতেই টাইট দেওয়া যায় না চন্দ্রাকে, চটাং চটাং কথা বলে! যে মেয়ে তার সংসারই করবে না, তারে কী দিয়ে ভয় দেখানো যায় সে জানে না।
অপারেশন হলো, নানা ঝুঁকি, মেয়ে যায় যায় গেল গেল করে শেষ পর্যন্ত বেঁচে গেল। থাকার কথা দশ দিন, থাকতে হলো সতেরো দিন।
স্বামী দু-একদিন থাকে, বাড়ি যায়, আবার পর দিনিই চলে আসে। চোখে-মুখে এক রকম অবিশ্বাস চন্দ্রার প্রতি, তিন লাখ টাকার অপারেশন কীভাবে ত্রিশ হাজারে ম্যানেজ হয়! জহিরউদ্দিনের অবশ্য বাড়ি গিয়েও শান্তি নাই। গোলাপবাগানে ফুল ফোটার কথা হাজারে হাজারে, কিন্তু কী এক রোগবালাই, কুঁড়ি ফোটার আগেই পাপড়ি কুঁকড়ে কালো হয়ে যাচ্ছে; লকলকে আগাগুলো মোথা হয়ে যাচ্ছে! যে-শীতে ফুলে ফুলে বাগান ছেয়ে যায়, ফুল তুলতে পাঁচ-ছয়জন মুনিশ লাগে, এবার কী হলো! সাভার কৃষি অফিসারের সঙ্গে দেখা করতে গেলে অফিসার অনেকক্ষণ ধরে কী কী যে বলে, জহিরউদ্দিন তার ভাষা বুঝতে পারে না, বলে আপনে চলেন। অফিসার কিছুক্ষণ মাথা চুলকে বলে, বাগানে ভালোবাসার কি ঘাটতি হইছে নাকি?
তামান্নার হাসপাতাল থেকে ছুটির আগের দিন ফুলবাগানে পাওয়া গেল যুবতীর লাশ, লাশের আবার মাথা নাই। ধর্ষিত যুবতী, পরীক্ষা ছাড়াই বলে দেয় গ্রামবাসী! দেহের অর্ধেক তার বাগানে বাকিটা জংলি গোলাপের ঝাড়ে, এজমালি স্থানে। জহিরউদ্দিন যত বলে আমার বাগানে না, ওই জঙ্গলে, লোকে তত বলে, জহিরউদ্দিনের বাগানে। এলাকার লোক অবাকবিস্ময়ে দেখল লাশগন্ধময় এক বিস্রস্ত গোলাপবাগান। জহিরউদ্দিন তাই বলে দমে যাওয়ার লোক নয়। লাশ পড়ে থাকল জমিতে, সে ছুটল হাসপাতালে বাচ্চা আনতে, সঙ্গে একখান জিনিস। জিনিস কিনতে তাকে মাঝে ফার্মগেট নামতে হয়েছে, দোকানদারকে বোঝাতে গিয়ে যাচ্ছেতাই অবস্থা। উপবাসী মানুষ হিংস্রতার শেষবিন্দু নিংড়ে শিকার ধরবে, এটাই স্বাভাবিক।
যা হোক, আটশো টাকায় সিএনজি ভাড়ায় বাড়ি পৌঁছাতে রাত নটা। বস্তুত এই টাকা দেবে চন্দ্রা, আটশো কি হাজার তাতে জহিরউদ্দিনের কোনো অসুবিধা নাই, কিছু এসে-যায় না, তাও নয়। সে জানে প্রচুর টাকা বেঁচে গেছে, হয়তো পুরো চল্লিশই, কে জানে!
পৌঁছে দেখে বাড়িঘর সতেরো দিনে জঙ্গল। আগে ঘরবাড়ি পরিষ্কার করে, জানে মেয়ের জন্য সামান্য নোংরা তার সব চেষ্টা ভেস্তে দিতে পারে। তারপর স্টোভ ধরিয়ে নিজেদের জন্য ভাতে আলু আর মেয়ের জন্য দুধসুজি। মেয়েকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে হাসপাতাল থেকে আনা কাপড়চোপড় কাচতে বসে। জহিরউদ্দিন বলে, এত রাইতে দরকার কি ধোয়াধুয়ির!
– না, সকালে আমার অনেক কাম আছে।
শুতে আসে রাত দেড়টায়।, জহিরউদ্দিন যে জেগে আছে জানেই না। মাথার কাছ থেকে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দেয়, বলে, পইরা আস। শখ কইরা কিনছি।
মনোহর একটা প্যাকেট, হালকা গোলাপি একটা কিছু ভেতরে।
– কী জিনিস?
– খুইলা দেখ!
ফ্যানের বাতাস না থাকলেও বাতাসে জহিরউদ্দিনের পাতলা কাঁচাপাকা দাড়ি ওড়ে। নাকি সম্ভোগের আবেগে কাঁপে!
বুদ্ধিমতী চন্দ্রা কিসের যেন গন্ধ পায়, বলে, সকালে দেখুম, সরেন ঘুমামু।
জহিরউদ্দিন আকুল হয়ে বলে, একবার পরো, খুব শখ কইরা কিনলাম। অবহেলে পলিথিনটার মুখের জায়গাটা টানলে খুলে যায় মুখটা, ভেতরে হালকা গোলাপি কিছু। বুঝতে সে ঠিক পারে তবু আবার বলে, কী জিনিস?
– জিনিস একটা, পইরা আস।
চন্দ্রা আগেই বুঝেছিল, এবার বেঁকে বসে, কাইল পইরা দেখাব, সরেন ঘুমাব।
– না, এখনই পরো, আর কিছু না, প্লিজ।
– আর কিছু না তো!
– নাহ্!
একটু আড়ালে গিয়ে পরতে গিয়ে থমকে যায় চন্দ্রা। কষ্টে চোখ ফেটে পানি আসে, হাসপাতালে একটা দিন একটুকরো মাছ কিনে যে খাওয়ায়নি, রোজ ডাল-ভাত-ভর্তা, কঠিন সন্দেহ। জিনিসদুটো হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আড়ালে। জহিরউদ্দিন ডাকে, ভেবেছে পরে বুঝি লজ্জায় আসছে না। আবার ডাকে, আবার ডাকে। তারপর সে জিনিসগুলো পরে কাছে এসে দাঁড়ায়। জহিরউদ্দিন অবাকবিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হাত বাড়ালে চন্দ্রা নতুন জিনিসের গায়ে কাঁচি চালায়।
দুই.
পরদিন সকালে দুজনে স্বাভাবিক। জহিরউদ্দিন কিছু না খেয়ে বেরিয়ে যায়, বাগানে নয় চেয়ারম্যানের বাড়ি, তার একটু পর একজন ডেকে নিয়ে যায় চন্দ্রাকে। চন্দ্রা বলে, সতেরো দিন পর আমি বাড়ি আসছি, ঘুম নাই, খাওয়া নাই, চিন্তায় রাত-দিন একাকার। সেখানে বলে আমি ডাক্তারগো কাছে চাহিদা মিটায় আসছি! আমার মেয়ের অপারেশন সাকসেসফুল কিন্তু মেয়ে আমাদের চেনে না, আমার মেয়ে বাঁচবে, সারাজীবন তাকে আমার দেখাশোনা করতে হবে। ঠিক সময়ে কাজটা করলে আজ এই দশা হইত না, আমি তার ভাত খাব না। তার উপহারের জিনিস পইরা তারে খুশি করতে পারি না!
সালিশের দশ-বারোজন কিছু বোঝার আগেই গায়ের বড় ওড়নার নিচ থেকে টুকরো টুকরো গোলাপি কিছু ফুলের মতো জিনিস ছুড়ে ফেলে মেঝেতে, তারপর হনহনিয়ে বেরিয়ে যায়।