বাস্তুভিটা

‘ওই আস্তে…। ছায়া! মাইনষের মাথার ছায়া! মাথা নিচা কর্, মাথা নিচা কর্!’ – সয়ফুলের হকচকিত চাপাস্বরে আমরা থতমত খেয়ে থামি, কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাথা নিচু করে চকিতে সয়ফুলের দিকে তাকাই; নিঃশব্দে, হামাগুড়ি দিয়ে শচীন সামন্তের বড় ঘরের উত্তর পাশের জানালার নিচে উবু হয়ে বসি। ‘লেডা মার, লেডা মার’ – সয়ফুল অস্ফুট স্বরে বলে; ‘লেডা’ – আমাদের ফুলবাড়িয়ার ভাষায় দেহ পুরোপুরি মাটিতে শায়িত করাকে বোঝায় – এবার দ্রুত তাই করি; সয়ফুলও ‘লেডা মারে’, আমরা প্রায় নিশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করি, অচিরে তিন-চারটি মানুষের ছায়া জানালার মিহি পর্দার আড়াল ভেদ করে স্পষ্ট হয়, তারা কথা বলে চলে উচ্চস্বরে; সয়ফুল আবার হিসহিস করে বলে, ‘লেডা মাইরা পইড়া থাক। আনিগুনি করতেছে। এক্কেরে চুপ!’

আমরা সয়ফুলের কথার আকস্মিকতায় স্তব্ধ, মাটিলগ্ন শায়িত থাকি; আমরা – সয়ফুল, আমি আর রমেশ পাল; সয়ফুলই আমাদের একত্র করে – শচীন সামন্তের বড় ঘরে আগুন দেবো আমরা; আমার আর রমেশের হাতে তিন তিন ছয় লিটার পেট্রলের দুই গ্যালন আঁকড়ে ধরা, সামান্য কাজ – রমেশ আর আমি পেট্রল ঢালব, সয়ফুল ঠান্ডা মাথায় দিয়াশলাই জ্বালিয়ে দেবে, মুহূর্তে সামন্তবাবুর ঘরে দাউদাউ আগুন জ্বলতে শুরু করবে, এই সময় শচীন সামন্তের বউ আর দুই বাচ্চার কেবল ঘরে থাকার কথা – সামন্তবাবু বাদিহাটি বাজারে জুতার দোকান মেসার্স রানুকা সু স্টোরের ডালা বন্ধই করে এশার নামাজের পর, এরপর চাখানায় আরো আধা কি এক ঘণ্টা; ঘরে আগুন দিয়ে আমরা অন্ধকারে তেড়েফুঁড়ে দৌড়ে বানাড় নদীর দিকে চলে যাবো – ছকমতো এশার আজানের পরপর আমরা সামন্তবাবুর বাড়ির উঠোন পেরিয়ে বড় ঘরের উত্তর পাশে পৌঁছি, ঠিক সেই সময় সয়ফুলের ভয়ার্ত হিসহিস, আমি মাটিতে উবু হয়ে শুয়ে যতদূর সম্ভব নিচু গলায় সয়ফুলকে বলি, ‘হাতে পেট্রল লয়া এহন ডরাইয়া কাঁপোছ! ল, ঢাইলা দেই। তুই ম্যাচ বাইর কর।’

‘জব্বার’ – আমার নাম ধরে সয়ফুল ধমকের সুরে চাপাস্বরে বলে, ‘ছায়াডা দেখছোস কার্? আরফান মুন্সীর না? হ্যায় দিছে আমরারে এই কাম। নিশ্চিত ফেরে পড়ছে উনি! আগুন লাগায়া দুই কাইক না যাইতেই ধরা পড়ুম! … ওই পিছে জামগাছের নিচে দ্যাখ্ মাইনষের ছায়া। কুনদিক দিয়া পলায়াম!’

তাইতো – ঘরের ভেতরের মানুষটি যে আরফান মুন্সী, এখন প্রায় স্পষ্ট বোঝা যায় – সেই মাঝারি উচ্চতার বেঢপ ভুঁড়ি, মেহেদিরাঙা দাড়ি-টুপির মাঝবয়সী ইউনিয়ন পরিষদের কাউন্সিলর; আর, যে-উঠোন পেরিয়ে এসেছি আমরা, তার পেছনের জামগাছের নিচে আরো কয়েক মানুষের অবয়ব; ‘আরফান মুন্সী ধরা খাইছে … চুপ কইরা মটকা মাইরা পইড়া থাকলে বাঁচুম আমরা?’ – এবার অস্ফুট স্বরে বলে রমেশ পাল, ভয়ে রমেশের কণ্ঠ থরথর কাঁপে।

রমেশের বাবা – আমরা ডাকি, সুশীল পাল কাকা, প্রয়াত হয়েছেন দিনপনেরো আগে, রমেশের মাথা তাই ন্যাড়া; ভয় পেলে কি মাথাও এত দরদর করে ঘামে? আবছা চাঁদের আলোয় রমেশের চুলশূন্য মাথা ধক্ ধক্ করে জ্বলে; সয়ফুল আবার রুদ্ধ কণ্ঠে ধমকে দেয়, ‘চুপ থাক্। বুইঝা লই কী করুম!’

আমরা নিঃশব্দে উদগ্রীব চোখে পর্দাঢাকা জানালার দিকে তাকিয়ে থাকি, আরফান মুন্সী হাত নেড়ে নেড়ে আরেকজন পুরুষকে কী যেন বলছে; এই লোক সামন্তবাবু না; সামন্তবাবু ছোটখাটো মানুষ, মাথায় টাক আর সবসময় ধুতি-পাঞ্জাবি পরেন। এই লোকের শরীরে প্যান্ট-শার্ট – কে এই লোক? টিটু সাহেব না?  তোজাম্মেল হক টিটু, আরফান মুন্সীর কন্ট্রাকটরির পার্টনার। সে এখানে কেন?

সয়ফুলকে কয়েক সন্ধ্যা আগে আরফান মুন্সী প্রস্তাব দেয়, দ্রুত কাজ করলে কাঁচা পয়সাই শুধু মিলবে না, নগদে ভিটেবাড়ি পর্যন্ত পাওয়া যাবে; সয়ফুল আমাকে আর রমেশকে নিয়ে বসে ফরিদের চা-শিঙাড়ার দোকানে, ষড়যন্ত্রের স্বরে বলে, ‘আবার আনিগুনির মইদ্যে একটা কাজ করতে হবে!’ আমরা তিনজন একই ক্লাসে পলাশীহাটা স্কুলে পড়েছি। সয়ফুল তিনবারের চেষ্টায় এসএসসি পাশ করতে ব্যর্থ হয়। আমি আর পরেশ অবশ্য দ্বিতীয়বারে উত্তীর্ণ হয়ে ফুলবাড়িয়া কলেজে আইএ ভর্তি হই – কয়েক মাস কলেজে যাওয়া-আসা করে আমরা ক্ষান্ত দিই ও ফুলবাড়িয়া বাজারে আমি আর পরেশ যথাক্রমে রাইস মিল ও সিনেমা হলের ম্যানেজারির কাজ নিই। সয়ফুল স্কুল পাশ দেওয়ার চেষ্টা বাদ দিয়ে নানাধরনের ধান্ধা-ফিকিরের চেষ্টা করে অবিরাম ব্যর্থ হলেও কথায় খই ফোটা তার বন্ধ হয় না – ‘খাড়স্ না। কয়টা দিন যাক। দ্যাখ না কী করি!’

ছোটবেলায় বুঝি নাই, ছোটখাটো গড়নের শক্তপোক্ত সয়ফুল মানসিকভাবে একসময় আস্ত ডাকাত হয়ে যাবে; ওর বাবা বদিউল মাঝারি কৃষক – সয়ফুলের যখন আঠারো-উনিশ বছর বয়স, তার বাবা চার সন্তান আর স্ত্রী রেখে শ্রমিক হিসেবে ওমান যান। সেখানে বছরদুয়েক পরে এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন, তারপর থেকে পরিবারের জ্যেষ্ঠ হিসেবে সয়ফুলই গার্জিয়ান, পেঁয়াজ-রসুনের এক খুচরা দোকান দেয় বাদিহাটি বাজারে, আর খ-কালীন আরফান মুন্সীর বিভিন্ন কর্মকা–র অন্যতম সহযোগী হয়ে ওঠে।

‘সুজা দৌড় দিয়া পুবদিকের ডোবার পাশে আন্ধারে হান্দাই। ল।’ – সয়ফুল আচমকা আমাদের বলে; আর পূর্ব পাশের বটগাছের কিছু আগে ছোট ডোবার মতো জলাধার অভিমুখী গাঢ় অন্ধকারের দিকে ছুটে যায়; আমরাও বিন্দুমাত্র দেরি না করে সয়ফুলের পিছু দমবন্ধ দৌড় দিয়ে পরিত্যক্ত জলাভূমির পাশে লতাগুল্মের ভেতর নিজেদের সেঁধিয়ে হাতে ধরা পেট্রলের গ্যালন সন্তর্পণে এমন দূরত্বে রাখি, প্রয়োজনে যাতে দ্রুত টেনে নেওয়া যায়।

‘শব্দ করিস না। মটকা মাইরা পইড়া থাক। বুইঝা লই। কী হইতেছে!’ সয়ফুল বলে।

সম্ভবত ডাকাত-মানসিকতার বলেই বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে সয়ফুলের মাথা ঠান্ডা থাকে। আমার রীতিমতো উলটা হয়, পেটের ভেতর গুড়গুড় করে, বমি বমি বোধ হয়; আমি সত্যিকারের ভীতু মানুষ, পরেশের আরো বেশি কাহিল অবস্থা। সে আমার চেয়েও নিরীহ ও ভীতু। ওর বাবা সুশীল পাল পলাশীহাটা স্কুলের উচ্চমান সহকারী ছিলেন – ছোট সাদা চুলে ভারী চশমা, আমুদে মানুষ ছিলেন তিনি। আমরা যখন আট-নয় বছরের, মনে আছে – সুশীল কাকাদের বাড়ি মানেই থইথই মানুষে ভরা এক দারুণ ব্যাপার; না, বৈভব যে বেশি ছিল – এমন নয়, তবে কাকারা কয়েক ভাই পাশাপাশি থাকতেন, বোনদের অবশ্য বিয়ে দিলেন কলকাতার দিকে, এরপর আমাদের চোখের সামনেই একের পর এক পরেশের কাকারা বানাড় নদী পেরিয়ে গারো পাহাড় – সেটা পেরিয়ে শিয়ালদার দিকে যাত্রা করলেন। তখন বুঝিনি, এখন বুঝতে পারি – বৈরী বাস্তবতা তাদের বাস্তুচ্যুত করে দেশান্তরি করেছে। পরেশকে আমি ঠিক বুঝতে পারি না; যতই হোক – নিজের জাতধর্ম বলে একটা বিষয় আছে বইকি; মাস-দেড়েক আগে – মিহির বসাকের বাড়িতে যখন আমরা অপারেশন করব বলে ঠিক করি; তখনো পরেশের বাবা জীবিত – আমার বড় খটকা লাগতে থাকে, কী করে সে পারবে আমাদের সঙ্গে মিলে হিন্দুর বাড়িতে আগুন দিতে? জমির লোভ যে দেখায় আরফান মুন্সী – হাহ্! পাগলেও তা বিশ্বাস করে! আর, জমির অংশ যদি আপাতত পরেশকে দেয়ও আরফান; দুদিন পরে হিন্দু হিন্দু রব তুলে পরেশকে নানা কায়দায় যে ঠিকই উচ্ছেদ করবে না – তখন!

‘আমার তো বাঁইচ্যা থাকতে হবে। বাপ-মারে নিয়া বাস্তুভিটা আঁকড়ায়াই বাঁচুম। আরফান মুন্সীর লগে মিশ্যা থাকলে অন্তত আমাগোর ইন্ডিয়াত যাওন লাগব না। … ধর্ম কি আমারে বাঁচাইতেছে! নাকি মানুষ বাঁচায় আমাগোরে! বাঁচায় টেকা-পয়সা, সম্পত্তি, রাজনীতি। আমি কিছু টেকা-পয়সা হাতে নিয়া পলিটিক্সে নামুম। টাইমমতো আরফান মুন্সীরে টেক্কা দিয়াম তহন! নিজের মাটিত দপদপায়া হাঁটুম!’ বাপরে, কথাবার্তা কম বললেও পরেশের মাথা পরিষ্কার, অনেকদূর চিন্তা করে; তবে খুব যে বাস্তবের সঙ্গে মিল আছে পরেশের চিন্তা-ভাবনার, তা মনে হয় না আমার – দশ মণ তেলও হবে না, রাধাকেও ইহজগতে পাওয়া যাবে না। তবে এটাও মনে হয় আমার, আমাদের মতো মানুষের আবার হিন্দু-মুসলিম কী? ছাল নাই তার বাঘা নাম! … হাতে লাখখানেক টাকা গুঁজে দিবা … বলবা কী করতে হবে! … সত্যিই  নগদ টাকা আমার দরকার, আমার অবশ্য পরেশের মতো পলিটিক্স করবার গভীর কোনো খায়েশ নাই। সয়ফুলও আমার মতো – নগদে কিছু পেলেই আপাতত হয়ে যায় তারও।

সয়ফুল আর আমার – দুজনেরই পরিবার প্রান্তিক – পরেশেরটা মধ্যবিত্ত বলা যায়; আউটবুক পড়া, গান-বাজনারও চল ছিল তাদের বাড়িতে। পরেশের মা পরমা কাকি যেমন সুন্দরী, পরেশের বড় বোন তৃষ্ণা আরো বেশি সুন্দরী। ভাবতে একটু লজ্জা লজ্জাই লাগে, কলেজে উঠবার পর – আমি আর সয়ফুল একসঙ্গে তৃষ্ণাদির প্রেমে পড়ি; কারণে-অকারণে পরেশের বাসায় যাই, আর তক্কে তক্কে থাকি – কখন তৃষ্ণাদি জল আর সন্দেশের থালাটি আমাদের দিকে স্মিত হাস্যে বাড়িয়ে দেবেন; শান্ত রাঙা হাত আর তারও চেয়ে বেশি শান্ত চোখ – দেবী প্রতিমার মতো পটে আঁকা মুখখানি; পরেশ-সয়ফুলকে না জানিয়ে মাঝে মাঝে গোপনে আমি তৃষ্ণাদির কাছে যাই, সরল মুখ করে বলি – ‘এইদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম… ’

তৃষ্ণাদির প্রতিক্রিয়া বোঝা যায় না, বসতে বলেন; সন্দেশ আর জলের গ্লাস এগিয়ে দেন, একদিন বলেন – ‘চুলগুলা এমন আউলাঝাউলা কইরা রাখো কেন জব্বার? আর এইটা বুঝি শার্ট? গলার কাছের দুইটা বোতাম নাই? … দাঁড়াও, তুমি পরেশের এই শার্টটা পরো কিছুক্ষণ, আমি তোমার জামার বোতাম লাগায় দেই।… ’

…‘বস্ … আমরা কী করুম? কী করুম? ধরা পড়লে আমরা আস্তা থাকতে পারুম?’ – অন্ধকার লতাগুল্মের ভেতরে বসে অস্ফুট স্বরে কথা বলে সয়ফুল, অন্তত আধঘণ্টার টানা চেষ্টায় সে নিজের মোবাইলে ধরতে পারে আরফান মুন্সীকে।

ওপাশ থেকে আরফান মুন্সী কী বলে আমরা পুরো বুঝতে না পারলেও এটুকু বুঝি যে, আমরা যেখানে যে-অবস্থায় আছি, আপাতত সেখানেই সে-অবস্থায় যেন ঘাপটি মেরে বসে থাকি, সেই পরামর্শই দেয় আরফান মুন্সী।

হিন্দুবাড়ি হিসেবে মিহির বসাকের বাড়িই ছিল আমাদের প্রথম অভিযানস্থল – সেটাও আরফান মুন্সীর পরিকল্পনায় হয়, তবে বড় মসৃণ ছিল ঘটনাটি – কোনো নিহত-আহত নাই, কারো গায়ে আঁচড়ও লাগে নাই, মাগরেবের আজানের পরপর মিহিরের ঘরে আস্তে করে পেট্রল ঢালি আমি আর পরেশ, ফস করে দিয়াশলাই জ্বালিয়ে দেয় সয়ফুল, তারপর তিনজনে মিলে ভোঁ-দৌড়; বাড়ির সকলে ছিল বৈঠকখানায় – লকলক করে আগুন বাড়তে থাকলে চিৎকার-চেঁচামেচি, আগুন আগুন রব … দশ মিনিটে বড় ঘর তো বটেই, এরপর বৈঠকখানাও শেষ; পরের সপ্তায় মিহিরবাবু বাদিহাটির পেছনের বানাড় গাঙপাড় হয়ে গারো পাহাড় পাড়ি দিয়ে বউ-বাচ্চা নিয়ে সোজা ইন্ডিয়ার উদ্দেশে দেশত্যাগ করে! কথা ছিল কাজটি করে প্রত্যেকে আমরা এক লাখ করে টাকা পাব, সঙ্গে পরেশ পাবে মিহিরের জমির অর্ধেক – দলিল বানানোর কাজে আরফান মুন্সী নিখুঁত – দলিলে চমৎকার দেখা যায়, মিহিরবাবু যাওয়ার আগে পরেশের কাছে অর্ধেক আর অর্ধেক আরফানের কাছে নগদ মূল্যে বেচে গেছে।

‘হিন্দুর কাছে হিন্দু বেচছে, এইটা কেউ অবিশ্বাস করবে না! এইতা কাজে সনাতন ধর্মের লোক রাখতে হবি। নইলে পুলিশি হুজ্জতে কিচ্ছু করতি পারবি নারে সয়ফুল!’ – আরফান মুন্সী আমাকে আর সয়ফুলকে বোঝায়, পরেশ থাকলে আমাদেরও সুবিধা, নিজের বুদ্ধিতে সেও এগিয়ে আসে আরফান মুন্সী আর আমাদের সঙ্গে – কাজের আগে পঞ্চাশ হাজার, কাজ শেষে আরো পঞ্চাশ হাজার করে পেলেও পরেশ প্রতিশ্রুত জমির ভাগ পায় না – আরফান তার মাথায় হাত বুলায়, ‘শোন্, ইউনিয়ন পরিষদই তো শ্যাষ কথা না। কেবল শুরুর কথা। উপজেলা আছে, এমপি সাব আছে। এত বড় ঘটনা … সবার চোখ হিন্দুর জমির দিকে। এরপর  সামন্তবাবুর জমির ভাগ তোরে ঠিক দিমো। তুইতো আমরার লোক। তুই আমরার কাছে হিন্দু না। আমরার মানুষ!’

মিহিরবাবুর জমির পরিমাণ ছিল সামান্য – দুই কাঠাও না; সামন্তবাবুরটা বড় আকারের – তিন বিঘার কাছাকাছি। কথা হয়, এইবার আমরা কাজ শেষ হলে প্রত্যেকে নগদ দুই লাখ করে টাকা পাব, পরেশ পাবে নগদ এক লাখ টাকা আর এক কাঠা জমি। জমির বাকিটা আরফান মুন্সী আর তার বড় নেতারা ভাগাভাগি করে নেবে; আমাদের দৌড় আরফান মুন্সী পর্যন্তই – তার নেতা কে বা তারও নেতা কারা – এইসব আমরা জানি না, জানতেও চাই নাই। দ্রুততম সময় আর পরিশ্রম ছাড়া অর্থ উপার্জনের সহজ রাস্তা চোখের সামনে ছিল এইটাই – হিন্দুবাড়িতে আগুন দেওয়া, আমরা তাই করতে এসে এখন ঘন অন্ধকারে পোকামাকড়-গু-মুতে ভরা এক ডোবার পাশে উবু হয়ে বসে আছি, কী করা যায়, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অপেক্ষায় আছি। সয়ফুলের ওপর রাগ হয় আমার! হারামজাদা! আরো আস্তে-ধীরে অপারেশনে নামা উচিত ছিল!

তৃষ্ণাদি আমাকে কয়েকবার বলেছে, ‘তুমি একটা আস্ত গাধা। তবে মানুষ ভালো। সয়ফুলের মতো শয়তান না। তবে যে কেউ তোমারে দিয়া যা খুশি করায়া নিতে পারবে।’

‘আমি কোন্ গাধামিটা করলাম? গাধা বলেন কেন?’ আমার কণ্ঠে উষ্মা, অপমানবোধ।

‘এই যে কথা নাই বার্তা নাই আমার পিছে ঘুরঘুর করো! কলেজ থিকা বাইর হয়া গেলা! কী করবা? কী খাইবা? … এইগুলা গাধামি না তো কী?’ আমি মন খারাপ করে চলে আসি, আবার কয়েকদিন পর যাই; তৃষ্ণাদিকে বলি – ‘এই পথ দিয়েই যাচ্ছিলাম… ’

রাগ করতে গিয়ে দিদি হেসে ফেলেন। অবশ্য তৃষ্ণাদির অনিন্দ্য হাসি দেখবার সৌভাগ্য বেশিদিন হয় নাই আর, কথা নাই বার্তা নাই, পরেশের বাবা সুশীল পাল কাকা দিদিরে কলকাতার উপকণ্ঠে পাঠিয়ে দিলেন, তার মাসির বাড়ি, সেখানে তার বিয়ে হবে। দিদির দেশত্যাগ পরেশকে আরো কোণঠাসা করে তোলে, যে-কোনো উপায়ে তাকে আমাদের সঙ্গে মিশে থাকতে হবে; বাস্তুভিটা সে ছাড়তে পারবে না।

‘আবার ফোন দে আরফান মুন্সীরে! হালারপুত পাইছে কী? দেখছোস মানুষ কেমনে জড়ো হইতাছে? … এহন হাঁইটাও যাইতে পারুম না।’ পরেশ বলে সয়ফুলকে, সম্বিৎ ফিরে পেয়ে দেখি – সুশান্তবাবুর বাড়ি ঘিরে ফেলেছে লোকজন। এরা কারা?

‘পলিটিক্স করে। সব দলের লোকই আছে। … এরা এইখানে ক্যান!’ এবার সয়ফুলের কণ্ঠে ঘোর অবিশ্বাস আর সন্দেহ।

‘ধর, ধর …’ বলে কয়েকজন ষণ্ডামার্কা যুবক দেখি দৌড়ে যায় সামন্তবাবুর ঘরের দিকে, মুহূর্তের মধ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে আরফান মুন্সী – ‘এই থামো। আমি আব্বাসভাইর সঙ্গে কথা বলছি। এইখানে কোনো ঘটনা ঘটবে না!’

‘আপনেরাই ঠিক করবেন – ঘটনা ঘটবে বা ঘটবে না?’ দূর থেকে বুঝতে পারি, ফুলবাড়িয়া কলেজের ছাত্রসংগঠনের নেতা আক্কাছ তরফদার চিৎকার করে বলে।

‘আব্বাসভাই তোমাদের নেতা। তার সঙ্গে কথা হইছে আমার। তিনি বলছেন, তিনি বুঝবেন তোমাদের ব্যাপার।’

‘সে মোমেনসিং কি ঢাকার রাজনীতি করে। এইটা এলাকার ব্যাপার। রমজানভাই ঠিক করবেন, আমি ঠিক করব – এখানে কী হবে না হবে!’

সুশান্তবাবুর উঠানে যখন আব্বাস আলী, রমজান ব্যাপারি আর আরফান মুন্সীর কর্তৃত্ব নিয়ে বচসা শুরু হয় – আমাদের ইশারা দেয় সয়ফুল, আমরাও বুঝতে পারি – চোখের পলকে এঁদো ডোবা থেকে আমরা একত্রে তিনজন হইহই করে দৌড়াতে দৌড়াতে উঠানে এসে উপস্থিত হই – ‘হইছে কী? হইছে কী? এইখানে ঘটনাটা কী?’ – আমরা একযোগে চিৎকার করতে করতে ভিড়ের মধ্যে মিশে যেতে চাই।

‘এই যে … এই যে …।’ – সয়ফুলকে চারপাশ দিয়ে তিন-চারজন ঘিরে ধরে, ছাত্রসংগঠনের নেতাটি – আক্কাছ সয়ফুলের কলার ধরে, আমাকে আর পরেশকে জাপটে ধরে আরো কয়েকজন – ‘এই তিন হারামজাদা একসঙ্গে! মিহিরবাবুর বাড়ির ঘটনাতেও এরাই আছিল। আইজ আমরা না আসলে একই কাজ হইতো! … ’

রাত গভীর হয়ে আসে। আমাদের তিনজনকে হাতমোড়া বেঁধে পলাশীহাটা স্কুলের মাঠের একপ্রান্তে বসানো হয়। আক্কাছ, আরফান মুন্সীর সঙ্গে আব্বাস মিয়াসহ এলাকার বয়স্ক মুরব্বিরা এসে যুক্ত হন। আব্বাস মিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান। মজলিশে উপস্থিত আছেন সামন্তবাবুও।  সামন্তবাবুর মুখে কথা নাই, ঘটনার আকস্মিকতায় সে বিমূঢ়, স্তব্ধ; কেবল মাঝে মাঝে তার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল ঝরে পড়ে, আর অস্ফুট কান্নাজড়িত কণ্ঠ শোনা যায় তার – ‘এইডা আমরার সাতপুরুষের বাস্তুভিটা। আমরারে আগুন দিয়া খেদাইবো! ইটা কেমুন কথা!’

‘ঘটনাটা খুইলা ক’ সয়ফুল। সত্য কথা বললে তোদের শাস্তি হবে না। নইলে পিটাইয়া হাড্ডি ভাংগি দিমু।’ – আক্কাছ চিৎকার করতে থাকে।

‘কী আর ঘটনা … লোকজন দেইখা আমরাও আগাইছি। ব্যাপার আর কিছু না! আমরা কী করলাম?’ সয়ফুল তার কথায় অনড় থাকে, একই কথা বলি আমরাও।

ঠিক সেই মুহূর্তে আরফান মুন্সী যা বলে, তাতে আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে, ‘আক্কাছের কাছে খবর আছে, তোরা তিনজনে মিহিরের ঘরে আগুন দিছস। মিহির দ্যাশ ছাড়ছে। এহন লাগছোস সামন্তবাবুর বাস্তুভিটার পেছনে … !’ কথা শেষ করে না আরফান, বলতে থাকে – ‘এরা এতোই বজ্জাত, বড় কারু নাম লাগায় দেবে! কে জানে, এখন বইলে বসবে – আমিই তাগোরে কইছি, সামন্তর ঘরে আগুন লাগানোর জইন্যে!’

হায় হায় করতে করতে বলে আরফান, ‘ছোটবেলা থিকা এই শিখলাম আমরা? এই শিখলি তোরা? হিন্দু-মুসলিম একপাকে খাইলাম, এই সামন্তর বাবারে আমি নিজে কাকাবাবু ডাকছি। কত খাইছি তাগোর বাড়িত! নিজের বাপ-কাকার মতো দেখছি। সামন্তরে ভাই বলে জানি। একলগে উঠবস করলাম সারাজীবন! এখন কারা তোদের এইসব বুদ্ধি দেয়। ছি!’

দ্রুত নেতারা একমত হন, এলাকায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্যে একত্রে কাজ করতে হবে; যুবকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে; প্রতিটি হিন্দুবাড়িকে আলাদা নিরাপত্তা দেওয়ার আশ্বাস দেন উপজেলা চেয়ারম্যান আব্বাস মিয়া।

 

 

ঘটনার ঠিক একমাস পর আমাদের তিনজনকে ডেকে পাঠায় আরফান মুন্সী। তার কন্ট্রাকটরি ব্যবসার আপিসকক্ষে; আমরা  তিনজন – সয়ফুল, আমি আর পরেশ যাই তার কাছে, দেখি – আরফান সাহেবের পাশে বসে আছে আক্কাছ আর টিটু সাহেব – ছাত্রনেতা আক্কাছ আর সামন্তবাবুর বড় ঘরে সেই রাতে আরফান মুন্সীর সঙ্গে গোলযোগের সূচনাকারী, ব্যবসায়িক পার্টনার তোজাম্মেল হক টিটু – তিনজনেরই হাসিমুখ।

‘শুনলাম। তোমরা খুব কাজের ছেলে। … কাজটা সেইবার অর্ধেকে থামাইতে হইছিল।’ বলতে বলতে হাসে আক্কাছ – ‘ভাই, একলাই খাইতে চাইছিল পুরাটা। এইবার আমরা আছি সঙ্গে। তোমরাও ঠিক ঠিক সব পাবা। … কাজটা যে সমাধা করতে হয়।’

আমরা বুঝি না, কোন কাজ? কী করতে হবে আমাদের?

‘আরে … বুঝো না ক্যানো সোনার ছাওয়ালেরা? আগুন … আগুন দিতে হবে … সামন্তবাবুর বাড়িতে। লেট দেয়ার বি লাইট। হিহিহি! বাবুরে উচ্ছেদ হইতে হবে আলটিমেটলি … এইটাই রিয়ালিটি … ’ আক্কাছ হাসতে হাসতে বলে, ‘এইবার আর মাঝপথে কাজ বন্ধ হবে না। আমাদের মিল হয়া গেছে। আব্বাসভাইও আছে আমরার লগে।’

আরফান মুন্সী হাসিমুখে সম্মতি দেয় – ‘মিসটেক হয়া গেছিল। আপনাদের মতো লেখাপড়া তো আর জানি না ভাই!’

আক্কাছ বলে, ‘যা জানেন, তাতে তো আমার আক্কেলগুড়ুম হয়া গেল! গতবার টিটুভাই আপনেরে খপ কইরা না ধরলে তো সুশান্তবাবুর পুরাটা একলাই খাইতেন! … দলে একটা হিন্দুরেও রাখছেন। পরেশ পাল … আরফানভাই, আপনে পারেনও …। আপনি একটা মাল।’ হাহা করে হাসে আক্কাছ।

‘ভাই একটু বেশিই চালাক। আমারেও ভাগ না দেওয়ার পাঁয়তারা করছিল! তাই বাদ সাধছিলাম। একলা খাইবার দিমু না, যতই আপনে আমার ব্যবসার পার্টনার হন। এতো বড় বাস্তুভিটা! হে-হে-হে … কিসসু পামু না! হয়?’ – হে-হে-হে … ’ বিকট স্বরে হাসে টিটু সাহেব, ভারী শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে।

আক্কাছ, আরমান মুন্সী আর টিটু সাহেব – প্রত্যেকে আমাদের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে যার যার মতো হাসি-তামাশা করতেই থাকে। আমাদের মনে হয়, এদের তিনজনের হাসির শব্দ আর ভঙ্গিমায় কোথায় যেন মিল আছে! মিলটা কোথায়, বুঝতে না পেরে বোকার মতো আমরা তাদের তেলতেলে হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। কোথায় এদের মিল? কোথায়?

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত